বাংলাদেশীদের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 14, 2021
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ব্যর্থতাটি ভয়ানক
বাংলাদেশীদের ব্যর্থতার তালিকাটি বিশাল। অতি ভয়নাকও। সেটি মূলত সভ্য রূপে বেড়ে উঠায়। কবি রবী্ন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে বাঙালীর সে ব্যর্থতাটি হলো মানুষ রূপে বেড়ে উঠায়। তাই মনের ক্ষেদে বিধাতার কাছে প্রশ্ন রেখে রবী্ন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সাত কোটি প্রাণীরে রেখেছো বাঙালী করে, মানুষ করোনি।” তবে বাঙালী কেন মানুষ হতে ব্যর্থ হলো -তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তেমন কিছুই লেখেননি। তবে বাঙালীর এ ব্যর্থতা নিয়ে যখন তিনি লিখেছিলেন –সে স্তর থেকে বাঙালী বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙালীগণ বহু নীচে নেমেছে। যেমন, দূর্নীতিতে বাংলাদেশ পর পর ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়েছে। বিশ্বের প্রায় দুই শত দেশের মধ্যে দূর্নীতিতে ৫ বার হওয়ার অসভ্য কর্মটি একমাত্র বাংলাদেশী বাঙালীদের। অন্য কোন দেশ এর ধারে কাছে নাই। মানবতার মানদন্ডে বিশ্বমাঝে বাঙালীর অবস্থা যে কতটা তলানীতে -এ হলো তার প্রমাণ।
এই বাংলাদেশেই ১৯৭১’য়ে লক্ষাধিক অবাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ধর্ষণ করা হয়েছে হাজার হাজার অবাঙালী নারীদের। দখল করে নেয়া হয়েছে অবাঙালীদের বহু লক্ষ ঘরবাড়ী ও দোকানপাট। বাঙালীর সমগ্র ইতিহাসে এ বঙ্গভুমিতে এতো বড় অসভ্য কর্ম পূর্বে কখনোই হয়নি। তবে চোর-ডাকাত ও ধর্ষকদের নিজেদের কুকর্ম নিয়ে কোন রূপ অনুশোচনা থাকে না। তারা বরং সে কুকর্ম নিয়ে গর্ব করে। তাই বাঙালীর ইতিহাসে একাত্তরের অপকর্ম নিয়ে কোন আলোচনা নাই। তবে বাঙালী নীচে নামা এখনো শেষ হয়নি। ২০১৮ সালে নির্বাচনের নামে যেরূপ ভোটডাকাতি হলো সে ইতিহাসও সমগ্র বিশ্বমাঝে একমাত্র বাংলাদেশীদের। সুষ্ঠ নির্বাচন কোন রকেটি সায়েন্স নয়, নেপাল, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশেই সেটি হয়। বাংলাদেশীদের সে সামর্থ্যও নাই। কারণ, ভোটডাকাতির সংস্কৃতি ও নিরেপক্ষ নির্বাচনের সংস্কৃতির এক সাথে চলে না। সে জন্য মানবিক গুণে বেড়ে উঠাটি জরুরি।
অসভ্য সমাজে কাউকে সন্মান দেয়াটি রীতি নয়। তখন রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পায় “জোর যার মুল্লুক তার” -এ রূপ পশু সমাজের এ সংস্কৃতি। ফলে যার হাতে থাকে শক্তি, তার থাকে ইচ্ছা মত অন্যের থেকে যাচ্ছে তাই কেড়ে নেয়ার অধিকার। শক্তি না থাকলে সে পশু সংস্কৃতির দেশে প্রাণে বাঁচার অধিকারও থাকে না। জঙ্গলে আদালত থাকে না, অসভ্য সমাজেও তেমনি আইনের শাসন থাকে না। আদালতের বিচারকগণ পরিণত হয় দুর্বৃ্ত্ত সরকারের চাকর-বাকরে। সরকার যাকে হত্যা করতে চায় তাকে ফাঁসিতে ঝুলানোই তাদের কাজে পরিণত হয়্। এমন এক জংলী সংস্কৃতির কারণেই বাংলাদেশে মানুষ হারিয়েছে ভোটের অধিকার, এবং মতপ্রকাশ ও সভাসমিতির করার অধিকার্। জোয়ার আনা হয়েছে চুরি-ডাকাতি, গুম,খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের।
ডাকাত দলে যে ক্ষেত্রটিতে মড়ক লাগে সেটি হলো ডাকাতদের বিবেক বোধে। সে মরা বিবেকের কারণে তাদের মাঝে বিলুপ্ত হয়, অসভ্য ও অন্যায় কর্মকে ঘৃনা করার সামর্থ্য। বরং অন্যায় ও অসভ্য কর্মের নায়কগণ তাদের কাছে গণ্য হয় হিরো রূপে। পশু যে পশু –সে হুশ পশুর থাকে না। কারণ সে হুশ থাকার জন্য সমৃদ্ধ মানবিক বিবেক লাগে। তেমনি দুর্বৃত্তগণও নিজেদের দুর্বৃত্ত রূপে ভাবে না। বরং নিজেদেরকে তারা অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ভাবে। তাই তাদের রচিত ইতিহাসে যারা গণহত্যা, গণতন্ত্র-হত্যা ও ভোট-ডাকাতি করে এবং কেড়ে নেয় জনগণের মৌলিক মানবিধ অধিকার -তারা চিত্রিত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে। তারা জাতির পিতা, জাতির বন্ধূ, দেশের নেত্রীর খেতাবও পায়।
অবমূল্যায়নটি খোদ মানবের
বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণ অনেক। তবে অন্যতম কারণ হলো, আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মানুষকে দেশটিতে যথার্থ ভাবে মূল্যায়নই করা হয়নি, বরং তাদের তুচ্ছ জ্ঞান করা হয়েছে। অন্য আর দশটি জীবের ন্যায় মানব শিশুও স্রেফ একটি জীব রূপে গণ্য হয়েছে। এমনকি সকল সমস্যার মূল কারণ রূপে দেশের জনসংখ্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন ভ্রান্ত চেতনার কারণে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়েছে জনসম্পদের উন্নয়ন্। ফলে মূল্য হারিয়েছে মানব সন্তান; এবং তাতে অবহেলিত হয়েছে মানব সন্তানের উন্নয়ন। এতে গুরুত্ব হারিয়েছে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন। অথচ মানুষকে এরূপ তুচ্ছ ভাবা শুধু গোনাহই নয়, বড় রকমের কবিরা গুনাহ। অপরাধটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করার। এমন চেতনার কারণে পণ্য সম্পদ পাচারের ন্যায় মানব-রপ্তানী এবং মেধা-পাচারও তুচ্ছ মনে হয়েছে।
মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানব। সোনা-রোপা, তেল-গ্যাস নয়্। অথচ তাকে পোষাক, চা-পাট বা হিমায়ীত মাছের ন্যায় বিক্রয়যোগ্য পণ্য রূপে অতি সস্তা মূলে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এবং মনে করা হয় এতেই বৈদেশিক মূদ্রা প্রাপ্তি ঘটবে এবং দেশও সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকেই এরূপ মানব-রপ্তানি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে বিপুল ভাবে বেড়েছে মেধা পাচার। যারা অপেক্ষাকৃত যোগ্যবান ও প্রতিভাবান -তারা এভাবেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। ফল দেশে জনসংখ্যা বাড়লেও কমছে মেধাবী ও দক্ষ মানুষের সংখ্যা। অথচ উন্নত দেশগুলো বিদেশ থেকে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদই সংগ্রহ করে না, সংগ্রহ করে মেধাসম্পদও।
উন্নত রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চরিত্রবান মানুষ। ইট ছাড়া যেমন বিল্ডিং গড়া যায় না, তেমনি উন্নত চরিত্রের মানুষ ছাড়া জাতি গঠনের কাজও হয় না। আর এজন্য অপরিহার্য হলো মানুষের আত্মীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন। বুদ্ধিবৃত্তিক এ উন্নয়নের ফলেই ব্যক্তির জীবনে গড়ে উঠে উন্নত চেতনা। সে চেতনা থেকেই পরিবর্তন আসে ব্যক্তির বিশ্বাস, আচরণ ও কর্মে। দুর্বৃত্তের জীবন থেকে চরিত্রবানের যে বিপুল চরিত্রগত পার্থক সেটির মূল কারণ এ বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন বা পরিশুদ্ধি। আর চেতনার পরিশুদ্ধি ও বিপ্লবে সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদানটি হলো পবিত্র কোর’আনের জ্ঞান। আরবের আরবগণ এ কোর’আনী জ্ঞানের বলেই ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর পর্যায়ে উঠতে পেরেছিলেন।
মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে দিয়েছেন যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ মগজ তথা হার্ডডিস্ক, তেমনি দিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ সফ্টওয়ারও। মানব মগজকে বিস্ময়কর ক্ষমতা দেয় যে শক্তিশালী সফ্টওয়ার -সেটি হলো পবিত্র কোর’আন। এটি মানুষের মগজকে দেয় বিস্ময়কর বিবেকবোধ, মানবতাবোধ ও আবিস্কারের ক্ষমতা। কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না, প্রয়োজন পড়ে উপযোগী সফ্টওয়ারের। তেমনি সফ্টওয়ার ছাড়া মানুষের মগজের সামর্থ্যও অতি সীমিত। যখন হার্ডডিস্ক ও সফ্টওয়ার একত্রে কাজ করে তখন বিস্ময়কর হয় তার কর্ম। অথচ সে সফট ওয়ারের অভাবে মানব প্রচন্ড ভাবে ব্যর্থ হয় ন্যায-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, শ্লিল-অশ্লিল এবং ধর্ম-অধর্মের বাছবিচারের ন্যায় সহজ বিষয়েও। মুর্তিপূজা শাপ-শকুন পূজা বা সংস্কৃতির নামে অশ্লিল-উলঙ্গতার যে প্রসার -সেটি তো মানব মগজে সে সফট ওয়ারটি না থাকার কারণেই।
উপেক্ষিত পবিত্র কোর’আন
মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দানটি হলো পবিত্র কোর’আন। অথচ সেটি্ই বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত। পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের কবিতা যতটা গুরুত্ব দিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো তার শত ভাগের এক ভাগ গুরুত্ব দিয়েও পবিত্র কোর’আন পড়ানো হয় না। অথচ মুসলিম সন্তানের জন্য রবিন্দ্র-সাহিত্য পাঠ ফরজ নয়, বরং ফরজ হলো কোর’আন বুঝা ও তা থেকে জ্ঞানলাভ করা। এ কোর’আনের কারণেই অতীতে অতি পশ্চাতপদ আরব জনগোষ্টি ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন। মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে আর কোন সময়ই কোন জাতি মানব জীবনে এতো বিস্ময়কর মানবিক মূল্য সংযোজন করতে পারিনি। ফলে যারা এক সময় অপরের সম্পদ লুন্ঠনে পথে পথে দস্যুবৃত্তি করতো, নিজেদের কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফন করতো, মানব সন্তানদের হাটে তুলে বেচাকেনা করতো –তাদেরকে দেখা গেছে অন্যের জীবন বাঁচাতে প্রাণ দিতে। খলিফাকে দেখা গেছে আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে গরীবের ঘরে পৌঁছে দিতে। চাকরকে উটের পিঠে চড়িয়ে বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের শাসককে দেখা গেছে উঠের সামনে রশি টানতে। মানব জাতির সমগ্র ইতিহাসে একটি বারের জন্যও কি এমনটি ঘটেছে? মুসলিমগণ মহা মানব রূপে বেড়ে উঠার এরূপ বিস্ময়কর সামর্থ্য পেয়েছিল পবিত্র কোরআনের জ্ঞানে আলোকিত বিবেক থেকে। আর গণতন্ত্রের চর্চা? শাসকের পুত্র শাসক হবে -সে রাজতান্ত্রিক প্রথাকে তাঁরা আজ থেকে ১৪ শত বছর পূর্বেই বিদায় দিয়েছিলেন। তাঁরা সেদিন সবচেয়ে যোগ্যবান ব্যক্তিকে শাসক রূপে নির্বাচিত করেছেন পারস্পারিক পরামর্শের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন সেদিন এতো বিশাল ভাবে হয়েছিল যে, খলিফার সামনে তারা তরবারি তুলে বলতেন, “হে আমিরুল মোমিনুন কোর’আন ও রাসূলের সূন্নাহ অনুযায়ী শাসনকাজ না চালালে এ তরবারি দিয়ে আপনাকে দুই টুকরা করে ফেলবো।”
হচ্ছে না মূল্য-সংযোজন
দেশের জিডিপি’তে হিসাব হয় সেদেশের কলকারখানায় বা ক্ষেতেখামারে পণ্যের উপর কতটা মূল্য সংযোজন হলো সেটি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এটিই মাপকাঠি। কিন্তু প্রতিটি মানব শিশুর উপর কতটুকু মূল্য-সংযোজন হলো -সভ্যতার নির্মানে বা মানবতার অগ্রগতিতে সেটিই মূল। সেটি হয় শিক্ষাদীক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিচর্যার মাধ্যমে। এবং সে কাজ শুধু বিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ রাখলে চলে না, ছড়িয়ে দিতে হয় প্রতিটি গৃহ, গ্রাম ও সংগঠনে। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটি যথাযত হয়নি। দেশের প্রায় অর্ধেক শিশুর জীবনে কোন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানই সংযোজিত হয়নি। ফলে তাদের জীবনে হয়নি কোন মূল্য সংযোজন। বহু কোটি শিশু বেড়ে উঠছে কিছু না শিখে বা না জেনে। অর্থাৎ নিজ জীবনে মূল্য না বাড়িয়েই তারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। আমরা পাটকে কার্পেট বা মাছকে হিমায়িত মাছে পরিণত করা নিয়ে যতটা ব্যস্ত, সে ব্যস্ততা মানব শিশুকে সৃষ্টিশীল মানব রূপে গড়া নিয়ে নাই। অথচ ইসলামে শেখা ও শেখানো -এ দুটি কাজটি ফরয। দেশের নগর-বন্দরে আজ যে সন্ত্রাসীদের তান্ডব -সেটি কি এই অবহেলার কারণে নয়? সুস্থ্য মানব রূপে বেড়ে উঠার পরিবেশ না পেলে চোর-ডাকাত, খুনী, ধর্ষক হবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
তাছাড়া চা-পাট, সোনা-রোপা বা তেল-গ্যাসের কতই বা উন্নয়ন করা যায়। এবং কত বা তার মূল্য বাড়ানো যায়? অথচ ব্যক্তিকে সৃষ্টিশীল করা যায় অবিশ্বাস্য ভাবে। বাংলাদেশের সমুদয় রপ্তানী মূল্যের চেয়ে বহুগুণ অধিক সম্পদের মালিক মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী বিল গেটস। এবং সেটি সম্ভব হয়েছে তাঁর বিজ্ঞানীসুলভ সৃষ্টিশীল যোগ্যতার কারণে। জাতি হিসাবে তারাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়, যারা এভাবে মূল্য সংযোজন করে প্রতিটি নাগরিকের জীবনে। জাপান বা সিঙ্গাপুরের ন্যায় সম্পদশালী দেশগুলো সম্পদ বাড়িয়েছে এভাবে মানবসম্পদে উন্নয়ন ঘটিয়ে, প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে নয়। কিন্তু বাংলাদেশে একাজটিকে যথাযত গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এদেশে জন্ম নেওয়া বহু বিলগেটসের জীবনের আমরা একটি ডলারও ব্যয় করিনি। মেধার পরিচর্যাও করিনি। ফলে কোন ফল না দিয়ে তারা হারিয়ে গেছে। অথচ শিক্ষাদানের এ কাজটি কোন আনবিক প্রযুক্তিগত বিষয় নয় যে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আনুবিক রিয়াক্টর কিনতে হবে। টিনের ঘরে বা মসজিদের মেঝেতেও সেটি সম্ভব। শুধু প্রয়োজন, নিবেদিত প্রাণ কিছু শিক্ষক, বই পুস্তক ও সরকারের ঐকান্তিক নিষ্ঠা। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলিরই প্রচন্ড অভাব। দেশের ১৭ কোটি মানুষ কয়েক লাখ ভাল শিক্ষকও গড়ে তুলতে পারিনি। লিখতে ও ছাপাতে পারিনি পর্যাপ্ত সংখ্যক ভাল বই। ফলে বাংলাদেশে শিক্ষার নামে যতটা সার্টিফিকেট বিতরণ হয়েছে জ্ঞানবিতরণ ততটা হয়নি। অথচ জাপান বাংলাদেশের চেয়ে কম সংখ্যক গ্রাজুয়েট নিয়ে শিল্প বিপ্লব শুরু করেছিল। অপর দিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরই শুরু হয়েছিল বিনা পরীক্ষায় পাশের হিড়িক। শুরু হয়েছিল অবাধ নকল। এমন কি বিসিএস ক্যাডারের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ পদেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কোনরূপ পরীক্ষা না নিয়ে। পাকিস্তান আমলেও কিছু ভাল স্কুল থানা পর্যায়ে ছিল। বিলুপ্ত করা হয়েছে সেগুলোও।
দৈন্যতা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদে
জাতি শুধু পানাহারে বেড়ে উঠে না। দেহের পুষ্টির সাথে চাই মনের পুষ্টি। মনের পুষ্টি জোগাতে প্রয়োজন পর্যপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। সভ্যতার নির্মানে তাই শুধু চাষাবাদ বাড়ালে চলে না। অয়োজনে বাড়াতে হয় দেশের বই পুস্তক ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে। অথচ বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের দৈন্যতাটি বিশাল। দেশটিতে বাংলা ভাষা নিয়ে যতটা গর্ব করা হয়, এ ভাষাকে ততটা সমৃদ্ধ করেনি। খাদ্যের ভান্ডারে শূণ্যতা রেখে কি দেহে পুষ্টি জোগানো যায়? তেমনি ভাষার ভান্ডারে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা রেখে কি চেতনায় সমৃদ্ধি আনা যায়? কিছু কবিতা, উপন্যাস, নাটক বা ছড়ার বইয়ের পাতায় বুদ্ধিবৃত্তির কাজ সীমিত হলে কি বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধি আসে? অথচ বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেটিই বাস্তবতা। দর্শন, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, বিদেশী ভাষাশিক্ষা, বিভিন্ন ভাষার ডিকশোনারি, আইন, তফসির, ফিকাহ ও বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে এখনো পর্যাপ্ত পুস্তক লেখা হয়নি। ফলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া চলছে অনেকটাই দায়সারা ভাবে।
উদাহরণ স্বরূপ, বিলেতের বা যে কোন উন্নত দেশের স্কুলের শিশুদেরকেও প্রচুর বই পড়তে হয়। হোম ওয়ার্ক বা প্রজেক্ট ওয়ার্ক করতে তাদেরকে লাইব্রেরি ও ইন্টারনেট সার্চ করতে হয়। যে বইয়ে জ্ঞানের কথা, সেটিই ক্লাসের পাঠ্য বই। অথচ নির্বাচিত পাঠ্য বইয়ের বাইরে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ তেমন পাঠ্য বই পায় না। এক কোটি মানুষের দেশ গ্রীসে প্রতি বছর যে পরিমান বই লেখা হয় বা ৭০ লাখ মানুষের শহর লন্ডনে যত পত্রিকা বের হয়, ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে সে পরিমান প্রকাশনাও নেই। ফলে ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ বাড়ছে সীমাহীন বুদ্ধিবৃত্তিক অপুষ্টি নিয়ে। অথচ জ্ঞানচর্চা ইসলামে ফরয। ফরয জ্ঞানের প্রচারও। গৌরব যুগে মুসলিম শাসকগণ রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন জ্ঞান চর্চা বাড়াতে। বলা হয়ে থাকে, একখানি মূল্যবান বই লিখলে বা তরর্জমা করলে বইয়ের ওজনে লেখককে তখন স্বর্ণ মুদ্রা দেওয়া হতো সরকারি তহবিল থেকে। তখন শহরে শহরে মসজিদের পাশাপাশি বিশাল বিশাল গ্রন্থ্যশালা নির্মিত হতো। লাইব্রেরিতে বসে জ্ঞানচর্চাকেও তখন ইবাদত মনে করা হতো। ফলে তখন সমৃদ্ধি আসতো চেতনায়, এবং গড়ে উঠতো জ্ঞনবান ও চরিত্রবান মানুষ। সেকালে বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমগণ প্রতিষ্টা পেয়েছিল শুধু নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত পালনের কারণে নয়, বরং নানাবিধ জ্ঞানের ভুবনে বিচরনের কারনে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন একটি প্রক্রিয়া গড়েই তোলা হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তি ও সৃষ্টিশীলতা বাড়েনি এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের মাঝেও। বরং দেশের অধিকাংশ প্রফেসর দুনিয়া থেকে বিদায় নেন কোনরূপ গবেষণা প্রবন্ধ বা গ্রন্থ্য রচনা না করেই।
কবিরা গুনাহর রাজনীতি
পবিত্র কোর’আন পথ দেখায়। সে পথটি দেয় যেমন ইহকালীন শান্তি ও সমৃদ্ধি, তেমনি পরকালে দেয় জান্নাত। অথচ সে কোর’আনী রোডম্যাপ বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিতই শুধু নয়, বরং এর প্রতি দেখানো হয় সীমাহীন তাচ্ছিল্য। অথচ পথচলার এটিই হলো সমগ্র মানব ইতিহাসে একমাত্র নির্ভূল রোডম্যাপ। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত এটিকে বাদ দিয়ে কি জীবনের পথ চলা বা রাষ্ট্র পরিচালনা সঠিক ভাবে হয় -সেটি বিশ্বাস করাও কবিরা গোনাহ। কারণ এতে চরম অবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া কোর’আনী বিধানের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে সে কবিরা গুনাহর রাজনীতিই বেশী বেশী হচ্ছে। এ্টি যেমন চরম ঔদ্ধত্য, তেমনি বিদ্রোহ। পরিতাপের বিষয় হলো, সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে সে বিদ্রোহই হলো রীতি। বাংলাদেশের ব্যর্থতার বড় কারণ হলো এটি।
বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য পবিত্র কোর’আনের জ্ঞানার্জনকে দেশের প্রতিটি সরকারই অপ্রয়োজনীয় মনে করেছে। কোন কোন সরকার দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে বাধা রূপে। মহান আল্লাহপাকের সর্বশ্রেষ্ঠ এ নেয়ামতের প্রতি এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে? শুধু তাই নয়, সাম্প্রদায়ীক বলে সীমিত, সংকুচিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে পবিত্র কোর’আনের জ্ঞানার্জনকে। পাঠ্য পুস্তক থেক বাদ দেয়া হয়েছে ইসলামী চেতনা সমৃদ্ধ করতে পারে এমন সব প্রবন্ধ ও কবিতা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইসলামের প্রতিষ্ঠা বাড়াতে পারে এমন সব ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোকে। এবং উন্নতির জন্য অপরিহার্য মনে করা হয়েছে সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও জাতীয়তাবাদের ন্যায় হারাম মতবাদগুলোকে। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশে পবিত্র কোর’আনের রোডম্যাপ এতটা উপেক্ষিত হবে এবং ইসলাম এতটা পরাজিত হবে -সেটি কি ভাবা যায়? অথচ এটিই হলো বাংলাদেশের বাস্তবতা। প্রশ্ন হলো, নিজ দেশে ইসলামের এরূপ পরাজয় বাড়িয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে কি পুরস্কার মিলবে? মিলবে কি কাফের ও মুনাফিকদের থেকে ভিন্নতর পরিচয়? রোজ হাশরের বিচার দিনে হিসাব দেয়ার আগে প্রতিটি বাংলাদেশীরই সে হিসাব নেয়া উচিত? ১ম সংস্করণ ১৫/০৪/২০০৫; ২য় সংস্করণ ১৪/০১/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018