অতীতের ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশের আজকের বিপর্যয়
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 27, 2021
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
আজকের বিপর্যয়
বাংলাদেশের আজকের বিপর্যয়টি যেমন গভীর, তেমনি ভয়ানক। দেশটিতে অসম্ভব হয়েছে সভ্য জীবন-যাপন। নৃশংস ফ্যাসিবাদ বলতে যা বুঝায় -প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তারই টেক্সটবুক ভার্শন। ক্ষমতাসীন দলের নাশকতায় মারা পড়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, কেড়ে নেয়া হয়েছে মৌলিক মানবাধিকার, কোমড় ভাঙ্গা হয়েছে বিরোধী দলগুলোর, বিলুপ্ত হয়েছে নিরপেক্ষ নির্বাচন, দলীয়করণের শিকার হয়েছে আদালত এবং প্লাবন এসেছে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, গুম, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের। তারা দখলে নিয়েছে রাজনীতিই শুধু নয়, দেশের বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া, প্রশাসন, পুলিশ -এমনকি সেনাবাহিনী তাদের আজ্ঞাবহ সেবাদাসে পরিণত হয়েছে। সরকারের যা ইচ্ছা তাই করার আজাদী রয়েছে। কিন্তু জনগণের অধিকার নাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিটিং, মিছিল ও প্রতিবাদের। দুর্বৃত্তদের হাতে শত শত কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। সেটিও যেন মামূলী বিষয়; প্রতিকার নাই।
রাজনীতির ময়দানে নিরংকুশ বিজয়টি ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টদের। তাদের কারণে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভারতীয় এজেন্ডা। বাংলাদেশ থেকে ভারতের চাওয়ার তালিকাটি বিশাল। ভারত চায়, নবীজী (সা:)’র ইসলাম –যাতে আছে ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়তের প্রয়োগ, জিহাদ, বিশ্বমুসলিম ভাতৃ্ত্ব, শুরা ভিত্তিক শাসন এবং একতা, তা পুরাপুরি বাংলাদেশের বিলুপ্ত হোক মুসলিম জনগণের চেতনা থেকে। ভারতের কাছে নবীজী (সা:)’র ইসলাম হলো মৌলবাদ এবং জিহাদ হলো সন্ত্রাস। ভারতের দাবী, বাংলাদেশের মুসলিমদের সরতে হবে ইসলাম থেকে। ইসলামের পক্ষ নেয়াটাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের ভারতেসেবী পক্ষটিও অবিকল সেটিই বলে। ভারত চায়, বাংলাদেশের মানুষ বাঁচুক মুর্তিনির্মাণ ও মুর্তির সামনে ভক্তি জানানোর হিন্দু সংস্কৃতি নিয়ে। ভারতের সে সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দিতেই রাস্তাঘাট পূর্ণ হচ্ছে মুর্তিতে –৮ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে কখনোই সেটি হয়নি। এমনকি হিন্দু শাসন আমলেও এতো মুর্তি গড়া হয়নি -যা আজ হচচ্ছে।
ভারত চায়, ভারতে মুসলিমগণ খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হলে বা সেদেশে মসজিদ ধ্বংস করা হলে বাংলাদেশ সরকারের কাজ হলো তা নিয়ে নীরব থাকা। এবং জনগণকে রাস্তায় ভারতবিরোধী প্রতিবাদ থেকে প্রতিহত করা। এবং ভারত চায়, বাংলাদেশের বানিজ্যিক বাজার ও শ্রম বাজার সম্পূর্ণ উম্মুক্ত হোক ভারতীয়দের জন্য। লক্ষণীয় হলো, ভারত যা কিছু চায় তা সবই দিয়েছে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার। ভারতকে অকাতরে দেয়া নিয়ে হাসিনার প্রচুর গর্বও। অতীতে একই ভাবে শেখ মুজিবও দিয়েছিল। কিন্তু ভারত থেকে পাওয়ার অংকটি ফাঁকা। পদ্মার নায্য পানি যেমন মিলছে না, মিলছে না তিস্তার পানিও।
অতীতের ব্যর্থতা
অতীতের ব্যর্থতাগুলো পরবর্তীতে ভয়ানক বিপর্যের কারণ হয়। এবং আজকের ব্যর্থতাগুলো বিপর্যয় সৃষ্টি করবে ভবিষ্যতে। প্রশ্ন হলো, কি সে অতীতের ব্যর্থতা? এবং আজকের ব্যর্থতাগুলোই কি? বাংলাদেশের কল্যাণ নিয়ে যারা ভাবে তা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়্ বাংলাদেশে আজ যে বিপর্যয় তার শিকড় রোপন করা হয়েছিল দেশটির জন্মের বহু আগেই। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোথায় সে ব্যর্থতা এবং কারা সে ব্যর্থতার নায়ক সেগুলো চিহ্নত করা। নইলে আজকের ব্যর্থতার কারণগুলো যেমন জানা যাবে না, তেমনি ভবিষ্যতের বিপর্যয় থেকেও মুক্তি মিলবে না।
বাংলাদেশের বর্তমান ব্যর্থতাগুলোর শিকড় বপন করা হয়েছে ২৩ বছরের পাকিস্তান আমলে। ঘটেছে ব্রিটিশ শাসনামলেও। সে ব্যর্থতার কারণ যেমন অপরাধী চক্রের রাজনীতি, তেমনি বুদ্ধিজীবী চক্রের ভয়ানক বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি। সে সাথে যোগ হয়েছে প্রতিবেশী ভারতের আগ্রাসী ষড়যন্ত্র। তারা যৌথ ভাবে ব্যর্থ করে দেয় উপমহাদেশের মুসলিমদের বিশাল রক্ত ব্যয়ে অর্জিত পাকিস্তান প্রজেক্ট। দেশটির ধ্বংসের মধ্যে তারা নিজেদের স্বার্থ পূরণের রাস্তা খুঁজেছে। তবে তাদের ধ্বংস প্রক্রিয়া ১৯৭১’য়ে থেমে যায়নি, বরং সে অভিন্ন অপরাধীদের হাতেই জিম্মি হলো আজকের বাংলাদেশ।
ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাঙালী মুসলিমদের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্ব ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। সে সময় পাকিস্তান ছিল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। এবং সে রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ জনগোষ্টি ছিল বাঙালী মুসলিম। এবং সে পাকিস্তান আজ পারমানবিক অস্ত্রধারী একমাত্র মুসলিম দেশ। ফলে বাঙালী মুসলিমগণ সুযোগ পেয়েছিল শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, সমগ্র বিশ্ব রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার। হতে পারতো দক্ষিণ এশিয়ার বুকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রধান কর্ণধার। কিন্তু বাঙালী মুসলিমদের সে সুবর্ণ সুযোগ বাঙালী কাপালিকদে ভাল লাগেনি। ফলে সে সুযোগটি বিনষ্ট করতে তারা উঠে পড়ে লাগে।
প্রতিবেশীর গোলাম হওয়ার নেশা যখন চাপে তখন স্বাধীন থাকাটাই অসহ্য হয়ে উঠে। এদের কাছে তাই অসহ্য হয়ে পড়ে পাকিস্তানের বৃহৎ ভূগোল। এবং সে ভূগোল ভাঙ্গার কাছে ভারতের ন্যায় কুচক্রি ও সুযোগ-সন্ধানী পার্টনারও পেয়ে যায়। ভারত পাকিস্তান ভাঙ্গার সে কাজটি নিজ খরচে ১৯৪৭ সালে করে দিতে দুই পাড়ে খাড়া ছিল। তাদের প্রয়োজন ছিল শেখ মুজিবের ন্যায় একজন আজ্ঞাবহ সেবাদাসের। সে সুযোগটি আসে ১৯৭১’য়ে। ফলে মুক্তি বাহিনীকে একটি জেলা বা একটি মহকুমাও স্বাধীন করতে হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনী সে কাজটি নিজ দায়িত্বে ও নিজ খরচে করে দিয়েছে। একাজের জন্য ভারতের পদসেবা, অর্থসেবা ও ভারতের এজেন্ডার প্রতিষ্ঠা দিয়ে বাঁচাই এখন বাঙালী কাপালিকদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি। ভারতের প্রতি চির কৃতজ্ঞ হয়ে বাঁচাটাই তাদের কাছে গর্বের।
পাকিস্তান আমলের বড় ব্যর্থতাটি
পাকিস্তান আমলের বড় ব্যর্থতাটি অর্থনৈতিক ছিল না। প্রশাসনিকও নয়। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার ছিল ভারতের চেয়েও অধিক। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশাসকগণ আসতো পাকিস্তান থেকে উন্নয়নের মডেল শিখতে্। সে সময় বহু বিশ্ববিদ্যালয়, বহু মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, ডিগ্রী কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, স্কুল, ক্যান্টনমেন্ট ও কলকারাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্ত ২৩ বছরে একখানি বইও এ নিয়ে লেখা হয়নি যে কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হলো। ভারত তো ১৯৪৭ সালের আগে অখণ্ডই ছিল। কিন্তু কেন ভাঙ্গার প্রয়োজন দেখা দিল? পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে এ প্রশ্নটির জবাব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের ছাত্ররা দেশ-বিদেশের কত জীবজন্তু, লতা-পাতা, কবিতা-পুঁথির উপর গবেষণা করে। পিএইচডি ডিগ্রিও নেয়। কিন্তু অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে কেন পাকিস্তান সৃষ্টি হলো -তা নিয়ে কোন গবেষণা করা হয়নি। তেমন কোন বইও লেখা হয়নি। আজ যে অখণ্ড ভারতের কথা বলা হচেছ এবং যেভাবে বাঙালী মুসলিমের মনে বাড়ছে অখণ্ড ভারতের মোহ, সেটি কখনোই এতটা প্রতিষ্ঠা পেত না যদি সে সময় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ছাত্রদের প্রকৃত ইতিহাস জানানো হত। রাতের অন্ধকারে সুবিধা হয় চোর-ডাকাত-দুর্বিত্তদের, তেমনি অজ্ঞতায় মহা সুবিধা পায় বিদেশী শত্রুরা। তখন জনপ্রিয়তা পায় তাদের ধোকাপূর্ণ বুলি এবং ক্ষতিকর ধ্যান-ধারণা। অখণ্ড ভারতের মোহ তো সে কারেণই বাড়ছে। ইসলামে অজ্ঞ থাকা এজন্য কবীরা গুনাহ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল ইসলাম ও প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্ব। ইসলামই ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে একমাত্র যোগসূত্র। এমন একটি আদর্শিক দেশের প্রতি সেক্যুলারিস্ট, জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রি ও ইসলামবিরোধীদের দরদ থাকার কথা নয়। বরং এমন দেশে তাদের রাজনৈতিক মৃত্যু অনিবার্য। সেটি তারা বুঝতো বলেই দিবারাত্র খেটেছে দেশটির ত্বরিৎ ধ্বংসে। কিন্তু পাকিস্তানের সরকারের যারা কর্ণধার ছিল তারা এ ঘরের শত্রুদের চিনতে পারিনি। চিনলেও তাদের থেকে বাঁচার কোন চেষ্টা করেনি। বরং তাদের অবাধে বাড়তে দিয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধের বহু আগেই বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনটি ভারতসেবীরা দখলে চলে যায়। পাকিস্তান ও ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের তেমন কোন লড়াকু সৈনিকই ছিলনা। একই অবস্থা আজও।
সেক্যুলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেদিন যারা বের হয়েছেন তারা পাকিস্তানের বা ইসলামের পক্ষে লাঠি না ধরে নিজেদের শ্রম ও মেধার বিনিয়োগ করেছেন তার বিনাশে। ষাটের দশকে তারা লাঠি ধরেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া বা চীনের পক্ষে। আর এখন খাটছেন ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণে। তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম যে বাঙালীকে পাকিস্তান সরকার বৃত্তি দিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠায় তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক জনাব আব্দুর রাজ্জাক। অথচ এই আব্দুর রাজ্জাকই বিলেত থেকে ফিরে এসে যে কাজটি লাগাতর করেছেন তা হলো পাকিস্তানের শিকড় কাটার কাজ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব তাঁর এ রাজনৈতিক গুরুকে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা দেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আব্দুব রাজ্জাকের ন্যায় এ রকম গাদ্দার ছিলেন প্রচুর। এদেরই অনেকেই এখন খাটছেন ভারতের সেবাদাস রূপে। এদের কারণেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসলাম-বিরোধীদের দুর্গে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও তাদের মিশন শেষ হয়নি। বাংলাদেশের ভুগোলের মধ্যেও তারা পাকিস্তান ও ১৯৪৭’য়ের গন্ধ টের পায়। এবং যা কিছু পাকিস্তানী -তাই তাদের কাছে ঘৃণ্য। এদের অনেকে নাকি পাকিস্তানের নাম উচ্চারন করলে টুথ পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজে। তারা শুধু পাকিস্তানের নয়, শত্রু স্বাধীন বাংলাদেশেরও।
নাশকতা চেতনা বিভ্রাটের
বাঙালী মুসলিমের চেতনা বিভ্রাটের আলামতগুলো বিশাল। অনেকেই বলে, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলেই তো ভাল হতো। অখণ্ড ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হতো -এ বিশাল জনসংখ্যা শক্তিশালী মুসলিম শক্তির জন্ম ঘটাতো।” একথা বলার মতলবটি হলো, বাংলাদেশ না হলে ভাল হতো -সে কথাটা পরোক্ষ ভাবে বলা। এরূপ কথা ১৯৪৭’য়ের আগে কংগ্রেসপন্থি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা-কর্মীগণও বলতো। তারাও চায়নি, বাংলাদেশ অখন্ড ভারতের বাইরে থাক। সিলেটে যখন গণভোট হয় তখন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আলেমগণ বহু চেষ্টা করেছে যেন সিলেটে ভারতে থাকে। বাংলাদেশ ভারতে মিশে গিলে এখনও তারা খুশি হয়।
বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যা শতকরা ৯১ ভাগ। কিন্তু তাতে কি রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রশাসনে হিন্দু বা ভারতীয়দের দাপট কমেছে? কাশ্মীরে শতকরা ৭০ ভাগ মুসলিম। কিন্তু তাতে কি তারা স্বাধীন ভাবে বাঁচার সুযোগ পেয়েছ। অনেকের প্রশ্ন, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের কোন কল্যাণটি হয়েছে?” কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন হলো, ভারতে বসবাসকারি প্রায় ২০ কোটি মুসলিমেরই বা কোন কল্যাণটি হয়েছে? বাংলাদেশে যত মুসলিমের বাস তার চেয়ে বেশী মুসলিমের বাস ভারতে। কিন্তু ভারতীয় মুসলিমদের শক্তি কতটা বেড়েছে? বরং বঞ্চনা সেখানে সর্বত্র। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য একটি তদন্ত কমিশন ঘটনা করেছিলেন। সে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে যে তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে তা তো অতি করুণ। শিক্ষা ও চাকুরিতে মুসলিমদের অবস্থা ভারতের অচ্ছুত নমশুদ্রদের চেয়েও খারাপ। ১৯৪৭’য়ে ভারতের মুসলিমদের যে অবস্থা ছিল তা থেকেও তারা অনেক নিচে নেমেছে। অর্থনৈতিক বঞ্চনার পাশাপাশি তারা নিয়মিত নির্মম ভাবে মারা যাচ্ছে এবং লুটপাঠ ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মুসলিম-নির্মূলের অসংখ্য দাঙ্গায়। ভারতীয় জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ মুসলিম হলেও চাকুরিতে তাদের সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগও নয়। কিন্তু ভারতীয় মুসলিমের সে বঞ্চনার ইতিহাস বাঙালী মুসলিমদের সামনে তুলে ধরা হয়নি। পাকিস্তান আমলের এ এক বড় ব্যর্থতা। নেকড়েকে নেকড়ে রূপে পরিচয় না করিয়ে বিপদ তো ভয়াবহ।
পাকিস্তান কি সত্যিই ব্যর্থ?
বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের খাসলত হলো নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে পাকিস্তানের ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরা। নিজেরা যে ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হলো -সে কথা তারা বলে না। তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি বা শাড়ীর বদলে মাছধরা জাল পড়ে বাঙালী মহিলা যে বিশ্বময় ইতিহাস গড়লো -সে কথাও বলে না। অথচ লাহোর বা করাচীতে বোমা ফুটলেই বলে পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক। তবে দেশটির অর্জন কি এতোই তুচ্ছ? পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালগুলিতে যত মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করে ভারতে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা তার ২০ ভাগের এক ভাগও নয়। অথচ একটি দেশের মানুষ কতটা সামনে এগুচ্ছে বা কীরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক শক্তিসঞ্চয় করছে -সেটি পরিমাপের একটি নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা। ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে চাকুরিজীবী প্রফেশনালদের সংখ্যাও অনি নগন্য।
পাকিস্তানের একমাত্র করাচী শহরে যত ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী, আইনবিদ, প্রফেসর, বিজ্ঞানী ও সামরিক অফিসারের বসবাস -সমগ্র ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে তা নেই। তাছাড়া পাকিস্তানে যতজন পারমানবিক বিজ্ঞানী বা পদার্থ বিজ্ঞানীর বসবাস তা ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে দূরে থাক, ৫৭টির মুসলিম দেশের মধ্যে কোন দেশেই নাই। সম্প্রতি ব্রিটিশ পত্রিকায় প্রকাশ, পাকিস্তানের পারমানবিক বোমার সংখ্যা ফ্রান্সের প্রায় সমকক্ষ। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একমাত্র তাদের হাতেই রয়েছে পারমানবিক বোমাধারি দূরপাল্লার মিজাইল যা ভারতীয় প্রযুক্তির চেয়ে অগ্রসর। একাত্তর থেকে পাকিস্তানে তাই অনেক সামনে এগিয়েছে। দেশটি আজও বেঁচে আছে সে সামরিক শক্তির জোরেই। নইলে ভারত ইতিমধ্যে দেশটিকে আরো কয়েক টুকরোয় বিভক্ত করে ফেলতো। একাত্তরের পর ভারতীয় র’ সেটির পরিকল্পনাও এঁটেছিল। ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার বই “Inside RAW”য়ে সে বিষয়ে বিস্তর বিবরণ তুলে ধরেছেন।
সামরিক শক্তির বিচারে পাকিস্তানই হল সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। আর এ কারণেই দেশটি তার জন্ম থেকেই সকল আন্তর্জাতিক ইসলাম-বিরোধী শক্তির টার্গেট। অখণ্ড ভারতে বসবাস করলে মুসলিমদের কি এরূপ শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ মিলতো? শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তো নিজের পায়ের তলায় মাটি চাই, স্বাধীনতাও চাই। ভারতের মুসলিমদের কি সেটি আছে? কারাগারে বন্দীদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক তাতে কি তাদের শক্তি বাড়ে? মুসলিমদের জন্য ভারত কি জেলখানা থেকে ভিন্নতর?
বীজ সব জায়গায় গজায় না,বেড়েও উঠে না। বনেজঙ্গলে পড়লে গজালেও বেড়ে উঠে না। ভারতে মুসলিম প্রতিভা যে নাই -তা নয়। প্রতিটি শিশুরই থাকে বিপুল সম্ভাবনা। কিন্তু ভারতে মুসলিম শিশুকে বেড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশ দেয়া হয়না। হিজরত এজন্যই ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। মক্কার বন্দী জীবন ছেড়ে হিজরত এজন্যই আল্লাহপাক ফরয করেছিলেন। হিজরতের মাধ্যমেই তাঁরা সেদিন পেয়েছিলেন উর্বর ভূমিতে গিয়ে নিজ প্রতিভা নিয়ে বেড়ে উঠার সামর্থ্য। এর ফলে পেয়েছিলেন শক্তিশালী সভ্যতার নির্মান ও বিশ্বশক্তি রূপে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ্য। সাতচল্লিশের পর ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলিম ভারত থেকে হিযরত করে পাকিস্তান গিয়েছিলেন এমন এক চেতনায়। পাকিস্তানের পারমানবিক বোমা আবিস্কারক ড.আব্দুল কাদির হলেন তাদেরই একজন।
তাছাড়া পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা অনর্থক গণ্য হলে শুধু পাকিস্তান নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজনীতাও অনর্থক হয়ে দাঁড়ায়। তাই পাকিস্তানের সৃষ্টিকে অনর্থক বা অনাসৃষ্টি বলা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর চিন্তা। বাংলাদেশ তার সমগ্র মানচিত্রটা পেয়েছে পাকিস্তান থেকে। বাংলাদেশীরা একাত্তরে বা তার পরে এ একইঞ্চি ভূমিও এ মানচিত্রে বাড়ায়নি। তাই বাংলাদেশী মুসলিমদের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ১৯৪৭’য়ে অর্জিত স্বাধীনতা। ১৯৭১’য়ে এসে পাকিস্তান থেকে শুধু বিচ্ছিনতাই জুটেছে, স্বাধীনতা নয়। ১৯৭১’য়ের ১৬ই ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা দিবস বললে তার পূর্বের পাকিস্তানী ২৩ বছরকে ঔপনিবেশিক বিদেশী শাসন বলে প্রমাণিত করতে হয়। কিন্তু সে পাকিস্তানী আমলকে ঔপনিবেশিক বিদেশী শাসনামল বললে কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর ঢাকার খাজা নাযিম উদ্দিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হন কি করে? বগুড়ার মহম্মদ আলী এবং আওয়ামী লীগের সোহরোয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীই বা হন কি করে? মিথ্যা কথায় হিসাব মিলানো যায় না। তবে মিথ্যা কথা বলার পিছনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা আছে। সেটি নিজেদের কৃত অপরাধগুলোকে গৌরবময় করার স্বার্থে। তাছাড়া তাদের দায়বদ্ধতা হলো ভারতের আগ্রাসী চরিত্রকে আড়াল করার। কিন্তু যারা আওয়ামী লীগের সে অপরাধের সাথে জড়িত নয় এবং লিপ্ত নয় ভারতের লেজুড়বৃত্তিতে, অন্তত তাদের তো সত্য কথাগুলো নির্ভয়ে বলা উচিত।
বরং একাত্তরে যেটি জুটেছে সেটি হলো, ভারতীয় প্রভাব বলয়ে প্রবেশ। ১৯৭১’য়ের পর থেকে ভারত বাংলাদেশকে গণ্য করে তার প্রতিরক্ষা সীমানার অন্তভূক্ত একটি দেশ রূপে। যেমন হায়দারাবাদেরর নিযামের রাজ্য গণ্য হতো ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। হায়দারাবাদের নিযাম সে আমলে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। অথচ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নিজ দেশের প্রতিরক্ষায় দূরপাল্লার একখানি কামানও কিনতে দেয়নি। দেশটির মধ্য দিয়ে ট্রানজিট নিতে জালের মত রেল লাইন বসিয়েছিল। তাই ১৯৪৮ সালে ভারত-ভূক্ত করতে ভারতকে বেগ পেতে হয়নি। এক দুর্বল আশ্রিত রাষ্ট্রের অবকাঠামো ব্রিটিশেরা পূর্ব থেকেই সেদেশে নির্মাণ করে গিয়েছিল। বাংলাদেশেও তেমনি এক অবকাঠামো নির্মাণ করেছে ভারত ও তার বাংলাদেশী সহযোগীরা। সেটি যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক, তেমনি সাংস্কৃতিক ও সামরিক। তেমন একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একাত্তরের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান আর্মির অব্যবহৃত সকল অস্ত্র ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজ দেশে নিয়ে যায়। একমাত্র অজ্ঞতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক মহাবিভ্রাটই এ সত্যকে ভুলিয়ে দিতে পারে। অথচ বাংলাদেশের ভারতপন্থিরা সে বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রাটই বাড়িয়ে চলেছে। আর সে অজ্ঞতা ও বিভ্রাটের কারণেই ভারতের জালে আটকা বন্দীদশা নিয়েও আজ ভারতপন্থি বাঙালী মহলে হচ্ছে মহোৎসব।
সামনে মহা বিপদ
আজকের ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারি শাসক বাংলাদেশে যেভাবে গণতান্ত্রিক আচার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে -তা ভবিষ্যতে মারাত্মক রকমের বিপর্যয়ের জন্ম দিবে। স্বৈরাচার নিজেই দেশ শাসনের এক নৃশংস ও অসভ্য রীতি। এবং সে অসভ্য শাসনই এখন বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ের উপর। গণতান্ত্রিক শাসনের সভ্য রীতি হাওয়ায় জন্ম নেয় না, সে জন্য লাগাতর পরিচর্যা দিতে হয়। লাগাতর পরিচর্যার মাধ্যমে গণতন্ত্র জনগণের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়। তখন জনগণ ভোটচুরি ও ভোটডাকাতিকে মন থেকে ঘৃণা করতে শেখে। অথচ সে সংস্কৃতি ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারে গড়ে উঠে না।
স্বৈরাচারি শাসনের বড় নাশকতা হলো এটি দেশকে নেতা শূণ্য করে। পাল্টে দেয় মানুষের মূল্যবোধ ও বিচারবোধ। দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসন জনগণকে ভোটচোর ও ভোটডাকাতদেরও মাননীয়, মহান নেতা, দেশবন্ধু, দেশনেত্রী বা জাতির পিতা বলতে শেখায়। এভাবে জনগণের চেতনা ও সংস্কৃতি পাল্টায়। এখানেই বাংলাদেশের জন্য মহা বিপদ। ১৯৭১’য়ে দেশের মানচিত্র পাল্টানো হয়েছিল। এখন চলছে চেতনা, চরিত্র ও সংস্কৃতি পাল্টানোর কাজ। কারণ শয়তান শুধু মুসলিমদের ভূগোল বিভক্ত করা নিয়ে খুশি নয়। আরো নিচে নামাতে চায়। জাহান্নামের পূর্ণ উপযোগী করে গড়ে তুলতে চায়। এজন্য জনগণের ঈমান, আমল ও সংস্কৃতির অঙ্গণে নাশকতা ঘটায়। কারণ স্বৈরাচার তো সুস্থ্য চেতনা ও সংস্কৃতিতে বাঁচে না। অসভ্য স্বৈরাচারি শাসকগণ নিজেরা পাল্টায় না; বরং জনগণকে পাল্টায় নিজেদের দুর্বৃত্তির সাথে ম্যাচিং তথা সমন্বয় বাড়াতে। এজন্যই স্বৈরশাসনে দুর্বৃত্ত উৎপাদনে বাম্পার ফলে। বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর বিপদের কারণ এখানেই্। ২৭/০১/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018