অধঃপতিত মুসলিম উম্মাহ: মূল ব্যর্থতাটি যেখানে ইবাদতে
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 26, 2020
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ইবাদত: সাফল্যের চাবি
মুসলিম জীবনে সাফল্যের মূল চাবিটি হলো ইবাদত -কি ইহলোকে, কি পরকালে। ইবাদতই ব্যক্তিতে আনে কাঙ্খিত পরিশুদ্ধি। আনে তাকওয়া; দেয় সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার প্রেরণা। এবং জাতীয় জীবনে আনে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ। আনে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত সাহায্য। আনে বিজয়, আনে গৌরব। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের কোথায় আজ সে পরিশুদ্ধি? কোথায় সে সিরাতুল মুস্তাকীমে পথচলা? কোথায় সে সাহায্যপ্রাপ্তী ও বিজয়? দূর্নীতিতে মুসলিমরাই কি আজ বিশ্বে প্রথম নয়? অথচ মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মিশন বেঁধে দেয়া হয়েছে “দুর্নীতি-দুর্বৃত্তির নির্মূল ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা”। বিজয় দূরে থাক, তারাই কি বিশ্বে সবচেয়ে পরাজিত, অধঃপতিত, অপমানিত ও নির্যাতীত নয়? শিক্ষায় অনগ্রসর, বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ এবং বিশ্বের সবচেয়ে স্বৈরাচার কবলিত ও মানবাধিকার বর্জিত রাষ্ট্রগুলো কি এখনও মুসলিমদের নয়? নিছক প্রাণে বাঁচাটি নিশ্চিত করতেই কি মুসলিমগণ আজ নিজ দেশ ছেড়ে অমুসলিম দেশে পাড়ি জমাচ্ছে না? এটিই কি কম লজ্জাকর? এত অপমান ও পরাজয়ের পরও কি ভাববার অবকাশ থাকে যে সাফল্যের মূল চাবিটি মুসলিম জনপদে যথার্থ ভাবে কাজ করছে? মুসলিমগণ অতীতে শূণ্য থেকে শুরু করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন। পরাজিত করেছিলেন বড় বড় বিশ্বশক্তিকে। এবং সেটি কি সংখ্যা বলে? জনবিরল আরবের কি সে সংখ্যাবল ছিল? সংখ্যাবলে বিজয় সম্ভব হলে তেমন বিজয় আসা উচিত ছিল আজকের মুসলিমদেরও। অন্ততঃ তিরিশ কোটি আরব বিজয়ী হতো অর্ধ কোটি ইসরাইলীদের উপর।
বিশ্বব্যাপী পরাজয়, সীমাহীন গ্লানী ও কদর্যতার পর মুসলিমদের অবশ্যই ভাবা উচিত, কেন তাদের এ পতিত দশা? এতদিন যে পথে তারা চলছে সেটি যে বিজয়ের নয় -উপর্যপরি পরাজয়ই তা প্রমাণ করেছে। বছরের পর বছর সেবনেও যে ঔষধে রোগ সারে না -সে ঔষধ যে যথার্থ নয় তা নিয়ে অন্ততঃ বোধোদয় হওয়া উচিত। সিরাতুল মুস্তাকীম জ্ঞান করে যে পথে আমরা চলছি এবং ভাবছি মহান আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে এ পথে পৌঁছবোই –সে পথ যে কতটা ভ্রান্ত সে হিসাব কি আমরা নিয়েছি? মুসলিমদের আজ যে বিপন্নদশা -সেটি নিতান্তই নিজস্ব অর্জন। এবং এ বিপদ থেকে নিজ চেষ্টায় বেড়িয়ে আসতে হবে। নইলে মহান আল্লাহতায়ালাও আমাদের সাহায্য করবেন না। এ প্রসঙ্গে তাঁর নিজস্ব নীতিটি ঘোষিত হয়েছে পবিত্র কোর’আনে। বলা হয়েছে, “ইন্নাল্লাহা লা ইউগাইয়েরু মা বি কাউমিহি হাত্তা ইউগাইয়েরু মাবি আনফুসিহিম।” অর্থ: মহান আল্লাহতায়ালা কখনই কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না -যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনে। এ ভাবে সাহায্যলাভে মহান মহান আল্লাহতায়ালা শর্ত বেঁধে দিয়েছেন। আর সেটি হলো, ব্যক্তিজীবনে নিজ উদ্যোগে কাঙ্খিত পরিবর্তন। আর সে পরিবর্তনের পথটি হলো ইবাদতের। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সে ইবাদত আমাদের জীবনে কতটুকু? হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, “মহান আল্লাহতায়ালা কাছে হিসাব দেওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নাও।” কিন্তু ক’জন নেয় সে হিসাব?
যে ব্যবসায়ী লাভ চায়, সে প্রতিদিন লাভ-লোকসানের হিসাব নেয়। লোকসান হলে সতর্ক হয়, প্রয়োজনে ব্যবসা পাল্টায়। যে ব্যবসায় হিসাব নিকাশ নাই -সে ব্যবসায় লোকসানের ভয়ই অধিক। আর জীবনের ব্যবসায় তো বিনিয়োগ ঘটে জান-মালসহ সমগ্র সামর্থ্যে; এবং ব্যর্থতা জাহান্নামে পৌঁছায়। মুসলিম উম্মাহর ব্যবসা যে পরাজয়, পতন ও ভয়নাক লোকসানের -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? লোকসানের এ পথ কি পরকালেও কোন লাভ দিবে? মহান আল্লাহতায়ালা চান তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ শুধু দুনিয়াতে নয়, আখেরাতেও সফল হোক। সাফল্যের পথ সিরাতুল মুস্তাকীমও বাতলিয়ে দিয়েছেন। তেমন একটি লাভের পথ ছাড়া স্রেফ হাসি-তামাশা, আনন্দ-ফুর্তির জন্য মানবকে সৃষ্টি করবেন -সেটি কি ভাবা যায়? পবিত্র কোরআনের ঘোষণা: “আফা হাসিবতুম আন্নামা খালাকনাকুম আবাসা।” – (সূরা মুমিনূন-১১৫)। অর্থ: তোমরা কি ভেবেছো, আমি তোমাদেরকে হাসি তামাশার জন্য সৃষ্টি করেছি? মানুষের সৃষ্টির পিছনে মহান আল্লাহতায়ালার একটি সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। অথচ সে লক্ষ্যকে পরিহার করে হাসি-তামাশা, আনন্দ-ফুর্তির মধ্যেই মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ যারা সফল হতে চায়, তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে দেয়া সে ইচ্ছাটি ও লক্ষ্যটিকে জানা এবং সে লক্ষ্য পূরণে নিজের সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ করা।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, “ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ও ইনসানা ইল্লা লি’ইয়াবুদুন।” অর্থ: “আমি জিন ও মানুষ জাতিকে (আমার) ইবাদত ভিন্ন অন্য কোন লক্ষ্যে সৃষ্টি করেনি।” ফলে বান্দার যে কাজটি আল্লাহর দরবারে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে সেটি হলো ইবাদত। ইবাদত ভিন্ন মানব সৃষ্টির পিছে মহান আল্লাহতায়ালার যেমন ভিন্নতর লক্ষ্য নেই, তেমনি এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাও নেই। মহান স্রষ্টার সে উদ্দেশ্য পূরণের চেয়ে মানব জীবনে আর কোন আরধ্য কাজও থাকতে পারে না। বাঁচা ও মরা নিয়ে এমন একটি নিখাদ উপলব্ধিই মানব জীবনে কম্পাসের কাজ করে এবং জান্নাতে পৌঁছায়।
বিদ্রোহ সর্বত্র জুড়ে
বিকট বিভ্রান্তি ইবাদতের ক্ষেত্র নিয়েও। মহান আল্লাহতায়ালা চান তাঁর ইবাদত শুধু জায়নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতে সীমিত থাকবে না। তাঁর ইবাদত তথা তাঁর হুকুমের গোলামী চলবে রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহসহ জীবনের সকল অঙ্গণে। কিন্তু মুসলিম জীবনে কোথায় সে ইবাদত? ইবাদতের বদলে বিদ্রোহের আলামত তো সর্বত্র জুড়ে। রাজনীতিতে ইবাদত থাকলে কি প্রতিষ্ঠা পেত ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদ? প্রতিষ্ঠা পেত কি মুসলিম মানচিত্র ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের দেয়াল গড়ার রাজনীতি? অর্থনীতিতে ইবাদত থাকলে কি প্রতিষ্ঠা পেত কি সূদী ব্যাংক ও সূদী অর্থনীতি? মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি আনুগত্য ও তাঁর প্রতি ইবাদতে আগ্রহ থাকলে কি আইন-আদালতে থেকে বিলুপ্ত হতো শরিয়তী আইন? এবং বিচার চাওয়া হতো কি কাফেরদের আইন থেকে? শিক্ষাঙ্গণ থেকে কি বিলুপ্ত হতো কোর’আন শেখার আয়োজন? রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণ জুড়ে কার ইবাদত হচ্ছে এবং কার এজেন্ডা বাস্তবায়ীত হচ্ছে -সেটি কি গোপন বিষয়? মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা পূরণের বদলে মানুষ শ্রম দিচ্ছে, অর্থ দিচ্ছে, মেধা দিচ্ছে, এমন কি প্রাণ দিচ্ছে দলের বা নেতার এজেন্ডা সফল করতে। এতে পরাজয় বাড়ছে যেমন মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার, তেমনি বিজয় বাড়ছে শয়তানের। মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এর চেয়ে বড় গাদ্দারি আর কি হতে পারে? এবং সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে!
মুসলিম জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, জীবনের মূল লক্ষ্য বা এজেন্ডাটি নিয়ে চরম অজ্ঞতা। এটিই জীবনের সবচেয়ে বড় জাহিলিয়াত। গন্তব্যস্থল না জেনে গাড়ী চালানোর ন্যায় অনেকেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে জীবনের মুল এজেন্ডা না জেনেই। কখনো বা সে এজেন্ডাটি স্থির করা হয় নিজস্ব খেয়াল খুশীতে। অথচ মানব জীবনে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো এই এজেন্ডা নির্ধারণ। বস্তুত সে সামর্থ্য দিয়ে মানুষকে সৃষ্টিও করা হয়নি। ফলে মানব বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিস্কারে সামর্থ্য দেখালেও ব্যর্থ হয়েছে জীবনের সঠিক এজেন্ডা নির্ধারণে। ফলে জীবনে বাঁচার বিপুল আয়োজন আছে, কিন্তু সঠিক লক্ষ্য নাই্। মানবের সে অক্ষমতা জেনেই কি লক্ষ্য নিয়ে মানুষ বাঁচবে –সে এজেন্ডা নির্ধাারণের গুরু দায়ভারটি মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে দেননি। সেটি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তিনি স্বয়ং নিজে। এবং সেটি মানব সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই। মানব জীবনে প্রকৃত সফলতাটি আসে সে এজেন্ডা নিয়ে বাঁচায়। নইলে বাঁচতে হয় শয়তানী এজেন্ডা নিয়ে। এবং পৌঁছতে হয় জাহান্নামে। বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তিনি হাজার হাজার নবী রাসূল পাঠিয়েছেন স্রেফ এ বিষয়টি শেখাতে যে, কি ভাবে সে নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে বাঁচতে হয়।
মানব বাঁচবে এবং বাঁচার জন্য কর্মে ও উপার্জনে নামবে – সেটিই স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তির জীবনে এগুলো বেঁচে থাকার কৌশল মাত্র, বাঁচার লক্ষ্য নয়। মুল লক্ষ্য, মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদত। এবং ইবাদত নিয়ে আমৃত্যু বাঁচার পথটিই হলো সিরাতুল মুস্তাকিম। একমাত্র এ পথটিই জান্নাত মুখী। এ ভিন্ন অন্য সবগুলি পথই মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছায়। তবে ইবাদতের অর্থ শুধূ নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত বা তাসবিহ-তাহলিল নয়। এটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার পূর্ণ গোলামী। এ গোলামী নামায-রোযা,হজ্ব -যাকাত বা তাসবিহ পাঠকালীন সময়ে সীমিত নয়। এবং ইবাদতের ক্ষেত্র নিছক জায়নামায বা মসজিদ-মাদ্রাসাও নয়, এটির বিস্তার ব্যক্তির প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে। নামায ৫ ওয়াক্তের, রোযা এক মাসের। হজ্ব জীবনে মাত্র একবার। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের গোলামী প্রতি দিন ও প্রতি মুহুর্তের। এবং সেটি আমৃত্যু।
ইবাদতের অর্থ, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমকে মেনে চলা। জেনে বুঝে তাঁর কোন একটি হুকুমের অবাধ্যতাই ব্যক্তিকে কাফেরে পরিণত করে। তাই অভিশপ্ত শয়তান হতে ইবলিসকে মহান আল্লাহতায়ালার বহু হুকুম অমান্য করতে হয়নি। হযরত আদম (আ:)’কে সেজদার একটি মাত্র হুকুম অমান্যই সে জন্য যথেষ্ট ছিল। এ বিষয়টি শিক্ষণীয় প্রতিটি মানুষের জন্যই, বিশেষ করে যারা মুসলিম রূপে পরিচয় দেয়। নামাজ-রোজা-হজ্ব পালনের পরও যারা সূদ খায়, ঘুষ খায় এবং কোর’আনী আইনের বিরোধীতা করে তাদের অবাধ্যতা তো অনেক। সৈনিকের জীবনে সামান্য ক্ষণের বিদ্রোহ তাকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখী করে, বিচারে প্রান নাশও হয়। মুসলিম মাত্রই মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিক। তাই মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধে সামান্য বিদ্রোহও তাকে অভিশপ্ত করবে এবং জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে বাব্দার কোরবানীর অর্থ, রক্ত, গোশতো কোনটিই পৌঁছে না। পৌঁছে না শহীদের রক্তও। যা পৌঁছে তা হলো তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি তাঁর নিয়েত, নিষ্ঠা ও হুকুমের প্রতি আনুগত্য। আর এ আনুগত্য অবিভাজ্য। কোথাও আনুগত্য আবার কোথাও বিদ্রোহী -ঈমানের ক্ষেত্রে তেমনটি চলে না। এটি মোনাফেকি। মুসলিম তাই মসজিদে নামাজ পড়বে আবার দোকানে মদ বিক্রি করে বা বেপর্দা ও অশ্লিলতাকে প্রশ্রয় দিবে -সেটি হয় না। এমন জীবনে ঈমানের কনসিসটেন্সি তথা পূর্বাপর সঙ্গতিটি কোথায়? এটি বস্তুত মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচারন। তাই রাজনীতিতে নেমে যে ব্যক্তিটি ইসলামের প্রতিষ্ঠাকেই অসম্ভব করে তোলে -তাকে কি মুসলিম বলা যায়?
হযরত ইব্রাহীম (আঃ): ইবাদতের শ্রেষ্ঠ মডেল
মুসলিম শব্দটিও এসেছে আসলামা থেকে; বুঝায় এমন ব্যক্তিকে যে রীতিমত আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি। সমগ্র ইতিহাসে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের শ্রেষ্ঠ মডেল হলেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। রাব্বুল আলামীনের প্রতিটি হুকুমে তিনি লাব্বায়েক বলেছেন। যখন তাঁকে নিজ ঘর ছেড়ে হিজরতের হুকুম দেয়া হয়েছে -তখনও তিনি লাব্বায়েক তথা আমি হাজির বলেছেন। যখন শিশুপুত্রসহ স্ত্রী হাজেরাকে জনমানবশূণ্য ও খাদ্যপানীয়শূণ্য মক্কাতে ছেড়ে যাওয়ার হুকুম দেয়া হলো –তখনও তিনি লাব্বায়েক বলেছেন। যখন স্বপ্নে শিশুপুত্র ঈসমাইলকে কোরবানী করার হুকুম দেয়া হলো তখনও তিনি লাব্বায়েক বলেছেন। “মুসলিম” তথা আত্মসমর্পনকারী শব্দটির জনকও তিনি। মুসলিম হওয়ার অর্থ তো হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র সে আদর্শ নিয়ে বাঁচা। কথা হলো, যে ব্যক্তির আত্মসমর্পণ মহান আল্লাহতায়ালাতে -সে কি কখনো ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও আদালতে স্বেচ্ছাচারি হতে পারে? হতে পারে কি অনৈসলামের অনুসারি? এরূপ বিদ্রোহ তো কুফরি।
মুসলিম দেশগুলিত আজ বহু লক্ষ মসজিদ। নামাযীর সংখ্যাও কোটি কোটি। কিন্তু শিক্ষাঙ্গণে কোর’আন-শূণ্যতা, আইন-আদালতে শরিয়তের অনুপস্থিতি, অর্থনীতিতে সূদ এবং সংস্কুতিতে অশ্লিলতা –এসব দেখে কি মনে হয় মহান আল্লাহতায়ালাতে তাদের আত্মসমর্পণ যথার্থ? আইন-আদালত, রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষ-সংস্কৃতির ন্যায় জীবনের গুরুত্বপূণ ক্ষেত্র জুড়ে যদি হয় মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা -তবে নিছক মসজিদের চার দেয়ালের মাঝের ইবাদতে কি তিনি খুশী হবেন? কোরআন পাকে বলা হয়েছে, “ইয়া আইয়োহাল্লাযীনা আমানু উদখুলু ফিসসিলমি কা’আফফা” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২০৮)। অর্থ: হে ঈমানদারগণ, তোমরা ইসলামের মধ্যে পুরাপুরি প্রবেশ করো। অর্থাৎ শুধু নামায-রোযা বা হজ্ব-যাকাতে মুসলিম হলে চলবে না, মুসলিম হতে হবে রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত, বুদ্ধিবৃত্তি তথা জীবনের প্রতি কর্মে । “ইনসানে কামেল” তথা পূর্ণাঙ্গ মুসলমানের যে মডেল নবীপাক (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম গড়েছিলেন সেটির যথার্থ অনুসরণ হতে হবে সর্বস্তরে।
ইবাদত তো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচায়
মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদতের অর্থ, তাঁর ইচ্ছা ও এজেন্ডার সাথে পুরাপুরি সম্পৃক্ত হওয়া। সে ইচ্ছাটি হলো সকল দ্বীন ও মতবাদের উপর তাঁর দ্বীন তথা ইসলামকে বিজয়ী করা। পবিত্র কোর’আনে ঘোষিত এজেন্ডাটি হলো: “লি’ইয়ুযহিরাহু আলাদ্দীনি কুল্লিহি।” অর্থ: সকল দ্বীনের উপর তাঁর দ্বীনের বিজয়। ফলে রাজনীতি থেকে দূরে থাকাটি মুসলিম জীবনে অসম্ভব। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচতে হলে তাঁকে বাঁচতে হয় রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে। এজন্যই মু’মিনের জীবনে অনিবার্য কারণেই জিহাদ দেখা যায়। তাছাড়া মুসলিম জীবনে রাজনীতি তখনই হালাল হয়, যখন সে রাজীনীতির এজেন্ডাটি ইসলামকে বিজয়ী করা হয়। অন্যথায় হারাম গণ্য হয় রাজনীতি। সত্য তো এটাই, যার জীবনে জিহাদ নাই -বুঝতে হবে তাঁর জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার আগ্রহও নাই। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি তার আত্মসমর্পণও নাই। প্রশ্ন হলো, এমন আত্মসমর্পণহীন ব্যক্তিদেরকে কি মুসলিম বলা যায়? সে আত্মসমর্পণ না থাকাটিই বিদ্রোহ। আজ মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের যে পরাজয় -তার কারণ তো এ বিদ্রোহ।
আত্মসমর্পণের জ্বালল্যমান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার চেয়ে তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কোন এজেন্ডাই ছিল না। ইসলামের বিজয়ে তাঁরা শুধু অর্থ ও শ্রমদানই করেননি, প্রাণদানও করেছেন। জান ও মালের এমন বিনিয়োগকে তারা মনে করতেন মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার একমাত্র মাধ্যম রূপে। প্রকৃত মুসলিমের তারাই তো মডেল। প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর তাসবিহ পাঠ, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালন করেও যারা শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভোট দানে রাজী নয় -তাদেরকে কি বলা যাবে? বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলীতে এদের ভোট নিয়েই কি ইসলামের বিপক্ষ শক্তি বার বার বিজয়ী হয়নি? মানবের প্রতিটি সামর্থ্যই মহান আল্লাহতায়ালার নিয়ামত। সে নিয়ামত কি কাজে ব্যয় হলো -সে হিসার কি দিতে হবে না? ফলে ইসলামের শিকড় কেটে যারা জাতীয়তাবাদ, দলবাদ, দলীয় স্বৈরাচার ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদগুলিকে বিজয়ী করতে শ্রম দেয়, অর্থ দেয়, ভোট দেয়, এমন কি প্রাণ দেয় –তাদের সে হারাম বিনিয়োগের ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে ভাবা উচিত। সে বিনিয়োগ যে জাহান্নামে পৌঁছাবে -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে?
নিছক দোয়ার মাধ্যমে যারা মুছিবত লাঘব বা বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন -তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। নবীজী(সাঃ) শুধু জায়নামাযে বসে দোয়া করেননি; দোয়া করেছেন জিহাদের ময়দানে কাফেরদের তলোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে। মসজিদের শীতল জায়নামাজে বসে যারা বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন -তাদের জন্য নবীজী (সা)’র এ সূন্নতটি অতি শিক্ষণীয়। জিহাদবিমুখ অলস মোনাজাতে সেটি সম্ভব হলে ইতিমধ্যেই সেটি সাধিত হতো। অমুসলিম দেশের রাজধানী লন্ডনে যত নামাযী প্রতি নামাযে আল্লাহতায়ালার কাছে হাত তোলে মোনাজাত করে, নবীজীর (সাঃ) আমলে ততজন মুসলিমই ছিল না। কিন্তু সে আমলে তাঁরা বিজয়ের পর বিজয় আনলেও আমরা এনেছি পরাজয়ের পর পরাজয়। কারণ, পরম নিষ্ঠা ছিল তাদের ইবাদতে। তাদের সে ইবাদত মহান আল্লাহতায়ালাপাককে এতটাই খুশী করেছিল যে তাদের পরাজয় তাঁর কাছে অসহ্য ছিল। ফলে ফেরেশতা পাঠিয়ে তিনি তাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালা অতীতের ন্যায় আজও তাঁর অনুগত বান্দাদের সাহায্যে উদগ্রীব, কারণ এটিই তাঁর পবিত্র সূন্নত। কিন্তু সে সাহায্য লাভে আমরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছি কতটুকু?
গুরুত্বপূর্ণ হলো ইবাদতের ওজন
মহান আল্লাহতায়ালা ইবাদতের ওজন দেখেন, সংখ্যা নয়। নামায-রোযা ও হজ্ব পালনের সংখ্যা বিচারে আজকের বহু মুসলিমই পূর্ব কালের মুসলিমদের হারিয়ে দিবেন। হযরত হামযা (রাঃ), হযরত ইয়াসির (সাঃ), হযরত সুমাইয়ার (রাঃ) মত ইসলামের অতি উঁচূ মর্তবার বহু সাহাবা হজ্ব করেননি। মাহে রামদানের একটি রোজাও রাখেননি। কারণ, রোযা বা হজ্ব ফরজ হওয়ার আগেই তারা শহিদ হয়ে গেছেন। ফিরাউনের দরবারে হযরত মূসা (আঃ) এর সাথে লড়তে এসে যে যাদুকরেরা মুসলিম হলেন তারা তো কোনরূপ ইবাদতের ফুরসতই পাননি। তাদের সারাটি জীবন কেটেছিল যাদুগিরির হারাম কাজে। মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান আনার সাথে সাথে তাদেরকে হাত পা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ “আমরা মূসা (আঃ) ও হারুনের (আঃ)’য়ের রবের উপর ঈমান আনলাম” তাদের এ সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে যে বলিষ্ঠ প্রত্যয় ও ওজন ছিল -তা ক’জনের সারা জীবনের নামায-রোযায় সৃষ্টি হচ্ছে? মহান আল্লাহতায়ালা তাদের মুখ থেকে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণে এতটাই খুশী হয়েছিলেন যে পবিত্র কোরআনে তাদের সে বলিষ্ঠ ঈমানের কাহিনী বার বার উল্লেখ করেছেন। এভাবে মানব ইতিহাসে অমর ও অক্ষয় করেছেন তাদের ঈমানের জ্বাজল্যমান প্রকাশকে। মহান আল্লাহতায়ালা এভাবে বিশ্ববাসীর সামনে নমুনা পেশ করেছেন, প্রকৃত ঈমান কাকে বলে?
পবিত্র কোরআনে ইবাদতের ওজনের গুরুত্ব বর্নীত হয়েছে এভাবে, “ফা আম্মা মান ছাকুলাত মাওয়াজিনুহু ফা হুয়া ফি ঈ’শাতের রাদিয়া।” অর্থ: অতঃপর যাদের আমলের ওজন সেদিন (বিচার দিনে) ভারী হবে তারা সেদিন অতিশয় আনন্দ ও প্রসন্ন চিত্তে বসবাস করবে।” –(সূরা ক্বারিয়া, আয়াত ৬-৭)। উপরুক্ত আয়াতে ইবাদতের সংখ্যার কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে ওজনের কথা। নেক আমলের ওজন তো তখন বাড়ে যখন সকল কাজের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব পায় মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা। ব্যক্তির কর্মে তখন বিমূর্ত হয় মহান আল্লাহতায়ালার গোলামীতে নিষ্ঠা ও আপোষহীনতা। তবে ইবাদতের সে ক্ষেত্রটি শুধু মসজিদ বা বায়তুল্লাহ ক্বা’বা’তে সীমিত নয়; সেটি ক্ষেত-খামার, দোকান-পাঠ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অফিস-আদালত, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনীতির ময়দানও। আল্লাহতায়ালা চান তাঁর দ্বীন সারা বিশ্বে বিজয়ী হোক। বিভ্রান্ত বিশ্ববাসী পাক সিরাতুল মুস্তাকিমে পথ চলার সামর্থ্য। এবং জনগণের সামনে সিরাতুল মুস্তাকিম পেশ এবং তাদের মাঝে সে পথে চলার সামর্থ্য সৃষ্টির দায়িত্বটি প্রতিটি মুসলিমের। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এবং এ দায়িত্ব পালনের কাজটি পবিত্র ইবাদতও। একাজে শয়তানের খলিফাদের সাথে আপোষ চলে না। এবং সেরূপ খালেছ ইবাদত অসম্ভব হয় নিজের স্বেচ্ছাচারি খায়েশের কাছে আত্মসমর্পণে বা বহমান সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোয়ারে ভেসে।
ব্যর্থতা জ্ঞানার্জনের ইবাদত
পানাহার ছাড়া দেহ বাঁচে না। তেমনি শিক্ষা ছাড়া অসম্ভব হয় মানবিক রূপে বাঁচা। জাহিলিয়াতই জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ। এ পাপ আরো অনেক পাপের দুয়ার খুলে দেয়। জাহিলিয়াতের অন্ধকারে অসম্ভব হয় সত্যকে চেনা এবং সে পথে চলা। তাই ইসলামের পথে চলতে হলে অজ্ঞতার অন্ধকার সরাতে হয়। নামায-রোযা ফরজ করার আগে তাই মনের অন্ধকার সরানোর কাজকে ফরজ করা হয়েছিল। “ইকরা” দিয়ে তাই কোর’আন শুরু করা হয়েছিল। নবীজী (সাঃ)’র হাদীস: “শেখা ও শেখানো -উভয়ই ইবাদত।” ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছে। কিন্তু সে ফরজ ইবাদত পালনে মুসলিমদের ব্যর্থতা কি কম? অশিক্ষা ও অজ্ঞতায় তারা অমুসলিমদের চেয়েও পিছিয়ে পড়েছে। যারা কোর’আন শিক্ষা করে এবং কোর’আন শিক্ষা দেয় নবীজী (সা:) তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলেছেন। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে সবচেয়ে উপেক্ষিত হলো কোর’আন শিক্ষা করা ও কোর’আন শিক্ষা দেয়া। এর ফলে মুসলিমগণ ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত থেকে ফায়দা নিতে। যাদের দায়িত্ব ছিল অন্যদের সিরাতুল মুস্তাকীম দেখানো, তারা নিজেরাই আজ পথভ্রষ্ট।
অজ্ঞতার নাশকতা বহুবিধ। সবচেয়ে বড় নাশকতাটি হলো, অসম্ভব করে যথার্থ ইবাদত। মহান আল্লাহতায়ালার ইবাদত দূরে থাক, তাঁর কুদরত চেনাই অজ্ঞের পক্ষে অসম্ভব। তাই সবচেয়ে বড় পাপ যেমন অজ্ঞ বা জাহেল থাকা, তেমনি সবচেয়ে বড় নেক কর্ম হলো অজ্ঞতার বিলুপ্তি। এজন্যই শ্রেষ্ঠ সমাজকর্ম হলো জ্ঞান বিতরণ করা। বেহুশ ও অসুস্থ মস্তিস্ক ব্যক্তির পক্ষে সজ্ঞান হওয়া অসম্ভব করে। এজন্যই তারা ইবাদতের দায়ভার থেকে মুক্ত। অসংখ্য বিভ্রান্তিকর পথের ভিড়ে সিরাতুল মোস্তাকীম চেনার কাজটিই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে কঠিন কাজ। এখানে সফল হলে জান্নাত পাওয়া সহজ হয়ে যায়। বিফল হলে জাহান্নাম প্রাপ্তি অনিবার্য। সঠিক পথপ্রাপ্তিটি কখনোই ভাগ্যগুণে হয় না। দৈবাৎ দূর্ঘটনাতেও ঘটে না। এটি সাধনাবলে অর্জনের বিষয়। সে সাধনার কাজে জরুরি হলো কোর’আনের জ্ঞান। বস্তুত কোর’আনের জ্ঞানহীনতায় সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতিটি হয় সিরাতুল মুস্তাকীম চিনতে ব্যর্থ হওয়া বা তা থেকে পথহারা হওয়ার মধ্য দিয়ে।
হিদায়েত একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার দান। তবে কারা হিদায়েত পাবে -সে বিষয়ে তাঁর নিজস্ব সূন্নত রয়েছে। সেটি হলো, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পথ দেখান -যারা সে কাজে লাগাতর প্রচেষ্টায় নামে। পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের সে ঘোষণাটি হলো: “ওয়াল্লাযীনা জাহাদু ফি’না লা’নাহদিয়ান্নাকুম সুবুলুনা।” অর্থ: “এবং যারা আমার পথে প্রচেষ্ঠা করবে আমি অবশ্যই তাদেরকে পথ দেখাবো।” – (সূরা আন কাবুত)। হিদায়েতে খোঁজে প্রচেষ্টার সে কাজটি আদৌ অজ্ঞতায় হয় না, সেটি হয় পবিত্র কোর’আন থেকে লব্ধ জ্ঞানশক্তি বলে। তাই সে জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনটি সবার। প্রতিটি নারী-পুরুষের উপর জ্ঞানার্জন এজন্যই ফরজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন: ’ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহি উলামা।’ অর্থ: মানবসৃষ্টির মাঝে একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে। তবে জ্ঞানী হওয়ার অর্থ মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাটিফিকেটধারী হওয়া নয়, ইসলামের সর্বাধিক গৌরব কালে সেরূপ সাটিফিকেট কোন ব্যক্তিরই ছিল না। বরং সে জ্ঞানী ব্যক্তি হলেন তিনিই -যার রয়েছে আল্লাহতায়ালার অপার কুদরাত অনুধাবনের সামর্থ্য। সামর্থ্য রয়েছে আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপ থেকে পাঠোদ্ধারের। বস্তৃতঃ ইসলামই হলো সিরাতুল মোস্তাকিম এবং পবিত্র কোরআন হলো সে পথের রোড ম্যাপ। সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে পদে পদে এ রোডম্যাপের অনুসরণটি ফরজ, নিছক তেলাওয়াত নয়। এবং এটির অনুসরণই হলো ইবাদত। অথচ পরিতাপের বিষয়, মুসলিম বিশ্বে সাটিফিকেটধারীর সংখ্যা বাড়ালেও আল্লাহতায়ালার দেয়া রোডম্যাপ বুঝতে পারে এমন ব্যক্তির সংখ্যা বাড়েনি। বাড়েনি অনুসরণকারীর সংখ্যাও। বরং বাস্তবতা হলো, মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বৃদ্ধ প্রফেসর ততটুকুই বিভ্রান্ত যতটুকু বিভ্রান্ত বস্তির একজন নিরক্ষর ব্যক্তি। জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, দলতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সেকুলারিজমের ন্যায় ভ্রষ্ট মতবাদও বিস্তর অনুসারী পায় তো এ গভীর বিভ্রান্তির কারণেই। এ বিকট বিভ্রান্তি কি নিছক সম্পদ দিয়ে দূর হবার?
যে ব্যর্থতা নামাযে
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহশে ওয়াল মুনকার।” অর্থ: “নিশ্চয়ই নামায অশ্লিলতা ও খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।” নামায কতটা সত্যিকারের নামায -সেটির যাচাইয়ে এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত মানদন্ড। প্রশ্ন হলো, কোটি কোটি মানুষের নামায এ মানদন্ডে কতটা সফল? নামায কতটা ফিরাচ্ছে অশ্লিলতা ও খারাপ কাজ থেকে? কাজ যে দিচ্ছে না তার প্রমান, বিশ্বে দূর্নীতিতে প্রথম কোন অমুসলিম দেশ নয় বরং বেশ কিছু সলিম দেশগুলি। বাংলাদেশ একাই দূর্নীতিতে ৫ বার বিশ্বে প্রথম হয়েছে। অথচ এই বাংলাদেশ পরিচিত মসজিদের দেশরূপে। কিন্তু লজ্জাজনক এ ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশী মুসলিমদের আত্মসমালোচনা কতটুকু?
ব্যক্তির জীবনে নামায একমাত্র তখনই পরিশুদ্ধি আনে যখন নামাযে উচ্চারিত পবিত্র কোর’আনের আয়াতগুলো চেতনায় জাগরন তোলে; এবং আনে ধ্যানমগ্নতা। তখন ঘুমন্ত ও সুপ্ত বিবেকও তখন জেগে উঠে। নামাযের এ উচ্চারণগুলো হলো মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার কসম বা অঙ্গিকার -যা প্রতিদিন বহুবার সে উচ্চারণ করে। যেমন প্রতি রাকাতে বলে, “ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তায়ীন।” অর্থ: “আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য চাই।” কিন্তু ইবাদতের অর্থ কি -সে হুশ ক’জনের? ক’জনের জীবনে সে পূর্ণ ইবাদত? প্রতি রাকাতে পাঠ করা হয়, “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম, সিরাতাল্লাযীনা আনআমতা আলায়হীম গায়রিল মাগদু’বি আলায়হীম ওয়া লাদ্দোয়ালীন।” অর্থ: “(হে আল্লাহতায়ালা, আমাদের দেখান সিরাতুল মুস্তাকীম -সেই পথ যার উপর নাযিল করেছেন আপনার করুণা এবং তাদের পথ নয় যারা অভিশপ্ত এবং পথভ্রষ্ট।” অথচ কর্মজীবনে অসঙ্গতিটি বিশাল। নামাজে চাওয়া হচ্ছে সিরাতুল মুস্তাকীম অর্থাৎ পবিত্র কোর’আনের পথ, অথচ রাজনীতি, আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ জীবনের তাবত অঙ্গণে সজ্ঞানে অনুসরণ করা হচ্ছে শয়তানের পথ তথা অবাধ্যতার পথ।
নামাযে দাঁড়িয়ে নামাযী যেসব বিষয়ে কসম করে, কর্ম জীবনে যদি তার প্রয়োগ না করে -তবে সে নামাযে পরিশুদ্ধি আসবে কেমনে? কসম ভাঙ্গা তো মুনাফিকি। নামায পড়েও যে মানুষ মুনাফিক হওয়া -সেটি তো নবীজী (সা:)র যুগেও দেখা গেছে। নামায তো তখনই পরিশুদ্ধি আনে যখন বিবেকের ভূমিতে বিপ্লব আনে। তখন বিপ্লব আসে জীবনের মিশন নিয়ে উপলদ্ধিতে। উপলদ্ধির এ গুণই তো মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে। তখন বিপ্লব আসে ব্যাক্তির কর্মেও। পবিত্র কোর’আনে তাই ’আফালা তা’কিলুন’, ’আফালা তাদাব্বারুন’ অর্থাৎ “তোমরা কেন বুদ্ধিকে কাজে লাগাও না” এবং “তোমরা কেন চিন্তাভাবনা করো না” –এ প্রশ্নগুলো বার বার করা হয়েছে। কোরআনের জ্ঞানতো তায়াক্কুল ও তাদাব্বুরের সামর্থ্যই বাড়ায়। এজন্যই কোর’আনের জ্ঞানার্জন ফরজ। ব্যক্তির চেতনার পুষ্টি বৃদ্ধিতে এর চেয়ে উত্তম উপকরণ নেই। কোর’আনী জ্ঞানের সে সামর্থ্যটি দেখা গেছে খোলাফায়ে রাশেদার যুগে। সে আমলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও যে ভাবে হাজার বিজ্ঞ দার্শনিক পয়দা হয়েছেন মুসলিম বিশ্বের বহু হাজার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার শতভাগের এক ভাগও হচ্ছে না। পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া মৃত বলেই নামাযীদের সংখ্যায় বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান নিয়েও বাংলাদেশ দূর্নীতিতে প্রথম হয়। কারণ, নামাযের সংখা বাড়লেও ওজন বাড়েনি। কথা হলো, যে নামায পরিত্রাণ দিচ্ছে না পাপকর্ম থেকে, পরিত্রান দিবে কি পরকালে? ভান্ডারে কোটি কোটি অচল নোট জমিয়ে কি লাভ হয়? তেমনি ওজনহীন অসংখ্য নামাযই বা পরকালে কী কল্যাণ আনবে? কল্যাণের কিছু থাকলে সেটির প্রভাব পড়া উচিত ছিল নামাযীর কর্ম ও আচরণে।
বাংলাদেশে নামাযীদের ব্যর্থতার কারণ, কোর’আনের তেলাওয়াত গুরুত্ব পেলেও গুরুত্ব পায়নি কোর’আনের জ্ঞানার্জন। নফলের চর্চা বাড়লেও ফরজ কাজটি গুরুত্ব পায়নি। সমস্যা শুধু ইবাদত নিয়েই নয়, ইবাদতের প্রায়োরিটি অর্থাৎ কোনটি অধিক জরুরি সেটির নির্ধারণ নিয়েও। ফলে মুসলিম রূপে যেভাবে বেড়ে উঠা উচিত ছিল -সেটিই হয়নি। আর ইবাদতে ব্যর্থ, বিভ্রান্ত বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে মুসলিম জীবনে কি আদৌ সফলতা বা গৌরব মিলে? ব্যক্তিগঠন, জাতিগঠন বা সমাজ-উন্নয়নের ন্যায় সকল কল্যাণ-কর্মে আত্মনিয়োগে অবিরাম অনুপ্রেরণা আসে তো ইবাদতে আত্মনিয়োগ থেকেই। ইবাদত যথার্থ হলে উম্মাহর কল্যানে শুধু অর্থদান ও শ্রমদান নয়, প্রাণদানে আগ্রহী ব্যক্তিরও অভাব হয় না। যুগে যুগে মুসলিমগণ এ পথেই গৌরবজনক ইতিহাস গড়েছে। আজও কি এছাড়া ভিন্ন পথ আছে? ১ম সংস্করণ ০৪/০১/২০০৩; ২য় সংস্করণ ২৬/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018