অধ্যায় আট: ইয়াহিয়া-মুজিব-ভূট্টোর ব্যর্থ বৈঠক

 অবিশ্বাসের রাজনীতি

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় কায়েদে আযম মুহ্ম্মদ আলী জিন্নাহ ঈমান, একতা ও শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সে নীতির ভিত্তিতেই বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু প্রদেশ ও বহু মজহাবে বিভক্ত ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে তিনি একতা গড়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-অবধি সে একতা ও বিশ্বাস অটুট ছিল। ফলে বাঙালী, আসামী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বিহারী, গুজরাতী এরূপ নানা ভাষার শিয়া-সূন্নী-দেওবন্দি-বেরেলভী মুসলমানেরা তাঁকে অবিসংবাদিত নেতা রূপে বরণ করে নেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বহু শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে এমন একতা আর কোন কালেই প্রতিষ্ঠা পায়নি। কায়েদে আযম এক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় নেতা। একতার শক্তি অসামান্য। সে একতার বলেই তিনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের প্রবল বাধা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন। মুসলিম একতার সবচেযে বড় নিয়ামতটি হলো, এটি মহান আল্লাহতায়ালার অপার রহমত নামিয়ে আনে। আর অনৈক্য নামিয়ে আনে কঠিন আযাব -যার হুশিয়ারি মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। বলা হয়েছে, “তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হলো এবং নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলো। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।”–(সুরা আল ইমরান আয়াত ১০৫)। অর্থাৎ মুসলমানদের মাথার উপর মহান আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনার জন্য অনৈক্যের ন্যায় কবিরা গুনাহটিই যথেষ্ট।

তবে বাস্তবতা হলো, মুসলিম ইতিহাসে যেমন নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণের মানুষের মাঝে সীসাঢালা দেয়ালের মত অটুট ঐক্যর ইতিহাস আছে, তেমনি রক্তাত্ব সংঘাতের ইতিহাসও আছে। মুসলমানদের মাঝে সংঘটিত প্রতিটি যুদ্ধই ভাতৃঘাতি। সেরূপ ঘটনা যে কেবল হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ) এবং তার পুত্র এজিদের হাতে ঘটেছে তা নয়। পরেও বহুবার ঘটেছে। এরূপ ভাতৃঘাতি সংঘাত কীরূপে মহান আল্লাহতয়ালার আযাব ঢেকে আনে পবিত্র কোরআনে যে চিত্রটি বার বার তুলে ধরা হয়েছে –বিশেষ করে বনি ইসরাইলের ইতিহাস থেকে। সমগ্র মানব জাতির জন্য সেটি এক শিক্ষণীয় দিক। তারা নিজেরা নানা গোত্রে বিভক্ত হয়েছে এবং নিজ হাতে নিজ গোত্রের নবীদেরকে হত্যা করেছে। এমন কি হযরত ঈসা (আঃ)এর মত মহান নবীকে রোমান কাফেরদের হাতে তুলে দিয়েছে, এবং তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যার জন্য জেরুজালেমের রোমান শাসকের উপর চাপও দিয়েছে। একই রূপ সংঘাতের দিকে দ্রুত এগুতে থাকে পাকিস্তানের রাজনীতিও। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছর এক মাস পর কায়েদে আযমের ইন্তেকাল ঘটে। তার মৃত্যুর কিছুদিন পরই রাওয়ালপিণ্ডির এক জনসভায় আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নবার লিয়াকত আলী খান। পাকিস্তানের সামনে তখন শাসনতন্ত্র রচনার ন্যায় বহু জটিল সমস্যা। সে জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের সর্ব-এলাকায় গ্রহণযোগ্য বলিষ্ঠ, সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্ব। কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর তেমন নেতৃত্বের অবসান ঘটে।তাঁর শূণ্যস্থান পূরণের মত সমমানের কোন নেতা সে সময় সমগ্র পাকিস্তানে ছিল না। গান্ধির জন্ম না হলেও ভারত নিশ্চিত স্বাধীন হতো, কিন্তু কায়েদে আয়ম না হলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়তো আদৌ হত না। তাঁর মৃত্যুতে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে দেশটির বেঁচে থাকাতেও। জিন্নাহর মৃত্যুর পর পারস্পারীক একতা ও বিশ্বাসের সে রাজনীতি আর অটুট থাকেনি। পাকিস্তানীরা দারুন ভাবে ব্যর্থ হয় জিন্নাহর মত সর্ব-পাকিস্তান ভিত্তিক জনপ্রিয় দ্বিতীয় একজন নেতার জন্ম দিতে। একটি দেশ বিজ্ঞানী, ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার বা কবি-সাহিত্যিক জন্ম দিতে না পারলেও হয়তো বেঁচে থাকে।কিন্তু বিপর্যয় ঘটে যোগ্য নেতা জন্ম না দিলে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। জিন্নাহর মৃত্যুর পর বাঁকি নেতাদের সবচেয়ে বড় দৈন্যতাটি হলো, তাদের পরিচিত ও রাজনীতি ছিল তাদের নিজ নিজ প্রদেশে সীমিত। নিজ নিজ ভাষা, গোত্র এবং ক্ষুদ্র ভূগোলের উর্দ্ধে উঠার সামর্থ যেমন ছিল না, তেমন ইচ্ছাও তাদের ছিল না। বরং নিজেদের প্রদেশভিত্তিক নেতৃত্বকে মজবুত করতে গিয়ে তারা অখণ্ড পাকিস্তানের কল্যাণ ভূলে নিজ নিজ এলাকার স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ফলে দ্রুত বেড়ে উঠে আঞ্চলিকতা এবং শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যের সাথে বেঈমানী। শুরু হয় অনৈক্য ও অবিশ্বাসের রাজনীতি। পাকিস্তানের ধ্বংসে যে কোন বিদেশী শত্রুর চেয়ে তাদের নিজেদের ভূমিকাই তখন বেশী বিধ্বংসী রূপ নেয়।

এসব আঞ্চলিক নেতাদের রাজনীতি এতোটাই নিজ নিজ এলাকায় বন্দী হয়ে পড়েছিল যে, ১৯৭০এর নির্বাচনে শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভূট্টোর মত প্রধান নেতাগণ নিজ নিজ প্রদেশের বাইরে অন্য প্রদেশে নির্বাচনী প্রচারনায় নামার প্রয়োজনও বোধ করেনি। সর্ব-পাকিস্তানী নেতা রূপে আবির্ভাবের কোন আগ্রহও তাদের মধ্যে জাগেনি। ১৯৭১ এসে তাদের মাঝে পারস্পারীক অবিশ্বাস এতোটাই চরম পর্যায়ে পৌছেছিল যে, এক নেতা অপর নেতার সাথে আলোচনায় বসা দূরে থাক, মুখ পর্যন্ত দেখতে চায়নি। তারই এক বর্ণনা দিয়েছেন মার্কিন গবেষক এবং প্রফেসর রিচার্ড সিশন এবং প্রফেসর লিও রোজ তাঁদের বইতে। এ দুই মার্কিন প্রফেসর একাত্তরের যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। বইয়ের নাম “War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh”। তথ্য সংগ্রহে তাঁরা দুইজন পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের সেসব ব্যক্তিদের সাথে দেখা করেছেন যারা ছিলেন সে সময়ের রাজনীতির মূল নিয়ন্ত্রক। সাক্ষাতদাতাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রেসডেন্ট ইয়াহিয়া খান, লে.জেনারেল নিয়াজী, এয়ার মার্শাল নূর খান, লে.জেনারেল হামিদ খান, লে.জেনারেল পীরজাদা, লে.জেনারেল সাহেবযাদা ইয়াকুব খান, এডমিরাল আহসান, মেজর জেনারেল রাও ফারমান আলী, অধ্যাপক গোলাম মাওলা চৌধুরী , একে ব্রোহী, মিয়া মমতাজ দৌওলাতানা, মমতাজ ভূট্টো, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি, লে. জেনারেল অরোরা, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ক ভারতীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কে.সি পান্ত, পশ্চিম পাকিস্তান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রি রাম নিবাস মির্ধা, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা পি.এন.হাকছার, পি.এন.ধর এবং বাংলাদেশের জেনারেল ওসামানি, ড.কামাল হোসেন, প্রশাসনিক আমলা শফিউল আযম, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানসহ বহু ব্যক্তি। এ বইতে বেরিয়ে এসেছে ইতিহাসের বহু অজানা কথা।

 

আলোচনায় অনীহা

রাজনীতি মানব ইতিহাসের অতি উচ্চাঙ্গের আর্ট বা শিল্প। ইসলামে এটি পবিত্র ইবাদত। কিন্তু ভয়ানক বিপর্যয় দেখা দেয় যখন সেটি ইয়াজিদ বা মীরজাফরদের মত দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয়। যারা ছোট চেতনার ছোট ছোট মানুষ তাদের মনে থাকে শুধু নিজের ঘর, নিজের কর্ম ও নিজের বাণিজ্য নিয়ে ভাবনা। এ ভাবনার মধ্যেই তারা ডুবে যায় এবং পশু-পাখি ও উদ্ভিদের ন্যায় ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যায়। একারণেই সভ্যতা নির্মানের সামর্থ্য সকল দেশের সকল নাগরিকদের থাকে না। তাই বহু দেশের বহুশত কোটি মানুষ ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে কোন সভ্যতার চিহ্ন না রেখেই। অথচ চিন্তা-চেতনায় যারা উচ্চতর,তারা শুধু নিজের ঘর, কর্ম বা বাণিজ্য নিয়ে ভাবে না। তারা ভাবে এবং সে সাথে নিজেদের সর্ববিধ সামর্থের বিনিয়োগ করে একটি উচ্চতর সভ্যতা গড়া নিয়ে। তবে সভ্যতা গড়ার কাজ একাকী হয় না। ক্ষুদ্র দেশের সীমিত জনগোষ্ঠী দিয়েও হয় না। নিজ ভাষা, নিজ অঞ্চল ও নিজ বর্ণের ক্ষুদ্রতা ডিঙ্গিয়ে অন্যভাষা, অন্য অঞ্চল ও অন্য বর্ণের মানুষের সাথে একাত্ম হতে হয়। গ্রীকরা তখনই সভ্যতা গড়তে পেরেছিল যখন তারা আলেকজাণ্ডারের নেতৃত্বে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে এক বিশাল রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছিল। গ্রীসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রের পক্ষে এমন একটি যুগান্তকারি সভ্যতার নির্মাণ সম্ভব ছিল না। ইসলামী সভ্যতার নির্মানেও মুসলমানদের তাই মক্কা-মদিনার ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতে হয়েছিল। ইরান, তুরান, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, ভারত, মধ্য-এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিভা ও সামর্থের মিলন ঘটাতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে এমন একটি মহত্তর প্রেরণা নিয়েই বাংলার মুসলিমগণও উপমহাদেশের অন্যভাষী মুসলিমদের সাথে একাত্ম হয়েছিল। বাংলার মুসলিম ইতিহাসে এটি ছিল এক বিপ্লবী সিদ্ধান্ত। কিন্তু ইসলামী সমাজ ও সভ্যতা-বিমুখ মানুষের কাছে সেটি ১৯৪৭ সালেও যেমন ভাল লাগেনি, তেমনি ভাল লাগেনি ১৯৭১ সালেও। তাদের কাছে বাঙালীর ভাষা ও ভূগোলের পরিচয়টিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এর বাইরে যেতে তারা রাজী ছিল না। অথচ মুসলমানের জীবনে অতিশয় মহান কর্ম হল শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র-নির্মাণ। ইসলামে এটি পবিত্র জিহাদ। মুসলমান জান্নাত পায় এ মহান কর্মে আত্মত্যাগের কারণে। প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কোরবানীটা হয়েছে একাজে। নবীজী (সাঃ) অধিকাংশ সাহাবী সে কাজে শহীদ হয়ে গেছেন; নামায-রোযার প্রসার বাড়াতে এতো রক্ত কোন কালেই ব্যয় হয়নি। তাদের সে আত্মত্যাগের ফলেই গড়ে উঠেছে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। আর মুসলিমগণ যুগে যুগে সে প্রেরণাটি পেয়েছে তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও দর্শন থেকে। বস্তুত সে বিশ্বাস ও প্যান-ইসলামীক দর্শনই তাঁদের রাজনীতির মূল ভিত্তি।

মুসলিম রাজনীতির মূল কথা, ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ক্ষমতা দখল নয়। বরং শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র নির্মানের লক্ষ্যে মানুষের মাঝে সংযোগ, সমঝোতা ও একতা গড়া। উচ্চতর সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার নির্মানে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। রাজনীতির এটাই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীলতা। অন্য যে কোন পেশার চাইতে রাজনীতি এজন্যই শ্রেষ্ঠ। তাই মুসলিম সমাজে এমন রাজনীতির হাল ধরেছেন নবীজী (সাঃ) স্বয়ং এবং তার শ্রেষ্ঠ সাহাবারা। এমন সৃষ্টিশীল রাজনীতি ছাড়া উচ্চতর সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার জন্ম নেয় না, সুস্থ সমাজ বা সভ্যতা টিকেও থাকে না। বরং এমন সৃষ্টিশীল রাজনীতির অভাবে সমাজে রক্তাত্ব বিভক্তি ও সংঘাত দেখা দেয়। রাষ্ট্র তখন নানা গোত্র,নানা বর্ণ ও নানা ভাষাভাষীর বিভিন্নতায় টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রাজনীতিতে এমন বিভক্তি এবং সংঘাতের কারণে সামাজিক শান্তি বা গৌরবই শুধু বিপন্ন হয় না, রাষ্ট্র তখন পরাজয়ের মুখে পড়ে, এমনকি ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যায়। ভারতের নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলে বিভক্ত মুসলমানেরা ১৯৪৭ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিল সে সৃজনশীল রাজনীতির কারণে। তাদের চেতনায় তখন বিশ্বমাঝে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু সে রাজনীতি তার সুস্থ সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে স্বার্থপর নেতাদের কারণে। রাজনীতিকে সৃজনশীল করতে হলে নেতাদের মাঝে যে গুণটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো দেশ নিয়ে নিঃস্বার্থ ভাবনা, আলাপ-আলোচনা, সমঝোতা ও ত্যাগ-স্বীকারের সামর্থ্য। চাই উচ্চতর দর্শন। সেটি যেমন ট্রাইবাল নেতাদের দ্বারা সম্ভব নয়। তেমনি স্রেফ দলীয় চেতনাতেও সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জরুরী হলো,ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের জিঞ্জির ভেঙ্গে নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণে বিভক্ত মানুষের মাঝে একতা গড়ার প্যান-ইসলামীক চেতনা। উদ্ধত জ্বালাময়ী বক্তৃতার সামর্থ একজন ট্রাইবাল নেতা ও দুর্বৃত্ত প্রতারকেরও থাকে। বরং এমন বক্তৃতাকে তারা প্রতিষ্ঠা লাভের বড় হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের যোগ্যতার প্রকৃত বিচার হয় দেশবাসীর মাঝে ভাতৃত্ব, মানবপ্রেম, উচ্চতর চরিত্র ও আত্মত্যাগ সৃষ্টির সামর্থ এবং ঘোরতর প্রতিদ্বন্দীর সাথেও সমঝোতা স্থাপনের কুশলতা দেখে। রাজনৈতিক নেতাগণ আবিস্কারক হবেন, ভালো ব্যবসায়ী বা দার্শনিক হবেন -সেটি আশা করা যায় না। তবে এটুকু অবশ্যই আশা করা হয়, তারা সৎ হবেন, ওয়াদা পালনে নিষ্ঠাবান হবেন এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ভদ্র এবং শান্তভাবে গঠনমূলক মতবিনিময়ের সামর্থ্য রাখবেন। তারা যেমন রাজনৈতিক ময়দানের অন্যান্য খেলোয়াড়দের সাথে একত্রে বসবেন,তেমনি বিভিন্ন জটিল বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি আপোষরফায়ও পৌঁছবেন। একমাত্র এ পথেই একটি দেশের জনগণ ভয়ানক রক্তক্ষয় থেকে বাঁচে। আপোষে অনিহা থাকলে তখন শুধু সংঘাতই অনিবার্য হয়। এরূপ যোগ্যতার বলেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান স্থাপনে সফল হয়েছিলেন। তিনি যেমন গান্ধির সাথে আলোচনায় বসেছেন, তেমনি বসেছেন মাউন্টব্যাটেনের সাথেও। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের সাথে আলোচনা করার লক্ষে সে সময় মহম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মহম্মদ আলী জওহর, মাওলানা শওকত আলী ও করম চাঁদ গান্ধির ন্যায় ভারতের স্বাধীনতাকামী নেতাগণ সাতসমূদ্র পাড়ি দিয়ে সূদুর লণ্ডনে গিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এ বৈঠকগুলো গোল টেবিল বৈঠক রূপে পরিচিত।

 

সংকট রাজনৈতিক ভদ্রতায়

কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে সে কালচারটি তেমন গড়ে উঠেনি। আলোচনার বৈঠকে বসার রুচী যেমন শেখ মুজিবের ছিল না, তেমনি ভূট্টোরও ছিল না। এমনকি ভাষানীরও ছিল না। তাদের মাঝে উচ্চতর রাজনৈতিক দর্শনও ছিল না। পাকিস্তানের যখন ভয়ানক দুর্দিন সে মুহুর্তটিতেও শেখ মুজিব এবং জূলফিকার আলী ভূট্টো একত্রে বসতে রাজী হননি। মুজিব যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে রাজী হননি, ভূট্টোও তেমনি পূর্ব পাকিস্তানে আসতে রাজী হয়নি। শেখ মুজিব দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনায়ও তেমন আগ্রহ দেখাননি। নিতান্তই চাপের মুখে যখন আলোচনায় বসেছেন তখন ভদ্রভাবে একে অপরের সাথে কথা বলতেও রাজী হননি। তাদের সে অনাগ্রহটি তুলে ধরেছেন প্রফেসর রিচার্ড সিশন এবং প্রফেসর লিও রোজ। ১৯৭১ এর ফেব্রেয়ারির শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবের সাথে সাক্ষাতের জন্য ইসলামাবাদে যাওয়ার জন্য দাওয়াত করেন। কিন্তু মুজিব সেখানে যেতে অস্বীকার করেন। পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের ৪টি পশ্চিম পাকিস্তানে, ফলে সেখানে গেলে পাকিস্তানের জাতীয় নেতা রূপে তার ভাবমুর্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল। সরকার গঠনে তিনি হয়তো ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নেতা মূফতি মাহমুদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা পাঞ্জাবের মমতাজর দৌলতানার সমর্থন হয়তো পেতেন। কিন্তু তা নিয়ে তাঁর কোন আগ্রহই ছিল না। শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাতের গুরুত্ব তুলে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর এ্যাডমিরাল আহসান। শেখ মুজিব এরপরও বৈঠকে রাজী হননি। মুজিবের অহংকার, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নিরুংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা। তাঁর কথা, তাঁর সাথে দেখা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বরং ঢাকায় আসতে হবে। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় বদ গুণ অহংকার। এ বদগুণটি ফিরাউন ও নমরুদের ছিল -যা তাদের জন্য আযাব ডেকে এনেছিল। আল্লাহতায়ালা মানুষের বহু গুনাহ মাফ করেন। কিন্তু অহংকারকে নয়। নবীজীর (সাঃ)র হাদীসঃ অহংকারিদের জন্য জান্নাতের দরজা বন্ধ। অথচই সে অহংকার চেপে বসেছিল সে সময়ের দুই নেতার ঘাড়ে। পরিণতিতে এ অহংকার তাদেরও নিজেদের জীবনেও বিশাল অক্যাণ ডেকে এনেছে।

শুরু থেকেই শেখ মুজিবের মনে শুধু যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপর অবিশ্বাস ছিল তা নয়, অবিশ্বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের উপরও। মুজিবের ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জনাব ভুট্টোকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। জনাব ভূট্টো শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন। ইয়াহিয়া খানও চাচ্ছিলেন একটি জাতীয় সরকার গঠিত হোক। শেখ মুজিবের যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলীর কোন সদস্যই ছিল না, আওয়ামী লীগের একক সরকার গঠিত হলে সেটি পশ্চিম পাকিস্তানের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীর শাসন রূপে চিত্রিত হতো। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে কোন সময়েই কেন্দ্রে কোন একক প্রদেশের লোক নিয়ে সরকার গঠিত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যখন কেউ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তখন গভর্নর জেনারেল বা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল –এ দাবীতে কেন্দ্রে শুধু এ দলটি নিয়ে কোন একক দলীয় সরকার গঠিত হলে সেটি গণতান্ত্রিক ভাবে সিদ্ধ হলেও নৈতিক বা রাজনৈতিক ভাবে সিদ্ধ হতো না। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে গৃহিত হতো না।

পাকিস্তান বাংলাদেশের ন্যায় একটি মাত্র প্রদেশ ভিত্তিক কোন দেশ নয়। সে সময় পাকিস্তানে ছিল ৫টি প্রদেশ। তাই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে শুধু একটি মাত্র প্রদেশে জনপ্রিয় হলে চলে না, অন্যান্য প্রদেশের জনগণকেও সাথে নেয়ার দায়িত্বটিও তাকে বহন করতে হয়। কিন্তু সে দায়িত্ব বহনের সামর্থ্য আওয়ামী লীগের ছিল না, তা নিয়ে আগ্রহও ছিল না। সে সামর্থ্যটি বিলুপ্ত হয় মুজিবের নেতৃত্বাধীনে।তিন দলটিকে নিছক একটি প্রাদেশিক দলে পরিণত করেন। অথচ মুজিবের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের নবাবজাদা নাসরুল্লাহ খান। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে দলটি জিতেছিল একটি মাত্র প্রদেশ থেকে। ফলে পাকিস্তানের অন্য ৪টি প্রদেশে দলটির কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশে এমন অবস্থায় কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। অথচ সেরূপ কোয়ালিশনেও আওয়ামী লীগের আগ্রহ ছিল না। বরং জিদ ধরেছিল, যেহেতু পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল,অতএব শাসনতন্ত্র রচনা এবং দেশ শাসনের একক অধিকার একমাত্র তাদের। তাদের দাবী, অন্যদের উচিত তাদের শাসন এবং তাদের রচিত শাসনতন্ত্র বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া। গণতন্ত্র বলতে তারা এটুকুই বুঝতো। এ বিষয়ে শেখ মুজিব কোনরূপ আপোষরফায় রাজী ছিলেন না। অথচ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চাচ্ছিলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে দুই প্রদেশের নেতাদের সাথে একটা সমঝোতা হোক। আর সে সমঝোতা না হওয়ায় ইয়াহিয়া খানকে জাতীয় পরিষদের বৈঠককে মুলতবি করতে হয়েছিল। কিন্তু সে মুলতবির পর শুরু হয় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট। সে সময় ভূট্টোকে ক্যাবিনেটে অংশ দেয়ার বিরুদ্ধে মুজিবের যুক্তি ছিল ‘ভূট্টো হলো একটি “ট্রোজান হর্স”। অপরদিকে ভূট্টোর অবিশ্বাসও কমছিল না। তার দুর্ভাবনা ছিল,আর্মি হয়তো তাকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখবে। তাই আর্মির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করতে তিনি মুজিবকে বলেছিলেন, “আর্মি কখনই বাঙালীর হাতে ক্ষমতা দিবে না।” শেখ মুজিবও চেষ্টা করেছেন আর্মির বিরুদ্ধে জনাব ভূট্টোকে খ্যাপাতে। শেখ মুজিব ভূট্টোকে বলেছিলেন আর্মিকে বিশ্বাস না করতে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হুশিয়ার করে দিয়ে শেখ মুজিব ভূট্টোকে বলেছিলেন, “সেনাবাহিনী আমাকে ধ্বংস করতে পারলে আপনাকেও ধরবে।” -(Sisson and Rose, 1990)। এই হলো সে সময়কার নেতাদের পারস্পারিক অবিশ্বাসের নমুনা।

 

বাঙালী শাসনের ভয়

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত্তি ছিল প্যান-ইসলামী চেতনা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার স্থান এ আন্দোলনে ছিল না। তখন ভাষা ও প্রদেশভিত্তিক বিভিক্তকে মুসলিম উম্মাহর জন্য অতি আত্মবিনাশী এবং ইসলাম বিরোধী রূপে চিত্রিত করা হতো। বিভিন্ন ভাষা ও বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত হিন্দুরাও সেদিন এক হিন্দুস্থানী জাতীয়তার ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীরা ভাসতে শুরু করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের জোয়ারে। ফলে দেশটির জন্য দ্রুত দূর্দিনও ঘনিয়ে আসতে শুরু করে। এমন ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রথম জোয়ারটি শুরু হয় ১৯০৫ সালে,যখন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করে এবং পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ গড়ে। এ আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ছিল মূলত হিন্দু। বাংলার বিভক্তিতে হিন্দুদের স্বার্থহানি হবে -সে বিশ্বাস নিয়েই তারা বাঙালী জাতীয়তার শ্লোগান নিয়ে তুমুল আন্দোলন শুরু করেছিল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সে আন্দোলনে মাঠে নেমেছিলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তিনি গান ও কবিতা লিখেছেন। অবশেষে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকারকে তারা বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করে। কিন্তু হিন্দুরাই আবার সে বাঙালী জাতিয়তাবাদ পরিত্যাগ করে ১৯৪৭ সালে। তখন ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদ বর্জন করে তারা হিন্দু ধর্মভিত্তিক হিন্দুস্থানী জাতীয়তাকে গুরুত্ব দেয় এবং ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে খণ্ডিত করাকে অনিবার্য করে তোলে। তখন পূর্ব বাংলার বাঙালীদের পরিত্যাগ করে তারা অবাঙালী হিন্দুদের সাথে ভারতে যোগ দেয়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালী জাতীয়তাবাদের সে পতাকাটি তুলে নেয় বাঙালী হিন্দুদের বদলে বাঙালী মুসলমানেরা এবং সেটি প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর। সে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে যখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট ভাষা করার ঘোষণা দেয়। তৎকালীন সরকার উর্দুকে রাষ্টভাষার ঘোষণা দিয়েছিল পাকিস্তানের সংহতি মজবুত করার লক্ষ্যে, বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করার জন্য নয়। বাংলা ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানীর ভাষা হলেও সেটির চর্চা বাংলার বাইরে ছিল না। একই অবস্থা ছিল পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পশতু এ বেলুচ ভাষার। অথচ উর্দু ভাষা পাকিস্তানের প্রতি প্রদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মুসলিম বুঝতেো। পাকিস্তানের সকল প্রদেশের সকল মাদ্রাসাতে উর্দু ভাষাতে শিক্ষা দেয়া হত। সে সময় একমাত্র ঢাকা শহরে যত উর্দু ভাষী ছিল এবং এ ভাষায় যত বই ছাপা হত পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে সমগ্র পাকিস্তানে ততজন বাংলাভাষী ছিল না এবং বাংলার চর্চাও ছিল না। কিন্তু নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙালীরা তখন সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠার দাবী তোলে।

ব্রিটিশ শাসনের বিদায় ঘন্টা যখন বাজতে শুরু করে তখন মুসলিমদের মনে প্রচণ্ড ভয় সৃষ্টি হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু শাসনের বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতে তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। আর গণতন্ত্রের মূল কথা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সার্বভৌমত্ব বলতে বুঝায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সার্বভৌমত্ব। সংখ্যালঘিষ্টদের দাবী যত যৌক্তিকই হোক -সেটি মেনে নেয়ায় গণতন্ত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা -তা যত অযৌক্তিক এবং অমানবিকই হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সেটির প্রতিষ্ঠাই যে সাংবিধানিক বৈধতা পাবে সে ভয় ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মনে। তাদের সে ভয় আদৌ অমূলক ছিল না, বরং অতি সঠিক ছিল তার বড় প্রমাণ আজকের ভারত। মুখে সেক্যুলারিজমের কথা বললেও ভারতীয় নেতাগণ ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে সাথে হিন্দুধর্মের পৌরাণিক বিশ্বাস, দর্শন ও মুর্তিকে জাতীয় মর্যাদা দেয়। মুসলিমদের বাধ্য করা হয় ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক জাতীয় সঙ্গিত বন্দেমাতরম গানটি গাইতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুনেতাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি বাবরী মসজিদের ন্যায় একটি মসজিদের নিরাপত্তা দানের বিষয়টি। শিক্ষাদীক্ষা ও চাকুরিতে মুসলমানদের উন্নয়ন দূরে থাক, তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি এমন কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে মুসলমানদের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু বাঁচানোর ন্যায় অতি মৌলিক মানবিক বিষয়গুলিও। একই কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের বিরুদ্ধে ভয় দানা বাঁধতে থাকে পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশবাসীদের মনে। আর সে ভয়ই তীব্রতর হয় ভাষা আন্দোলনের পর। সে ভয় আরো তীব্রতর হয় ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং বিজয় শেষে শাসনতন্ত্র রচনায় ও সরকার গঠনে শেখ মুজিবের আপোষহীন মনভাবের কারণে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কোন কোন বাঙালী বুদ্ধিজীবী দাবী তোলেন, সমগ্র পাকিস্তানের উপর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে। তাদের যুক্তি, বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। পাঞ্জাবী, সিন্ধু, পাঠান,বেলুচ এবং ভারত থেকে আগত গুজরাতি, রাজস্থানী, বিহারী, মারাঠী ইত্যাদী ভাষাভাষীদের কারোই মাতৃভাষা উর্দু ছিল না। কিন্তু মাতৃভাষা না হলেও উর্দূ বর্ণমালা ও সাহিত্যের সাথে তাদের পুরনো পরিচিত ছিল। কিন্তু সে অবস্থান বাংলা ভাষার ছিল না।

 

সেনাবাহিনীর দুশ্চিন্তা

সত্তরের নির্বাচন কালে পাকিস্তান আর্মির দুটো মৌলিক বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা ছিল -যার নিষ্পত্তি তারা সে নির্বাচনের যারা বিজয়ী হয়েছিল তাদের কাছ থেকে আশা করছিল। তা ছিল, এক). পাকিস্তানের সংহতি, দুই). পাকিস্তান আর্মির বাজেট, সেনাবাহিনীর অফিসারদের প্রমোশন, পোষ্টিং ও লজিস্টিক নিয়ে আর্মির স্বাধীনতার বিষয়। এ দুটি বিষয়ের বাইরে প্রদেশগুলির স্বায়ত্বশাসনের বিষয়ে ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সহকর্মিরা ছিল পূর্ববর্তী সরকারগুলোর তুলনায় অনেক বেশী উদার। ফলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দেন এবং পুনরায় পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্তপ্রদেশ এবং বেলুচিস্তান এ চারটি প্রদেশের জন্ম দেন। অথচ এ চারটি প্রদেশ ভেঙ্গে এক পশ্চিম পাকিস্তান গড়া হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানীদের বিরদ্ধে অবাঙালীদের একতাবদ্ধ শক্তি রূপে খাড়া করার জন্য। ইয়হিয়া খান এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানর জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নির্ধারিত করেন। ইয়াহিয়া খানের এরূপ সিদ্ধান্তের কারণে শেখ মুজিবও তাঁর উপর এতোটাই খুশি ছিলেন যে, তাঁকে নাকি শাসনতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাবও দেন। তবে সে প্রস্তাব পেশে নির্বাচনে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সেনাবাহিনীর সুনজর ও সহযোগিতা লাভের বিষয়টিই সম্ভবতঃ মুজিবের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়া সরকারের নিকট থেকে সে সহযোগিতা পেয়েছিলও প্রচুর। ইয়াহিয়া সরকারের প্রশ্রয়ের ফলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা নির্বাচনি প্রচারে অন্যান্য দলগুলোকে তেমন নামতেই দেয়নি।

১৯৭০এর নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের রাজনীতির চিত্রই পাল্টে দেয়। এ নির্বাচন শুধু সরকারকেই হতবাক করেনি, হতবাক করেছিল শেখ মুজিব এবং ভূট্টোকেও। শেখ মুজিব এবং জুলফিকার আলী ভূট্টো –এ দুজনের কেউই ভাবতে পারিনি তারা এতো বিপুল আসনে নির্বাচিত হবেন। নির্বাচনের আগে ভূট্টোর অবস্থা এমন ছিল যে, জনাব মমতাজ দৌলতানার কাউন্সিল মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পাঞ্জাবে তার দলকে মাত্র ২০টি সিট ছেড়ে দিলে তিনি তাঁর সাথে আপোষ করতে রাজী ছিলেন। কিন্তু দৌলতানা ভেবেছিলেন, ভূট্টোর দল পাঞ্জাবে ২০ সিটেও নির্বাচনী লড়াই পরিচালনার অর্থ জোগাতে পারবে না। ফলে তিনি ২০ সিঠ দিতেও রাজী হননি। কিন্তু শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ভূট্টোরও। পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা ভূট্টোকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী শাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিদ্বন্দি মনে করে এবং মুসলিম লীগের প্রবীন নেতাদের বদলে তাঁকে অর্থ জোগায়। ফলে নির্বাচনে দৌলাতানাদের অনুমান ভূল প্রমানিত হয়।-(Sisson and Rose, 1990)।

 

ভূট্টোর ক্ষমতালিপ্সা

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালের ১২ জানুয়ারি তিন দিনের জন্য ঢাকার আসেন এবং শেখ মুজিবের সাথ দুই বার দেখা করেন। একবার ছিল ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত বৈঠক। দ্বিতীয় বৈঠকটি ছিল তিন ঘন্টার। সে বৈঠকে আওয়ামী লীগের হাই কমাণ্ড উপস্থিত ছিল। ইয়াহিয়া খানের সাথে ছিল তাঁর দুইজন সহকারি। ঢাকার অবস্থান শেষে যাওয়ার আগে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী রূপে ঘোষণা দেন এবং একথাও বলেন তার কাজ এখন শেষ এবং প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রস্থানের। অপর দিক নির্বাচনে আশীতীত সাফল্যের পর ভূট্টোর ক্ষমতালিপ্সা এতোটাই প্রচণ্ড ছিল যে, ইয়াহিয়া খানকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, “আমি অপেক্ষা করতে পারবো না, এখনই ক্ষমতা চাই।” তিনি এ আভাসও দেন, পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেয়াই তার অদিষ্ট এবং সেকাজে কোন রূপ বিলম্ব হতে দিতে রাজী নয়। সরকারের এক উচচ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যে গদী না পেলে ভূট্টো বদ্ধ পাগল হয়ে যাবেন‍। মার্চের দিকে ভূট্টো অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ও সংঘাতমুখি হয়ে পড়েন। জাতীয় পরিষদে তার পার্টি একটি সংখ্যালঘিষ্ট পার্টি রূপে আবির্ভূত হলেও তিনি পিপলস পার্টিকে দুই মেজোরিটি পার্টির একটি রূপে দাবী করেন। শেখ মুজিবের সাথে জানুয়ারির সাক্ষাতে মুজিবকে কেন পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তাতে তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিলেন। -(Sisson and Rose, 1990)। জনাব ভূট্টো একথাও বলেন, আওয়ামী লীগ শুধু একমাত্র প্রদেশের দল, অতএব কি করে সে দল সমগ্র পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার রাখে? তার দাবী, পিপলস পার্টি পাঞ্জাব ও সিন্ধু এ দুটি প্রদেশ থেকে নির্বাচিত হয়েছে। অতএব যে কোন সরকার গঠনে অবশ্যই পিপলস পার্টির অংশদারিত্ব থাকতে হবে। অপরদিকে শেখ মুজিবের দাবী ছিল, নির্বাচন ছিল ৬ দফার উপর রিফারেণ্ডাম, বিশ্বের কোন শক্তি ৬ দফার বাস্তবায়ন রুখতে পারবে না। সরকার প্রতিষ্ঠায় তিনি জনাব ভূট্টো থেকে কোনরূপ সহযোগিতা নিতে আগ্রহী ছিলেন না। সরকার গঠন নিয়ে তাই ভূট্টোর সাথে কোনরূপ আলাচনায় বসতে রাজী হননি।

অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলিতে শেখ মুজিব এবং জনাব ভূট্টোর মধ্যে কোন রূপ যোগাযোগোই ছিল না। এমনকি তাদের মধ্যে সৌজন্যমূলক আচরণও লোপ পেয়েছিল। এবং সে বিবরণটিও দিয়েছেন Sisson and Rose। ইয়াহিয়া খান ১৫ই মার্চ ঢাকায় আসেন। পরের দিন তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসে শেখ মুজিবকে আলোচনায় ডাকেন, এবং একটি শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার গুরুত্বটি তুলে ধরেন। ১৯ মার্চ শেখ মুজিব জানান তিনি ভূট্টোর সাথে আলোচনায় বসতে রাজী আছেন। সে খবর ভূট্টোকে জানানোর পর ২১ মার্চ ঢাকায় আসেন। ঢাকার পরিস্থিতি তখন খুবই থম থমে। সেনা-পাহারায় তাঁকে বিমান বন্দর থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আনা। হোটেলের বাঙালী স্টাফগণ তাঁর সাথে কথা বলতে এবং কোনরূপ আপ্যায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ ছিল এক অদ্ভুদ অবস্থা। ভূট্টো ও তাঁর দলের নেতাদের হোটেলের সর্বোচ্চ তালায় নেয়া হয়। অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অবশেষে ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে বৈঠক বসে। আলোচনা কক্ষে বসে শেখ মুজিব ও জনাব ভূট্টো একে অপরের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে চেয়ারে আধাআধি ঘুরে বসে থাকেন। শেখ মুজিবের ঘোরতর আপত্তি, কেন ভূট্টোকে ডাকা হয়েছে। অপরদিকে ভূ্ট্টোর অভিযোগ, শেখ মুজিব যখন তাঁর সাথে আলোচনায় বসতে রাজী নয় তবে কেন তাকে ঢাকায় ডেকে আনা হলো? উভয়ের অভিযোগ ও অবিশ্বাস ইয়াহিয়া খানের উপর। আলোচনায় অচলাবস্থা দেখে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব এবং জনাব ভূট্টোর হাত ধরে একে অপরের কাছে টানেন এবং সামাজিক সৌজন্য ও ভদ্রতার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন। তাতে আলোচনা কিছুটা শুরু হলেও সেটি কোনরূপ আপোষ-রফার জন্য উপযোগী ছিল না। অবশেষে ভূট্টো ও মুজিব উভয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পায়াচারি শুরু করেন। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব ভূ্ট্টোকে সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করার ব্যাপার হুশিয়ার করে দেন। অপরদিকে ভূট্টো শেখ মুজিবের আর্মির উপর অবিশ্বাসকে আরো তীব্রতর করেন, আর্মির সাথে সমাঝোতা যে তার জন্য বোকামী হবে সেটিও তাকে বলেন।-(Sisson and Rose, 1990)।

 

স্বাধীনতার পতাকা টানিয়ে মুজিব

আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয় মূলত একাত্তরের ২৩ মার্চ। ঐদিনটি পাকিস্তানের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের ইতিহাসে ঐ দিনটি পরিচিত পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রি দিবস রূপে। ১৯৪০ সালের ঐদিনে লাহোরের মিন্টো পার্কে মুসলিম লীগের সন্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সে প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জনাব শেরে বাংলা ফজলুল হক। ঐদিন পাকিস্তানে সরকারি ভবনগুলোতে পাকিস্তানের চাঁদতারা খচিত সবুজ পতাকা উত্তোলনের দিন। আওয়ামী লীগ ঐদিনকে প্রতিরোধ দিবস রূপে ঘোষণা দেয়। ঐদিন ঢাকায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়, এবং নানা স্থানে পদদলিত করা হয় পাকিস্তানের পতাকাকে। পাকিস্তানের পতাকা সেদিন শুধুমাত্র সামরিক স্থাপনাগুলিতেই উড়তে দেখা যায়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ঐদিন স্বাধীনতা ও সামরিক প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের হাজার হাজার কর্মী প্যারেড, কুচকাওয়াজ ও মিছিল করে। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র তখন “ঢাকা রেডিও” নামে নিজস্ব সম্প্রচার চালাতে থাকে। ঐদিনের ঘটনাবলিতে পাকিস্তান আর্মির মধ্যে উদ্বেগ গুরুতর আকার ধারণ করে। সে উদ্বেগের অন্যতম কারণ, অবসরপ্রাপ্ত দুই বাঙালী অফিসার কর্নেল ওসমানি এবং মেজর জেনারেল মজিদ সামরিক বাহিনীর সাবেক সেনাদের নিয়ে ঢাকাতে এক সমাবেশ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের এগিয়ে যেতে বলেন। সমাবেশ শেষে তারা মিছিল করে শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাসায় যান এবং তাঁর শুভেচ্ছা নেন। ঐদিন ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে গঠিত জয়বাংলা ব্রিগেড পল্টন ময়দানে এক সমাবেশ করে এবং ছাত্রলীগের চার নেতার নেতৃত্বে শেখ মুজিবের বাসায় গিয়ে তার থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করে।

পাকিস্তান আর্মির জন্য অবস্থা চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে তখন যখন শেখ মুজিব নিজে তাঁর নিজের গাড়ীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক করতে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে এতোদিনও যারা একটি আপোষরফা নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তাদের কাছে শেখ মুজিবের এ আচরণ অতি অপমানজনক মনে হয়েছিল। সেটি অতিশয় বিদ্রুপ ছিল পাকিস্তানের প্রতিও। অপরদিকে আলোচনা এমন এক পর্যায়ে পৌছেছিল যে, ইয়াহিয়া খান এবং ভূট্টো উভয়ই শেখ মুজিবের ৬ দফা মেনে নেন। তারা আওয়ামী লীগের এ দাবীও মেনে নেন যে পূর্ব পাকিস্তানে একটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মূদ্রা গচ্ছিত রাখার জন্য একটি পৃথক ফাণ্ডও থাকবে। ভূট্টোর দলও এসব নিয়ে আর কোন আপত্তি তোলেনি। ইয়াহিয়া খান তখন তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম আহম্মদকে নির্দেশ দেন ৬ দফার ভিত্তিতে অর্থনীতিকে সাজানোর খসড়া প্রণয়নে। সরকার এসব নিয়ে একটি মেমোরেণ্ডাম অফ আন্ডারস্টডিং স্বাক্ষরেরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। -(Sisson and Rose, 1990)। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা শুরু হয় কিভাবে কেন্দ্রে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় তা নিয়ে। ইয়াহিয়া খান চাচ্ছিলেন,শেখ মুজিবকে প্রধানন্ত্রী করে সত্বর একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হোক। সে কোয়ালিশনে ভূট্টো বা পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যদলের সদস্যরাও থাকবে এবং সত্বর একটি শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু করবে।

 

পাল্টে গেল গোলপোষ্ট

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং জনাব ভূট্টো আওয়ামী লীগের ৬ দফা পুরোপুরি মেনে নিলেও আলোচনা ধেয়ে চলে চরম ব্যর্থতার দিকে। আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে তার গোলপোষ্টই পাল্টিয়ে ফেলে। শেখ মুজিব তখন নিজেই তাঁর ৬ দফার কথা ভূলে যান। তিনি ইয়াহিয়া এবং জনাব ভূট্টোর কাছে এমন সব নতুন নতুন দফা পেশ করেন যা তিনি পূর্বে কখনই জনসম্মুখে বলেননি, নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ঘোষণা দেননি এবং জনগণের পক্ষ থেকে তার পক্ষে কোন ভোটও নেননি। তিনি তখন আর কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। বরং দাবী তুলেন দুই প্রদেশে দুইটি পৃথক “Constituent Conventions” গঠনের এবং সে সাথে সত্বর প্রাদেশিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের। শেখ মুজিব ভূলেই যান, যে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক স্বাক্ষর করে তিনি ১৯৭০এর নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাতে প্রথমে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল না। শর্ত ছিল, নির্বাচনের পর নির্বাচিত সদস্যগণ প্রথমে একটি শাসনতন্ত্র রচনা করবে। সে কাজটি সফল ভাবে সমাধা হওয়ার পরই তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা আসবে। কিন্তু ক্ষমতা-পাগল নেতারা তাদের সে ওয়াদা এবং দায়িত্বের কথা তারা সম্পূর্ণ ভূলে যান। মূল দাবী হয়ে দাঁড়ায়, দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের।

শেখ মুজিব আরো দাবী তোলেন, জাতীয় পরিষদের বৈঠক জাতীয় ভাবে বসবে না, সেটি বসবে প্রাদেশিক ভাবে এবং পৃথক পৃথক ভাবে। প্রাদেশিক ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর সত্বর সামরিক আইন তুলে নিতে হবে। শাসনন্ত্র তৈরীর বিষয়টি তারা ভূলেই যান। প্রশ্ন হলো, দেশে তখন শাসনতন্ত্র ছিল না। তখন দেশ চলতো সামরিক শাসন অনুযায়ী। শাসনতন্ত্র তৈরীর আগে সামরিক শাসন তুলে নিলে নতুন সরকার দেশ চালাবে কোন আইনে? কিন্তু ক্ষমতা-পাগল নেতাদের সে ভাবনা লেশ মাত্র ছিল না। ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল সংসদ সদস্যরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের শপথ নিবে। শেখ মুজিব ও তাঁর দল তাতেও রাজী হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, সংসদ সদস্যগণের অঙ্গীকার থাকবে স্রেফ শাসনতন্ত্রের প্রতি, পাকিস্তানের প্রতি নয়। অথচ তখনও দেশে কোন শাসনতন্ত্র তৈরীই হয়নি। ফলে এদাবী অনুযায়ী শপথ নেয়ার প্রশ্নই উঠে না। এভাবেই কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয় জাতীয় পরিষদের সদস্য ও মন্ত্রীদের শপথ নেয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের নাম হবে “Federation of Pakistan” ।কিন্ত আওয়ামী লীগের দাবী ছিল সেটি হবে “Confedaration of Pakistan”। সরকারি পক্ষ Confedaration এর বদলে ভারতীয় আদলে “Union” শব্দটি মেনে নিতে রাজী ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের জিদ ধরেন,“কনফেডারেশন” শব্দটিই রাখতে হবে। -(Sisson and Rose, 1990)।

সরকারি পক্ষের কথা ছিল, কনফেডারেশন হয় দুটি স্বাধীন দেশের মধ্যে, কখনই একই দেশের দুইটি প্রদেশের মধ্যে নয়। ইয়াহিয়া খান ও তাঁর টিমের কাছে শেখ মুজিবের এসব প্রস্তাব সাংবিধানিক ভাবে বিচ্ছিন্নতার ষড়যন্ত্র মনে হয়। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে, মুজিবের দাবী মেনে নিয়ে সামরিক শাসন তুলে নেয়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে আর কোন বাধাই থাকবে না। তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আর কোন রূপ আইনগত ক্ষমতাই থাকবে না, এবং সে সাথে আইনগত বৈধতাও থাকবে না। কারণ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতার মূল উৎস ছিল সামরিক আইন। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন না করে দুই প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে এবং সামরিক আইন তুলে নিলে শুধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই ক্ষমতা হারাবেন না, সে সাথে অখণ্ড পাকিস্তানেরও আইনগত বিলুপ্ত ঘটবে। বিষয়টি এতোই সুস্পষ্ট ছিল যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানই শুধু নয়, জনাব ভূট্টোও এরূপ দাবী মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। মানতে রাজী ছিলেন না ন্যাপের জনাব আব্দুল ওয়ালী খানসহ পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও। এ বিষয়ে জনাব ভূট্টো লিখেছেন, “Martial Law was the source of law then obtaining in Pakistan and the very basis of the President’s authority; and with the proclaimation lifting Martial Law, the President and the Central Government would have lost their legal authority and sanction. There would thus be a vacuum unless the National Assembly was called into being to establish a new source of sovereign power on the national level. If, in the absence of such national source, power were transferred as proposed in the provinces, the government of each province could acquire de facto and de jure sovereign status.”  -(Bhutto, Great Tragedy, p.43)  অর্থঃ “তখন পাকিস্তানে আইনের উৎস ছিল সামরিক আইন, এবং এটাই ছিল প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মূল ভিত্তি। ফলে সামরিক আাইন তুলে নেয়ার ঘোষণার সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকার তার আইনগত ক্ষমতা এবং অর্পিত অধিকার হারিয়ে ফেলতো। জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করে জাতীয় পর্যায়ে সার্বভৌম ক্ষমতার নতুন উৎস প্রতিষ্ঠা না করলে ক্ষমতার শূণ্যতা সৃষ্টি হতো। জাতীয় পর্যায়ে সার্বভৌম ক্ষমতার এমন শূণ্যতা নিয়ে প্রদেশগুলির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে প্রত্যেকটি প্রদেশের সরকারই কার্য্যতঃ এবং আইনতঃ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি হতো।” অথচ শেখ মুজিব ও তার দল সেটিই চাচ্ছিলেন। জনাব ভূট্টোকে এটাকেই বলেছেন “constitutional secession” বা শাসনন্ত্রিক বিচ্ছিন্নতা।

২৩শে মার্চের রাতে প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়া খান ছোট ছোট দলের নেতাদের সাথে মিলিত হন। তিনি তাদের কাছে শেখ মুজিবের আপোষহীন মনোভাবের কথা তুলে ধরেন। তাদেরকে একথাও বলেন, শেখ মুজিবের দাবী মেনে নিলে বিশ্ববাসী হাঁসবে এবং তাঁকে বোকা বলে উপহাস করবে। ২৪শে মার্চ ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান এবং গাওস বকস বিজেঞ্জো শেখ মুজিবের সাথ দেখা করেন। তাঁরা তাকে দুই Constituent Conventions এবং Confedaration of Pakistan এর দাবী প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু তাদের সে প্রস্তাব শেখ মুজিব মানেন নি। শেষ আলোচনা হয় ২৪ তারিখে। তাজউদ্দীন আহমেদ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চুড়ান্ত প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু তাতে আলোচনা আর সামনে এগুয়নি। এরপর অধিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া ইয়াহিয়া খানের কাছে অনর্থক মনে হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রচণ্ড আশাহত হন। তাঁর আশা ছিল, শেখ মুজিব পাকিস্তানকে বাঁচানোর ব্যাপারে অন্ততঃ আন্তরিক হবেন। এমন একটি ধারণা শেখ মুজিবই ইয়াহিয়া খানকে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবই তাঁকে বলেছিলেন, ৬ দফা কোন বাইবেল নয়। শেখ মুজিবের সে কথাটিকে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করেছিলেন। ফলে পাকিস্তান মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সির গুপ্তচরেরা যখন মুজিবের পাকিস্তান বিধ্বংসী পরিকল্পনার ক্যাসেট শুনেয়েছিল তখনও তিনি সেটি বিশ্বাস করেননি। বলেছিলেন, মুজিব আমাকে ওয়াদা দিয়েছে।

তিনি শুধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে নয়, অনেককেই মিথ্যা ওয়াদা দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশী বোকা বানিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোটি কোটি জনগণকে। মুজিবের ধোকা দেয়ার ধরণ নিয়ে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল গফুরর বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে। তিনি মুজিবের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে পরিচিত ছিলেন। তমুদ্দন মজলিসের অফিসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে – সেখানে এ গ্রন্থের লেখকও উপস্থিত ছিলেন, স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, “শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাসায় একবার তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। বাসায় প্রবেশের পর বারান্দায় দাঁড়িযে দেয়ালে টানানো কিছু ফটো দেখছিলাম। হঠাৎ করে কে যেন পিছন দিক থেকে আমার চোখ চেপে ধরলো। বুঝলাম এ কাজ শেখ মুজিবের। চোখ ছাড়লে আমি তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি সত্যই পাকিস্তান ভাঙ্গতে চান।” মুজিব বললেন, “তুইও কি তাই বিশ্বাস করিস? যে পাকিস্তান নিজ হাতে বানিয়েছি সেটি কি আমি ভাঙ্গতে পারি?” অথচ এই সেই শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে ১৯৭২ সালে ফেরার পর ঢাকার সহরোয়ার্দি উদ্দানের জনসভায় বল্লেন, “পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির কাজের শুরু একাত্তর থেকে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে।”

শেখ মুজিবের সে কথাটি অধ্যাপক আব্দুল গফুর বিশ্বাস করেছিলেন কি না -তা তিনি বলেননি। তবে শেখ মুজিবের এমন কথা বাংলার বহু মানুষই বিশ্বাস করেছিল। এমন কথা শেখ মুজিব শুধু অধ্যাপক আব্দুল গফুরকেই বলেননি, ইয়াহিয়া খানকেও বলেছিলেন। এবং ইয়াহিয়া খান সেটি পুরাপুরি বিশ্বাসও করেছিলেন। পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের সংগৃহীত মুজিবের পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে পেশ করা বক্তব্যের ক্যাসেটও তার বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে পারেনি। তবে ইয়াহিয়া খানের গুরুতর অপরাধ, শেখ মুজিবকে তিনি শুধু বিশ্বাসই করেননি, তাকে রাজপথের উপর দখলদারি ও অন্যান্য দলের নির্বাচনি জনসভাগুলোকে পণ্ড করার পূর্ণ অধিকারও দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান ভেবেছিলেন মুজিব তাকে সাংবিধানিক প্রেসিডেন্ট বানাবে। সে খোশ খেয়ালে মুজিবকে তিনি অবাধ ছাড় দিয়েছেন। তিনিই আওয়ামী লীগের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিলেন ব্শিাল নির্বাচনি বিজয়ের -যা মুজিব নিজেও কখনো ভাবেননি।

 

ব্যর্থ হলো বৈঠক

শেষ মুহুর্তে শেখ মুজিবের আসল রূপ ইয়াহিয়া খানের কাছেও সুস্পষ্ট হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তাঁর টিমের ধারণা জন্মে, আলোচনায় আওয়ামী লীগের কোনরূপ সততা নেই এবং অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানোর কোন ভাবনাও নাই। দুটি পক্ষ সম্পূর্ণ দুটো বিপরীত এজেন্ডা নিয়ে আলোচনায় বসছিল যার মধ্যে কোনরূপ আপোষ সম্ভব ছিল না। ফলে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় ইয়াহিয়া-মুজিব-ভূট্টো আলোচনা। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। আর পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয় রক্তাত্ব পথে। আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার জন্য কে দায়ী তা নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন বিবরণ নাই। যা আছে তা স্রেফ আওয়ামী লীগের নিজের ভাষ্য, যাতে প্রকৃত সত্য নেই। তাই আজও  প্রশ্ন, কার অপরাধে দেশ সেদিন রক্তাত্ব হলো? প্রশ্ন হলো, আলোচনা ব্যর্থ হলে দেশ যে রক্তাত্ব পথে এগুবে সেটি কি শেখ মুজিবের জানতেন না? আলোচনা ব্যর্থ হলে দেশে যে ভয়ানক যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হবে সেটি মুজিব না বুঝলেও ইয়াহিয়া খান বুঝেছিলেন। সে যুদ্ধাবস্থা এড়াতেই তিনি ৬ দফা মেনে নিয়েছিলেন। অপরদিকে শেখ মুজিব নিজেই তার নিজের ৬ দফাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। অথচ ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি ম্যান্ডেট নিয়েছিলেন ৬-দফার উপর, পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে নয়। কিন্তু শেখ মুজিবের সমস্যা হলো ৬ দফার ম্যান্ডেটের বাইরেও তাঁর কাঁধে আরেকটি অর্পিত বড় দায়ভার ছিল। সেটি পাকিস্তান ভাঙ্গার। পাকিস্তান ভাঙ্গা নিয়ে জনগণের কাছে তিনি দায়বদ্ধ না হলেও তা নিয়ে প্রচণ্ড দায়বদ্ধ ছিলেন দিল্লীর শাসকচক্রের কাছে। ষাটের দশকে তিনি আগরতলা গিয়েছিলেন সে দায়বদ্ধতা পাকা করতে। ইতিহাসে সেটি আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। ফলে শেখ মুজিবের ৬ দফা সেদিন আর ৬ দফাতে থাকেনি, এক দফাতে পরিনত হয়।

 

যুদ্ধের পথে দেশ

প্রশ্ন হলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান না হয় ৬ দফাকে জনগণ-প্রদত্ত ম্যান্ডেট মনে করে মেনে নিতে পারেন, এবং মেনে নেয়ার পক্ষে গণতান্ত্রিক রায়ের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের ৬-দফা বিরোধীদের বুঝাতেও পারতেন। কিন্তু দেশবিভক্তির একদফাকে তিনি মেনে নিবেন কোন যুক্তিতে? দেশের প্রেসিডেন্টের উপর অর্পিত প্রধান দায়িত্বটা দেশের স্বাধীনতা ও সংহতির সুরক্ষা; স্বাধীনতা বিলিয়ে দেয়া নয়, দেশকে বিভক্ত করাও নয়। একাজ তো গাদ্দার বা মীরজাফরদের। অথচ মুজিব চাচ্ছিলেন, ইয়াহিয়া খানের দ্বারা সে গাদ্দারীই সাধিত হোক। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সে পথে এগুননি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র তাঁর হাতে ধ্বংস হোক সে অপরাধ তিনি নিজ কাঁধে নিতে চাননি। দেশের এমন সংকটে সামান্য দেশপ্রেম আছে এমন মানুষও ভয়ানক যু্দ্ধের ঝুঁকি নিজ কাঁধে তুলে নেয়। এমন কি সে যুদ্ধে নিজের মৃত্যু বা পরাজয়ও বরণ করে নেয়। নিজ দেশের সাথে গাদ্দারী সে মেনে নেয় না।

মুজিবই বা কি করে বুঝলেন, পাকিস্তান ভাঙ্গার চেষ্টা হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরবে বসে শুধু আঙুল চুষবে? একাত্তরে পাকিস্তানে আর্মির সামনে বিশাল প্রতিবন্ধকতা ছিল। জনগণের বিরাট অংশ তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। বড় বড় দুষমন ছিল আন্তর্জাতিক মহলেও। ভয়ানক বন্যায় ধ্বসিয়ে দিয়েছিল দেশের অর্থনীতি ও যোগযোগ ব্যবস্থা। যুদ্ধের জন্য একাত্তর আদৌও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য উপযোগী ছিল না। কিন্তু এরপরও নিরব থাকার সুযোগ ছিল না। দেশ এরূপ বিভক্তির মুখে পড়লে যে কোন দেশের সেনাবাহিনীই হাতের কাছে যা কিছু পায় তা নিয়েই ময়দানে নামে। পাকিস্তানের এমন একটি অবস্থার জন্য দায়ী মূলত শেখ মুজিব ও তাঁর দল। তিনি জেনে বুঝে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে একটি রক্তাত্ব যুদ্ধ, যুদ্ধজনীত বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং লজ্জাজনক পরাজয়ের দিকেই ধাবিত করেন। আর সে যুদ্ধে রক্তাত্ব হয় বাংলাদেশের মাটিও। মুজিব মূলত সেটিই চাচ্ছিলেন।

 

শেখ মুজিবের যুদ্ধাপরাধ

২৫শে মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাঠে নামার আগেই শেখ মুজিব ৭ই মার্চে সহরোওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় “এবারের যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ” বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যার যা সামর্থ আছে তা নিয়ে জনগণকে ময়দানে নামার আহবান জানিয়েছেন। “আমরা ওদেরকে ভাতে মারবো, পানিতে মারবো” বলে প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছিলেন। তার সে ঘোষণার পর সেনাবাহিনীর ক্যান্টমেন্টগুলোতে খাদ্য-পানীয়’র সরবাহ বন্ধ করা হয়েছিল। বহু বিহারী এবং সেনা বাহিনীর বহু সদস্যকে সে সময় হত্যা করা হয়েছিল। যে কোন অন্যায্য যুদ্ধই মানব জাতির বিরুদ্ধে ভয়ানক বড় অপরাধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধ নিয়ে নুরেমবার্গে যে আদালত বসেছিল সে আদালতের বিচারকদের সেটিই রায় ছিল। তাই শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ পরিহার করে যুদ্ধের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা বা মানুষকে যুদ্ধে প্ররোচিত করাটাই যুদ্ধাপরাধ। শেখ মুজিব মুলত সেটিই করেছেন। হিটলার নিজ হাতে কোন শহরে বোমা ফেলেছেন বা কোন গ্যাস চেম্বারে ইহুদীদের পুড়িয়ে মেরেছেন সে প্রমাণ নাই। কিন্তু তাঁর প্ররোচনায় বহু জনপদ বিরাণ হয়েছে এবং বহু লক্ষ ইহুদী ও বহু দেশের বহু লক্ষ নিরাপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। তেমনি শেখ মুজিবের “আমরা ওদেরকে ভাতে মারবো, পানিতে মারবো” ঘোষণায় খুলনা, যশোর, শান্তাহার, পাকশী, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংসহ বাংলাদেশের বহু জেলার হাজার হাজার নিরপরাধ বিহারী নিহত হয়েছে। বহুলক্ষ বিহারী নিজের বাড়ি ঘর হারিয়ে পথে বসেছে। অথচ বিহারীরা বাঙালীদের উপর ২৫ মার্চের আগে কোথাও হামলা করেছে বা কাউকে হত্যা করেছে সে প্রমাণ নেই। একমাত্র ভাষার ভিন্নতা ছাড়া তাদের আর কি অপরাধ ছিল?

অথচ এরূপ প্রত্যেকটি ঘটনাই ভয়ানক যুদ্ধাপরাধ। ইসলামে একজন মানুষ হত্যাই গুরুতর অপরাধ। আর একটি মুসলিম দেশ বিনাশ তো আরো গুরুতর অপরাধ। দেশকে বিভক্তি ও বিনাশের ন্যায় গুরুতর অপরাধ থেকে বাঁচাতে অতীতে হাজার হাজার মুসলিমকে প্রাণ দিতে হয়েছে। শেখ মুজিব ২৫ মার্চ জেলে গিয়ে উঠেছেন, কিন্তু পাকিস্তান ভাঙ্গার বাঁকী কাজটি সঁপে দিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। এবং জেল থেকে ফিরেই তিনি রেডিমেট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে বসেছেন। সেদিন লাভের ফসল একমাত্র ভারতই ঘরে তুলেছিল। সে লাভের বলেই ভারত আজ বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে। ভারত সেদিন কইয়ের তেল কই ভেঝেছিল। সে যুদ্ধে বিশাল সম্পদহানী, প্রাণহানী ও ইজ্জতহানীর শিকার শুধু পাকিস্তানই হয়নি, বাংলাদেশও হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী “তলাহীন ভিক্ষার থলি”র উপাধি পায়। যুদ্ধে পরাজয়ের চেয়ে এটি কি কম অপমানজনক?

 

অপরাধ উম্মাহর বিরুদ্ধে

উম্মতে ওয়াহেদা হওয়ার কারণে মুসলিম উম্মাহর জয়-পরাজয়ের কোন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সীমা-সরহাদও নেই। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর আর্নল্ড টয়েনবীর ভাষায়, একটি সভ্যতার ইতিহাস একত্রে উঠানামা করে। সেটি যেমন পাশ্চাত্য সভ্যতার বেলায়, তেমনি মুসলিম সভ্যতার বেলায়ও। আর মহান আল্লাহর ভাষায় মুসলমান তো অভিন্ন উম্মাহর অংশ। ফলে মুসলিম মাত্রই অভিন্ন মুসলিম সভ্যতার শরীক। আর পাক-ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস তো এক্ষেত্রে একসূত্রে বাঁধা। তাই ১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বিহারী, বেলুচ, পাঠান ও গুজরাতি মুসলমানের সাথে বাঙালী মুসলমানের এক কাতারে স্বাধীনতার লড়াই করতে সমস্যা হয়নি। অবাঙালী সিরাজুদ্দৌলা বা বখতিয়ার খিলজিকেও তাই বাঙালী মুসলমানের ইতিহাস থেকে আলাদা করে দেখার উপায় নাই। পাকিস্তানের জয়-পরাজয়ের ইতিহাস থেকেও তাই বাঙালী মুসলমান বিস্মৃত হতে পারেনা। কারণ পাকিস্তানের সৃষ্টির সাথে বাঙালী মুসলিমগণ জড়িত। সে স্মৃতি ভূলে যাওয়া নাস্তিক বা ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলারিস্টদের কাজ হতে পারে, ঈমানদার মুসলমানের নয়। নবীজী (সাঃ)র হাদীস, মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের মত, এক অংশে আঘাত লাগলে সে ব্যাথা অন্য অঙ্গও অনুভব করে। আরবদের বিভক্তি ও পরাজয় শুধু আরবদেরই শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন করেনি, শক্তিহীন, ইজ্জতহীন এবং ব্যাথীত করেছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকেই।

তাই একাত্তরের যুদ্ধে একটি অমুসলিম শক্তির হাতে শুধু পাকিস্তানের পরাজয় ঘটেনি, তাতে দুর্বল হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। বিশেষ করে উপমহাদেশের মুসলিম। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভূমিতে সেদিন ভারতের ন্যায় অমুসলিম শক্তি বিজয়ী হয়েছিল; তা নিয়ে ভারতসহ ইসলামের বিপক্ষ শক্তির আজো তাই উৎসব।মুজিবের হাত দিয়ে পরাজয় ও অপমানের কালিমা সেদিন শুধু পাকিস্তানীদের গায়েই লাগেনি, লেগেছিল মুসলিম উম্মাহর গায়েও। ইসলাম ও বিশ্ব-মুসলিমের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারিদের এটি এক বিশাল অপরাধ। হালাকু-চেঙ্গিজ-হিটলার-মীরজাফরগণ আদালতের বিচার থেকে বেঁচে গেছে, কিন্তু ইতিহাসের বিচার থেকে তারা বাঁচেনি। তেমনি আদালতের বিচার থেকে মুজিবও বেঁচে গেছেন। ষাটের দশকে বেঁচে গেছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকেও।তবে মুসলিম ইতিহাসে তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন;সেটি অপরাধের গ্লানি বহন করেই।

গ্রন্থপঞ্জি

  • Sisson, Richard and Leo Rose (1990): War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California; Berkeley.
  • W. Chowdhury, 1974:  The Last Days of United Pakistan, C. Hurst & Company, London

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *