অধ্যায় কুড়ি: একাত্তরের মিথ্যাচার
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
প্লাবন মিথ্যাচারের
একাত্তরকে ঘিরে বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মূল অস্ত্রটি হলো মিথ্যাচার। বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের দাবী,পাকিস্তান সরকার বাঙালীদের কখনোই বিশ্বাস করতো না।সে দাবী যে কতটা মিথ্যা সেটি প্রমাণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট গুলোতে বহু হাজার বাঙালী সৈন্যের অবস্থান।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ইরাকীদের বিশ্বাস করেনি।সেটির প্রমাণ,ইরাক দখলে নেয়ার সাথে সাথে তারা ইরাকী সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেয়। ইরাকী সৈন্যদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয় এবং চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে তাদেরকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়।এ হলো অবিশ্বাসের নমুনা।পাকিস্তানে বাঙালী সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে কি সেটি ঘটেছে? কাশ্মীরে ভারতীয় ৬ লাখ সৈন্যদের প্রায় সবাই অকাশ্মীরী তথা বাইরের অন্যান্য প্রদেশের।অথচ একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে যে ১৪ হাজার সৈন্য ছিল তার মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’য়ের ৩ হাজার বাঙালী সৈন্য ছিল একমাত্র চট্টগ্রামে।বহু হাজার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টগুলোতে।এছাড়া ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)’য়ে ছিল সশস্ত্র ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ছিল আরো ১৪ হাজার।তারা সবাই সশস্ত্র ছিল।তাছাড়া ছিল প্রায় এক লক্ষ আনসার।বাঙালীদের উপর বিশ্বাস না থাকলে কি পাকিস্তান সরকার বাঙালী সৈন্যদের কান্টনমেন্টে থাকতে দিত? তাদের হাতে কি অস্ত্র তুলে দিত? অথচ বাঙালী সৈনিকগণ তাদের উপর অর্পিত আস্থার জবাব দিয়েছে অবাঙালী অফিসার ও তাদের স্ত্রী-পরিজনদের হত্যা করে। চট্টগ্রামে পাকিস্তানে আর্মির বহু অফিসার,সৈনিক এবং বহু হাজার অবাঙালী নারী-পুরুষ মারা যায় বাঙালী সৈনিক ও সৈন্যদের হাতে।-(Williams, L.F.Rushbrook;1972)। সেনাবাহিনীর বাইরেও বহু বাঙালী অফিসার একাত্তরে পাকিস্তান সরকারেরর বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দেশে ও বিদেশ আসীন ছিল।লন্ডন,ওয়াশিংটন,নিউয়র্ক,বেইজিংসহ বিশ্বের নানা দেশে পাকিস্তান সরকারের দূতাবাসগুলোর বিরাট সংখ্যক কর্মচারী ছিল বাঙালী।কোন কোন দূতাবাসে প্রায় অর্ধেক। তখন কলকাতায় পাকিস্তানের যে ডিপুটি হাইকমিশন ছিল তার প্রধান ছিল বাঙালী।এমন কি রাজধানী ইসালামাবাদের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েটের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কর্মচারি ছিল বাঙালী।এগুলি কি অবিশ্বাসের নমুনা?
বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের মিথ্যাচারের সাথে যোগ হয়েছিল তাদের হৃদয়হীন সন্ত্রাস। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবির্ভুত হয় বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মূল দল রূপে। সন্ত্রাস ও মিথ্যাচার যে শুধু দলটির নীচের তলার ক্যাডার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল -তা নয়। তাতে আক্রান্ত হয় দলের শীর্ষ নেতা, আওয়ামী ক্যাডার, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক –তথা সবাই। উদাহরণ দেয়া যাক। ১৯৭০ সালের ১৮ ই জানুয়ারিতে পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর জনসভা ছিল। সেখানে দলটির আমীর মওলানা মাওদূদী ছিলেন প্রধান বক্তা। কিন্তু জনসভায় তার আগমনের আগেই প্রচণ্ড হামলা শুরু হয়। সেদিন সে নৃশংস হামলাটি লেখকের স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়। না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন হত যে, গণতন্ত্রের দাবীদার একটি দল অন্যদলের শান্তিপূর্ণ জনসভার উপর এতোটা নিষ্ঠুর ও নৃশংস হতে পারে। হামলার জন্য প্রচুর ভাঙ্গা ইট জমা করা হয়েছিল জিন্নাহ এভিনিউতে যা আজ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ নামে পরিচিত। আওয়ামী ক্যাডারগণ বৃষ্টির মত ছুঁড়ে মারছিল জনসভায় সমবেত শ্রোতাদের উপর। মিনিটের মধ্যেই শত শত মানুষ আহত হলো। পাথরের আঘাতে মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছিল অনেকেরই। জনসভাটি বিশাল করার লক্ষ্যে জামায়াত সারা দেশ থেকে হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থক নিয়ে জমা করেছিল। তাছাড়া এ জনসভাটিই ছিল জামায়াতের প্রথম নির্বাচনী জনসভা। তাই এ জনসভা সফল করায় তাদের মেহনতের সীমা ছিল না। মফস্বলের সাদামাটা মানুষগুলো মাথায় বা দেহে পাথর খেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কোথায় যে পালাবে -সে রাস্তাও পাচ্ছিল না। হামলা হচ্ছিল পশ্চিম দিক থেকে। তখন পল্টন ময়দানের দক্ষিণের উঁচু দেয়াল অতি কষ্টে টপকাতে দেখা গেছে লম্বা আলখেল্লা পরিহিত মুসল্লীদের। সেদিন তিনজন নিরীহ শ্রোতা নিহত হয়েছিল। অথচ জনসভায় আসা ছাড়া তাদের কোন অপরাধই ছিল। আহত হয়েছিল বহুশত। আহতরা পুনরায় আহত হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে। সেখানেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের মারপিট করে। সন্ত্রাসের নেশা যেন দলটির সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে প্রবল ভাবে বাসা বেঁধেছিল। দেশের রাজনীতি অবশেষে এরূপ সন্ত্রাসীদের হাতেই অধিকৃত হয়ে যায়।
দুই জন নিহত ও শত শত ব্যক্তি আহত হওয়ার পরও শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের অন্য কোন নেতা এমন বর্বর ঘটনার নিন্দা করে কোন বিবৃতি দেয়নি। যেন তারা কিছুই দেখেনি এবং কিছুই শুনেনি। এরূপ হত্যাকাণ্ড যে নিন্দনীয় বিষয় -সেটিও তারা অনুভব করেনি। সুস্থ্ গণতন্ত্রচর্চার প্রতি সামান্য আগ্রহ থাকলে একটি দল কি এভাবে অন্য দলের উপর এতোটা নির্দয় ও বিবেকহীন হতে পারে? তাদের বিবেক যে কতটা মৃত সেটিই সেদিন প্রকাশ পেয়েছিল। এমন বিবেকহীন বর্বরগণ ক্ষমতা হাতে পেলে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্টা দিবে,শাপলা চত্ত্বরের গণহত্যার ন্যায় গণহত্যার জন্ম দিবে এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ফাঁসীতে ঝুলাবে বা ক্রস ফায়ারে দিয়ে হত্যা করবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশে তো সেটিই ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। পল্টনে জামায়াতে ইসলামীর জনসভা রক্তাত্ব ভাবে পণ্ড করারপরের দিন আওয়ামী লীগের মুখপত্র ইত্তেফাক ও ন্যাপের মুখপত্র দৈনিক সংবাদের হেডিং ছিল আরো বিস্ময়কর। প্রথম পৃষ্ঠায় তারা বিশাল খবর ছেপেছিল, জনসভার সমাবেত শ্রোতাদের উপর জামাতকর্মীদের হামলা –এ শিরোনাম দিয়ে। যেন জামায়াতে ইসলামী বহু হাজার টাকা ব্যয়ে সপ্তাহব্যাপী প্রচার চালিয়ে মানুষ জমা করেছিল তাদের মাথায় পাথর মারার জন্য! এটি কি বিশ্বাস করা যায়? কোন সুস্থ্ সাংবাদিক কি এমন মিথ্যা লিখতে পারে? অথচ সে অবিশ্বাস্য মিথ্যাটিই পাঠকদের কাছে পেশ করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক ও সংবাদ। এভাবে রেকর্ড গড়া হয় মিথ্যার প্রচারে। আর মিথ্যা তো প্রতি যুগেই কোটি কোটি ভক্ত ও প্রচারক পায়। নইলে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছ ফিরাউন খোদা হয় কি করে? গরুই বা কি করে কোটি কোটি মানুষের কাছে দেবতার মর্যাদা পায়? সেদিনও বহু বাঙালী সে নিরেট মিথ্যাচারে বিশ্বাসী ও তার প্রচারকে পরিণত হয়েছিল। মুজিবের উত্থানের মূলেও ছিল সে নিরেট মিথ্যাচার।
প্রশ্ন হলো, রাস্তার সন্ত্রাসীদের থেকে সাংবাদিক নামধারি এমন ব্যক্তিদের বিবেককে কি আদৌ উন্নত বলা যায়? দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে তারা যুদ্ধ করবে, সেটি কেউ আশা করে না। কিন্তু মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দায়িত্বটা তো তাদের যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী রূপে দাবী করে।জনগণের সামন মিথ্যাকে মিথ্যা, সন্ত্রাসকে সন্ত্রাস এবং সত্যকে সত্য রূপে পরিচিত করার সর্বাধিক দায়ভার তো তাদের। এটিই সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদান। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে তারা পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। তারা করেছেন উল্টোটি। স্বৈরাচারী দুর্বৃত্ত নেতাদের কাছে তারা নীরবে আত্মসমর্পণ করেছেন। পরিণত হয়েছেন শেখ মুজিবের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিবেকহীন চাটুকারে। বাঙালী মুসলিমের বুদ্ধিবৃত্তির ভূমি এভাবেই পরিণত হয় মিথ্যাচারী দুর্বৃত্তদের অধিকৃত ভূমিতে। ১৯৭০’য়ের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে পল্টনে ছিল ফজলুল কাদের চৌধুরীর মুসলিম লীগের জনসভা। এ মিটিংয়েও লেখকের স্বচোখে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস দেখার সুযোগ মিলেছিল। গুণ্ডাগণ সে সভা শুরুই করতে দেয়নি। শুরুতেই জনসভার উপর ইটের বর্ষণ শুরু হয়। মুসলিম লীগের কর্মীগণ ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পাহারা দিয়ে পল্টনের ময়দানের বাইরে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের কাছে নিয়ে আসে। কিন্ত গুণ্ডারা সেখানেও তার পিছনে ধাওয়া করে আসে। এমন ভাঙ্গা ইট বর্ষণের মুখে ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাহস ছিল দেখবার মত। পুলিশ ঐদিনও কোন ভূমিকা নেয়নি। সন্ত্রাসীদের কাউকেই গ্রেফতার করেনি। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে যে রাজপথে কতটা মুক্তভাবে ছেড়ে দিয়েছিল -এ হলো তার নমুনা।
গোপন সন্ধি ইয়াহিয়ার সাথে
১৯৭১-এর নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগের মিথ্যা ওয়াদার। মিথ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জনগণকেও। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়াকেও। সে প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যথেচ্ছা সন্ত্রাসের পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। মুজিব ইয়াহিয়া খানকে শাসনতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে কথা বলেছেন ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রী জি ডব্লিউ চৌধুরী ।-(G.W. Chowdhury, 1974)। ফলে আওয়ামী লীগ আবির্ভুত হয়েছে যেন সরাকারি দল রূপে। দলটির সন্ত্রাসে অন্য কোন দল শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচনী জনসভাই করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামী পারেনি, মুসলিম লীগও পারেনি। পারেনি নূরুল আমীন সাহেবে পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি। পারেনি অন্যান্য দলও। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে, বহু প্রাণহানীও হয়েছে। ১৯৭০’য়ের ১৮ই জানুয়ারির পল্টনের জনসভায় জামায়াতের ৩ জন নিহত এবং ৪ শতেরও বেশী আহত হয়েছিল গভর্নর হাউজের সামনে। সে হামলা রোধে পুলিশ কোন ভূমিকাই পালন করেনি। কারো বিরুদ্ধে কোন মামলাও দাখিল করেনি। হত্যাকান্ডের অপরাধে কোন অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার চেষ্টাও করেনি। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসের সাথে এভাবেই সহযোগিতা করেছিল সে সময়ের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। মুজিবকে বিজয়ী করাই যেন তার এজেন্ডা ছিল। এরূপ অপ্রতিরোধ্য ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে যে নির্বাচন হাইজ্যাক করা হয়, তাকে কি মূক্ত নির্বাচন বলা যায়?
লক্ষ্যণীয় হলো, যে নির্বাচনে বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হলো, তছনছ হলো বহু নির্বাচনী সভা, বহু ভোটকেন্দ্রে প্রতিদ্বন্ধি দলের পোলিং এজেন্টকে বসতে দেয়া হলো না এবং জালি ভোট দেয়া হলো বিপুল সংখ্যায় – সে নির্বাচনকেও সুষ্ট ও নিরপেক্ষ বলা হয়েছিল। সেটি দুটি পক্ষ থেকে। পক্ষ দুটি হলো আওয়ামী লীগ এবং ইয়াহিয়া খানের সরকার। ৭১’য়ের নির্বাচনের পূ্র্বে মওলানা ভাষানী কি বলেছিলেন সেটা শোনা যাক। এ বিবরণ দিয়েছেন ঢাকার মুসলিম লীগ নেতা ইব্রাহীম হোসেন। তিনি তাঁর বই “ফেলে আসা দিনগুলো” তে লিখেছেনঃ “ঢাকার টাঙ্গাইলে জনসভা করার পর কাইয়ুম খান (পাকিস্তান মুসলিম লীগের এক গ্রুপের সভাপতি, ইনি এক সময় পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, এ দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খুলনার খান আব্দুস সবুর) গেলেন মওলানা ভাষানীর সাথে দেখা করতে। আমিও তাঁর সাথে ছিলাম। মওলানার সেই টিনের ঘরে গিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা কাটান। আমি তখন মওলানার নির্মীয়মান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রুমে বসে ছিলাম। ..তারপর কাইয়ুম খান বললেন, মওলানা যা বলেছেন তা তো সাংঘাতিক কথা। আমি বাঙালি হলে এসব কথা জোরে শোরে বলতে পারতাম। আমি বললে সবাই ভুল বুঝবে। মওলানা বললেন, নির্বাচনে তিনি কেন যোগ দিচ্ছেন না। এতো সব সাজানো নাটক। আর্মির সাথে মুজিবের বোঝাপড়ার পরে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচেছ। এ ষড়যন্ত্রের পিছনে মদদ যোগাচ্ছেন ভুট্টো। যদিও তিনি আমার খুব ঘনিষ্ঠ। ইন্ডিয়া সুযোগের অপেক্ষায়। এই ভাগাভাগির নির্বাচনে যদি কোন উল্টাপাল্টা হয় তবে ইন্ডিয়া এগিয়ে আসবে।”-(ইব্রাহিম হোসেন,২০০৩)।
আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচার
তবে মাওলানা ভাষানী মুখে যাই বলুন, পাকিস্তানের সে দূর্দিনেও তিনি কোন কল্যাণ করেননি। যেহেতু সে সময় তার সাথে দেশী-বেদেশী -বিশেষ করে চীনা গোয়েন্দা চক্রের সংযোগ ছিল, মুজির ও ইয়াহিয়ার গোপন সমঝোতার বিষয়ে তিনি যা বলেছেন সেটি উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া জেনারেল ইয়াহিয়ার তৎকালীন ইনার সার্কেলের মন্ত্রী জনাব জি ডব্লিউ চৌধুরীও একই কথা বলেছেন। মিথ্যাচর্চা শুধু আওয়ামী লীগ নেতা, মাঠকর্মী ও আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমান ভাবে সংক্রামিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মাঝেও। বাংলাদেশের আওয়ামী ঘরানার উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। দেখা যাক, উচ্চশিক্ষা তার চারিত্রিক কদর্যতাকে কতটা পাকসাফ করতে পেরেছিল। তার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন লিখেছেন, “বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী একাত্তরের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে ঢাকা ত্যাগ করেন সপরিবারে। তিনি তখন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে জেনেভায় জুরিষ্টদের সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ২৫ মার্চের অব্যবহিত পর তিনি বিবিসিতে এক ইন্টারভিউতে বলেন যে, পাকিস্তান আর্মি তার ইউনিভার্সিটির হাজার হাজার শিক্ষক ও ছাত্রকে খুন করেছে। এরপর তিনি বলেন, তিনি আর ঐ সরকারের আনুগত্য করতে পারেন না। অথচ এটি ছিল মিথ্যাচার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক ২৫ মার্চ মারা যায় এবং সে সাথে দুই জন ছাত্র। অথচ যারা আবু সাঈদ চৌধুরীর বক্তৃতা শুনেছিলেন তাদের ধারণা ছিল সত্যি বুঝি কয়েক শত শিক্ষক এবং ছাত্র ২৫শে মার্চের রাতে নিহত হয়।“ -(ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন,১৯৯৩)
বাংলাদেশের ইতিহাসে “একাত্তরে ৩০ লাখ নিহত হয়েছে” এ মিথ্যার ন্যায় “২৫শে মার্চের রাতে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক ও ছাত্র খুন হয়েছে” আরেকটি বহু উচ্চারিত মিথ্যা। অথচ বিশ্বজুড়ে এ মিথ্যা রটনায় সক্রিয় ভূমিকা নেন জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী। এই হলো আওয়ামী লীগের সেরা শিক্ষিত ব্যক্তিটির চরিত্র! একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল – এতো বড় মাপের এ মিথ্যা কথাটি বলে শেখ মুজিব বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বাংলাদেশের বাইরে খুব কম লোকই সে মিথ্যা বিশ্বাস করেছিল। বিশ্বাস করেনি এমনকি ভারতীয়রাও। তবে তাতে আওয়ামী-বাকশালীদের মিথ্যাচর্চায় ভাটা পড়েনি। শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও মিথ্যাচার আওয়ামী লীগ নেতা ও ক্যাডারদের চরিত্রের সাথে কতটা মিশে গিয়েছিল তার আরো কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন লিখেছেন,“(লন্ডনে থাকাকালে ) সালমান আলী সানডে টাইমস পত্রিকার একটি সংখ্যা দেখালেন। পড়ে তো আমি অবাক। মৃতের তালিকার মধ্যে ছিলেন আমার বন্ধু সহকর্মী কে এম মুনিম, মুনীর চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক – এ রকম আরো কয়েকজন। আমি যখন বললাম যে লন্ডন যাত্রার প্রাক্কালে আমি মুনিম সাহেবের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে এসেছি, সালমান আলীর বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। তাঁকে আরো বললাম যে আমি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর নিয়ে এসেছি যে মুনীর চৌধুরী এবং আব্দুর রাজ্জাক জীবিত। সালমান আলীকে আরো বলা হয়েছিল যে ঢাকায় নাগরিক জীবন বলে কিছু নেই। তানভির আহমদের রুমে যখন গেলাম পুরোন পরিচয় সূত্রে অনেক আলাপ হলো। তিনি ড্রয়ার থেকে বড় হরফে ইংরেজীতে লেখা একটা লিফলেট বা প্রচারপত্র দেখালেন। বললেন তাঁর পরিচিত এক বাঙালী মহিলা ওটা লন্ডনের রাস্তায় বিলি করছিলেন। প্রচারপত্রে লেখা ছিল, আপনাদের মধ্যে বিবেক বলে যদি কিছু থাকে তবে পাশবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। এরপর ছিল কয়েকটি লোমহর্ষক কাহিনী। এক পিতার বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল যে, ২৫ শের রাত্রে আর্মি ঢাকায় মেয়েদের হলে ঢুকে শুধু গুলী করে অনেক মেয়েকে হত্যা করেনি, তাদের উপর পাশবিক অত্যাচারও চালিয়েছে। সমকামী পাঠান সৈন্যরা মেয়েদের ঐ জঘন্য প্রকারেও ধর্ষণ করেছে। বক্তা পিতা আরো বলেছিলেন যে এ সমস্ত ঘটনা নীচের তলায় যখন হচ্ছিল তখন জন পঞ্চাশেক মেয়ে উপরতলা থেকে এ সমস্ত কাণ্ড দেখছিল। তারা যখন বুঝতে পারলো যে এর পরই তাদের পালা তখন তারা উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার মধ্যে বক্তার কন্যাও ছিল। তানভির আহমদ যখন বর্ণনার বীভৎসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ঐ মহিলাকে বলেছিলেন যে আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন যে এ ঘটনার মূলে কোন সত্য নেই। মহিলা জবাব দিয়েছিলেন Everything is fair in love and war অর্থাৎ যুদ্ধ এবং প্রেমের ব্যাপারে অন্যায় বলে কিছু নেই। তানভির সাহেবকে আমি বললাম যে ঢাকায় আমি নিজে মেয়েদের হলের প্রভোস্ট মিসেস আলী ইমামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসেছি। তাঁর থেকে যা শুনেছি তা হলো এই, ৭ই মার্চের পর অধিকাংশ মেয়ে হলো ছেড়ে চলে যায়। ২৪ তারিখে ৫ জন মেয়ে মাত্র ছিল। ২৪ তারিখের দিকে যখন আর্মি এ্যাকশনের সম্ভাবনা সম্বন্ধে যখন ঢাকায় নানা গুজব ছড়াতে থাকে তখন মিসেস ইমামের নির্দেশে এই মেয়েগুলোও হল ছেড়ে জনৈকা হাইজ টিউটরের বাসায় আশ্রয় নেয়। সুতরাং হলের মেয়েদের উপর অত্যাচার বা ধর্ষণের কোন কথাই উঠতে পারে না। -(সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ১৯৯৩)।
গ্রন্থপঞ্জি
- ড.সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন।একাত্তরের স্মৃতি,ঢাকা:নতুন সফর প্রকাশনী,১৯৯৩।
- ইব্রাহিম হোসেন।ফেলে আসা দিনগুলো,ঢাকা: নতুন সফর প্রকাশনী, ২০০৩।
- W. Chowdhury. The Last Days of United Pakistan; London: C. Hurst & Company, 1974.
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018