অধ্যায় ষোল: প্রতারণা দ্বি-জাতি তত্ত্বের সাথে
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 29, 2018
- ই-বুকস
- No Comments.
শ্বাশ্বত দ্বি–জাতি তত্ত্ব
যে কোন বিশাল মহৎ কর্মের শুরুতেই প্রবল দর্শন বা যুক্তি চাই। নইলে সে কর্মে জনগণ নিজেদের অর্থ, শ্রম, মেধা ও জানের কোরবানি পেশ করে না। ফলে সে দর্শনের প্রতিষ্ঠায় কোন অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনও গড়ে উঠেনা। পাকিস্তান তো এক অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলনের ফসল। কিন্তু কী ছিল সে আন্দোলনের মূল দর্শন? সে দর্শনটি ছিল দ্বি-জাতি তত্ত্ব। সে দর্শনটিই এতোই প্রবল ছিল যে, সেটি উপমহাদেশের মানচিত্রই পাল্টে দেয়। সে দর্শনটি ব্রিটিশদের বাধ্য করে ভারত বিভাগে; এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় হিন্দুগণও বাধ্য হয় ভারত মাতার বিভক্তিকে মেনে নিতে। সে দর্শনের মূল কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের থেকে মুসলিমগণ সর্বার্থেই একটি পৃথক জাতি। এ জাতির লোকদের বসবাস যেহেতু বিপুল সংখ্যায় এবং ভারতের বিশাল এলাকায় জুড়ে, তাদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রও চাই। মুসলিমগণ পৃথক জাতি শুধু ভিন্ন প্রকারের নাম ও নামকরণ পদ্ধতির জন্য নয়; বরং এজন্য যে, তাদের রয়েছে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর জীবন-লক্ষ্য, আইন-কানূন, তাহজিব তামুদ্দন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং সে সাথে এ জীবনে সফলতা ও বিফলতা যাচাইয়ের মানদণ্ড।
মুসলিম ও হিন্দু -এ দুইটি জাতি যেমন একই লক্ষ্যে বাঁচে না, তেমনি একই লক্ষ্যে রাজনীতি, শিক্ষাদীক্ষা এবং যুদ্ধবিগ্রহও করে না। একই লক্ষ্যে তারা রাষ্ট্রও নির্মাণ করে না। মুসলিমকে শুধু তার নামায-রোযা, হজ-যাকাত নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বাঁচতে হয় মহান আল্লাহতায়ার পক্ষ থেকে অর্পিত অলংঘনীয় ঈমানী দায়বদ্ধততা নিয়ে। সে দায়বদ্ধতার পরিধিটি বিশাল। সে দায়বদ্ধতার মধ্যে অন্যতম দায়ভার হলো মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিশ্বময় প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দেয়া। রাষ্ট্রের বুকে প্রতিষ্ঠা দিতে হয় শরিয়তি আইনকে। এখানে আপোষ চলে না। অন্যদের অধিকৃত রাষ্ট্রে বসবাসে সে দায়ভার পালিত হয় না। পরিপূর্ণ ধর্ম পালনের স্বার্থে তাদেরকেও রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হয়, প্রয়োজনে হিজরতও করতে হয়। শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাত নিয়ে বাঁচলে পরিপূর্ণ মুসলিম রূপে বাঁচা হয় না। ঈমানী দায়ভারও পালিত হয় না। ঈমানী দায়ভার নিয়ে বাঁচতেই মহান নবীজী (সাঃ) কে ২০টির বেশী যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং অধিকাংশ সাহাবাকে রণাঙ্গণে শহীদ হতে হয়েছে। এ জন্যই অমুসলিমদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর হলো মুসলিমের জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক এজেন্ডা।হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসানধীন ভারতে সে মুসলিম এজেন্ডা পূরণ অসম্ভব। সে জন্য মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তান চাই। এটিই হলো দ্বি-জাতি তত্ত্বের মূল কথা। সেটি যেমন জিন্নাহ বুঝতেন, তেমনি ভারতীয় মুসলিমগণও বুঝেছিলেন। ফলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রবল আন্দোলন হয়েছিল। এবং সে আন্দোলন সফলও হয়েছিল।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের জনক রূপে মুসলিম লীগ নেতা কায়েদ আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে চিহ্নিত করা হয়। এটি ইসলামের ইতিহাস ও কোরআনের জ্ঞানে অনভিজ্ঞ সেক্যুলারিস্টদের নতুন আবিস্কার। আসলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের জনক জনাব জিন্নাহ নন; এ তত্ত্বের শুরু মানব সভ্যতার শুরু থেকে। বস্তুত মানব জাতির ইতিহাসে এটি অতি শ্বাশ্বত ও পুরাতন তত্ত্ব। এ তত্ত্বের ভিত্তিতে মানব ইতিহাসের শুরুতেই মোটা দাগে বিভাজন টানা হয়েছিল সমাজের হাবিল ও কাবিলদের মাঝে -তথা ইসলামী এবং ইসলামবিরোধী শক্তির মাঝে। সভ্যতা নির্মাণের এ হলো দু’টি ভিন্ন ধারা। ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনাব জিন্নাহ এ তত্ত্বটি নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মাত্র; তিনি এর জনক বা আবিস্কারক নন। সে সত্যটি বহু মুসলিম বুঝতে ব্যর্থ হলেও অনেক হিন্দু সেটি বুঝতেন। তাই নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন, “The so-called two nation theory was long before Mr Jinnah or the Muslim League; in truth, it was not a theory at all, it was the fact of history. Every body knew this as early as the turn of the century. Even as children we knew it from before the Swadeshi movement.” –(Chaudhury, Nirod; 1951). অনুবাদঃ “তথাকথিত দ্বি-জাতিতত্ত্ব মি. জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের বহু আগেই বিরাজ করছিল। সত্য বলতে এটি কোন থিওরী ছিল না, এটি ছিল ইতিহাসের বাস্তব বিষয়। শতাব্দীর মোড় নেয়ার শুরুতেই প্রত্যেকে এটি জানতো। শৈশবে স্বদেশী অআন্দোলনের আগেই আমরা এটি জানতাম।” বঙ্কিম চন্দ্রের কাছেও সেটি অজানা ছিল না।তিনি লিখেছন, “হিন্দু জাতি ভিন্ন পৃথিবীতে আরো অনেক জাতি আছে। …যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। সেখানে আমাদের অমঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতি পীড়ন করিতে হয় করিব।” –(বদরুদ্দীন উমর,১৯৮৭)।তাই নিজেদের এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে মুসলিম পীড়নটি বঙ্কিম চন্দ্রের অপরাধ মনে হয়নি। এটিই হলো বাঙালী হিন্দু মনের আসল চিত্র।এমন এক সহিংস মন নিয়েই বাংলার হিন্দু মহাজন ও জমিদারগন মুসলিম পীড়নে নামে।
অন্যদের থেকে মুসলিমদের পরিচিতিটি শুরু থেকেই ভিন্নতর। সে ভিন্ন পরিচিতিটি এ জীবনে বাঁচবার সুনির্দিষ্ট ভিশন ও মিশনের কারণে। সে ভিশন ও মিশন বেঁধে দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। মানুষ মাত্রই পানহার করে। তবে বাঁচার লক্ষ্যটি পানাহার নয়। যে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচে সেটিই তার মিশন। মানব জীবনের সে সনাতন মিশনটি স্থির করে দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা। সেটি মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বাঁচার। এটিই মু’মিনের জীবনে মূল মিশন। অথচ কোন হিন্দু বা অন্য কোন অমুসলিম কি কখনো সে লক্ষ্যে বাঁচে? যাত্রাপথটি ভিন্ন হলে কেউ কি অন্যদের ট্রেনে উঠে? সে তো তার নিজ ট্রেনটি খোঁজে। কারণ হিন্দুদের এজেন্ডাই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন,তাতে মুসলিমদের জন্য কোন স্থান ছিল।হিন্দুদের শাসনাধীনে অখণ্ড ভারতে বসবাস এজন্যই ভারতীয় মুসলিমদের কাছে অভাবনীয় ছিল। তাতে অসম্ভব হতো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত মিশনটি নিয়ে বাঁচা। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সেদেশে শত শত বছরের জন্য অসম্ভব হতো শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। ব্রিটিশের হাতে পরাজিত হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় মুসলিমগণ সে গোলামী দশা থেকে পরিত্রাণের সুযোগ খুঁজছিল। সে জন্য জিহাদ তাদের উপর অনিবার্য ছিল। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদেরও সেটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি। দেরীতে হলেও সে সত্যটি কংগ্রেস নেতা গান্ধি, নেহেরু ও অন্যান্যরা বুঝেছিলেন। তারা এটিও বুঝেছিলেন, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না পেলে ভারতীয় মুসলিমদের অবিরাম জিহাদ দেশটির প্রতিষ্ঠাকে অনিবার্য করবে। মুসলিম লীগের “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ছিল সে জিহাদেরই ঘোষণা। মুসলিম লীগের সে ঘোষণাটি রাজনীতির স্লোগান ছিল না, ছিল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি ঈমানী দায়বদ্ধতার ঘোষণা। সে জিহাদের সামনে দাঁড়ানো সাহস ভারতীয় হিন্দুদের ছিল না, সে শক্তিও ছিল না। ভারতব্যাপী তেমন একটি জিহাদী পরিস্থিতি এড়াতেই ইসলামের চরমশত্রুরাও মেনে নিয়েছিল পাকিস্তান।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সুফল
ইসলামে রাজনীতির লক্ষ্য স্রেফ এক খণ্ড ভূখণ্ডের উপর স্বাধীনতা লাভ নয়। নবীজী (সাঃ) অতীতে সে লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য শুধু এ নয়,সেখানে স্রেফ জান-মাল, ইজ্জত-আবরু, ঘর-বাড়ী, ব্যবসা-বাণিজ্য নিরাপত্তা পাবে। বরং রাষ্ট্র এ জন্য অনিবার্য, মহান আল্লাহতায়ালার বিধান অনুযায়ী সেখানে জীবন পরিচালনা করবে। এটি ইসলামি সভ্যতা নির্মাণের কাজ। সে বিশাল কাজটি বনেজঙ্গলে অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব সংখ্যাগরিষ্ঠ কাফেরদের দেশে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অমুসলিম হলে সেদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার পরিবেশ ইসলামী হয় না। সেদেশে অসম্ভব হয় পরিপূর্ণ ইসলাম পালন ও পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা। তখন সেদেশের মুসলিমের জীবনে নেমে আসে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জিম্মিদশা। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরও তেমনি এক জিম্মিদশায় ভুগছে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম। ভারতীয় মুসলিমগণ এতোটাই নিরাপত্তাহীন যে, মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হলেও ন্যূনতম ন্যায় বিচার তাদের জুটেনি। দেশটিতে গরুহত্যা দণ্ডনীয়, কিন্তু মুসলিম হত্যা নয়। দিন দুপুরে পুলিশের সামনে বাবরী মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হলেও সে অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি; কারো কোন শাস্তিও দেয়া হয়নি। বরং আদালত থেকে মসজিদের ভিটায় মন্দির নির্মাণের অধিকার দেয়া হয়েছে। ভারতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার কথা তো কল্পনাও করা যায় না। অথচ শরিয়ত পালন ছাড়া কি ইসলাম পালন হয়?
১৯৪৭-য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না পেলে ভারতীয় মুসলিমদের সে জিম্মিদশায় যোগ হত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আরো প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটি মুসলিম। ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল মূলত এ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়া লক্ষ্যে। সে লক্ষ্যে মূল যুক্তি বা দর্শনটি ছিল দ্বি-জাতিতত্ত্ব। এ যুক্তিটি এতোই শক্তিশালী ছিল যে, ব্রিটিশ শাসকেরাও তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই তারা দেয় পৃথক নির্বাচন। যার ফলে মুসলিম এমপি নির্বাচিত হতো মুসলিম ভোটে। এতে মুসলমানের রাজনীতিতে গুরুত্ব পায় মুসলিম স্বার্থ ও মুসলিম তাহজিব-তমুদ্দনের প্রতি অঙ্গীকার। ফল দাঁড়ায়, মুসলিম প্রার্থীগণ ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম মানুক আর না মানুক, মুসলমানদের কাছে নিজেকে ধর্মভীরু রূপে পেশ করার প্রতিদ্বন্ধিতা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মিস্টারও তখন হাজির হয় মৌলবী রূপে। নেতাদের পোষাক-পরিচ্ছদেও কোট-প্যান্ট-টাইয়ের পরিবর্তে পাজামা-শেরওয়ানি-টুপি ও মুখে দাড়ীর গুরুত্ব পায়। মুসলিম লীগের নেতাদের মুখ দিয়ে তখন ধ্বনিত হতে থাকে,“কোরআনই আমাদের শাসনতন্ত্র” এবং “আল্লাহর দেয়া আইনই আমাদের আইন”। ভারতীয় মুসলিমগণ তখন দেখতে পায় ইসলামের নতুন জাগরণের সম্ভাবনা। স্বপ্ন দেখে, হারানো দিনের গৌরব ফিরে পাওয়ার। মুসলিম জাগরণের এ প্রভাব গিয়ে পড়েছিল এমন কি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের রাজনৈতিক দল ভারতীয় কংগ্রেসের উপরও। এ দলটিও স্রেফ মুসলিমদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ন্যায় একজন মাওলানাকে দলের সভাপতি করে। সেটি এক বছরের জন্য নয়, লাগাতর চার বছরের জন্য। সে সময় কংগ্রেস পেশ করেছিল, হিন্দু-মুসলিম মিলিত এক অভিনব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব। তাদের মুল কথা,ভারতে বসবাসকারি সকল হিন্দু, মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বিগণ প্রথমে ভারতীয়, তারপর তাদের ধর্মীয় বা ভাষাগত পরিচিতি। কংগ্রেস এ নীতিকে তুলে ধরেছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলে। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মূল বিচার বসবে সে কতটা সাচ্চা মুসলিম তা নিয়ে। ভাষা, ভূগোল বা জাতীয়তা নিয়ে সেদিন কোন প্রশ্নই উঠবে না। অতএব মুসলিমের রাজনীতিতে তার মুসলিম হওয়ার বিষয়টি যে সর্বপ্রথমে আসবে সেটিই তো স্বাভাবিক। অতএব কংগ্রেসের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব ভারতীয় মুসলিমদের কাছে সেদিন গ্রহনযোগ্যতা পায়নি।
প্রতারণা দ্বি–জাতি তত্ত্বের সাথে
১৯৪৬ সালে নির্বাচন হয়েছিল মূলত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং পাকিস্তান ইস্যুতে। অবিভক্ত বাংলার মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৫৪% এবং তাদের ৯৮% ভাগ সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেয় (সিরাজুদ্দীন হোসেনঃ ইতিহাস কথা কও; পৃষ্ঠা ১৭)এবং প্রত্যাখান করে কংগ্রেসের পেশ করা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব। প্রত্যাখ্যান করে সেক্যুলারিজম। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দ্বি-জাতি তত্ত্বের সাথে শুরু হয় প্রতারণা। সেটি শুরু হয় মুসলিম লীগের সাবেক বাঙালী নেতাদের দ্বারা। হঠাৎ করেই তারা সেক্যুলারিজম ও বাঙালী জাতিয়তাবাদে দীক্ষা নেন এবং বিষোদগার শুরু করেন দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে। তাদের এ নীতির পিছনে হঠাৎ কোন ফিলোসফি বা দর্শনের আবিস্কার ছিল না, ছিল স্রেফ ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। তাতে প্রয়োজন পড়ে হিন্দু ভোটের। ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে এ অস্ত্রটির প্রয়োজন এজন্যই বিশাল রূপে দেখা দেয়। ফলে তারা ভূলে যায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের পক্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে দেয়া তাদের নিজেদের দীর্ঘ দীর্ঘ বক্তব্যগুলো।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের সাথে প্রতারণার বিষয়টি আলোচনায় এলে বাংলার দুই জন নেতার নাম অবশ্যই প্রথমে আসে। তারা হলেন মওলানা ভাষানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধীতায় তারাই প্রথম সারিতে ছিলেন। অথচ ব্রিটিশ আমলে তারা নিজেরাও হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের কথা বলতেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই তাদের নীতিতে আসে প্রচণ্ড ডিগবাজি। মাওলানা ভাষানী নামের আগে মাওলানা এঁটে পীর-মুরিদী চালালেও তিনি নিজে একনিষ্ঠ মুরীদে পরিণত হন চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা চেয়্যারম্যান মাও সে তু্ঙয়ের।তার কাছে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি আইন প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও কোন গুরুত্ব পায়নি। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা হওয়ার বদলে তিনি পরিণত হন চেয়্যারম্যান মাও সে তুঙয়ের খলিফায়। মাও সে তুঙয়ের প্রভাব তার উপর এতোটাই গভীর ছিল যে তার নির্দেশে তিনি নিজের স্বঘোষিত নীতিও পাল্টিয়েছেন। সে প্রমাণ পাওয়া যায় লন্ডন-প্রবাসী পাকিস্তানী বংশোদ্ভুদ বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও লেখক তারিক আলীর লেখা “Can Pakistan Survive?” বইয়ে। পাকিস্তানে তখন আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসন। স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে পাকিস্তানের সকল বিরোধী দল একত্রে আন্দোলন করছে। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির একক প্রার্থী ছিলেন কায়েদে আযম মুহাম্মদ অলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। মাওলানা ভাষানীও তাকে সমর্থণ দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি খামোশ হয়ে যান এবং ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষের নির্বাচনি প্রচার থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। এরূপ নিরব হওয়ার কারণটি জানা যায় তারিক আলীর বইয়ে। নির্বাচনের কিছুকাল আগে ১৯৬৩ সালে মাওলানা ভাষানী চীন সফরে যান এবং চেয়ারম্যান মাও সে তুং’য়ের সাথে সাক্ষাত করেন। চেয়ারম্যান মাও মাওলানা ভাষানীকে কি বলেছেন সেটি জানার জন্যই তারিক আলীর ঢাকায় গমন। ভাষানীর সাথে সাক্ষাতেই তিনি জানতে চান চেয়ারম্যান মাও তাকে কি বলেছেন? মাওলানা ভাষানী বলেন, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে চীন বর্তমানে কিছু সমস্যায় আছে, তাই চেয়ারম্যান মাও’য়ের ই্চ্ছা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে যেন বিব্রত করা না হয়। গণতন্ত্রের সে ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানে গণত্ন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের চেয়ে চেয়ারম্যান মাও’য়ের সে নসিহতকেই মাওলানা ভাষানী বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। অথচ সে নির্বাচনটি পাকিস্তানের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মিস ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচিত হলে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ হয়তো ভিন্নতর হত।
ইসলামের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন আছে। নিজে দীর্ঘ দশটি বছর রাষ্ট্রপ্রধান থেকে নবীজী (সাঃ) রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা রেখে যান। নীতিমালা রেখে যান খোলাফায়ে রাশেদাগণও। রাজনীতিতে প্রতিটি মুসলিমের কাছে সর্বকালে সেটিই অনুকরণীয়। কিন্তু মাওলানা ভাষানীর কাছে সেসব নীতিমালা গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে সমাজতন্ত্র। ফলে নিজের আশে পাশে আলেম বা ইসলামপন্থীদের স্থান দেননি। বরং নানা সংগঠনের নামে তিনি ছাতা ধরেছেন সমাজতন্ত্রি ও কম্যুনিস্টদের আশ্রয় দিতে। নইলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানে নাস্তিক সমাজতন্ত্রি ও কম্যুনিস্টদের পক্ষে জনগণের মাঝে স্থান করে নেয়া সেদিন অসম্ভব ছিল। বামপন্থীগণ পশ্চিম পাকিস্তানে এমন কোন মাওলানাকে আশ্রয়দাতা রূপে পাশে পায়নি। এমনকি ভারতেও পায়নি। ফলে বাংলাদেশে যেরূপ লক্ষ লক্ষ মুসলিম যুবক সমাজতন্ত্র ও কম্যুনিজমের ন্যায় ইসলাম বিরোধী মতবাদের স্রোতে বিপথগামী হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তানী বা ভারতীয় মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। যে সব সমাজতন্ত্রি ও কম্যুনিস্টদের তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থান করে দেন তাদের অধিকাংশের মনে পাকিস্তানে প্রতি সামান্যতম অঙ্গীকারও ছিল না। আরো লক্ষ্যণীয় হলো, ভাষানী নিজে বহু আন্দোলন, বহু জনসভা, বহু অনশন,বহু মিছিল করেছেন। কিন্তু একটি বারও আল্লাহর আইন (শরিয়ত) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ময়দানে নামেননি। অথচ ঈমানদারের রাজনীতির এটিই তো মূল এজেন্ডা। অথচ সেটিই বাদ থেকেছে তার দীর্ঘকালের রাজনীতি থেকে। তার রাজনীতি বৈপরীত্যে ভরা। শেখ মুজিব যখন ৬ দফা পেশ করেন তখন তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতার গন্ধ পেয়ে সেটিকে পাকিস্তানকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র বলে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন।বলেছিলেন, “রোয কিয়ামত তক পাকিস্তান তার দুই অংশ নিয়েই বেঁচে থাকবে, তা’ ধ্বংস করার সাধ্য কারো নাই।” তিনি অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামকে ধমকের সুরে বলেছিলেন,“বেশী বেশী বাংলা বাংলা বললে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। এটা আল্লাহর দেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম রাষ্ট্র,এই দেশকে তোমরা ভাঙ্গতে চাও? তা আমি হতে দিব না।” (সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুঃ অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম, পৃঃ ৩১৪)। চীন সফর থেকে ফিরে তিনি আইয়ুবের পররাষ্ট্র নীতির প্রশংসা শুরু করেন। অপর দিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনিই প্রথম নেতা যিনি হিন্দুদের সাথে সুর মিলিয়ে পৃথক নির্বাচন বিলোপের দাবী তুলেন। অথচ পাকিস্তান ধ্বংসের পথে মূলত এটি ছিল প্রথম ষড়যন্ত্র। তিনিই মুজিবকে ৬ দফা ছেড়ে এক দফা তথা স্বাধীনতার পথ ধরতে বলেন।
নবীজীর (সাঃ) আমলে এবং তার পরবর্তীতে খোলাফায়ের রাশেদার আমলে মুসলিম দেশে বহু অমুসলিম বাস করত। তাদের সংখ্যার অনুপাতটি বাংলাদেশের হিন্দুদের চেয়েও বেশী ছিল। কিন্তু কে হবে খলিফা বা কীরূপ হবে আইন-আদালত ও রাজনীতি, সেটি নির্ধারণ করতেন মুসলিম জনগণ। তারা অমুসলিমদের জানমাল ও ব্যবসা- বাণিজ্যের পূর্ণ নিরাপত্ত দিয়েছেন, কিন্তু রাজনীতি, প্রতিরক্ষা ও ধর্মীয় বিধান প্রতিষ্ঠার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। মুসলিম উম্মাহর জীবনে প্রতিটি রাজনৈতিক ফয়সালাই অতি গুরুত্বপূর্ণ, এর উপর নির্ভর করে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় ও পরাজয়ের বিষয়টি। তাই এসব ফয়সালায় আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী তাদের নিয়ে পরামর্শ করা যায় না। ইসলামের বিধানে কখনোই অনৈসলামের ভেজাল চলে না। সেগুলি শতভাগ ইসলামী হতে হয়। কিন্তু ইসলাম-সম্মত সিদ্ধান্ত কি হিন্দু বা অন্য কোন অমুসলিম থেকে জুটে? মওলানা ভাষানীর রাজনীতিতে আল্লাহকে খুশি করার বদলে গুরুত্ব পায় হিন্দু, সেক্যুলারিস্ট, নাস্তিক ও কম্যুনিষ্টদের খুশি করার বিষয়টি। বস্তুত তাদের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মূল খেলাটি তিনিই প্রথম শুরু করেন। পরবর্তীতে শেখ মুজিবসহ আরো অনেকে সেটিকে ষোলকলায় পূর্ণ করেন।
মুসলিম লীগ ভেঙ্গে ভাষানীই আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ায় নেতৃত্ব দেন। শুরুতে আওয়ামী মুসলিম লীগের নীতিতে যুক্ত নির্বাচনের দাবী ছিল না। ব্রিটিশ আমলে মুসলিম প্রার্থীগণ নির্বাচিত হতো স্রেফ মুসলিম ভোটারদের ভোটে, ফলে তাকে হিন্দু এজেণ্ডার কাছ মাথা নত করতে হতো না। হিন্দুপ্রার্থী নির্বাচিত হতো হিন্দুদের ভোটে। এরূপ পৃথক নির্বাচন ছিল মুসলিম লীগের রাজনীতির ভিত্তি। ফলে পাকিস্তান আন্দোলনকে সফল করতে হিন্দু ভোটারদের সমর্থণ নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রধান দল রূপে আবির্ভূত হলেও দলটি সরকার গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ক্ষমতা পায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-প্রজা দল। শেরে বাংলার দলকে সমর্থন দেয় সংখ্যালঘু সদস্যগণ। আওয়ামী লীগ নেতাগণ তখন বুঝতে পারে, সংখ্যালঘুদের দলে টানতে না পারলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব। ফলে পরিবর্তন আসে দলের নীতিতে। সংখ্যালঘুগণ দাবী তুলে পৃথক-নির্বাচন প্রথা বাতিলের। সোহরাওয়ার্দী প্রথমে রাজী না হলেও পরে আত্মসমর্পণ করেন ভাষানীর কাছে। তখন মাওলানা ভাষানী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগের “মুসলিম” শব্দটিও তাদের কাছে অসহ্য হয়ে পড়ে। ১৯৫৫ সালে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আয়োজিত অধিবেশনে মুসলিম নামটিকে তারা আবর্জনার স্তূপে ফেলে। আওয়ামী মুসলিম লীগ তখন পরিণত হয় আওয়ামী লীগে। পৃথক নির্বাচন প্রথা তুলে নেয়ার ফলে আওয়ামী লীগ ও তার মুসলিম প্রার্থীগণ তখন হিন্দু ভোটারদের কাছে পুরাপুরি জিম্মি হয়ে পড়ে। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্রুত প্রাধান্য পায় হিন্দু এজেণ্ডা। আর হিন্দু এজেণ্ডার অন্য নাম ভারতীয় হিন্দুদের এজেণ্ডা। কারণ বাঙালী হিন্দুর এজেণ্ডা কখনো ভারতীয় হিন্দু এজেণ্ডা থেকে পৃথক ছিল না। সেটি যেমন ১৯৪৭’য়ে, তেমনি ১৯৭১’য়ে। এবং আজও নয়।
সেক্যুলারিজমের নাশকতা
দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে বড় প্রতারণাটি শুরু হয় সেক্যুলারিজমের নামে। ১৯৫৬ সালের ৭-৮ ফেব্রেয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারি -বর্তমানে সন্তোষ’য়ে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার দল হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। ইসলাম এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি যে চেতনা ও অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সে চেতনা ও অঙ্গীকার চিত্রিত হয় সাম্প্রদায়িকতা রূপে। পাকিস্তানের সৃষ্টির মূল ভিত্তিতে এটি ছিল একটি পাকিস্তানী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অতি কঠোরতম আঘাত।এমন একটি সেক্যুলার যুক্তি মেনে নিলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে যেমন যুক্তি থাকে না, তেমনি দেশটির বেঁচে থাকার পক্ষেও কোন যুক্তি থাকে না। পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতি বিপদসংকেত বেজে উঠে তখনই। আওয়ামী লীগের সে নীতিতে অতি প্রসন্ন হয় দিল্লির শাসকচক্র, এবং আনন্দ বাড়ে দেশের অভ্যন্তরে ওঁতপেত থাকা ভারতীয় ট্রোজেন হর্সদের –যারা ১৯৪৭ সাল থেকেই এমন একটি অবস্থার অপেক্ষায় ছিল। হিন্দু এজেণ্ডাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতালোভী রাজনীতিতে মুসলিম ও ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার শুধু অসহনীয়ই নয়, বর্জণীয় গণ্য হয়। একই সাথে দুই নৌকায় পা’ দেয়া যায় না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ তখন থেকেই পাকিস্তানী নৌকা ফেলে ভারতীয় নৌকায় উঠা শুরু করে।একাত্তরে সেটিই ষোলকলায় পূর্ণ হয়। এবং সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
সেক্যুলারিজমকে তাঁরা সংজ্ঞায়ীত করে ধর্ম-নিপরপেক্ষতা রূপে। অথচ সেক্যুলারিজমের এ অর্থটি যেমন বিভ্রান্তিকর ও তেমনি প্রতারণামূলক। এ ব্যাখাটি চালু করা হয় মুসলিম জনগণকে স্রেফ ধোকা দেয়ার লক্ষ্যে। সেক্যুলারিস্টগণ যা বলে সেটি ইসলামের কথা নয়, বরং ইসলামের শত্রুপক্ষের কথা।মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে তারা ইসলামকে বন্দী দেখতে চায় এবং শক্তিহীন রাখতে চায় মুসলিম উম্মাহকে।পৃথিবীতে যত রকমের ধর্মই থাক, মহান রাব্বুল আ’লামীনের কাছে একমাত্র মনোনীত ও স্বীকৃত ধর্ম হলো ইসলাম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে সুস্পষ্ট ঘোষণাটি এসেছে এভাবেঃ “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন রূপে মনোনীত করলাম।”-(সুরা মায়েদা,আয়াত ৩)।কোনটি সত্য ধর্ম,আর কোনটি মিথ্যা -তা নিয়ে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এ হলো সুস্পষ্ট সাক্ষ্য। এরূপ সাক্ষ্য আসার পরও কি কোন ঈমানদার নিরপেক্ষ থাকতে পারে? অন্য ধর্মের পক্ষ নেয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ পরিত্যাগ করা এবং শয়তানের পক্ষ নেয়া -সেটি কি উপরুক্ত আয়াত নাযিলের পরও বুঝতে বাঁকি থাকে? মহান আল্লাহতায়ালা তো চান তার প্রতিটি বান্দাহ শুধু ইসলামের পক্ষই নিবে না, প্রয়োজনে যুদ্ধও করবে। পৃথিবীতে মানুষ যত দলেই বিভক্ত হোক না কেন, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে দল মাত্র দু’টি। একটি আল্লাহর দল, অপরটি শয়তানের। পবিত্র কোরআনের ভাষায় “হিযবুল্লাহ” এবং “হিযবুশ শায়তান”। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার দলে শামিল হওয়া। তাই মুসলিমের জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতা আসে কি করে? ঈমানের অর্থ তো ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধতা। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো নিরবতা বা নিস্ক্রীয়তা। কাফেরদের সাথে নবীজী (সাঃ)’র যখনই কোন লড়াই হয়েছে,সাহাবাগণ কি তখন নিরপেক্ষ দর্শক থেকেছেন? সেক্যুলারিস্টগণ পবিত্র কোরআনের এ শিক্ষাকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে চায়। তাদের মিথ্যাচারটি তাই খোদ আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে।
সেক্যুলারিজম আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ নয়; বরং ইসলাম বিরোধী। ইসলামের প্রতিষ্ঠার যারা বিরোধী একমাত্র তারাই এ মতবাদ গ্রহণ করতে পারে। সেক্যুলারিজমের লক্ষ্য মূলত দুটিঃ এক).মানুষকে পরকালের বদলে পার্থিবমুখি করা –আভিধানিক অর্থে এটি ইহজাগতিকতা। দুই). রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত রাখা। এ দু’টি অর্থেই এ মতবাদটি ইসলাম বিরোধী এবং ইসলামের বুনিয়াদি বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। আখেরাত-সচেতনতা তথা পরকালে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জবাবদেহীতার ভয়ই মানব জীবনে আধ্যাত্মিক বিপ্লব আনে এবং ভাল কাজে আগ্রহ বাড়ায়। অপর দিকে পার্থিবমুখিতা ভূলিয়ে দেয় পরকালের ভয়, মানুষ তখন স্বার্থপর ও দুর্বৃত্ত হয়। আরবের জনগণ মহান নবীজী (সাঃ)র জন্মের বহু শত আগে থেকেই মহান আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করতো। সন্তানদের নাম আব্দুল্লাহ তথা আল্লাহর গোলাম রাখতো। কিন্তু বিশ্বাস ছিল না পরকালে। ফলে আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করলেও ভয় ছিল না তাঁর কাছে জবাবদেহীতার। এর ফলে নির্ভয়ে পাপের কাজ করতো। এমন কি নিজের কণ্যাকে জীবিত দাফন করতো। এবং সেটি স্রেফ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে। অর্থাৎ তারা ছিল শতভাগ সেক্যুলার। নবীজী (সাঃ) তাদের সে দুর্বৃত্ত জীবনে আমূল বিপ্লব এনেছিলেন আখেরাতমুখি করে। অথচ আধুনিক সেক্যুলারিস্টগণ জাহিলিয়াত যুগের সে উগ্র সেক্যুলারিজমকেই আবার ফিরিয়ে আনতে চায়।
অপর দিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মের প্রভাবমুক্ত রাখার বিপদটিও ভয়াবহ। রাষ্ট্রই হচ্ছে মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটিকে ইসলামের নিয়ন্ত্রনের বাইরে রেখে কি ইসলাম পালন সম্ভব? ঘরে হাতি ঢুকলে সে হাতি ঘরের সাজানো গোছানো সবকিছুই তছনছ করে দেয়। তেমনি মানুষের ধর্মপালন, পরিবার পালন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি তছনছ করার ক্ষেত্রে হাতির চেয়েও শক্তিশালী হলো রাষ্ট্র। তাই সেটিকে নিয়ন্ত্রনে আনতে হয়। নইলে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ-মাদ্রাসা গড়েও রাষ্ট্রীয় হাতির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের একটি জেলায় যত মসজিদ,খলিফায়ে রাশেদার আমলে সমগ্র মুসলিম জাহানে তা ছিল না। কিন্তু তাতে কি বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় এসেছে? প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কি আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন? রাষ্ট্রীয় হাতির মোকাবেলা করার সামর্থ্য কি লাখ লাখ মসজিদ বা মাদ্রাসার আছে? সে জন্য রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রনে আনতে হয় সেটিকে ইসলামী করে। এটিই হলো মহান নবীজী(সাঃ)র অতি গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত। সে সূন্নতের প্রতিষ্ঠা ঘটাতে তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা নয়, রাষ্ট্রীয় প্রধানও হয়েছেন। শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী সে কাজে শহীদ হয়ছেন। অথচ সেক্যুলারিস্টদের দাবী, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ইসলামের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। শয়তানকে খুশি করার এর চেয়ে মোক্ষম রাজনীতি আর কি হতে পারে? যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে সে কি এমন রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে? অথচ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের মাটিতে সে রাজনীতিকেই বাজারজাত করে। পাকিস্তানে নিজের শত্রু এভাবে নিজ ঘরেই বেড়ে উঠে।
সেক্যুলারিজমের নাশকতা
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় নাশকতাটির শুরু সেক্যুলার রাজনীতির মাধ্যমে। নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বীজ বপন করা হয়েছিল ঢাকাতে। আর সে ঢাকা নগরীতেই রোপণ করা হয় দেশটির ধ্বংসের বীজও। সেটি ১৯৫৫ সালে সেক্যুলার আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেদিনের রোপণ করা বীজটিরই কাক্ষিত ফল রূপে দেখা দেয় ১৯৭১’য়ে পাকিস্তানের বিভক্তি। পূর্ব পাকিস্তানে সেক্যুলার রাজনী তির উপস্থিতি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেও ছিল। সেটি ছিল হিন্দু বা বামপন্থীদের রাজনীতিতে। মুসলিমদের মাঝে সে রাজনীতি কখনোই জনপ্রিয়তা পায়নি। সেটি ঘটলে ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হতো না। মুসলিম দেশে সেক্যুলার রাজনীতির মূল এজেন্ডা হলো ইসলাম পালনে ও প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদেরকে অঙ্গীকারহীন করা। অথচ অঙ্গীকারবদ্ধতার মাঝেই মু’মিনের ঈমানদারী।ইসলামে সেক্যুলার রাজনীতি তাই হারাম। নবীজী ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে এমন রাজনীতি ছিল না। ইসলামে অঙ্গীকারহীন হলে অসম্ভব হয় ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম সংহতিতে অটল থাকা। তখন সংকটে পড়ে মুসলিম দেশের অস্তিত্ব। কিন্তু সে আত্মঘাতি সেক্যুলার রাজনীতিকে প্রবলতর করেন মাওলানা ভাষানী। পরিস্থিতি যখনই উপযোগী ভেবেছেন ভাষানী তখনই পাকিস্তান ভাঙ্গার গীত গেয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানকে সর্বপ্রথম তিনিই আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দেন। সেটি ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন পল্টন ময়দানে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায়। দ্বিতীয় বার জানান ১৯৫৬ সালে কাগমারি সম্মেলনে। সে সম্মেলনে তিনি গান্ধী, সুভাষবোস, চিত্তরঞ্জণ দাস প্রমুখ ভারতীয় নেতাদের নামে তোরণ নির্মাণ করেছিলেন। যেন বাংলার মুসলমানদের কল্যাণে এসব হিন্দু নেতাদের অবদানই বেশী। অথচ বাংলার মুসলিমগন নবজীবন লাভ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর।
পাকিস্তান সৃষ্টির মূলেই শুধু নয়, এ দেশটির বেঁচে থাকারও মূল প্রাণশক্তি ছিল মুসলিম ও ইসলামের প্রতি গভীর অঙ্গীকার। এ প্রাণশক্তি দুর্বল হলে পাকিস্তানের বেঁচে থাকার শক্তিটিও যে বিলুপ্ত হবে -সে সত্যটি শত্রুদেরও অজানা ছিল না। ফলে ভাষানীর প্রতিষ্ঠিত সে সেক্যুলার আওয়ামী লীগের মধ্যে ইসলামের শত্রুরা পাকিস্তানের মৃত্যুর পয়গাম শুনতে পায়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম দেশটির সৃষ্টিতে সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট ও কোন বর্ণহিন্দুর ভূমিকা ছিল না। বরং প্রাণপণে তারা বিরোধীতা করেছিল। ১৯৪৭’য়ের পর তাদের লাগাতর চেষ্টা ছিল দেশটির বিনাশ। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে এবং নতুন জীবন ফিরে পায়। পাকিস্তানের বিনাশের রাজনীতিতে তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র খুঁজে পায়। ফলে নিজেদের কথা বলার জন্য তাদের আর মুখ খুলতে হয়নি, সে কাজ আওয়ামী লীগই করেছে। ১৯৪৭ সালে তারা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রোধ করতে পারিনি, কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর এবার দেশটির বেঁচে থাকাকে বিপন্ন করার মহা সুযোগ পেল। দলটি তখন পাকিস্তানের মাটিতে ইসলামের বিপক্ষ শক্তির সম্মিলিত কোয়ালিশনে পরিণত হয়। সেটি প্রমাণিত হয় ১৯৭১’য়ে। ভাষানী ও সোহরাওর্দীর নেতৃত্বে এ দলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে হিন্দু, কম্যুনিষ্ঠ, নাস্তিক প্রভৃতি পদের ইসলাম বিরোধী বা ইসলামে অঙ্গীকারহীন ব্যক্তিবর্গ দলে দলে যোগ দিয়েছিল। ১৯৪৭-য়ের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ইসলামের প্রতিপক্ষ শক্তি তখন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে শুধু নিরাপদ আশ্রয়ই পায়নি, অতিবিশ্বস্ত মিত্রও পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের কাগমারি সম্মেলণে মাওলানা ভাষানী যাদের নামে তোড়ণ বানিয়েছিলেন তাদের তালিকায় কায়েদে আযম, আল্লামা ইকবাল বা নবাব সলিমুল্লাহর ন্যায় ব্যক্তিগণও স্থান পাননি। এমনকি নবীজী (সাঃ) বা খোলাফায়ে রাশেদারও কেউ নয়। এমন কি শাহজালাল (রহঃ) বা শাহ মোখদুম বা খান জাহান আলী (রহঃ)ও নন। তোরণ নির্মাণের মধ্য দিয়ে মূলত সবাইকে জানিয়ে দিলেন তার রাজনীতির কেবলা কোন দিকে। এবং কারা তাঁর তার স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এভাবে জানিয়ে দেন পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে তার মনে কি পরিমাণ ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিষ। এরপর গান্ধি বা নেহেরুর ভক্তরা পাকিস্তানের মাটিতে কংগ্রেসকে জীবিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। পাকিস্তানের চিহ্নিত শত্রুগণ তখন নিজ নিজ দল গুটিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়াকেই শ্রেয় মনে করে। তৃতীয়বার তিনি আর আসসালামু আলাইকুম বলেননি, সরাসরি স্বাধীনতারই ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটি ১৯৭০’য়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর। এই হলো এক কালের মুসলিম লীগ নেতার নাশকতার কাণ্ড! ভাষানীর রাজনীতিতের বড় সমস্যাটি ছিল, তার রাজনীতিতে কোন দর্শন ছিল না। ছিল প্রচণ্ড ভাবাবেগ ও মাঠ উত্তপ্ত করার নেশা। দর্শন রাজনীতিতে শক্ত শিকড়ের কাজ করে। আর সে বিশ্বাসটি যদি ইসলাম হয় -তবে তার চেয়ে শক্ত শিকড় আর কি হতে পারে? ফলে যে ব্যক্তি মুসলিম ও প্যান-ইসলামী –সে বিশ্বাস তার মাঝে বেঁচে থাকে আজীবনের জন্যই।শিকড়হীন কচুরিপানার ন্যায় সে তখন নানা মতবাদের স্রোতে নানা বন্দরে ভাসে না। বরং ইসলামী দর্শনের বলে শক্ত ভাবে সেগুলির মোকাবেলা করে। ফলে রাজনীতিতে কখনো প্যান-ইসলামী, কখনো সেক্যুলার, কখনো বা বামপন্থী–এরূপ নানা মতবাদে দীক্ষা নেয়ার সুযোগ থাকে না।অথচ অপ্রিয় হলেও সত্য, সময়ের তালে নানা শ্রোতে ভাসাটিই ছিল মাওলানার ভাষানীর নীতি। একই রূপ স্রোতে ভাসার রাজনীতি ছিল মুজিবের। তিনি এক সময় প্যান-ইসলামি রূপে অবাঙালীদের সাথে কাঁধে কাঁধ কলকাতার রাজপথে মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন।পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের কথা বলেছন। সমাজতন্ত্রী রূপে দেশের কলকারখানা জাতীয়করণ করেছেন;আবার ভয়ংকর বাকশালী স্বৈরাচারি রূপেও আবির্ভূত হয়েছেন।
ফিতনার রাজনীতি
সৃষ্টিশীল রাজনীতির পরিবর্তে একাত্তরের আগে ও পরে বাংলার মাটিত প্রতিষ্ঠা পায় মূলতঃ ফিতনার রাজনীতি।পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়েও জঘন্য বলেছেন। ফিতনাকারিদের মূল অপরাধ, তারা নানা কৌশলে ও নানারূপ মতবাদের আড়ালে সাধারণ মানুষের জন্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সিরাতুল মোস্তাকীমটি খুঁজে পাওয়াকে কঠিন করে এবং অসম্ভব করে সে পথে চলাক। ধর্ম পালন ও মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেও তারা বিপন্ন করে। স্রেফ নামায-রোযা বা হজ-যাকাত পালনে পরিপূর্ণ ধর্ম পালন হয় না। শরিয়তের প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিজয়ে জান ও মালের বিনিয়োগও এ জন্য অপরিহার্য। নবীজী (সাঃ) ও সাহাবাগণ তো সেটিই করেছেন। ধর্মপালনের সেটিই কোরআনী মডেল। মাওলানা ভাষানী ও তার অনুসারিগণ সে কোরআনী মডেল ও নবীজী (সাঃ)র সে সূন্নতের দিকে যাননি। সাধারণ মানুষকে তিনি সিরাতুল মোস্তাকীমের দিকেও আহবান করেননি। বরং শিষ্যদের সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে সরিয়ে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের পথে টেনেছেন। এভাবে জনগণকে যেমন ইসলাম থেকে দূরে টেনেছেন, তেমনি বিপন্ন করেছেন পাকিস্তানকেও।
বহু হাজার বা বহু লক্ষ মানুষের নিহত হওয়ার কারণে একটি জাতির জীবনে ধ্বংস বা পরাজয় আসে না। কিন্তু পরাজয় আসে আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও রাষ্ট্রে গোলযোগের কারণে। বাংলাদেশের ন্যায় কত দেশেই তো কত দুর্যোগ আসে। সে সব দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুও হয়। শত শত কোটি টাকার সম্পদও বিনষ্ট হয়। কিন্তু তাতে কোন দেশ ভেঙ্গে যায়নি। মুসলিম উম্মাহও তাতে দুর্বল হয়নি। মানুষ সে বিপদ কাটিয়ে উঠে। দেশ ধ্বংস হয় বা বিপর্যয়ের শিকার হয় যদি ধর্ম-পালন বাধাগ্রস্ত করা হয়; এবং যুদ্ধ বা গোলযোগের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা হয়। ভাষানী ও তার সহিংস সহচরগণ ছিলেন সে রকম বিদ্রোহ ও দেশ ধ্বংসের গুরু। সরকার গঠন ও সে লক্ষ্যে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর তিনি আর কোন কালেই নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন না। তার পারদর্শিতা ছিল শুধু একটি কাজেই –সেটি ফিতনা সৃষ্টি। ভারতের জন্য সহায়ক এমন একটি ভূমিকার জন্যই ১৯৭১’য়ে তিনি ভারত গমনে সাহস পান।
বিশ্বের মানচিত্র থেকে বিশাল খেলাফত যে কারণে হারিয়ে গেল তা কোন সুনামী, ভূমিকম্প, প্লাবন বা অন্য কোন বিপর্যয়ের কারণে নয়; বরং ভাষা, গোত্র ও এলাকা ভিত্তিক ফেতনার কারণে। মুসলিম উম্মাহর জীবনে সর্বনাশা সে নাশকতাটি ঘটেছিল জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের হাতে। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেল একই রূপ ফিতনার কারণে। মুসলিম উম্মাহর বিশাল এ ক্ষতিগুলি কি লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে পোষানো যায়? মসজিদ বা মাদ্রাসা গড়তে হাজার হাজার শহীদের প্রাণের কোরবানী লাগে না। কিন্তু সে কোরবানী লাগে এক ইঞ্চি ভূগোল বাড়াতে ও সে ভূগোলের প্রতিরক্ষা দিতে। কিন্তু মুসলিমগণ এতোটাই বিবেকশূণ্য যে ভূগোল ক্ষুদ্রতর করার সে বিষাদপূর্ণ দিনগুলোতেও বিজয় উৎসব করে! সে দিনে আনন্দ ভরে পতাকা উড়ায়। নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মুসলিমগণ যে পরস্পরে ভাই –মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া পরিচয়টিও তারা বেমালুম ভূলে যায়! বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিমের শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন হওয়ার কারণ যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত ভূগোল –সেটি বুঝবার সামর্থ্যও ইসলামী চেতনাশূণ্যদের নাই। নানা ভাষা ও নানা বর্ণে বিভক্ত ভারতীয় হিন্দুগণ শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করছে তাদের বৃহৎ ভূগোল ছোট হওয়া থেকে বাঁচাতে। রাশিয়া ও চীনসহ বিশ্বের আরো অনেক জাতি সেটি করছে। মহান নবীজী (সাঃ) মুসলিম রাষ্ট্রের ভূগোল পাহারা দেয়ার কাজে এক মুহুর্ত ব্যয়কে সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। অথচ বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ দেশের ভূগোল পাহারা দেয়ার বদলে যুদ্ধে কাফেরদের ডেকে এনেছে ভূগোল ছোট করার কাজে। যেন পাকিস্তানের বৃহৎ ভূগোলই ছিল বাঙালীর মূল সমস্যা। ১৯৭১’য়ে যে বিশাল বিজয়টি তারা ভারতের ঘরে তুলে দিয়েছে তা নিয়ে ভারতে প্রতি বছর বা প্রতি মাস নয়, প্রতি দিন ও প্রতি মুহুর্ত উৎসব হবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018