আধ্যাত্মিক বিপ্লব কেন ও কীরূপে?
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on May 16, 2019
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, ইসলাম
- No Comments.
অপরিহার্য কেন আধ্যাত্মিক বিপ্লব?
“আধ্যাত্মিকতা” বলতে আমরা কি বুঝি? কেনই বা অপরিহার্য “আধ্যাত্মিক বিপ্লব”? এবং কীরূপে সম্ভব এ বিপ্লব? এরূপ বিপ্লব না হলেই বা ক্ষতি কি? এ প্রশ্নগুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ।এবং অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের জন্য যারা এ বাঁচার মাঝে সার্বিক সাফল্য চায় এবং মৃত্যুর পর জান্নাত পেতে চায়। “আধ্যান” শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো স্মরণ বা চিন্তন।“আধ্যাত্মিক” শব্দটির মাঝে “আত্মা”র সাথে মিশ্রণ ঘটেছে “আধ্যান” শব্দের।ব্যক্তির মনে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণে লাগাতর ধ্যানমগ্নতাই হলো আধ্যাত্মিকতা।আরবী ভাষায় মনের এরূপ অবস্থাকে বলা হয় যিকর। যিকরের মাঝেই আত্মার পুষ্টি। পশুর জীবনে সে যিকর থাকে না বলেই সে পশু। মানুষ পশু বা তার চেয়েও নীচু পর্যায়ে পৌঁছে যদি সে যিকর ও ফিকর না থাকে।এখানে ফিকরের অর্থ হলো গভীর চিন্তাশীলতা।আরবীতে এরূপ চিন্তাশীলতা বলা হয় তাফাক্কু,তায়াক্কুল ও তাদাব্বুর। নবীজী (সাঃ) চিন্তাশীলতাকে উচ্চমানের ইবাদত বলেছেন।পবিত্র কোরআনে আ’’ফালা তাফাক্কারুন,আ’’ফালা তাদাব্বারুন,আ’’ফালা তা’ক্বীলূন বলে সে চিন্তাশীলতায় বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আধ্যাত্মিক বিপ্লবের অর্থ মানব মনে মহান আল্লাহতায়ালার যিকর ও ফিকরে বিশাল প্লাবন আনা। সে যিকর ও ফিকর তখন ব্যক্তির মনে সীমিত থাকে না,বরং কূল উপচানো জোয়ারের ন্যায় তা নেমে আসে ব্যক্তির কথা,কর্ম,লিখনি,আচরণ,রাজনীতি,সংস্কৃতি,অর্থনীতি,ব্যবসা-বাণিজ্য ও যুদ্ধবিগ্রহে।ব্যক্তির চেতনারাজ্যের এ বিশাল বিপ্লব তখন মহাবিপ্লব আনে পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে।তখন পাল্টে যায় দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি,রাজনীতি ও মূল্যবোধ।তখন নির্মিত হয় উচ্চতর সভ্যতা।নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে তো সেটিই হয়েছিল।মানব ইতিহাসে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লব।এ বিপ্লবটি ছিল বস্তুত মানব শিশুকে মানবতাসম্পন্ন প্রকৃত মানব রূপে গড়ে তোলার।ফলে এ বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার বিপদটি বিশাল। তখন মানব শিশুর পক্ষে মানব রূপে বেড়ে উঠাটি ব্যহত হয়।তখন সভ্যতার বদলে বাড়ে অসভ্যতা।শান্তির বদলে বাড়ে অশান্তি।
মহান আল্লাহতায়ালা চান,তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ এ মানব সৃষ্টি জৈবিক বা দৈহিক পরিচয়ের বাইরেও প্রবল এক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বল নিয়ে বেড়ে উঠুক। দৈহিক বলে মানব থেকে বাঘ-ভালুক-হাতি-সিংহ বহুগুণ শক্তিশালী। কচ্ছপও মানুষের চেয়ে বেশী দিন বাঁচে। মানুষের প্রকৃত গৌরব ও চ্যালেঞ্জটি বাঘ-ভালুকের ন্যায় শক্তি নিয়ে বাঁচা নয়,কচ্ছপের ন্যায় দীর্ঘ কাল বাঁচাও নয়। বরং নৈতিক গুণ নিয়ে বাঁচায়। মানবের শ্রেষ্ঠত্ব উচ্চতর সভ্যতা নির্মানের লক্ষ্য নিয়ে বাঁচায়। মু’মিনের জীবনে সেটাই মূল মিশন। সে মিশন ভূলে মানব যখনই নিছক পানাহার ও আনন্দ-উল্লাস নিয়ে বাঁচায় ব্যস্ত হয়েছে তখনই পশু থেকে মানুষের পার্থক্যটিও বিলুপ্ত হয়েছে। এরূপ পশুবৎ মানুষটি মর্যাদা হারায় মহান আল্লাহর কাছেও।সমাজে এরূপ মানুষের সংখ্যা বাড়লে আল্লাহর রহমত না এসে তখন আযাব আসে।
তাই আধ্যাত্মিক বিপ্লব অপরিহার্য শুধু ওলি-আউলিয়া,পীর-দরবেশদের জন্য নয়,এটি অপরিহার্য হলো প্রতিটি নারী-পুরুষ,বালক-বৃদ্ধেরও। কারণ,মহান আল্লাহতায়ালার সাথে আত্মিক বন্ধনটি অর্জিত না হলে বান্দার মুসলিম বা ঈমানদার হওয়াটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শুধু মু’মিন হওয়ার জন্য নয়,মানব শিশুকে এমনকি মানব রূপে বেড়ে উঠার জন্যও সেটি অপরিহার্য।ব্যক্তির জীবনে এ বিপ্লবটি না এলে শুরু হয় আগাতর নীচে নামা। নীচে নামা মানুষটি তখন বর্বরতা ও হিংস্রতায় হিংস্র পশুকেও হার মানায়।আজ অবধি দেশে দেশে রাজনৈতিক ও সামরিক বিপ্লব কম হয়নি। সে সব বিপ্লবে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ানটি অতি বিশাল। কিন্তু তাতে শান্তি বাড়েনি, প্রতিষ্ঠা পায়নি মানবতাও।মানব জাতির ব্যর্থতাটি এক্ষেত্রে অতি বেদনাদায়ক। পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বড় বড় হিংস্র তান্ডবগুলি কোন বন্য পশুদের দ্বারা ঘটেনি।প্লাবন,ঘূর্ণিঝড়,সুনামী,মহামারি বা ভূমিকম্পেও হয়নি।ভয়াবহ যুদ্ধ,বিশ্বযুদ্ধ,গণহত্যা,এথনিক ক্লিন্জিং,উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ন্যায় বীভৎস কান্ডগুলি ঘটেছে মানবতাশূণ্য বা আধ্যাত্মিকতাশূণ্য মানব-পশুদের হাতে।কম্যুনিস্টদের বিপ্লবে বহু লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে রাশিয়া ও চীনে। এবং ২০ লাখের বেশী মানুষ মারা গেছে ক্যাম্পুচিয়ায়। সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে মাত্র দুটি বিশ্ব যুদ্ধে। অথচ ইতিহাস জুড়ে এরূপ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সংখ্যা দুয়েক শত নয়,বরং বড় হাজার। তাছাড়া এরূপ মানব পশুদের পাপাচারের কারণে পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ভয়ানক আযাব নেমে আসার বিপদটিও বিশাল।
ইতিহাসের অনন্য বিপ্লব
প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের সফলতার মূল কারণটি কৃষি,শিল্প বা কারিগরি বিপ্লব নয়। বরং বিশাল মাপের আধ্যাত্মিক বিপ্লব।সে বিপ্লবের ফলে মানুষ বেড়ে উঠেছিল মহামানব রূপে।বলা হয়,অধিকতর ক্ষমতা মানুষকে অধিক অত্যাচারি,দুর্নীতিপরায়ন ও আরামপ্রিয় করে। ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় স্বৈরাচারি শাসকগণ তার উদাহরণ।কিন্তু আধ্যাত্মিক বিপ্লব ক্ষমতাধর মানুষেকেও অতিশয় বিনয়ী ও মাটির মানুষে পরিণত করে।মানুষের চিন্তা,চেতনা,চরিত্র ও কর্ম যে তখন কতটা পাল্টে যায় তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক।খলিফা হযরত উমরা (রাঃ) ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রটির প্রধান। তাঁর আমলে মুসলিমগণ তৎকালীন দুটি বিশ্বশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে প্রধান বিশ্বশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তার আমলের একটি মাত্র প্রদেশ বালাদে শাম (সিরিয়া)ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে আজ কের ৫টি রাষ্ট্র সিরিয়া,লেবানন, জর্দান, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন।থানার দারগো বা গ্রামের মাতবরও রাস্তায় সচারচর একাকী হাঁটে না,সেটিকে তারা হীনতা বা অপমান ভাবে।অথচ সে বিশাল রাষ্ট্রটির শাসক মদিনা থেকে জেরুজালেমের দীর্ঘ ৬ শত মাইল পথ সফর করেছেন মাত্র একজন খাদেম ও একটি মাত্র উঠ নিয়ে। পালাক্রমে খাদেমকে উঠের উপর বসিয়ে তিনি নিজ হাতে উঠের রশি টেনেছেন। যখন তাদের যাত্রা জেরুজালেমের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখন ছিল হযরতের উমর (রাঃ)র রশি ধরে উঠের সামনে চলার পালা। প্রজাদের কল্যাণে তিনি এতটাই বিভোর থাকতেন যে মাঝ রাতে কাঁধে আটার বস্তা বহন করে ক্ষুদার্ত মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সাবেক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রাঃ)কে তিনি শ্রদ্ধাভরে সম্বোধন করতেন “সাইয়েদুনা বিলাল” অর্থাৎ “আমাদের নেতা বেলাল” রূপে।কারণ সত্যদ্বীনকে চেনার ব্যাপারে হযরত বেলাল (রাঃ) হযরত উমর (রাঃ)এর চেয়ে অগ্রণী ছিলেন এবং অকথ্য নির্যাতনও তাকে ইসলাম থেকে বিচ্যুৎ করতে পারেনি। অথচ সম্ভ্রান্ত আরব সর্দারের পিঠে চাবুক মেরে শাস্তি দিতে তিনি ইতস্ততঃ করেননি। এই ছিল হযরত উমরের আধ্যাত্মিকতা। মহান আল্লাহতায়ালার ভয় হৃদয়ে স্থান পেলে অন্য সবকিছুর ভয় তখন বিদায় নেয়।কাকে অধীক সন্মান দিতে হবে সেটি তিনি শিখেছিলেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষনা থেকে।পবিত্র কোরআনের ঘোষণাঃ “ইন্না আকরামাকুম ইন্দাল্লাহি আতকাকুম” -সুরা হুজরাত আয়াত ১৩)।অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক তাকওয়া সম্পন্ন।” তাকওয়ার গুণে সে সমাজে তাই বেলালের মত সমাজের দরিদ্র ও দুর্বলেরা সেদিন অতি সন্মানিত হয়েছেন।সমগ্র ইতিহাসে কোন অমুসলিম রাজা বা শাসক কি একটি দিন,একটি ঘন্টা বা একটি মিনিটের জন্যও এরূপ নজির সৃষ্টি করতে পেরেছে? অথচ এই হযরত উমর (রাঃ)ই নবীজী (সাঃ)র হত্যায় অস্ত্রহাতে রাস্তায় নেমেছিলেন।ইসলাম কবুলের ফলে তিনি এক ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
কীরূপে আধ্যাত্মিক বিপ্লব?
সমাজ বিপ্লবে ইসলামের অবদান শুধু বিশালই নয়,অতূলনীয়ও।কোন ভূ-খন্ডে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেলে পরিবার ও রাষ্ট্র তখন মহামানব গড়ার ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়।অথচ শয়তানি শক্তির হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে পরিণতিটি হয় সম্পূর্ণ বিপরীত।তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পরিনত হয় মানুষরূপী হিংস্রজীবের উৎপাদন-কেন্দ্রে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান,ইরাকে যারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো বা অতীতে যারা রক্তক্ষয়ী ক্রসেড ও বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল তারা জঙ্গলে বেড়ে উঠেনি,বেড়ে উঠেছিল এরূপ রাষ্ট্রীয় ইন্ডাস্ট্রি থেকেই।অথচ রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও কল্যাণকর পরিচয় পেয়েছিল নবীজী (সাঃ)ও খোলাফায় রাশেদার আমলে।সে রাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য উমর।ফলে সম্ভব হয়েছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ।তখন রাষ্ট্র পরিণত হয়েছিল আধ্যাত্মিক বিপ্লবের হাতিয়ারে। কত সাধু-সন্যাসীই তো আধ্যাত্মিকতার নামে জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করে। হাজার হাজার সুফি-দরবেশ হুজরা,খানকা বা দরগায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তাদের হাতে বিশ্বের কোথাও কি আধ্যাত্মিক বিপ্লব এসেছে? সে সন্যাস ব্রতে নির্মত হয়েছে কি উচ্চতর কোন সভ্যতা? যে ভারতে বহুলক্ষ সাধু-সন্যাসীর বাস সে দেশটিতে বহুকোটি দরিদ্র ও অনগ্রসর মানুষ তো অচ্ছুৎই রয়ে গেছে।অচ্ছুৎদের ঘৃণা করা সন্যাসব্রতে অপরাধ গণ্য হয়না বরং ধর্মীয় কর্ম রূপে বৈধতা পায়।তাই সংসারত্যাগী সাধু-সন্যাসী প্রতিপালন বা আধ্যাত্মিকতার নামে খানকা,হুজরা বা দরগাহ গড়া মহান আল্লাহতায়ালার রীতি নয়,নবীজী (সাঃ)রও সূন্নত নয়।ইসলামের গৌরব যুগে এসব ছিল না।মুসলিম উম্মহর জীবনে ঈমানের স্রোত যখন গতি হারায় তখন আধ্যাত্মিকতার নামে এসব আবর্জনা জমতে শুরু করে।
মহান আল্লাহতায়ালার সাথে নিজ আত্মার বন্ধনটি গভীরতর করার মাঝেই আধ্যাত্মিক বিপ্লব।সে বিপ্লবে গুরুত্ব পায় পার্থিব স্বার্থের বদলে আখেরাতের স্বার্থ।গুরুত্ব পায়,আল্লাহ সুবহানা ওয়া’তায়ালা যা চান বা পছন্দ করেন সেটিকেই নিজ জীবনে প্রায়োরিটি দেয়া।মনের সে বিপ্লবটি অন্ধকার বনে-জঙ্গলে হয় না,জ্ঞানচর্চাহীন সুফিখানকা,পীরের মাজার বা হুজরাতেও হয় না। সে জন্য চাই ওহীর জ্ঞানে আলোকিত মন।সে আলোকিত মনের সৃষ্টিতে ইসলামের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটি হলো মসজিদ ওহীর জ্ঞান বিতরণে পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার এটিই একমাত্র আলোকিত ঘর বা ইন্সটিটিউশন।মহান আল্লাহতায়ালার সৈনিকদের জন্য প্রতি জনপদে এটিই মূল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুসলিমগণ যখন বড় বড় যুদ্ধজয় করেছে এবং জ্ঞানচর্চয় বিপ্লব এনেছে তখন মসজিদ ছাড়া তাদের কোন সেনানীবাস ছিল না।কোন বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল না। মসজিদের জায়-নামাজেই ঘটে মু’মিনের জীবনে সবচেয়ে বড় আত্মবিপ্লব।সে বিপ্লবটি ঘটে কোরআনী জ্ঞানে আত্মস্থ হওয়ায় এবং ইবাদতের মাঝে ধ্যানমগ্ন হওয়ায়।
মূল অস্ত্রটি কোর’আন
আধ্যাত্মিকতার পথে ঈমানদারের মূল যুদ্ধটি হয় তার নিজ নফস ও খায়েশাতের বিরুদ্ধে।এ যুদ্ধে তরবারি বা গোলাবারুদের ব্যবহার চলে না।অস্ত্রটি এখানে আল কোর’আন। পবিত্র কোর’আনই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে বান্দাহর একমাত্র যোগসুত্র। কোর’আনের মাধ্যমেই মহান আল্লাহতায়ালা বান্দাহর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর অন্তরে ওহীর ইলম (জ্ঞান) ও হিকমা (প্রজ্ঞা) ঢেলে দেন। নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটিই মুমিনের মূল হাতিয়ার।নামাজের শ্রেষ্ঠ অংশটি তাই রুকু-সিজদা নয়, বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কোরআন পাঠ।বার বার কোরআন পাঠের মাধ্যমে সে তার বিদ্রোহী নফসে হত্যা করে। নবুয়তের প্রথম সাড়ে এগারো বছর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও সে নামাজে আজকের ন্যায় রুকু-সিজদা ছিল না,ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘরাত ব্যাপী কোরআন তেলাওয়াত। তারাবীর নামাযে নফসের বিরুদ্ধে সে অস্ত্রটির প্রয়োগ আরো দীর্ঘকালীন হয়।মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশঃ “জাহিদু বিহি জিহাদান কবিরা” অর্থঃ “এ দিয়ে (অর্থাৎ কোরআন দিয়ে)বড় জিহাদের যুদ্ধটি চালিয়ে যাও।” রোযা মু’মিনের মনে মহান আল্লাহতায়ালার যিকর বা স্মরণকে পুরা দিবাভাগে জারি রাখে,রাতে সে সংযোগটি আরো গভীরতর হয়।এবং সেটি তারাবীতে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে।কিন্তু যে ব্যক্তিটি কোরআনের কথাগুলোই বুঝলো না,বা বুঝলেও তাতে ধ্যানমগ্ন হলো না -তার মনে আধ্যাত্মিকতা বাড়বে কেমনে? ঈমানদারের আধ্যাত্মিকতার মূল কেন্দ্রবিন্দুটি হলো কোরআন। মহান রাসূলে পাক (সাঃ)এর ভাষাই পবিত্র কোরআনই হলো যিকরুল্লাহিল হাকীম (প্রজ্ঞাপূর্ণ আল্লাহর যিকর),হাবলুল্লাহিল মাতিন (আল্লাহর মজবুত রশি)ও সিরাতুল মুস্তাকীম (জান্নাতের পথে সরল রাস্তা)।তাই কোরআন থেকে দূর থাকার অর্থ আল্লাহ রাব্বুল আ’’লামীনের যিকর,তাঁর মজবুত রশি ও তাঁর প্রদর্শিত জান্নাতের পথ থেকে দূরে থাকা। এমন দূরে থাকায় আধ্যাত্মিকতা হাওয়ায় হারিয়ে যায়।
মু’মিনের আলোকিত মনে যে চেতনাটি সর্বক্ষণ কাজ করে সেটি মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে জবাবদেহীতার দায়ভার।সে চেতনাটিই তাকে প্রতি পদে পথ দেখায়। জাহেলদের অন্ধকার মনে সে জবাবদেহীতার ভাবনা থাকে না,ফলে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলায় যেমন আগ্রহ থাকে না,তেমনি সে পথটি পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না।জাহেলদের থাকে পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির প্রবল তাড়না।ফলে থাকে প্রচন্ড পথভ্রষ্টতা।অপর দিকে মু’মিনের জীবনে প্রতিক্ষণের মূল ভাবনাটি জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচার।এটিই মু’মিনের তাকওয়া।এখানে ধ্যানমগ্নতাটি প্রতিদিন ও প্রতিক্ষণ মহান আল্লাহতায়ালার একান্ত আজ্ঞাবহ গোলাম রূপে বাঁচার;এবং সে সাথে সাথে তাঁরই রাস্তায় প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার আকুতি।
“ইসলাম” এর আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণ।আত্মসমর্পণটি এখানে মহান আল্লাহতায়ালার সর্বহুকুমের প্রতি।এমন আত্মসমর্পিত ব্যক্তিকেই বলা হয় মুসলমান।পবিত্র কোরআনে “উদখুলু ফিস সিলমে কা’আফ্ফা” অর্থঃ “ইসলামে পরিপূর্ণ রূপে দাখিল হয়ে যাও” বলে মহান আল্লাহতায়ালা মূলত সে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই চেয়েছেন।ফলে ঈমানদারের বুদ্ধিবৃত্তি,রাজনীতি,সংস্কৃতি,অর্থনীতি,ব্যবসা-বাণিজ্য তথা প্রতিটি কর্ম,চিন্তা ও আচরনের মাঝেই আসে ইসলাম তথা আত্মসমর্পণ।এবং সেটি না আসাটিই বেঈমানি।এরূপ আত্মসমর্পনের মাঝেই মু’মিনের আধ্যাত্মিকতা।দেশের রাজনীতি,সংস্কৃতি,অর্থনীতি ও প্রশাসনের অঙ্গণকে ইসলামচ্যুৎ সেক্যুলারিস্টদের হাতে সমর্পিত করে খানাকা,হুজরা বা দরগায় আশ্রয় নেয়াটি ঈমানদারি নয়,বরং গাদ্দারি।আল্লাহর দ্বীনের কোন আধ্যাত্মিক সৈনিক রাষ্ট্রের কোন একটি অঙ্গণেও আল্লাহর দ্বীনের পরাজয় মেনে নেয় না।প্রকৃত ঈমানদার ঝান্ডা উড়ানোর জন্য দেশ স্বাধীন করে না।ভাষা বা জাতির গর্ব বাড়াতেও যুদ্ধ করে না। অর্থ ও রক্ত ব্যয় করে এবং দেশ স্বাধীন করে স্রেফ আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।এপথেই মেলে জান্নাত।এখানেই মু’মিনের আল্লাহপ্রেম ও ঈমানদারি।তাদের বন্ধনটি ভাষা,বর্ণ,ভূগোল বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে নয়।বরং সেটি রাব্বুল আলামীনের সাথে। সালাউদ্দীন আইয়ুবী তাই কুর্দি হয়েও স্বাধীন কুর্দিস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেননি।বরং আরব,,তুর্ক,কুর্দ সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেছেন মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা ও সংহতি বাঁচাতে। তাঁর মনে কাজ করেছে আল্লাহপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতা।সে আল্লাহপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে মু’মিনগণ জন্মভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে গিয়ে জিহাদ করে এবং শহীদ হয়।আল্লাহতায়ালার রাস্তায় শহীদ হওয়ার মাঝেই তাঁরা জীবনের সর্বোচ্চ সফলতা দেখে। ইসলাম বহু হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে পৌঁছেছে তো এমন চেতনাধারিদের ত্যাগের বিনিময়েই।এমন এক আধ্যাত্মিক বিপ্লবের কারণে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুমুখি আহত ও পীপাসার্ত সৈনিকটি মুখের কাছে পানি পেয়েও পাশের অপর আহত সৈনিককে তা দিতে অনুরোধ করে।আত্মপ্রেমের স্থলে আল্লাহপ্রেম প্রবলতর হলে আচরণ এভাবেই পাল্টে যায়।কিন্তু মুসলমানদের মাঝে সে চেতনার আজ মৃত্যু ঘটেছে। ফলে থেমে গেছে ইসলামের প্রসার;এবং সে সাথে বিলুপ্ত হয়েছে মুসলমানদের শক্তি ও ইজ্জত। তারা ইতিহাস গড়ছে বরং দুর্বৃত্তি ও বিভক্তিতে।
নবীজী (সাঃ)র সাহাবাদের হাতে পীরামিড বা তাজমহল নির্মিত হয়নি।চাঁদের বুকে পা রাখার স্বপ্নও তাঁরা দেখেননি।তাদের জীবনে মূল সাধনাটি ছিল আল্লাহপ্রেমী হওয়ার। মনে ব্যাকুলতা ছিল মহান আল্লাহতায়ার কাছে কোন কর্মটি অতি পছন্দের সেটি জানার এবং প্রচন্ড তাড়না ছিল সে কর্মে প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার।ফলে তাদের আগ্রহ বেড়েছিল জিহাদে ও শহীদ হওয়াতে। এর চেয়ে বড় আধ্যাত্মিকতা আর কি হতে পারে? আধ্যাত্মিকতার সে বিপ্লব এসেছিল সাহাবায়ে কেরামদের জীবনে। মহান আল্লাহতায়ালার গর্ব তো এমন মানুষদের নিয়ে।ফেরেশতাদের দরবারে তিনি তাদের প্রশংসা করেন।এরূপ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণই শয়তান ও তার অনুচরদের মূল শত্রু। ফলে শয়তানি শক্তি চায় না,পৃথিবীর কোন প্রান্তে এমন আধ্যাত্মিক মানব নির্মাণের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠুক এবং মুসলিমগণ বেড়ে উঠুক জিহাদের সংস্কৃতি নিয়ে। এজন্যই ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের এতো ক্রোধ এবং বিশ্বজুড়ে গড়েছে বিশাল কোয়ালিশন।পৃথিবীর যেখানেই ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্ঠা সেখানেই শুরু হয় এ শয়তানি কোয়ালিশনের বিমান হামলা। তাদের বোমা বর্ষণে নিহত হয়েছে সিরিয়া ও ইরাকের হাজার হাজার নিরপরাধ নারী,শিশু ও বৃদ্ধ।বিধ্স্ত হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। তারা চায়,১৩০ কোটির বেশী মুসলমান বাস করুক ইসলামি রাষ্ট্র ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছাড়াই। অথচ মুসলমানদের জনসংখ্যা যখন বাংলাদেশের একটি জেলার সমানও ছিল না তখনও কি ইসলামি রাষ্ট্র,খেলাফত ও শরিয়ত ছাড়া তাদের একটি দিন বা একটি ঘন্টাও অতিক্রান্ত হয়েছে?
আধ্যাত্মিকতার পরিচয় কীরূপে?
দেশে আধ্যাত্মিকতা কতটা বাড়লো সেটি সুফি-দরবেশ,সুফি খানকাহ,মাজার ও পীর-মুরীদের সংখ্যা দিয়ে নির্ণীত হয় না।সুফি খানকাহগুলোর যিকর,ওজিফা পাঠ ও দরবেশী গানেও সেটি ধরা পড়ে না।বরং সঠিক ভাবে ধরা পড়ে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পণ কীরূপ,কতটা প্রতিষ্ঠা পেল শরিয়তি বিধান,কতটা সংঘটিত হলো জিহাদ,কতজন শহীদ হলো সে জিহাদে এবং কতটা নির্মূল হলো শয়তানি শক্তির বিদ্রোহ -তা দিয়ে।যে দেশের রাজনীতি,শিক্ষা-সংস্কৃতি,অর্থনীতি,প্রশাসন,আইন-আদালত জুড়ে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের পরাজয় এবং বিজয় ইসলামের শত্রুপক্ষের -সে দেশের মানুষের আবার কিসের আধ্যাত্মিকতা? তাদের ঈমানদারিই বা কোথায়? বিদ্রোহ বা অবাধ্যতার মাঝে কি আধ্যাত্মিকতা বাঁচে? আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শহীদ হওয়ার মাঝেই আধ্যাত্মিকতা তথা মহান আল্লাহতায়ালার সাথে বন্ধনের পরমতম প্রকাশ।জিহাদে তো তারাই যায় যাদের অন্তরের গভীরে মহান প্রভুর সাথে বন্ধনের টানটি প্রবল।শহীদ তো তারাই হয় যারা তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তি বিধানের বিজয় আনতে শুধু শ্রম,মেধা,অর্থ ও সময়ই বিনিয়োগ করে না,নিজের প্রাণও বিলিয়ে দেয়। শুধু চেতনা-রাজ্যে নয়,তাদের কর্মজীবনের সবটুকু জুড়ে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ।সে প্রতি মুহুর্ত বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে নিজ দায়বদ্ধতা নিয়ে। যার মধ্যে এ দায়বদ্ধতা নেই সে ব্যক্তি যত বড় সুফি বা সাধক রূপেই পরিচিত পাক না কেন,আদৌ কি তাকে আধ্যাত্মিক বলা যায়? মু’মিনের যিকর কি স্রেফ মহান আল্লাহতায়ালার নামের যিকর? সেটি তো তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার স্মরণ।মু’মিনের জীবনে এ যিকর প্রায় প্রতি মুহুর্তের।এদের নিয়েই মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন,“(এরা হলো তারা)যারা দাঁড়িয়ে,বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে,এবং চিন্তা করে আসমান-জমিনের সৃষ্টি নিয়ে..”) সুরা আল ইমরান,আয়াত ১৯১)।যিকর ও আধ্যাত্মিকতার এটিই তো প্রকৃত রূপ।আল্লাহতায়ালার প্রতি এরূপ গভীর প্রেম নিয়ে কোন ব্যক্তি কি মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের অপমান বা পরাজয় সইতে পারে? তাই যে দেশে জনগণের মাঝে আধ্যাত্মিকতা প্রকট,শয়তানি শক্তির দখলদারি বিরুদ্ধে জিহাদও সে দেশে প্রবলতর।তাই নবীজী(সাঃ)র এমন কোন সাহাবা ছিলেন না যিনি জিহাদে যোগ দেননি।অর্ধেকের বেশী সাহাবী শহীদও হয়েছেন।
বিশ্বে আজ মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে।বিপুল ভাবে বেড়েছে নামাযী ও মসজিদের সংখ্যাও। বেড়েছে সুফি-দরবেশ ও তাদের মুরীদদের সংখ্যাও।এবং আধ্যাত্মিকতার নামে বেড়েছে সুফি তরিকা,খানকাহ,ওরশ এবং ওজিফা পাঠের বিশাল বিশাল আয়োজনও।বেড়েছে ভক্তিগান,গজল, কাউয়ালী ও মারেফতি গান।কিন্তু এতো আয়োজনের মাঝে কতটুকু বেড়েছে আধ্যত্মিকতা বা আল্লাহপ্রেম? কতটুকু বেড়েছে জিহাদে সুফিদের সংশ্লিষ্টতা? কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শরিয়ত? বরং মুসলিম বিশ্বজুড়ে যা বেড়েছে তা হলো আল্লাহর দ্বীনের পরাজয়। মুসলিম দেশগুলি আজ দেশী ও বিদেশী শত্রুদের হাতে অধিকৃত;এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কুফরি আইন-আদালত।চোখের সামনে মহান আল্লাহতায়ার দ্বীন ও তাঁর শরিয়তি বিধানের এরূপ পরাজয় দেখেও যে ব্যক্তিটি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায় এবং সে পরাজয় রুখতে জিহাদে নামে না বা জিহাদের প্রস্তুতিও নেয় না এবং জনগণের সামনে জিহাদের গুরুত্বও তুলে ধরে না -সে ব্যক্তি যতবড় সুফি,পীর,দরবেশ,পীরে কামেল বা আল্লামা বলে খ্যাতি পাক না কেন,তার মধ্যে যে বিন্দুমাত্র আল্লাহপ্রেম বা আধ্যাত্মিকতা নাই -তা নিয়ে কি সন্দেহ চলে? আধ্যাত্মিকতার দাবীতে এরূপ জিহাদবিমুখ ব্যক্তিগণ যে ভণ্ড –সে সাক্ষ্যটি এসেছে খোদ নবীজী (সাঃ) থেকে। নবীজী (সাঃ)র প্রসিদ্ধ হাদীসঃ যে ব্যক্তিটি জিহাদে যোগ দিল না এবং জীবনে কোন দিন জিহাদের নিয়েতও করলো না -সে ব্যক্তিটির মৃত্যু ঘটে মুনাফিক রূপে। এ ভন্ডামী দাড়ি-টুপি ও দরবেশী লেবাস দিয়ে কি লুকানো যায়?
আধ্যাত্মিক বিপ্লবে ব্যর্থতা
ঈমানদারের জীবনে নামায,রোযা,হজ,যাকাত ও কোরআন পাঠের ন্যায় যত ইবাদত -তার মূল লক্ষ্যটি ইবাদতকারির জীবনে আধ্যাত্মিক বিপ্লব।ইবাদত যত গভীরতর হয় এ বিপ্লবও ততই প্রবলতর হয়।আধ্যাত্মিক বিপ্লব এলে চারিত্রিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব তখন অনিবার্য হয়ে উঠে,আগুণ জ্বললে যেমন উত্তাপ অনিবার্য।ইবাদত কতটা সফল তা পরিমাপের মূল মাপকাঠিটি হলো ব্যক্তির জীবনে এই আধ্যাত্মিক বিপ্লব।নামায-রোযা-হজ-যাকাত পালন ও কোরআন পাঠে যদি সে বিপ্লবই না আসে তবে বুঝতে হবে সেগুলি প্রকৃত ইবাদত নয়,নিছক রসম-রেওয়াজ। ইবাদতের অর্থ তো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ।প্রতিদিন ৫ বার মসজিদে ডেকে নামায তো সে আত্মসমর্পণের প্রশিক্ষণই দেয়। যে ইবাদতে কোরআনী আনুগত্য বা আত্মসমর্পণ সৃষ্টি হয় না -তা কি আদৌ ইবাদত? যে ব্যক্তির আত্মসমর্পণ এমন আইনের প্রতি যে আইনে সূদ,ঘুষ ও পতিতাবৃত্তির ন্যায় জ্বিনাও সিদ্ধ -সে ব্যক্তির ইবাদতকে কি ঈমানদারি বলা যাবে? নামায-রোযা তো নবীজী (সাঃ)র আমলে মুনাফিকগণও পালন করেছে,এমনকি নবীজী (সাঃ)র পিছনে তারা নামাযও আদায় করেছে।কিন্তু সে ইবাদতে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্কটি বাড়েনি। ফলে বাড়েনি আধ্যাত্মিকতাও।বরং যা বেড়েছে তা হলো রাব্বুল আ’’লামীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গাদ্দারি।
পশু বাঁচে তার জৈবিক সত্বা নিয়ে,সে বাঁচায় আধ্যাত্মিকতা নেই। সত্যকে চেনা বা বুঝার ব্যাপারে পশুর কান,চোখ ও ক্বালব কোন সাহায্যই করে না। ব্যক্তির জীবনেও একই রূপ অবস্থা সৃষ্টি হয় ঈমানশূন্যতা ও তাকওয়াশূণ্যতার কারণে।তবে পার্থক্য হলো,পশুর জীবনে অজ্ঞতা থাকলেও আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা নেই।কিন্তু সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা আছে মানব পশুদের মাঝে। এমন মানব পশুদের নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার ভাষ্যঃ“…তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে অনুভব করে না,তাদের চোখ কাছে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না,তাদের কান আছে কিন্তু তা দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ পশুর মত,বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর।এরাই হলো গাফেল।”–(সুরা আরাফ আয়াত ১৭৯)।প্রশ্ন হলোঃ মহান আল্লাহতায়ালা কি তাঁর পবিত্র জান্নাত এমন চেতনাশূণ্য পশুদের দিয়ে ভরবেন?
দেহ নিয়ে বেঁচে থাকাকে নিশ্চিত করতে মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবী পৃষ্টে নানারূপ পানাহারের ব্যবস্থা করেছেন।আর আত্মার খাদ্য জোগাতে একাধিক কিতাব নাযিল করেছেন।এবং সে সাথে লক্ষাধিক নবীরাসূল পাঠিয়েছেন,এবং তাদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ওহীর জ্ঞান দিয়েছেন। মানব রূপে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে এ হলো অতি অপরিহার্য প্রয়োজন। সে প্রয়োজন পূরণে পবিত্র কোরআন হলো সর্বশেষ কিতাব।সে অর্পিত মিশন পালনে পবিত্র কোরআনের সামর্থটিও গোপন বিষয় নয়। বস্তুতঃ সমগ্র মানব ইতিহাসে পরিশুদ্ধ আত্মার সবচেয়ে অধিক ও সবচেয়ে সবল মানুষ গড়ে উঠেছে পবিত্র কোরআনের বদৌলতে।মানব জাতির কল্যাণে এটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান।এ দান না পেলে মানুষের পক্ষে মানবিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠা কোন কালেই সম্ভব হতো না,তখন মানুষ বাঁচতো নিছক পশু রূপে।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দানের মাসটি হলো রামাদ্বান।এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সে দানটি হলো আল কোরআন। সে দানকে সম্মানিত করতেই তিনি রামাদ্বানে মাসব্যাপি রোযা ফরয করেছেন।এবং দান করেছেন লায়লাতুল ক্বাদর –যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।বহু গুণ বাড়িয়েছেন এ মাসে সম্পাদিত প্রতিটি নেক কর্মের সওয়াব। এভাবে বুঝিয়েছেন,মানব জাতির জন্য কত বড় গুরুত্বপূর্ণ দান হলো আল কোরআন। প্রশ্ন হলো,পবিত্র কোরআন নাযিল হওয়ার মাস হওয়ার কারণে যে মাসকে মহান আল্লাহতায়ালা এভাবে সন্মানিত করলেন,মুসলিমগণ নিজেরা সে কোরআনকে কতটা সন্মানিত করছে? সেটি কি অর্থ না বুঝে বার বার খতমে তেলাওয়াতের মাধ্যমে? কোরআন হিদায়েতের গ্রন্থ। না বুঝে পড়ায় কি হিদায়েত জুটে? কোরআন নাযিল হয়েছিল সিরাতুল মুস্তাকিম দেখাতে।কিন্তু সে সিরাতুল মুস্তাকীমের অনুসরণই বা কতটুকু? অনুসরণের জন্য তো সে পথের জ্ঞানটি জরুরী। সিরাতুল মুস্তাকিমের অনুসরণ হলে তো মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা পেত। গড়ে উঠতো ইসলামি খেলাফত।প্রতিষ্ঠা পেত শরিয়তি বিধান।বহুরাষ্ট্রে বিভক্তির বদলে প্রতিষ্ঠা পেত অখন্ডিত ভূগোল। কিন্তু সেটি হয়নি।অথচ এসবই তো সিরাতুল মুস্তাকীমের অবিচ্ছেদ্দ অংশ।সে অংশগুলির প্রতিটিতে পা না রাখলে কি সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা যায়? বরং যা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা তো মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মুসলিম দেশগুলির শাসনতন্ত্র এবং আইন-কানুন ও আদালত হলো সে বিদ্রোহের দলীল। এরূপ বিদ্রোহ বা অবাধ্যতায় মধ্য দিয়ে কি মাহে রামাদ্বানের সন্মান হয়?
অধিকৃতি শয়তানের
মহান আল্লাহতায়ালার যিকর বা স্মরণ থেকে দূরে সরার বিপদটি তো ভয়ানক। তখন নিজের উপর অনিবার্য রূপে নিয়োগপ্রাপ্তি ঘটে শয়তানের। তখন সে ব্যক্তির চেতনা অধিকৃত হয় শয়তান ও শয়তানের সৃষ্ঠ ধ্যান-ধারণায়।এটি এক ভয়ানক শাস্তি। এ শাস্তির পরিণামে অসম্ভব হয় হিদায়েত লাভ ও জান্নাত লাভ। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে শাস্তির প্রতিশ্রুতিটি এসেছে এভাবেঃ “এবং যে ব্যক্তি রহমানের স্মরণ থেকে দূরে সরলো তার তার উপর আমরা অবশ্যই নিয়োগ দেই শয়তানের এবং সে তখন তার সঙ্গিতে পরিণত হয়।এবং নিশ্চিত ভাবে তারা তাদেরকে (কোরআনে প্রদর্শিত)পথ থেকে বিচ্যুত করে,অথচ তারা ভাবে তারা সত্যপথ প্রাপ্ত।” –(সুরা যুখরুফ আয়াত ৩৬-৩৭)।আল্লাহর স্মরণ থেকে বিস্মৃত হওয়ার বিপদ যে কত ভয়াবহ -আজকের মুসলিমগণ তো তারই নজির।মুসলিম দেশে যারা ন্যাশনালিজম,ট্রাইবালিজম,সেক্যুলারিজম,লিবারালিজম,মার্কসবাদ,পুঁজিবাদ ও অন্যান্য ইসলামবিরোধী মতবাদের জয়গানে মত্ত তারা তো মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ ও তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে দূরে সরা লোক। তাদের গলায় তো শয়তানের রশি। তাদের বু্দ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি,সংস্কৃতি,অর্থনীতি ও আইন-আদালতের অঙ্গণ তো অনৈসলামি ধ্যানধারণা দ্বারা অধিকৃত। এবং তারা নিজেরা পরিণত হয়েছে ইসলামের আন্তর্জাতিক শত্রুপক্ষের কোয়ালিশন-পার্টনারে। তারা ব্যস্ত শত্রুর অস্ত্র নিয়ে মুসলিম দেশগুলিতে মুসলিম নিধনে ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রোধে।
বড় বাধাটি অজ্ঞতা
মানবতা নিয়ে বেড়ে উঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধাটি হলো অজ্ঞতা।এটি বিশাল বাধা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও।পানাহার ছাড়া দেহ বাঁচে না;জ্ঞান ছাড়া তেমনি বাঁচে না ঈমান।তবে সে জ্ঞান কৃষি,পশুপালন,অর্থনীতি,শিল্প বা বিজ্ঞানের জ্ঞান নয়।সেটি হলো পবিত্র ওহীর জ্ঞান।ওহীর জ্ঞানের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস হলো পবিত্র কোরআন।একমাত্র কোরআনী জ্ঞানই মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকীম চিনতে সাহায্য করে এবং জান্নাতে পৌঁছায়।মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মজবুত আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে একমাত্র এটিই তাঁর রশি।পবিত্র কোরআনে হুকুম দেয়া হয়েছে এ রশিকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরার। এবং বলা হয়েছে,যে এ রশিকে আঁকড়ে ধরলো সেই সিরাতুল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথ পেল।কোরআনের সাহায্যেই মহাজ্ঞানী রাব্বুল আলামীন ব্যক্তির আত্মায় সরাসরি ওহীর বানি পৌঁছিয়ে দেন।আত্মা তখন হিদায়েত পায় এবং ওহীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়।ঈমানদারের আত্মা এভাবেই পুষ্টি পায় এবং আধ্যাত্মিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়।যে মনে ওহীর জ্ঞান নেই,বুঝতে হবে সে মনে আধ্যাত্মিকতাও নাই।
সমাজে কে জাহেল আর কে আলোকপ্রাপ্ত -সেটি নির্ণয়ের মহান আল্লাহতায়ালা নিজের মাপকাঠিটি হলো এই ওহীর জ্ঞান। এ জ্ঞানের অভাবে একজন নবেল প্রাইজ বিজয়ী বিজ্ঞানীও জাহেল হতে পারে,জাহান্নামের যাত্রীও হতে পারে।অতীতে যারা পিরামিডের ন্যায বিস্ময়কর ইমারাত গড়েছে তারা বিদ্যাবুদ্ধি কম ছিল না। কিন্তু তারপরও তাদেরকে জাহেল বা অজ্ঞ বলা হয়েছে,জাহান্নামের বাসিন্দাও বলা হয়েছে।ওহীর জ্ঞানের অভাবে জাহেলদের জীবনে আধ্যাত্মিকতা থাকে না;যা থাকে তা হলো সিরাতুল মোস্তাকীম থেকে পথভ্রষ্টতা।থাকে জাহান্নামের পথে চলার নেশাগ্রস্ততা।জাহান্নামের পথে চলায় প্রতি পদে পথ চিনে চলার প্রয়োজন পড়ে না।জাহেলদের ধর্মে জ্ঞানার্জন তাই ফরজ নয়।অথচ সিরাতুল মুস্তাকীমে প্রতিপদে পা ফেলতে হয় কোরআনি জ্ঞানের আলোয় পথ চিনে। নইলে বিচ্যুতি বা পথভ্রষ্টতা অনিবার্য। ইসলামের শুরুটি তাই কোরআন নাযিল দিয়ে।গাড়ি যেমন মুহুর্তের ভূলে খাদে গিয়ে পড়তে পারে,ব্যক্তিও তেমনি পথভ্রষ্টতার শিকার হতে পারে।আধ্যাত্মিকতার খোঁজে ভন্ড পীর-ফকির-দরবেশের আসরে গিয়ে পৌছার ঘটনাও তাই কম নয়।
মুসলিমের জীবনে মুল ফিকর বা ধ্যানমগ্নতাটি পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচার।এমন ধ্যানমগ্নতা থেকেই জন্ম নেয় মু’মিনের আধ্যাত্মিকতা।দরবেশী বেশভূষা এখানে গুরুত্বহীন।ধ্যানমগ্নতা এখানে সর্বাবস্থায় সিরাতুল মুস্তাকীমে অবিচল থাকার।ঈমানদার ব্যক্তি কৃষক,শ্রমিক,বিজ্ঞানী,প্রশাসক,বিচারক,ছাত্র-শিক্ষক,রাজনীতিবিদ হলেও সে বাঁচে এ ধ্যানমগ্নতা নিয়ে।এমন আধ্যাত্মিকতায় সমাজ ও রাষ্ট্র অতি দ্রুত সভ্যতর হয়।সমাজে তখন অনাবিল শান্তি নেমে আসে। সাহাবাদের আমলে তো সেটিই হয়েছিল।জীবনের মুল পরীক্ষাটি হয় যেমন আধ্যাত্মিকতা নিয়ে বাঁচায়।অথচ মানব জাতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি ঘটে এক্ষেত্রে।ব্যর্থতার এ মহাবিপদ থেকে বাঁচাতেই মহান আল্লাহতায়ালা ওহীর জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নরনারীর উপর ফরজ করেছেন এবং লক্ষাধিক নবীরাসূল পাঠিয়ে সাহায্যও করেছেন।সফল তো তারাই যারা সে নেয়ামত থেকে ফায়দা নিয়েছে। মুসলিমের জ্ঞানার্জনের এ পর্বটি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভে শেষ হয় না।বরং সে জ্ঞানার্জনের ধারাকে বিরামহীন করতে পব্ত্রি কোরআনের সাথে সে সম্পর্কটি অটুট রাখতে হয়।এবং সেটি কবরে পৌছার পূর্বপর্যন্ত। তাই নবী পাক (সাঃ)এর নির্দেশঃ “উতলুবুল ইলম মিনাল মাহদে ইলাল লাহাদ”। অর্থঃ “দোলনা থেকে কবর অবধি জ্ঞানার্জন করো”। মুসলমানের তাই শুধু স্রেফ মুর্তিপুজা বা নাস্তিকতার বিপদ থেকে বাঁচা নয়,বরং অজ্ঞতার পাপ থেকে বাঁচাও।
বিষয় আত্মিক রোগমুক্তির
ব্যক্তির জীবনে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মিক রোগমুক্তি।আত্মিক রোগমুক্তির উপরই নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক ভাবে বেড়ে উঠা। অর্থাৎ মানবিক পরিচয় নিয়ে বাঁচা। আত্মার সে রোগমুক্তিতে রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার নির্ভূল চিকিৎসা ব্যবস্থা।পবিত্র কোরআনের ঘোষণা,“হে মানব!তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে নসিহত,এসেছে তোমাদের অন্তরে যে রোগ আছে তার আরোগ্য।এবং যারা মু’মিন তাদের জন্য এসেছে হেদায়েত এবং রহমত।”–(সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৭)।বলা হয়েছে,“উম্মীদের মধ্য থেকে তিনি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে শোনান,(এভাবে)তাদেরকে পবিত্র করেন,এবং তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত। ইতিপূর্বে তো এরাই ছিল ঘোরতর বিভ্রান্তিতে।-(সুরা জুমুয়া,আয়াত ২)। অর্থাৎ কোরআন তেলাওয়াত ও কোরআনের জ্ঞান আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে আসে পবিত্রতা,আসে প্রকৃত শিক্ষা ও প্রজ্ঞা।যে কারণে পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান ও আধ্যাত্মিক রোগমুক্তির উপায় -সেটি বুঝার জন্য উপরুক্ত দুটি আয়াতই যথেষ্ট।পবিত্র কোরআনের জ্ঞান ছাড়া আধ্যাত্মিক বিপ্লব দূরে থাক,উচ্চতর মানব ও মানবিক সভ্যতাও গড়া অসম্ভব। মু’মিনের দায়িত্ব হলো,আল্লাহতায়ালার নেয়ামতপূর্ণ ভাণ্ডার থেকে ফায়দা নেয়া।
পশুর জীবনে ওয়াজ-নসিহতের মূল্য থাকে না।কারণ,পশুত্বের উর্দ্ধে উঠে মহান কিছু হওয়া তার লক্ষ্য নয়।সে মিশনটি তো মানুষের। মানুষকে বনজঙ্গলের গুহায় ইতর ভাবে বসবাসের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি।বরং তাকে গড়া হয়েছে জান্নাতের উপযোগী হওয়ার জন্য।সে জন্য চাই আত্মায় পরিশুদ্ধি।পরিশুদ্ধির কাজে সহায়তা দানের দায়িত্বটি মহান আল্লাহতায়ালা নিজ হাতে নিয়েছেন।দেহে যেমন রোগ আসে,তেমনি মনেও বার বার বক্রতা ও বিভ্রান্তি আসে।সুস্থ্যতা নিয়ে বাঁচার জন্য চাই সে বিভ্রান্তি ও বক্রতা থেকে দ্রুত আরোগ্য।সে জন্য চাই প্রতিপদে হিদায়াত।হিদায়েতের সে জিম্মাদারি মহান স্রষ্টার।সে লক্ষ্য পূরণেই নায়িল হয়েছে পবিত্র কোরআন।তাই মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণাঃ “ইন্না আলায়নাল হুদা” অর্থঃ “নিশ্চয়ই পথ দেখানোর দায়িত্ব আমার।” –(সুরা লাইল)।বলা হয়েছে,“এটি (কোরআন) মানব জাতির জন্য সুস্পষ্ট বর্ণনা;এবং মুত্তাকীদের জন্য হিদায়েত ও নসিহত। -(সুরা ইমরান আয়াত ১৩৮)।
ইসলামের প্রথম দিকে মুসলিম জীবনে যখন নামায-রোযা,হ্জ-যাকাত ছিল না এবং কোন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল না তখনও মুসলিম ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান সৃষ্টি হয়েছে এই কোরআনের গুণে। ইসলামের প্রথম শহীদ হলেন হযরত সুমাইয়া (রাঃ) ও তাঁর স্বামী হযরত ইয়াছের (রাঃ)র। মক্কার কাফেরদের নির্মম অত্যাচার তাঁরা নীরবে সয়ে গেছেন,এবং শহীদ হয়ে গেছেন। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন থেকে এক বিন্দু্ও তাঁরা সরেননি। মাদ্রাসা বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়েও তাঁরা পেয়েছেন সত্যকে চেনার জ্ঞান।তাকওয়া এবং তাজকিয়ায়ে নাফস তথা আত্মার পরশুদ্ধির এর চেয়ে বড় নমুনা আর কি হতে পারে? আজকের উচ্চ ডিগ্রিধারিগণ পায় কি সে সামর্থ? বিপদের মুহুর্তে তাঁরা পেয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পবিত্র কোরআনে বর্নিত নসিহত ও হেদায়াত।মুসলমানদের জীবনে নামায-রোযা-হজ-যাকাত বেড়েছে,নফল ইবাদতও বেড়েছে এবং বিপুল ভাবে বেড়েছে মসজিদ মাদ্রাসা।কিন্তু বাড়েনি কোরআনের জ্ঞান। আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত নসিহত,হেদায়েত ও জ্ঞানের বাণীগুলোকে যেভাবে নবী (সাঃ)র যুগে আস্তে আস্তে অন্তরের গভীরে ভাল ভাবে বসিয়ে দেয়ার কাজটি হয়েছিল -আজকের মুসলিম সমাজে তা হচ্ছে না।
“কোরআনকে আমি সহজ করে করেছি উপদেশ গ্রহণের জন্য,উপদেশ গ্রহণকারি কেউ আছে কী?” সুরা ক্বামারে মহান আল্লাহতায়ালা এ প্রশ্নটি একবার নয়,৪ বার রেখেছেন।মহান করুণাময়ের প্রত্যাশা,যে পবিত্র কোরআনে করীমকে তিনি সহজ করে নাযিল করেছেন তা থেকে মানব জাতি প্রতিকর্মে উপদেশ নিবে এবং পরিণামে জান্নাত পাবে। জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচার এছাড়া কি ভিন্ন পথ আছে? কোরআন থেকে উপদেশ নেয়ার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে সেটি বুঝাতে একই সুরায় প্রশ্নটি তিনি ৪ বার রেখেছেন।চিন্তাশীল মানুষের অন্তরে ধাক্কা দেয়ার জন্য কি এটিই যথেষ্ট নয়? অথচ অন্যদের কথা দূরে থাক,খোদ মুসলমানেরা করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দেয়নি।মুসলিম ঘরে কোরআন তেলাওয়াত হয় স্রেফ সওয়াব হাসিলের আশায়,হিদায়েত লাভ বা শিক্ষা লাভে নয়।প্রশ্ন হলো,হিদায়েত লাভ না হলে সওয়াব লাভ কীরূপ হবে? আরবী ভাষায় “সওয়াব” হলো বোনাস বা পুরস্কার,হিদায়েত নয়।বোনাস বা পুরস্কার তো তারাই পায় যারা প্রভুর হুকুমের আজ্ঞাবহ ও নিষ্টাবান,অবাধ্য বা বিদ্রোহীদের তা জুটে না। অবাধ্য বা বিদ্রোহীগণ বহিস্কৃত করা হয় এবং শাস্তিও দেয়া হয়।যারা কোরআন থেকে কোন হিদায়েতই নিল না,শরিয়তের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যাদের লাগাতর যুদ্ধ,এবং যাদের রাজনীতি,সংস্কৃতি,পোষাক-পরিচ্ছদ ও আচরণের মাঝে বিদ্রোহের সুর –মহান আল্লাহতায়ালা কি তাদেরকে স্রেফ কোরআন তেলাওয়াতের কারণে সওয়াব দিবেন তথা পুরস্কৃত করবেন?
কোরআনের কথাগুলো যে ব্যক্তি বুঝলোই না -তা থেকে সে ব্যক্তি হিদায়েত পাবে কীরূপে? ওহীর জ্ঞানকে সে নিজ মনের গভীরে বসাবেই বা কি করে? কোরআন না বুঝার কারণে তখন ব্যক্তির লাগাতর দুরত্ব বৃদ্ধি পায় খোদ মহান আল্লাহতায়ালা থেকে।এবং তখন বাড়ে পথভ্রষ্টতা।তাতে অসম্ভব হয় ইসলাম থেকে কল্যাণ লাভ।এবং অসম্ভব হয় আল্লাহতায়ালার সাহায্য লাভ।যে ব্যক্তি মহান আল্লাহতায়ালা থেকে এভাবে দুরে সরলো এবং যিকরশূণ্য হলো,তার মন ও মনন যে শয়তানের দ্বারা অধিকৃতি হবে সেটিই তো কোরআনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুতি।ফলে পৃথিবীতে মুসলিমের সংখ্যা বাড়লেও ইসলামের প্রতিষ্ঠার বাড়ছে না।বরং বাড়ছে ভিতরে ও বাইলে শয়তানি শক্তির বিজয়।অথচ আল্লাহতায়ালা ও তাঁর পবিত্র কোরআনের সাথে সংযোগ বাড়াতে প্রাথমিক যুগের অনারব মুসলিমগণ নিজেদের মাতৃভাষাকে পরিত্যাগ করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিল।সে আমলে কোরআনের ভাষা শেখাটি এতটাই সহজ প্রমাণিত হয়েছে যে ভাষা শিখতে মিশর,সূদান,মরক্কো,তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া,লিবিয়া,মৌরতানিয়া,সিরিয়া,ইরাকসহ বিশাল এলাকার জনগণকে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়নি।
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি
মানব জাতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি কৃষি,শিল্প,বিজ্ঞান বা ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়।বরং সে ভয়ানক ব্যর্থতাটি আধ্যাত্মিকতায়।সভ্যতার নামে যুগে যুগে যা বেড়েছে তা সভ্যতা নয়,বরং নিদারুন অসভ্যতা। ইতিহাসে সে উদাহরনও কি কম? প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বড় বড় পিরামিড এবং ইউরোপীয় সভ্যতার বিশাল বিশাল শহর ও শিল্পস্থাপনা তো সে অসভ্যতারই প্রতীক।পিরামিড গড়তে পাথর চাপায় মারা গেছে হাজার হাজার দাসশ্রমিক।পিরামিডগুলো তো সেটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। ইউরোপীয়দের জৌলুস বাড়াতে এশিয়া-আফ্রিকা ও আমিরিকার কোটি কোটি মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসনের নিষ্ঠুর নির্যাতন সইতে হয়েছে।তাদের পরিচালিত ইথনিক ক্লিন্জিংয়ে প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে আমিরিকার রেড ইন্ডিয়ান,অস্ট্রেলিয়ার অ্যাব-অরিজিন ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসি মাউরী জনগণ।গরু-ছাগলের ন্যায় হাটে তুলে বেচা-বিক্রি করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ আফ্রিকানদের। ব্রিটিশ পণ্যের কাটতি বাড়াতে বাংলার মসলিন শিল্পিদের হাতের আঙ্গুল কাটা হয়েছে।পাশ্চাত্য অসভ্যতার আরেক অসভ্য সৃষ্টি হলো ইসরাইল।ফিলিস্তিনের আদিবাসীদের নির্মূলের মধ্য দিয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেছে অতি আগ্রাসী ও বর্ণবাদি রাষ্ট্র ইসরাইল।পাশ্চাত্য সভ্যতার অতি ভয়ংকর দুটি উপহার হলো দুটি বিশ্বযুদ্ধ।সাড়ে ৭ কোটি মানুষ হত্যার পাশাপাশি এ দুটি বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমান সম্পদ হানি করেছে তা দিয়ে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বহুযুগ বিনাশ্রমে আরাম-আয়াশে কাটাতে পারতো।এত সম্পদহানি অতীতে কোন ভূমিকম্প,সুনামী বা ঘূনিঝড়ে হয়নি।হালাকু চেঙ্গিজের বর্বরতাকে এ ধ্বংসযজ্ঞ ম্লান করে দিয়েছে।তবে বিনাশের সে বর্বর ধারা দুটি বিশ্বযুদ্ধে শেষ হয়নি।ভিয়েতনাম,আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসন ও ধ্বংসযজ্ঞ হলো নতুন সংযোজন। প্রাণনাশী ও সম্পদবিনাশী যুদ্ধবিগ্রহের সে পাশ্চাত্য ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।যুদ্ধের ঘোষণা না দিয়েও চলছে ড্রোন হামলায় হত্যাকান্ড।মানবহত্যাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার ধারকেরা এভাবে এক বিশাল শিল্পে পরিণত করেছে।তারা চালু করেছে গোয়ান্তানামো বে ও আবু গারিবের সংস্কৃতি। জুয়া,মদ্যপান,অশ্লিলতা,পর্ণগ্রাফীর সাথে ফিরিয়ে এনেছে সমকামীতার ন্যায় আদিম পাপাচার। এগুলিকে সভ্যতা ও আধুনিকতা বললে অসভ্যতা আর কাকে বলা যাবে?
পশুর বল তার দেহে,সেখানে কোন আধ্যাত্মিকতা থাকে না।তেমনি আধ্যাত্মিক থাকে না কাফেরদের যুদ্ধবিগ্রহ ও বিপ্লবেও।ফলে সেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিপ্লবে জানমালের স্রেফ ক্ষয়ক্ষতিই বেড়েছে।তাতে বড়জোর বহুদেশের সরকার ও মানচিত্র পাল্টে গেছে।কিন্তু তাতে মানুষের চরিত্র পাল্টায়নি,শান্তিও আসেনি।মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ বা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে বেড়ে না উঠলে মানুষ যে কতটা ধ্বংসমুখি ও জাহান্নামমুখি হয় –এ হলো তার উদাহরণ।তাই মানব-ইতিহাসের বড় শিক্ষাঃ স্রেফ যুদ্ধবিগ্রহ ও বিপ্লবে শান্তি বা কল্যাণ নাই।আখেরাতেও কোন কল্যাণ নাই।যেগুণটি মানুষকে অন্য জীবজন্তু ও সৃষ্টিকূল থেকে শ্রেষ্ঠতর দেয় সেটি তার দৈহিক বল নয়,সেটি আধ্যাত্মিক গুণ।মানবসমাজ একমাত্র তখনই মানবিক পরিচয় পায় ও শান্তির সন্ধান পায় যখন সে আধ্যাত্মিক শক্তির বৃদ্ধি ঘটে।
ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহৎ ও বিপ্লবটি গুণটি হলো তাকওয়া।এ গুণটি যেমন ব্যক্তির জীবনে আলোকিত বিপ্লব আনে,তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার চলার পথে তীব্র গতিময়তা আনে। সে গতিময়তা বিপ্লব আনে উম্মাহর জীবনেও। সমাজ ও সভ্যতা তখন সামনে এগুয়। নইলে জীবন পরিণত হয় সকাল থেকে সন্ধা,সন্ধা থেকে সকাল –এরূপ বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়মান এক গতিহীন জীবনে। প্রাচীন অজ্ঞতা,উলঙ্গতা,পাপাচার ও সমকামিতার ন্যায় নানা পাপাচার তখন সমাজে বার বার ফিরে আসে।এ কারণেই প্রাচীন জাহিলিয়াত তো পাশ্চাত্য সভ্যতায় আবার ফিরে এসেছে।তাছাড়া ইবাদত কবুলের শর্ত হলো তাকওয়া। নামায-রোযা,হজ-যাকাত তো বহু মানুষই আদায় করে।প্রতি বছর বহু লক্ষ মানুষ দেয় পশু কোরবানী।কিন্তু সবার ইবাদত বা কোরবানী কি কবুল হয়? কোরবানী দিয়েছিলেন হযরত আদম (আঃ)এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল।হাবিলের কোরবানী কবুল হয়েছিল কিন্তু কবুল হয়নি কাবিলের। কারণ কাবুলের কোরবানীতে তাকওয়া ছিল না।বরং ছিল অবাধ্যতা।সে অবাধ্যতার কারণেই সে তার ভাই হাবিলকেও খুন করে।শুধু আমল কবুল নয়,পাপ মোচনেও তাকওয়ার বিকল্প নেই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করলো (তথা তাকওয়ার অধিকারি হলো)তাঁর পাপ তিনি মোচন করে দিবেন।”–(সুরা তালাক,আয়াত ৫)।তাকওয়ার বলেই ব্যক্তি পায় আল্লাহর প্রতিটি হুকুমে লাব্বায়েক তথা আমি হাজির বলার সামর্থ।সেটি যেমন নামায-রোযা,হজ-যাকাত পালনের ক্ষেত্রে তেমনি রাষ্ট্র জুড়ে শরিয়তি বিধান,সূদমূক্ত অর্থনীতি ও দুর্বৃত্তমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্টার ক্ষেত্রে। যার মধ্যে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমে লাব্বায়েক বলার সে সামর্থ নাই,বুঝতে হবে তার মধ্যে তাকওয়াও নাই। এমন ব্যক্তিগণ মুখে যাই বলুক কার্যত তারা আল্লাহর অবাধ্য ও বিদ্রোহী। এমন বিদ্রোহের পরও কি তাদের ঈমান যাচায়ে বিরাট পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।এমন বিদ্রোহীদের কারণেই মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধান খোদ মুসলিম দেশে আস্তাকুঁড়ে গিয়ে পড়েছে।সূদ,জুয়া,অশ্লিলতা,পতিতাবৃত্তির ন্যায় নানারূপ অপরাধ কর্ম তখন সরকারি প্রশাসন,পুলিশ ও আদালতের প্রটেকশন পায়।অধিকাংশ মুসলিম দেশ বস্তুত অধিকৃত এরূপ বিদ্রোহীদের হাতেই।
নাশকতা শয়তানের
মহান আল্লাহতায়ালা চান,তাঁর গড়া সুন্দর পৃথিবীটি পরিশুদ্ধ ও উচ্চতর গুণের মানবে পূর্ণ হোক। তিনি চান,প্রতিটি মানব শিশু নিয়ামতপূর্ণ জান্নাতের বাসিন্দা হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠুক,এবং নির্মূল হোক এ ধরাধামে দুর্বৃত্তদের আধিপত্য ও দুর্বৃত্তকরণের প্রক্রিয়া। নির্মিত হোক মানবতায় পরিপূর্ণ এক মহান সভ্যতা। তবে সে কাজে অপরিহার্য হলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব। সেটি যেমন ব্যক্তির জীবনে,তেমনি পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে।সে লক্ষ্য পূরণেই মহান আল্লাহতায়ালা লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন,তেমনি নাযিল করেছেন ৪ খানি ধর্মীয় গ্রন্থ। সে ধারায় পবিত্র কোরআন হলো সর্বশেষ কিতাব। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার সে আয়োজনের বিরুদ্ধে শয়তানের আয়োজনটিও বিশাল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলি মূলত শয়তানি শক্তির হাতেই অধিকৃত। তাদের হাতে রয়েছে ইসলামি চেতনা বিনাশী অসংখ্য রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠান। সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে হাতিয়ার রূপে।সংকুচিত হয়েছে কোরআন শিক্ষা। অপর দিখে বিনিয়োগ বেড়েছে গান-বাজনা,খেলাধুলা,নাটক,টিভি,সিনেমা,সাহিত্য ও পত্র-পত্রিকায়। প্রতি জনপদে গড়া হয়েছে মদ্যশালা,নাট্যশালা,সিনেমা হল,পতিতাপল্লি,সূদী ব্যাংক,ক্লাব-ক্যাসিনো গড়া হয়। লক্ষ্য,সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত করা ও পাপের পথে টানা।তখন কি সম্ভব আধ্যাত্মিক ভাবে বেড়ে উঠা?
শয়তানের হাতিয়ার
মানব জীবনে মহামূল্যবান সম্পদটি হলো সময়।মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এটি এক মহামূল্য আমানত।সে আমানতের বড় খেয়ানত হয় অপচয়ে। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়েও এক মুহুর্ত সময় বাড়ানো যায় না। অর্থ অপচয়কারিকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। কিন্তু যারা মহামূল্য সময় অপচয় করে তাদেরকে কি বলা যাবে? মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কি এ অপচয়ের হিসাব দিতে হবে না? অথচ বিনোদনের নামে এরূপ বিশাল অপচয়কে জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে।আল্লাহতায়ালার স্মরণ ও তাকওয়া বিনাশে শয়তানের হাতিয়ার বহু। সেগুলি যেমন নাচ-গান,যাত্রা ও কুসাহিত্য,তেমনি হলো খেলাধুলা।খেলায় বা খেলা দেখায় যে মন বিভোর সে মনে কি পরকালের ভয়-ভাবনা থাকে? থাকে কি আল্লাহতায়ালার যিকর। যিকরশূণ্য সে মন তখন অধিকৃত হয় শয়তানের হাতে। ফলে নামাযের ওয়াক্ত অতিক্রান্ত হলেও উঠার হুশ থাকে না। শয়তান তো এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালা ভয় ও তাঁর স্মরণকে বিলুপ্ত করে।শত শত কোটি ঘন্টা এভাবেই বিনোদনের নামে হারিয়ে যায়। মুসলিম উম্মাহর জীবনে প্রতিবছর এ অপচয়ের পরিমান বহু ট্রিলিয়ন ঘন্টা।এর সিকি সময় দ্বীনের দাওয়াত ও জিহাদে ব্যয় হলে মুসলিম বিশ্ব থেকে বহু পূর্বেই শত্রুশক্তির দখলদারি বিলুপ্ত হতো এবং ইসলাম আবির্ভূত হতো বিশ্বশক্তি রূপে।পার্থিব জীবন তো পরীক্ষা কাল।মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা,“(তিনিই সেই আল্লাহ)যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন যাতে পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম।”–(সুরা মুলক আয়াত ২)।প্রশ্ন হলো,পরীক্ষা দিতে বসে কেউ কি বিনোদনে ব্যস্ত হয়? বিনোদনে কি ধ্যানমগ্নতা সম্ভব? সম্ভব কি আধ্যাত্মিক উন্নয়ন? অথচ শয়তান সেটিই চায়। শয়তানি শক্তির হাতে ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্র অধিকৃত হওয়ার সবচেয়ে বড় বিপদটি তো এখানেই।
অপরিহার্য কেন রাষ্টবিপ্লব?
আধ্যাত্মিক বিপ্লবের জন্য যা অতি অপরিহার্য তা হলো ইসলামি রাষ্ট্র বিপ্লব। আত্মার খোরাক যেমন বন-জঙ্গলে মেলে না,তেমনি শয়তানের অধিকৃত অনৈসলামিক রাষ্ট্রেও মেলে না।রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ রাস্তাঘাট,শিল্পকারখানা বা হাসপাতাল গড়া নয়। বাঘ-ভালুক থেকে বাঁচানোও নয়; বরং অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজটি জনগণকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচানো। মানব জীবনে এটিই সবচেয়ে বড় বাঁচা।নইলে অনন্ত অসীম কালের জন্য ঘর হয় জাহান্নামের আগুণে। সে সাথে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো,সিরাতুল মুস্তাকীমে তথা জান্নাতের পথে টানার। এটিও বিশাল শ্রমসাধ্য ও ব্যয়সাধ্য কাজ। জাহান্নামের আগুণ থেকে জনগণকে বাঁচানো ও জান্নাতের পথ দেখানোর কাজটি মূলত নবীরাসূলদের কাজ। নবী-রাসূলদের অবর্তমানে সে কাজটি নিজ দায়িত্বে নেয় ইসলামি রাষ্ট্র। ইসলামি রাষ্ট্রের অবর্তমানে সে কাজ ব্যক্তি ও পরিবারের পক্ষে অতি কঠিন হয়ে পড়ে। ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণ ও সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এজন্যই মু’মিনদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একাজে ব্শেীর ভাগ নবীজী (সাঃ)র সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। অথচ শয়তানি শক্তির মিশন হলো,একাজে মুসলমানদের নির্লিপ্ত করা।
ইসলামের মহান নবীজী (সাঃ) শুধু কোরআন-হাদীস রেখে যাননি,জনগণকে জান্নাতের পথে নিতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রও রেখে যান। প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব শুধু নামায-রোযা ও হজ-যাকাত পালন নয়, বরং সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায় আমৃত্যু সৈনিক হয়ে যাওয়া।এটিই নবীজী (সাঃ)র পক্ষ থেকে খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের দায়ভার। এ রাষ্ট্রের পাহারায় এক মুহুর্ত ব্যয় করাকে নবীজী (সাঃ) সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। শত্রুর হামলার মুকে প্রতিরক্ষার কাজকে জিহাদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এ ইবাদতে প্রাণ গেলে তাঁকে মৃত বলাকে মহান আল্লাহতায়ালা হারাম করে দিয়েছেন। এমন শহীদদের জন্য তিনি সরাসরি জান্নাতে প্রবেশের বিধান রেখেছেন। আজকের মুসলমানদের বড় ব্যর্থতা নামাযী,রোযাদার বা হাজি হওয়াতে নয়,মসজিদ-মাদ্রাসা গড়াতেও নয়,বরং আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদ হওয়াতে। বিলুপ্ত ঘটেছে আল্লাহর পথে জিহাদ ও খেলাফতের। এবং যেদিন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে খেলাফত, সেদিন থেকেই মুসলিম দেশগুলি অধিকৃত হতে শুরুকরেছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। বিচ্যুতি বেড়েছে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে। এবং বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামের শরিয়তি বিধান। আর শরিয়ত পালন না হলে কি ইসলাম পালন হয়? মহান আল্লাহতায়ালার হুশিয়ারিঃ “মান লাম ইয়াহকুম বিমা আনাযাল্লাহু ফা উলায়িকা হুমুল কাফিরুন, …হুমুল যালিমুন, …হুমুল ফাসিকুন” অর্থ আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তা অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না তারাই কাফির, ….তারাই যালিম, ….তারাই ফাসিক।” –সুরা মায়েদা আয়াত ৪৪, ৪৫, ৪৭)। কাফির,যালিম ও ফাসিক হওয়ার জন্য কি তাই মুর্তিপুজারি,অগ্নিপুজারি বা নাস্তিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে? দেশের বিচার কাজ থেকে মহান আল্লাহর নাযিলকৃত শরিয়তি বিধানের অপসারণই যথেষ্ঠ।অজ্ঞতা অবাধ্যতাই বাড়াই।জাহিলিয়াতের এটিই তো খাসলত।মুসলিম দেশে তাই বেড়েছে শরিয়তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ঔপনিবেশিক শাসনের বদৌলতে মুসলমানদের চেতনা রাজ্যে ঘন মেঘের ন্যায় ছেয়ে আছে জাহিলিয়াত।সে মেঘ দিন দিন আরো ঘনিভূত হচ্ছে। অথচ স্রেফ সাহাবায়ে কেরামের সময় নয়,এমন কি ঔপনিবেশিক কাফরদের হাতে অধিকৃত হওয়ার পুর্বে মুসলিম দেশগুলিতে কি এমন একটি দিনও অতিক্রান্ত হয়েছে যখন আদালতে শরিয়তি আইন ছিল না? ইসলামি রাষ্ট্র নির্মিত না হলে ইসলাম পালন এভাবেই অসম্ভব হয় এবং জনগণ ইসলাম থেকে দুরে সবে।তখন মুসলিম দেশে বৃদ্ধি পায় মুসলিম নামধারি কট্টোর কাফের,জালেম ও ফাসেকদের সংখ্যা। ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা নিয়ে তখন খোদ মুসলিম দেশে জিহাদ করতে হয়!
মানুষের চিন্তা-চেতনা,আচার-আচরণ,কর্ম ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা মামুলী বিষয় নয়। অন্যের বিরুদ্ধে দূরে থাক,একাকী এমন কি নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে বিজয় লাভও অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে এমনকি নিজ পরিবারে সদস্যদের উপর নিয়ন্ত্রন রাখা ও তাদেরকে ইসলামের পথে রাখা অতি কঠিন।অতীতে ব্যর্থ হয়েছেন এমন কি নবীও।আজ ব্যর্থ হচ্ছেন অনেক আলেম পরিবার। কারণ শয়তান ও নিজ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের মূল হাতিয়ারটি হলো আল কোরআনের গভীর জ্ঞান।কিন্তু সে জ্ঞান কি অনৈসলামি রাষ্ট্রের স্কুল-কলেজ,মিডিয়া বা সাহিত্যে মেলে? সেগুলি বরং শিশুমনকে ইম্যুনাইজড করে ইসলামের বিরুদ্ধে। বীজ থেকে চারা বৃক্ষ রূপে বেড়ে উঠার জন্যও তো অনুকুল পরিবেশ চায়, বীজ ঝোপঝাড়ে পড়লে তা বেড়ে উঠে না।তাই পবিত্র কোরআনের হাজার হাজার কপি কাফের অধ্যুষিত দেশে পাওয়া গেলেও তা থেকে সচারাচর মুজাহিদ গড়ে উঠে না।এজন্যই কাফের দেশে বসবাস কোন কালেই জায়েজ বিবেচিত হয়নি। বরং উৎসাহ দেয়া হয়েছে হিজরতের।ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে কোন মুসলিম রাষ্ট্র অধিকৃত হলে একই রূপ বিপদ ঘটে সেদেশেও। সে রাষ্ট্রে তখন অসম্ভব বা দুঃসাধ্য হয় ইসলাম পালন ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব। তখন রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান কাজ করে আল্লাহর স্মরণকে ভূলিয়ে দেয়ার কাজে। অন্যসব নবী-রাসূলদের তূলনায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)র সাফল্যের বড় কারণ,তাঁর হাতে রাষ্ট্র ছিল। তাঁর মহান নেতৃত্বে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান জনগণকে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে রাখতে সাহায্য করেছিল। সে ধারা অব্যাহত থাকে এবং রাষ্ট্র বলবান হয় খেলাফতে রাশেদার আমলে।ফলে অতিদ্রুত ইসলামের বিস্তার ঘটে সমগ্র বিশ্বজুড়ে।
বাস-যাত্রীদের সবাই যদি মাতাল বা পাগল হয় তবুও সে বাস গন্তব্যস্থলে পৌছে -যদি সে বাসটির ড্রাইভার সুস্থ্য ও সঠিক থাকে। কিন্তু ড্রাইভার মাতাল বা পাগল হলে যাত্রীদের দোয়া-দরুদ পাঠও কাজ দেয় না।একই অবস্থা হয়েছে ইসলামি শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অবস্থা। ক্ষমতালোভী সরকারগুলি দেশে দেশে ইসলাম পালন অসম্ভব করেছে।এভাবে অসম্ভব করে তুলেছে জান্নাতের পথে চলা।এদের কারণেই মুসলিম রাষ্ট্রগুলি আজ সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কাজ হয়েছে,ব্যক্তির মনের ভূবন থেকে মহান আল্লাহর স্মরণকেই বিলুপ্ত করা। কম্যুনিস্ট শাসনামলে সোভিয়েত রাশিয়ায় হাজার হাজার মসজিদকে ঘোড়ার আস্তাবল বানানো হয়েছে। চীনের সিনজিয়াং প্রদেশে উইগুর মুসলমানদের উপর রোযা রাখায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। সন্ত্রাস রূপে চিত্রিত হচ্ছে নবীজী (সাঃ)প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকীমে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা। ইসলামের শত্রুপক্ষ নবীজী (সাঃ)র এ ইসলাম মেনে নিতে রাজী নয়। নবীজী (সাঃ)র ইসলাম রুখতে তারা আন্তর্জাতিক কাফের কোয়াশিনের সাথে জোট বেঁধেছে। ইসলাম বলতে ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্তগণ সেটিই বুঝে যা তারা নিজেরা পালন করে। মুসলিম দেশগুলির মূল সমস্যা তো ইসলামের শত্রুদের হাতে এরূপ অধিকৃতি। অথচ জনগণ সে অধিকৃতি থেকে মুক্তির জিহাদ না করে দোয়াদরুদ পাঠে দায়িত্ব সারছে!দেশের ড্রাইভিং সিট থেকে দুর্বৃত্তদের সরানোর জিহাদে তারা অংশ নিতে রাজি নয়।এ পথে কি মহান আল্লাহর সাহায্য মেলে? আখেরাতেও কি মুক্তি মিলবে?
ঘরের শত্রু
সিরাতুল মুস্তাকীমের পথটি স্রেফ নামায-রোযা,হজ-যাকাতের পথ নয়;এ পথে যেমন জিহাদ আছে,তেমনি ইসলামি খেলাফতও আছে। আছে শরিয়তের পূর্ণ প্রতিষ্ঠাও।ব্যক্তির জীবনে আধ্যত্মিক বিপ্লব এলে প্রতি পদে আসে আল্লাহর দ্বীনের পূণ অনুসরণ।সে খোঁজে কোথায় হারাম-হালালের নির্দেশ।খোঁজে কোথায় জিহাদের ময়দান।সেখানে সে নিজ খরচে গিয়ে হাজির হয়। আফগানিস্তানের জিহাদে তো এভাবেই হাজার হাজার সাচ্চা মুজাহিদ বিশ্বের নানা প্রান্তর থেকে গিয়ে হাজির হয়েছিল,এবং সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় একটি বিশ্বশক্তিকে পরাস্ত করেছিল। এবং আজ জমা হচ্ছে সিরিয়ায়। দ্বীন পালনে সামান্য আপোষও এমন মুজাহিদদের কাছে অচিন্তনীয়।আল্লাহপ্রেমী এমন ব্যক্তি সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে এক বিন্দু সরতে রাজী হয় না। সে শুধু নামাযের প্রতি রাকাতে “এহদিনাস সিরাতুল মুস্তাকীম” বলে মনের আর্জি পেশ করে না,বরং জীবনের প্রতি পদে সে পথে চলায় সিরিয়াস ও নিষ্ঠাবান হয়।সিরাতুল মুস্তাকীমে চলায় প্রতি মুহুর্তে এরূপ নিষ্ঠাবান থাকাটাই তো প্রকৃত ঈমানদারি। এটিই তো মু’মিনের জীবনে সত্যিকার তাকওয়া।ঈমানদারের মনে এরূপ তাকওয়া বৃদ্ধিই তো নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের ন্যায় ইবাদতের মূল লক্ষ্য।
নামাযে দাঁড়িয়ে “সিরাতুল মুস্তাকীম” চাওয়া আর রাজনীতির ময়দানে নেমে ইসলামি রাষ্ট্র,খেলাফত,জিহাদ ও শরিয়তের বিরোধীতা করা তো সুস্পষ্ট মুনাফেকী। এটি তো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে গাদ্দারি;এবং তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।এ অপরাধ তো ইসলামের শত্রু-শিবিরে ফিরে যাওয়ার অপরাধ।যারা এভাবে ইসলামে বিরোধীতায় নামে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে শুধু মুনাফিক বলেননি,মুরতাদও বলেছেন।খোলাফায়ে রাশেদার যুগে মুরতাদের শাস্তি দেয়া হতো প্রাণদণ্ড দিয়ে।পাপের যে ফসল সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফলেছে,আজ যে তা শতগুণ বেশী ফলবে তা নিয়ে কি সন্দেহ আাছে? মুসলিম দেশগুলি তো তাদের হাতেই আজ অধিকৃত। নামে মুসলমান হলেও ইসলাম ও তার শরিয়তি বিধানকে পরাজিত দেখার মধ্যেই এদের আনন্দ। আজকের মুসলিমদের মূল জিহাদটি তাই ভিন্ দেশী কাফেরদের বিরুদ্ধে নয়,বরং স্বদেশী এ মুরতাদদের বিরুদ্ধে।
আত্মবিপ্লব ও বিজয় যে পথে
দেহে বর্জ জমা হলে শরীর বাঁচে না।বর্জের সাথে তাই আপোষ চলে না। মুসলিম সমাজের আজকের স্বাস্থ্যহীনতা ও শক্তিহীনতার মূলকারণ তো ভিতরে জমা এ বিশাল বর্জ।মুসলিম নাম ধারণ করে এরাই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে ব্যস্ত। এরা শুধু ইসলামি রাষ্ট্রবিপ্লবের শত্রু নয়,তারা শত্রু মুসলিম মানসে আধ্যাত্মিক বিপ্লবেরও। ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা নিয়েই কোরআন চর্চায় তারা বাধা দেয়। নিয়ন্ত্রন করে মসজিদে কোরআন শিক্ষা ও জুম’আর খোতবা। এভাবে নানা ভাবে তারা অসম্ভব করেছে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা। আজকের মুসলমানদের বড় ব্যর্থতা শুধু ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠায় নয়,ইসলামের এ ঘরের শত্রুদের চেনাতেও।বরং এ শত্রুদের কাছে আত্মসমর্পণই তাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতি। এবং এরূপ আত্মসমর্পণকে বলে প্রজ্ঞা! ফলে জঘন্য এ শত্রুদের থাবা পড়েছে সর্বত্র। এমনকি চেতনার যে ভূবনে বীজ পড়বে সে ক্ষেত্রটিতেও। ফলে সমাজ বিপ্লব বা রাষ্ট্রবিপ্লব আর কি হবে,আত্মবিপ্লবও সম্ভব হচ্ছে না। মহান আল্লাহতায়ালা কি এমন মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন? কারণ যারা নিজ অবস্থার পরিবর্তন করে না তাদের পবিবর্তন করাটি তো তাঁর সূন্নত নয়। পবিত্র কোরআনে তাঁর ঘোষণাঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।”–(সুরা রা’দ আয়াত ১১)।জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের মূল দায়ভারটি তাই বান্দার।তবে সে পরিবর্তনে যারা নিয়েত বাঁধে এবং আত্মরিক ভাবে সচেষ্ট হয়,তাদের পথ দেখানোর দায়িত্বটি মহান আল্লাহতায়ালা নিজ দায়িত্বে নেন। পরম করুণাময়ের পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“যারা আমার পথে আত্মনিয়োগ করে আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পথ দেখাবো।নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।”–(সুরা আনকাবুত আয়াত ৬৯)। তিনি তাদের বিজয়ও দেন। বিজয় নিশ্চিত করতে তাদের সাহায্যে হাজার হাজার ফেরেশতাও পাঠান।
আখেরাতে প্রতি ব্যক্তিই তার নিজ সামর্থের বিনিয়োগের প্রতিদান পায়।কাফের থেকে মু’মিনের পার্থক্যটি সৃষ্টি হয় মূলত বিনিয়োগের এ ক্ষেত্রটিতে। কাফেরের লড়াই শয়তানের পথে। প্রতিদানে পায় জাহান্নাম। আর মু’মিন তার অর্থ,শ্রম,সময়,মেধা ও রক্তের বিনিয়োগটি করে মহান আল্লাহতায়ালার পথে। মহান আল্লাহতায়ালার পথে অবিরাম আত্মনিয়োগই মু’মিনের আধ্যাত্মিকতা। আর আত্ম-উন্নয়নে যে বিনিয়োগ সেটিই তো বিনিয়োগের সর্বোত্তম ক্ষেত্র। আত্ম-উন্নয়নের তাগিদে মু’মিন তখন ওহীর জ্ঞানের আমৃত্যু ছাত্রে পরিণত হয়।ফলে তার জীবনে পর পর দু’টি দিন কখনোই একই রূপ হয় না, জ্ঞানের রাজ্যে সে প্রতি দিন উপরে উঠে। লড়াকু মুজাহিদ সে শত্রুর বিরুদ্ধে আমৃত্যু জিহাদে। এভাবেই মু’মিনের জীবনে প্রতিক্ষণ কাটে এবাদতে। আসে আত্ম-পরিসুদ্ধি। সাহাবায়ে কেরাম তো আত্ম-উন্নয়ন ও আত্ম-পরিসুদ্ধির এ পথ ধরেই সমগ্র মুসলিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ আলেম ও শ্রেষ্ট মুজাহিদে পরিণত হয়েছিলেন। আল্লাহর দরবারে নিজের মূল্যমান ও মর্যাদা বাড়ানোর এটিই তো শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।প্রতিটি মু’মিন তো এভাবেই রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের পাওয়ার হাউসে পরিণত হয়। কোন দেশে যখন কোটি কোটি এরূপ পাওয়ার হাউস সে দেশ কি কখনো শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হয়? রেকর্ড গড়ে কি দুর্বৃত্তিতে? সে দেশ তো বরং অবিরাম বিজয় আনে ও গৌরবের উচ্চ শিখরে পৌঁছে। সাহাবায়ে কেরামদের যুগে বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে রাষ্ট্রবিপ্লব এসেছিল এবং মুসলিম রাষ্ট্রটি বিশ্বশক্তির মর্যদা পেয়েছিল তো এমন আত্মবিপ্লবীদের দ্বারাই। মহান আল্লাহতায়ালার কাছেও তারা প্রিয় হতে পেরেছিলেন।আজও কি সে লক্ষ্যে পৌছার ভিন্ন পথ আছে? ১০/৭/২০১৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- যে যুদ্ধ পলাশীতে শেষ হয়নি
- ১৯৪৭’য়ের নেতৃবর্গ এবং ১৯৭১’য়ের নেতৃবর্গ
- অসভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের আওয়ামী মডেল
- মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি এবং অর্জিত বিপর্যয়
- গণতন্ত্র ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন সমীকরণ
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018