আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা  ও ইসলামী রাষ্ট্রের অনিবার্যতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মানব জীবনের এজেন্ডা কি?

কেন মানুষ বাঁচবে, কি হবে তাঁর বাঁচার এজেন্ডা এবং কেন ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ -এ বিষয়গুলি মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ বিষয়গুলি বুঝতে ব্যর্থ হলে এ জীবনের সমগ্র বাঁচাটাই ভূল হবে এবং ভূলের জন্য নিশ্চিত জাহান্নামে পৌঁছতে হবে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়েছে এ বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে। দার্শিনক, বিজ্ঞানী বা পেশাজীবী হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এ বিষয়গুলি সঠিক ভাবে বুঝা। নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের আমলে মুসলিমদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু ভেড়ার রাখাল, কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণও বিষয়গুলি সঠিক ভাবে বুঝতেন। ফলে তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হতে পেরেছিলেন এবং মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন। আজকের মুসলিমদের মূল ব্যর্থতা এখানেই। বহু কোটি মুসলিম আজ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি হাসিল করলেও তারা জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় করতে পারিনি। কারণ সে ফরজ আদায় করতে হলে তো কুর’আন বুঝতে হয়। সে কুর’আন বুঝার কাজটিই তারা করেনি। ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর তাদের অজানা রয়েছে। ফলে ধাবিত হচ্ছে ব্যর্থতার দিকে -সেটি যেমন এ দুনিয়ায়, তেমনি আখেরাতে। তাদের পার্থিব জীবনের ব্যর্থতা বুঝা যায় তাদের নিজ জীবন ও নিজ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দেখে।

কি হবে ঈমানদারের বাঁচার এজেন্ডা এবং কেন ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে সে তাঁর শ্রম, মেধা, অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগ করবে -সেটি বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হয় মানব জাতিকে নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে। নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করা সত্ত্বেও যারা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবে না এবং তেমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদেও নামে না -বুঝতে হবে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বুঝতে এবং সে এজেন্ডার সাথে একাত্ম হতে। এবং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সা:) যে ইসলামের প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন -সে ইসলামকে সঠিক ভাবে বুঝতে। ইসলাম নিয়ে তাদের ধারণাটি নিতান্তই অজ্ঞতা-প্রসূত। এরূপ অজ্ঞতা ও ব্যর্থতার কারণে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম মুসলিম বিশ্বের কোথাও আজ বেঁচে নাই। আর সে ইসলাম বেঁচে না থাকাতে বেঁচে নাই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। এবং বেঁচে নাই অসত্য ও অবিচারের নির্মূলে ও সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ। বেঁচে নাই প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্ব। তারা বসবাস করছে কুর’আনী বর্ণিত ইসলাম ছাড়াই। ব্যর্থতাটি এখানে মুসলিমদের সত্যিকার মুসলিম হওয়ায়।

প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা কি? এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে সুরা সাফের ৯ নম্বর, সুরা তাওবার ৩৩ নম্বর এবং সুরা আল-ফাতাহ‌’র ২৮ নম্বর আয়াতে। লক্ষণীয় হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে উপরিউক্ত তিনটি সুরা’র ভাষা একই রকমের। সুরা সাফ‌’য়ের ৯ নম্বর আয়াত থেকে উদাহরণ দেয়া যাক:

هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ

অর্থ: “তিনি হলেন সেই মহান আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন পর্থনির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ -যাতে তার দ্বীন বিজয়ী হয় সকল ধর্ম, সকল মিথ্যা ধ্যান-ধারণা ও সকল মতবাদের উপর। যদিও তা মুশরিকদের কাছে অপছন্দনীয়।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৯)। তাঁর দ্বীনের বিজয়ের অর্থ হলো, দেশের শাসনতন্ত্রে ও শাসন প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব। আদালতে প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র তাঁরই শরিয়তী আইন।  রাষ্ট্র থেকে বিলুপ্ত হবে ইসলাম বিরোধী শক্তির শাসন, বিলুপ্ত করা হবে সর্বপ্রকার জুলুম, দুর্বৃত্তি ও অবিচার এবং প্রতিষ্ঠা পাবে ন্যায়, সত্য এবং সুবিচার। ইসলামকে এরূপ বিজয়ী করার এ কাজটি মসজিদের সংখ্যা বাড়ালে হয় না; নামাজী-রোজাদার-হাজীর সংখ্যা বাড়ালেও হয় না। স্রেফ দোয়া-দরুদের মধ্য দিয়েও এ কাজটি হয়না। সে লক্ষ্য অর্জনের কাজটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা না দিয়ে অসম্ভব। ইসলামী রাষ্ট্রই হলো মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার মূল হাতিয়ার। নবীজী (সা:)কে তাই ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছে। তেমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পড়ে শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে লাগাতর জিহাদের। সে জিহাদে প্রতিটি ঈমানদারকে বিনিয়োগ করতে হয় তাঁর অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের। একমাত্র অতি বৃদ্ধ ও বিকলাঙ্গ ছাড়া সে বিনিয়োগের দায় থেকে কারো কোন অব্যাহতি নেই। এমন কি অব্যাহতি নবীজী (সা:)’রও ছিল না; তাকেও অস্ত্রহাতে রণাঙ্গণে হাজির হতে হয়েছে। নবীজী (সা:)’র যুগে যারা জিহাদ থেকে দূরে থেকেছে তাদেরকে কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট তথা মুনাফিক বলা হয়েছে।

যে ব্যবসা জান্নাতে নেয়

জিহাদই হলো এমন এক পবিত্র ব্যবসা -যা ঈমানদারকে জান্নাতে নেয়। সুরা সাফা’র ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে মুসলিম জীবনের সে পবিত্র ব্যবসার কথা বলা হয়েছে। একমাত্র জিহাদের ময়দানেই অতি নিবিড় ভাবে পরীক্ষত হয় ব্যক্তির  ঈমান, নিয়েত ও আমলের। জিহাদ ব্যক্তিকে জান্নাতের দরওয়াজার কাছে হাজির করে।  মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নামাজী, রোজাদার, দাতা ও হাজী হওয়া নয়, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার সৈনিক হওয়াও। যে ব্যক্তি সৈনিক হতে ব্যর্থ হয়, সে ব্যর্থ হয় মুসলিম হতে। এবং ব্যর্থ হয় জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে। সে কথাগুলিই অতি স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে সুরা সাফ’য়ের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَـٰرَةٍۢ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍۢ ١٠

تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَتُجَـٰهِدُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ بِأَمْوَٰلِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌۭ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ ١١

অর্থ: “হে মু’মিনগণ! আমি কি তোমাদের এমন বাণিজ্যের সন্ধান দিব -যা তোমাদের রক্ষা করবে বেদনাদায়ক আযাব থেকে? সে বাণিজ্যটি হলো, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনবে এবং তোমাদের নিজেদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর -যদি তোমরা জানতে।” –(সুরা সাফ, আয়াত ১০-১১)।     

যারা আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে নাই এবং জান্নাতের রাস্তা দেখেন শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত ও দোয়া-দরুদ পাঠের মধ্য -তাদের জন্য উপরিউক্ত আয়াতে রয়েছে ভয়ানক দুঃসংবাদ। যারা জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি চায় ও জান্নাত চায় -তাদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার প্রেসক্রিপশন হলো, তাঁরা বাঁচবে তাদের রব’য়ের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে এবং সে জিহাদে বিনিয়োগ করবে নিজ অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের। নবীজী (সা:)’র জামানায় এটিই ছিল মুসলিম জীবনের মূল মিশন। সে মিশন নিয়ে বাঁচতে গিয়ে অর্ধেকের বেশি সাহাবা শহীদ হয়ে গেছেন। নবীজী (সা:)’র মুসলিম শরীফের বিখ্যাত হাদীস: “ব্যক্তি জিহাদ করলো না এবং জিহাদের নিয়েতও করলো না, সে ব্যক্তি মুনাফিক।” ইসলামের গৌরব যুগে মুসলিমদের লাগাতর বিজয় এসেছে এবং মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে তো সে জিহাদে আত্মনিয়োগ করাতেই। এ পথেই সমাজ থেকে নির্মূল হয়েছে দুর্বৃত্তি এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সুবিচার ও সুনীতি। এরূপ দুর্নীতির নির্মূল ও সুনীতির প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাঁচার মিশনই মুসলিমদের মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা দিয়েছে। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:    

كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِٱلْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ ٱلْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ

অর্থ: “তোমরাই হলে শেষ্ঠ উম্মত; তোমাদের আবির্ভাব ঘটনা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং নির্মূল করবে অসৎ কাজকে। এবং ঈমান আনবে আল্লাহর উপর।” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১১০)।

 

কেন মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব?

সুরা আল-ইমরানের উপরিউক্ত আয়াতে অতি সুস্পষ্ট করা হয়েছে, কেন আবির্ভাব ঘটনা হয়েছে মুসলিম উম্মাহর? সেটি হলো, এ পৃথিবী পৃষ্ঠে সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং অসত্য ও দুর্বৃত্তির নির্মূল। মহান আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন এবং নানা রূপ নিয়ামত দিয়ে সাঁজিয়েছেন এর প্রতিটি অঙ্গণকে। তবে এ পৃথিবীকে মিথ্যা ধর্ম, অসত্য মতবাদ ও জালেমের নাশকতা দেখে বাঁচানো এবং শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তার নীড় রূপে গড়ে তোলার দায়িত্বটি মুসলিমদের। এটিই হলো তাদের উপর অর্পিত দায়ভার। একাজের জন্য প্রতি মুসলিম হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নিযুক্তিপ্রাপ্ত খলিফা তথা নির্বাহী অফিসার। সেটিই হলো মুসলিম জীবনের মূল ব্যবসা বা মিশন -যার বর্ণনা এসেছে সুরা সাফ’য়ের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে। যারা সে খলিফার দায়িত্ব পালনে সফল হয়, একমাত্র তারাই পায় জান্নাত। যারা ব্যর্থ হয় তারা পায় জাহান্নাম।  আর সে মিশনকে সফল করার জন্য কাজটি শুধু দ্বীনের তাবলিগ ও নামাজ-রোজা পালন করলে চলে না, শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করলেও হয় না; সে কাজের জন্য অনিবার্য এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ারটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। তাই যারা শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত এবং মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা নিয়ে খুশি, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নাই -বুঝতে হবে তারা ইসলামের মূল ভিশন, মিশন ও লক্ষ্য বুঝতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে নবীজী (সা:)‌’র জীবন থেকে শিক্ষা নিতে। মুসলিম জীবনের সে মিশনের ঘোষণাটি এসেছে সুরা মায়েদার ৮ নম্বর আয়াতেও। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُونُوا۟ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلْقِسْطِ ۖ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَـَٔانُ قَوْمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعْدِلُوا۟ ۚ ٱعْدِلُوا۟ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۖ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ خبِيرٌۢ بِمَا تَعْمَلُونَ

অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর জন্য খাড়া হয়ে যাও, সাক্ষ্যদাতা হও সুবিচারের পক্ষে। কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত থেকে বিরত না করে; সুবিচার করবে -সেটিই তাকওয়ার নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করবে -তোমরা যা কিছু করো সে বিষয়ে আল্লাহ খবর রাখেন।” একই রকম হুকুম এসেছে সুরা সাবার ৪৬ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

  قُلْ إِنَّمَآ أَعِظُكُم بِوَٰحِدَةٍ ۖ أَن تَقُومُوا۟ لِلَّهِ مَثْنَىٰ وَفُرَٰدَىٰ ثُمَّ تَتَفَكَّرُوا۟ ۚ مَا بِصَاحِبِكُم مِّن جِنَّةٍ ۚ إِنْ هُوَ إِلَّا نَذِيرٌۭ لَّكُم بَيْنَ يَدَىْ عَذَابٍۢ شَدِيدٍۢ

অর্থ: “বল হে মহম্মদ!, “তোমাদের প্রতি আমার একটিই ওয়াজ (নসিহত), তা হলো তোমরা আল্লাহর জন্য (তথা আল্লাহর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে) খাড়া হয়ে যাও -দুই জন -দুই জন করে অথবা একাই।  অতঃপর চিন্তা করে দেখ! তোমাদের সঙ্গি (রাসূল) আদৌ কোন উম্মাদ নন। তিনি তো আসন্ন কঠিন আযাবের ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করছেন মাত্র।” তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো, যারা  জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচতে চায় তাদের উপর ফরজ হলো তারা খাড়া হয়ে যাবে তাঁর খলিফারূপে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদে। কিন্তু আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ বাদ দিয়ে যারা রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, দলীয় শাসন, ফ্যাসিবাদ, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ বা অন্য কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে -তারা কি জান্নাত আশা করতে পারে? তারা কি রক্ষা পাবে জাহান্নামের আযাব থেকে? উপরিউক্ত দুটি আয়াত অনুসারে মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়া। সেটি শুধু জায়নামাজে নয়, বরং সেটি রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আদালত ও যুদ্ধের ময়দানেও। এবং মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়ার অর্থ: তাঁর এজেন্ডার পক্ষে খাড়া হওয়া। অর্থাৎ তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হওয়া। এবং সেটি সম্ভব একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই। তাই যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, বুঝতে হবে সেখানে প্রতিষ্ঠা পায়নি মহান আল্লাহয়ালার এজেন্ডা এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব ও আইন। এখানে ব্যর্থতাটি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে খাড়া হওয়ায়। এরূপ ব্যর্থতা নিয়ে কি জান্নাত আশা করা যায়?   

 

 

যুদ্ধ যেখানে আল্লাহতায়ালা ও রাসূলের বিরুদ্ধে!

মানব জীবনে সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো মহান আল্লাহতায়ালা ও তার রাসূলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে বাঁচা। অপরাধ এখানে তার স্রষ্টা ও রেজেকদাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ও গাদ্দারীর। এ অপরাধ ব্যক্তিকে নিশ্চিত জাহান্নামে নেয়। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচা। সেরূপ জিহাদ নিয়ে বাঁচা শিখিয়ে গেছেন খোদ নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। ইসলামের সে মৌল কথাটি বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুর’আনের ছত্রে ছত্রে। তাই এমন একজন সাহাবীও পাওয়া যাবে না যার জীবনে জিহাদ ছিল না। অথচ সেরূপ জিহাদ আজ ক’জন মুসলিমের জীবনে? সে জিহাদ না থাকায় মুসলিম দেশগুলিতেও মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা ও তাঁর দ্বীন আজ পরাজিত। বিজয় এখানে রাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ ও দলীয় ফ্যাসিবাদের। নবীজী (সা:)’র জামানায় যাদের জীবনে জিহাদ ছিল না -তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে।

স্রেফ মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, দরগাহ, মারকায নির্মাণ করে কি মহান মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা সম্ভব? সে জন্য অবশ্যই ইসলামী রাষ্ট্র চাই। রাষ্ট্রের সরকার, প্রশাসন, আদালত, পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ইসলাম বিরোধীদের হাতে ন্যস্ত রেখে কি মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়া সম্ভব? এমন রাষ্ট্র অধিকৃত হয় ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে। তখন সে অধিকৃত রাষ্ট্রে চলে মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ: তাঁর এজেন্ডা, তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। শুধু তাই নয়, কোন অনৈসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার যে কোন প্রচেষ্টাই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সে গুরুতর অপরাধ ঘটে রাজতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী ও সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সে যুদ্ধটি অতি প্রবল এবং লাগাতর। দেশগুলির ফ্যাসিবাদী শাসক, সেক্যুলার সংবিধান, অপরাধী প্রশাসন, সেক্যুলার আদালত এবং গুম-খুন-দুর্বৃত্তির প্লাবন হলো মহান আল্লাহতায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের দলিল। অতি পরিতাপের বিষয় হলো, এসব মুসলিম দেশের মুসলিম প্রজাগণ বাঁচছে দখলদার শত্রুশক্তির প্রতি আত্মসমর্পণ নিয়ে। অথচ মুসলিম তো বাঁচবে শত্রুশক্তির দখলদারির বিরুদ্ধে জিহাদ নিয়ে। শত্রুপক্ষের প্রতি এরূপ আত্মসমর্পণের অর্থই হলো ইসলামের সাথে গাদ্দারী। এরূপ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় মহান আল্লাহতায়ার এজেন্ডাকে বিজয়ী করায় তারা কতটা অনাগ্রহী ও উদাসীন। তাদের এ অনাগ্রহ ও উদাসীনতা বিজয় ও আনন্দ বাড়াচ্ছে শয়তান ও তার অনুসারীদের।

রাসূলে পাক (সা:)’য়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ: তাঁর সূন্নত নির্মূলের যুদ্ধ। নবীজী(সা:)’য়ের সবচেয়ে বড় সূন্নতটি হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা -যে রাষ্ট্রের তিনি ১০টি বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। ফলে আজ যারা সেরূপ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী তাদের যুদ্ধটি মূলত মহান নবীজী(সা:)’র সূন্নতের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধটি আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধেও। কারণ, যারা নবীজী(সা:)’র অনুসারী তারাই অনুসারী হলো মহান আল্লাহতায়ালার। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে। এর অর্থ দাঁড়ায়, যাদের যুদ্ধ রাসূলের বিরুদ্ধে, তাদের যুদ্ধ মহান আল্লাহতায়ালারও বিরুদ্ধেও। এমন একটি যুদ্ধের সাথে জড়িত বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মী। তাদের অপরাধটি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে পরাজিত করায় এবং শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করায়। এরাই রাষ্ট্রের বুকে এনেছে জুলুম ও নানারূপ দুর্বৃত্তির জোয়ার। চলমান শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশকে এরাই দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।  এটি গুরুতর অপরাধ। এবং সে অপরাধের শাস্তিও গুরুতর। মহান আল্লাহতায়ালা সে শাস্তির কথা ব্যক্ত করেছেন সুরা মায়েদার ৩৩ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا جَزَٰٓؤُا۟ ٱلَّذِينَ يُحَارِبُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَسْعَوْنَ فِى ٱلْأَرْضِ فَسَادًا أَن يُقَتَّلُوٓا۟ أَوْ يُصَلَّبُوٓا۟ أَوْ تُقَطَّعَ أَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُم مِّنْ خِلَـٰفٍ أَوْ يُنفَوْا۟ مِنَ ٱلْأَرْضِ ۚ ذَٰلِكَ لَهُمْ خِزْىٌۭ فِى ٱلدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ

অর্থ: “যারা যুদ্ধ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে এবং প্রচেষ্টা চালায় পৃথিবী পৃষ্ঠে ফ্যাসাদ তথা দুর্বৃত্তির প্রতিষ্ঠায়, তাদের জন্য  শাস্তি হলো: তাদেরকে হত্যা করা হবে, অথবা শূলে চড়ানো হবে, অথবা তাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে; অথবা দেশ থেকে তাদেরকে নির্বাসিত করা হবে। এটিই হলো তাদের জন্য এ দুনিয়ার জীবনের লাঞ্ছনা জনক শাস্তি; এবং আখেরাতে তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মহাশাস্তি।”

পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বড় নাশকতাটি হলো মানব হত্যা। এবং সবচেয়ে বড় কল্যাণকর্মটি হলো কোন মানব সন্তানের প্রাণ বাঁচানো। একজন  নিরপরাধ মানুষের হত্যাকে সুরার মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে গোটা মানবের হত্যা রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এবং মানুষের প্রাণ বাঁচানোকে গোটা মানবের প্রাণ বাঁচানো বলা হয়েছে। সুরা মায়েদায় সে ঘোষণাটি হলো:

مِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ أَنَّهُۥ مَن قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍۢ فِى ٱلْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ ٱلنَّاسَ جَمِيعًۭا وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَآ أَحْيَا ٱلنَّاسَ جَمِيعًۭا ۚ وَلَقَدْ جَآءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِٱلْبَيِّنَـٰتِ ثُمَّ إِنَّ كَثِيرًۭا مِّنْهُم بَعْدَ ذَٰلِكَ فِى ٱلْأَرْضِ لَمُسْرِفُونَ

অর্থ: “ঐ ঘটনার কারণে আমি বনি ইসরাইলীদের উপর বিধান জারি করলাম, কোন মানুষকে হত্যা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার শাস্তি প্রদানের কারণ ছাড়া কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে জন্য গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো; আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই বাঁচিয়ে দিল। এদের কাছে আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারপরও এদের অনেক লোক জমিনের বুকে সীমালংঘনকারী রূপেই থেকে গেল।” অথচ একজন বা দুইজন নয়, বিশাল বিশাল গণহত্যার কান্ড ঘটে রাষ্ট্র যখন দুর্বৃত্তদের দখলে যায়। হাজার হাজার মানুষকে তখন নানারূপ নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। তাই অতি বড় মাপের পাপকর্ম হলো কোন খুনি দুর্বৃত্তকে ক্ষমতায় বসানো এবং ভোট দিয়ে ও রাজস্ব দিয়ে সে জালেমকে সুরক্ষা দেয়া ও তার শাসনের আয়ু বাড়ানো। অপর দিকে সবচেয়ে বড় কল্যাণকর কাজ হলো কোন খুনি শাসকের হাত থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করা। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে তো সে কাজটিই হয়। তাই পৃথিবী পৃষ্ঠে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম।

 

কেন নাই ইসলামী রাষ্ট্র?

পবিত্র কুর’আন যে ইসলাম পেশ করে এবং মহান নবীজী (সা:) যে ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন, সে ইসলাম আজ কোথাও বেঁচে নাই। নবীজী (সা:)’র সে ইসলাম বেঁচে না থাকার কারণ, কোথাও বেঁচে নাই ইসলামী রাষ্ট্র। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ছাড়া সে বিশুদ্ধ ইসলামকে কখনোই সুরক্ষা দেয়া যায় না, বাঁচিয়েও রাখা যায় না। নবীজী (সা:)’র সে ইসলামকে পূর্ণ ভাবে পালন করাও যায়না। কারণ, পূর্ণ ইসলাম পালনের জন্য তো চাই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, চাই শরিয়ত পালন, চাই কুর’আন-হাদীসের জ্ঞান, চাই দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার বিরামহীন জিহাদ এবং সর্বোপরি চাই মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিজয়।  ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি এগুলি অর্জন করা সম্ভব?

তাই যারা মনে করে ইসলামী রাষ্ট্রোর প্রতিষ্ঠা ছাড়াও ইসলাম  পূর্ণ ভাবে পালন করা সম্ভব – বুঝতে হবে নবীজী (সা:)’র ইসলাম নিয়ে তারা গভীর ভাবে অজ্ঞ। বুঝতে হবে, তারা পবিত্র কুর’আন বুঝে পড়েনি এবং নবীজী (সা:)’র জীবনী থেকেও শিক্ষা নেয়নি।  এরাই হলো সে সব অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত ব্যক্তি -যারা মনে করে ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে পালনের বিষয়। নিজ গৃহে বা মসজিদের জায়নামাজের পালন করলেই চলে। তারা ভাবে, ইসলাম বলতে বুঝায় স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন পাঠ ও তাসবিহ-তাহলিল। পরিতাপের বিষয় হলো, সে ভ্রান্ত ধারণাটি শুধু সেক্যুলারিস্ট শাসকদের নয়, বেঁচে আছে বহু আলেমের মধ্যেও। বিশেষ করে সুফি তারিকা, তাবলিগ জামায়াত ও দেওবন্দী ফেরকার আলেমদের মাঝে। এমন একটি ধারণার কারণেই নিজগৃহের বাইরে রাজনীতি, আদালত, প্রশাসন, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষাব্যবস্থায় ও সেনাবাহিনীতে ইসলামকে তথা পবিত্র কুর’আনের বিধানকে তারা স্থান দিতে রাজী নয়। ইসলামের শত্রুগণ জানে, রাজনীতি, আদালত ও প্রশাসনে ইসলামকে স্থান দেয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর এজেন্ডাকে স্থান দেয়া। সেটি হলে তাদের নিজেদের সার্বভৌমত্ব, স্বৈরাচার ও অধিকৃতি বাঁচে না। এজন্যই তারা ইসলামবিরোধী। 

পরিতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ মুসলিম দেশ আজ স্বৈরাচারী শাসকদের হাতেই অধিকৃত। নিজেদের শাসন বাঁচাতে তাদের অবিরাম যুদ্ধটি তাই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের বিরুদ্ধে। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের পবিত্র জিহাদকে এরা সন্ত্রাস বলে। জঙ্গিবাদও বলে। অথচ নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সশস্ত্র জিহাদ ছিল; রণাঙ্গণে তারা শত্রুদের হত্যা করেছেন। নিজেরাও শহীদ হয়েছেন। তবে কি তাদের সে সশস্ত্র জিহাদ সন্ত্রাস ছিল? নবীজী (সা:) ও তার সাহাবাগণ কি তবে সন্ত্রাসী ছিলেন? ইসলামের চিহ্নিত এ শত্রুগণ জেনে শুনেই ইসলামের পবিত্র জিহাদকে সন্ত্রাস বলে। অথচ নিজেদের সেক্যুলার যুদ্ধকে এরা সন্ত্রাস বলেনা। নিজেদের নৃশংস গণহত্যার যুদ্ধকেও তারা কোন অপরাধ বলেনা।

অথচ সন্ত্রাসের আভিধানিক অর্থ হলো, যে কোন রাজনৈতিক স্বার্থে অস্ত্রের ব্যবহার। সে বিচারে প্রতিটি স্বৈরাচারী শাসকই শতকরা শতভাগ সন্ত্রাসী। তাদের প্রতিটি যুদ্ধই হলো গুরুতর যুদ্ধাপরাধ। রাষ্ট্রের বুকে তারা নিজেদের অধিকৃতি বাঁচিয়ে রাখে স্রেফ অস্ত্রের জোরে। তারা আইনের শাসনের কথা বলে। অথচ তারা নিজেরা মানে না আইনের শাসন। বিনা বিচারে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা করাই তাদের রাজনীতি। সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ রাজনৈতিক মতলব হাছিলে মানব ইতিহাসের আর কোন দেশই এতো অস্ত্রের ব্যবহার করেনি -যা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক মতলব হাছিলে হিরোশিমা ও নাগাসাকি -এ দুটি জাপানী শহবের উপর পারমানবিক বোমাও নিক্ষেপ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত সামরিক আগ্রাসনে ও গণহত্যায় বহু লক্ষ মানুষ প্রান হারিয়েছে ও আহত হয়েছে ভিয়েতনাম,সোমালিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায়। মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে অধিকৃত দেশের শত শত নগর-বন্দর ও আবাসিক স্থাপনাকে। অতীতে শতভাগ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ছিল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইটালির ন্যায় প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মতলব হাছিলে তারা অধিকৃত দেশে গণহত্যা চালিয়েছে।

সেক্যুলার সন্ত্রাসী রাষ্ট্রগুলির প্রতিটি যুদ্ধই ভয়ানক যুদ্ধাপরাধ; এবং সেগুলি যেমন গণহত্যার অপরাধ নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে, তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে। ইসলামে এগুলি গুরুতর অপরাধ। শরিয়তের আইন এমন অপরাধীদের প্রাণদণ্ড দেয় -যা ঘোষিত হয়েছে উপরিউক্ত সুরা মায়েদা ৩৩ নম্বর আয়াতে।

 

জিহাদশূণ্যতার বিপদ

ইসলামের এ চিহ্নিত শত্রুগণ ইসলামের পবিত্র জিহাদকে যে নামেই অভিহিত করুক না কেন, জিহাদ জিহাদই। কোনটি পবিত্র জিহাদ এবং কোনটি যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ -মুসলিমকে সে বিষয়ে রায় নিতে হয় একমাত্র পবিত্র কুর’আন থেকে, ইসলামের কোন চিহ্নিত শত্রু থেকে নয়। জিহাদই হলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। জিহাদে না থাকার অর্থ, বিনা যুদ্ধে শয়তান ও তার অনুসারীদের ঘরে বিজয় তুলে দেয়া। সেটি কি কোন ঈমানদার মেনে নেয়? এতে পরাজিত হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশে জিহাদ থেকে দূরে থাকা এবং দেশের উপর দখলদারি ইসলামের শত্রুদের হাতে তুলে দেয়াই রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ অপরাধীদের সামনে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকাও গুরুতর অপরাধ; কারণ এমন নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা পরিণত হয় শয়তানী শক্তিকে বিজয়ী করার সক্রিয় হাতিয়ারে। 

ইসলামের নির্দেশিত সকল ইবাদতের মাঝে একমাত্র জামাতবদ্ধ নামাজ পালনের কাজটি হয় মসজিদের মেঝেতে বা গৃহের জায়নামাজে। মহান আল্লাহতায়ালার অন্য সবগুলি হুকুম যেমন শাসনতন্ত্রে তাঁর সার্বভৌমত্ব, আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার, নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের মাঝে প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্ব, দুর্বৃত্তি ও অবিচারের নির্মূল, ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর’আন শিক্ষা, মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ প্রকল্প – ইসলামের এরূপ সবগুলি প্রকল্প পালিত হয় মসজিদের বাইরে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গণে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এ হুকুমগুলি রাষ্ট্রজুড়ে পালিত না হলে কি কখনো পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজ হয়? তাতে বিজয়ী হয় কি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা? তখন তো রাষ্ট্রের এ অঙ্গণগুলি দখলে যায় শত্রুশক্তির হাতে। তখন বিদ্রোহের কান্ড ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। মহান আল্লাহতায়ালার কোন খলিফা কি রাষ্ট্র ও সমাজের এরূপ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে? দূরে সরিয়ে রাখলে কিরূপে পালিত হয় খলিফার দায়িত্ব? খলিফার কাজ কি এরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকা?

 

 

ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত না হওয়ার বিপদ

কোন বীজই পাথরের উপর বা জঙ্গলে বেড়ে উঠতে পারে না। সেজন্য আগাছামুক্ত উর্বর জমি চাই। তেমনি সত্যিকার মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার কাজটিও কোন আনৈসলামী রাষ্ট্রে হয়না। ইসলাম যেখানে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, বুঝতে হবে সেদেশে পূর্ণ ইসলাম পালনের কাজটি আদৌ হয়না। অর্থাৎ সেখানে পালিত হয়না নবীজী (সা:)’র ইসলাম। এর অর্থ দাঁড়ায়, যে ভূমিতে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, সে ভূমিতে পূর্ণাঙ্গ মুসলিমও নাই। মুসলিম উম্মাহকে সেরূপ একটি বিপদজনক অবস্থা থেকে বাঁচাতে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের বহু অর্থ, বহু শ্রম ও বহু রক্তের বিনিময়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছে। অথচ মুসলিম ভূমিতে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের সে সূন্নতই আজ উপেক্ষিত। ফলে মুসলিমগণ বাঁচছে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম পালন ছাড়াই। ফলে তারা ব্যর্থ হচ্ছে পূর্ণ মুসলিম হতে। মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ তো এখানেই।

প্রশ্ন হলো, নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের ধর্মকর্ম কি শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত, দোয়া-দরুদ ও তাসবিহ পাঠ নিয়ে ছিল? সেরূপ হলে সে কালে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, কাফির শক্তির নির্মূলের জিহাদ, আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজগুলি কে করলো? এবং তারা কেন করলো? প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি দেশের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিল না, ভাষা-বর্ণ-গোত্র ও আঞ্চলিকতা-ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে ঊঠে নিজকে প্যান-ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ করলো না, দুর্বৃত্তদের নির্মূলের কাজে অংশ নিল না, সুবিচারকে প্রতিষ্ঠা দিল না, মুসলিম উম্মাহর জান-মালের সুরক্ষায় জিহাদ করলো না, এবং দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুর্দশা দূর করায় কোন উদ্যোগই নিল না  -সে ব্যক্তি  মুসলিম হয় কি করে? নবীজী (সা:)’র সূন্নতের অনুসারীই বা হয় কি করে?  ঈমানদারই বা হয় কি করে? প্রকৃত মুসলিম তো একমাত্র সেই যে ইসলামের এ বিধানগুলিকে নিজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার জিহাদ নিয়ে বাঁচে। যার জীবনে সে জিহাদ নাই -বুঝতে হবে ঈমানের দাবীতে সে ব্যক্তি সত্যবাদীও নয়। ঈমানের দাবী তো সূদখোর, ঘুষখোর, জালেম স্বৈরাচারী, খুনি, ব্যাভিচারী, সন্ত্রাসীও করতে পারে। কিন্তু ঈমানের দাবীতে কারা সত্যবাদী -সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণাটি এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। সেটি সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ

অর্থ: “মু’মিন একমাত্র তারাই যারা ঈমান আনলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, অতঃপর তার উপর আর কোনরূপ সন্দেহ পোষণ করলো না। এবং নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে জিহাদ করলো আল্লাহর রাস্তায়। ঈমানের দাবীতে এই লোকগুলোই হলো সত্যবাদী।” –(সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫)। এটিই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার নিজের পক্ষ থেকে দেয়া প্রকৃত ঈমানদারের সংজ্ঞা বা পরিচয়। যারা ঈমানদার হতে চায় তাদের উচিত উপরিউক্ত আয়াতের সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখা। এবং খতিয়ে দেখা উচিত আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদে তাঁর অর্থ, সময়, মেধা ও রক্তের কুরবানী আছে কিনা। উপরিউক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে এজন্যই নিশ্চিত বলা যায়, যার জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে নিজের সম্পদ, সময়, মেধা ও রক্তের কুরবানী নাই সে নামাজী, রোজাদার, হাজী, পীর, মৌলভী, মুফতি, ইমাম, মোয়াজ্জেন ও মোহাদ্দেস হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার হতে পারে না। এজন্যই নবীজী (সা:)’র এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যার জীবনে জিহাদ ছিল না। জিহাদ থেকে যারা দূরে থেকেছে তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে। এরই নজির হলো, জিহাদ থেকে দূরে থাকার ফলে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার তিন শত সঙ্গি নবীজী (সা:)‌’র পিছনে নামাজ পড়ে এবং তাঁর ওয়াজ শুনেও ঈমানদার হতে পারেনি। তারা অর্জন  করেছে মুনাফিকের খেতাব।

জিহাদ তো তাদের জীবনেই অনিবার্য হয়ে উঠে যাদের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন এবং তাঁর কুর’আনী হুকুমগুলিকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার প্রবল তাড়না থাকে। এবং তাড়না থাকে,এসব কাজের মধ্য দিয়ে মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের। এমন তাড়না থেকেই মু’মিন ব্যক্তির জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ অনিবার্য হয়ে উঠে। তখন জিহাদে শহীদ হওয়াকে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন গণ্য হয়। কিন্তু যার মধ্য সে তাড়না নাই এবং ধর্মকর্ম বলতে বুঝে স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, দোয়া-দরুদ ও কুর’অআন পাঠ নিয়ে বাঁচা -তার জীবনে জিহাদ না থাকারই কথা। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব এরা বুঝে না। ফলে দেশ শত্রু শক্তির হাতে অধিকৃত হলেও তাদের মধ্যে জিহাদও সৃষ্টি হয় না। মুসলিম বিশ্বে এমন কপট মুসলিমের সংখ্যাই বেশি। তাদের কারণে বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশেও নির্মিত হচ্ছে না ইসলামী রাষ্ট্র। এবং গড়ে উঠছে না ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদ। ফলে মুসলিম উম্মাহ ব্যর্থ হয়েছে এমন এক রাষ্ট্র পেতে যা তাদের জান, মাল, ইজ্জত ও স্বাধীনতার সুরক্ষা দিবে এবং সহায়ক পরিবেশ দিবে পরিপূর্ণ ইসলাম পালনের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *