ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ, হামাসের জিহাদ এবং মুসলিম বিশ্বের সম্ভাব্য নতুন ভূ-রাজনীতি
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on October 20, 2023
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও যুদ্ধাপরাধ
যুদ্ধের অর্থ দুটি হিংস্র পশুর আমৃত্য লড়াই নয়। প্রতিটি যুদ্ধে কিছু আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান আছে। যুদ্ধরত প্রতিটি পক্ষকে সেগুলিকে মেনে চলতে হয়। কোন যুদ্ধেই নারী-শিশু, যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে থাকা নাগরিক, সাংবাদিক, এ্যামবুলেন্স, হাসপাতাল, মসজিদ, গীর্জা, স্কুল-কলেজ, এবং আবাসিক এলাকাকে হামলার নিশানা বানানো যায় না। সেগুলির উপর হামলা করা নিরেট যুদ্ধাপরাধ। ইসরাইলের পক্ষ থেকে এ যুদ্ধকে আত্মরক্ষার যুদ্ধ বলা হচ্ছে। আত্মরক্ষার যুদ্ধ হয় আগ্রাসী বাহিনীর সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধের লক্ষ্য কখনোই নারী, শিশু ও নিরস্ত্র নাগরিক হত্যা হয়না। হাসপাতাল, মসজিদ ও গীর্জা ধ্বংসের জন্যও নয়। আত্মরক্ষার নামে বিরামহীন যুদ্ধাপরাধ করছে। ইসরাইলের বোমা বর্ষণ থেকে বেসামরিক নারী-পুরুষ, সাংবাদিক যেমন বাঁচছে না, তেমনি বাঁচছে না এমন কি হাসপাতাল এবং আবাসিক ঘরবাড়ী। বস্তুত ইসরাইলের যুদ্ধ পরিণত হয়েছে নিরেট যুদ্ধাপরাধের যুদ্ধে। এসব নিরেট রাষ্ট্বীয় সন্ত্রাস। ইসরাইলের জন্ম সন্ত্রাসে মাধ্যমে; এখন সন্ত্রাসই ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় নীতি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ইসরাইলের সকল রাষ্ট্রীয় সকল সামরিক সামর্থ্য। বিগত ১৩ দিনের যুদ্ধে প্রায় ৪ হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার হলো শিশু। গাজার শতকরা ৬০ ভাগের বেশী আবাসিক গৃহকে ধ্বংস করেছে। ১৭ অক্টোবর বোমা বর্ষণ করেছে আহলি আরাব হাসপাতালের উপর এবং সাথে প্রায় ৫০০ জনকে হত্যা করেছে। আজ ২০ অক্টোবর বোমা ফেলেছে গাজার সবচেয়ে পুরনো গীর্জার উপর। তাতে সেখানে আশ্রয় নেয়া ১৬ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। (সুত্র: আল-জাজিরা)।
গাজায় ২২ লাখ মানুষের বসবাস; এটি বহুকাল পূর্ব থেকেই একটি অবরুদ্ধ জেলখানা। এর বিমান বন্দরটি বহু আগেই ধ্বংস করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে এর সমুদ্র বন্দর। গাজার দক্ষিণ সীমান্তে মিশর; কিন্তু মিশরও আজ্ঞাবহ ইসরাইলের। সেখানকার আলা রাফা সীমান্ত পোস্টের উপর চলে মিশর ও ইসরাইলের যৌথ পাহারাদারি। ইসরাইলের অনুমতি ছাড়া সে সীমান্ত দিয়েও গাজায় কিছু প্রবেশ করত পারে না। খাদ্য-পানীয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানী, ঔষধ এরূপ নিত্য-প্রয়োজনীয় সবকিছুর সাপ্লাই আসে ইসরাইল থেকে। ইসরাইল ৭ অক্টোবর থেকে সবকছু বন্ধ করে দিয়েছে। গাজার অবস্থা এখন জেলখানার চেয়েও খারাপ। কারণ জেলখানার কয়েদীদের জন্য খাদ্য-পানীয়-বিদ্যুৎ বন্ধ করা হয়না। অথচ সেগুলি বন্ধ করা হয়েছে গাজাবাসীর জন্য।
অপর দিকে হামাস ও ইসলামী জিহাদের পরিচালিত যুদ্ধটি কোন সাধারণ যুদ্ধ নয়। সেটি শতভাগ বিশুদ্ধ ও পবিত্র জিহাদ। এমন জিহাদে যারা শহীদ হবে তারা সরাসরি জান্নাতে যাবে । এবং সে ঘোষণাটি মহান আল্লাহতায়ালার -যার প্রতিশ্রুতি পবিত্র কুর’আনে বার বার এসেছে। কারণ, মুসলিম ভূমি যখন অমুসলিমদের হাতে অধিকৃত হয় তখন সে আগ্রাসী শত্রুদের বিরুদ্ধে খাড়া হওয়াটি ফরজে আইন। ফিলিস্তিন যে ইসরাইলীদের হাতে অধিকৃত ভূমি -এ নিয়ে কারো কোন দ্বি-মত নাই। সে অধিকৃত ভূমিতে মুসলিমগণ আজ নির্মূলের মুখে। ফলে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই ফিলিস্তিনীদের উপর জিহাদ ফরজ হয়ে গেছে। ফকিহদের মাঝে নানা বিষয়ে নানা মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু এ বিষয়ে কোন মতভেদ নাই। হামাস ও ইসলামী জিহাদ নামে দুটি সংগঠন সে ফরজ দায়িত্বটিই পালন করছে মাত্র। চোর-ডাকাত গৃহে ঢুকলে তার সাথে আপোষ চলে না। তাকে শাস্তি দেয়ার মধ্যেই মানবতা। কখনোই কি তাকে গৃহের উপর মালিকানা দেয়া যায়? অথচ ইসরাইল সে মলিকানাটিই চাচ্ছে। ডাকাতি করা সে ভূমির উপর ইসরাইলের মালিকানা প্রতিষ্ঠা দিতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলিও। ডাকাতের সে অধিকৃতিকে জায়েজ বলে মেনে নিতে তারা চাপ দিচ্ছে ফিলিস্তিনীদের উপর। তুরস্ক,মিশর, জর্দান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান, ওমানের মত যেসব দেশগুলি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে -তারা বস্তুত ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলের সে অবৈধ অধিকৃতিকে জায়েজ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ তো সেটিই। এটি শুধু মুসলিম উম্মাহর সাথে গাদ্দারী নয়, নিরেট গাদ্দারী সত্য ও সুবিচারের সাথেও। অবশেষে ইয়াসির আরাফাত এবং পি. এল. ও ইসরাইলের এই ডাকাতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। হামাস ও ইসলামী জিহাদ’য়ের অপরাধ হলো তারা ইসরাইলের সে হারাম অধিকৃতিকে স্বীকৃতি দেয়নি। এজন্যই ইসরাইল হামাস ও ইসলামী জিহাদের নির্মূল চায়। ইসরাইল ও তার অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় না কোন মুসলিম সংগঠন এরূপ সাহস নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াক। এরূপ সাহস তাদের কাছে অসহ্য। তারা তো মুসলিম শাসকদের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ পেয়ে অভ্যস্ত।
ইসরাইলের আরেক মিথ্যাচার হলো, তাদের যুদ্ধটি নাকি হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্যে। অথচ ১৯৮৭ সালের আগে ফিলিস্তিনীদের মাঝে কোন হামাস ছিল না, তখনও তো ফিলিস্তিনীদের নির্মূলে ইসরাইলের যুদ্ধ ছিল। তাছাড়া অধিকৃত জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে হামাস নাই, সেখানে কেন ইসরাইলী সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনীদের হত্যা করছে? বিগত এক বছরে সেখানে শতাধিক ফিলিস্তিনীকে তারা হত্যা করেছে। হামাস যেহেতু ইসরাইলী অধিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক -তাই ইসরাইলের যুদ্ধ হামাসের নির্মূলে। কিন্তু হামাস নির্মূল হলেই কি জিহাদ নির্মূল হবে? মুসলিম উম্মাহর জিহাদ তো তখনই শেষ হয়, যখন মুসলিম ভূমির উপর থেকে শত্রুর অধিকৃতি নির্মূল হয়। অথচ ইসরাইল ও তার মিত্ররা সে অপ্রিয় সত্যকে মেনে নিতে রাজী নয়। ফলে ইসরাইলের অবৈধ অধিকৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনীদের মধ্য যে জিহাদ শুরু হয়েছে -তা শেষ হবার নয়। যুদ্ধ এর আগেও বহু বার থেমেছে কিন্তু জিহাদ শেষ হয়নি।
শত্রু পক্ষের একতা এবং মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি
একজন ব্যক্তির দেহ কতটা সুস্থ সেটি বুঝা যায় দেহের উপর আঘাতের প্রতিক্রিয়া দেখে। সুস্থ দেহের উপর মশা বা মাছি বসলে -সেটি মারতে তার হাত কোন রূপ বিলম্ব না করে না। ত্বরিৎ আঘাত হানে। প্রতিক্রিয়াটি সেরূপ না হলে বুঝতে হবে, দেহটি আদৌ সুস্থ নয়। মুমূর্ষু হলে দেহের উপর মশা-মাছি দূরে থাক, শিয়াল-শকুনে কামড় দিলেও সামান্যতম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মুসলিম উম্মাহ আজ সে মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে গেছে। ফিলিস্তিন, ভারত, কাশ্মির, আরাকানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলছে। মুসলিম উম্মাহর প্রতিক্রিয়া কই? সুস্থতার লক্ষণ শুধু পানাহার, কাজকর্ম ও দৌড়াদৌড়ির সামর্থ্য নয়। সেরূপ সামর্থ্য গরু-ছাগলেরও থাকে। শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতও নয়। সে সামর্থ্য সূদ খোর, ঘুষখোর ও হারামখোর মিথ্যাবাদীদেরও থাকে। মুসলিমের সুস্থতার অর্থ তাঁর ঈমানের সুস্থতা। ঈমানের সুস্থতা দেখা যায় মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশে প্রতি সাড়া দেয়া থেকে। মুসলিম হওয়ার জন্য শুধু দৈহিক সুস্থতা থাকলে চলে না, তাকে ঈমানের সুস্থতা থাকতে হয়। সেটি বুঝা সে কতটা সাড়া দেয় মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের প্রতি। যখন সে সাড়া নাই তখন বুঝতে হবে সে ব্যক্তির দেহ বেঁচে থাকলেও ঈমান বেঁচে নাই। প্রশ্ন হলো আজকের মুসলিম উম্মাহ কি মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ সাড়া দিচ্ছে? সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, তারা আদৌ সাড়া দিচ্ছে না। গাজায় ইসরাইলী হামলা, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সেটি চোখে আঙ্গুল দিলে প্রমাণ করে দিল।
মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো মুসলিমকগণ নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা আঞ্চলিকতা ও নানা ফেরকার উর্দ্ধে উঠে একতা গড়বে। এটি ফরজ, যেমন ফরজ হলো নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত। এবং হারাম হলো বিভক্তি। প্রতিটি বিভক্তি তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কোন মুসলিম ভূমির উপর শত্রু শক্তির হামলা হলে তারা একতাবদ্ধ ভাবে সে হামলার প্রতিরোধ করবে -সেটিই তো ঈমানের দাবী। কিন্তু মুসলিমগণ আজ সে একতা নিয়ে বাঁচে না। তারা বরং বিভক্তি নিয়ে উৎসব করে এবং বিভক্তি বাঁচাতে যুদ্ধ করে। কোন একটি হাত বা পা’য়ের উপর আঘাত হানা হলে বাকি হাতটি ত্বরিৎ সে আঘাতের মোকাবেলা করে। তখন মাথা, মগজ, হাত-পা একত্রে প্রতিরোধের সে কাজটি করে। সেটি না হলে বুঝতে হবে দেহটি দারুন অসুস্থ। মুসলিম উম্মাহকে নবীজী (সা:) একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন। তাই উম্মাহর কোন অঙ্গে আঘাত হলে সমগ্র উম্মাহ তার প্রতিরক্ষায় ছুটে আসবে -সেটিই তো কাঙ্খিত। কিন্তু সেটি হয়নি। গাজার উপর বিগত ১৩ দিন চলছে ইসরাইলের বিরামহীন হামলা। বিগত ১৩ দিনে ৬,০০০ বারের বেশী বোমা বর্ষণ করেছে। গাজা হলো ২৫ মাইল লম্বা এবং গড়ে ৭ মাইল চওড়া ১৪১ বর্গ মাইলের একটি ক্ষুদ্র ভূমি। এমন কি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত দেশগুলির কোন শহরের উপরই এতো বোমাবর্ষণ হয়নি -যা গাজার উপর হয়েছে। একমাত্র মার্কিন বাহিনীর বোমা বর্ষণে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইরাক ও সিরিয়ার শহর মোসল, রামাদি, ফালুজা, কোবানী, রাক্কা ও দেরাজুরের সাথেই তার তুলনা চলে। উপর এখনও অবিরাম চলছে।
বিশ্বের মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া অতি দুঃখজনক। গাজার ঘটনা অধিকাংশ মুসলিম শাসকের ঈমানহীনতা, বিবেকহীনতা ও মানবতাহীনতা অতি স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে। প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলি থেকে এক লিটার পানি, এক বস্তা চাউল বা আটা এবং জীবনরক্ষাকারী কোন ঔষধ বিগত ১৩ দিনে সেখানে পৌঁছেনি। ইসরাইলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, জার্মানীর চ্যান্সেলর, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে গিয়ে পৌঁছেছে। ফ্রান্সের প্রসেডিন্টও শীঘ্রই সেখানে গিয়ে পৌঁছবে। যারা মুসলিম ভূমিতে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল -এই হলো তাদের একতার মান। ইসরাইলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ভারতের মোদী সরকার। সেখানে বিজিপি কর্মীদের পক্ষ থেকে ইসরাইলের সমর্থনে মিছিল হয়েছে। অথচ গাজার জেলবন্দী দুর্দশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনীদের সাথে সেরূপ একাত্মতা নাই মুসলিম নেতাদের।
ইসলামের শত্রুগণ যেখান সক্রিয় ও একতাবদ্ধ, মুসলিমগণ সেখানে বিভক্ত ও নিষ্ক্রিয়। মুসলিম দেশে যা কিছু প্রতিক্রিয়া -তা শুধু সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে, সরকারি মহল থেকে নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি নারাজ হবে -এই ভয়ে মুসলিম রাষ্ট্র-প্রধানগণ মুখ খুলছে না। গাজার একমাত্র প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র হলো মিশর। কিন্তু সে মিশরের সরকার হলো ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত বন্ধু। জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সরকার হলো মিশরীয় জনগনের শত্রু। জনগণের রায়কে এ স্বৈরাচারি সরকার ইজ্জত দেয়না। ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও আমিরাতের কোয়ালিশন সর্ববিধ সহযোগিতা নিয়ে সে দেশের ইতিহাসের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মহম্মদ মুরসীর বিরুদ্ধে ক্যু করে ক্ষমতায় বসানো হয় এই ফ্যাসিস্ট আল সিসিকে। নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে সে দেশের স্বাধীনতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রয় করেছে বাৎসরিক দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্যের বিনিময়ে। এরই প্রতিদানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাসত্ব চাপিয়ে দিয়েছে মিশরবাসীর উপর। ফলে ফিলিস্তিনের সমর্থনে ওয়াশিংটন, নিউয়র্ক, লন্ডন, প্যারিসে মিছিল হলেও সেরূপ মিছিল কায়রোতে হয় না। একই অবস্থা সৌদি আরব ও আমিরাতে। সেখানেও ফিলিস্তিনের পক্ষে কোন মিছিল হতে দেয়া হয়না। লক্ষণীয় হলো, মার্কিন অনুগত এসব মুসলিম দেশগুলির রাষ্ট্র প্রধানগণ রাশিয়ার অধিকৃতির বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বললেও হামাসকে সন্ত্রাসী বলে।
পাশ্চাত্য জোটের ক্রসেড এবং হামাসের জিহাদ
মুসলিমদের প্রথম কেবলা হলো, ফিলিস্তিনের জেরুজালেম। নামাজ পড়া প্রথমে শুরু হয় জেরুজালেমের দিকে মুখ করে। এখানেই আল আকসা মসিজদ। মক্কা ও মদিনার পর এটিই ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম ভূমি। কিন্তু সে পবিত্র ভূমি এখন ইহুদীদের হাতে অধিকৃত। ১৯১৭ সালে এ পবিত্র ভূমিকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ উসমানিয়া খেলাফত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের দখলে নেয়। পরে এ অধিকৃত ভূমিকে পরিকল্পিত ভাবে ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়। পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী পক্ষের লক্ষ্য, শুধু একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দেয়া নয়, বরং মুসলিম বিশ্বের হৃদপিন্ডে এমন এক ক্যান্টনমেন্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া -যা সুরক্ষা দিবে মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্য স্বার্থের। দেশটিকে এজন্যই তারা লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই প্রতি বছর ৩.৮ বিলিয়ন ডলার দান করে। নিয়মিত সাহায্য দেয় জার্মানী, গ্রেট ব্রিটেনসহ আরো অনেক পাশ্চাত্য দেশ।
ইসরাইল প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিমত হলো, “ইসরাইলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অর্থদান করে সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোত্তম বিনিয়োগ। ঐ এলাকায় যদি ইসরাইল না থাকতো তবে আমাদের একটি নির্মাণ করতে হতো। ইসরাইল না থাকলে সেখানে আমাদের অসংখ্য যুদ্ধ করতে হতো। বিপুল সংখ্যক সৈন্য সেখানে মোতায়েন রাখতে হতো। ” প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এ বক্তব্যের ভিডিও যে কেউ দেখতে পারে সোসাল মিডিয়াতে। এটি নিশ্চিত যে, সেরূপ একটি স্ট্রাটেজিক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দখলদার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা পরিকল্পিত ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ভূমিতে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা দেয়। সেটিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ ভেবেছিল। তারা ইহুদীদের ঘাড়ে অস্ত্র রেখে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়ছে। তাদের কাজ শুধু পিছনে থেকে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক সাহায্য দেয়া। এবং প্রয়োজন দেখা দিলে নৌ বহর নিয়ে হাজির হওয়া।
ইসরাইল তাই শুধু নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে যুদ্ধ লড়ছে না। বরং লড়ছে সমগ্র খৃষ্টান পাশ্চাত্যবাদী শক্তির যুদ্ধটি। এটিই হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে খৃষ্টানদের নতুন ক্রসেড। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় শক্তিবর্গের কাছে ইসরাইলকে কোন সাহায্য চাইতে হয় না। তারাই বরং ইসরাইলকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিতে দুপায়ে খাড়া। এজন্যই আজ পাশ্চাত্য দেশগুলির নেতাদের ভিড় জমেছে ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে। ইসরাইলকে সহায়তা দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সর্ববৃহৎ বিমানবাহী জাহাজ জেরাল ফোর্ডকে ভূ-মধ্য সাগরে পাঠিয়েছে। সে সাথে মার্কিন নৌবাহিনীর ২ হাজার সৈন্যও পাঠিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চাচ্ছে ইসরাইল এ যুদ্ধ তত দিন চালিয়ে যাক যত দিন না সমগ্র ফিলিস্তিন মুসলিম শূণ্য না হয়। অতীতের ক্রসেড শেষে খৃষ্টান অধিকৃত ফিলিস্তিনে মুসলিম বসতি থেকে যায়, ফিলিস্তিন তাতে খৃষ্টানদের দুর্গরাষ্ট্রে পরিণত হতে পারিনি। ফলে সুলতান সালাহ উদ্দীনের বিরুদ্ধে তারা সফল প্রতিরোধ গড়তে পারিনি। তারা সে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এবারের ক্রসেডারদের লক্ষ্য হলো, সমগ্র ফিলিস্তিনকে মুসলিমশূণ্য করা। এবং ইসরাইলকে একটি মুসলিমশূণ্য দুর্গরাষ্ট্রে (fortified cantonement state) পরিণত করা। দুর্গরাষ্ট্রে তো অন্য কোন ধর্ম ও ভিন্ন এজেন্ডার মানুষের স্থান হয়না, তাই সেখানে চলছে মুসলিমদের নির্মূল ।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইসরাইল যতই শক্তিশালী হচ্ছে ততই বেশী আগ্রাসী হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় এজেন্ডা। ইসরাইলের হাতে রয়েছে শতাধিক পারমানবিক বোমা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান ও ট্যাংক। দিয়েছে মিজাইলরোধী Iron dome নামক প্রতিরক্ষা বুহ্য। ইসরাইলে এ শক্তিবৃদ্ধির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরাচারি শাসক ও রাজা-বাদশাহদের মধ্য সৃষ্টি হয়েছে চরম ইসরাইলভীতি। এটি কারোই অজানা নয় যে, ইসরাইলের সকল সামরিক শক্তি ও আগ্রাসী নীতির মূলে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তারা জানে ইসরাইলের আগ্রাসী হামলা থেকে বাঁচার সামর্থ্য তাদের নাই। তাদের প্রাসাদের উপর ইসরাইলের বিমান বোমা বর্ষণ শুরু করলে সেটি রুখবার সামর্থ্য বা আগ্রহ বৃহৎ শক্তিবর্গের নাই। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পাশ্চাত্যের দেশগুলি সেরূপ ইসরাইলী হামলকে সমর্থন দিবে। এতে বেড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের স্বেরাচারি মুসলিম শাসকদের ইসরাইলের প্রতি আনুগত্য। তাই তারা ব্যস্ত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে ও ইসরাইলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে। এতে ইসরাইল সুযোগ পেয়েছে মুসলিমদের অধিকারগুলিকে ক্রমান্বয়ে কেড়ে নেয়ার । এরই ফল হলো, অধিকৃত মুসলিম ভূমিতে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে দিন দিন ইহুদীদের নতুন বসতি এবং নতুন দাবী-দাওয়া। বাধা দেয়ার কেউ নেই। এতকাল মসজিদে আকসাতে একমাত্র মুসলিমগণ নামাজ পড়তো। এখন নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্থানীয় মুসলিমদের উপর। ইসরাইলী কতৃপক্ষ ইচ্ছামত মসজিদের দরজা মুসল্লীদের জন্য বন্ধ করে দেয়। সে সাথে ইহুদী উগ্রপন্থীদের দাবী হলো, আল-আকসার প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে ইহুদীদের ধর্মীয় স্থানের উপর। তাই সেটিকে তারা নিজেদের উপাসনা-স্থল বানাতে চায়। পুলিশি প্রহরায় সেখানে ইহুদীদের সেখানে প্রবেশের সুযোগও দেয়া হয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা যে বাহানা খাড়া করে সেরূপ বাহানা এখন আল-আকসার ধ্বংসের লক্ষ্যে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের এবারের হামলার কারণ, আকসা মসজিদকে দখলে নেয়ার এরূপ ইহুদী ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করা।
তেমন একটি আগ্রাসী লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ইসরাইলের মানচিত্রের কোন সুনির্দিষ্ট সীমারে খা নাই। তাই আজকের যে ইসরাইল সেটি ১৯৪৮’য়ের ইসরাইল থেকে ভিন্ন এবং বৃহৎ। যে নতুন ভূমির উপর তারা দখল জমায় সেটিই ইসরাইল হয়ে যায়। তাই ইসরাইলভু্ক্ত করা হয়েছে পূর্ব জেরুজালেমকে। অথচ ১৯৪৮ সালের মানচিত্রে পূর্ব জেরুজালেম ইসরাইলের অংশ ছিল না। অথচ আজ সেখানে ২ লাখ ২০ হাজার ইসরাইলীর বসতি। এবং অখণ্ড জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী বানানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটিকে মেনে নিয়েছে এবং নিজেদের দূতাবাস সেখানে সরিয়ে এনেছে। ইসরাইল এক শতের বেশী কলোনী নির্মাণ গড়েছে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে। অথচ সেগুলি ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা কালে ছিলন। সেখানে বসিয়েছে সাড়ে ৪ লাখ ইহুদীদের। তেমন এক অভিন্ন প্রক্রিয়ায় অধিকৃত গোলান উপত্যাকাকে ইসরাইলভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে ২০ হাজার ইহুদীর আবাদী গড়া হয়েছে। অথচ সে ভূমির বৈধ মালিক সিরিয়া। এসবই আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। কিন্তু কে রুখবে ইসরাইলকে সে বেআইনী অপরাধকর্ম থেকে। জাতিসংঘ নিজেই তো বন্দী ইসরাইলের অভিভাবকদের কাছে। ফলে যত অপরাধকর্মই করুক তার কোন জবাবদেহীতা নাই। ফলে দিন দিন আরো আগ্রাসী হচ্ছে।
এখন ইসরাইলের লক্ষ্য হলো, পুরা গাজাকে দখলে নেয়া। সে জন্য ইসরাইলের সেনাবাহিনী ২৪ ঘন্টার নোটিশ দিয়েছে প্রথমে উত্তর গাজার ১১ লাখ মুসলিমদের নিজ গৃহ খালি করতে। সে এলাকা দখলে নেয়ার পর নির্দেশ দিবে দক্ষিণ গাজাকে খালি করতে। এভাবেই সমগ্র গাজাকে ফিলিস্তিনীশুণ্য করা হবে। মিশরের উপর চাপ দিচ্ছে গাজার অধিবাসীদের সিনাই মরুভূমিতে স্থান দেয়ার। দাবী তুলেছে তাদের জন্য সেখানে তাবুর শহর নির্মাণ করা হউক। প্রস্তাব দিয়েছে সে তাবু নির্মাণের খরচ ইসরাইল ও তার বন্ধু দেশগুলি দিবে। এভাবে গাজা ইসরাইলভুক্ত করার পর শরু হবে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে মুসলিম শূণ্য করার। এ বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতিয়ানহু একটি ভাষণ দিয়েছে। সে ভাষণে আগামী দিনের মধ্যপ্রাচ্যের একটি ম্যাপও দেখিয়েছে। সে ম্যাপে ইসরাইলের যে মানচিত্র পেশ করা হয়েছে তাতে ইসরাইল বহির্ভুত গাজা, পূর্ব জেরুজালেম, জর্দান নদীর পশ্চিম তীরকে আলাদা ভাবে দেখানো হয়নি। সেগুলি বিলীন করা হয়ে গেছে ইসরাইলের পেটে। ইসরাইলীগণ জানে, তাদের এই বৃহৎ ইসরাইল বানানোকে বাধা দেয়ার মত কোন শক্তি এ পৃথিবীতে নাই। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল পশ্চিমা দেশগুলি তাতে সামরিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা দিবে। ইসরাইলের পক্ষের দেশগুলি দু-পায়ে খাড়া এমন একটি বৃহৎ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। সেরূপ একটি ইসরাইল নির্মিত হলে সেটিকে ইহুদীদের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য বলে যুক্তি দেখাবে। সেরূপ একটি ইসরাইলের জন্য ভূমি প্রস্তত করার অংশ রূপেই গাজার উপর চলছে কার্পেট বোম্বিং। পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ চায় ইসরাইল সে প্রক্রিয়া জারি রাখুক। এজন্যই জাতিসংঘে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোন রূপ নিন্দা প্রস্তাব পাশ হচ্ছে না। এমন কি কোন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবও পাশ হচ্ছে না।
মুসলিম উম্মাহর অপরাধী শাসকচক্র
ইসলামে অতি গুরুতর অপরাধ হলো শত্রুর আগ্রাসনের মুখে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকা। এরূপ হামলার মুখে ফরজ হলো জিহাদ। এমনকি নামাজ-রোজাও তখন কাজা করা যায়, কিন্তু জিহাদকে পরিত্যাগ করা যায় না। নবীজী (সা)’র যুগে জিহাদ থেকে যারা দূরে থেকেছে তাদেরকে মুনাফিক বালা হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার ৩০০ জন সহচরের নামাজ-রোজা তাই মুনাফিক হওয়া থেকে তাদেরকে বাঁচাতে পারিন। অথচ মুসলিম বিশ্বের কোনে কোনে ইসলামের শত্রুদের যুদ্ধ চলছে, তাদের রক্তাক্ত অধিকৃতিও আছে, কিন্তু মুসলিমদের মাঝে জিহাদ নাই। পরিতাপের বিষয় হলো, বহু কাল আগে থেকেই মুসলিমগণ জিহাদ ছেড়ে নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার পথ বেছে নিয়েছে। মুসলিমগণ শুধু সংখ্যায় ও সম্পদে বেড়েছে, কিন্তুতে ঈমানে ও শক্তিতে বাড়েনি। ফলে তারা বাঁচছে পরাধীনতা ও আত্মসমর্পণ নিয়ে। সেরূপ নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে মুসলিম ভূমির উপর শত্রুর অধিকৃতি এবং সে ভূমিতে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকে যেমন তারা রুখতে পারিনি, তেমনি রুখতে পারছে না বৃহৎ ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাকে। এরূপ অবস্থায় সৌদি আরব, জর্দান, আমিরাত, মিশর, সুদান, ওমান, ও মরক্কোর মত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?
ইসরাইলের কাছে আত্মসমর্পণের পথে একমাত্র বাধা হলো হামাস ও ইসলামী জিহাদ’য়ের ন্যায় কয়েকটি জিহাদী সংগঠন। এজন্যই ইসরাইলের সাথে সুর মিলিয়ে মুসলিম বিশ্বের স্বৈরাচারি শাসকগণও তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে। কারণ, তারাও জিহাদের বিরোধী। তাদের ভয়, জিহাদ শুরু হতে পারে তাদের স্বৈরাচারি শাসনের বিরুদ্ধেও। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতিয়ানহুর কাছে হামাস হলো ISIS। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্প্রতি তেল আবিবের প্রস কনফারেন্সে ISIS’কে বরং হামাসের চেয়ে উত্তম বলেছে। কারণ, ISIS ইসরাইলের এতো ক্ষতি করতে পারিনি -যা হামাস করেছে। হামাসের মূল অপরাধটি হলো, তারা অধিকৃত ফিলিস্তিনকে ইসরাইলের দখলদারী থেকে মুক্ত করতে চায়। সে একই কাজ করছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের আজাদীকামী যোদ্ধারা। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলির কেউই তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে না, বরং তাদেরকে তারা মুক্তিযোদ্ধা বলে সম্মানিত করে। এটিই হলো পাশ্চাত্যের নেতাদের double standard তথা মুনাফিকি। তেমন এক মুনাফিকি নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশের কোন কোন রাজধানীতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলগুলিকেও তারা নিয়ন্ত্রিত করছে। এমনকি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো অপরাধ গণ্য করা হচ্ছে। প্রতিবাদী ছাত্রদের চাকুরি দেয়া হবে না -সে ভয়ও দেখানো হচ্ছে।
অপর দিকে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর যুদ্ধটি একাকী লড়ছে হামাস। এবং হামাসে সাথে রয়েছে ইসলামী জিহাদ। এমনকি পি.এল. ও এবং তার বৃহৎ অঙ্গসংগঠন ফাতাহও এ জিহাদে নাই। ২০০৬ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয় ফিলিস্তিনে। সে নির্বাচনে বিজয়ী হয় হামাস। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনি বলেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু সে নির্বাচনের রায়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও তার পাশ্চাত্যের মিত্ররা মেনে নেয়নি। তাদের কথা নির্বাচন হলেই হলো না। নির্বাচিত করতে হবে তাদের আজ্ঞাবহ পক্ষের লোকদের, নইলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। সে অভিন্ন নীতি দেখা গেছে মিশর, আলজিরিয়া ও তিউনিসিয়াতে। মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও নির্বাচন হলে সেখানে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হয়। সেটি তারা মেনে নিতে রাজি নয়। তারা তাই মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের শত্রু। তারা হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাত ও খুনি এবং আল-সিসির ন্যায় ফ্যাসিস্টের নৃশংস শাসনকে মেনে নিতে রাজী, কিন্তু মুহম্মদ মুরসী বা ইমরান খানের ন্যায় নির্বাচিত নেতাদের গণতান্ত্রিক শাসনকে মেনে নিতে রাজী নয়। কারণ জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকারকে দিয়ে ইসরাইলের ন্যায় একটি অবৈধ ও অপরাধী রাষ্ট্রের জন্য স্বীকৃতি আদায় করা অসম্ভব। কিন্তু সেটি অনায়াসেই করিয়ে নেয়া সম্ভব স্বৈরাচারি শাসকদের দ্বারা।
জেলবন্দী মুসলিম-উম্মাহ এবং বিজয় শত্রুশক্তির
আজ বিশ্বে ১৫০ কোটির বেশি মুসলিম। কিন্তু তারা জেলবন্দী। ফলে তারা শক্তিহীন। মুসলিম উম্মাহর এই বিশাল জেলখানাটি পঞ্চাশটির বেশি রাষ্ট্র নিয়ে নির্মিত। এ রাষ্ট্রগুলি যেন জেলের কুঠরি। এসব জেল-বাষ্ট্রের রাজা, রাষ্ট্রপ্রধান বা আমিরগণ হলো নিছক জেল-সুপারিনটেনডেন্ট মাত্র। জেলের সুপারিনটেনডেন্ট কখনোই কয়েদীদের দ্বারা নির্বাচিত হয় না, তেমনি এসব জেল-রাষ্ট্রের সুপারিনটেনডেন্টগণও নির্বাচিত নয় বন্দী জনগণ দিয়ে। এসব রাষ্ট্রের সরকারগুলির কাজ, জনগণকে স্বাধীনতা ও ইজ্জত দেয়া নয়, বরং সেগুলি কেড়ে নেয়া। জেলের বন্দী কয়েদীদের তাদেরও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই। স্বাধীনতা নাই রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির। সেখানে বাঁচতে হয় গোলামী ও অধীনতা মেনে নিয়ে। তাই ২২টি আরব জেল-রাষ্ট্রের কোনটিতেই গণতন্ত্র নাই। সেখানে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন হয়না। এখানে জনগণের প্রাণের নিরাপত্তা নাই; ইজ্জত নাই তাদের রায়ের । এখানে নিরাপত্তা ও ইজ্জত পায় কেবল স্বৈরাচারি শাসক।
কেবল মাত্র স্বাধীন মানুষই বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সে নিজেই যদি কারাগারে বন্দী হয়, তবে সে কারোই কল্যাণ করতে পারেনা। ঠিক একই একই রূপ অবস্থা ১৫০ কোটির বেশী বন্দী মুসলিমের। ১৭ অক্টোবর আল জাজিরা ইংরেজী টিভির স্ক্রীনে দেখা গেল, জর্দানের রাজধানী আম্মানে বিশাল জনতা রাস্তায় নেমেছে। তাদের মুখে একই স্লোগান, “আমরা সবাই হামাস”। তারা আওয়াজ তুলছে, “হামাস যা করছে আমরাও তাই করতে চাই”। কিন্তু বাস্তবে তারা কিছুই করতে পারছে না। কারণ তারা তো জেলবন্দী।। তেমনি কিছুই করতে পারছে মিশরের জনগণ। কারণ তারাও তো জেল-বন্দী। ফিলিস্তিনীদের লড়াইয়ে শামিল হওয়া দূরে থাক, এমনকি তারা গাজার সীমান্তে খাদ্য-পানীয় নিয়েও হাজির হতে পারছে না। কারণ, সে স্বাধীনতা তাদের নাই। একই অবস্থা সারা বিশ্বের মুসলিমদের। তাই মুসলিমরা যদি স্বাধীনতা, ইজ্জত ও বিজয় নিয়ে বাঁচতে চায় তবে তাদের সামনে প্রথম কাজটি হলো, জেলের দেয়াল ভেঙ্গে প্রথমে নিজেদের বন্দী দশা থেকে মুক্ত করা। মুসলিম জীবনে জিহাদের শুরু হতে হবে এখান থেকেই। এরপর দ্বিতীয় ধাপটি হলো, বিভক্তি ছেড়ে ধরতে হবে একতার পথ। একমাত্র এ পথটিই হলো মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার পথ। অপরদিকে বিভক্তির পথটি হলো আযাবের পথ। আযাবের সে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আল ইমরানের ১০৫ নাম্বার আয়াতে।
বিভক্তির নাশকতা বিশাল। মুসলিম বিশ্বে যত তেল, যত গ্যাস ও যত ধন-সম্পদ আছে তার চেয়ে যদি শতগুণ বেশি সম্পদেরও মালিক হয় এবং তাদের জনগণ যদি আরো চারগুণ বেশী হয় -তবুও গোলামীর বন্দীদশা থেকে তাদের মুক্তি নাই। বিভক্ত মানুষের সংখ্যা যতই হোক, তাতে শক্তি বাড়ে না। তাছাড়া বিভক্তদের সাহায্য করা কখনোই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। বরং তাঁর সূন্নত হলো বিভক্তদের শাস্তি দেয়া। আর প্রতিটি বিজয় আসে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে -সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালে। সে বিজয়ের জন্য জিহাদে নামতে হয়। জিহাদে না নেমে সেটি সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয়, চাষাবাদ না করে ফসল ঘরে তোলা। মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ, তারা শুধু বিভক্তই হয় না, বিভক্তি নিয়ে তারা বরং উৎসবও করে। এবং বিভক্তিকে প্রতিরক্ষা দিতে বিশাল বিশাল সেনাবাহিনীও প্রতিপালন করে। অথচ কোন মুসলিম ভূমি কাফের শক্তির হাতে অধিকৃত হলে এসব সেনাবাহিনী কখনোই এগিয়ে আসে না। তাই গাজার উপর ৬,০০০ বার বোমাবর্ষণ হলে কি হবে, মিশর, সৌদি আরব, জর্দান ও তুরস্কের সেনাবাহিনী তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সাহায্যে ২ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে, কিন্তু কোন মুসলিম দেশই হামাসের সাহায্য একজন সৈন্যও পাঠায়নি। কোন খাদ্যও পাঠায়নি। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সাহায্যে যা কিছু করছে -সেটি তাদের রাজনীতি। এটি তাদের ধর্মীয় অনুশাসন নয়। কিন্তু হামাসকে সাহায্য করা তো মুসলিমদের উপর ধর্মীয় ভাবে ফরজ। কারণ, ইসলামের বিধান হলো যখন কোন দুর্বল মুসলিম জনগোষ্ঠি প্রবল শত্রু-শক্তির হামলা রুখতে ব্যর্থ হয় তবে প্রতিবেশীদের উপর ফরজ হয় তাদেরকে সাহায্য করা। কিন্তু সমস্যা হলো, যারা নিজেরাই ইসলাম থেকে দূরে সরেছে তারা কি ফরজ পালনে আগ্রহ দেখাতে পারে? বরং আল্লাহতায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই তো তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি। এজন্যই মুসলিম জীবনে এতো বিভক্তি, এতো নিষ্ক্রিয়তা, এতো পরাজয় ও গোলামী।
মুসলিমগণ আজ শুধু নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ও দোয়া দরুদ পাঠের মধ্য দিয়ে ইসলাম পালন করছেন। মুসলিম উম্মার একতা নিয়ে তারা ভাবে না। ইসলামের বিজয় নিয়েও ভাবে না। আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার কথাও তারা ভাবে না। অথচ যদি তাদের মনে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও থাকতো তাহলে এই বিভক্তি নিয়ে তাদের মধ্যে মাতম শুরু হতো। প্রতিটি বিভক্তি তো মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। অথচ তারা নিজেরা নিজ হাতে মুসলিম দেশগুলোকে খন্ড খন্ড করেছে । একতাবদ্ধ হওয়ায় তাদের কোন আগ্রহ নাই, বরং প্রচণ্ড আগ্রহ সে বিভক্তিকে বাঁচিয়ে রাখায়। যেরূপ আগ্রহ তাদের মসজিদ মাদ্রাসায় গড়ায়, সেরূপ আগ্রহ নাই ইজ্জত স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচায়। অথচ মসজিদ-মাদ্রাসা শক্তি বাড়ায় না, স্বাধীনতাও বাঁচায় না। ইজ্জত ও স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে একতা চাই এবং একতাবদ্ধ জিহাদ চাই।
দায়ী শুধু সরকার নয়, আলেমগণ এবং জনগণও
আজ ফিলিস্তিনে যা কিছু হচ্ছে তার জন্য দায়ী সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। যখন কোন ব্যক্তির আঙ্গুলগুলিতে পচন ধরে তখন সেটিকে শুধু আঙুলের ব্যাধি বললে ভূল হবে। বরং সেটি একটি গুরুতর অসুস্থ দেহের লক্ষণ। যেমন ডায়েবেটিক রোগীদের ক্ষেত্র হয়ে থাকে। তাই আজ ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আরাকান, সিরিয়া ও উইঘুরে যা কিছু হচ্ছে -তার জন্য দায়ী সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। দায়ী শুধু শুধু সরকারগুলি নয়, দায়ী আলেমগণ।। সে সাথে এ ব্যর্থতা সাধারণ মুসলিমদেরও। আলিমগণ নবীজী (সা:)’র ইসলামের উপর নেই। যে ইসলামে ইসলামী রা ষ্ট্র আছে, আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার আছে, মুসলিমদের মাঝে একতা আছে, শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ আছে, অবিচার ও দুর্বৃত্তির নির্মূল আছে এবং সত্য ও সুবিচারে প্রতিষ্ঠা আছে -সে ইসলাম নিয়ে আজকের আলেমগণ বাচে না। সাধারণত মুসলিমগণ বাঁচে না। তারা যে ধর্ম নিয়ে বাঁচে সে ধর্মে ইসলামী রাষ্ট্র নাই, শরীয়তের বিচার নাই, একতা নাই, কুরআন বুঝার আগ্রহ নেই এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠার জিহাদও নাই। জিহাদকে এদের অনেকে সন্ত্রাস বলে। এভাবেই তারা বিলুপ্তি ঘটিয়েছে নবীজী (সা:)’ইসলামকে। এদের বিরুদ্ধেই নবীজী (সা:) মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে অভিযোগ তুলবেন। মহান আল্লাহতায়ালার ভাষার তাদের বিরুদ্ধে নবীজী (সা:)’র অভিযোগটি হবে এরূপ: “রাসূল বল্লেন, হে আমার রব, আমার কওম তো এই কুর’আনকে পরিতাজ্য মনে করে।” –(সুরা ফুরকান ৩০।) নবীজীর (সা:)’র ইসলামকে মুসলিম ভূমিতে বিলুপ্ত করে তাঁর সে আশংকাকে কি আজকের মুসলিমগণ সত্য প্রমাণিত করেনি?
মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে যথেষ্ট দৈহিক সামর্থ্য দিয়েছেন। চিন্তা-ভাবনা, লেখালেখি ও কথা বলার সামর্থ্যও দিয়েছেন। অর্থ-সম্পদও দিয়েছেনা। এ সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে প্রতিটি বান্দাই মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারে। আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে অনেক কোরবানি পেশ করতে পারে। এভাবে নিজেকে মাগফেরাত পাওয়ার যোগ্য রুপে গড়ে তুলতে পারে। এ ভাবে জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করতে পারে। নবীজী (সা:)’র সাহাবাগণ তো সেটি করেছেন। ফলে তারা আল্লাহর সাহায্যও পেয়েছেন। এবং বিশ্বমাঝে পেয়েছেন বিজয়ের গৌরব।
ষড়যন্ত্র জিহাদ বিলুপ্তির
জিহাদ বিলুপ্তির জন্য অতীতে ব্রিটিশগণ গোলাম আহম্মদ কাদিয়ানীকে নবী সাজিয়ে ময়দানে নামিয়েছিল। সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। তবে জিহাদ বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র থেকে শয়তান ও তার অনুসারিগণ নিবৃত হয়নি। এখন ময়দানে নামানো হয়েছে সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, সেক্যুলার রাজনীতিবিদ ও সেক্যুলার আলেমদের। তারা ফতোয়া দিচ্ছে জিহাদের হুকুম দেয়ার অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের। প্রশ্ন দাঁড়ায়, হামাসের হাতে কোন রাষ্ট্র নেই। সেখানে রাষ্ট্র তো ইহুদিদের হাতে। অথচ সেখানে চলছে শত্রু শক্তির অধিকৃতি, চলছে প্রচণ্ড জুলুম। সে অধিকৃত ভূমিতে জিহাদ তো ফরজ। তবে কি সে জিহাদের ঘোষণা তবে ইসরাইলী রাষ্ট্র? সেটি তো হওয়ার নয়। ফিলিস্তিনী জনগণ কি তবে জিহাদ পরিহার করে গোলামী নিয়ে বাঁচবে? হামাসের জিহাদ কি তবে হারাম? একই অবস্থা কাশ্মীরে। সেখানে রাষ্ট্র তো হিন্দুত্ববাদীদের হাতে। সে অধিকৃতি থেকে বাঁচাতে জিহাদের ঘোষণা দিবে কি ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক? জিহাদ না করলে কাশ্মির স্বাধীন হবে কি করে,?
প্রতিটি মুসলিমদেশের তো একই অবস্থা। সে সব দেশে দখলদারি হলো ইসলাম থেকে দূরে সরা ন্যাশনালিস্ট,সেকুলারিস্ট ও রাজতন্ত্রীদের। তারা তো জিহাদের বিরুদ্ধে। জিহাদকে তারা সন্ত্রাস বলে। তাই যারা বলে, জিহাদের ঘোষণা দেওয়ার অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের তারা চায় মুসলিম বিশ্বকে জিহাদমুক্ত করতে। সেটি তো শয়তানী শাসক চক্রকে খুশি করার পথ। এটি তো চিরকালের জন্য মুসলিমদের গোলাম বানানো ও আল্লাহতায়ালার শরিয়তী বিধানকে বিলুপ্ত রাখার পথ। অথচ আল্লাহতায়ালা জিহাদকে ফরজ করেছেন। এবং এটিকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ করেছেন। যার জীবনে জিহাদ আছে একমাত্র তাকেই তিনি ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী বলেছেন। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে সূরা হুজরাতের ১৫ নাম্বার আয়াতে।
আল্লাহর সাহায্য কখনোই নিষ্ক্রিয় ও ভীতু মানুষেরা পায়না।। জিহাদশূণ্য মানুষও পায়না। বিজয় দোয়া-দরুদেও আসে না। বিজয়ের পথ সেটি নয়। বিজয় আসে জিহাদের পথ ধরে। জিহাদই হলো দ্বীনকে বিজয়ী করার একমাত্র হাতিয়ার। দোয়াদরুদে সম্ভব হলে নবীজী (সা:) জিহাদে নামতেন না। অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হতেন না। মহান আল্লাহতায়ালা জিহাদকে ফরজ করেছেন। কারণ, তিনি মুসলিমদের বিজয় চায়। শয়তান চায়, ইসলামের পরাজয়। এজন্যই শয়তান চায়, মুসলিমদের জিহাদ থেকে দূরে সরাতে। তাই শয়তানী শক্তির পক্ষ থেকে জিহাদ বিলুপ্তির নানারূপ ষড়যন্ত্র। জিহাদ থেকে দূরে থাকার লোকদের জন্য কোন বিজয় নেই। সম্মানও নেই। আখিরাতে তাদের জন্য জান্নাতও নেই। আল্লাহ সুবাহানাহ ওয়া তায়ালা তার নিয়ামত ভরা জান্নাত ভীরু, কাপুরুষ ও স্বার্থপরদের জন্য নির্মাণ করেননি। ঈমানদারগণ যখন আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে কুরবানি পেশ করা শুরু করে, তখন তাদের সাহায্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা সারিবদ্ধ ভাবে ফেরেশতা পাঠান। সে বর্ণনা সূরা আনফালের ৯ নম্বর আয়াতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো মুসলিমরা আল্লাহর দেয়া সামর্থকে শুধু নিজেদের স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করে। আল্লাহ দ্বীনের স্বার্থে নয়। আল্লাহর আইন, তাঁর দ্বীন ও তাঁর সার্বভৌমত্ব মুসলিম ভূমিতে বিলুপ্ত হলেও তাতে তাঁদের বিবেকে কোন দুঃখবোধ হয় না। তারা সেগুলি বহাল করতে জিহাদে নামে না। বরং নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের কোরবানির ইতিহাস পাঠ করে, কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নেয় না। তারা বরং জালেমের শাসন ও অধিকৃতিকে মেনে নেয়। অনেকে তাদের নিজেদের সামর্থ্যকে জালিমের খেদমতে লাগায়। এভাবেই আল্লাহতায়ালার দেয়া আমানতকে তারা খেয়ানত করে। মুসলিম উম্মার আজকের বিপর্যয়ের মূল কারণ তো এই খেয়ানত।
জিহাদের মোজেজা হামাস ৭ নভেম্বর দেখিয়ে দিয়েছে। ইসরাইল বিশ্ববাসীর সামনে নিজেকে অপরাজেয় (invincible) বলে এক বিশাল ভাবমুর্তি (myth) খাড়া করেছিল। ইসরাইলকে পরাজিত করা যাবে না মনে করে ইয়াসির আরাফাত ও তার সংগঠন ফাতাহ লড়াই পরিত্যাগ করে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়। অথচ হামাসের মাত্র কয়েক হাজার মুজাহিদ ইসরাইলের দুর্ভেদ্য সীমান্ত বেষ্টনি ভেদ করে ইসরাইলের গভীরে প্রবেশ করে। ইসরাইলের রাডার সিস্টেম এত উন্নত যে সীমান্ত দিয়ে কোন পাখি ঢুকলেও সেটি রাডারে ধরা পড়ে। কিন্তু এসব উন্নত প্রযু্ক্তি হামাসকে থামাতে পারিনি। তারা বহু মাইল ভিতরে ঢুকে কয়েকটি সামরিক ঘাটি ধ্বংস করে। ব্রিগেডিয়ারসহ প্রায় ১৫০ জনকে বন্দী করে। হামলা শুরু প্রায় ৬ ঘন্টা পর ইসরাইলী বাহিনী যুদ্ধে নামে। তাদেরকে কে ঘুমিয়ে রাখলো এই ৬ ঘন্টা। এসবই মোজেজা। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও জর্দান এ তিটির দেশের সেনাবাহিনীইও ইসরাইলের এতো গভীর ঢুকতে পারিনি এতো ক্ষয়ক্ষতিও করতে পারিনি। ফলে হামাস ইসরাইলের ভাবমুর্তিকে ধুলিতে মিশিয়ে দিয়েছে।
ইসরাইলীদের মনে হামাস ভীতি এখন এতোই প্রবল যে লাগাতর ১৩দিন বোমা বর্ষণ করেও ইসরাইলের তিন লাখের বেশী বিশাল সেনা বাহিনী গাজার ভিতরে ঢুকতে সাহস করছে না। সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে হামাসের এটি এক বিস্ময়কর অর্জন। হামাসের একার পক্ষে এটি অসম্ভব ছিল। জিহাদই হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য নামিয়ে আনার একমাত্র পথ। সেটি নবীজী (সা:)ও সাহাবাদের সময় বার বার দেখা গেছে। মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত এখনো জমিনে নেমে আসে মোজেজা দেখাতে প্রস্তুত। হামাস সেটিই প্রমাণ করলো। এটিই হামাসের বড় কৃতিত্ব। নবীজী (সা:)ও তাঁর সাহাবাদের বিজয় যাত্রা কোন বিশাল শহর বা দেশ থেকে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছিল মদিনার ন্যায় এক ছোট্ট গ্রামীন শহর থেকে। আশা করা যায়, গাজার ১৪১ বর্গ মাইলের ক্ষুদ্র জনপদ থেকেই শুরু হলো মুসলিম উম্মাহর বিজয় যাত্রা। বিজয়ের জন্য বিজয়ের সঠিক পথ তথা সিরাতাল মুস্তাকীমটি জানা জরুরি। হামাসের কৃতিত্ব যে তারা সে পথটিই খুঁজে পেয়েছে। হামাস এ জন্য মুসলিম ইতিহাসে যুগ যুগ বেঁচে থাকবে। এবং অনুপ্রেরণার উৎস হবে আগামী দিনের মুজাহিদদের জন্য। ২০/১০/২০২৩
(প্রবন্ধটি London Islamic Circle’য়ের ২০/১০/২০২৩ তারিখের সেমিনারে পেশ করা হয়।)
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018