ঈমানদারের পরাধীনতা ও বেঈমানের স্বাধীনতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 12, 2021
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
স্বাধীনতা যখন নাশকতার হাতিয়ার
স্বাধীনতার রূপটি জনে জনে ভিন্নতর। বেঈমানের সে স্বাধীনতাটি আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে নাশকতার হাতিয়ার। বেঈমানের স্বাধীনতার অর্থ মিথ্যাচার, স্বৈরাচার, সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, ভোট-ডাকতি ও গণহত্যাসহ নানাবিধ দুর্বৃত্তি নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা। সেটি নিরস্ত্র মানুষের উপর পারমানবিক বোমা, রাসায়নিক বোমা, ব্যারেল বোমা, ক্লাস্টার বোমা, ড্রোন হামলা ও বিমান হামলার অবাধ স্বাধীনতা। সেটি দুর্বল দেশগুলিতে যুদ্ধ ও অধিকৃতির স্বাধীনতা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ দেশে দেশে সে স্বাধীনতার প্রয়োগ করে চলছে বহুকাল যাবত। বেঈমানের স্বাধীনতার মূল চরিত্রটি হলো তারা ঈমানদারদের স্বাধীনতা দিতে রাজী নয়। জালেমদের হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ার বিপদটি তাই ভয়াবহ। সমগ্র দেশ তখন দুঃসহ জেলখানায় পরিণত হয়। তখন নৃশংস পরাধীনতা জেঁকে বসে অধিকৃত দেশের জনগণের উপর। জালেমের স্বাধীনতা এভাবেই দুর্বলের জন্য ভয়াবহ পরাধীনতার কারণ হয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতের উপর সেরূপ স্বাধীনতার একচ্ছত্র মালিক ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশগণ। ব্রিটিশ ডাকাতগণ তখন শাসকে পরিণত হয়েছে; এবং ভারতীয়গণ পরিণত হয়েছে নিছক গোলামে। ব্রিটিশদের লুন্ঠনের সে অবাধ স্বাধীনতায় তখন দেশে ছিয়াত্তরের মনন্তর এসেছে; যাতে মৃত্যু হয় বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নাগরিকের।
অধিকাংশ মুসলিম দেশ থেকে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হয়েছে; কিন্তু স্বাধীনতা মেলেনি জনগণের। বরং আরোপিত হয়েছে নতুন পরাধীনতা। স্বাধীনতা নতুন ভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শত্রুদের আশ্রয়ে, প্রশ্রয়ে ও পরিচর্যায় বেড়ে উঠা স্বৈরাচারী রাজা-বাদশাহ, সামরিক শাসক ও ফ্যাসিবাদি দুর্বৃত্তদের হাতে। সাম্রাজ্যবাদী বিদেশীদের ন্যায় এসব দেশী শাসকদের মনযোগটিও ছিল মূলত লুন্ঠনে। ঔপনিবেশিক কাফেরদের ন্যায় তাদের বেঈমানীটাও খেলাফত, শরিয়ত, হুদুদ, জিহাদের ন্যায় ইসলামের অতি মৌলিক বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাতের ন্যায় আরব দেশগুলীতে সে স্বাধীনতার একচ্ছত্র মালিক হলো রাজা-বাদশাহগণ। মিশরে সে স্বাধীনতা কুক্ষিগত হয়েছে সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের হাতে। এবং সিরিয়া ও বাংলাদেশের ন্যায় দেশগুলিতে স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায় তা হলো স্রেফ স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্টদের স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতার অঙ্গণে জনগণের কোন স্থান নাই। ঔপনিবেশিক লুটেরাদের তূলনায় জেঁকে বসা এ দেশী স্বৈরাচারীদের নাশকতাও কি কম নৃশংস? সে লাগামহীন স্বাধীনতা নিয়েই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ প্রায় তিন লক্ষ সিরিয়াবাসীকে হত্যা করেছে ও ধ্বংস করেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ী। তিরিশ লাখের বেশী নরনারী ও শিশুকে বাধ্য করেছে নিজ ঘর-বাড়ী ছেড়ে বিদেশে পাড়ী দিতে।
১৯৭১’য়ে স্বাধীনতার নাম ভাঙ্গিয়ে বাংলাদেশেও একই রূপ নিজ স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার প্রচন্ড স্বাধীনতা পেয়েছিলেন শেখ মুজিব ও তার দলের লোকজন। লাগামহীন সে স্বাধীনতা নিয়ে শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার। বিরোধীদের ও বিহারীদের হাজার হাজার ঘর-বাড়ী ও ব্যবসা-বানিজ্যের উপর দখলে নিয়েছে তার দলের লোকজন। নিজের গদী বাঁচনোর স্বার্থে শেখ মুজিব তিরিশ হাজারেরও বেশী বিরোধী দলীয় রাজনৈতীক নেতা-কর্মীকে বিনাবিচারে হত্যা করেছিলেন; এবং নিষিদ্ধ করেছিলেন ইসলামী চেতনাধারীদের সংগঠিত হওয়াকে। মুজিবের পতন ঘটেছে, কিন্তু তার স্বৈরাচার বিলুপ্ত হয়নি। ইসলামপন্থি নেতাকর্মীদের খুন, গুম ও নির্মূলে একই রূপ লাগামহীন স্বাধীনতা প্রয়োগ করে চলেছেন শেখ হাসিনা । তার নৃশংস নাশকতা শুধু ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে সীমিত থাকেনি, বরং সমগ্র দেশ পরিণত হয়েছে শাপলা চত্ত্বরে।
ইসলামের শত্রুপক্ষ কখনোই ঈমানদারদের পূর্ণ ইসলাম পালন ও প্রকৃত মুসলিম বেড়ে উঠার স্বাধীনতা দিতে রাজী নয়। তারা রাজী নয়, কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে দূর্নীতিমূক্ত ইসলামের পূণ্যভূমি রূপে গড়ে উঠতে দিতে। সে অধীকার যেমন শেখ মুজিব দেয়নি, দিচ্ছে না শেখ হাসিনাও। জালেমদের হাতে শাসনভার গেলে মু’মিনদের জন্য জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে বাঁচা যে কতটা অসম্ভব হয় তার উদাহরণ হলো আজকের বাংলাদেশ। তখন তাদের ঘাড়ে চাপানো হয় নিরেট ও নির্মম পরাধীনতা। স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তগণ সব সময়ই ইসলামের রাজনৈতিক শক্তিতে ভয় পায়, ফলে ইসলামের বিরুদ্ধ তারা অতিশয় নৃশংস ও নির্দয় হয়। নিরস্ত্র হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে তাই তারা আগুণে ফেলেছিল। হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল হযরত মহম্মদ (সাঃ)র বিরুদ্ধে। তাদের সে সংস্কৃতি আজও বেঁচে আছে আধুনিক স্বৈরাচারীদের মাঝে। নানারূপ মিথ্যাচারের সাথে তাদের আরেক মিথ্যাচার হলো, নিজেদের জুলুমবাজীর লাগামহীন স্বাধীনতাকে তারা জনগণের স্বাধীনতা বলে প্রচার করে। এবং জনগণকে বাধ্য করে বছরের বিশেষ মাসে ও বিশেষ দিনে সে স্বাধীনতার উদযাপনে রাস্তায় নামতে। সেসব উৎসবে নিজেদের নিরেট স্বৈরাচারকে তারা দেশবাসীর স্বাধীনতা রূপে প্রচার করে। বাংলাদেশে সেটি যেমন মুজিব করেছিল, এখন সেটিই করছে হাসিনা।
স্বাধীনতার অর্থ বিয়েশাদী, পরিবার পালন, মৎস্যপালন, পশুপালন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ ও দালান-কোঠা গড়ার স্বাধীনতা নয়। এরূপ স্বাধীনতা কাফের শাসিত দেশেও থাকে। সত্যিকার স্বাধীনতার ক্ষেত্রটি অতি বিশাল। মহান আল্লাহতায়ালার এটি এক বিশাল নেয়ামত। এটি যেমন ধর্মপালন, ধর্মপ্রচার, কোর’আন শিক্ষা ও শরিয়ত পালনের স্বাধীনতা, তেমনি সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো ও আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে মুজাহিদ রূপে বেড়ে উঠার স্বাধীনতা। ঈমানদার ব্যক্তি তো এভাবেই অর্জন করে মহান আল্লাহতায়ালার মাগফেরাত লাভের সামর্থ্য; এবং পায় জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠার স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা নিয়েই ঈমানদার ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রের প্রতি অঙ্গণে ঈমানী দায়িত্বপালন করে এবং প্রয়োজনে জান ও মালের কোরবানী পেশ করে। এমন স্বাধীন ভূমিতে তখন ঘরে ঘরে বেড়ে উঠে আত্মত্যাগী মুজাহিদ –যেমনটি হয়েছিল সাহাবায়ে কেরামদের সময়। মানুষ তখন পার্থিব স্বার্থপরতা ছেড়ে জান্নাতমুখি হয়। গড়ে উঠে জনসেবা, ত্যাগ ও জিহাদের সংস্কৃতি। তখন শিশুরাও বুঝে, আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয়ে শ্রমদান, অর্থদান ও প্রাণ দান তথা শহীদ হওয়াই এ জীবনে সফলতা তথা জান্নাতের পথ।
জিহাদের পথেই আসে মহান আল্লাহতায়ার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত গায়েবী মদদ; তখন বিজয় আসে শক্তিধর কাফের শক্তির বিরুদ্ধেও। সেরূপ গায়েবী মদদ, বিজয় ও পরকালে সফল হওয়ার লক্ষ্যে মু’মিনের প্রতিটি যুদ্ধ ও প্রতিটিকে লড়াইকে তাই শতভাগ বিশুদ্ধ জিহাদে পরিণত করতে হয়। তখন ১৭ জন সৈনিকের পক্ষেও বিশাল দেশজয় সম্ভব হয় –যেমনটি হয়েছিল ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের ক্ষেত্রে। ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার এমন স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়াটি ইসলামে গুরুতর অপরাধ। একাজ কাফের, মুনাফিক ও জালেমদের। তাদের হাতে অধীনতায় সে স্বাধীনতা ঈমানদারদের জুটে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রয়োগটি ইসলামের পক্ষে হলো সে স্বাধীনতা তখন হত্যাযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হয়। ফিরাউনের দরবারে যে যাদুকরগণ হযরত মূসা (আঃ)’র সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে ঈমান এনেছিলেন, তাদেরকে তাই নির্মম ভাবে করা হত্যা করা হয়েছিল। ফিরাউন তাদেরকে প্রতিযোগিতায় নামালেও ঈমান আনার স্বাধীনতা দেয়নি। ইসলাম গ্রহণ করায় একই ভাবে হত্যা করা হয়েছিল হযরত সুমাইয়া (রাঃ)ও তাঁর স্বামী হযরত ইয়াসির (রাঃ)কে। একই রীতি আধুনিক কাফেরদেরও। তাদের কাছে দন্ডনীয় অপরাধ রূপে গণ্য হয় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলে মুসলিম যুবকের জিহাদ ও তাঁর জান-মালের কোরবানী। ঘরে জিহাদ বিষয়ক বই রাখাও হাসিনা সরকারের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এবং নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত, শরিয়ত ও হুদুদের ধারণা নিয়ে রাষ্ট্র গড়লে মার্কিনী জোটের পক্ষ থেকে বোমা বর্ষণ শুরু হয়।
পরাধীনতার নাশকতা
বেঈমানদের হাতে পরাধীনতার সবচেয়ে বড় বিপদটি হলো, তখন অসম্ভব হয় সিরাতুল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের পথে চলা। এমন অধিকৃত দেশে সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতির মূল লক্ষ্য হয় জনগণকে জাহান্নামের উপযোগী করে গড়ে তোলা। সে লক্ষ্য-সাধনে তারা জনগণকে বিদ্রোহী করে আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তি বিধানের বিরুদ্ধে। এবং দূরে হটায় জিহাদের পথ থেকে। তাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ জাহান্নামে চলার স্বাধীনতা। অথচ মানব জীবনে অতি কল্যাণকর স্বাধীনতাটি হলো ইসলাম পালন ও জান্নাতের পথে চলার স্বাধীনতা। একমাত্র তখনই জুটে জাহান্নামের পথ থেকে বাঁচার স্বাধীনতা। মানব জীবনে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কি হতে পারে? এরূপ স্বাধীনতার উপরই নির্ভর করে অনন্ত অসীম আখেরাতের সফলতা। এরূপ স্বাধীনতা ছাড়া কি কারো পক্ষে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে পরাধীনতার নাশকতাটি ভয়াবহ; পার্থিব জীবনের দুঃসহ যাতনার সাথে তখন ভয়ানক বিপদে পড়ে অনন্ত অসীম কালের পরকালীন সফলতা তথা সুখশান্তি। সে অধিকৃত ভূমিতে ইসলামের শত্রুপক্ষের রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির মূল এজেন্ডা হয়, জনগণকে পথভ্রষ্ট করা ও জাহান্নামের পথে চলতে বাধ্য করা। শয়তানী শক্তির অধিকৃত সে ভূমিতে দেহব্যবসায়ী, মদ-ব্যবসায়ী, জোয়ারী, নর্তকী ও সূদী ব্যাংকের মালিকদের নিজ নিজ ব্যবসার চালানোর আজাদী দিলেও আজাদী মেলে না ইসলাম নিয়ে বাঁচা ও ইসলামের শরিয়তী বিধান প্রতিষ্ঠার। ফিরাউন, নমরুদ, মুজিব-হাসিনার ন্যায় ইসলামের শত্রুপক্ষের দখলদারীর এটিই হলো মূল নাশকতা।
ইসলামের শত্রুশক্তির মূল এজেন্ডাটি হলো, আল্লাহর স্মরণ ও জীবনের মূল মিশন ভূলিয়ে দেয়া। অথচ আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়ার বিপদটি ভয়াবহ। এর অর্থ, নিজের ঘাড়ে শয়তানকে চাপিয় নেয়া। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “যারাই দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয় তাদের উপর আমি নিযুক্ত করি শয়তান। অতঃপর সে হয় তার সহচর। এসব শয়তানেরা সৎপথ থেকে চলা থেকে তাদেরকে বিরত রাখে। অথচ সে (বিভ্রান্ত) মানুষগুলি মনে করে তারা হিদায়েতপ্রাপ্ত।” –(সুরা যুখরুফ, আয়াত ৩৬-৩৭)। শয়তানী শক্তির অধিকৃত ভূমিতে শয়তানের এজেন্টগণ তখন সমাজ-সংসারের প্রতি মোড়ে খাড়া হয় জনগণকে জান্নাতের পথ থেকে হটিয়ে জাহান্নামের পথে টানতে। কেউবা সেটি করে সেক্যুলার রাজনীতিকের বেশে; কেউবা পথভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী বা ভন্ড আলেমের বেশে। কেউবা করে নর্তকী, গায়ক-গায়িকা, মিডিয়াকর্মী, নাট্যকর্মী, এনজিও কর্মী বা দেহব্যবসায়ীর বেশে। দেশে দেশে ইসলামের শত্রুশক্তির পক্ষ থেকে পরিচালিত সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিং’য়ের এটিই হলো মূল কৌশল। লক্ষ্য, জনগণকে আল্লাহর দ্বীনের শত্রুতে পরিণত করা। কোটি কোটি মানুষ তখন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে, খেলার মাঠে, সিনেমা হলে, টিভির সামনে, নাটক পাড়ায় ও গান-বাজনার আসরে লক্ষ লক্ষ ঘন্টা কাটিয়ে দেয় এক মুহুর্তের জন্য দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ না করেই। বিস্মরণের সে বিশাল সময় জুড়ে তাদের ঘাড়ে আসীন থাকে প্রতিশ্রুত শয়তান। শয়তানের আজ্ঞাবহ দাস রূপে এভাবেই শুরু হয় ইসলাম ও জীবনের মূল মিশন থেকে দ্রুত দূরে সরার পর্ব। রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণকে তারা চিত্রিত করে পশ্চাৎপদতা ও সাম্প্রদায়িকতারূপে।
শয়তানী প্রকল্পের অংশ রূপেই বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯১% ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে একজন মুসলিম ছাত্র বা ছাত্রীকে তার শিক্ষা জীবনের ১৫ বা ১৬টি বছরে বহু বইয়ের বহু হাজার পৃষ্ঠা পড়ানো হলেও পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের অর্থ বুঝার সামর্থ্য সৃষ্টি করা হয় না। অথচ সে সামর্থ্য সৃষ্টিই প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। কোর’আনের জ্ঞানে অজ্ঞ থাকাটি কবিরা গুনাহ। অন্য গুনাহগুলো জন্ম নেয় এই কবিরা গুনাহ থেকে। তাই নামায-রোযা ফরজ করার বহু বছর আগে মহান আল্লাহতায়ালা তাই জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছিলেন। কোর’আনী জ্ঞানে এমন অজ্ঞতা নিয়ে কি মুসলিম রূপে বেড়ে উঠা সম্ভব? মুসলিম শিশু তার ঈমানের পুষ্টি ভাত-মাছ-গোশতো থেকে পায় না; সেটি পায় কোর’আনী জ্ঞান থেকেই। সে কোরআনী জ্ঞানের সে পুষ্টি না পেলে ঈমান মারা পড়তে বাধ্য। ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে অধীনতার বিপদ তাই ভয়াবহ। তাদের অপরাধটি শুধু চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও মানব-হত্যা নয়, কোটি কোটি মানুষের ঈমান হত্যারও। মানব হত্যার চেয়ে এটি কি কম গুরুতর? ঈমান হত্যার সে কাজটি করা হয় সিলেবাস থেকে কোর’আন শিক্ষা তথা ঈমানের পুষ্টিকে বিলুপ্ত করে। ফলে বিপদ এখানে কাফের, ফাসেক ও মুনাফিক রূপে বেড়ে উঠার। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ হয় এবং ধর্ষণে সেঞ্চুরীর উৎসবও হয়। যেমনটি শেখ হাসিনার প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে এক ছাত্রলীগের এক কর্মীর দ্বারা ধর্ষণে সেঞ্চুরীর উৎসব জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছিল। দুর্বৃত্তদের লক্ষ্য কখনোই দুর্বৃত্তদের নির্মূল নয়। ফলে ধর্ষণে সেঞ্চুরী্ করার অপরাধীকে সেদিন শাস্তি দেয়া হয়নি। দুর্বৃত্ত শক্তির হাতে দেশ অধিকৃত হওয়ায় ভয়াবহ বিপদ তো এখানেই। তখন জোয়ার আসে দুর্বৃত্তির; নামিয়ে আনে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত আযাব –যেমন ইহকালে, তেমনি পরকালে।
শয়তানী শক্তির অধিকৃতি থেকে মুক্তির লড়াই হলো প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ। এমন প্রতিটি যুদ্ধই হলো শতভাগ বিশুদ্ধ জিহাদ। প্রকৃত মু’মিনের জীবনে সর্বক্ষণের প্রস্তুতি তো তেমন একটি জিহাদের। জিহাদের সে সার্বক্ষণিক প্রস্তুতির কথাটি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে এভাবে, “তাদের (ইসলামের শত্রুশক্তির) মোকাবেলায় প্রস্তুত রাখো তোমাদের যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী; এভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুদের; এবং (সন্ত্রস্ত রাখো) অন্যদেরও যাদেরকে তোমরা জান না, অথচ আল্লাহ তাদেরকে জানেন।” –(সুরা আনফাল, আয়াত ৬০)। জিহাদের এরূপ সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি নিয়ে বাঁচাই মু’মিনের বাঁচা। যাদের জীবনে রয়েছে জিহাদের এমন সদা প্রস্তুতি, তাদের সাহায্যে সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকেন মহান আল্লাহতায়ালার বিশাল ফেরশতা বাহিনীও। তাদের সাহায্যে ক্ষুদ্র পাথর টুকরোও মিজাইলে পরিণত হয় –যা বিশাল হাতিকেও গুড়িয়ে দেয়। সাগরও পথ করে দেয়। তখন পুরস্কার রূপে আসে প্রতিশ্রুত বিজয়। অপরদিকে এরূপ প্রস্তুতি না থাকার বিপদটি ভয়াবহ। তাতে ধরা পড়ে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তথা কুফরি। এমন বিদ্রোহ তখন অনিবার্য করে প্রতিশ্রুত আযাব। সে আযাবের আলামত হলো শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃতি, নির্যাতন ও সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে পথভ্রষ্টতা। সে পথভ্রষ্টতা পৌঁছিয়ে দেয় জাহান্নামের আগুনে। বাংলাদেশের মুসলিমদের ব্যর্থতাটি এক্ষেত্রে বিশাল। মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয় নিয়ে তাদের ভাবনা নাই, প্রস্তুতিও নেই। তাদের প্রস্তুতি ও কোরবানী তো ইসলামের শত্রুদের বিজয়ে। এরাই ১৯৭১’য়ে অস্ত্র ধরেছিল ভারতীয় কাফেরদের বিজয়ী করতে। তারা ভোট দেয়, অর্থ দেয় ও শ্রম দেয় সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট ও ন্যাশনালিস্টদের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের বিজয়ী করতে।
যে বিপদ ইসলামী রাষ্ট্র না গড়ার
ইসলাম নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা মক্কার কাফেরগণ মুসলিমদের দেয়নি। নমরুদ, ফিরাউনও দেয়নি। এরূপ পরাধীনতা থেকে বাঁচতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত মূসা (আঃ)কে যেমন নিজ জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছে, তেমনি হিজরত করতে হয়েছে মহান নবীজী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদেরকে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে মুসলিমদের সে স্বাধীনতা দেয়নি দখলদার কাফের শাসকগণও। কাফের শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর বিপদটি হলো, পরিপূর্ণ ইসলাম ও জিহাদ নিয়ে বেড়ে না উঠার বিপদ। রাষ্টীয় শিক্ষা, প্রচার ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি তখন মনের ভূবন থেকে ঈমান নির্মূলের হাতিয়ারে পরিণত হয়। তাদের হাতে অর্থনৈতীক শোষণ ও জেল-জুলুমের বিপদটি সাময়িক, কিন্তু ইসলাম ও জিহাদ নিয়ে বেড়ে না উঠার শাস্তিটি চিরন্তন। কোটি কোটি বছরেও সেটি শেষ হওয়ার নয়। অথচ সে বিপদটি নেমে আসে দেশ ইসলামের দেশী বা বিদেশীদের শত্রুদের হাতে অধীকৃত হওয়ায়। সে বিপদ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ, রাষ্ট্রের ইসলামীকরণ। প্রকৃত ঈমানদারগণ তাই ইসলামী রাষ্ট্র গড়ার জিহাদ শুরু করে ঈমান আনার প্রথম দিন থেকেই। এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়ভারটি তারা সমাজের সবচেয়ে আল্লাহভীরু লোকদের হাতে তুলে দেয়। মহান নবীজী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের যুগে তো সেটিই হয়েছিল। সমগ্র মানব জাতির জন্য আজও সেটিই অনুকরণীয় আদর্শ।
মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সামর্থ্য বিশাল। সেটি শুধু আল্লাহর দ্বীনের সৈনিক গড়া ও ইসলামের বিজয় আনার ক্ষেত্রেই নয়, জাহিলিয়াতের প্রতিষ্ঠা দেয়ার ক্ষেত্রেও। শয়তানী শক্তির হাতে এ শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটির অধিকৃত হওয়ার বিপদ এজন্যই ভয়াবহ। ইসলামে সবচেয়ে বড় নেক কর্ম তাই রাষ্ট্রকে শত্রুশক্তির হাত থেকে বাঁচানো। ইসলাম বিরোধী শক্তির হাতে রাষ্ট্র অধীকৃত হলে তখন সে রাষ্ট্র জাহান্নাম-মুখি ট্রেনের কাজ করে। অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্র ট্রেনে পরিণত হয় জনগণকে জান্নাতে নেয়ায়। ইসলামী রাষ্ট্র সে কাজটি করে ইসলামি শিক্ষা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূল, শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, তাকওয়া-সম্পন্ন মানুষের প্রশাসন ও অর্থনৈতীক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাছাড়া মহাকল্যাণটি করে, জাহান্নামে নেয়ার শয়তানী পথ ও পাথেয়গুলি বিলুপ্ত করে। তাই ইসলামে শ্রেষ্ঠতম জিহাদ শুধু ইসলামী রাষ্ট্র গড়া নয়, বরং শত্রুশক্তির হামলা থেকে সে রাষ্ট্রকে প্রতিমুহুর্তে প্রতিরক্ষা দেয়া। নবীজী (সাঃ)র হাদীসঃ “ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তে দাড়িয়ে এক মুহুর্তের পাহারাদারি সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ট।” ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দেয়ার প্রতি এরূপ গুরুত্ব থেকেই বুঝা যায়, সেরূপ একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব কত অধীক। তাই অতীতে মুসলিমদের জান ও মালের সবচেয়ে বড় খরচটি হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও প্রতিরক্ষায়; মসজিদ বা মাদ্রাসা গড়ায় বা দাওয়াতী কাজে নয়। নবীজী (সাঃ)র ২৩ বছরের নবুয়তী জীবনে তিনি একখানী মাদ্রাসাও গড়েননি। মহল্লায় মহল্লায় মসজিদও গড়েননি। বরং সে সময় মুসলিম উম্মাহর সমুদয় সামর্থ্য ব্যয় হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায়। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে সমগ্র দেশ তখন আল্লাহর দ্বীনের মাদ্রাসায় পরিণত হয়। তখন প্রতিটি গৃহ, প্রতিটি মসজিদ, প্রতিটি শ্রেণীকক্ষ ও প্রতিটি অফিস-আদালত পরিণত হয় কোরআনী জ্ঞানের পাঠশালায়। এবং বন্ধ হয় জাহান্নামে নেয়ার সমুদয় পথ। মুসলিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তিগণ গড়ে উঠেছেন তো সে পাঠশালা থেকেই। অপর দিকে ইসলামী রাষ্ট্র না গড়ার ভয়ানক বিপদটি হলো, তখন প্রতিটি নগর-বন্দর, গ্রামগঞ্জ ও জনপদ থেকে শুরু হয় জাহান্নামের পথে মিছিল।
আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতা অনেক। তবে মূল ব্যর্থতাটি ইবাদতের প্রায়োরিটি চিনতে না পারায়। ফলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ন্যায় ফরজ জিহাদের বদলে গুরুত্ব পেয়েছ নফল নামায। নফল ইবাদত না করলে গুনাহ হয় না; আযাবও আসে না। কিন্তু ফরজ বাদ দেয়াটি কবিরা গুনাহ; তখন অনিবার্য হয় আযাবপ্রাপ্তি। সেটি যেমন দুনিয়ায়, তেমনি আখেরাতে। এক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমদের ব্যর্থতাটি চোখে পড়ার মত। মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ভারতের সাধারণ মুসলিমগণ বুঝলেও অধিকাংশ আলেম বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী বিরোধীতা হয়েছে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ন্যায় উলামাদের সংগঠন থেকে। অথচ পাকিস্তানের ব্যর্থতা আজ যতই হোক, ভবিষ্যতে দেশটির ইসলামী রাষ্ট্র রূপে বেড়ে উঠার সম্ভাবনা তো বিশাল। কিন্তু শতকরা ৮০ ভাগ হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে কি সে সম্ভাবনা হাজার বছরেও সৃষ্টি হবে? তাছাড়া পাকিস্তান তখন প্রতিষ্ঠা পেল তখন সে নতুন রাষ্ট্রের ইসলামীকরণে তারা তেমন ভূমিকাও রাখেনি। রাজনীতিকে নোংরা মানুষে কাজ বলে তা থেকে দূরে থেকেছে। রাজনীতির ময়দান তখন দখলে গেছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। অথচ নবীজী (সাঃ) শুধু রাসূলই ছিলেন না তিন শাসক ছিলনে এবং সেনাবাহিনীর প্রধানও ছিলেন। কিন্তু নবীজী (সাঃ)র সে গুরুত্বপূর্ণ সূন্নত থেকে তারা কোন শিক্ষাই নেয়নি। তাদের বড় অপরাধ, ইসলামকে স্রেফ নামায-রোযা, হজ-যাকাত, মসজিদ-মাদ্রাসা ও ওয়াজ-মহফিলের মধ্যে তারা সীমিত রেখেছেন। তারা পুরাপুরি ব্যর্থ হয়েছেন ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব বুঝতে। ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার ভিশন ও মিশনকে বুঝতে। নবী-রাসূলদের পরই শহীদদের মর্যাদা। সাহাবায়ে কেরামদের শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সে স্তরে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু এ যুগের আলেমদের শতকরা এক ভাগ দূরে থাক হাজারে একজনও সে স্তরে পৌছতে পারেনি। সাহাবায়ে কেরাম ও প্রাথমিক যুগের আলেমদের থেকে এ যুগের আলেমদের এখানেই মূল পার্থক্য।
ভারতীয় আলেমগণ বড় বড় মাদ্রাসা গড়লেও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন কাফের শাসিত দেশে বসবাসের ক্ষতিকর বিষয়টি। সংখ্যাগরিষ্ঠ কাফেরের দেশে বসবাসের কবিরা গুনাহ বা ভয়ানক অপরাধটি হয় মুসলিম হত্যায় ও মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বোমারু বিমান, গোলাবারুদ, ট্যাংক, মিজাইল ও গুলির খরচ জোগানার মধ্য দিয়ে। যেমন কাশ্মীরে মুসলিম গণহত্যা, নির্যাতন ও কাশ্মীরী মহিলাদের ধর্ষণে খরচ জুগিয়ে যাচ্ছে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম। সেটি শত শত কোটি টাকা রাজস্ব জুগিয়ে। তেমনি ১৯৭১ সালে তারা খরচ জুগিয়েছে বিশ্বের সর্ব মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু লক্ষ মুসলিম একই ভাবে খরচ জুগিয়ে চলেছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ নানা দেশে মুসলিম গণহত্যায় এবং সে দেশগুলির নগর-বন্দর ও ঘর-বাড়ী ধ্বংসের কাজে। তাই কাফের দেশে বসবাস করে কারো পক্ষে নির্দোষ বা নিরাপরাধ থাকাটাই অসম্ভব। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কারণে ভারতীয় হিন্দুদের ইসলামবিনাশী প্রজেক্টে অংশ নেয়ার কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ –এ উভয় দেশের প্রায় ৪০ কোটি মুসলিম। এরূপ ভয়ানক অপরাধ ও গুনাহ থেকে বাঁচাতেই ইসলামে যেমন রয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হুকুম, তেমনি রয়েছে কাফের রাষ্ট্র থেকে হিযরতের নির্দেশ। এবং হারাম হলো স্রেফ উপার্জন বাড়াতে মুসলিম দেশ ছেড়ে কাফর শাসিত দেশে ঘর বাঁধা। এজন্যই নবীজী (সাঃ)র যুগে হারাম ছিল মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র ছেড়ে কাফের শাসিত মক্কায় গিয়ে বসবাস করা।
ইসলামে মানব হত্যার চেয়েও অতি গুরুতর অপরাধ হলো ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনে বিদ্রোহ বা ফিতনা সৃষ্টি। মহান আল্লাহতায়ালার সেটি ব্যক্ত করেছেন এ ভাষায়ঃ “ফিতনাতু আশাদ্দু মিনাল কাতল”। অর্থঃ মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ হলো ফিতনা সৃষ্টি। ইসলামে রাষ্ট্রে কিছু লোকের প্রাননাশ হলেও তাতে রাষ্ট্রের জান্নাতমুখি ট্রেনটি বিলুপ্ত হয় না। কিন্তু সেটি ধ্বংস হয় জনগণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হলে। ফিতনা বা বিদ্রোহের শাস্তি তাই প্রাণদণ্ড। বিষয়টি ইসলামের এতই মৌলিক বিষয় যে প্রসিদ্ধ ফিকাহর কিতাবগুলিতে এ নিয়ে কোন বিরোধ নেই। এ জন্যই কাফের বা বেঈমান ব্যক্তিকে কামার, কুমার, কৃষক, শ্রমিক বা রাস্তার ঝাড়ুদার বানানো যায়, কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, বিচারপতি, সেনাপতি, আইন প্রণেতা বা প্রশাসক করা যায় না। তাতে মারা পড়ে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার মূল এজেন্ডা। ইসলামে তাই এটি হারাম। সে হারাম রুখতেই মু’মিনের জীবনে আজীবনের যুদ্ধ। গাড়ীর সকল যাত্রী মাতাল হলেও সে গাড়ী সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যদি চালক সুস্থ্য হয়। অথচ মাতাল চালকের হাতে গাড়ি ছিনতাই হলে যাত্রীদের কোর’আন পাঠ ও দোয়া-দরুদে লাভ হয় নয়। বিষয়টি অবিকল সত্য রাষ্ট্রের বেলায়। তাই রাষ্ট্রের শাসক রূপে বসা ও সর্বস্তর থেকে দুর্বৃত্তদের হটানোর কাজটি মহান নবীজী (সাঃ)র সূন্নত। মু’মিনের জীবনের এটি গুরুত্বপূর্ণ মিশন। তাই ঈমানদারকে শুধু নামায-রোযা হজ-যাকাত পালন করলে চলে না, এবং স্রেফ মসজিদের ইমাম নির্বাচনে যত্নবান হলেই চলে না। রাষ্ট্রপ্রধানের আসনেও নবীজী (সাঃ)র আদর্শের শ্রেষ্ঠ অনুসারিকে বসাতে উদ্যোগী হতে হয়। প্রশ্ন হলো, যে পবিত্র আসনে মহান নবীজী (সাঃ) বসেছেন সে আসনে কি কোন কাফের, মুনাফিক ও ইসলামে অঙ্গীহারহীন সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট বা জাতীয়তাবাদীকে বসানো যায়? সেটি তো হারাম। সেটি ইসলামের সাথে গাদ্দারি। মুসলিমদের আজকের বিশাল ব্যর্থতাটি তো এ গুরুতর বিষয়টি না বুঝাতে। ফলে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে সে হারাম কর্মও জনগণের সমর্থন ও বৈধতা পায়। অতি দুর্বৃত্ত স্বৈরাচারীগণও তখন বিজয়ী হয় জনগণের ভোটে। এমন গুরুতর দায়িত্বহীনতার কারণে মুসলিম দেশগুলিতে শুধু পতিতাবৃত্তি, সূদী ব্যাংক, মদের দোকান, নাচগানের অশ্লিলতাই বৈধতা পায়নি, রাষ্ট্রের বৈধ শাসক রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুগণও। মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের নায়ক হলো ইসলামে অঙ্গিকারশূণ্য এসব সেক্যুলার শাসকগণ। অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলি আজ এদের হাতেই অধিকৃত। ফলে মুসলিমদের ব্যক্তি জীবনে ও রাষ্ট্রের বুকে মহান আল্লাহতায়ালা যে ধরনের ইসলামের প্রতিষ্ঠা চান তা কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুসলিমদের নানা ব্যর্থতার মাঝে এটিই হলো সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
অব্যাহত পরাধীনতা
রাষ্ট্রকে ইসলামী করার লাগাতর জিহাদ না থাকলে সে রাষ্ট্র ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে অধিকৃত হতে বাধ্য। আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতা এক্ষেত্রে শতভাগ। ফলে মুসলিম বিশ্ব থেকে ঔপনিবেশিক কাফের শাসন শেষ হলেও কোথাও প্রতিষ্ঠা পায়নি ইসলামী রাষ্ট্র। এমন ব্যর্থতা ভয়ানক আযাব নিয়ে হাজির হবে -সেটিই তো স্বাভাবিক। সে আযাবটি মূলতঃ কাফের, ফাসেক ও মুনাফিকদের গড়া গোলামীর শিকল গলায় নিয়ে আমৃত্যু বসবাসের। এরূপ অধিকৃতির কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশেও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায় সাহায্য জোগাতে কোনরূপ রাষ্টীয় অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রশাসনের অঙ্গন জুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কাফেরদের গড়া অবকাঠামো –যার মূল কাজ জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো ও মুসলিমদের শক্তিহীন রাখা। এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য দুর্বৃত্ত সেক্যুলারিস্টদের শাসন। ফলে বিদেশী কাফেরগণ বিতাড়িত হলেও তাদের বিশ্বস্থ্য খলিফাদের হাতে শুরু হয়েছে নতুন পরাধীনতা। সে অব্যাহত পরাধীনতার কারণেই ব্যর্থ হচ্ছে প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার চেষ্টা। ফলে মুসলিমগণ বেড়ে উঠেছে ইসলাম ছাড়াই।
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি মসজিদ-মাদ্রসার নির্মাণ বা কৃষি ও শিল্প খাতে নয়; সেটি ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণে। সে ব্যর্থতাটির নাশকতা বিশাল। রাষ্ট্রের বিকল্প রাষ্ট্রই; মসজিদ-মাদ্রাসা নয়। তাই লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে বা তাবলিগ জামাতের বিশাল বিশাল এজতেমা করে কি সে ব্যর্থতা দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। যে দায়ভারটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের, সে কাজ কি নামাযী-রোয্দার ও মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়িয়ে সম্ভব? তাই শুধু ব্যক্তির ইসলামীকরণ হলে চলে না, ইসলামীকরণ করতে হয় রাষ্ট্রকেও। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সে সত্য বিষয়টি সাহাবা কেরাম শতভাগ বুঝেছিলেন; এবং তাঁরা সেটি বুঝেছিলেন মহান নবীজী (সাঃ) থেকে। ফলে নিজেদের জান-মাল ও সর্বপ্রকার সামর্থ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে শয়তানী শক্তির দখলদারি থেকে বাঁচিয়েছিলেন। ফলে তাদের হাতে এসেছে ইসলামের লাগাতর বিজয় ও প্রতিষ্ঠা এবং জুটেছে বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার গৌরব। তাদের হাতে নির্মিত হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। আজকের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো ইসলামের সে কোরআনী রূপটি না বুঝার। নিরেট সে অজ্ঞতার কারণেই মুসলিম মনে বিশ্বাস জমেছে, মুসলিমের জীবনে জিহাদ অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় হলো জান-মালের কোরবানী -এমন কি যদি সেটি খেলাফত ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বা কাফের বাহিনীর অধিকৃতি নির্মূলের জন্যও হয়! এমন অজ্ঞতার কারণেই তারা কাফেরদের সাথে গলা মিলিয়ে জিহাদকে সন্ত্রাস বলছে। বলছে, ইসলামের নামে এটি বাড়াবাড়ি। জিহাদ বিরোধী সে কথাগুলো তারা আরো বেশী বেশী বলে মার্কিন যুক্তরাষ্টের নেতৃত্বাধীন ইসলাম বিরোধী জোটের কাছে মডারেট মুসলিম রূপে গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থে। তাদের মনে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবনা নাই। বরং বহু ইসলামী দলের নেতাকর্মী তো এ বেদনায় কাতর, তাদেরকে কেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনে নেয়া হচ্ছে না। তাদের দৃষ্টিতে ইসলামের বিজয়ের পথটি হলো স্রেফ দোয়া-দরুদ, বেশী বেশী কোর’আন পাঠ, নামায-রোযা, মসজিদ নির্মাণ, ইসলামী দলগুলোর কর্মীবৃদ্ধি ও তাবলিগ জামায়াতের এজতেমায় হাজিরা-বৃদ্ধিতে। তাদের দলীয় গঠণতন্ত্রে বা সিলেবাসে কোথাও খেলাফত, শরিয়ত, হুদুদ ও জিহাদের উল্লেখ নাই। সেগুলো তারা মুখেও আনে না। মহান নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামে জীবনে যা ছিল অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা বাদ পড়েছে আজকের মুসলিমদের ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি ও আইন-আদালত থেকে। এরপরও তাদের দাবী, তারা মহান নবীজী (সাঃ)র অনুসারি!
বেঈমানের স্বাধীনতার নাশকতা
পৃথিবী পৃষ্টে সবচেয়ে ভয়াবহ নাশকতাটি ভূমিকম্প, সুনামী বা মহামারিতে ঘটে না, সেটি হয় দুষ্ট বেঈমানদের স্বাধীনতায়। বেঈমানদের স্বাধীনতার অর্থ দুর্বৃত্তিতে তাদের স্বাধীনতা। দেশ তখন যুদ্ধ-বিগ্রহ, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও নানারূপ অপরাধ কর্মে ভরে যায়। বিগত দু’টি বিশ্বযুদ্ধে তারা সে স্বাধীনতার প্রয়োগ করেছে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে হত্যা করে। এখন সে স্বাধীনতার প্রয়োগ করছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ায় ইচ্ছামত বিমান হামলা, ড্রোন হামলা করে। এরূপ স্বাধীনতা পাওয়াতে বাংলাদেশকে এরা দুর্বৃত্তিতে বিশ্বমাঝে ৫ বার প্রথম স্থানে পৌছে দিয়েছে। তাদের হাতে ঈমানদারদের প্রাণে বাঁচার স্বাধীনতাই শুধু ভূ-লুন্ঠিত হয় না, বরং ভয়ানক বিপদে পড়ে জান্নাত পাওয়ার বিষয়টিও। কারণ সিরাতুল মোস্তাকীমে চলার পথে তারা বাঁধা সৃষ্টি করে। অসম্ভব করে শরিয়তের পালন নিয়ে বাঁচতে। মক্কার কাফেরগণ মারা গেলেও তাদের এজেন্ডা মারা পড়েনি। সে অভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে আজও প্রবল ভাবে বেঁচে আছে শয়তানের আধুনিক অনুসারিগণ। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে মুসলিম নামধারী আধুনিক মুনাফিকগণ। প্রতিযুগে ইসলাম ও মুসলিমদের স্বাধীনতার মূল শত্রু এরাই।
মুসলিমের জীবনে ধর্মীয় স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ নামাজ-রোযা, হজ-যাকাত ও দোয়া-দরুদ নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা নয়, বরং সেটি পরিপূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা। ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, খেলাফাহ, হুদুদ ও জিহাদের প্রতিষ্ঠা ছাড়া পূর্ণ ইসলাম পালন কি সম্ভব? নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে ইসলাম বলতে যা বুঝাতো তাতে ছিল এর সবকিছুই। মহান অআল্লাহতায়ালার হুকুম, “উদখুলু ফিস সিলমে কা’ফ্ফা” অর্থঃ “পরিপূর্ণ রূপে প্রবেশ করো ইসলামের মাঝে।” সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে মুসলিমদের জান, মাল, সময় ও সামর্থ্যের সবচেয়ে বেশী খরচ হয়েছে সে পরিপূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচার লড়াইয়ে। শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী সে সব লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন। প্রকৃত মুসলিম রূপে বাঁচার অর্থ যে ইসলামের মৌল বিষয়গুলো নিয়ে বাঁচা -সেটি বুঝতে ইসলামের শত্রুপক্ষ কখনোই ভূল করেনা। তাই নবীজী (সাঃ)র ইসলাম নিয়ে যারা বাঁচতে চায় তাদেরকে তারা মৌলবাদী বলে। তারা চায়, মুসলিমগণ বাঁচুক ইসলামের মৌল বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলাম নিয়ে। লক্ষ্যণীয় হলো, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলামে নেই খেলাফত, শরিয়ত, হুদুদ, জিহাদ ও একতাবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর ন্যায় মৌলিক বিষয়ের স্বীকৃতি। এরূপ এক অপূর্ণাঙ্গ ও বিকৃত ইসলামকে তারা বলছে মডারেট ইসলাম। ইসলামের এ শত্রুগণ যখনই কোন মুসলিম দেশ দখলে নেয় সে দেশে তারা অসম্ভব করে ইসলামের মৌল বিষয়গুলো পালন। ব্রিটিশগণ যখন ভারত দখলে নিয়েছিল তখন তারা সেদেশের আদালত থেকে শরিয়তী বিধানকে বিলুপ্ত করেছিল। আফগানিস্তান দখলে নেয়ার সাথে সাথে একই কাজ করেছিল মার্কিনীগণ।
স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ একটি মানচিত্র বা পতাকা পাওয়া নয়, বরং সেটি শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসনসহ জীবনের সর্বস্তরে পরিপূর্ণ ইসলামের অনুসরণ নিয়ে বাঁচা ও বেড়ে উঠার স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা না থাকাটাই মানব জীবনে সবচেয়ে বড় পরাধীনতা। সেটিই জীবনের সবচেয়ে বড় নিঃস্বতা। ভাতে-মাছে সে নিঃস্বতা দূর হয় না। ১৯৭১’য়ে সে স্বাধীনতা মেলেনি। বরং মিলেছে দুঃসহ পরাধীনতা। বাংলাদেশের জনগণের উপর সে পরাধীনতা চাপিয়ে দিয়েছে ভারতীয় কাফের শক্তি। তখন পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিল ভারতের আশ্রয়ে প্রতিপালিত ভারতসেবী ইসলামের শত্রুপক্ষ। ভারতীয় সাহায্যে স্বৈরাচারী শেখ মুজিব তখন নেমেছিল বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের এজেন্ডা প্রতিপালনে; সেটি ছিল ইসলাম ও ইসলামের পক্ষের শক্তির নির্মূলে। শেখ মুজিব হাজার হাজার ইসলামপন্থিকে নিহত, আহত ও কারাবন্দী করেছিলেন, অথচ মূক্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন কাফের, মুনাফিক, সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট, কম্যুনিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট তথা ইসলামবিরোধী শিবিরের সহিংস নেতাকর্মী ও ক্যাডারদের। মুজিবের কাছে ইসলাম ও মুসলিম -এ দুটি শব্দ সহ্য হয়নি। তাই পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গির নগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে যায় জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হয়ে যায় সলিমুল্লাহ হল, নজরুল ইসলাম কলেজ হয়ে পড়ে নজরুল কলেজ। সহ্য হয়নি পবিত্র কোর’আনের আয়াতও। শেখ মুজিব তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে পবিত্র কোরআনের আয়াত “ইকরা বিসমে রাব্বিকা” বিলুপ্ত করেছেন। একই পথ ধরেছেন মুজিব-কণ্যা শেখ হাসিনা। তার কাছে সহ্য হয়নি শাসনতন্ত্রে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার উপর আস্থার বিষয়টি। ভারতীয় কাফেরদের উপর আস্থা নিয়ে যাদের উঠাবসা, বেড়েউঠা ও রাজনীতি, তাদের মনে কি মহান আল্লাহতায়ালার উপর ঈমান বা আস্থা গড়ে উঠতে পারে। এমন ব্যক্তি তো পূজা মন্ডপে গিয়ে বলবেন, “এবার আমাদের দেবী গজে চড়ে এসেছেন, তাই ফসল এবার ভালো হয়েছে”। (২০১১ সনের ৫ই অক্টোবর রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনে দুর্গা পূজা উপলক্ষে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে শেখ হাসিনা এ কথা বলেছিনেন। সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ, ৬ই অক্টোবর, ২০১১)। কথা হলো, এটি কি ঈমানদারের লক্ষণ। একাত্তরে একমাত্র এরাই স্বাধীনতা পেয়েছে, দেশের ঈমানদার জনগণ নয়। এরূপ ঈমানশূণ্যতার কারণেই নিরস্ত্র মুসল্লীদের হত্যায় শাপলা চত্বরে সশস্ত্র সেনাবাহিনী ও ট্যাংক নামাতে শেখ হাসিনার মনে সামান্যতম দ্বিধা হয়নি। অগণিত মুসল্লী হত্যার পর লাশগুলোকে তিনি ময়লার গাড়ীতে তুলে গায়েব করার ব্যবস্থা করেছেন। স্বাধীনতা এভাবেই ইসলামপন্থিদের হত্যা ও দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। তখন ভূলুন্ঠিত হয় জনগণের প্রাণে বাঁচার অধীকার।
অপরাধের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো
শত্রুশক্তির হাতে অধীকৃত হওয়ার যন্ত্রনাটি বহুমুখি। নিজেদের স্বাধীনতার অবাধ প্রয়োগে তারা গড়ে তোলে বিশাল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো। সে প্রকল্পের অংশ রূপেই রাষ্ট্রের মন্ত্রীপরিষদ, পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষাব্যবস্থা, আদালত ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভয়ানক অপরাধীতে পরিণত করা হয়। তাদের এরূপ সোসাল ইঞ্জিনীয়ারিং’য়ের মূল লক্ষ্য, মুসলিম ভূমি থেকে ইসলামের মৌল বিশ্বাসগুলি নির্মূল। এবং যারা খেলাফত, শরিয়ত, হুদুদ ও জিহাদের ন্যায় বিধানগুলির প্রতিষ্ঠা চায় তাদের হত্যা। ঢাকার শাপলা চত্বরের ন্যায় নিষ্ঠুর গণহত্যাও তখন মামূলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। নিরপরাধ মানুষ তখন অহরহ লাশে পরিণত হয় ক্রসফায়্যারে ও ফাঁসীর মঞ্চে। জনগণের গলায় শিকল পড়ানোর লক্ষ্যে শত্রুপক্ষ স্রেফ প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীকেই কাজে লাগায় না, বরং সেটি সহনীয় ও আইনসিদ্ধ করে পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা, অপসংস্কৃতি ও আইন-আদালতের মাধ্যমে। ছাত্রদের ইসলামের মৌল শিক্ষা থেকে দূরে সরানোর লক্ষ্যে লেখা হয় নতুন নতুন বই, পরিবর্তন আনা হয় সিলেবাসে। ইসলামবৈরী এমন এক পরিচর্যার কারণে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীগণও তখন ইসলামপন্থীদের ফাঁসীর দাবী নিয়ে রাজপথে নামে। সন্ত্রাসের মনোপলি সরকার নিজ হাতে নিয়ে নেয়। তখন নিরস্ত্র জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে রাস্তায় ট্যাংক ও কামান নামানো হয়। ত্রাস সৃষ্টির এরূপ প্রতিটি উদ্যোগই তো সন্ত্রাস। অথচ জনগণের ঘরে দা, কুড়াল এবং ছুরিও সন্ত্রাসের হাতিয়ার রূপে প্রচার পায়। একই রূপ নীতি ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটেশের। এবং সে নীতির কারণে তাদের শাসন ১৯০ বছর যাবত স্থায়ীত্ব পেয়েছিল। তারা বিলুপ্ত করেছিল শরিয়ত ও হুদুদের ন্যায় ইসলামের বহু মৌল বিষয় -যা ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এবং আইনসিদ্ধ করেছিল সূদী ব্যাংক, মদ্যপান, জুয়া, পতিতাবৃত্তি, অশ্লিলতা এবং নিজেদের প্রণীত কুফরী আইন। বাংলাদেশে আজও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বিশুদ্ধ জিহাদ
বেঈমানদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ রাজনৈতীক স্বেচ্ছাচার নয়, বরং সে অধীকারটি মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও। সে গুরুতর যুদ্ধাপরাধ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। তাই পবিত্র কোর’আনে তারা চিত্রিত হয়েছে স্রেফ ঈমানদারদের শত্রু রূপে নয়, বরং মহান আল্লাহতায়ালার শত্রু রূপে। পবিত্র কোরআনে এমন বিদ্রোহীদের মডেল হলো ফিরাউন ও নমরুদ। যুগে যুগে এরাই জনগণের উপর পরাধীনতা চাপিয়ে দিয়েছে এবং অসম্ভব করেছে সত্যের পথে চলা। ইতিহাসে এরাই সন্ত্রাসের আদি নেতা। তাদের হাতে প্রতিষ্ঠা পায়, শয়তানী আইন এবং শুরু হয় সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে দূরে সরা। এরূপ দূরে সরার কারণেই বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে ইসলাম যে পরিচিতি নিয়ে বেঁচে আছে তার সাথে নবীজী (সাঃ)র ইসলামের দূরত্বটি বিশাল। এ ইসলামে শরিয়ত, হুদুদ, খেলাফত ও জিহাদের কোন ধারণা নেই।
ইসলাম থেকে এরূপ দূরত্ব বাড়িয়েছে ইসলামের দেশী শত্রুগণ। তাদের কারণে ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হলেও পরাধীনতা শেষ হয়নি। পরাধীনতার সে শিকলটি হলো ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে প্রণীত কুফরি আইনের অধীনতা। এ আইনে ব্যাভিচার, দেহব্যবসা, মদের ব্যবসা, মদ্যপান, জুয়া ও সূদের ন্যায় পাপকর্ম বৈধ হলেও বৈধ নয় শরিয়ত প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাস্তায় নামা। সন্ত্রাসে অভিযোগ এনে তখন হত্যা করা হয়। প্রকৃত মুসলিমের জীবনে প্রকৃত লড়াইটি তো এরূপ পরাধীনতা থেকে মূক্তির লড়াই। ভাষা, বর্ণ, শ্রেণী, গোত্র বা আঞ্চলিকতার নামে যুদ্ধে স্রেফ শিকলের বদল ঘটে, কিন্তু পরাধীনতা থেকে মুক্তি মেলে না। স্বাধীনতা তখন পালাক্রমে লুন্ঠিত হয় নানা দলের ও নানা মতের সুযোগ-সন্ধানী দুর্বৃত্তদের হাতে। এরূপ পরাধীনতা থেকে মুক্তি স্রেফ নামায-রোযা, হজ-যাকাত বা দোয়া-দরুদেও আসে না। সে বিপদ থেকে বাঁচাতেই ফরজ করা হয়েছে জিহাদকে। শয়তানী শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তির এ লড়াইটি যে শতভাগ বিশুদ্ধ জিহাদ –তা নিয়ে কি তাই সামান্যতম সন্দেহ চলে? কোন ব্যক্তির জীবনে ঈমান থাকবে অথচ মহান আল্লাহতায়ালার পথে এরূপ জিহাদ থাকবে না সেটিই বা কীরূপে ভাবা যায়? ১৪/০৮/২০১৬
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018