ঈমানবিনাশী জাতীয় সঙ্গিত ও দেশধ্বংসী প্রকল্প
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 25, 2021
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
যে পাপ কথা ও গানে
সমাজে বড় বড় অপরাধগুলি শুধু খুন, ব্যভিচার বা চুরিডাকাতি নয়। মানুষ কাফের হয় এবং জাহান্নামের যোগ্য হয় -মুখের কথায় ও গানে। মহান আল্লাহতায়ালাকে যে ব্যক্তি অবিশ্বাস করে বা তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দেয় – জাহান্নামে পৌঁছতে তাকে কি খুন, ধর্ষণ বা চুরি-ডাকাতিতে নামার প্রয়োজন পড়ে? বিদ্রোহের ঘোষণাটি মুখে একবার দেয়াই সে জন্য যথেষ্ঠ। অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হতে ইবলিসকে তাই খুন বা ব্যভিচারে নামতে হয়নি। মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া একটি মাত্র হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই তাকে লানতপ্রাপ্ত শয়তানে পরিণত করেছে। সে হুকুমটি ছিল হযরত আদম (আ:)কে সেজদার। তাই বক্তৃতায় কি বলা হয়, সঙ্গিতে কি গাওয়া হয় বা সাহিত্যের নামে কি লেখা হয় –সেগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা রেকর্ড হয় এবং তা নিয়ে বিচার বসবে রোজ হাশরের বিচার দিনে। মু’মিন ব্যক্তিকে তাই শুধু উপার্জন বা খাদ্য-পানীয়’র ক্ষেত্রে হারাম-হালাম দেখলে চলে না। কথাবার্তা বা লেখালেখির ক্ষেত্রেও অতি সতর্ক হতে হয়।
নবীজী(সা:)’র হাদীস: “অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে জিহ্বা ও যৌনাঙ্গের দ্বারা কৃত অপরাধের কারণে।” তেমনি বহু মানুষ জান্নাতেও যাবে সত্য দ্বীনের পক্ষে জিহ্বাকে কাজে লাগানো তথা সাক্ষি দেয়ার কারণে। ফিরাউনের দরবারে যে কয়েকজন যাদুকর হযরত মূসা (আ:)’র সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে মুসলিম হয়েছিলেন -তারা জীবনে এক দিনও নামায বা রোযা পালন করেননি। “মুসা (আ:) ও হারুনে (আ:)’র রবের উপর ঈমান আনলাম” –তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত এই একটি মাত্র বাক্যই তাদেরকে সরাসরি জান্নাতবাসী করেছে। ঈমানের প্রবল প্রকাশ ঘটেছিল তাদের সে উচ্চারণে। ঈমানের সে প্রকাশ ফিরাউনের কাছে সহ্য হয়নি -তাই তাদের হাত-পা কেটে নির্মম হত্যা করা হয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে সাক্ষদানে তারা এতই অটল ছিলেন যে, সে নির্মম হত্যাকান্ডও তাদের একবিন্দু বিচলিত করতে পারেনি। তাদের এ সাহসী উচ্চারনে মহান আল্লাহতায়ালা এতোটাই খুশি হয়েছিলেন যে, পবিত্র কোর’আনের একাধিক স্থানে তিনি নিজ কালামের পাশে তাদের সে ঘোষণাকেও লিপিবদ্ধ করেছেন। এবং ক্বিয়ামত অবধি মানব জাতির জন্য শিক্ষ্যনীয় করেছেন তাদের ঈমানী প্রত্যয়কে।
ঈমান বন্দুকের গুলি বা মিজাইলে মারা পড়ে না। মারা যায় তখন, যখন গান,সঙ্গিত বা সাহিত্যের নামে চেতনার ভূবনে লাগাতর বিষ ঢালা হয়। শয়তান বিষ পান করানোর সে কাজটাই মহা ধুমধামে করে নানারূপ গীত, গান, স্লোক ও মিথ্যা ধর্মগ্রন্থ পাঠ করানোর মধ্য দিয়ে। সে লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে শয়তানের লক্ষ লক্ষ পুরোহিত, মন্দির ও পূজামন্ডপ এবং হাজারো গান। বাংলার বুকে ইসলামের যখন প্রচন্ড জোয়ার, সে জোয়ার ঠেকাতে শয়তান যে অস্ত্রটি বেছে নিয়েছিল সেটিও কোন আধুনিক মারণাস্ত্র ছিল না। সেটি ছিল ভাববাদী গান। ইসলামের প্রসার রুখতে ভাববাদী গান ও হাতে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তখন মাঠে নেমেছিল চৈতন্য দেব ও তার শিষ্যরা। তার গানের আবেগ এতোটাই প্রবল ছিল যে, বাংলার বুকে হিন্দুদের ইসলাম কবুলের জোয়ার দ্রুত থেমে যায়। ফলে প্রায় অর্ধেক বাঙালী থেকে যায় পৌত্তলিকতা নিয়ে জাহান্নামের পথে। আজও বাংলাদেশের বুকে শয়তানের স্ট্রাটেজীটি অবিকল অভিন্ন। তবে শয়তানের উদ্দেশ্য, হিন্দুদের মুসলিম হওয়া থেকে রুখা নয়। বরং সেটি মুসলিমদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো তথা ডি-ইসলামাইজেশন। সে কাজে শয়তান তার অবতার রূপে বেছে পেয়েছে আধুনিক মুর্তিপুজারী কবি রবীন্দ্রনাথকে।
একাত্তরের আত্মসমর্পণ এবং পৌত্তলিক চেতনা
বাঙালী মুসলিমদের চেতনায় ঈমানবিনাশী বিষ ঢালার কাজ যে পূর্বে হয়নি -তা নয়। সে কাজের শুরু প্রবল হয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের শাসনামলে। সেটি উগ্র পৌত্তলিক সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরম’ গান গাওয়ার মাধ্যমে। বাঙালী হিন্দুগন সে গানকে অবিভক্ত বাংলার সকল স্কুলে জাতীয় সঙ্গিতের মর্যাদা দেয়। কিন্তু বাঙালী মুসলিমগণ পৌত্তলিকদের সে ঈমানবিনাশী ষড়য্ন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ফলে সে প্রকল্প সেদিন ব্যর্থ হয়। বাঙালী মুসলিমদের সেদিনের সাফল্যের কারণ, মুসলিম রাজনীতির নেতৃত্ব মুজিবের ন্যায় ভারতীয় স্বার্থের সেবাদাসদের হাতে বন্দী ছিল না। বাঙালী মুসলিমগণ হিন্দু আধিপত্যের কাছে সেদিন আত্মসমর্পিতও ছিল না। বরং তাদের চেতনার ভূমিতে সেদিন ছিল ইসলামের প্রতি গভীর অঙ্গিকার। তাছাড়া সেদিন তারা বন্ধুহীনও ছিল না। তাদের পাশে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষাভাষি বহু কোটি মুসলিম।
কিন্তু ১৯৭১’য়ে বাংলার রাজনীতির চিত্রই পাল্টে যায়। দেশ অধিকৃত হয় লক্ষাধিক ভারতীয় সৈন্যদের হাতে। এবং বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গণ তখন অধিকৃত হয় ইসলামি চেতনাশূণ্য ও ইসলামচ্যুত জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের হাতে। তখন বাড়ে ভারতের প্রতি আত্মসমর্পণ। ভারতের অর্থে ও স্বার্থে প্রতিপালিত এ সেবাদাসদের অঙ্গিকারটি ভারতের প্রতি এতোই গভীর যে, একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বহু হাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র ভারতের হাতে ডাকাতি হওয়াতেও তাদের মনে সামান্যতম দুঃখ জাগেনি। সে ডাকাতি রোধে তারা কোন চেষ্টাও করেনি। অথচ সে অস্ত্র কেনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীদের অর্থ ছিল। ভারতের সেবাদাসগণ রুখেনি দেশের কলকারাখানার যন্ত্রপাতি লুন্ঠনও। বরং লুন্ঠনকে বাধাবিপত্তিহীন করতে সীমান্ত বাণিজ্যের নামে তারা বিলুপ্ত করে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সীমান্তও। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশ দ্রুত পরিণত হয় তলাহীন ভিক্ষার পাত্রে। ১৯৭৪ য়ে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ; তাতে মৃত্যু হয় বহু লক্ষ মানুষের। আত্মসমর্পণের পর কি আর নিজের ইচ্ছা চলে? তখন তো প্রতি পদে প্রভুর ইচ্ছাই মেনে নিতে হয়। একাত্তরে ভারতের যুদ্ধজয়ের পর তেমনি একটি পরাজিত অবস্থা নেমে আসে বাংলার মুসলিম জীবনে।
দাসদের জীবনে স্বাধীনতা থাকে না। তারা বাঁচে মনিবের পদতলে আমৃত্যু পরাধীনতা নিয়ে। সে পরাধীনতাটি যেমন ভৌগলিক মানচিত্রে, তেমনি চেতনার মানচিত্রে। একাত্তর-পরবর্তী ভারতীয় দখলদারী ও তাদের ডাকাতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ভারতের আশ্রয়ে প্রতিপালীত এহেন বাংলাদেশী দাসদের ছিল না। ফলে ভারত যা চেয়েছে তাই করেছে। স্কুলে কি গাইতে হবে বা পড়তে হবে -সেটিও নির্ধারিত করে দেয় ভারত। শাসতন্ত্রের মূলনীতিগুলিও তারা নির্ধারণ করে দেয়। নিষিদ্ধ করে দেয় ইসলামপন্থীদের রাজনীতি। অথচ ১৯৭০’য়ের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে শেখ মুজিব একটি বারের জন্যও এমন কথা উল্লেখ করেনি। এবং ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে জনগণের রায়ও নেয়নি। পরাধীন ব্রিটিশ আমলে ইসলামের শত্রুগণ “বন্দেমাতরম” গানটি চাপাতে না পারলেও একাত্তরের পর তারা “আমরা সোনার বাংলা”কে চাপিয়েছে। একাত্তরে ইসলামের শত্রুদের এটি হলো বিশাল অর্জন।
প্রশ্ন হলো, ভাব ও ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের “আামার সোনার বাংলা” এবং বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরম” গানের মাঝে পার্থক্য কতটুকু? উভয় গানেই দেশ মাতৃতূল্য, সে সাথে পূজনীয় বলে বন্দনা গাওয়া হয়েছে। ফলে উভয় গানের মূলেই রয়েছে অভিন্ন পৌত্তলিকতা। এমন গান কি কোন মুসলিম গাইতে পারে? যারা ঈমানশূন্য, এ গান নিয়ে তাদের আগ্রহটি গভীর। মুসলিমের ঈমান ধ্বংসে যাদের আগ্রহটি প্রবল, একমাত্র তারাই চাইবে এমন পৌত্তলিক গানকে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিতে। এ গানটি জাতীয় সঙ্গিত রূপে বিবেচিত হওয়ার পিছনে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সেক্যুলার ও হিন্দুয়ানী বিচারবোধ। তাদের সে মানদন্ডে রবীন্দ্রনাথ দেবতুল্য গণ্য হয়েছে। ইসলাম কি বলে -সেটি আদৌ সেদিন বিবেচনায় আনা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেক্যুলার মানদন্ডে যা কিছু হালাল, সেগুলি কি ইসলামি মানদন্ডেও হালাল? জ্বিনা সেক্যুলার মানদন্ডে কোন অপরাধই নয় -যদি সে ব্যাভিচারে সংশ্লিষ্ট নারী ও পুরুষের সম্মতি থাকে। অথচ ইসলামে রয়েছে বিবাহিত ব্যাভিচারীদের প্রস্তরাঘাতে প্রাণনাশের বিধান। আর অবিবাহিতের জন্য রয়েছে লোকসম্মুখে ৮০টি বেত্রাঘাতের শাস্তি। ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালন নয়, বরং সেটি মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধানের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। সেক্যুলারিস্টদের জীবনে সে আত্মসমর্পণ নাই, বরং প্রকাশ পায় বিদ্রোহ। সে বিদ্রোহের চেতনাটিই ধরা পড়েছে জাতীয় সঙ্গিত নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
আল্লাহতায়ালার সিলেবাস ও শয়তানে সিলেবাস
মহান আল্লাহতায়ালা চান, প্রতিটি মুসলিম বেড়ে উঠুক তাঁর প্রতি অটুট ঈমান নিয়ে। ঈমানে বৃদ্ধি ঘটানোর প্রয়োজনেই মহান আল্লাহ-রাব্বুল আলামীনের রয়েছে নিজস্ব সিলেবাস। সেটি পবিত্র কোর’আনের জ্ঞানার্জন। এ জন্যই অর্থ বুঝে কোর’আন তেলাওয়াতকে বাধ্যতামূলক করেছেন। সে ফরজটি যেমন ৫ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি রাকাতে আদায় করতে হয়, তেমনি নামাযের বাইরেও। ঈমান বৃদ্ধিতে কোর’আনী জ্ঞানের গুরুত্ব যে কত অধীক -সেটি বর্ণীত হয়েছে পবিত্র কোর’আনে। বলা হয়েছে “মুসলিম তো একমাত্র তারাই যাদের হৃদয় আল্লাহর নাম স্মরণ হওয়া মাত্রই ভয়ে কেঁপে উঠে এবং যখন তাদের কাছে কোর’আনের আয়াত পড়ে শোনানো হয় তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং আল্লাহর উপর তারা নির্ভরশীল।” -(সুরা আনফাল, আয়াত ২)।
মহান আল্লাহতায়ালার প্রকল্পকে বানচাল করার লক্ষ্যে শয়তানেরও রয়েছে নিজস্ব স্ট্রাটেজী। রয়েছে নিজস্ব সিলেবাস। শয়তান চায়, ঈমানের বিনাশ। চায়, মানব মন থেকে আল্লাহর স্মরণকে ভূলিয়ে দিতে। চায়, কোর’আন থেকে দূরে টানতে। তাই শয়তানপন্থীদের হাতে দেশ অধিকৃত হলে নিষিদ্ধ হয় পবিত্র কোর’আনের জ্ঞানদান। এবং শুরু হয় নাচ, গান, খেলাধুলা ও বহুবিধ উৎসব দিয়ে শয়তানের নিজস্ব সিলেবাস। তখন গুরুত্ব পায় চৈতন্যদেব, বঙ্কীমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের ন্যায় পৌত্তলিকদের রচিত কবিতা, গান ও সাহিত্য। এভাবে শয়তান বাড়ায় মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে লাগাতর অবাধ্যতা। বাংলাদেশে কোর’আন পাঠের বদলে রবীন্দ্র-সঙ্গিত পাঠ এজন্যই বাধ্যতামূলক। সেটি শুধু দেশের স্কুলগুলিতেই নয়, এমনকি ধর্মীয় মাদ্রাসাগুলোতেও। এমন কি জাতীয় সংসদসহ সকল সামরিক ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও।
রবীন্দ্রচেতনার নাশকতা
মানুষ শুধু তার দেহ নিয়ে বাঁচে না। বাঁচতে হয় চেতনা নিয়েও। সে সুস্থ্য চেতনাটির কারণেই মানব শিশু তার মানবিক পরিচয়টি পায়। সে চেতনাটি সাথে নিয়েই মানবের সর্বত্র বিচরণ। সেটি যেমন ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি; তেমনি ধরা পড়ে তার গদ্য, পদ্য, কথা ও গানে। মানুষ বেড়ে উঠে, তার আমলের ওজন বাড়ে এবং মূল্যায়ন হয় -সে চেতনার গুণে। ঈমানদারের জীবনে চেতনার সে বিশেষ রূপটি হলো তার ঈমান ও আক্বীদা। বিচার দিন নামায-রোযা ও হজ-যাকাতের আগে প্রথমে হিসাব হবে ঈমান ও আক্বীদার। এখানে অকৃতকার্য হলে কি সে বিচারে পাশের সম্ভবনা থাকে? মানুষের ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি ও আচার-আচরনে বিপ্লব আসে তো ঈমান ও আক্বীদের গুণে। চেতনায় রোগ থাকলে কি ব্যক্তির ইবাদতে বা চরিত্রে পরিশুদ্ধি আসে?
মানুষ কি খায় -সেটি দেখা যায় তার দৈহিক স্বাস্থ্যের মাঝে। তেমনি কি শেখে -তা দেখা যায় তার কথা, চেতনা ও চরিত্রে। তাই ব্যক্তির চেতনায় শিরক বা পৌত্তলিকতা দেখে বলা যায় -তার বিদ্যাশিক্ষার কাজটি সঠিক হয়নি। বুঝা যায়, চেতনা দূষিত হয়েছে শিক্ষালয়ে। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে অন্য সব পাপ মাফ হতে পারে, কিন্তু মাফ হয়না শিরকের পাপ। অথচ রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যে সে শিরকের বীজই ছড়িয়েছেন। বঙ্কিমের ন্যায় তিনিও উপাস্য রূপে হাজির করেছেন দেশের মাটি ও আলো-বাতাসকে। শিরকের সে রূপটি প্রবল ভাবে ছড়িয়ে আছে তার রচিত কবিতা, নাটক, ছোটগল্প ও গানে। বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে এখানেই রবীন্দ্রনাথের গুরুতর অপরাধ। বস্তুত বাঙালী মুসলিম সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি ক্ষেত-খামার বা রণাঙ্গণে হয়নি, সেটি হয়েছে দেশের শিক্ষাঙ্গণে। সেটি রবীন্দ্র সাহিত্যের মাধ্যমে। চৈতন্য দেবের কাজ সীমিত ছিল হিন্দুদের মাঝে, অথচ রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিকতা প্রবেশ করেছে মুসলিম চেতনায়।
বাংলাদেশে আজ গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি ও ভোটডাকাতির জোয়ার। এসব খুনি ও ধর্ষকগণ আসমান থেকে পড়েনি। ক্ষেত-খামারেও বেড়ে উঠেনি। হিংস্র পশু উৎপাদনের জন্য জঙ্গল চাই। তেমনিট দুর্বৃত্ত উৎপাদনের জন্য চাই ইন্ডাস্ট্রী। বাংলাদেশে বিদ্যাশিক্ষার নামে সে কাজগুলোই করছে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই বেড়ে উঠেছে অপরাধের নায়কগণ। বিশ্বের দরবারে দুর্বৃত্তিতে যারা বার বার প্রথম করলো তারা নিরক্ষর কৃষক বা শ্রমিক নয়। তারা বেড়ে উঠেছে এই শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষার নামে বাড়ানো হয়েছে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক নাশকতা। স্বাস্থ্যের পতন রোধে পরিবর্তন আনতে হয় খাদ্যে, চারিত্রিক পতন রোধে তেমনি পাল্টাতে হয় শিক্ষা। নবীজী (সা:)’র যুগে তো সেটিই করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে না। ফলে অবিরাম ভাবে চলে দুর্বৃত্ত উৎপাদনের কাজ।
পৌত্তলিক চেতনায় বিশ্বের কোথাও উন্নত চরিত্র গড়ে উঠেছে বা উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয়েছে -সে প্রমাণ নাই। কারণ, সেটি তো আদিম জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার পথ। এমন অজ্ঞতায় মানুষ নিষ্ঠুর হয়, অসভ্য হয় ও অশালীন হয়। এমন জাহিলিয়াতের কারণে ভারতে হিন্দুগণ অতীতে মৃত স্বামীর চিতায় তার স্ত্রীকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। রবীন্দ্রনাথের জাহেল মনের পরিচয় মেলে সতিদাহের প্রশংসায় লেখা তার কবিতা পাঠ করে। পৌত্তলিক চেতনায় মানব সন্তানকে বিভক্ত করা হয় বিভিন্ন জাত-পাতে। ভারতে কোটি কোটি মানুষকে নিম্ন জাতের আখ্যায়ীত করে তাদেরকে অচ্ছ্যুত গণ্য করা হয়। এটি নিরেট অমানবিকতা। এতে বিলুপ্ত হয় অন্যায়কে ঘৃণা করার সামর্থ্য। একারণেই ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও গণনির্যাতন হয়। এবং সরকার ও পুলিশের রুচি নাই সেগুলো রুখার। বাংলাদেশে তেমন এক অসুস্থ্য পৌত্তলিক চেতনাকে প্রতিষ্ঠা দেয়া হচ্ছে যেমন রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সঙ্গিত করে, তেমনি তার রচিত গান, নাটক ও সাহিত্যকে জনগণের রাজস্বের অর্থে বিপুল ভাবে প্রচার করে।
যে গান ঈমানধ্বংসী
জাতীয় সঙ্গিতের মূল বিষয়টি ভাব, ভাষা, ছন্দ এবং আবেগের প্রকাশ নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটাতে হয় সংখ্যাগরিষ্ট দেশবাসীর ঈমান-আক্বিদা, আশা-আকাঙ্খা, দর্শন, ভিশন ও মিশন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন “আমার সোনার বাংলা” গানটি লিখেছিলেন তখন বাংলাদেশ বলে কোন স্বাধীন দেশ ছিল না। সে সময় বাংলা ছিল ভারতের একটি প্রদেশ। সে প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলেও তাদের সংখ্যা আজকের ন্যায় শতকরা ৯১ ভাগ ছিল না। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজেও সে গানটিতে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ, দর্শন, চেতনা বা স্বপ্নের প্রকাশ ঘটাতে লেখেনি। সেটি যেমন তার লক্ষ্য ছিল না, ফলে সে লক্ষ্যে তাঁর প্রস্তুতিও ছিল না। পৌত্তলিকগণ সব সময়ই নতুন উপাস্য চায়। যাদের কাছে গরু-বাছুর ও শাপ-শকুন উপাস্য, তাদের কাছে নবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ তো বিশাল। তাই রবীন্দ্রপূজারি পৌত্তলিকগণ রবীন্দ্রনাথকে পূজনীয় করেছে নিজেদের সে পৌত্তলিক চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। মনের সে পৌত্তলিক ক্ষুধা নিবারণেই “আমার সোনার বাংলা” গানকে বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গিতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ভারতে সে মর্যাদাটি পেয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দেমাতরম” গানটি। প্রশ্ন হলো, সে পৌত্তলিক গান গাইতে ভারতের মুসলিমদের বাধ্য করা হলেও এরূপ পৌত্তলিক গান কেন বাংলাদেশের মুসলিমগণ গাইবে?
পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হলেও কার্যতঃ ছিলেন পৌত্তলিক। এ জগতটাকে একজন মুসলিম যেভাবে দেখে, কোন পৌত্তলিকই সেভাবে দেখে না। উভয়ের ধর্মীয় বিশ্বাস যেমন ভিন্ন, তেমনি চেতনার জগতটাও ভিন্ন। আর কবিতা ও গানে তো সে বিশ্বাসেরই প্রকাশ ঘটে। একজন মুসলিমের কাছে এ পৃথিবীর ভূমি, আলো-বাতাস, মাঠ-ঘাট, গাছ-পালা, ফুল-ফল, নদী-সমুদ্র এবং সেগুলির অপরূপ রূপ –সবকিছুই মহান আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন। এসব নিদর্শন দেখে সে মহান আল্লাহর কুদরত যে কত বিশাল সে ছবকটি পায়। ফলে স্রষ্টার এ অপরূপ সৃষ্টিকূল দেখে মু’মিন ব্যক্তি সেগুলিকে ভগবান বা মা বলে বন্দনা করে না, বরং হামদ ও নাত গায় সেগুলির সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালার। অথচ রবীন্দ্রনাথের চোখে বাংলার অপরূপ রূপ ধরা পড়লেও মহান আল্লাহতায়ালার সর্বময় অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। এখানেই রবীন্দ্রনাথের অজ্ঞতা ও দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর “আমার সোনার বাংলা” গানটিতে লিখেছেন:
“আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রানে পাগল করে–
মরি হায়, হায় রে
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা খেতে,
আমি কি দেখেছি মধুর হাসি।।
কি শোভা কি ছায়া গো,
কি স্নেহ কি মায়া গো–
কি আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে,
নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী
আমার কানে লাগে
সুধার মতো–
মরি হায়, হায় রে
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি।”
রবীন্দ্রনাথের এ গানে প্রচুর ভাব আছে, ভাষা আছে, ছন্দও আছে। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু আছে যা একজন মুসলিমের ঈমানের সাথে প্রচন্ড সাংঘর্ষিক। এ গানে তিনি বন্দনা গেয়েছেন বাংলার ভূমির, এবং সে ভূমির আলো-বাতাস, নদীর কূল, ধানের ক্ষেত, আমবাগান ও বটমূলের। দেশকে তিনি মা বলেছেন। দেশের বিস্তৃত মাঠঘাট, নদীর পাড় ও বটমূলকে সে মা দেবীর আঁচল রূপে দেখেছেন। দেশকে হাজির করেছেন একজন দেবীর মুর্তিতে। গানটিতে ধ্বনিত হয়েছে সে মা দেবীর প্রতি অশ্রুসিক্ত বন্দনা। কিন্তু যে মহান আল্লাহতায়ালা সেগুলির স্রষ্টা, সমগ্র গানে একটি বারের জন্যও তাঁর বন্দনা দূরে থাক তাঁর নামের উল্লেখ পর্যন্ত নাই। একজন পৌত্তলিকের জন্য এটিই স্বভাবজাত। পৌত্তলিকের এখানেই মূল সমস্যা। এখানে পৌত্তলিকের ভয়ানক অপরাধটি হলো নানা দেবদেবী ও নানা সৃষ্টির নানা রূপ বন্দনার মাঝে মহান আল্লাহতায়ালাকে ভূলে থাকার। মানব জীবনের এটিই সবচেয়ে ঘৃণ্য কর্ম। মহাসত্যময় মহান আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকারের এটিই সবচেয়ে জঘণ্যতম শয়তানি কৌশল। এটিই শিরক। এবং এজন্যই রবীন্দ্রনাথ এজন্যই একজন মুশরিক। মহান আল্লাহর বান্দার বহু বড় বড় গোনাহ মাফ করে দিবেন কিন্তু শিরকের গুনাহ কখনোই মাফ করবেন না। নবীজী (সাঃ) সে হুশিয়ারিটি বহুবার শুনিয়েছেন। তাই একজন মুসলিম এ গান গায় কি করে? সমগ্র মুসলিম ইতিহাসের কোথাও কি একজন পৌত্তলিককে এরূপ সন্মানের আসনে বসানো হয়েছে –যা হয়েছে বাংলাদেশে?
গদ্য,পদ্য, কবিতা ও গানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মুখ বা জিহবা কথা বলে না, কথা বলে তার চেতনা বা বিশ্বাস। ফলে সে কবিতা ও গানে ব্যক্তির আক্বিদা বা ধর্মীয় বিশ্বাস ধরা পড়ে। তাই “আমার সোনার বাংলা” গানে যে চেতনাটির প্রকাশ ঘটেছে সেটি পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের। কোন মুসলিমের নয়। গানে ইসলামী চেতনার প্রকাশের সামর্থ্য থাকলে রবীন্দ্রনাথ মুসলিম হয়ে যেতেন। পৌত্তলিক চেতনা নিয়েই একজন পৌত্তলিক কবি কবিতা ও গান লিখবেন বা সাহিত্যচর্চা করবেন -সেটিই তো স্বাভাবিক। এমন একটি চেতনার কারণেই পৌত্তলিক ব্যক্তি শাপ-শকুন, গরু, বানর-হনুমান, নদ-নদী, বৃক্ষ,পাহাড়-পর্বতকে উপাস্য রূপে মেনে নেয় এবং তার বন্দনাও গায়। “আমার সোনার বাংলা” গানের ছত্রে ছত্রে তেমন একটি পৌত্তলিক চেতনারই প্রবল প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে তাঁর নিজ চেতনার সাথে আদৌ গাদ্দারী করেননি। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার সাথে একজন মুসলিমের গাদ্দারী তো তখনই শুরু হয় -যখন পৌত্তলিক চেতনার এ গানকে মনের মাধুরি মিশিয়ে গাওয়া হয়। বাংলাদেশে রবীন্দ্রভক্তদের মূল প্রকল্প হলো বিপুল সংখ্যায় এরূপ গাদ্দার উৎপাদন।এবং সে লক্ষ্যে তারা বিপুল সফলতাও পেয়েছে। মুসলিম নামধারি এরূপ গাদ্দারদের কারণে আল্লাহর শরিয়তি বিধান আজ বাংলাদেশের ন্যায় শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের দেশে পরাজিত।
“সোনার বাংলা” গানের প্রেক্ষাপট
“আমার সোনার বাংলা” গানটি রচনার একটি ঐতিহাসিক পেক্ষাপট আছে। গানটি রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের পর। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয় ১৯০৫ সালে। পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় অর্থনীতি ও শিক্ষাদীক্ষায় অতি পশ্চাদপদ ছিল পূর্ব বঙ্গ। পূর্ববঙ্গের সম্পদে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল কলকাতার হিন্দু বাবুদের। সে শহরের শতকরা ৮০ ভাগ বাসিন্দাই ছিল হিন্দু। শুধু প্রশাসনই নয়, বাংলার শিক্ষা ও শিল্প গড়ে উঠছিল স্রেফ কলকাতাকে কেন্দ্র করে। মুসলিমদের দাবী ছিল বাংলাকে বিভক্ত করা হোক এবং পূর্ববঙ্গের রাজধানি করা হোক ঢাকাকে। সে দাবীর ভিত্তিতে ভারতের তৎকালীন ভাইস রয় লর্ড কার্জন পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ গঠন করেন। এ নতুন প্রদেশের রাজধানী রূপে গৃহীত হয় ঢাকা নগরী। শহরটি রাতারাতি জেলা শহর থেকে রাজধানী শহরে পরিণত হয়। তখন ঢাকায় কার্জন হলসহ বেশ কিছু নতুন প্রশাসনিক ইমারত এবং হাই কোর্ট ভবন নির্মিত হয়। নির্মিত হয় কিছু প্রশস্ত রাজপথ। নতুন এ প্রদেশটি ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলার এবং সে সাথে আসামের মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি হয় তখন নতুন রাজনৈতিক প্রত্যয়। সে প্রত্যয় নিয়ে ১৯০৬ সালে ঢাকার বুকে গঠিত হয় মুসলিম লীগ যা শুধু বাংলার মুসলিমদের জন্যই নয়, সমগ্র ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি করে নতুন আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক চেতনা।
মুসলিমদের এ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং কলকাতা ছেড়ে ঢাকার এ মর্যাদা-বৃদ্ধি কলকাতার বাঙালী বাবুদের ভাল লাগেনি। কবি রবীন্দ্রনাথেরও ভাল লাগেনি। অথচ বাঙালী মুসলিমগণ সে বিভক্তিকে নিজেদের জন্য কল্যাণকর মনে করে। তারা এটিকে কলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু আধিপত্য থেকে মুক্তি রূপে দেখে। বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে বর্ণ হিন্দুদের পক্ষ থেকে শুরু হয় সন্ত্রাসী আন্দোলন। সে সন্ত্রাস ছিল উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিপুষ্ট। সন্ত্রাসীরা মন্দিরে গিয়ে শপথ নিত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সে সন্ত্রাসী আন্দোলনের সমর্থক। সে সন্ত্রাসের পক্ষে প্রয়োজন ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্রের। সে অস্ত্র জোগাতেই রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধে নামেন তার কবিতা, গান ও উপন্যাস নিয়ে। এ প্রেক্ষাপটেই রচিত হয় “আমার সোনার বাংলা” গান।
“আমার সোনার বাংলা” গানে যা প্রকাশ পেয়েছে সেটি রবীন্দ্রনাথের একান্তই সাম্প্রদায়িক হিন্দু চেতনার, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চেতনা সে গানে স্থান পায়নি। রবীন্দ্রনাথ মুসলিম ছিলেন না। ফলে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাস, দর্শন, স্বপ্ন, ভিশন ও মিশনের প্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছা যেমন ছিল না, তেমনি সেগুলির প্রকাশ ঘটানোর সামর্থ্যও তার ছিল না। পূর্ব বাংলা পশ্চাদপদ মুসলিমদের প্রতি অগ্রসর বাঙালী হিন্দুদের কোন দরদ না থাকলেও বাংলার প্রতি তখন তাদের দরদ উপচিয়ে পড়ে। বাংলার মাঠ-ঘাট, আলো-বাতাস, জলবায়ু, বৃক্ষরাজী ও ফলমূলের প্রতি আবেগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লেখেন এ গান। এ গানের একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। সেটি স্বাধীনতা ছিল না, বরং ছিল বাংলার বিভক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতার বদলে বাঙালী হিন্দুদের রাজনীতির মূল বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় বঙ্গভঙ্গ রদের দাবী। ব্রিটিশ শাসকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত ভ্রমনে আসেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভারত আগমন উপলক্ষে “জনগণ মনোঅধিনায়ক ভারত ভাগ্যবিধাতা” নামে কবিতা লেখেন। সেটিই আজ ভারতের জাতীয় সঙ্গিত। রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালী হিন্দুদের সে দাবী রাজা পঞ্চম জর্জ মেনে নেন এবং আবার বাংলা একীভূত হয়। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা নেমে আসে পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের মাঝে। বিক্ষুদ্ধ এ মুসলিমদের শান্ত করতে ভারতের ব্রিটিশ সরকার তখন ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সেটিও কলকাতার বাঙালী হিন্দুদের ভাল লাগেনি। তার মধ্যেও তারা কলকাতার শ্রীহানীর কারণ খুঁজে পায়। ফলে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও বাঙালী বাবুগণ তখন বিক্ষোভে রাজপথে নামেন। মিছিলে নেমেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা রোধে কলকাতার গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। সে জনসভাতেও সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। এই হলো রবীন্দ্র মানস। সে সাথে বাঙালী হিন্দু-মানস। মুসলিম বিদ্বেষ নিয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের সে গানটিই এখন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত।
আজকের শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথের আমলের অবিভক্ত বাংলা যেমন নয়, তেমনি দেশটি ভারতভূক্ত কোন প্রদেশও নয়। রবীন্দ্রনাথের অবিভক্ত বাংলায় মুসলিমদের সংখ্যা শতকরা ৫৫ ভাগের বেশী ছিল না। সে আমলের বাংলা ঢাকাকেন্দ্রীকও ছিল না। এখন এটি এক ভিন্ন চরিত্রের বাংলাদেশ -যে দেশে রবীন্দ্রনাথ একদিনের জন্যও বাস করেননি। কোনদিনও তিনি এদেশের নাগরিক ছিলেন না। এদেশের স্বাধীনতার কথা তিনি যেমন শোনেননি,তেমনি এ দেশের শতকরা ৯১ ভাগ মুসলিমদের নিয়ে তিনি কোন স্বপ্নও দেখেননি। ফলে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া,স্বাধীনতা বা স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? সবচেয়ে বড় কথা,এ সঙ্গিতটি সে উদ্দেশ্যে লেখাও হয়নি। জাতীয় সঙ্গিত নির্বাচনের বিষয়টি দোকান থেকে ‘রেডিমেড’ সার্ট কেনার ন্যায় নয়। এটিকে বরং বিশেষ রুচি, বিশেষ আকাঙ্খা, বিশেষ প্রয়োজন মেটাতে অতি বিশেষ গুণের ‘tailor made’ হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি। বরং এখানে গুরুত্ব পেয়েছে রবীন্দ্রভক্তি ও রবীন্দ্রপূজার মানসিকতা।
বাঙালী মুসলিমের আত্মসমর্পণ
আত্মসমর্পণের পর আর এ অধিকার থাকে না, কি খাবে বা কি পান করবে সে সিন্ধান্ত নেয়ার। প্রভু যা খাওয়ায় বা পান করায় -সেটিই খেতে হয় বা পান করতে হয়। এমন কি বিষ পান করানো হলেও সেটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস থাকে না। তখন অধিকার থাকে না জাতীয় সঙ্গিত রূপে কি গাওয়া হবে -সে সিদ্ধান্ত নেয়ার। শেখ মুজিব ও তার অনুসারিদের মূল কাজটি হয় সে আত্মসমর্পণে মাথা নত করা। তাদের কারণেই বাঙালী মুসলিম জীবনে নিদারুন আত্মসমর্পণ নেমে আসে ১৯৭১’য়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত হওয়ার পর। ১৯৭২’য়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে ভারত তার সেনাবাহিনীকে তুলে নিলেও হাজার হাজার চর ও রাজনৈতিক এজেন্টদের তুলে নেয়নি। বরং দেশ এখন সে এজেন্টদেরই দখলে। ভারত জানে নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভারতপন্থীদের বিজয় অসম্ভব। তাই গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে কবরে পাঠানো হয়েছে। এবং স্থায়ী রূপ দেয়া হয়েছে ভারতীয় এজেন্টদের জবরদখলকে। ইংরেজগণ তাদের ১৯০ বছরের শাসনের গণদাবীর পরওয়া করেনি। তারা শাসন করেছে খলিফাদের মাধ্যমে; এবং সেটি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে। ভারতীয়রাও দিল্লি বসে সেটিই চায়। সে জন্য তারাও ঢাকার শাসন ক্ষমতায় চায় আত্মসমর্পিত খলিফা। সে খলিফার শাসনকে গ্রহণযোগ্য করতেই চায়, পৌত্তলিক চেতনার চাষাবাদ। সেটি বাড়াতেই প্রয়োজন পড়েছে রবীন্দ্র সঙ্গিত ও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের।
ইসলামের শত্রুদের কাছে বাঙালী মুসলিমের আত্মসমর্পণের প্রমাণ শুধু এ নয় যে, দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসলাম বিরোধী শাসনতন্ত্র, সূদী ব্যাংক,পতিতাপল্লি, জুয়ার আসর, মদের দোকান, অশ্লিল, ছায়াছবি এবং কুফরি আইনের আদালত। বরং আরো প্রমাণ হলো, জাতীয় সঙ্গিত রূপে তারা গেয়ে চলেছে পৌত্তলিক চেতনাপুষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গিতকে। এরূপ আত্মসমর্পণে যা বাড়ে তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বেঈমানি। সে বেঈমানী তখন ছড়িয়ে পড়ে জীবনের প্রতিক্ষেত্রে। ইসলামের সাথে গাদ্দারীটা তখন শুধু রাজনীতিতে সীমিত থাকে না। মুসলিম সংহতির বুকে কুড়াল মারা এবং মুসলিম রাষ্ট্র বিনাশের ন্যায় হারাম কাজটিও তখন উৎসবযোগ্য গণ্য হয়।
সাইনবোর্ড পৌত্তলিকতার
নবীজীর আমলেও আরব দেশে বিস্তৃত ভূমি, চন্দ্র, সূর্য্য ও আকাশ-বাতাস ছিল। সে ভূমিতেও মাঠ-ঘাট, ফুল-ফল ও বৃক্ষরাজি ছিল। কিন্তু মহান নবীজী (সা:) কি কখনো সে গুলিকে মা বলে সম্বোধন করেছেন? বরং আজীবন হামদ-নাত ও প্রশংসা গীত গেয়েছেন সে সৃষ্টিকুলের মহান স্রষ্টার। আল্লাহর অনুগত বান্দাহ রূপে মুসলিমের বড় দায়িত্ব হলো আল্লাহর নামকে সর্বত্র প্রবলতর করা বা বড় করা। কোন দেশ, ভূমি, ভাষা বা বর্ণকে যেমন নয়, তেমনি কোন ব্যক্তি বা জীবজন্তুকেও নয়। পৌত্তলিকদের থেকে ঈমানদারের এখানেই বড় পার্থক্য। এ জীবনে হেদায়াতপ্রাপ্তির চেয়ে মহান আল্লাহতায়ালার বড় নেয়ামত নেই। তেমনি পথভ্রষ্ট হওয়ার চেয়ে বড় ব্যর্থতাও নেই। হেদায়াত প্রাপ্তির শুকরিয়া জানাতে ঈমানদার ব্যক্তি তাই আমৃত্যু আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করে। এ জন্য সে আল্লাহু আকবর বলে। এবং সেটির নির্দেশ রয়েছে পবিত্র কোরআনে। বলা হয়েছে,“তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন তোমরা আল্লাহর নামে তাকবির বল (অর্থাৎ আল্লাহ যে মহিমাময় সর্বশ্রেষ্ঠ -সেটি মুখ দিয়ে প্রকাশ করো), যাতে তোমরা এভাবে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)। তাই মুসলিম শুধু জায়নামাযেই “আল্লাহু আকবর” বলে না, রাজপথের মিছিলে বা জনসভাতেও বলে। তার মুখে তাই “জয় বাংলা” বা “জয় হিন্দ” ধ্বনিত হয় না।
আব্দুল্লাহ আর ভগবান দাস –এ দুটি শুধু ভিন্ন নাম নয়, বরং দুটি ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক। ব্যক্তির নাম থেকে এভাবেই তার ধর্ম, চেতনা ও বিশ্বাসের পরিচয় মেলে। সে পরিচয়টুকু জানার জন্য তাই বাড়তি প্রশ্নের প্রয়োজন পড়ে না। ব্যক্তির নাম তাই আজীবন তার নিজ ধর্ম বা বিশ্বাসের পক্ষে সাইনবোর্ড রূপে কাজ করে। তেমনি জাতির জীবনে সাইন বোর্ড হলো জাতীয় সঙ্গিত। জাতীয় সঙ্গিত থেকেই পরিচয় মেলে জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস ও চেতনার। জানা যায় ভিশন ও মিশন। তাই নাস্তিকের ও আস্তিকের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন যেমন এক হয় না, তেমনি এক হয় না জাতীয় সঙ্গিতও। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত থেকে দেশবাসীর যে পরিচয়টি মেলে -সেটি কি কোন তৌহিদী মুসলিমের? সে পরিচয়টি তো রবীন্দ্রনাথের ন্যায় পৌত্তলিকের।
তাছাড়া এ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত রূপে নির্বাচনের একটি ইতিহাস আছে। সেটি গৃহীত হয়েছিল পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর। যারা এ সঙ্গিতটিকে গ্রহণ করেছিল -তারা ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার। তাদের চেতনায় ও রাজনীতিতে ইসলামের কোন প্রভাব ছিল না। বরং তারা পরিচিতি নিজেদের ভারতপ্রীতি, রবীন্দ্রপ্রীতি,এবং ইসলামি চেতনা নির্মূলে আপোষহীনতার কারণে। লগি বৈঠা দিয়ে ইসলামপন্থীদের হত্যা, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এনে ফাঁসিতে ঝুলানো এবং হত্যার পর তাদের লাশ ময়লার গাড়িতে তুলে গায়েব করাই তাদের রাজনীতি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিও শ্রদ্ধা দেখানো তাদের রীতি নয়। সেরূপ শ্রদ্ধাবোধ ছিল না মুজিবেরও। মুজিব যে শুধু রাজনীতিতে স্বৈরাচারি ছিলেন তা নয়, প্রচণ্ড স্বৈরাচারি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির অঙ্গণেও। দেশের উপর তিনি শুধু একদলীয় বাকশালই চাপিয়ে দেননি, চাপিয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপেক্ষা করে পৌত্তলিক সংস্কৃতির আগ্রাসন। জাতীয় সঙ্গিত রূপে রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গানটিকে চাপানো হয়েছে তেমন এক স্বৈরাচারি মানসিকতা থেকে। এক্ষেত্রে ভারতীয় বর্ণ হিন্দুদের থেকে তার চেতনাটি আদৌ ভিন্নতর ছিল না।
আকুতি নিষ্ঠবান পৌত্তলিকের
প্রতিটি দেশের শুধু রাজনৈতিক,ভৌগলিক ও ভাষাগত পরিচয়ই থাকে না, থাকে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ও। জনগণের চেতনায় যেমন সুনির্দ্দিষ্ট দর্শন থাকে, তেমনি সে দর্শনের আলোকে রাজনৈতিক স্বপ্নও থাকে। সে স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠায় জনগণের জীবনে লড়াইও থাকে। সে বিচারে প্রতিটি দেশই অনন্য। সে অনন্য বৈশিষ্ঠের কারণেই পশ্চিম বাংলার ন্যায় বাংলাদেশ ভারতের অংশ নয়। পশ্চিম বাংলার সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যটি ভূমি, জলবায়ু বা আলোবাতাসের নয়, বরং সেটি দর্শন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভিশন ও মিশনের। পার্থক্যটি ভিন্ন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচার। সে ভিন্ন স্বপ্নের কারণেই ১৯৪৭’য়ে পশ্চিম বাংলার হিন্দুগণ যখন ভারতে যোগ দেয় তখন পূর্ব বাংলার মুসলিমগণ সচেতন ভাবেই বাঙালী হিন্দুদের সাথে প্রতিবেশী ভারতে যায়নি। গিয়েছে পাকিস্তানে।
জাতীয় সঙ্গিত রচিত হয় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে বিশেষ পরিচয় ও স্বপ্ন -সেগুলো তুলে ধরতে এবং প্রবলতর করতে। এমন সঙ্গিতের প্রতিটি শব্দ ও প্রতিটি উচ্চারণ থেকে প্রতিটি নাগরিক তখন পায় নতুন প্রত্যয় ও নতুন প্রেরণা। পায় স্বপ্নের সে পথটিতে অবিরাম টিকে থাকার মানসিক বল। কিন্তু জাতীয় সঙ্গিতের নির্বাচনে বাংলাদেশের মুসলিমদের সে বিশিষ্ট পরিচয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এ সঙ্গিতে যে সুর, যে দর্শন, যে বর্ণনা এবং যে আকুতি ধ্বণিত হয়েছে সেটি কোন মুসলিমের নয়, সেটি নিতান্তই একজন পৌত্তলিকের। এমন সঙ্গিত থেকে কোন মুসলিমই অনুপ্রেরণা পেতে পারে না, বরং পায় পথভ্রষ্টতা। পায় শিরকের ছবক। পায় জাহান্নামের পথ। হিন্দুস্থান চায়, বাংলাদেশীদের মাঝে ১৯৪৭’য়ের পরিচয়টি বিলুপ্ত হোক। চায়, নির্মিত হোক ইসলামচ্যুত নতুন প্রজন্ম নিয়ে এক নতুন বাংলাদেশ।
রবীন্দ্রসঙ্গিতের রাজনৈতিক এজেন্ডা
জাতীয় সঙ্গীত কোন সাধারণ গান নয়। তার একটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও দর্শনগত এজেন্ডা থাকে। তাতে দেশবাসীর মিশন ও ভিশনের ঘোষণাও থাকে। ১৯০৫ সালে বাঙালী হিন্দুদের এজেন্ডা ছিল বঙ্গভঙ্গ রদ ও অখণ্ড বাংলা। তখন প্রয়োজন দেখা যায় “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভাল বাসি” এ গানটির। কিন্তু হিন্দুদের রাজনৈতিক এজেন্ডাই পাল্টে যায় ১৯৪৭ সালে; তখন সেটি হয় বঙ্গভঙ্গ। তখন প্রয়োজন হারিয়ে ফেলে সে গান। কিন্তু ১৯৭১’য়ের পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর তাদের এজেন্ডা আবার পাল্টে যায়। ভারতীয় হিন্দুদের রাজনীতিতে আবার ফিরে এসেছে “অখন্ড বাংলা”র প্রকল্প। তাই আবার প্রয়োজন দেখা দেয় সে গানটির। তারা জানে, এখন অখন্ড বাংলা গড়লে সে বাংলার পক্ষে পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সুযোগ নাই। বরং সম্ভাবনা বেড়েছে পশ্চিম বাংলার সাথে যুক্ত হয়ে ভারত ভুক্ত হওয়ার। তাতে ভারত পাবে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের উপর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ। তাতে বাড়বে ভারতের সামরিক ও সামরিক শক্তি। এ সুযোগটি পেতে অতীতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে বাংলার বুকে এসে যুদ্ধ করেছে। তাই এতো কাছে থেকে ভারত সে সুযোগ ছাড়ে কেমনে? তবে সে রাজনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তনের পূর্বে ভারত চায়, বাংলাদেশীদের চেতনার মানচিত্রে পরিবর্তন। চেতনাগত পবিবর্তনের লক্ষ্যেই পুণরায় প্রয়োজন পড়েছে অবিভক্ত বাংলার পক্ষে আবেগ সৃষ্টির। ফলে কদর বেড়েছে রবীন্দ্রনাথের “সোনার বাংলা” গানের।
কোন যুদ্ধই স্রেফ সামরিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রকান্ড যুদ্ধ চলে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানেও। ১৯৭১’য়ের সামরিক যুদ্ধটি শেষ হয়েছে, কিন্তু তীব্র ভাবে এখনো চলছে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ। পাকিস্তান ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে ভারত এক ধাপ এগিয়েছে মাত্র, কিন্তু অখণ্ড ভারত নির্মাণের মূল লক্ষ্যটি এখনো অর্জিত হয়নি। ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের লক্ষ্য,বাঙালী মুসলিমের আদর্শিক ভূবনে পরিবর্তন আনা। কারণ, পূর্ব বাংলার মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ভূক্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিক বন্ধনের কারণে নয়। সেটি সম্ভব হয়েছিল প্যান-ইসলামি মুসলিম ভাতৃত্বের কারণে। ইসলাম এজন্যই ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের মূল টার্গেট। ১৯৭১’য়ে সামরিক বিজয়ের পর ইসলামি চেতনা বিনাশের ভারতীয় প্রজেক্ট বহুদূর এগিয়ে গেছে। ১৯৪৭য়ে শতকরা ৯৬ ভাগ বাঙালী মুসলিম পাকিস্তানে যোগ দেয়ার পক্ষে ছিল। অথচ চিত্রটি এখন ভিন্ন। মনের মাধুরি মিশিয়ে যারা রবীন্দ্রনাথের “আমার সোনার বাংলা” গায় তাদের অনেকেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টিকে অনাসৃষ্টি মনে করে। তাদের সামনে ১৯৪৭ এলে তারা পাকিস্তানে যোগ দেয়ার পক্ষে ভোট দিত না। ভারত তাই বিজয়ী হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধেও। নতুন প্রজন্ম ভূলে গেছে ১৯৪৭-পূর্ব বাঙালী মুসলিমদের দুরাবস্থার কথা। তখন বাংলার শহরে ও গ্রামে শতকরা ৯৫ ভাগ দালানকোঠা ও ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল হিন্দুরা। শহর এলাকার শতকরা ৮৫ ভাগের বেশী জমিজমার মালিক ছিল তারা। সরকারি চাকুরীতে মুসলিমদের সংখ্যা শতকরা ৫ ভাগও ছিল না। ভারতের মুসলিমগণ এখনো সে একই অবস্থায় রয়ে গেছে।
আত্মসমর্পণে কি আখেরাত বাঁচবে?
বাঙালী মুসলিমের চেতনা রাজ্যে ভারতীয় দখলাদারিকে স্থায়ী রূপ দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে সেক্যুলার বাঙালী বুদ্ধিজীবীগণ। এরা হচ্ছে ভারতের পক্ষে খাঁচার ঘুঘু। এদের কাজ, তাদের ন্যায় অন্যদেরও খাঁচায় বন্দী করা। এরূপ ভারতসেবী সাংস্কৃতিক সৈন্য গড়ে তোলার কাজে ভারতের বিনিয়োগটি ১৯৪৭ থেকেই। ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ভারতের সে খরচটি বিপুল ভাবে কমেছে। ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে এখন ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশী মুসলিমের নিজস্ব রাজস্বের পুঁজি। ভারতের বর্তমান স্ট্রাটেজী হলো, একাত্তরে অর্জিত অধিকৃতিকে যে কোন ভাবেই হোক লাগাতর ধরে রাখা। বাংলাদেশের উপর ভারতের দখলদারিটি শুধু সামরিক, রাজনৈতিক বা অর্থনতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক। সে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকৃতিরই প্রতীক হলো জাতীয় সঙ্গিত রূপে চাপিয়ে দেয়া পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের গান।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অখণ্ড হিন্দু ভারতের ধ্বজাধারি। সে অখণ্ড হিন্দু ভারতের চেতনা থেকেই ভারত থেকে মুসলিম নির্মূলের প্রবক্তা মারাঠী শিবাজীকে তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা দিয়েছেন। শিবাজীকে বন্দনা করে তিনি কবিতাও লিখেছেন। এখন সে রবীন্দ্রনাথকে ভারত ব্যবহার করছে বাংলাদেশের উপর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের যোগসূত্র রূপে। এজন্যই বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও রবীন্দ্রঅর্চনা বাড়াতে ভারত সরকার ও আওয়ামী লীগ সরকারের এত বিনিয়োগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের রাজস্বের অর্থে বাংলা এ্যাকাডেমীর কাজ হয়েছে প্রতিবছর পৌত্তলিক রবীন্দ্রনাথের উপর শত শত বই প্রকাশ করা। অথচ ইসলামের মহান নবীজী(সাঃ)এবং মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষটির উপর কি এর দশ ভাগের এক ভাগ বই ছাপানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?
জনগণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাধটি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়। সেটি ঘটছে চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। অপরাধটি এখানে জনগণকে জাহান্নামের আগুণে পৌঁছানোর। অথচ সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা বা হাসপাতাল গড়া নয়, বরং জাহান্নামের আগুণ থেকে নাগরিকদের বাঁচানো। এবং সেটি সম্ভব জান্নাতের পথ তথা সিরাতুল মুস্তাকীমটি চিনতে এবং সে পথে পথচলায় লাগাতর সহয়তা দেয়ার মধ্য দিয়ে। ইসলামে এটি এক বিশাল ইবাদত এবং প্রতিটি শাসকের উপর এটি এক বিশাল দায়ভার। এ দায়িত্ব পালনের কাজটি সঠিক হলে মহান আল্লাহর দরবারে সে শাসক মহান মর্যাদায় ভূষিত হন। এবং কিভাবে পালন করতে হয় খোদ নবীজী (সা:) দেশ শাসনের সে গুরু দায়ভার নিজ কাঁধে নিয়ে শিখিয়ে গেছেন। শাসকদের জন্য আজও মহান নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদার ন্যায় মহান সাহাবায়ে কেরামগণ। কিন্তু বাংলাদেশে সে দায়ভার পালিত হয়না। কারণ, শাসকের সে পবিত্র পদটি অধিকৃত হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। এরা আবির্ভুত হয়েছে স্বার্থ-শিকারি চোর-ডাকাত রূপে। ক্ষমতালোভী এ সেক্যুলারিস্টদের মূল মিশনটি হলো, কোর’আনে প্রদর্শিত সিরাতুল মুস্তাকীমকেই জনগণের দৃশ্যপট থেকে বিলুপ্ত করা এবং জাহান্নামে পৌঁছাটি সহজতর করা। সে লক্ষেই তাদের রাজনীতি ও শিক্ষানীতি। সে লক্ষ্যেই নৃত্য-গীত, মদ-জুয়া ও পতিতাপল্লির সংস্কৃতি। সে লক্ষ্যেই দেশ জুড়ে গড়া হচ্ছে শত শত নাট্যশালা ও সিনেমা হল। সে অভিন্ন লক্ষ্যেই এক পৌত্তলিকের রচিত সঙ্গিতকে জাতীয় সঙ্গিত রূপে গাইতে বা শুনতে জনগণকে বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে অধিকৃত হয়ে আছে জনগণের মনের ভূবন। জনগণের অধিকৃত সে মন বাধ্য হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ থেকে দূরে থাকতে।
অথচ মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ থেকে দূরে থাকার বিপদটি তো ভয়াবহ। তখন সে ব্যক্তির উপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তার সঙ্গিরূপে তখন নিয়োগ দেয়া হয় অভিশপ্ত শয়তানের। সে ঘোষণাটি এসেছে পবিত্র কোরআনে। বলা হয়েছে, “যে কেউ রহমানের স্মরণ থেকে দূরে সরবে তার উপর নিয়োগ দেয়া হবে শয়তানের, সে তার সঙ্গি হবে।” –(সুরা জুখরুফ, আয়াত ৩৬)। রবীন্দ্র সঙ্গিত গাওয়ার অর্থ শুধু গান গাওয়া নয়। এর অর্থ, দেশবন্দনার মাঝে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ থেকে ভূলে থাকা। ফলে তার পরিণতিটি ভয়াবহ। এখানে মহাবিপদটি সঙ্গি রূপে শয়তানকে নিজ ঘাড়ে বসিয়ে নেয়ার। জনগণের কাঁধে শয়তান বসিয়ে দেয়ার সে ভয়ানক পাপের কাজটিই করছে বাংলাদেশের সরকার। সরকারের নীতির কারণেই দিন দিন শয়তানের অধিকৃতি বাড়ছে দেশবাসীর মনের ভূবনে। আর তাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গণই শুধু নয়, জনগণের চেতনার মানচিত্রও অধিকৃত হয়ে যাচ্ছে পৌত্তলিক হিন্দুদের হাতে। এভাবে জাতীয় সঙ্গিত পরিনত হয়েছে জনগণের ঈমান ধ্বংস ও জাহান্নামে পৌছানোর নীরব হাতিয়ারে। ১ম সংস্করণ ১০/০৫/২০১৫; ২য় সংস্করণ ২৫/০২/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018