একাত্তরের গণহত্যা-চার
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on January 1, 2021
- Bangla Articles, অতিথি লেখক
- No Comments.
যে কাহিনী শুনতে নেই (০৮)
================ চট্টগ্রাম হত্যাকান্ড (০১ Kai Kaus ০১. “… একটি অভিজ্ঞতা যা আজো আমাকে হানা দেয়। কালুরঘাটের অনুষ্ঠান শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি। দেখলাম একটা গাড়ি আটকানো হয়েছে। ভেতরে একটি অবাঙালি পুরুষ ও একটি বাঙালি মহিলা। সড়কের বিভিন্ন পোস্ট যারা পাহারা দিচ্ছিলেন তারাই আটকেছে। অবাঙালি পুরুষটিকে মহিলাটির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হলো। মহিলাটিও কিছুতেই ছাড়বে না তাকে। অনুনয়, বিনয়, পায়ে ধরা সমস্ত কিছুই মহিলাটি করছেন। কিন্তু কোন কিছুতেই কোন ফল হলো না। মহিলাটির শাড়ি ও ব্লাউজ ছিঁড়ে গেল। তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে দেয়া হলো। গাড়িটি আবার চলে গেলো উল্টোমুখে। অবাঙালি পুরুষটির হাতে ছিল একটি ব্রিফকেস, সম্ভবত: তার মধ্যে টাকা, গহনা ইত্যাদি থাকলেও থাকতে পারে। পুরুষটিকে নিরাপদে পার করে দিতে বাঙালি হয়েও মহিলাটি এসেছিল, ভেবেছিল সফল হবে। পুরুষটিকে সামনেই একটি গাছের পেছনে নিয়ে যাওয়া হলো। সড়ক পাহারায় যারা নিযুক্ত ছিলেন, তাদের কাছে তখন রাইফেল না থাকায় রাস্তার পাশের কোন বাসা থেকে একটা ভোঁতা ছুরির মতো কেউ এনে দিয়েছিল। সেই ভোঁতা অস্ত্রটি দিয়ে অবাঙালি লোকটিকে শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে মারা হয়েছিল। আজো ভাবি, যুদ্ধের সময় মহিলাটি কেনো তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল? যুদ্ধের চেয়েও কি তবে প্রেম বড়? মানুষের সাথে মানুষের যে নাড়ির যোগ তা কি আবহমান প্রবাহিত? মানুষে মানুষে নিজেদের মধ্যে যতো যুদ্ধই করুক সবকিছুরই উর্ধ্বে মানুষ ও মনুষ্যত্বই শেষ কথা? তবে কি সব যুদ্ধের লক্ষ্য মানুষ ও মনুষ্যত্বের বিজয় ঘোষণার সমাপ্তির সংগীত? …আমার লেখা একটি শ্লোগান (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত) “ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা আমরা পশু হত্যা করি” সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল॥” — মুস্তফা আনোয়ার (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক) / মুস্তফা আনোয়ার রচনা সমগ্র ॥ [ সম্পাদনা : আব্দুল মান্নান সৈয়দ । ঐতিহ্য – ফেব্রুয়ারী, ২০১০। পৃ: ৩৭০ ] ০২. “… কর্ণফুলী মিলে বাঙালিরা সকল পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারীদের ও তাদের পরিবার পরিজনদের একটি ক্লাব হলে নিয়ে যায় ও সেখানে গুলি করে তাদের হত্যা করে। মেজর আনিস সেখনে যান এবং মৃতদেহের স্তুপ দেখতে পান যেখানে কেবলমাত্র একজন নারী ও একটি শিশু বেঁচে ছিল। হতভাগ্যদের সেখানে গণকবর দেয়া হয়। এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসের প্রথম দিকে আর্মি এভিয়েশনের ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে লে. জেনারেল) আলী কুলি চট্টগ্রাম উড়ে যান। তিনি কর্ণফুলী মিল পরিদর্শন করেন। তখনও সেখানকার দেয়ালে ও সিঁড়িতে মজুত ছিল রক্তের চিহ্নসহ স্পষ্ট খুন খারাবীর আলামত। বিদেশী সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল মিলে অবাঙালিদের ব্যাপক হত্যাকান্ডের প্রমাণ। রাজা ত্রিদিব রায় চট্টগ্রামে উভয়পক্ষের বাড়াবাড়ির কথা লিখেছেন। তার এক চাচা ও দু’জন চাচাতো ভাইকে সেনাবাহিনী নিয়ে গেলে তারা আর কখনোই ফিরে আসেনি। “অন্যদিকে রাঙ্গামাটিতে ২৬ মার্চ-এর পর থেকে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিদ্রোহী পুলিশ সদস্য ও ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যরা বিহারীদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে…বাঙালিদের এ সব অপকর্মের সাথে যোগ না দেয়ায় তারা পাহাড়িদের হুমকি দিয়ে বলে, ‘বিহারী ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের পর তোমাদের পালা আসবে’।” ত্রিদিব রায় অবাঙালি নারী-পুরুষ ও শিশুদের প্রতি বাঙালিদের হৃদয়বিদারক নৃশংসতা নিয়ে অনেক লিখেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী ক্যাডাররা মানুষকে বাধ্য করতো তাদের অর্থ ও চাল দেয়ার জন্য এবং সেখানে সেনাবাহিনী পৌঁছলে গ্রামবাসী তাদেরকে মনে করতো রক্ষাকর্তা হিসেবে॥” — ডেড রেকনিং : ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি / শর্মিলা বসু (মূল: Dead Reckoning : Memories of the 1971 Bangladesh War । অনু: সুদীপ্ত রায়) ॥ [ হার্স্ট এন্ড কোম্পানী – ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৯২ ] ০৩. “… ১৯৭১ সালের মার্চে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি বিদ্রোহে জনবহুল বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অবাঙালিদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান সংকটে ১৯৭১ সালের আগস্টে প্রকাশিত পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্রে চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের এলাকায় অবাঙালিদের মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল ১৫ হাজারের নিচে। কিন্ত এ বই প্রকাশের প্রয়োজনে গৃহীত শত শত প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে যে, ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রাম হত্যাযজ্ঞে ৫০ হাজারের বেশি অবাঙালি নিহত হয়েছে। হাজার হাজার মৃতদেহ কর্ণফুলি নদী ও বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা হয়। বাঙালি বিদ্রোহীরা এ শহর এবং শহরের উপকণ্ঠে ১৭টি কসাইখানায় বহু নির্দোষ অবাঙালিকে হত্যা ও নির্যাতন করেছিল ৷ এসব নির্যাতিত অবাঙালির লাশ ভস্মীভূত করা হয়। মনে হচ্ছে বাঙালি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিল ১২ বছরের বেশি সব অবাঙালিকে হত্যা করা। অবাঙালি পুরুষদের হত্যা করার পাশাপাশি ১৯৭১ সালে মার্চের শেষ দিনগুলোতে এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাঙালি বিদ্রোহীরা বহু নারী ও শিশুকে হত্যা করে। প্রদেশের অন্য যে কোনো জায়গার চেয়ে চট্টগ্রামে অবাঙালি হত্যাকান্ডের ভয়াবহতা ছিল প্রচণ্ড।খুলনা, যশোর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ ছিল ব্যতিক্রম। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড ঢাকায় বিদ্রোহের সূচনা ঘটানোর ঠিক পরক্ষণে ৩ মার্চ পাহাড়, নদী ও বনভূমি শোভিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ নগরীতে অগ্নিকাণ্ড ও মৃত্যুর আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ ঘটে। গভীর রাতে আওয়ামী লীগের বন্দুকধারী সন্ত্রাসীদের নেতৃত্বে উন্মত্ত জনতা শহরে অবাঙালি বসতি আক্রমণ করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বিদ্রোহীদের হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওয়ারলেস কলোনি ও ফিরোজশাহ কলোনি। এককভাবে ফিরোজশাহ কলোনিতে ৭ শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং এসব বাড়ির অধিকাংশ পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অনেকে তাদের জ্বলন্ত ঘরবাড়ি থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু পালিয়ে যাবার সময় পথে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে তারা নিহত হয়। নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে যে ক’জন বেঁচে গেছে তারা এ নিষ্ঠুরতাকে মর্তের দোযখ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মুক্তিপণের জন্য অবস্থাপন্ন অবাঙালিদের অপহরণ করা হয়। পরে অপহৃতদের কসাইখানায় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতা এম. আর. সিদ্দিকী ছিলেন এ হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারী এবং তিনি চট্টগ্রামে ঘৃণ্য অবাঙালি হত্যাকাণ্ড তত্ত্বাবধান করেছেন। ৩ মার্চ রাতে প্রথম অগ্নিসংযোগের পর শহরের অন্যান্য অবাঙালি বসতিতে হামলা চালাতে বিদ্রোহীদের সাহস বৃদ্ধি পায়। বিদ্রোহীরা রৌফাবাদ, হালিশহর, দোতলা, কালুরঘাট, হামজাবাদ ও পাহাড়তলীতে শত শত অবাঙালি বাড়িঘরে লুটপাট চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। বাড়ি থেকে অপহৃত অবাঙালিদের কসাইখানায় হত্যা করা হয়। মার্চের প্রথম পক্ষকালে চট্টগ্রাম ও তার আশপাশে অবাঙালি পুরুষদের পর্যায়ক্রমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়। কিছু অস্ত্র লুট করা হয়েছিল আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান ও পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে এবং আরো অস্ত্র এসেছিল ভারত থেকে। আক্রান্ত হওয়া নাগাদ গুলিবর্ষণ না করার জন্য সেনা ও নৌবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। স্থানীয় পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। অধিকাংশ কর্মী বাঙালি হওয়ায় অগ্নিনির্বাপক বাহিনী ছিল স্থবির। অগ্নিনির্বাপক গাড়ি জ্বলন্ত বস্তির আগুন নেভাতে যেতে চেষ্টা করে। কিন্ত বের হওয়া মাত্র বিদ্রোহীরা এসব গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে চট্টগ্রামে বিদ্রোহীরা এতটুকু শক্তি সঞ্চয় করে যে, তারা এলাকায় সামরিক বাহিনীকেও চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। ১৮ মার্চ রাতে সশস্ত্র ব্যক্তিরা প্রতিটি অবাঙালি আবাসিক কলোনিতে হামলা চালায়। হাজার হাজার অবাঙালির জন্য রাতটি ছিল বিভীষিকাময়। বন্দুকধারীরা কোনো প্রশ্ন না করে বাড়িঘরে ঢুকে বাসিন্দাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। কোনো কিছু নড়াচড়া করতে দেখলেই তারা গুলি করতো। ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’কে আওয়ামী লীগ ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে নামকরণ করে। সেদিন বিদ্রোহীরা তাদের ব্যাপক শক্তিপ্রদর্শন করে। বেশ কয়েকটি জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা টুকরো টুকরো করা হয়। রাতে অবাঙালিদের ওপর ফের হামলা হয়। ইপিআর, আনসার ও স্থানীয় পুলিশ বিদ্রোহ করায় আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধি পায়। বিদ্রোহীরা ছিল সুসজ্জিত এবং তাদের গোলাবারুদ সরবরাহের কোনো ঘাটতি ছিল না। ২৫ মার্চ বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় সেনা ও নৌবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং শহর অভিমুখী সকল রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করে। তারা ক্যান্টনমেন্টে সৈন্য ও অস্ত্র পরিবহন রোধে আগ্রাবাদ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যস্ত মহাসড়কে বিরাট বিরাট ব্যারিকেড স্থাপন করে। তারা মূল সড়কে পরিখা খনন করে এবং যানবাহন চলাচল বন্ধে মহাসড়ক বরাবর দগ্ধ ট্রাক ও লরি এবং বিটুমিনের ড্রাম স্তূপ করে রাখে। বিদ্রোহীরা বন্দরে গুদামজাতকৃত গোলাবারুদ লুট করে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয়। ২৬ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চূড়ান্ত দিন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য গুরুতৃপূর্ণ শহরে পূর্বাহ্নে আঘাত হেনে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ এবং ১ লাখ ৭৬ হাজারের বেশি বাঙালি বিদ্রোহীর বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রদেশে শক্তি ছিল অপর্যাপ্ত। এজন্য বহু জায়গায় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনীর কোথাও কোথাও এক সপ্তাহ থেকে এক মাস সময় লেগেছিল। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে বন্দর এবং বিমানবন্দরের মতো শহরের কৌশলগত অংশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল নাগাদ বহু আবাসিক এলাকা সশস্ত্র বন্দুকধারীদের আওতায় থেকে যায়। এ নারকীয় মুহূর্তে হাজার হাজার অবাঙালিকে গণহারে হত্যা করা হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার ছিল চট্টগ্রামে বিদ্রোহীদের অপারেশনাল হেডকোয়ার্টার এবং শহরে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয় ছিল মূল কসাইখানা। এ কসাইখানায় নির্যাতন করার সেল ও চেম্বার ছিল। নির্যাতনের সেলগুলোতে আটক অবাঙালিদের শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করে নেয়া হতো। রক্ত বের করা হয়ে গেলে অবাঙালিদের হত্যা করা হতো। উসমানিয়া গ্লাস ওয়ার্কস, হাফিজ জুট মিল, ইস্পাহানি জুট মিল ও অন্যান্য ফ্যাক্টরি এবং বিবিরহাটে আমিন জুট মিল এবং চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলি পেপার মিলে অবাঙালি কর্মচারী এবং তাদের পরিবারবর্গের হত্যাকাণ্ডে প্রদর্শিত নিষ্ঠুরতা প্রাচীন চীনের অসভ্য হুনদের বর্বরতাকে ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মার্চের শেষ ৫ দিন এবং এপ্রিলের গোড়ার দিকে বিদ্রোহীরা এসব জায়গায় অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড চালায়।বিদ্রোহীদের বর্ণবাদী গণহত্যা থেকে খুব কমসংখ্যক অবাঙালি রক্ষা পেয়েছিল। চট্টগ্রামে গভর্নমেন্ট রেস্ট হাউজের কুখ্যাত কসাইখানায় প্রায় চার হাজার অবাঙালিকে হত্যা করা হয়। তাদের শরীর থেকে রক্ত বের করে নেয়া হয়। বাঙালি ডাক্তাররা তাদের চোখ থেকে কর্ণিয়া তুলে নেয়। তড়িঘড়ি করে খোড়া অগভীর গর্তে এসব লাশ চাপা দেয়া হয়। কারো মধ্যে বেঁচে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা দিলে তার মাথার খুলিতে গুলি করা হতো। আওয়ামী লীগের জঙ্গিরা মসজিদের কয়েকজন ইমামকে বিহারীদের হত্যা করা বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে ফতোয়া দিতে বাধ্য করে। চট্টগ্রামে ফায়ার ব্রিগেড অফিসের কাছে একটি মসজিদে অর্ধ ডজন অবাঙালিকে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীরা তাদেরকে বাড়ি থেকে অপহরণ করেছিল। কালুরঘাট শিল্প এলাকায় বাঙালি বিদ্রোহীরা তিন শত মহিলাসহ প্রায় ৫ হাজার অবাঙালিকে জবাই করে। কালুরঘাট হত্যাকাণ্ড থেকে খুব কমসংখ্যক অবাঙালি রক্ষা পেয়েছিল। আটক অবাঙালি মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়। কাউকে কাউকে ধর্ষণ করা হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায়। হালিশহর, কালুরঘাট ও পাহাড়তলীতেও বর্বর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এসব এলাকায় বাঙালি বিদ্রোহী সৈন্যরা গোটা বসতির চারদিকে পেট্রোল ও কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর অগ্নিকুণ্ড থেকে পালিয়ে যাওয়া অবাঙালিদের হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালে মার্চের শেষ সপ্তাহ এবং এপ্রিলের শুরুতে এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার অবাঙালি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মৃতদেহগুলো পুড়িয়ে দেয়ায় অথবা নদী কিংবা সাগরে নিক্ষেপ করায় নিহতদের সঠিক সংখ্যা কখনো জানা যাবে না। হিংস্র বিদ্রোহীদের অনেকেই ছিল হিন্দু। এসব হিন্দু বিদ্রোহী মসজিদ ও মুসলমানদের মাজার অপবিত্র এবং পবিত্র কোরআনের কপিতে অগ্নিসংযোগ করে। এ বইয়ের জন্য গৃহীত সাক্ষাৎকারগলোতে প্রত্যক্ষদর্শীরা এম. আর. সিদ্দিকীকে ‘চট্টগ্রামের কসাই” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা অভিযোগ করেছে যে, তার ব্যক্তিগত তত্বাবধানে শহরে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে কসাইখানায় হত্যাকাণ্ড চালানো হতো। নিরীহ অবাঙালিদের হত্যা করতে তিনি তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, “এই জারজদের হত্যা করো”। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের হতাহত সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় বাঙালি ডাক্তার রক্ত সরবরাহের আহ্বান জানান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এম. আর. সিদ্দিকী কসাইখানায় বন্দি অসহায় অবাঙালিদের শরীর থেকে রক্ত বের করে নিতে তার লোকদের নির্দেশ দেন। এমনকি তিনি পঙ্গু বাঙালি সৈন্যদের দেহে প্রয়োজনীয় অঙ্গ সংযোজনে অবাঙালিদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছেদনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মার্চের শেষ দিনগুলোতে কসাইখানায় স্তুপীকৃত লাশগুলো হয়তো গর্তে পুঁতে ফেলা হয় নয়তো মাটি ও আর্বজনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাপ সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহীরা পিছু হটার সময় মসজিদ ও স্কুল ভবনে সমবেত শত শত অসহায় নারী ও শিশুকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে হত্যা করে। চট্টগ্রামে অবাঙালি পুরুষদের পাইকারীহারে হত্যা করার পাশাপাশি কয়েক হাজার অবাঙালি মেয়ে ও তরুণীকে অপহরণ এবং ধর্ষণ করা হয়। কখনো কখনো বাঙালি বিদ্রোহীদের ঘাঁটিগুলোর কাছাকাছি সুরক্ষিত বাড়িগুলোতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটতো। নৈরাজ্যবাদী বিদ্রোহীরা সন্তান অথবা স্বামীকে হত্যা করার অসহনীয় দৃশ্য দেখতে মহিলাদের বাধ্য করতো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের দানবীয় শাসন থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করার পর জীবিত অবাঙালিরা তাঁদের বিধ্বস্ত জীবন নতুন করে শুরু করে এবং তাদের ভস্মীভূত ঘরবাড়ি মেরামত করে। তবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়ার পর তাদের ভগ্ন জীবন আবার ভেঙ্গে পড়ে। হাজার হাজার অবাঙালি নিহত হয়, অবাঙালি পরিবারগুলোকে তাদের মেরামত করা ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয় এবং জীবিতদের ঠাঁই হয় রেডক্রসের ত্রাণ শিবিরে। ১৯৭১ সালের মে মাসে ৬ জন বিদেশি সাংবাদিক পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। মর্ট রোসেনবাম ছিলেন তাদের একজন। ১৯৭১ সালের ১২ মে ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টারে তার প্রেরিত একটি রিপোর্টে বলা হয়: “বন্দর নগরী চট্টগ্রামে একটি জুট মিলের বিনোদন ক্লাবে কাপড়ের স্তুপের ভেতর রক্তমাখা একটি পুতুল গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এ ক্লাবে বাঙালিরা ১৮০ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। বাঙালিরা দেশপ্রেমের উত্তেজনায় মত্ত হয়ে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানিকে হত্যা করে। বাঙালি বেসামরিক লোক ও মুক্তি ফৌজ ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আগত (ভারতীয় অভিবাসী) বিহারীদের গণহত্যায় লিপ্ত হয় এবং হাটবাজার ও বসতবাড়ি তছনছ করে, ছুরিকাঘাত, গুলিবর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে। কখনো কখনো ধর্ষণ ও লুটপাটেও লিপ্ত হয় ৷” ১৯৭১ সালের ১২ মে আমেরিকান বার্তা সংস্থা এপি প্রেরিত একটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টারে আরো বলা হয়: “গতকাল গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দর নগরী সফরকারী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন যে, তারা ব্যাপক গোলা ও গুলিবর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির এবং বিদ্রোহীদের হাতে ব্যাপক বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার প্রমাণ দেখতে পেয়েছেন।প্রভাবশালী ইস্পাহানি পরিবারের মালিকানাধীন জুট মিলগুলোতে সাংবাদিকরা মিলের বিনোদন ক্লাবে গত মাসে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের হাতে নিহত ১৫২ জন অবাঙালি মহিলা ও শিশুর গণকবর দেখতে পেয়েছেন। বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত এ ক্লাবের মেঝেতে এখনো রক্তমাখা জামা-কাপড় ও খেলনা পড়ে রয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানি ও ভারতীয় অভিবাসীদের (১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বসতি স্থাপনকারী মুসলমান) হত্যা করা হয়েছে। অধিবাসীরা একটি ভস্মীভূত ডিপার্টমেন্ট ভবন দেখিয়ে বলেছে, সেখানে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের সাড়ে তিন শ’ পাঠানকে হত্যা করেছে।” ১৯৭১ সালের ১০ মে চট্টগ্রাম থেকে ম্যালকম ব্রাউন প্রেরিত নিউইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়: “সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানোর আগে যে সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করছিল তখন ভারত থেকে আগত বিহারী অভিবাসীদের তুলনামূলক সমৃদ্ধিতে দৃশ্যত ঈর্ষান্বিত বাঙালি শ্রমিকরা ব্যাপক সংখ্যায় বিহারীদের হত্যা করে।” ১৯৭১ সালে এপ্রিলের প্রথম পক্ষকালে লন্ডনের সানডে টাইমসের পাকিস্তানি প্রতিনিধি এন্থনি মাসকারেনহাস পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ কবলিত এলাকা সফর করেন। ১৯৭১ সালের ২ মে সানডে টাইমসে মাসকারেনহাস প্রেরিত এক রিপোর্টে বলা হয়: “চট্টগ্রামে মিলিটারি একাডেমির কর্নেল কমান্ডিংকে হত্যা করা হয়। এসময় তার আট মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তলপেটে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামের আরেকটি অংশে জীবন্ত অবস্থায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একজন অফিসারের চামড়া ছিলে ফেলা হয়। তার দু’পুত্রের শিরচ্ছেদ করা হয়। তার স্ত্রীর তলপেটে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে তার উন্মুক্ত শরীরের ওপর পুত্রদের মাথা রেখে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো বাঁশ দিয়ে জরায়ু বিদীর্ণ বহু যুবতী মেয়ের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম এবং খুলনা ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সমবেত হয়েছিল।” ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল ডারহামের ডার্লিংটনের নর্দার্ন ইকো’তে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়: “আমেরিকান সহায়তা প্রকল্পে কর্মরত মার্কিন প্রকৌশলী লিও লামন্সডেন বলেছেন যে, গত সপ্তাহে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসার আগে দু”সপ্তাহ পর্যত্ত বাঙালি অধ্যুষিত চট্টগ্রামে বন্দর এলাকায় আতঙ্কিত পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভিড় ছিল।” ১৯৭১ সালে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস কবলিত চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৫ হাজার অবাঙালি করাচি এসে পৌঁছে। এসব অবাঙালি শরণার্থী অবাঙালিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা প্রতিরোধে পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় তাদের বর্ণনা প্রকাশের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করে।
ত্রিশতম সাক্ষীর বিবরণ: ৪০ বছরের মোহাম্মদ ইসরাইল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইস্পাহানি নিউ কলোনির ২৮ নম্বর কোয়ার্টারে বসবাস করতেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিলে মোহাম্মদ ইসরাইল নতুন করে দুর্ভোগে পতিত হন। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি করাচিতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অবাঙালি গণহত্যাকালে তার বোন, ভগ্নিপতি এবং শিশু ভাগিনা নিহত হয়। ইসরাইল তার সাক্ষ্যে বলেছেন: “আমরা বহু বছর ধরে চট্টগ্রামে বসবাস করতাম এবং আমাদের প্রত্যেকে বাংলা বলতে পারতাম। আমি ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলাম এবং পাহাড়তলীতে আমি আমার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে তাদের বাসায় বসবাস করতাম। ৩ মার্চ বিকালে আওয়ামী লীগের জঙ্গি সমর্থকদের নেতৃতে প্রায় ৫শ’ বাঙালি ইস্পাহানি কলোনি আক্রমণ করে। এ কলোনিতে অধিকসংখ্যক অবাঙালি বসবাস করতো। আক্রমণকারীদের সঙ্গে ছিল জ্বলন্ত মশাল ও কয়েকটি বন্দুক। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার প্ররোচনা ছাড়া জনতা উন্মত্ততায় লিপ্ত হয় ৷ তারা বাড়িঘরে কেরোসিন ও পেট্রোল ছিটিয়ে অগ্নিসংযোগ করে। লোকজন ঘর থেকে বের হলে আক্রমণকারীরা গুলিতে তাদের হত্যা করে। ১০ জন সশস্ত্র বিদ্রোহী আমাদের ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলে এবং উদ্যত বন্দুক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা আমার ভগ্নিপতিকে গুলি করে। তিনি ঘটনাস্থলে নিহত হন। আমি আহত হই এবং মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকি। আমার বোন আক্রমণকারীদের বাধা দিতে গেলে তাকে বেয়নেট চার্জ করা হয়। আক্রমণকারীরা তার কোল থেকে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কেড়ে নেয়। আমার বোন যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল তখন আমার ভাগিনাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে আক্রমণকারীরা আমাদের বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি হামাগুড়ি দিয়ে একটি ভবনে যেতে সক্ষম হই। এ ভবনে আমি কয়েকদিন লুকিয়ে থাকি। আক্রমণকারীরা দু’হাজার অবাঙালির বসতি এ কলোনির প্রতিটি ঘর পুড়িয়ে দেয়। তারা জ্বলন্ত বাড়িঘরে বহু মৃত দেহ নিক্ষেপ করে৷ কয়েকজন দয়ালু বাঙালি আওয়ামী লীগের এই ঘৃণ্য আচরণ এবং নির্বিচারে অবাঙালি হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত হয় ৷ কিন্ত তার! ছিল অসহায়৷ কেননা আক্রমণকারীদের সঙ্গে ছিল বন্দুক। ৩ মার্চের পৈশাচিকতায় আওয়ামী লীগ সফল হওয়ায় উৎসাহিত এবং নিশ্চিত হয় যে, অবাঙালি নিধনে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তারা কোনো বাধার মুখোমুখি হবে না।” একত্রিশতম সাক্ষীর বিবরণ: ২৩ বছরের নূর মোহাম্মদ সিদ্দিকী চট্টগ্রামে ফিরোজশাহ কলোনিতে একটি ভাড়া করা বাসায় পিতামাতার সঙ্গে বসবাস করতো। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে সে তার অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনকে হারায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নূর মোহাম্মদ চট্টগ্রাম ত্যাগ করে করাচিতে এসে পৌঁছায়। সে তার মর্মস্পর্শী সাক্ষ্যে বলেছে: “৩ মার্চ দুপুরে আওয়ামী লীগের প্রায় ৫ হাজার সশস্ত্র কর্মী এবং তাদের সমর্থক ফিরোজশাহ কলোনি আক্রমণ করে। তাদের সঙ্গে ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের কয়েকজন সশস্ত্র বিদ্রোহী। তাদের পরণে ছিল ডিউটিকালীন ইউনিফর্ম। অবাঙালিদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্ররোচনা ছাড়া উন্মত্ত জনতা উন্মাদ হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগের জঙ্গি সমর্থকরা শত শত ঘরবাড়ি লুট করে এবং পেট্রোল ও কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাসিন্দারা দৌড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে সশস্ত্র লোকেরা খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করে।আমি আল্লাহর বিশেষ রহমতে হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাই। আক্রমণকারীরা এগিয়ে এলে আমি একটি স্টোর রূমে আত্মগোপন করি। আত্মগোপন থেকে বের হয়ে আমি আমাদের এলাকায় শত শত ভস্মীভূত ঘরবাড়ি দেখতে পাই। এলাকার সর্বত্র ছিল লাশের দুর্গন্ধ। আক্রমণকারীরা কাউকে কাউকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। এসব অর্ধমৃত লোকগুলো কাতরাচ্ছিল। কিন্তু সহায়তা করার মতো কেউ ছিল না। পুলিশ উধাও হয়ে যায়। পরদিনও আমাদের এলাকায় আক্রমণকারীরা ঘোরাফেরা করছিল। যেসব অবাঙালি কলোনি থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে তাদেরকে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়। রাতে বহু অবাঙালি মেয়েকে অপহরণ এবং খালি ঘরে ধর্ষণ করা হয়। বহু শিশুকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। মায়েদেরকে শিশুদের করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য করা হয়। দু’দিনের ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞে ফিরোজশাহ কলোনি আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত একটি লোকালয়ের রূপ ধারণ করে ৷ এ ভয়াবহ মাসের স্মৃতি আমি কোনোদিন ভুলতে পারিনি। মনে হচ্ছিল সবগুলো লোক যেন হত্যা, লুট ও ধর্ষণের জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। এ রক্তগঙ্গায় নিহতদের সবাই ছিল অবাঙালি। কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী বাঙালি তাদের অবাঙালি বন্ধুদের বাঁচানোর চেষ্টা করে। এসব পাকিস্তানপন্থী বাঙালিকে চরম শাস্তি দেয়া হয়। এমনকি হত্যা করা হয়।’
বত্রিশতম সাক্ষীর বিবরণ: ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ৪০ বছরের শরিফানের চোখের সামনে তার দু’পুত্র ও স্বামীকে হত্যা করা হয়। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেছেন: “আমার স্বামী শামসুল হক চট্টগ্রামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। আমি আমার দু’ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রামের লতিফাবাদে একটি ছোট ঘরে বসবাস করতাম। ৩ মার্চ একদল উন্মত্ত বাঙালি-অবাঙালি বস্তি এবং আমাদের এলাকায় হামলা চালায়। তারা শত শত বস্তিঘর ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। আক্রমণকারীরা হয়তো অবাঙালি পুরুষদের হত্যা করে নয়তো বন্দি হিসেবে ট্রাকে করে নিয়ে যায়। কয়েকজন অবাঙালি জ্বলন্ত ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাদেরকে রাইফেলের গুলিতে হত্যা করা হয়! ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডে অনেকে প্রাণ হারায়। একদল লোক আমার ঘর লুট করে এবং পরে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে একজন বন্দুকধারী আমাদের ওপর গুলি চালায়। আমার দু’পুত্র আহত হয়। আমি এবং আমার স্বামী হতবুদ্ধি হয়ে যাই। আমি আমার শাড়ি ছিঁড়ে তাদের ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ করে দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্ত্র ১০ মিনিটের মধ্যে তাদের শরীর নিথর হয়ে যায়। বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে আমরা নিকটবর্তী একটি মসজিদে আশ্রয় নেই। আমার স্থামী ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আমি শাড়ি থেকে আমার পুত্রদের রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলি। ঠিক এসময় আমি একটি বিকট আর্তনাদ শুনতে পাই এবং আক্রমণকারীরা মসজিদে প্রবেশ করে। তারা জানালো, মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী সকল অবাঙালি পুরুষকে হত্যা করা হবে। পুরুষরা বয়স্ক হওয়ায় আমি বন্দুকধারীদের পায়ে পড়ে তাদের জীবন ভিক্ষা চাই। একজন আক্রমণকারী তার পায়ের বুট দিয়ে আমাকে আঘাত করে।একটি রাইফেলের গুলির শব্দ হয়। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম আমার প্রিয় স্বামী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেছেন। তার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই এবং কয়েক ঘন্টা অচেতন থাকি। মসজিদে অবস্থানকারী মহিলাদের প্রিয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব মহিলা তাদের প্রিয়জনদের লাশ মসজিদের একটি কোণায় সরিয়ে রাখে। তারা নিজ নিজ শাড়ি দিয়ে চাদর বানিয়ে লাশগুলো ঢেকে রাখে। আমাদের কাছে কবর খোঁড়ার মতো কোনো শাবল অথবা খুন্তি ছিল না। আমরা অশ্রুজল, ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে মসজিদে তিন সপ্তাহের বেশি অবস্থান করি। মার্চের শেষদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদেরকে একটি স্কুল ভবনে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেয়ার পর মুক্তিবাহিনী আমাদেরকে উত্যক্ত করেছিল। কিন্তু রেডক্রস আমাদেরকে রক্ষা এবং সহায়তা করে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা করাচিতে প্রত্যাবাসন করি।’ — ব্লাড এন্ড টীয়ার্স / কুতুবউদ্দিন আজিজ (মূল: Blood and Tears । অনু: সুশান্ত সাহা) ॥ [ ইউপিপি – ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ৫৪-৬০ ] |
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018