একাত্তরের প্রসঙ্গ ও কিছু আলেমের কান্ড
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 21, 2020
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- 5 Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
লেখক পরিচিতি: বিলেতে মেডিসিনের কনসালটেন্ট; গবেষণা নিবন্ধ, পত্রিকার কলাম এবং বইয়ের লেখক; ইন্টার ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব সায়েন্টিফিক স্টাডিস অব পপুলিশেন (আই.ইউ.এস.এস.পি)’র ১৯৯৭ সালের চীনের বেইজিংয়ে ও ১৯৯৮ সালে ব্রাজিলে এবং ২০২০ সালের ফেব্রেয়ারীতে ফ্রান্সে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় ও নরম্যান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান ও গবেষণা পেপার পেশ।
উৎসব শত্রুর বিজয় নিয়ে
ইতিহাসের রক্তাত্ব ঘটনাগুলো ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় না। রক্তাত্ব স্মুতি নিয়ে সেগুলো যুগ যুগ বেঁচে থাকে। তাই কারবালার ইতিহাস মুসলিম হৃদয়ে আজও বেঁচে আছে। তেমনি বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে একাত্তরের যুদ্ধের স্মৃতিও বেদনা নিয়ে বেঁচে আছে। এবং ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকবে। প্রতিটি যুদ্ধেই দু’টি পক্ষ থাকে। এক পক্ষ জিতে, আরেক পক্ষ হারে। তেমনি প্রতিটি যুদ্ধে দু’টি আদর্শও থাকে। যেমন কারবালার যুদ্ধে ছিল দুর্বৃত্ত ইয়াজিদের আদর্শ এবং অপর দিকে ছিল জান্নাতের সর্দার ইমাম হোসেন (রাঃ)’র আদর্শ। তেমনি পলাশীতে ছিল সাম্রাজ্যাবাদী ইংরেজদের আদর্শ এবং স্বাধীনতার পক্ষের যোদ্ধাদের আদর্শ। তাই কোন যুদ্ধের দু’টি পক্ষের মূল্যায়নে শুধু বিজয় দেখলে চলে না, উভয়ের আদর্শকে দেখতে হয়। যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত হওয়াটি কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। যুদ্ধে বহু সাম্রাজ্যবাদী দুর্বৃত্ত যেমন জয়ী হয়েছে, তেমনি বহু ন্যায়-পরায়ন মানুষও পরাজিত হয়েছে। কিন্তু অতি নিন্দনীয় বিষয় হলো দুর্বৃত্তদের আদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করা এবং দুর্বৃত্ত শত্রুর বিজয় নিয়ে উৎসব করা।
অথচ বাংলাদেশে শত্রুর বিজয় নিয়েই বেশী বেশী উৎসব হচ্ছে। একাত্তরের প্রকৃত বিজয়ী হলো ভারত। তারা সেদিন যা চেয়েছিল তাই পেয়েছে। খণ্ডিত করতে পেরেছে তাদের প্রধানতম শত্রু পাকিস্তানকে। গোলাম করতে পেরেছে বাংলাদেশকে। শুধু বাজারই পায়নি, বহু দিনের কাঙ্খিত করিডোরও পেয়েছে বাংলাদেশের পেট চিরে। অপর দিকে বাংলাদেশ হারিয়েছে অনেক কিছুই। হারিয়েছে স্বাধীনতা। দেশের জনগণ হারিয়েছে ভোটের অধিকার। হারিয়েছে পদ্মা ও তিস্তাসহ বহু নদীর পানি। হারাচ্ছে নিজেদের সংস্কৃতি। অথচ সে হারানো নিয়েই বাংলাদেশীদের উৎসব। একাজ তো তাদের -যারা স্রোতের টানে খড়কুটোর ন্যায় ভেসে যাওয়া পছন্দ করে। ইমাম হোসেন (রাঃ) তার ৭২ জন সাথীকে নিয়ে শহীদ হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর অনুসারীগণ কখনোই এজিদের বিজয় নিয়ে উৎসব করেননি। বরং আজও তাঁরা ইমাম হোসেন (রাঃ)’য়ের পরাজয় নিয়ে মাতম করে। তেমনি পলাশীতে ইংরেজ বাহিনীর বিজয়ে বহু হিন্দু ইংরেজদের সাথে মিলে উৎসব করলেও বাঙালী মুসলিম তা নিয়ে শুধু মাতমই করে থাকে। ন্যায়পন্থীদের আদর্শ তো এভাবেই বেঁচে থাকে।
অন্য যে কোন যুদ্ধের ন্যায় একাত্তরে যুদ্ধে বাংলাদেশীদের মাঝে দু’টি ভিন্ন আদর্শ ছিল, দু’টি প্রতিদ্বন্দী পক্ষ্ও ছিল। তাই একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে বিচারে সে সময়ের দুটি বিপরীত আদর্শ ও পক্ষকে অবশ্যই চিনতে হবে। নইলে রায়দানে ভূল হবে এবং মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অপরাধী হতে হবে। বুঝতে হবে, সে সময় বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরে ছিল আরেকটি ভয়ংকর স্বার্থন্বেষী পক্ষ। সেটি হলো ভারত। তাদের ছিল নিজস্ব এজেন্ডা। এবং সেটি হলো ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিস্তার। ১৯৪৭ সাল থেকেই চাতক পাখীর ন্যায় ভারত অপেক্ষায় ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে ফায়দা নেয়ার। বিশেষ করে দেশটি খন্ডিত করায়। আওয়ামী লীগ সে সুযোগটিই ভারতের হাতে তুলে দেয়। তাই একাত্তরের বিচারে আওয়ামী লীগের এজেন্ডার সাথে ভারতের সে দুরভিসন্ধিকেও অবশ্যই হিসাবে রাখতে হবে।
সেক্যুলারিস্ট তথা ধর্মে অঙ্গিকারহীন হওয়ার কারণে মুসলিম ভাতৃত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠা পাকিস্তান বেঁচে থাকুক ও শক্তিশালী হোক –তা নিয়ে আওয়ামী লীগের সামান্যতম আগ্রহও ছিল না। তাদের স্বপ্নের মানচিত্রটি ছিল অতি ক্ষুদ্র্। চেতনার সে মানচিত্রে তাদের সামান্যতম আগ্রহ ছিল না মুসলিম পরিচয় নিয়ে বিশ্বমাঝে প্রতিষ্ঠা লাভে। আগ্রহ ছিল না অন্যভাষী ও অন্য এলাকার মুসলিমদের সাথে সখ্যতা গড়াতেও। ফলে তারা ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ মুসলিমদের মুসলিম ভাই রূপে গ্রহণ করতে। অথচ এ পরিচয়টি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া। অন্যদের সাথে মুসলিম ভাতৃত্ব নিয়ে বেড়ে উঠা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা ইসলামে ফরজ। কারণ সেরূপ বেড়ে উঠা ও ঐক্য গড়ার হুকুমটি এসেছে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে –যা ঘোষিত হয়েছে পবিত্র কোর’আনে। তেমন একটি ঈমানী ব্যর্থতার কারণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ কাশ্মিরে চলমান গণহত্যাকে নিন্দা না করে ভারতকে সমর্থণ করে। একাত্তরে তাদের রাজনীতির মূল কথা ছিল, বাঙালী জাতীয়তার ভিত্তিতে আলাদা বাংলাদেশ সৃষ্টি।
তাদের রাজনীতিতে শত্রু-মিত্রের ধারণাটিও ছিল ভিন্নতর। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও হিন্দু আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কিন্তু হিন্দু আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের রূচী ছিল না, তারা বরং হিন্দু ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করে । ভারতের সাথে শেখ মুজিব ও তার সহচরদের বন্ধুত্ব এ পর্যায়ে পৌঁছায় যে, পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে ভারতকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ডেকে এনে যুদ্ধ শুরুতেও তাদের আপত্তি ছিল না। ভারতের প্রতি তাদের নতজানু গোলামী চরিত্রটি এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, ১৯৭১’য়ের অক্টোবরে তাজুদ্দীনের প্রবাসী সরকার ভারতের সাথে যে ৭ দফা চুক্তি করে তাতে এ শর্তটিও মেনে নেয়, বাংলাদেশের কোন সামরিক বাহিনী থাকবে না। থাকবে শুধু প্যারামিলিটারী বাহিনী। এবং বাংলাদেশে সীমান্ত ঘিরে এক কিলোমিটার ছেড়ে দিতে হবে ভারতের জন্য মুক্ত বাজার দিতে।
অপর দিকে ইসলামী চেতনাসম্পন্ন বাঙালি মুসলিমগণ পাকিস্তানকে নিয়ে বিশাল স্বপ্ন দেখতো। পাকিস্তান তাদের কাছে ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ্। স্বপ্ন ছিল দেশটি ইসলামের সিভিলাইজেশনাল স্টেট রূপে গড়ে তোলার। তারা দেশটিকে মনে করতো মহান আল্লাহর দান রূপে। উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে গেছে। আরবগণ ২২ রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের চারি দিকে শুধু ভাঙ্গার আয়োজন। এমন এক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানপ্রেমীরা দেশটিকে দেখতো বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, মোহাজির –এরূপ নানাভাষী মুসলিমদের মাঝে প্যান-ইসলামিক ভাতৃত্বের প্রতীক রূপে। চেয়েছিল অন্যদের কাছে একতার মডেল হতে। কারণ মুসলিম জীবনে শুধু নামায-কালাম থাকলে চলে না, একতাও থাকতে হয়। মুসলিমের উপর ফরজ দায়িত্ব হলো ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলভিত্তিক ভেদাভেদের দেয়ালগুলি ভেঙ্গে সীসাঢালা ঐক্য নিয়ে খাড়া হওয়া। মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের মাঝে এরূপ একতা শুধু জায়নামাযে দেখতে চান না, দেখতে চান রাজনীতি ও যুদ্ধের ময়দানেও। ভাষা, বর্ণ ও এলাকার নামে বিভক্তি গড়া শুধু জায়নামাজেই হারাম নয়, সেটি হারাম রাজনীতির ময়দানেও। মুসলিমের কাজ তাই দেয়াল গড়া নয়, বরং ভাঙ্গা। অথচ আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভিত্তিই হলো ভাষাভিত্তিক বিভক্তির দেয়াল গড়া। শয়তান মুসলিম বিশ্বে মুর্তিপূজা বাড়াতে না পারলে কি হবে, বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে ভাষা, বর্ণ ও এলাকা পূজা। সে পূজার আধিক্যে পরস্পরে যুদ্ধ শুরুর ব্যবস্থাও করেছে। বিভেদের দেয়ালও গড়েছে। মুসলিমদের শক্তিহীন করার এটিই তো কার্যকর স্ট্রাটেজী। তেমন একটি স্ট্রাটেজী নিয়েই শেখ মুজিব একাত্তরে বাংলাদেশীদের ঘাড়ে প্রকান্ড একটি যুদ্ধ ডেকে আনে।
সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ
পানাহারে যেমন হারাম-হালাল আছে, তেমনি হারাম-হালাল আছে রাজনীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রেও। মুসলিম রাজনীতির গোলপোষ্ট কখনোই কোন মুসলিম দেশকে টুকরো টুকরো করা হতে পারে না। এটি শত ভাগ হারাম। এ হারাম কাজটি শয়তানকে খুশি করে এবং জাহান্নামে নেয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে মূল সমস্যা ছিল প্রদেশগুলির মধ্যে বৈষম্য ও বেইনসাফি। বঞ্চিত যে শুধু পূর্ব পাকিস্তান ছিল -তা নয়; বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশও ছিল। বৈষম্য ও বেইনসাফির বিরুদ্ধে লড়াই করাটি ফরজ, কিন্তু দেশ ভাঙ্গা নয়। সেটি কাফের শত্রুদের কাজ। আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন মাওলানা ভাষানীর পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিক স্বায়ত্বশাসনের দাবী তোলা হয়। জবাবে জনাব সোহরাওয়ার্দী তখন বলেছিলেন, “স্বায়ত্বশাসন আবার কিসের? পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়ে গেছে।” সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর সুস্পষ্ট হয়, আওয়ামী লীগের গোলপোষ্ট স্বায়ত্বশাসন বা ৬ দফা নয়, সেটি পাকিস্তানের বিভক্তি। শেখ মুজিব সেটিই প্রমাণ করেছেন ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানের জেল থেকে ফেরার পর সোহরাওয়ার্দী ময়দানের জনসভায় বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন একাত্তরে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছিলাম। (লেখক নিজ কানে সে ভাষণ শুনেছেন)।
মুসলিমের উপর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হলো, তাঁর প্রতিটি যুদ্ধকেই মহান আল্লাহতায়ার পথে শতভাগ জিহাদ হতে হয়। নইলে সে যুদ্ধে সে নাই্। এবং মহান আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ তো তাই, যা হয় কোন মুসলিম দেশের সংহতি, অখণ্ডতাকে প্রতিরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে। অথবা সে যুদ্ধকে হতে হয় কাফের শক্তির অধিকৃতি থেকে স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে। অথবা সেটি হতে হয় দেশে শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। একটি মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিক চেতনাভিত্তিক যুদ্ধ। ইসলামী পরিভাষায় এমন যুদ্ধকে বলা হয় “গাজওয়ায়ে আসাবিয়া”। তেমন যুদ্ধ হালাল হলে, ইসলামের প্রাথমিক যুগেই অখণ্ড মুসলিম রাষ্ট্র খণ্ডিত করে আরব, ইরানী, তুর্ক, কুর্দ,মুরদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেশ গড়া হতো –যেমনটি ইসলাম থেকে দূরে সরার কারণে পরবর্তীতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অপরাধ অনেক। সবচেয়ে বড় অপরাধটি এ নয় যে, গণতান্ত্রিক অধিকার হনন করে একদলীয় বাকশাল চাপিয়ে দিয়েছে ও দুর্ভিক্ষ ডেকে এনেছে। বরং সে অপরাধটি হলো হলো ভারতকে সাথে নিয়ে একাত্তরে বাঙালীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে একটি হারাম যুদ্ধ। আর প্রতি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নাশকতা তো বিশাল। তাই মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ নেক কর্ম হলো যুদ্ধ পরিহার করা। অথচ মুজিব ২৫শে মার্চের আগে ৭ মার্চের ভাষণে তিনি হাতের কাছে যা আছে তা নিয়ে লড়াইয়ের ডাক দিলেন। পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের ভাতে মারা ও পানিতে মারার ঘোষণা দিলেন। তার দলীয় ক্যাডারগণ তার ইঙ্গিতে শুরু করে দিল অবাঙালীদের ঘরবাড়ী ও দোকানের উপর হামলা। অবরুদ্ধ করা হলো পূর্ব পাকিস্তানের সকল সেনানীবাসগুলি। সৈন্যরা খাদ্য কিনতে কোন বাজারে বেরুলে শুরু হতো তাদের উপর হামলা।
একাত্তরের যুদ্ধে শুধু জান-মালেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, বাঙালী মুসলিমের ঘাড়ে চেপে বসেছে ভারতের দীর্ঘ গোলামী। গোলামদের স্বাধীনতা থাকে না, তা্ই স্বাধীনতা নাই্ বাংলাদেশীদেরও। একাত্তরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে অধিকৃত হওয়ার সাথে সাথে লুন্ঠিত হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ভারত শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অব্যবহৃত অস্ত্র, জিপ, সাঁজোয়া গাড়িই লুট করেনি, বরং সেনানীবাসের অফিস, ঘর ও মেস থেকে ফ্রিজ, টিভি, ফ্যানও খুলে নিয়ে গেছে। ভারতসেবীদের হাতে লুন্ঠিত হয়েছে ভোটের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তারাই আসে -যাদের প্রতি রয়েছে ভারতের আশির্বাদ। শুরু হয়েছে ইসলামপন্থিদের নির্মূল। ভারত জানে, জনগণ ভোটাধিকার পেলে তাদের অধিকৃতি টিকবে না। ফলে নিজ স্বার্থে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখায় ছাড়া তাদের উপায় নাই। অপরদিকে সীমান্তে হচ্ছে হামলা। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা সীমান্ত থেকে শুধু গরু-ছাগলই ছিনিয়ে নিচ্ছে না, বাংলাদেশীদের হত্যা করে লাশও কাটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে দিচ্ছে্। এটিই হলো একাত্তরের অর্জিত স্বাধীনতা। নেকড়ের চরিত্র বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাগে না। নিরক্ষর রাখালও সেটি বুঝে। তাই অতি পাগল বা অতি স্বার্থপর না হলে, ভারতকে চিনতে ভূল হওয়ার কথা নয়। এজন্যই কোন ইসলামী দল, কোন আলেম, কোন পীর একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেয়নি। কিন্তু শিকার ধরতে নেকড়কে সঙ্গ দেয় অন্য নেকড়ারা। তাই বাংলাদেশে আজ যারা গুম, খুন, ফাঁসি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি, ভোট-ডাকাতির নৃশংসতা বাড়িয়ে চলেছে, একাত্তরে তারাই ভারতীয় আগ্রাসনের কলাবোরেটরে পরিণত হয়েছিল। এবং আজও সে কাজে তারা বিরতি দেয়নি। অথচ পারমানবিক অস্ত্র, বিশাল সেনাবাহিনী এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মিলিত প্রায় ৪০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে পাকিস্তান বিশ্বের মানচিত্রে একটি সম্মানজনক আসন পেতে। পূর্ব পাকিস্তান পেত পশ্চিম পাকিস্তানে বস্ত্র, চা ও চর্ম শিল্পের ২২ কোটি মানুষের প্রতিযোগিতামুক্ত বিশাল বাজার। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সহজ মূল্যে পেত তূলা ও চাউল। দেশ যত বড় হয় অর্থনীতি তো এভাবেই সামনে এগোয়। এবং মজবুত হয় নিরাপত্তা। আজ বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিম বিশ্বরাজনীতিতে যেরূপ অভিভাবকহীন, সেখানে তারা পেত শক্তিশালী অভিভাবক। তাতে বাঙালী মুসলিমগণ পেত নিজ ভূমিকা পালনের সুযোগ। তখন শুধু হাত পেতে নেয়া নয়, দেয়ার সামর্থ্যও সৃষ্টি হতো্। অথচ মুজিব বাঙালী মুসলিমদের সে ভূমিকা পালন থেকে বঞ্চিত করেছে।
১৯৭১’য়ের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে তাবত দেশের মুসলিমদের হৃদয় সেদিন কেঁদেছে। ভারত ও কাশ্মিরের মুসলিম ঘরগুলোতে কান্নার রোল পড়েছে। অথচ তাতে বিপুল আনন্দের উৎসব হয়েছে ভারতের ন্যায় কাফের দেশের ঘরে ঘরে্। ভারতীয় রাজনীতিতে অতি প্রগতিশীল ও আসাম্প্রদায়িক মনে করা হয় নেহরু পরিবারকে। অথচ সে পরিবারের সন্তান ইন্দিরা গান্ধি ১৬ ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনা বাহিনীর বিজয়ে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেন, “হাজার সাল কি বদলা লে লিয়া।” অর্থ: “ভারতে হাজার বছরের মুসলিম শাসনের বদলা নিলাম।” একাত্তরের যুদ্ধে এটিই ছিল ভারতের মটিভ –যা প্রকাশ করতে ইন্দিরা গান্ধি ইতস্ততঃ করেননি। কাফের সৈন্যদের হাতে বন্দী হয় ৯৩ হাজার পাকিস্তানী। এ অপমান কি শুধু পাকিস্তানের? সেটি তো সমগ্র মুসলিম উম্মাহর। ১৪ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে আর কোথাও কি এমনটি ঘটেছে? ১৯৪৭’য়ের পর ভারতীয়দের সাথে বাঙালী মুসলিমগণ একদিনও এক রাষ্ট্রে বসবাস করেনি, অথচ পাকিস্তানীদের সাথে একসাথে ছিল ২৩টি বছর। উভয়ের সুখ-দুঃখের অনেক ইতিহাসই একত্রে জড়িত। কাফেরদের সাথে নিয়ে যারা তার মুসলিম ভাইদের বেইজ্জতি বাড়ায় -তারা কি ইজ্জত পায়? মহান আল্লাহতায়ালা কি তাতে খুশি হন? অথচ মুসলিমদের সে অপমান বাড়াতে ভারতীয় কাফেরদের সাহায্য করেছে শেখ মুজিব ও তার সাথীরা।
কিছু আলেমের কান্ড
প্লাবনের স্রোতে কচুরিপানা ও লতাপাতা ভাসে। তেমনি তীব্র প্রচারের স্রোতে অনেক মানুষও ভাসে। বাংলাদেশে বিগত ৫০ বছর ধরে চলছে সে জাহিলিয়াতের প্রবল স্রোত। সে স্রোতে ভেসেছেন এমন অনেকে যাদেরকে জনগণ আলেম রূপে চিনে। তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। সম্প্রতি মাওলানা মিযানুর রহমান আযহারীর বক্তৃতার একটি ভিডিও সোসাল মিডিয়াতে এসেছে। তাতে তিনি ওয়াজ করেছেন, এবং ওয়াজের আগে মনের মাধুরি দিয়ে গানও গেয়েছেন। সে গানের পংক্তিটি হলো, “এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা -আমরা তোমাদের ভূলবোনা….”। এ গানটি আগে সেক্যুলারিস্টদের গলায় শুনা যেত, এখন আলেমদের মুখেও শোনা যাচ্ছে। তিনি দোয়া করেছেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদদের কবরগুলো যেন জান্নাতের টুকরো বানিয়ে দেয়া হয়। দোয়া করছেন, আল্লাহতায়ালা যেন তাদের কবরগুলো তাঁর নূর দিয়ে আলোকিত করে দেন।
কারো জন্য দোয়া করায় আপত্তি থাকবে কেন? বিষয়টি দোয়া নিয়ে নয়। বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রষ্টতা ও বিভ্রাট নিয়ে। সেগুলো পরিস্কার হওয়া দরকার। নইলে ভ্রষ্টতা আরো বাড়বে। এতোদিন এ ভ্রষ্টতার শিকার ছিল বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ। এখন তাতে জড়িত হয়ে পড়ছেন আলেমগণও। সমস্যা এখানেই। দোয়া শুধু দোয়া নয়, দোয়ার মধ্য দিয়ে একটি চেতনা কথা বলে। সে চেতনায় ধরা পড়ে ব্যক্তির ঈমান। ধরা পড়ে তিনি কোন পক্ষের লোক সেটি। এখানে আলোচ্য হলো মিযানুর রহমান আযহারীর সে চেতনার বিষয়টি। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদ বলেছেন। মনে রাখতে হবে একাত্তরে দুটি পক্ষ ছিল। দুটি পক্ষে দুটি ভিন্ন চেতনা ও দুটি ভিন্ন চরিত্রের মানুষ ছিল। এ দুটি পক্ষ একাত্তরেও যেমন এক ছিল না, এখনো এক নয়। তেল ও পানি যেমন মেশে না, এরা তেমনি মেশেনি। একটি পক্ষ ছিল ইসলামের পক্ষের শক্তি। তাদের অবস্থানটি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। অপর পক্ষটি ছিল সেক্যুলারিস্ট জাতীয়তাবাদী পক্ষ। এরা ছিল ভারতকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে। একটি পক্ষকে স্বাধীনতার পক্ষ বললে, অপর পক্ষটি পরিণত হয় পরাধীনতার পক্ষের। তখন প্রশ্ন জাগে, তবে কি ২৩ বছরের পাকিস্তানী যুগটি ছিল পরাধীনতার যুগ? পূর্ব পাকিস্তান কি ছিল কলোনী? কলোনী হলে পূর্ব পাকিস্তানী খাজা নাযিমুদ্দীন, সোহরাওয়ার্দী, মহম্মদ আলী বোগরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হন কী করে? বাংলা ১৯০ বছর যাবত ছিল ব্রিটেশের কলোনী। কিন্তু কোন বাঙালী কি কখনো ব্রিটিশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছে? কলোনীর বাসিন্দাদের সে স্বাধীনতা থাকে না। মনে রাখতে হবে, একাত্তরে ভারত পাকিস্তানের জমিনে যে যুদ্ধটি শুরু করে সেটি ইসলামপন্থিদের কাছে কখনোই স্বাধীনতার যুদ্ধ রূপে গণ্য হয়নি, বরং গণ্য হয়েছে ভারতের occupational war রূপে। মনে রাখতে হবে মুক্তিবাহিনী পুরা দেশ দূরে থাক, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একটি জেলাও স্বাধীন করতে পারিনি। ফলে তারা স্বাধীনতা এনেছে –সেটি অসত্য। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে ভারতের occupational war’য়ে পাকিস্তানের পরাজয়ের পরিণতিতে। মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব না থাকলেও সেদিন ভারতের বিজয়ে কোন বাধা ছিল না। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ী হলে পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে? জনাব আযহারীর ওয়াজ শুনলে মনে হয় না যে তিনি এ সহজ বিষয়গুলো বুঝেন।
বিভ্রান্তি শহীদ শব্দটি নিয়েও। শহীদ একটি পবিত্র ইসলামী পরিভাষা যার উল্লেখ এসেছে এবং সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে পবিত্র কোর’আন ও হাদীসে। শহীদ তো তারাই হয় যারা ঈমানদার এবং প্রাণ দেয় ইসলামকে বিজয়ী করতে বা মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা দিতে। ইসলামে বিজয়ী করা বা মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষার কাজকে বলা হয় জিহাদ। অথচ আওয়ামী লীগ কখনোই এ দাবী করেনি যে তাদের একাত্তরের যুদ্ধটি জিহাদ ছিল। তাই প্রশ্ন যুদ্ধটি জিহাদ না হলে সে যুদ্ধে কেউ নিহত হলে সে ব্যক্তি শহীদ হয় কি করে? এ প্রশ্নের উত্তরটি পরিস্কার হতে হবে। এ নিয়ে ধোঁয়াশে ভাব থাকাটি উচিত নয়। বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের একাত্তরের চেতনাটি ছিল ইসলামমুক্ত। এখানে ইসলামী চেতনার কোন স্থান ছিল না। এ চেতনার মূল উপাদান হলো ধর্মনিরেপক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। অথচ মুসলিমের পক্ষে ধর্মনিরেপক্ষবাদী হওয়া যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো জাতীয়তাবাদী হওয়াও। ইসলাম ও অনৈসলামের দ্বন্দ তো সর্বত্র ও সর্বমুহুর্তে। ইসলাম কবুল করার সাথে সাথে একজন মুসলিমের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ থাকে না; তাকে ইসলামের পক্ষ নিতে হয়। ইসলামের বিজয়ে নিজের অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ হয় কি করে? অপরদিক জাতীয়তাবাদ হলো, ভাষা, বর্ণ ও এলাকা ভিত্তিক চেতনা নিয়ে মুসলিম উম্মাহকে বিভ্ক্ত করার মতবাদ। এ মতবাদের মূল এজেন্ডা হলো মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত মুসলিম ঐক্যের চেতনাকে দাফন করা। ফলে তাদের অবস্থান তো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিপক্ষ রূপে। তাদের মূল এজেন্ডা তো মুসলিম উম্মাহর দেয়ালে ফাটল ধরানো। একাজ তো শত ভাগ হারাম। বিভক্তি গড়ার এ ঘৃণিত হারাম কাজটি হালাল হয় কি করে? তাদের যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধই বা হয় কি করে? মুসলিমের প্রতিটি যুদ্ধকে হতে হয় ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। কিন্তু আওয়ামী লীগের যুদ্ধ কি কখনো ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে ছিল? সে দাবী কি কখনোই তারা করে?
আরেক প্রশ্ন, তাদের একাত্তরের যুদ্ধ কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল? শরিয়তের বিধানে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধটি হলো মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করা। এটি তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এটি মুসলিম উম্মাহকে পরাজিত ও অপমানিত করার ষড়যন্ত্র। এতে বিপন্ন হয় কোটি কোটি মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুর নিরাপত্তা। তাতে অসম্ভব হয় পরিপূর্ণ দ্বীন পালন তথা শরিয়ত পালন। শরিয়তের দৃষ্টিতে সেটি ফেতনা। পবিত্র কোর’আনে এমন ফেতনা সৃষ্টিকে মানব হত্যার চেয়েও জঘন্য বলা হয়েছে। যে কোন রাষ্ট্রে এমন অপরাধের শাস্তি তো প্রাণদন্ড। অপরাধ তো প্রতিরাষ্ট্রেই হয়। নানাবিধ অপরাধ তো বাংলাদেশেও হচ্ছে? বাংলাদেশে ভোটের উপর ডাকাতি হয়েছে। শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যা হয়েছে। গুম-খুম-সন্ত্রাসের জোয়ার এসেছে। মুজিব আমলে ৩০ হাজারের বেশী বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাই বলে কি বাংলাদেশকে খণ্ডিত বা ধ্বংস করতে হবে? কিছু লোকের হতাহতের মধ্য দিয়ে একটি জাতির এতোটা ক্ষতি হয়না যতটা ক্ষতি হয় ভূগোল খণ্ডিত করলে। ভূগোল বাড়লে শক্তি বাড়ে; ইজ্জতও বাড়ে। সাহাবাগণ ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্যে নানা দেশে অভিযান চালিয়েছেন। নবীজী রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল দখলের নসিহত করেছেন। আজকের মুসলিমদের পতিতদশার মূল কারণ তো খণ্ডিত ভূগোল। এক ইঞ্চি ভূগোল বাড়াতে যুদ্ধ করতে হয়; অর্থ ও রক্ত ব্যয় করতে হয়। তাই মানব হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হলো দেশের ভূগোল খণ্ডিত করা। এতে কোটি কোটি মানুষের জীবন, ইজ্জত-আবরু ও সম্পদ বিপন্ন হয়। একাত্তরের আরোপিত যুদ্ধে তো সেটি হয়েছে।
একাত্তরে আরেকটি পক্ষও বিশাল সংখ্যায় প্রাণ দিয়েছে। তাদের সংখ্যা মুক্তিবাহিনীর নিহতদের চেয়েও অধীক। তাদের কবরও রয়েছে এ বাংলাদেশে। তাদের মধ্য রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ বহু দলের হাজার হাজার কর্মী। রয়েছে বহু হাজার শান্তি কমিটির সদস্য। রয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসার বহু হাজার ছাত্র যারা সে সময়কার ইসলামী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী ছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত মাওলানা মোস্তাফা আল-মাদানী, মৌলভী ফরিদ আহম্মদ, মাওলানা আসাদুল্লাহ সিরাজী (প্রখ্যাত লেখক ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর পুত্র) ন্যায় শত শত আলেম ও ইসলামী চেতনার নেতৃবিন্দু। নিহত হয়েছেন হাজার হাজার অবাঙালী নারী, পুরুষ ও শিশু। তারা তো নিহত হয়েছে ইসলাম ও পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশের সংহতির পক্ষ নেয়াতে। তারা সেক্যুলার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষের লোক। তারা দাঁড়িয়েছিলেন হিন্দু ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। একটি হিন্দু ও মুসলিম রাষ্ট্রের মাঝে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন ঈমানদার কার পক্ষ নিবে? সে কি কাফর ভারতের পক্ষে নিতে পারে? একাত্তরে এজন্যই কো ইসলামী দল, কোন আলেম, কোন পীর, মাদ্রাসার কোন ছাত্র এবং মসজিদের কোন ইমাম পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেয়নি। যাদের মধ্যে সামান্যতম ইসলামী চেতনা ছিল তারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার ভারতীয় প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিল না। পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রজেক্টটি ছিল একান্তই ভারতমুখি ও ইসলাম বিরোধী বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের। নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃবিন্দু। আজও এরাই বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা রূপ ষড়যন্ত্র করছে। চালু করছে মুর্তিপূজার সংস্কৃতি। এবং শাসনতন্ত্র থেকে সরিয়েছে “মহান আল্লাহতায়ালার উপর আস্থা”র ঘোষণাটি। বাংলাদেশ যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ –সে পরিচিতিও তারা মুছে ফেলতে চায়। অথচ জনাব মিযানুর রহমান আযহারীর ভ্রষ্টতা এখানে সুস্পষ্ট। তিনি তাঁর দোয়ায় তাদের পক্ষ নিয়েছেন -যারা একাত্তরে ভারতীয় কাফেরদের পক্ষ নিয়েছিল।
এবার আরেক আলেম মাওলানা মামুনুল হকের প্রসঙ্গে আসা যাক। ইসলামে একতা গড়া ফরজ। ঈমানদার মাত্রই যেমন প্রতি ওয়াক্ত নামায পড়া নিয়ে পেরেশান থাকে, তেমনি পেরেশান থাকে মুসলিমদের মাঝে একতা গড়া নিয়েও। মুসলিম ঐক্যের বিষয়টি তাঁর অস্তিত্বের সাথে মিশ্রিত। কারণ সে জানে, একতার পক্ষে না দাঁড়ালে আযাব থেকে রক্ষা নেই্। সে আযাব বেনামাযী হওয়ার আযাবের চেয়ে কম নয়। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সে কঠোর আযাবের হুশিয়ারিটি এসেছে সুরা আল-ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। অথচ জনাব মাওলানা মামুনুল হক বাহনা খুঁজছেন কি করে সে করে ঐক্যকে অসম্ভব করা যায়। সে জন্য তিনি ইতিহাস ঘেঁটেছনে। তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীকে আগে একাত্তর নিয়ে মাফ চাইতে হবে। তারপরই তাদের সাথে একতা সম্ভব। মাওলানা মামুনুল হক পড়াশুনা করেছেন দেওবন্দী তরিকার কাওমী মাদ্রাসায়। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তাঁর ক্রোধের কারণ, জামায়াত একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। তিনি কি জানেন, কীরূপ ছিল একাত্তরে কাওমী মাদ্রাসার হুজুরদের ভূমিকা?
কাওমী মাদ্রাসার হুজুরদের রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ছিল নেজামে ইসলামী পার্টি। এ পার্টির নেতা চৌধুরী মোহম্মদ আলী ১৯৫৬ সালে ছিলেন পাকিস্তানে প্রধামন্ত্রী। তার আমলেই রচিত হয় পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র। তখন নেজামে ইসলামী পার্টির আরেক নেতা ও প্রখ্যাত পার্লামেন্টারীয়ান কক্সবাজারের মৌলভী ফরিদ আহমেদ ছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। এবং চট্রগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব ছিলেন নিযামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। মাওলানা সিদ্দিক আহমদ পাকিস্তান ভাঙ্গাকে হারাম বলতেন। তাদের দলের আরেক নেতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী সাহেব। তিনিও পাকিস্তান ভাঙ্গাকে হারাম বলতেন। তাদের সে সব বয়ান যুদ্ধকালীন ৯ মাসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা গুলিতে লিপিবদ্ধ আছে। অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর বইতে লিখেছেন, পাকিস্তান বাঁচাতে জামায়াতে ইসলামীর চেয়ে বেশী তৎপর ছিল নিযামে ইসলাম পার্টির নেতাকর্মীগণ। বিশেষ করে শান্তিবাহিনী গড়ে তোলা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতার ব্যাপারে। এ বিষয়গুলিতে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নেন নিযামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মৌলভী ফরিদ আহমেদ। একাত্তরে দেওবন্দী কাওমী মাদ্রাসার নেতাদের এটিই যখন ভূমিকা, জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকার বিরুদ্ধে মাওলানা মামুনুল হকের এতো আক্রোশ কেন? একতা গড়ার ন্যায় ফরজ কাজে সেটি বাধাই বা হবে কেন? নামাযের কাতারে শামিল হতে কি কোন শর্ত থাকে? মুসলিম উম্মাহর একতা গড়তেই বা শর্ত থাকবে কেন?
চাপাদেয়া ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় শুধু একটি পক্ষের বক্তব্যকেই বিপুল প্রচার দেয়া হয়েছে। সেটি একাত্তরের চেতনাধারীদের বক্তব্য। কিন্তু তাদের বাইরেও আরেকটি পক্ষ ছিল। কিন্তু তাদের বক্তব্যগুলি পরিকল্পিত ভাবে চাপা দেয়া হয়েছে। অথচ কি ছিল তাদের বক্তব্য এবং কোন যুক্তিতে তারা পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করলো –সে কথাগুলিও তো সবার সামনে আসা উচিত। আদালতে বাদী-বিবাদী –উভয় পক্ষেরই বক্তব্য পেশের সুযোগ দেয়া হয়। নইলে অসম্ভব হয় ন্যায় বিচার। তেমন জনগণ যাতে একাত্তর নিয়ে ন্যায় বিচার করতে পারে সেজন্য একাত্তর নিয়ে অন্য পক্ষের বক্তব্যও সামনে আসা উচিত। এ ধারণা ঠিক নয় যে শধু জামায়াত ইসলামী, নিযামে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, জমিয়তে ইসলামের ন্যায় কিছু সংগঠন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। বরং পক্ষ নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিককর্মী। নিম্নে তাদের কিছু বয়ান তুলে ধরা হলো।
১৯৭১ সালের ১৭ মে তারিখ দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) একটি বিবৃতি ছাপা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “পাকিস্তানী শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের অভাব-অভিযোগ রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এ অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্রের কাঠামোর আওতায় পূর্ব পাকিস্তাঅনের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা এ সহজ সরল আইন-সঙ্গত দাবীকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবীতে রূপান্তরিত করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। বাঙালী হিন্দু বিশেষ করে কলকাতার মারোয়াড়ীদের আধিপত্য ও শোষণ এড়ানোর জন্যই আমরা বাংলার মুসলমানেরা প্রথমে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে আমাদের পৃথক পূর্ব বাংলা প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত নেই এবং ১৯৪৭ সালে ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রদেশের মুসলিম ভাইদের সাথে যুক্ত হওয়ার সচেতন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উক্ত সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত হওয়ার আমাদের কোন কারণ নেই। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর সেটা আমাদের আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিলো। ঠিক তখনই চরমপন্থীদের দুরাশায় পেয়ে বসলো এবং জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুললো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলোচনা কালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু উল্টোটাই ঘটে গেলো এবং নেমে এলো জাতীয় দুর্যোগ। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা আশাবাদী হ্ওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত এবং বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূলে হওয়ার সাথে সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা আবার ঘোষণা করেছেন। এমতবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানের বন্ধু এ্যাকাডিমিশিয়ানরা আমাদের কল্যাণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করায় আমরা কৃতজ্ঞ। তবে আমরা আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন বড় ধরণের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও নিন্দা করছি।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে যারা ছিলনে তারা হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, লেখক নাট্যকার শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান এম. কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. মীর ফখরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের রিডার ড. কাজী দীন মোহম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও নাট্যকার নূরুল মোমেন, কবি আহসান হাবিব, অভিনেতা-চিত্রপরিচালক-সঙ্গীত পরিচালক খান আতাউর রহমান, গায়িকা শাহনাজ বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার ও নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখ, গায়িকা ফরিদা ইয়াসমিন, পল্লী গীতির গায়ক আব্দুল আলীম, লেখক-প্রয়োজক-চিত্রপরিচালক আব্দুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, লেখক-প্রয়োজক-চিত্রপরিচালক ও.এ. এইচ. চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মোহর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মুনীর চৌধুরী, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের ড. আশরাফ সিদ্দিকী, গায়ক খোন্দকার ফারুক আহমদ, গায়ক এম. এ. হাদি, গায়িকার নিনা হামীদ, গায়িকা লায়লা আন্জুমান্দ বানু, শামসুল হুদা চৌধুরী (জিয়া ক্যাবিনেটের মন্ত্রী, পরবর্তীততে এরশাদ সরকারের সংসদ স্পীকার), শিল্পী বেদার উদ্দিন আহমেদ, গায়িকা সাবিনা ইয়াসমীন, গায়িকা ফেরদৌসী রহমান, গায়ক মোস্তাফা জামান আব্বাসী, গল্পকার সরদার জয়েন উদ্দীন, লেখক ও সমালোচক সৈয়দ মুর্তজা আলী, কবি তালিম হোসেন, গল্পকার শাহেদ আলী, মাহে নও সম্পাদক কবি আব্দুস সাত্তার, নাট্যকার ফররুখর শীয়র, কবি ফররুখ আহমদ, পাকিস্তান অবজারবার (পরবর্তীতে বাংলাদেশ অবজারবার) সম্পাদক আব্দুস সালাম, মর্নিং নিউজ সম্পাদক এ.জি. এম. বদরুদ্দীন, দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) সম্পাদক আবুল কালাম সামসুদ্দীন, অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক ফতেহ লোহানী, কবি হেমায়েত হোসেন, লেখক আকবর উদ্দীন, লেখক আকবর হোসেন, অধ্যক্ষ এ. কিউ. এম. আদম উদ্দিন, নাট্য শিল্পী আলী মনসুর, লেখক আফসার উদ্দীন আহমদ, লেখক ও সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী, কবি ও লেখক সামসুল হক, লেখক সরদার ফজলুল করিমি, গায়িকা ফাওজিয়া খান প্রমুখ ৫৫ জন নেতৃস্থানীয় শিক্ষাবিদ, কবি, শিল্পী ও বুদ্ধীজীবী।
১৯৭১ সালের ২৭ জুনে দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) আরেকটি বিবৃতি ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, “আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর বেদনা বোধ করছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, ভারতীয় যুদ্ধবাজ যারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টিকে কখনো গ্রহণ করেনি প্রধানত তাদের চক্রান্তের ফলেই এটা হয়েছে। …আমরা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশংসা করছি। … আমরা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা বিপন্ন করার জন্য চরমপন্থীদের নিন্দা করছি। বহির্বিশ্বের চোখে পাকিস্তানের মর্যাদা হ্রাস ও পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা এবং অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে আমাদের ঘরোয়া ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আমরা নিন্দা করছি…”। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর এবং আইন বিভাগের ডীন ইউ. এন. সিদ্দিকী, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ও সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুল করিম, সমাজ বিজ্ঞানের ডীন ড. এম. বদরুদ্দোজা, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার মোহম্মদ ইনামুল হক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের রিডার মোহম্মদ আনিসুজ্জামান, ইংরাজী বিভাগের সিনিয়র লেকচারার খোন্দকার রেজাউর রহমান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার সৈয়দ কামাল মোস্তাফা ও এম. এ. জিন্নাহ, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচারার রফিউদ্দীন, রসায়ন বিভাগের প্রধান এ.কে. এম. আহমদ, সমাজ বিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার রুহুল আমীন, বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মোহম্মদ আলী ইমদাদ খান, ইতিহাসের সিনিয়র লেকচারার হোসেন মোহম্মদ ফজলে দাইয়েন, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোহম্মদ দিলওয়ার হোসেন, সংখ্যাতত্ত্বের সিনিয়র লেকচারার আব্দুর রশিদ, ইতিহাস বিভাগের রিডার মুকাদ্দুসুর রহমান, ইতিহাসের লেকচারার আহসানুল কবীর, অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার শাহ মুহম্মদ হুজ্জাতুল ইসলাম, ইংরাজী বিভাগের প্রধান মহম্মদ আলী, পদার্থ বিদ্যা বিভাগের রিডার এজাজ আহমদ, গণিতের লেকচারার এস. এম.হোসেন, গণিত বিভাগের রিডার জেড. এইচ. চৌধুরী, সংখ্যাতত্ত্বের লেকচারার হাতেম আলী হাওলাদার, বাংলা বিভাগের রিডার ড. মোহম্মদ আব্দুল আওয়াল, বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান হায়াত (লেখক হায়াত মাহমুদ), ইতিহাসের গবেষণা সহকারী আব্দুস সায়ীদ, অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার মোহাম্মদ মোস্তাফা, ইতিহাসের লেকচারার সুলতানা নিজাম, ইতিহাসের রিডার ড. জাকিউদ্দীন আহমদ এবং ফাইন আর্টসের লেকচারার আব্দুর রশীদ হায়দার।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তান অবজারভার (পরবর্তীতে বাংলাদেশ অবজারভার) পত্রিকার মালিক প্রখ্যাত আইনবিদ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, “ভারতীয় প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা এবং তার দ্বারা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এদেশের অস্তিত্বকে বিলোপ করে নিজস্ব সম্প্রসারণবাদী মনোভাবকে চরিতার্থ করা।” (সূত্র: একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ পৃষ্টা ৪৮, বিবৃতিটি ৬ এপ্রিল ১৯৭১’য়ে দেয়া হয়।) জিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বলেন, “প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রবল উৎকন্ঠার সাথে রাজনৈতিক দলসমুহকে অধিকতর স্বাধীনতা প্রদান পূর্বক দেশে পূর্ণ ও বাধাহীন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এ সুযোগের ভূল অর্থ করে বলপ্রয়োগের ….মাধ্যমে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়লাভ করে নিজেদের খেয়াল খুশীতে দেশ শাসন করার দাবী করে এবং এভাবেই অহমিকা, অধৈর্য ও ঔদ্ধত্যের ফলে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়।….আমি সাম্রাজ্যবাদী ভারতের দুরভিসন্ধি নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।” (সূত্র: একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ পৃষ্টা ৯১, বিবৃতিটি ৪ মে ১৯৭১’য়ে ছাপা হয়)। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টির প্রধান জনাব নূরুল আমীন বলেন, “পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও হিন্দু আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি এবং সে সংগ্রামে আমরা জয়ী হয়েছি। ….আজও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আমাদের বিরুদ্ধশক্তির মুকাবিলা করতে হবে। -(দৈনিক সংগ্রাম, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১)। মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, “জাতি তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে।…পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৬ জন পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। …পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করে যাব। কারণ যদি পাকিস্তানই না থাকে, তবে অধিকারের জন্য সংগ্রামের অবকাশ কোথায়?” –(দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ জুলাই, ১৯৭১)।
পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ৮ এপ্রিল ১৯৭১’য়ে এক বিবৃতি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে ছিনিমিনি খেলতে দিবে না। … পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের শত্রুদের কাছে সহানুভূতি কামনা করে না। জনগণ তাদের অধিকার চায় এবং কিভাবে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে সেটা হলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। … অসৎ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিটি পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের ব্যাপারে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের দুরভিসন্ধি বর্তমানে ফাঁস হয়ে গেছে। … ভারতীয়রা কি মনে করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এতদূর অধঃপতন হয়েছে, তারা ভারতকে তাঁদের বন্ধু ভাববে?” –(দৈনিক সংগ্রাম, ৮ এপ্রিল, ১৯৭১)।
বিলুপ্ত হোক ইতিহাসের মিথ্যাচার
একাত্তরের পর ৫০টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অথচ সে ইতিহাসের এখনো কোন সুষ্ঠ মূল্যায়ন হয়নি। ইতিহাসের কিতাব থেকে মিথ্যাচার ও পক্ষপাতের আবর্জনা এখনো দূর করা হয়নি। মিথ্যা দিয়ে ঢাকা হয়েছে সত্যকে। অথচ জাতি তার অতীতকে এবং সে সাথে শত্রু ও মিত্রদের চিনতে পারে ইতিহাসের সত্য বয়ান থেকে। এতদিন ইতিহাস চর্চার নামে যা হয়েছে তা হলো ভারতের ন্যায় চিহ্নিত শত্রুকে বন্ধু রূপে পরিচিত করানোর। ভূলিয়ে দেয়া হয় ভারতে ভয়ানক অপরাধগুলোও। সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের খাড়া করা হয়েছে শত্রু রূপে। প্রতিটি যুদ্ধের বিজয়ী পক্ষ সেটিই করে থাকে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পারমানবিক বোমায় জাপানের দুটি শহর ধ্বংস হওয়াটি ততটা নিন্দিত হয়নি -যতটা হয়েছে নিউয়র্কের টুইন টাওয়া বিধ্বস্ত হওয়াটি। বাংলাদেশের একাত্তরের ইতিহাসের উপর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ভারতপন্থিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এর ফলে ভারতের একাত্তরের নিরংকুশ বিজয়কে বাংলাদেশীদের বিজয় রূপে গেলানোর কাজটিও সহজ হয়েছে। একাত্তরের পর বাংলাদেশে জনগণের জীবনে যে দুঃসহ দুর্দিন নেমে আসে ইতিহাসের বইয়ে সে বর্ণনা স্থান পায়নি।
ইতিহাস চর্চার কাজটি গুরুত্ব অতি অপরিসীম। ইতিহাস এমন কিছু শেখায় যা অন্য কোন শাস্ত্র শেখায় না। ইতিহাস দেয় অতীতের ভূল, নিজেদের ব্যর্থতা এবং অপরাধীদের অপরাধ থেকে শিক্ষা নেয়ার ছবক। পবিত্র কোর’অআনে তাই বার বার ইতিহাসের শিক্ষা পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “ফাসিরু ফিল আরদ ফানজুর কাইফা কানা আক্বিবাতুল মোকাজ্জিবীন” অর্থ: “ভ্রমন করো জমিনের উপর এবং দেখো মিথ্যুকদের পরিণাম কি হয়েছিল।” মিথ্যুক অপরাধীগণ বিশ্ববাসীদের জন্য অমূল্য শিক্ষা রেখে যায়। তাই একাত্তরের মিথ্যুকগণ যারা গণতন্ত্র, সোনার বাংলা এবং আট আনা সের চাল খাওয়ানার ওয়াদা দিয়েছিল তাদের অপরাধ ও পরিণাম থেকেও শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে। ইতিহাস যারা পাঠ করে না, তারা একই ভূল বার বার করে। আর এতে জাতি বার বার বিপদের মুখে পড়ে। এতে বিপুল ভাবে বাড়ে অর্থ ব্যয় ও রক্ত ব্যয়।
তাই শত্রুগণ দেশের কৃষিক্ষেত, রাস্তাঘাট বা স্কুল-কলেজ ধ্বংসে ততটা মনযোগী নয়, যতটা মনযোগী ইতিহাস বিকৃত করায়। ভারত দখলে নেয়ার পর এদেশের ইতিহাস লেখার কাজটি ইংরেজগণ নিজ হাতে নেয়। লক্ষ্য ছিল মুসলিম শাসকদের চরিত্রহীন হিসাবে চিত্রিত করা। তারা যে ভারতবাসীর কোন কল্যাণই করেনি, শুধু অকল্যাণই করেছে -সেটি হিন্দুদের মনে বদ্ধমূল করা। এভাবে তারা ধ্বংস করে দেয় ইতিহাসের সত্য বয়ান। ভারত ও তার সেবাদাসগণ একই কাজ করেছে বাংলাদশের ইতিহাস রচনায়। জাতির মগজ তারা মিথ্যায় পরিপূর্ণ করেছে। এর ফলে ছাত্র-শিক্ষকই শুধু নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরগণও মিথ্যার প্রচারকে পরিণত হয়েছে। এতে নৃশংস ফ্যাসিবাদী খুনিও জাতির পিতা, দেশের বন্ধু ও মাননীয় নেতা বা নেত্রীর মর্যাদা পেয়েছে। অতীতে একই পথে ফিরাউন ভগবানে পরিণত হয়েছিল। এবং হযরত মূসা (সাঃ)’র মত নবীও দুর্বৃত্তি রূপে চিত্রিত হয়েছিল। মিথ্যার একই রূপ নাশকতা বাংলাদেশেও চলছে। ফলে দেশপ্রেমিক সৎ মানুষেরা শত্রু রূপে চিহ্নিত হচ্ছে। বিষ যেমন প্রাণনাশ ঘটায়, মিথ্যা তেমনই ঈমাননাশ ঘটায়। দুর্বৃত্তরা তাই মিথ্যাকে প্রবল ভাবে বাঁচাতে ও বাড়াতে চায়। বাংলাদেশে সন্ত্রাস তাই শুধু রাজনীতিতে হয়না, বরং সেটি যেমন বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে, তেমনি ইতিহাস রচনাতেও। লড়াইয়ের এ রণাঙ্গণে তাই সত্যসেবী সৈনিকের প্রয়োজনটি অতি বেশী। ইসলামে এ লড়াইও পবিত্র জিহাদ। ২১/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018
অসাধারণ ইতিহাস বণনা করার জন্য ধন্যবাদ। লেখাটায় তাদের জন্য শিক্ষণীয় যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় আজও আত্মগ্লানিতে ভোগে।
এক্সেলেন্ট। দয়া করে লিখে যান। একজন দু’জন করে হলেও কিছু মানুষ সত্যকে ধারণ করবে। আর সত্যকে ধারণ করে চলাই হল সবচেয়ে বড় কথা।
অসাধারণ! সত্যিকার ইতিহাস কেউ পড়েনা, পড়তেও দেয়ও না ইসলামী বক্তারাও পিঠ বাচানেরা জন্য ইদানিং বঙ্গবন্ধুকে আসমানে তুলে বক্তব্য শুরু করে ঈমানের চেতনা বড়ই কঠিন বহুত শুকরিয়া স্যার আপনার হক কথা তুলে ধরার জন্য
ভারতের আধিপত্যকে রুখে দেওয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সকল ঈমানদারের কর্তব্য
I am interested to get connected with you and with this blog Drfirozmahboobkamal.com