গণতন্ত্র ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন সমীকরণ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

বাংলার বুকে মুসলিম শাসনের শুরু প্রায় ৮ শত বছর আগে। কিন্তু কোন মুসলিম শাসকের হাতে একটি মূর্তিও নির্মিত হয়নি। একাজ ছিল একমাত্র হিন্দুদের। মূর্তিপূজা শিরকের প্রতীক। তবে ইসলাম থেকে যারা দূরে সরেছে বা ইসলাম বর্জন করেছে তারা ফিরে গেছে মূর্তি নির্মাণে। সেটি সেক্যুলারিস্ট অধিকৃত তুরস্ক ও আরব দেশগুলিতে দেখা যায়। ইসলামের আগমন মূর্তি গড়তে আসেনি; বরং মূর্তি ভাঙ্গাই ছিল মাহান নবীজী’র ও হযরত ইব্রাহিম (আ:)’র সূন্নত। ইসলামের শুরুই হয়েছে পৌত্তলিকতা নির্মূলের যুদ্ধ নিয়ে। তাই বাংলার বুকে মূর্তি একমাত্র মন্দিরে শোভা পেয়েছে, রাজপথে ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নয়। পাকিস্তান আমলেও পূর্ব পাকিস্তানে কোন মূর্তি রাজপথে বসানো হয়নি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পরও হাসিনার পূর্বে কেউই রাজপথে মূর্তি বসায়নি -যদিও শেখ মুজিব তার নিজের মূর্তি সিরাজ শিকদারের বোন শামীম শিকদারকে দিয়ে গড়িয়ে নিয়েছিল এবং ঢাকার জেল খানায় বসিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা হাজির হয়েছে হিন্দুত্ববাদের গর্বিত সৈনিক রূপে। হাসিনা শত শত মূর্তি বসিয়েছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। এভাবেই সে হিন্দুত্বায়নের কাজটি করেছে বাংলাদেশের ন্যায় সংখ্যাগরষ্ঠ মুসলিমের দেশে।

 হিন্দুত্ববাদীগণ এতোটাই প্রশ্রয় পেয়েছে যে, হিন্দুত্ববাদের নেতারা বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের সাথে সংযুক্ত করার পক্ষে প্রকাশ্যে দাবী তুলেছে। তাই গোবিন্দ প্রামানিকের মত বাংলাদেশীয় রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (RSS) সদস্য এক আলোচনা সভা য় বলেছে, “‌‍আমাদের এই বাংলায় বহু ঋষির জন্ম হয়েছে, তাই এ ভূমিকে অখণ্ড ভারতের বাইরে রাখতে পারি না; অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে।” তার সে বক্তৃতার ভিডিও ইউটিউবে দেখা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এতো বড় বক্তব্য পেশের পরও তাকে হাসিনার আমলে গ্রেফতার করা হয়নি। তাকে নিয়ে হাসিনা সরকারের এরূপ নীরবতার সুস্পষ্ট কারণও রয়েছে। কারণ, গোবিন্দ প্রামানিকের রয়েছে খুঁটির জোর। যে হিন্দুত্ববাদী সরকার থেকে গোবিন্দ প্রামানিক ইন্ধন পায়, সে অভিন্ন হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য পায় খোদ হাসিনা। ভারতের সাহায্য নিয়ে শেখ হাসিনা ভোটডাকাতি করছে এবং দুঃশাসন চালাচ্ছে। তাদের উভয়ই গোলাম হলো ভারতীয় প্রভুর। তাই গোবিন্দ প্রামানিককে শেখ হাসিনা গ্রেফতার করবে কোন সাহসে? হাসিনার মিশন, বাংলাদেশ যাতে কোন ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত না হয় -সেটি রোধ করা। হাসিনার এজেন্ডা কখনোই অখণ্ড ভারতের অংশ হওয়া থেকে ঠেকানো ছিল না। গোবিন্দ প্রামানিকগণ একারণেই অখণ্ড ভারতে শামিল হওয়া নিয়ে নিজেদের মনের বাসনাটি এতোটা জোরের সাথে প্রকাশ্যে বলতে পারে।

আবু লাহাব, আবু জেহেল ও তাদের সাথীরা শয়তানের পৌত্তলিক প্রকল্পকে এতো বড় বিজয় দিতে পারিনি -যা দিয়েছিল হাসিনা। এবং হিন্দুত্ববাদের সে বিজয়টি দিয়েছে ৪ লাখ মসজিদের দেশ বাংলাদেশে? বাংলাদেশ শুধু মসজিদের দেশ নয়, এদেশের শতকরা ৯১ ভাগ জনগণ নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী কর। হিন্দুত্ববাদের পক্ষে এ বিশাল কাজের জন্যই ভারতের মূর্তিপূজারী শিবিরে হাসিনার গ্রহনযোগ্যতা এতোটা প্রবল। হাসিনাকে তারা একান্তই নিজেদের লোক মনে করতো। ফলে হাসিনার পতনে তারা এতোটা মর্মাহত যে সে পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ছাত্র-জনতার এ বিশাল বিপ্লবকে তারা বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্র বলছে। ভারতীয় মিডিয়ার কথা, হাসিনাকে ষড়যন্ত্র করে তাড়িয়েছে পাকিস্তানী ISI এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের CIA। যেন বাংলাদেশের জনগণ নিজ সামর্থ্যে কোন স্বৈরশাসককে হটানোর সামর্থ্য রাখে না।

যেহেতু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনার বিজয় অসম্ভব ছিল, সেজন্যই ভারত তাকে ভোটডাকাতির পূর্ণ লাইসেন্স দিয়েছিল। ভারতীয় কুটনীতিকেরা হাসিনার ভোটডাকাতিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলে বিশ্বের দরবারে প্রচার করতো। এবং বিভিন্ন দেশের নেতাদের তারা বুঝাতো পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদ-আক্রান্ত বাংলাদেশে এর চেয়ে ভাল নির্বাচন সম্ভব নয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন-পূর্বে ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছিল, বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের উত্থান রোধে হাসিনার বিকল্প নাই। আরো বলেছিল, হাসিনার বিরুদ্ধে কোনরূপ হস্তক্ষেপ নিলে সেটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য সংকট সৃষ্টি করবে। হাসিনা চীনমুখী হবে এবং সংকট সৃষ্টি করবে পাশ্চাত্য বিশ্বের জন্য। ভারতের আরো যুক্তি, নির্বাচন যে ভাবেই অনুষ্ঠিত হোক -সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের দাবী, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টি করলে সেটি হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য বিশ্ব ভারতের সে যুক্তি মেনে নেয়। কারণ, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু ভারতের নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য বিশ্বেরও। ভারতের ন্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চায় না একটি মুসলিম দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক এবং মুসলিমদের ক্ষমতায়ন হোক। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার শক্তির মুখে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকল্প টিকেনি; হাসিনাকে প্রাণ ভয়ে পালাতে হয়েছে।

শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিজয়কে সব সময় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের বিজয় মনে করেছে। এবং এখন হাসিনার পরাজয়কে তারা নিজেদের পরাজয় মনে করছে। ফলে ২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট হাসিনার পতন ও পলায়নকে ভারত মেনে নিতে পারছে না। ১৯৭১’য়ে বিহারী ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নির্মূলের যুদ্ধটি ভারত সব সময়ই লড়েছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। তাদের যৌথ যুদ্ধটি ছিল ভারতীয় দখলদারি বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে। ভারত শুধু বাংলাদেশে ভিতরে লড়ছে না, বাইরে থেকেও লড়ছে। ভারত ও ভারত প্রতিপালিত আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের লড়াই এরূপ সকল শক্তির বিরুদ্ধে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র চায়। বাংলাদেশের মানুষ যতদিন ইসলাম নিয়ে বাঁচতে চাইবে ততদিনই চলবে বাংলাদেশ বিরোধী ভারতের এ যুদ্ধ। ফলে এ যুদ্ধ কখনোই শেষ হবার নয়।  কাফিরদের সেটিই নীতি। এ সত্যটি জানিয়ে দিয়েছেন সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতে। মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে তাদের বিষয়ে আর কে ভাল জানে? তাই ভারতকে যারা বন্ধু দেশ মনে করে, বুঝতে হবে তারা হয় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের চিনতে ভূল করেছে, অথবা তারা ভারত প্রতিপালিত দালাল। ইচ্ছা করেই তারা ভারতের এজেন্ডা গোপন করছে। তাই বাংলাদেশের মুসলিমদের অবশ্যই বুঝতে হবে, তাদের জীবনে যুদ্ধের শেষ। বুঝতে হবে, মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো যুদ্ধ নিয়ে বাঁচা। যারা ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ চায়, ভারতের কাছে তারা সর্বসময়ের শত্রু। ভারত তাদের নির্মূল চায়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা ফাঁসিতে ঝুলে সেটি প্রমাণ করেছে। তবে নির্মূলের সে কাজ এখনো শেষ হয়নি।

ভারতের কাছে বন্ধুত্ব আশা করাটি হবে ক্ষুদার্ত নেকড়ের কাছে করুণা চাওয়া। ইসলামপন্থী বাংলাদেশীদের জন্যই এটি হলো নিরেট বাস্তবতা। সমু্দ্র যাত্রায় সমুদ্রের স্রোতধারা ও বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি জানতে হয়, তেমনি যারা ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ চায় তাদের অবশ্যই জানতে হয় শয়তানী শক্তির চলমান যুদ্ধ ও তাদের রণকৌশলগুলিকে। তাই আগ্রাসী ভারতের উপর থেকে তারা কখনোই তাদের দৃষ্টি কখনোই ফিরিয়ে নিতে পারে না। তবে বিদেশী শত্রুদের চেনার সাথে চিনতে হয় ঘরের শত্রুদেরও। কারণ ঘরের এ শত্রুগণ হলো বাইরে শত্রুদের কোয়ালিশন পার্টনার। ভারত তার সকল ডিম কখনোই এক পাত্রে রাখেনি। কারণ, ভারত এতো বোকা নয়। তাদের এজেন্ট রয়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরা বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্যুলার দলে। রয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রতিটি সেক্যুলার ও বামধারার পার্টিতে।

ভারত তার যুদ্ধে নতুন সৈনিকদের নামাচ্ছে। সেটি দিন দিন সুস্পষ্ট হচ্ছে। মুজিবের বিশাল বিশাল মূর্তিগুলোকে ছাত্ররা গলায় রশি বেধে নীচে ফেলেছে। তাতে বিএনপি’র সেক্রেটারী জেনারেল মীর্জা ফখরুল দারুন কষ্ট পেয়েছেন। এতে তিনি বিক্ষুব্ধ।  কারণ গণতন্ত্রের খুনি, বাকশালী ফ্যাসিবাদের জনক, দুর্বৃত্তায়নের নায়ক এবং ভারতের দালাল মুজিব মীর্জা ফখরুলের কাছে স্বাধীনতার জনক এবং জাতীয় নেতা। মুজিবের ফটো অফিস থেকে নামানো হয়েছে তাতে বিএনপি’র যুগ্মসেক্রেটারী গোলাম কবির রিজভীও বিক্ষুব্ধ। এ থেকে বুঝতে কি বাকি থাকে, তারা ফ্যাসিবাদ ও হিন্দুত্ববাদের কত কাছের? বুঝতে হবে বাম ধারার মীর্জা ফখরুল ও গোলাম কবির রিজভীর ন্যায় যারাই ইসলাম থেকে দূরে সরেছে তারাই হলো ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের পার্টনার। এটি নিশ্চিত, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধটি এরা ভারতকে সাথে কোয়ালিশন গড়ে লড়বে -যেমনটি লড়েছে একাত্তরে। একাত্তরে এরা ভারতে গিয়ে অনেক নিমক খেয়েছে। ফলে ভারতের বিরুদ্ধে তারা যে নিমকহারামী করবে না -সেটি স্বাভাবিক। তাই তারা ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র বলতে ভূলে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *