জিহাদ ছাড়া কি জান্নাত পাওয়া সম্ভব?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

জিহাদ: চাবি জান্নাতের

মানব জীবনের মূল সাফল্যটি হলো জান্নাতপ্রাপ্তি। ঈমানদারের জীবনে এটিই হলো মূল গোলপোষ্ট। দুনিয়ার জীবনে বিপুল সম্পদ, আনন্দ-উল্লাস ও সুস্বাস্থ্য জুটলেও সেটি  অতি ক্ষণস্থায়ী। অথচ যারা জান্নাত পায় তারা সেটি পায় অনন্ত অসীম কালের জন্য। সে জীবনে কোন মৃত্যু নাই। ফলে যারা পরকালে বিশ্বাস করে তাদের প্রতিটি মুহুর্ত কাটে জান্নাতে পাওয়ার ভাবনা নিয়ে। তাদের প্রতিটি প্রচেষ্টা হয়, কি করে নিজেকে জান্নাতের জন্য তৈরী করা যায় সে চিন্তাটিকে লাগাতর মগজে রেখে। নবীজী (সা:)’র হাদীস: নিজের আমলের বলে কেউ জান্নাত পাবে না; জান্নাত পাবে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মাগফেরাত লাভের ফলে। তাই ঈমানদারের জীবনে সর্বসময়ের ভাবনা, নিজেকে কী করে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মাগফিরাত পাওয়ার যোগ্য রূপে গড়ে তোলা যায় সেটি। এ ক্ষেত্রে জিহাদের অবদানটি বিশাল। জিহাদ জীবনের বাঁচার এজেন্ডাই পাল্টে দেয়। জিহাদ নিয়ে বাঁচার অর্থ: মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচা এবং সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ করা –এমন কি প্রাণদান করা। আর যারা মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচে ও প্রাণদান করে -তাদের থেকে কে বেশী তাঁর পক্ষ থেকে মাগফিরাত লাভের অধিক হকদার?           

মানব জাতির জন্য ফুল-ফলে, ধনে-ধানে ও নানারূপ ঐশয্যে ভরা এ পৃথিবী নিজেই এক বিশাল দান। এ বিশ্বজগতে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র। এ পৃথিবীতে শত শত পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, বৃক্ষরাজী, জীবজন্তু ও নানা বর্ণের মানবসৃষ্টি। এ বিশাল বিশ্বজগত showcasing করে মহান আল্লাহতায়ালার অপার ক্ষমতার। তবে মানবের জন্য এর চেয়েও বিস্ময়কর কুদরত অপক্ষা করছে আখরোত। সেদিন আজকের নশ্বর মানুষ অবনিশ্বর সৃষ্টিতে পরণিত হবে। মৃত্যুরই সেদিন মৃত্যু ঘটবে। সেখানে রয়েছে জান্নাত –যার মাঠ-ঘাট, ফলমূল, খাদ্য-পানীয়, নদ-নদী ও নানাবধি আয়োজন নিয়ে শুধু কল্পনাই করা যায়, প্রকৃত ধারণা করা অসম্ভব। সেখানে অপরূপ সম্ভারে সাঁজানো হয়েছে অসংখ্য পৃথিবী। জান্নাতের এ চিত্রটি নিয়ে যে ব্যক্তি বাঁচে -সে কি এক মুহুর্তও বাঁচে সে জান্নাতটি পাওয়ার বাসনাকে হৃদয়ে ধারণ না করে? আশাই মানুষকে কর্মে আগ্রহী কর্মে। যারা জীবনে আশা নাই -তার জীবনে কর্মও নাই। আশাহীন সে ব্যক্তি তখন হারিয়ে যায় স্থবিরতায়। কিন্তু যে ব্যক্তি বাঁচে জান্নাত পাওয়ার আশা নিয়ে তাঁর কর্ম, আচরণ ও ত্যাগে আসে অভূতপূর্ব বিপ্লব। বিপ্লব তাকে ফিরেশতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। সেটিই দেখা গেছে সাহাবায়ে কিরামের জীবনে। বিশাল সাম্রাজ্যের খলিফা হয়েও উটের পিঠে চাকরকে বসিয়ে নিজে রশি ধরে টেনেছেন। আটার বস্তা নিজে পিঠে উঠিয়ে দুস্থ্য মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন।

মুসলিম উম্মাহর মূল সংকটটি হলো: ইসলামের সে কোরআনী চেতনা যেমন বেঁচে নাই্, তেমনি বেঁচে নাই নবীজী (সা:)’র ইসলাম ও সে যুগের মুসলিম ঐতিহ্য। এবং বেঁচে নাই জিহাদী চেতনা। মুসলিম বেঁচে আছে কোর’আন ও হাদীসের মৌলিক শিক্ষাগুলা হৃদয়ে ধারণ না করেই। জিহাদ হলো মু’মিনের জীবনে ইঞ্জিন। এবং সে ইঞ্জিনের জ্বালানী হলো ঈমান। বিমানে ডানা ও দেহ থাকলেই সেটি উড়ে না; উড়ার জন্য ইঞ্জিন থাকতে হয়। তেমনি শুধু নামায-রোযা, হ্জ্ব-যাকাতও থাকলে মুসলিম হওয়া যায় না্। পূর্ণ মুসলিম  হতে হলে জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়। জিহাদ না থাকলে মুসলিমের সংখ্যা বাড়লেও ইসলামের বিজয় আসেনা। তখন বাঁচতে হয় শয়তান ও তার অনুসারিদের প্রতি দাসত্ব নিয়ে। আর একই ভূমিতে কি শয়তানের দাসত্ব এবং মহান আল্লাহর দাসত্ব একত্রে চলে?

আভিধানিক অর্থে মুসলিম তো সেই যে পুর্ণ-আত্মসমর্পিত মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে সে আত্মসমর্পণ ও দাসত্বটি শয়তানের প্রতি। শয়তানের প্রতি দাস-সুলভ সে আত্মসমর্পণটি বুঝা যায় দেশের আদালত থেকে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনকে বিলুপ্ত করে কাফেরদের আইন প্রতিষ্ঠা দেয়ার মধ্যে। হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে কেউ কি মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের এরূপ অবমাননা এক মুহুর্তের জন্যও বরদাস্ত করতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে এ বেঈমানী ও বিদ্রোহ কি নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত ও তাহাজ্জুদ নামায দিয়ে ঢাকা যায়? এরূপ বেঈমানদের তো মহান আল্লাহতায়ালা সুরা মায়েদার ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে কাফের, জালেম ও ফাসেক বলে চিত্রিত করেছেন।

প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালা শরিয়তের বিরুদ্ধে যাদের এরূপ বিদ্রোহ তাদেরকে কি তিনি পরকালে জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করবেন? যারা নামায-রোযাকে বেহেশতের চাবি মনে করেন -তাদের অন্ততঃ এ বিষয়ে বোধোদয় হওয়া উচিত। ঘুমের ঘোরে চোখ বন্ধ করে জান্নাতে পৌছা যায় না। সে পথে চলতে হলে চোখ খুলে কোর’আন বর্ণীত সিরাতুল মুস্তাকীম পথটি অনুসরণ করতে হয়। এবং সে পথের সবটুকুতেই জিহাদ। কখনো সে জিহাদ বুদ্ধিবৃত্তিক, কখনো বা অস্ত্রের। যে পথে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে সেটি ভিন্ন পথ, কখনো সেটি সিরাতুল মুস্তাকীম নয়। কিন্তু যারা কোর’আন না বুঝে স্রেফ তেওয়াতে দায়িত্ব সারে -তাদের পক্ষে কোর’আনের পথটি চেনা এবং সে পথে চলা সম্ভবই বা কি করে?     

 

জিহাদে পরীক্ষা হয় ঈমানের

যেখানে পুরস্কারটি অতি বিশাল, সেখানে পরীক্ষাটিও কঠিন। সমাজে ঈমানের দাবী নিয়ে যেমন সাচ্চা ঈমানদার আছে, তেমনি বিপুল সংখ্যক মুনাফিকও আছে। তাই কে ঈমানদার আর কে মুনাফিক –সেটি বুঝা যাবে কীরূপে? খোদ নবীজী (সা:)’র যুগেও মুনাফিকদের মসজিদে প্রথম সারিতে দেখা গেছে। তাদেরকে রোযা রাখতেও দেখা গেছে। অপর দিকে চোর-ডাকাত এবং কাফেরগণও দান-খয়রাত করে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জরুরি হলো, কে মুনাফিক এবং কে ঈমানদার –সেটি সঠিক ভাবে সনাক্ত করা। সে কাজে ছাঁকুনির কাজটি করে একমাত্র জিহাদ। জিহাদের সে প্রয়োগ নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনাটি ঘোষিত হয়েছে এভাবে: “তোমারা কি ধারণা করে নিয়েছো, এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্যশীল?” –(সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৪২)। এবং আরো ঘোষণা: “তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে তোমাদেরকে ছেড়ে দেওেয়া হবে অথচ আল্লাহ জেনে নেবেন না যে তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে এবং কে আল্লাহ ও মুসলিম ব্যতীত অন্যদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গহণ করা থেকে বিরত থেকেছে?  আর তোমরা যা করো সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১৬)। এবং বলা হয়েছে: “তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছো যে, এমনতিইে জান্নাতে প্রবশে করব? অথচ সে অবস্থার মুখোমুখি তোমরা এখনও হওনি -যা তোমাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও ভয়ানক কষ্ট। তারা এমন ভাবে শিহরিত হয়েছে যে তাতে নবী এবং যারা তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা একথা পর্যন্ত বলেছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য। তোমরা শুনে নাও আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৪)।

মুসলিম হওয়ার অর্থ: মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত পরীক্ষার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া। পরীক্ষায় না বসলে কোন ছাত্রই বুঝতে পারে না তার জ্ঞানের দুর্বলতা কোথায়। তেমনি জিহাদ দেয় ঈমানের সঠিক পরিমাপ। তাই যার জীবনে জিহাদ নাই -সে বুঝতেই পারে না তার ঈমানের শূণ্যতা কতো গভীর। বরং তার নামায-রোযা, হ্জ্ব-যাকাত ও দানখয়রাত তাকে ঈমানের দাবীতে অহংকারী করে ফেলে। এবং সে অহংকারের কারণে যারা ইসলামের পথে জিহাদ করে, নির্যাতিত হয় এবং শহীদ হয় -তাদের আত্মত্যাগকে তারা খাটো করে। মু’মিনের জীবনে পরীক্ষা যে কতটা অনিবার্য সে বিষয়টি মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে বার বার ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন বলেছেন: “মানুষ কি ধরে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে? এবং এ ব্যাপারে কোন পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের পুর্বে যারাই ঈমানরে দাবী করেছে তাদেরকে আমরা পরীক্ষা করেছি, -এ জন্য যে আল্লাহ যেন জানতে পারেন ঈমানের দাবীতে কে সাচচা এবং কে মিথ্যাবাদী।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ২-৩)। তাই ঈমান আনলে দায়িত্ব শেষ হয় না, বরং তখন শুরু হয় পরীক্ষার পর্ব। ঈমান নিয়ে বাঁচতে বা মরতে হলে -এ পরীক্ষা থেকে বাঁচার রাস্তা রাস্তা নাই্। এবং সে পরীক্ষাটি হয় জিহাদের মধ্য দিয়ে। তাই নবীজী (সা:)’র এমন কোন সাহাবা ছিল না যারা জিহাদ করেননি। শতকরা ৬০ ভাগের বেশী শহীদ হয়েছেন। সেদিন যারা জিহাদ করেনি তারা চিহ্নিত হয়েছে মুনাফিক রূপে। 

মহান রাব্বুল আলামিন ব্যক্তির মনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বিষয় সবই জানেন। তাই ব্যক্তির ঈমানের অবস্থা জানার জন্য তার ইবাদত বা জিহাদ দেখার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা চান, ব্যক্তি তার মৃত্যুর আগে নিজেই জেনে নিক তার নিজের ঈমান বা বেঈমানীর প্রকৃত অবস্থা। এভাবে ব্যক্তিকে সুযোগ করে দেন মৃত্যুর আগে তার নিজের পরিশুদ্ধির। জিহাদে অংশগ্রহণ করলো কি করলো না -সে বিষয়টি ঈমানের প্রকৃত অবস্থাটি ব্যক্তির চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে তুলে তুলে ধরে। সেটি যেমন তার নিজের সামনে, তেমনি অন্যদের সামনেও। অন্য মুসলিমগণও তখন জানতে পারে কে তাদের নিজেদের লোক, আর কে শত্রু পক্ষের। এরূপ চেনার কাজটি মসজিদের জায়-নামাযে হয় না, রোযা বা হজ্বের জমায়তেও হয় না। পরীক্ষার আরো উচ্চতর ও নিবীড় ক্ষেত্র চাই। দশ হাজার টাকা বেতনের চাকুরীর ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্তরের সার্টিফিকেট দিয়ে চলে। কিন্তু বেতনের পরিমান লাখ টাকা হলে তখন কঠিন হয় পরীক্ষার মান। জান্নাত পাওয়ার অর্থ হাজার কোটি টাকা পাওয়া নয়। জান্নাতের এক ইঞ্চি ভূমি পাহাড় সমান সোনা দিয়ে কেনা যাবে না। সেটি কিনতে হয় জিহাদে নিজের জান, মাল ও সামর্থ্যের কোরবানী নিয়ে। পবিত্র কোর’আনে সে পরম ঘোষণাটি একবার নয়, বার বার শোনানো হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বার বার এরূপ ঘোষণার লক্ষ্য, যারা শুধু কালেমা পাঠ, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত পালনের মধ্য দিয়ে জান্নাত পাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের মারাত্মক ভূলটি ধরিয়ে দেয়া। লক্ষ্য, যেন তাদের ঘুম ভাঙ্গে। এবং জিহাদ যে জান্নাতের চাবি –সে গুরুতর বিয়য়টি যেন মৃত্যুর আগেই তারা বুঝতে পারে।     

ইসলাম ও তার শরিয়তী বিধানকে বিজয়ী করার লড়াইয়ে আপোষ চলে না। আপোষ হলে বিচ্যুতি হয় জীবনে বাঁচার মূল মিশন থেকে। আপোষের পথটি জাহান্নামের পথ। ঈমানদারদের আনুগত্য ও অঙ্গিকার একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার প্রতি। এবং রাব্বুল আলামীনের সে এজেন্ডা হলো সকল দ্বীনের উপর তাঁর দ্বীনের বিজয়। পবিত্র কোর’আনে সে এজেন্ডাটি ঘোষিত হয়েছে “লি’ইউযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি” এ বয়ানে। তাই তার শরিয়তের পরাজয় নিয়ে বাঁচাটি কোন মু’মিনের এজেন্ডা হতে পারে না। সে এজেন্ডাটি শয়তানের। ঈমানদারের জীবনে জিহাদ তাই অনিবার্য হয়ে উঠে। সমাজ  ও রাষ্ট্রে বসবাসকারি অন্য যারা ঈমানদারের এ অভিপ্রায়ের সাথে ভিন্নমত রাখে -তাদের বিরুদ্ধে ঈমানদারকে এ ক্ষেত্রটিতে অতি অনড় ও আপোষহীন হতে হয়। সেরূপ আপোষহীনতার মধ্যেই মু’মিনের ঈমানদারী; এবং আত্মসমর্পণ হলো কুফরি। বাস্তবতা হলো, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার যে কোনরূপ উদ্যোগকে ইসলামের বিপক্ষ-শক্তি কখনোই মেনে নেয় না। এটিকে তারা নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও প্রতষ্ঠিত বিধি-ব্যবস্থার বিরোধী গণ্য করে। শরিয়তের প্রতিষ্ঠা যে তাদের কায়েমী স্বার্থ, রাজনৈতিক দখলদারি ও প্রতিপত্তিকে বিপন্ন করবে -সেটি তারা বুঝে। ইসলামের বিরুদ্ধে এজন্যই তারা আপোষহীন। সে আপোষহীনতা নিয়ে তারা লাগাতর যুদ্ধ লড়তেও প্রস্তুত।

 

জিহাদশূণ্যতা অসম্ভব করে হিদায়েতলাভ

বহু মুসলিম দেশে অনেক নেতার রাজনীতি বেঁচে আছে অমুসলিমদের ভোটে ও কাফের রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্যে। বৃহৎ শক্তিবর্গ ও নিজদেশে বসবাসকারি সংখ্যালঘুদের মুখের দিকে তাকিয়ে মুসলিম নামধারী এসব নেতারা শরিয়তী বিধান প্রতিষ্ঠার কথা মুখে আনতেও ভয়। মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার চেয়ে কাফেরদের খুশি করাটি তাদের কাছে বেশী গুরুত্ব পায়। তাদের কাছে আখেরাতের চেয়ে গুরুত্ব পায় দুনিয়ার জীবন। এমনকি আল্লাহর দ্বীনের অস্বীকারকারীদের তারা কাফের বলতেও রাজী নয়। অথচ পৃথিবী পৃষ্টের বাঘ-ভালুকদের যেমন চিনতে হয়, তেমনি চিনতে হয় কাফের, মুনাফিক ও ফাসেকদের। মানব জাতি যাতে মহান আল্লাহতায়ালার এ শত্রুদের সঠিক চিনতে পারে সে জন্য তাদের পরিচিতিটি বার বার তুলে ধরা হয়েছে পবিত্র কোর’আনে। পৃথিবীটি একটা রণাঙ্গণ। ঈমানদারের জীবনে যুদ্ধ এখানে প্রতিদিন। যুদ্ধ এখানে ইসলামকে বিজয়ী করার, এবং শয়তানের পক্ষকে পরাজিত করার। ফলে এ রণাঙ্গণে শত্রুদের চিনতে যদি ভূল হয় তবে যুদ্ধ হবে কীরূপে? কাফেরকে কাফের বলাই তো মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। কাফের তো তারাই যারা ইসলামকে মহান আল্লাহতায়ালার একমাত্র দ্বীন রূপে মানতে রাজী নয়। এবং রাজী নয় তাঁর শরিয়তী বিধানকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিত। এরাই তো মুসলিম ভূমিতে ইসলামী বিধানকে পরাজিত করে রেখেছে। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার বিধানকে যারা পরাজিত করে রাখে তাদেরকে কি মুসলিম বলা যায়?

অনেকে নামায-রোযা আদায় করলেও শরিয়তের প্রতিষ্ঠার কথা মুখ আনতে রাজী নয়। তারা ভাবে, শরিয়তের পক্ষ নিলে প্রতিবেশী অমুসলিম দেশ ও বৃহৎ শক্তিবর্গ নারাজ হবে। ভাবে, তাতে নারাজ হবে দেশের সংখ্যালঘুরাও। তাদের ভয়, এতে তাদের ভোট-ব্যাংকে টান পড়বে। ভাবে, তাতে নির্বাচনী বিজয় অসম্ভব হবে। এরূপ স্বার্থপর চিন্তায় কি ঈমান বাঁচে? এরূপ রাজনৈতিক স্বার্থ চিন্তায় গুরুত্ব হারায় মহান আল্লাহতায়ালা কি চান –সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। বরং গুরুত্ব পায়, অমুসলিমগণ কি চায় -সেটি। তখন এজেন্ডা হয়, অমুসলিমের এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতি করা। অথচ মুসলিমদের রাজনীতিই শুধু নয়, তার বাঁচা-মরা নির্ধারিত হয়, মহান আল্লাহতায়ালা কি চান –সে ভাবনা থেকে। দেশের সংখ্যালঘু ভোটার বা বৃহৎ শক্তিবর্গ কি বলে সেটি দূরে থাক, তার নিজ পিতা-মাতার ন্যায় আপনজনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাটিও তাঁর কাছে গুরুত্বহীন -যদি তারা ইসলামের বিপক্ষের হয়। মু’মিনের জীবনে মূল বিষয়টি হলো একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা। এ প্রসঙ্গে মু’মিনদের সাবধান করতে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে হুশিয়ারীটি এসেছে এভাবে: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের পিতা ও ভাইদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করোনা যদি তারা ঈমান অপক্ষো কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের মধ্যে যারা তাদরেকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করবে তারা সীমালংঘনকারী।” -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২৩)। আরো বলা হয়েছে: “(হে মুহম্মদ!) বলে দাও! তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা -যার ক্ষতি হওয়ার ভয় করো এবং তোমাদের বাসস্থান –যাকে তোমরা পছন্দ করো আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয় -তবে অপক্ষো করো, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আল্লাহ ফাসেক লোকদের হিদায়েত করেন না।” -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ২৪)।

মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয় ও সে লক্ষ্যে লড়াই এতোই গুরুত্বর্পূণ যে, পিতা-মাতা ও ভাই-বোনের বিরোধীতা, পারিবারীক ও গোত্রীয় স্বার্থচিন্তা, ব্যবসা-বাণিজ্যেরে ক্ষয়-ক্ষতি -কোনটাই যেন সে কাজ থেকে ঈমানদারকে বিচ্যুৎ করতে না পারে। যারাই নানা বাহানায় সে লড়াই থেকে দূরে থাকে মহান আল্লাহপাকের কাছে তারাই হলো ফাসেক তথা দুর্বৃত্ত। তাদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর খবরটি হলো, তারা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে বিবেচিত হয় হিদায়েতের অযোগ্য রূপে –যা ঘোষিত হয়ছে উপরুক্ত আয়াতে। মানব জীবনের সবচে্য়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটি হলো হিদায়েত লাভ। যারাই হিদায়েতের অযোগ্য, তারাই জান্নাতের অযোগ্য। এবং সে অযোগত্যটি অর্জিত হয় জিহাদ থেকে দূরে থাকার জন্য।  স্রেফ নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত -সে অযোগ্যতা দূর করে না। জিহাদের বিকল্প একমাত্র জিহাদই। তাই যে সমাজে মুসলমিগণ দূরে সরে জিহাদ থেকে -সে সমাজে নামাযী, হাজী ও রোযাদারের সংখ্যা বাড়লেও শরিয়তের পথে চলার লোকের সংখ্যা বাড়ে না। কারণ, শরিয়ত মোতাবেক চলার জন্য তো চাই হিদায়েত লাভ। অথচ যারা জিহাদ থেকে দূরে থাকে -তাদের হিদায়েত না দেয়াটাই মহান আল্লাহতায়ালার নীতি। আর এর ফলে  দেশ ভরে উঠে মুসলিম নামধারী ভয়ংকর পথভ্রষ্টদের দিয়ে। উদাহরণ হলো, বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলো।   

 

হারাম যুদ্ধ বনাম ফরয জিহাদ

জিহাদের যোগ দেয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না। দুর্বলতা এখানে ঈমানের। জিহাদ হলো খালেছ ও বলিষ্ঠ ঈমানের প্রকাশ। ঈমান বাড়লে জিহাদে সংশ্লিষ্টতা বাড়ে। ঈমান যাদের তলায় ঠেকেছে তাদের পক্ষে জিহাদে যোগ দেয়াটি অভাবনীয়। জিহাদ একমাত্র তাদের জীবনে দেখা যায় -যারা বাঁচে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার জন্য। এটি দেয়ার জায়গা, নেয়ার জায়গা নয়। আখেরাতের চেয়ে পার্থিব স্বার্থ-উদ্ধার যাদের অধিক গুরুত্বর্পূণ তাদের পক্ষে জিহাদের ময়দানে পা রাখা অসম্ভব। এমন পার্থিব চেতনারই আধুনিক পরিভাষা হলো সেক্যুলারিজম। এদের কাছে পরকালীন চেতনা গণ্য হয় সাম্প্রদায়িকতা। অথচ এদেরই অনেকে নিজেদের পরিচয় দেয় ঈমানদার রূপে। তাদের অনেকে নামায-রোযা এবং হজ্ব-যাকাত পালন করে। অথচ সাড়া দেয়না জিহাদের ডাকে। পবিত্র কোর’আনে এদের সম্মন্ধে বলা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কি হলো, যখন আল্লাহর পথে বের হবার জন্যে তোমাদের বলা হয় তখন মাটি জড়িয়ে ধরো, তোমরা কি আখারাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেল? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনে উপকরণ অতি অল্প। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৩৮)।

পরকাল ভূলে মাটি জড়িয়ে ধরার এ চেতনাটি হলো নিরেট সেক্যুলারিজম তথা পার্থিবতা। সেক্যুলারিস্টদের জীবনেও যুদ্ধ আছে। তবে সে যুদ্ধ পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য। সাম্রাজ্য বিস্তারের যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক যুদ্ধ, শ্রেণীযুদ্ধ, এথনিক ক্লিন্জিংয়ের যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধ –এরূপ প্রতিটি যুদ্ধই হলো সেক্যুলারিজমের যুদ্ধ। কিন্তু তাদের কাছে অপছন্দীয় হলো মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার যুদ্ধ। একমাত্র যে যুদ্ধটিকে মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে ফরয করা হয়েছ সেটি হলো ইসলামী বিধানকে বিজয়ী করা ও সে বিধানকে প্রতিরক্ষা দেয়ার যুদ্ধ। অন্য সকল যুদ্ধ হারাম। সে ফরয যুদ্ধটির হুকুম এসেছে এভাবে: “তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দীয়। পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়তো কোন বিষয় পছন্দের নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তো কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয়, অথচ সেটি তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহ যা জানেন তোমরা তা জান না।” –(সুরা বাকারাহ, আয়াত ২১৬)। অথচ আল্লাহতায়ালা যে যুদ্ধকে ফরয করেছেন সে যুদ্ধকেই সন্ত্রাস বলা হচ্ছে। এবং হালাল করে নিয়া হয়েছে সেক্যুলারিস্টদের হারাম যুদ্ধগুলোকে।

 

সৎ কর্ম ও অপরাধ কর্মে রাষ্ট্রের সামর্থ্য

মহান আল্লাহতায়ালা চান, মানুষ তার সামর্থ্যের বিনিয়োগ করুক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে। মানবের জন্য এটিই সবচেয়ে কল্যাণকর কর্ম। সমাজ শান্তিময় ও সভ্যতর হয় -এ কর্মটি সুচারু ভাবে হলে। মুসলিম জীবনে এটিই মূল মিশন। রাষ্ট্রই যে সকল মঙ্গল ও অমঙ্গলের মূল -সেটি ইসলাম যতটা বিশুদ্ধ ভাবে তুলে ধরেছে তা অন্য ধর্ম তুলে ধরে নাই। রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ যা চায়, জনগণকে সে দিকেইে যেতে হয়। অপরাধ-কর্মে দেশের সকল অপরাধীদের যে সামর্থ্য -তা থেকে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারি শাসক এবং তার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অপরাধ-কর্মের সামর্থ্য শতগুণ অধিক।  তারা সন্ত্রস্ত করতে পারে সমগ্র দেশবাসীকে। যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের সবচেয়ে বড় সূদখোর -সে দেশে সূদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ওয়াজ হলেও জনগণকে সূদ থেকে বাঁচানো যায় না। বরং সূদ দিতে ও সূদ খেতে জনগণও তখন বাধ্য হয়। বাঁচার তাগিদে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নামধারি ব্যক্তি তখন সূদী ব্যাংকে চাকুরি নেয়। অথচ সূদ খাওয়া, সূদ দেওয়া এবং সূদের হিসাব লেখা হারাম। সূদ খাওয়াকে মহান আল্লাহতায়ালার রাসূল নিজের মায়ের সাথে জ্বেনার ন্যায় অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছেনে। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সে জ্বিনার অপরাধ অবিরাম করে যাচ্ছে। মদ আমদানী ও বিক্রয় করা হারাম। অথচ বিদেশ থেকে বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশের বিমান বন্দরে ঢুকলে সরকারের যে ব্যবসাটি প্রথমে নজরে পড়ে সেটি হলো মদের ব্যবসা। এমন দেশে দীবারাত্র ওয়াজ নসিহত করলেও কি মদ্যপান বন্ধ হবে? তেমনি ব্যাভিচারীর বিষয়। জ্বেনা বা পতিতাবৃত্তির সবচেয় বড় পাহারাদার হলো সরকার। জনগণের রাজস্বের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যভিচারের পাহারা দিচ্ছে সরকারি পুলিশ। আল্লাহর কাছে দোয়া বা বড় বড় ওয়াজ মহফিল বসিয়ে কি ব্যভিচার কি দূর হবে? নর্দমায় গলিত আবর্জনা জমিয়ে শুধু দোয়ার বরকতে কি মশা নির্মূল হয়? সে জন্য তো মশার আবাদ-ভূমি নির্মূল করতে হয়। বিষয়টি অভিন্ন সমাজ থেকে দুর্বৃত্ত নির্মূলের বিষয়ও। প্রতিটি মুসলিমের উপর দায়িত্ব হলো দুর্বৃত্ত নির্মূলের দায়িত্ব। এটিই জীবনকে সফল করার পথ। পবিত্র কোর’আনে সে দায়িত্বের কথাটি বলা হয়েছে এভাবে: “তোমাদের মধ্যে এমন এক উম্মত অবশ্যই থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের পথে ডাকবে, ন্যায়ের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হলো সফলকাম।”-(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৪)।

 

জিহাদ কেন অনিবার্য?

আর দুর্বৃত্ত নির্মূলের মিশন নিয়ে ময়দানে নামলে যুদ্ধ অনিবার্য। মুসলিম জীবনে একারণেই অনিবার্য হয় জিহাদ। কারণ, কোন সমাজ বা রাষ্ট্রই শূণ্যস্থান নয়। সেখানে বসে আসে এমন কিছু ব্যক্তি ও দল -যারা দুর্বৃত্তির ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের ন্য্যয় মুসলিম দেশগুলি এদের কারণেই দুর্নীতিতে বিশ্বে শিরোপা পেয়েছে। অন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়ের প্রতিরোধ তাদের রাজনীতি। এদের নির্মূলে মহান আল্লাহতায়ালা যুদ্ধকে ফরয করেছেন। সে ঘোষণাটি এসেছ এভাবে: “আর মুশরকিদের সাথে তোমরা যুদ্ধ করো সমবেত ভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেত ভাবে। মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও অধিক পাপের। বস্তুত তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে, যদি তা সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো জাহান্নামবাসী। তারা চিরকাল সেখানে বাস করবে। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই যে, যারা ঈমান এনেছে, যারা হিজরত করেছে, আর আল্লাহর পথে লড়াই করেছে -তারা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী। আর আল্লাহ হচ্ছেন ক্ষমাশীল ও করুণাময়। -(সুরা আল-বাক্বারা, আয়াত ২১৭-২১৮)।

আর যারা মহান আল্লাহতায়ালার জিহাদের এ হুকুমকে অবহেলা করে তাদেরকে শুনিয়েছেন চরম হুশিয়ারী। দিয়েছেনে কঠিন আযাবের খবর। বলা হয়েছে: “যদি বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে মর্মন্তদ আযাব দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। তোমরা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। -(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৩৯)। এবং এটিও শর্ত নয় যে, জিহাদের জন্য বিশাল বাহিনী গড়তে হবে। সে জন্য হাজার হাজার ট্যাংক, শত শত যুদ্ধ বিমান ও বিশাল বিশাল নৌ-বহর থাকতে হব। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে সর্ব-অবস্থায়। ঈমানদারের কাজ হলো খালেছ নিয়তে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে পড়া। তাদরেকে সাহায্য করার জন্য আল্লাহতায়ালার অসংখ্য ফিরেশতা সদাপ্রস্তত। বান্দাহর নিজিস্ব বিনিয়িোগ শুরু হলে মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্যও শুরু হয়ে যায়।

মুসলিমদের আজকের পরাজয়ের কারণ, জিহাদের ময়দানে তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ নাই। তাদের সকল সামর্থ্যের বিনিয়োগ হচ্ছে ভাষা, ভূগোল, ফিরকাহ ও দলীয় স্বার্থে, মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজযে নয়। ফলে আল্লাহর সাহায্যও আসছে না। যারা বিনিয়োগ করছে তারা আজও বিজয় পাচ্ছে। আফগানিস্তানে একটি বিশ্বশক্তির পরাজয় হলো তো সে সাহায্যের বদৌলতেই। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মুমিনের উপর লড়াইয়ের তাগিদটি এসেছে এভাবে: “তোমরা বের হয়ে পড়ো তোমাদের প্রস্তুতি স্বল্প হোক অথবা প্রচুর সরঞ্জামের সাথে হোক; এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে নিজদের মাল ও জান দিয়ে। এটি তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা বুঝতে পারো।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ৪১)। এখানে বিশাল প্রস্তুতির কথা বলা হয়নি। নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা আছে তা দিয়েই ময়দানে নামার। নবীজী (সা:) যদি কাফের শক্তির সমকক্ষ লোকবল ও অস্ত্রবল সংগ্রহের অপেক্ষায় থাকতেন তবে কি কোন দিনও জিহাদে নামার যুক্তি খুঁঝে পেতেন? কাফেরদের সংখ্যাবল ও অস্ত্রবল তো সব সময়ই অধিক ছিল। মুসলিমদের প্রতিরক্ষা, ইজ্জত এবং কল্যাণ কখনোই ঘরে বসে থাকাতে বাড়ে না, লড়াইয়ের পথে বেরিয়ে পড়াতে। মহান আল্লাহতায়ালা সেটি জানিয়েছেন এভাবে: “যারা জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে, আল্লাহ তাদের পদমর্যদা বাড়িয়ে দিয়েছেন যারা ঘরে অবস্থান নেয় তাদের তুলনায় এবং প্রত্যেকের সাথেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ মুজাহিদদেরকে ঘরে অবস্থানকারীদের তুলনায় মহান প্রতিদানে শ্রেষ্ঠ করেছেন।” –( সুরা নিসা, আয়াত ৯৫)।  

 

অসম্ভব ভাবনা

মাহে রমাদ্বানের রোযা ফরজ করতে পবিত্র কোর’আনে একটি মাত্র আয়াত নাযিল হয়েছে। বেশি আয়াত নাযিল হয়নি হজ্বের বিধান ফরজ করতে। নামায ও যাকাতের হুকুম বার বার এসেছে; কিন্তু সে নির্দেশগুলো এসেছে অন্য হুকুমের সাথে একই আয়াতের অংশ রূপে। সমগ্র একটি অআয়াত জুড়ে এবং ধারাবাহিক কয়েকটি আয়াত জুড়ে এসেছে এমন উদাহরণ বিরল। কিন্তু জিহাদের হুকুমগুলি যখন এসেছে তখন সেটি এসেছে বিস্তারিত ভাবে; অনেক সময় ধারাবাহিক কয়েটি আয়াত জুড়ে। সে সাথে এসেছে জিহাদে জানমাল কোরবানীর বিশাল পুরস্কারের সুসংবাদ নিয়ে। কেন এরূপ? বিষয়টি ভাববার বিষয়। বস্তুত এতে বুঝা যায় মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে জিহাদ কতো গুরুত্বপূর্ণ।

নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত ব্যক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি দেয়; কিন্তু জিহাদ হলো সমাজ ও রাষ্ট্র পরিশুদ্ধির একমাত্র হাতিয়ার। এ হাতিয়ার কাজ না করলে সমাজ ও রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয়। তখন অসম্ভব হয় পৃথিবী পৃষ্টে মহান আল্লাহর নিজের দ্বীনের বিজয়। মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয়টি মসজিদের জায়নামাযে আসে না, আসে জিহাদে ময়দানে। যারা নিজেদের অর্থ, মেধা ও রক্ত দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করে তাদের চেয়ে আর কে তাঁর কাছে অধিক প্রিয় হতে পারে? জিহাদ বাড়ায় মহান আল্লাহতায়ালার মহান উদ্দেশ্য ও তাঁর এজেন্ডার সাথে গভীর সংশ্লিষ্টতা। অপর দিকে জিহাদ থেকে দূরে থাকার অর্থ তাঁর ইচ্ছা ও এজেন্ডার সাথে সম্পর্কহীনতা।

মহান আল্লাহতায়ালার  পক্ষ ও শয়তানের পক্ষের মাঝে যুদ্ধটি যেখানে তীব্র ও রক্তাত্ব -সেখানে পক্ষ না নেয়া এবং নিষ্ক্রীয় থাকাও তো মহা অপরাধ। কারণ, সেরূপ নিষ্ক্রীয়তায় বিজয় বাড়ে শয়তানের। কথা হলো, জিহাদে অংশ না নিয়ে যারা বিজয় বাড়ায় শয়তানের এবং পরাজিত করে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে -তাদের চেয়ে অধিক অপরাধীই বা কে হতে পারে?  প্রশ্ন হলো, জিহাদবিমুখ এরূপ অপরাধীদের জান্নাত দিয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালা পুরস্কৃত করবেন? কোন সুস্থ্য মানুষ কি সেটি ভাবতে পারে? নিতান্তই এটি এক অসম্ভব ভাবনা।  ১ম সংস্করণ ০১/০১/২০১২; ২য় সংস্করণ ৩০/০১/২০২১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *