জিহাদ বিলুপ্তির নাশকতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on March 28, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
আক্রোশ কেন জিহাদের প্রতি?
দুর্বৃত্ত শাসনের সবচেয়ে বড় নাশকতাটি স্রেফ দুর্বৃত্তির বিস্তার নয়; বরং সেটি হলো জিহাদের ন্যায় মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্মটির বিলুপ্তি। তখন পন্ড হয় সভ্যতর সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের মহান আল্লাহতায়ালার নিজস্ব প্রকল্প। তখন বিজয়ী হয় শয়তানী পক্ষ; এবং প্লাবন আসে দুর্বৃত্তির। তখন দুর্বৃত্তি নির্মূলের প্রচেষ্ঠাগুলো গণ্য হয় দন্ডনীয় অপরাধ রূপে। যেমন বাংলাদেশে গুম, খুন, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হতে হয় হাসিনার ন্যায় ভোটডাকাতের বিরুদ্ধে রাজপথে অবস্থান নেয়াতে। যেমন নমরুদ ও ফিরাউনের সামনে মহান আল্লাহকে প্রভু বলাও হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হয়েছে। শয়তানপন্থীদের হাতে অধিকৃত হওয়ার এটিই সবচেয়ে বড় বিপদ।
অপর দিকে ইসলামে জিহাদ হলো, দুর্বৃত্তির নির্মূল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মহান আল্লাহর নির্দেশিত একমাত্র হাতিয়ার। এটিই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। হাতিয়ার ছাড়া যুদ্ধ লড়া যায় না; তেমনি জিহাদ ছাড়া ইসলামকে বিজয়ী করা যায় না। ইসলাম যে শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম, সেটি জিহাদ ছাড়া কখনোই প্রতিষ্ঠা দেয়া যায়না। এ পবিত্র ইবাদতে বিনিয়োগ ঘটে মু’মিনদের মেধা, অর্থ, শ্রম, সময় ও রক্তের। একমাত্র এ বিনিয়োগের ফলেই রাষ্ট্র দুর্বৃত্তমুক্ত হয় এবং প্রতিষ্ঠা পায় শরিয়তী বিধান। সভ্যতর সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা তো এভাবেই নির্মিত হয়। স্রেফ নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলে সেটি হয় না। লক্ষ লক্ষ মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়েও সেটি হয় না। সে সুফলটি পীরদের শত শত আস্তানা বা সুফি খানকা গড়েও জুটে না। আজকের মুসলিম দেশগুলিতে সেগুলি কি কম? কিন্তু কোথায় সে সভ্যতার উৎকর্ষ?
জিহাদ যেহেতু দুর্বৃত্তির নির্মূল ঘটায়; সকল দুর্বৃত্ত শক্তির আক্রোশ তাই জিহাদের বিরুদ্ধে। জিহাদ দেয় আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জজবা এবং দেয় লড়াইয়ের ধর্মীয় ও নৈতিক ভিত্তি। তাই তাবত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জিহাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ। মজলুমের এ প্রতিরোধ যুদ্ধকে তারা বলে সন্ত্রাস। বলে জঙ্গিবাদ। আগ্রাসী যুদ্ধকে প্রতিরোধহীন করার লক্ষ্যে তারা চায় মুসলিম জীবন থেকে জিহাদের বিলুপ্তি। জিহাদ বিষয়ক কোর’আন-হাদীসের আয়াতগুলিকে বাদ দিতে চায় স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সিলেবাস থেকে। অথচ সেরূপ আক্রোশ নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলের বিরুদ্ধে নাই। সে ক্রোধ তাবলিগ জামায়াত, পীরদের আস্তানা বা সুফি খানকার বিরুদ্ধেও নাই।
বাংলাদেশে জিহাদের বিরুদ্ধে সে আক্রোশটি দেখা যায় ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্ট শিবিরে। তাদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তিটি হলো, শরিয়ত প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা। জিহাদের ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত গণ্য করে ফৌজদারি অপরাধ রূপে। ঘরে স্রেফ জিহাদ বিষয়ক বই রাখাকে অপরাধ চিহ্নিত করে ছাত্র-ছাত্রীদের জেলে তোলা হচ্ছে। আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বিদ্রোহ আর কি হতে পারে? বিস্ময়ের বিষয়, এমন ইসলামবিরোধী সরকারও বেঁচে আছে মুসলিম জনগণের রাজস্বের অর্থে! বহুকোটি মানুষ তাদের ভোট দেয়। তাদের সভা-সমাবেশেও বিপুল সংখ্যায় হাজির হয়। ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে গাদ্দারীটা শুধু সরকারের নয়, বিপুল সংখ্যক জনগণেরও। কথা হলো, এমন গাদ্দারী কি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পুরস্কার আনে? আনে কি নিয়ামত? বরং যা আনে -তা হলো পরাজয় ও অপমান।
সমাজ ও রাষ্ট্রের পবিত্রতা বিধানের কাজটি নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাত ও তাসিবহ-তাহলিলে হয় না; এগুলির কাজ ব্যক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি আনা। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি, কল্যাণ ও পরিশুদ্ধি আনতে হলে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছাড়া বিকল্প নাই। শরিয়তী বিধান হলো দুর্বৃত্তি বিলুপ্তির হাতিয়ার। তখন পবিত্রতা আসে সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। শরিয়ত ছাড়া তাই ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র তাই পূর্ণাঙ্গ হয় না। এমন শরিয়তী শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল নবীজী(সা:) ও তাঁর সাহাবাদের শাসনামলে। ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালনের এটিই হলো মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মডেল। এটি শুধু কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারই পথ নয়; জান্নাতে পৌঁছার পথও। শরিয়ত ছাড়া সিরাতুল মুস্তাকীমের কথা ভাবা যায় না। যে রাষ্ট্রে শরিয়ত নাই –বুঝতে হবে সেখানে পথটি জাহান্নামের।
ব্যর্থতা সুস্থ সংস্কৃতির নির্মাণে
সংস্কৃতি একটি বিশেষ জীবনবোধ, রুচিবোধ ও দর্শন নিয়ে বাঁচতে অভ্যস্থ কর। লতাপাতা যেমন স্রোতে ভাসে, দেশের অধিকাংশ মানুষ ভাসে আবহমান সাংস্কৃতিক স্রোতে। তাই মুসলিমদের শুধু ঘর ও রাষ্ট্র গড়লে চলে না, সংস্কৃতিও নির্মাণ করতে হয়। আনতে হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বাংলাদেশের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি বস্তুত সুস্থ সংস্কৃতির নির্মাণে। সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার কারণে চরম ব্যর্থতা আসে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ায়। মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান কোন কালেই গান-বাজনা, নৃত্য, সংঙ্গীত ও ভাস্কর্য ছিল না। এগুলো তো মানুষকে আল্লাহবিমুখ করা ও পরকাল ভূলানোর সংস্কৃতি। এমন সংস্কৃতিতে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলা গুরুত্ব পায় না। বরং গুরুত্ব পায় আকন্ঠ জীবন সম্ভোগ। আর এ আকন্ঠ সম্ভোগটাই হলো সেক্যুলারিজমের মূল কথা। সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত করার এটিই শয়তানী প্রকল্প। শরিয়তী বিধান এমন প্রকল্পে বাধা দেয় বলেই সেক্যুলারিস্টগণ শরিয়তের বিরোধী। বাংলাদেশে এমন সেক্যুলার সংস্কৃতির প্রসারে সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগট বিশাল। শয়তান শুধু রাজনীতির পথই গড়ে না, সংস্কৃতির পথও গড়ে। মানুষকে মন্দিরে নিতে না পারলেও সংস্কৃতির পথে টেনে কোটি কোটি মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে দূরে সরায়। সাংস্কৃতিক অঙ্গণগুলো বস্তুত শয়তানের শিক্ষালয় রূপে কাজ করে। বাংলাদেশে শয়তানে এ প্রজেক্ট বিপুল ভাবে বিজয়ী।
অথচ ইসলামের সংস্কৃতি হলো জিহাদের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি যেমন দুনিয়ার বুকে জান্নাতের রাস্তা গড়ার সংস্কৃতি; তেমনি উন্নত মানব, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ারও। অথচ বাঙালী মুসলিম সমাজে সে সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। ফলে গড়ে উঠেনি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র। বরং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দুর্বৃত্ত-অধিকৃত রাষ্ট্র। জোয়ার বইছে পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের সংস্কৃতির। আল্লাহপাক এমন পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদেরকে সুরা ফাতেহা’তে দোয়াল্লিন (পথভ্রষ্ট) ও মাগদুব (অভিশপ্ত) বলেছেন। জান্নাত পাওয়ার জন্য সিরাতুল মুস্তাকীম পাওয়াটি যেমন জরুরি; তেমনি জরুরি হলো পথভ্রষ্টদের পথ থেকে বাঁচাটিও। তাই নামাযের প্রতি রাকাতে সিরাতুল মুস্তাকীম পাওয়ার দোয়া পাঠ যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি বাধ্যতামূলক হলো পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের পথ থেকে বাঁচার দোয়াটিও।
কিন্তু বাঙালী মুসলিমদের জীবনে সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার কাজটি যেমন সঠিক ভাবে হয়নি, তেমনি হয়নি পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্তদের পথ থেকে বাঁচাটিও। ফলে বাঙালী মুসলিমদের হাতে নির্মিত হয়েছে ১৪ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে কদর্য ইতিহাস। তারা দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম হয়ে রেকর্ড গড়েছে, রেকর্ড গড়েছে ঔপনিবেশিক কাফেরদের হাতে ১৯০ বছরের জন্য গোলাম হয়ে। কাফেরদের গোলাম হওয়ার চেয়ে মুসলিম জীবনে বড় আযাব আর কি হতে পারে? তখন শুধু নির্যাতিতই হতে হয় না, ঈমানও হারাতে হয়। অথচ এ আযাব থেকে বাঁচার জন্যই মহান আল্লাহতায়ালা জিহাদকে ফরজ করেছেন। অন্যরা যুদ্ধে মরলে জাহান্নামে যায়। অথচ মুসলিমগণ মরে না; শহীদ হয় এবং জান্নাতে যায়। এটি কি কম পুরস্কার? দেশরক্ষায় সামান্য সময়ের পাহারাদারীকে সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেছেন। অথচ সে দেশরক্ষায় বাঙালী মুসলিমের আগ্রহ কই? এবং যারা জিহাদ থেকে দূরে সরে তাদেরকে ঘিরে ধরে প্রতিশ্রুত আযাব। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন শেষ হয়েছে; এখন নতুন আযাব এসেছে ভারত ও তার সেবাদাসদের গোলাম রূপে।
হারাম বন্ধুত্ব ও যুদ্ধ
আফগানদের সংখ্যা বাঙালী মুসলিমদের সিকি ভাগও নয়। কিন্তু তারা কি এক দিনের জন্যও কি কোন কাফের শক্তির শাসন মেনে নিয়েছে? অথচ সে দেশে কাফেরদের হামলা যে হয়নি -তা নয়। কিন্তু কাফের আগ্রাসন শুরুর সাথে সাথেই শুরু হযেছে প্রচন্ড প্রতিরোধ। সেটি হয়েছে আম জনতার পক্ষ থেকে। তারা যেমন বীরদর্পে ব্রিটিশ হামলার মোকাবেলা করেছে, তেমনি যুদ্ধ লড়েছে রুশ ও মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। প্রানদানে তারা পিছুপা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে সম্পর্ণ বিপরীত সংস্কৃতি। সেটি হয়েছে নিজ দেশে কাফেরদের সামরিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দখলদারি প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে সেটিই প্রকট ভাবে হয়েছে একটি মুসলিম দেশে ভেঙ্গে ভারতীয় কাফেরদের বিজয়ী করার মধ্য দিয়ে। এমনকি কাফেরদের বিজয়কে নিজেদের বিজয় রূপে উৎসব করা হচ্ছে। মদ, জ্বিনা, সূদ যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো মুসলিম দেশ ভাঙ্গা। এটি তো শরিয়তের মৌল বিধান। কোন ঈমানদার কি সে পথে যেতে পারে?
সুরা আল –ইমারানে ঘোষিত “লা তাফাররাকু” অর্থাৎ “বিভক্ত হয়োনা” –এটি মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম। সুরা মুমতাহিনায় রাব্বুল আলামিনে আরেকটি হুশিয়ারি “লা তাত্তিখিজু আদুউ’য়ী ও আদুউ’য়াকুম আউলিয়া।” অর্থ: “তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করোনা।” মূর্তি পূজারীগণ যে আল্লাহর শত্রু তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? ভারতীয় হিন্দুগণ যে বাংলাদেশীদের শত্রু -সেটিও কি তারা এতো দিন প্রমাণ করেনি? যারা ঈমানশূণ্য সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট –তারা না হয় ভারতকে তাদের বন্ধু করতে পারে, কিন্তু যাদের হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে -তারা কি মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমকে অমান্য করে কাফেরদের কলাবোরেটর হতে পারে? ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের নামে রাষ্ট্র গড়া জায়েজ হলে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খেলাফত শত শত বছর বাঁচতো না। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও অঞ্চলের পরিচয়ে ১৪ শত পূর্বেই আলাদা আলাদা রাষ্ট্র গড়ে উঠতো। মুসলিম দেশ ভাঙ্গার মিশনটি কাফেরদের; এরাই মধ্যপ্রাচ্যকে ২২ টুকরোয় বিভক্ত করেছে। তাদের কলাবোরেটর হয়েছে কিছু গোত্রপূজারী আরব। মুসলিমদের আজকের যে পরাজয় ও পতিতদশা তার কারণ যে ৫৭ দেশে বিভক্ত ভূগোল তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? মুসলিম বিশ্বে সম্পদ ও জনসংখ্যা যা আছে তা থেকে হাজার গুণ বৃদ্ধি ঘটলেও কি বিভক্ত মানচিত্রের এ দুর্বলতা দূর করা যাবে? সেটি যে অসম্ভব সেটি মহান আল্লাহর চেয়ে আর কে ভাল জানে। তাই তিনি বিভক্তিকে হারাম করেছেন। অথচ মুসলিমগণ সে হারাম পথেই পা বাড়িয়েছে। একই হারাম পথে বাঙালী মুসলিমদের বিরাট অংশ পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে ভারতীয় মুশরিকদের কলাবোরেটর হয়েছে। তারা যে মহান আল্লাহতায়ালার খাতায় আখেরাতে কাফেরদের কলাবোরেটর হিসাবেই চিহ্নিত হবে -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্মটি
মুসলিম জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্মটি শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতিরক্ষা দেয়া। নবীজী (সা:)’র হাদীস: একাজে সামান্যতম মুহুর্ত ব্যয় সারা রাতের নফল নামাযের চেয়ে উত্তম। এবং সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার আযাবটি অতি করুণ। তখন শত্রুর হাতে শুধু গণহত্যা ও গণধর্ষণের শিকারই হতে হয় না, হারাতে হয় ঈমান-আমলও। সে ব্যর্থতার কারণেই অতীতে বিপদ চেপে বসেছিল স্পেন, রাশিয়া, চীন ও ভারতের বহু কোটি মুসলিমের জীবনে। শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ার দায়িত্বটি শুধু বেতনভোগী সৈনিকদের নয়, বরং প্রতিটি ঈমানদারের। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের মোকাবেলার দায়ভারটি শুধু নবাব সিরাজুদ্দৌলা ও তাঁর সেনাবাহিনীর ছিল না, ছিল প্রতিটি মুসলিমের। মুসলিমগণ যখন রোমান বা পারসিক সাম্রাজ্যের ন্যায় বিশাল বিশাল দেশের সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করেছে তখন মুসলিম বাহিনীতে কোন বেতনভোগী সৈনিকই ছিল না। তাদের সবাই ছিলেন যেমন নামায-রোযা পালনকারী, তেমনি সবাই ছিলেন যোদ্ধা। কিন্তু বাঙলার মুসলিমদের আচরণ ছিল এর বিপরীত। শহিদ তিতুমীরের প্রতিরোধ ও ফকির বিদ্রোহের মত কিছু বিচ্ছিন্ন জিহাদ ছাড়া তারা যে শুধু জিহাদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে তা নয়, বরং হাজার হাজার মুসলিম যুবক শত্রু সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছে। সেটি শুধু বাংলা বা ভারতে ব্রিটিশ দখলদারিকে স্থায়িত্ব দিতে নয়, বরং ইরাক, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনসহ এশিয়া-আফ্রিকার বহু মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদী দখলদারি বাড়াতে। অথচ এরূপ আত্মবিক্রীত সেবাদাসদের অনেককে বাঙালী মুসলিমগণ গৌরবের প্রতীক গণ্য করে। নিজ ধর্মের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কতটা গভীর হলে সেটি হতে পারে – সেটি কি বুঝতে কি থাকে?
শেষ হয়নি শত্রুর দখলদারী
মুসলিমদের দায়ভার শুধু ভৌগলিক মানচিত্রের উপর ইসলামের বিজয়কে সুনিশ্চিত করা নয়, বরং সেটি জনগণের চেতনার মানচিত্রেও সুসংহত করা। প্রতিটি বিজয়ী সেনাবাহিনীই সেটি করে। ইংরেজগণ তাই শুধু বাংলার ভৌগলিক মানচিত্রের উপরই দখল জমায়নি, দখল জমিয়েছে বাঙালীর চেতনার মানচিত্রেও। ব্রিটিশের সামরিক দখলদারীটা ১৯৪৭ সালে শেষে হয়েছে। কিন্তু চেতনা রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত সে দখলদারীটা এখনো প্রবল ভাবে বেঁচে আছে। শত্রুর সে বুদ্ধিবৃত্তিক দখলদারী হটিয়ে রাজনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত, অর্থনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির কোন একটি অঙ্গণেও ইসলাম বিজয়ী হতে পারিনি। ব্রিটিশের এ অব্যাহত দখলদারী বাঁচিয়ে রেখেছে বাঙালী সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, বিচারক, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাগণ। সে লক্ষ্যে কাজ করছে বহু হাজার এনজিও নেতাকর্মীগণ। বাংলাদেশে ইংরেজগণ তাদের ১৯০ বছরের শাসনেও ঘরে ঘরে সূদ খাওয়া ও সূদ দেয়ার ন্যায় হারাম কাজের আাবাদ বাড়াতে পারিনি। কিন্তু এনজিওগুলোর কারণে সেটি সহজেই সম্ভব হয়েছে। অথচ সূদ খাওয়া ও সূদ দেয়া সামান্য পাপ নয়, নবীজী (সা:) সূদকে মায়ের সাথে জ্বিনার ন্যায় পাপ বলেছেন।–(হাদীস)। তাই কোন মুসলিম যেমন ব্যাভিচারি হতে পারে না, তেমনি সূদখোরও হতে পারে না। এটিই তো মুসলিমের ঈমান। কিন্তু মুসলিমের সে ঈমান এবং ইসলামের সে ভিত্তিমূলটি গুড়িয়ে দিয়েছে দেশের সেক্যুলারিস্টগণ। অপর দিকে বাংলাদেশের আদালতে এখনো পূর্ণ দখলদারী ব্রিটিশদের প্রবর্তিত কুফরি আইন ও তাদের রসম-রেওয়াজের। সে আইনে পতিতাবৃত্তি যেমন হালাল, তেমনি হালাল হলো সূদ, মদ ও জুয়া। মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইনের সেখানে কোন দখলদারী চলে না।
শরিয়তী আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেয়ে মহান আল্লাহতায়ালার অধিক অসম্মান আর কি হতে পারে? কোন রাজার রাজ্য যদি তাঁর হুকুমই না চলে তবে সে রাজার কি কোন ইজ্জত থাকে? এ বিশ্ব তো মহান আল্লাহতায়ালার রাজত্ব এবং শরিয়ত তাঁর আইন। ফলে তাঁর মহান ইজ্জতের উপর এর চেয়ে বড় হামলা ও অবমাননা আর কি হতে পারে যদি তার শরিয়তী আইনই মানা না হয়? এটি তো অতি জঘন্য অপরাধ। এরূপ জঘন্য কাজ যারা করে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোর’আনে তাদেরকে কাফের, জালেম ও ফাসেক এ তিনটি বিশেষ পরিচয়ে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ তারা শুধু কাফেরই নয়, তারা সে সাথে জালেম ও ফাসেকও। অথচ আদালত থেকে শরিয়তী আইন বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সে অপরাধটিই লাগাতর করা হচ্ছে। মহান আল্লাহতায়ালার আইনের এরূপ অবমাননা নিয়ে কি মুসলিম থাকা যায়? সাহাবায়ে কেরামের যুগে এমনটি কি কল্পনা করা যেত?
শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখাই যে সেক্যুলারিস্টদের মূল এজেন্ডা -সেটি কোন গোপন বিষয় নয়। সেটি বরং তারা জোরে সোরেই বলে। শাসনতন্ত্রে আল্লাহর আইন দূরে থাক, মহান রাব্বুল আলামীনের নামটিও তাদের কাছে অসহ্য। ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদকে তারা ফাঁসির যোগ্য ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে। অথচ মানবাধিকার রূপে গণ্য হচ্ছে পতিতাবৃত্তি, সমকামিতা, মদ্যপান, জুয়া ও সূদের ন্যায় পাপাচার। আল্লাহর দেয়া আলো-বাতাসে বাস করেও কাফেরগণ যেমন শয়তানের গোলামী করে, এরাও তেমনি মুসলিম ভূমিতে বাস করে গোলামী করে অমুসলিম সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণার। মিশরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কর্তা ব্যক্তি লর্ড ক্রমার এ শ্রেণীর মানসিক ও সাংস্কৃতিক গোলামদের নিয়ে বড় আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ইসলামে অঙ্গিকারহীন এরূপ গোলাম শ্রেণী তৈরী না হওয়া অবধি কোন অধিকৃত মুসলিম ভূমিকে ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা দিবে না -সে ঘোষণাও তিনি দিয়েছিলেন। লর্ড ক্রমারের সে কথাই এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশেরা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু শাসন ক্ষমতা, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা দিয়ে গেছে এরূপ মানসিক গোলামদের হাতে। ফলে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
দেহের স্বাস্থ্য বাঁচাতে হলে শুধু প্রাণনাশী রোগজীবাণুগুলি চিনলে চলে না। সেগুলির নির্মূলে চিকিৎসাও জরুরি। তেমনি মুসলিম উম্মাহর স্বাস্থ্য বাঁচাতে হলে শুধু বিদেশী শত্রুদের চিনলে চলে না; ঘরের শত্রুদেরও চিনতে হয়। নবীজী (সা:)’র আমলে শুধু চেনার কাজই হয়নি; তাদের নির্মূলের কাজও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটিও যথার্থ ভাবে হয়নি। হয়নি বলেই ঈমানবিনাশী ও দেশবিনাশী এসব ভয়ংকর জীবাণুগণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু ভোটই পায় না, হৃদয়েও স্থান পায়। জাতির নেতা, জাতির পিতা ও দেশের বন্ধু রূপেও গৃহিত হয়।
জিহাদ ও জিহাদভীতি
মুসলিম দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আইন আদালত যখন ইসলামের শত্রুশক্তির হাতে অধিকৃত হয়, জিহাদ তখন নামায-রোযার ন্যায় সবার উপর ফরজ হয়ে যায়। নইলে সে অধিকৃত ভূমিতে পূর্ণ ইসলাম পালন অসম্ভব হয়। রাষ্ট্র তখন শয়তানের বাহনে পরিণত হয়; এবং সে রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটটি তখন সরাসরি শয়তানের দখলে যায়। মুসলিম জীবনে সবচেয়ে সর্বনাশা বিপর্যয় তখনই শুরু হয়। তাই সভ্য নাগরিকের দায়িত্ব শুধু নিজের ঘরকে ডাকাতমুক্ত করা নয়, বরং রাষ্ট্রকে শয়তানের অধিকার মুক্ত করা। মু’মিনের জীবনে এখানেই ঘটে ঈমানের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাশ করতে শতকরা ৬০ ভাগের বেশী শহীদ হয়ে গেছেন। হযরত আবু বকর (রা:)’র শাসনামলে কিছু লোক রাষ্ট্রীয় ভান্ডারে যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিলেন। আর তাতেই তাদের বিরুদ্ধে তিনি জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলাদেশের মুসলিমদের জিহাদ কোন কাফের দেশ দখল করা নিয়ে নয়। বরং সেটি নিজ দেশকে ইসলামের শত্রুশক্তির দখলদারি থেকে মুক্ত করার। জিহাদ এখানে আল্লাহর পরাজিত বিধানকে পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করার।এ জিহাদে যোদ্ধা হওয়া তাই প্রতিটি মুসলিমের উপর নামায-রোযার ন্যায় ফরজ। নামায-রোযায় কাজা আছে কিন্তু এ ফরজে কাজা নাই। অথচ সে পবিত্র ফরজ জিহাদে যোদ্ধা হওয়াকেই অপরাধ ও সন্ত্রাস বলা হচ্ছে। জিহাদ নিয়ে এ ব্যাখাটি নিতান্তই শয়তানি শক্তির নিজস্ব আবিস্কার। ইসলামের শত্রুপক্ষটি এরূপ প্রচার চালাচ্ছে একটি বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। সেটি শুধু তাদের স্বৈরাচারি শাসনকে দীর্ঘায়ীত করার লক্ষ্যে নয়, বরং বাংলাদেশের বুকে বিদেশী কাফের শক্তির আগামী আগ্রাসনকে প্রতিরোধহীন করার লক্ষ্যে। কারণ, তারা তো সে কাফের শক্তিরই সেবাদাস।
জিহাদই দেয় মুসলিম বাহিনীকে বিপুল লড়াকু জনবল। সাধারণ প্রজারা তখন নিজেদের অর্জিত অর্থ, খাদ্য এবং অস্ত্র সাথে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে। সেটিকে তারা জান্নাতে প্রবেশের দরওয়াজা গণ্য করে। জিহাদ এভাবে জনগণের ব্যাপক ক্ষমতায়ন ঘটায়। প্রতিটি নাগরিক তখন যোদ্ধায় পরিণত হয় –যেমনটি নবীজী (সা:)’র আমলে হয়েছিল। সে ইতিহাস জানে বলেই ইসলামের শত্রুপক্ষের মনে এতো ইসলামভীতি ও জিহাদভীতি। জিহাদের চেতনা বিলুপ্তিতে এজন্যই তাদের এতো আয়োজন। বিলুপ্ত করতে চায় ওয়াজ ও আলোচনায় জিহাদ শব্দের ব্যবহার। এমন কি আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ করতে চায় জিহাদকে। কারণ, জিহাদ নিষিদ্ধ হলে এ পবিত্র ইবাদতটি তখন আদালতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হবে। ভারতে যখন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের শাসন, তারাও নিষিদ্ধ করেছিল জিহাদকে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিন যক্তরাষ্ট্র মুসলিম দেশের স্কুল ও মাদ্রাসায় সিলেবাস বদলানোতে হাত দিয়েছে।
বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চেতনার ভূগোলটি বহু আগেই ভারতীয় কাফেরদের চেতনার সাথে মিশে গেছে। এখন শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল একাকার করার কাজটি বাঁকি। ভারতীয় বা পাশ্চাত্যের কাফেরদের ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতির চেয়ে ইসলাম ও ইসলামের সংস্কৃতিই তাদের কাছে বেশী বিদেশী মনে হয়। অথচ আগ্রাসী ভারতীয়দের হাতে বাংলাদেশ একাত্তরের ন্যায় আবার অধিকৃত হলে বাঙালী মুসলিমদের জীবনে যে ভয়ানক আযাব ও অপমান নেমে আসবে তাতেও কি কোন সন্দেহ আছে? একাত্তরে অধিকৃত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী খেতাব জুটেছিল ভিক্ষুকের তলাহীন ঝুলির। এতবড় অপমান কোন কালেই কোন মুসলিম দেশের জুটেনি। সেটিই পরিমাপ দেয় আগ্রাসী ভারতীয়দের দস্যুবৃত্তি একাত্তরে কতটা নির্মম ছিল। কিন্তু পুণঃরায় অধিকৃত হলে আবার নেমে আসবে সে আযাব।
মুসলিম রাষ্ট্রের অতিক্ষুদ্র অঙ্গণকেও কাফেরদের হাতে অধিকৃত থাকতে দেয়ার বিধান ইসলামে নেই। না সামরিক ভাবে, না সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক ভাবে। বাংলার নবাব যখন কয়েকটি গ্রামের মালিকানা ইংরেজদের হাতে তুলে দেয় তখন থেকেই শুরু হয় খাল কেটে কুমির আনার কাজ। তখন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে বাংলার উপর ইংরেজদের দখলদারি। একই ভাবে ধীরে ধীরে সমগ্র ফিলিস্তিন অধিকৃত হয়েছে ইহুদীদের হাতে। ধর্মীয়, আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক ময়দানের কোন একটি ক্ষেত্রও যদি শত্রুশক্তির দখলদারিতে যায় তখন সেটি যে কতবড় ভয়ানক বিপর্যয় ঘটায় -এ হলো তার নমুনা। মুসলিমদেরকে তাই মুসলিম ভূমির প্রতি ইঞ্চিকেই সুরক্ষা দিতে হয়। শুধু দেশের ভূগোল পাল্টালে চলে না, মনের ভূগোলও ইসলামী করতে হয়। নিরংকুশ বিজয় আনতে হয় দেশবাসীর চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণেও। অথচ বাংলাদেশে সে বিজয় কোন কালেই অর্জিত হয়নি। বাঙালী মুসলিমের এখানেই বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার কারণে, অনৈসলামিক চেতনা বেঁচে আছে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনের মানচিত্রে।
ইসলামের জিহাদ তাই শুধু সামরিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকও। বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধাদের কাজ হয় কোটি কোটি মুসলিমের চেতনার ভূমিকে প্রতিরক্ষা দেয়া। সে কাজটি যথাযথ না হলে মুসলিমগণও শত্রু বাহিনীর সৈনিকে পরিণত হয়। সব পরাজয়ের শুরু তো চেতনার ভূমি থেকেই। জ্ঞানীর কলমের কালি তাই শহীদের রক্তের চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে বাঙালী মুসলিম সৈনিকদের সংখ্যাটি অতি নগন্য। ফলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের সবচেয়ে বড় পরাজয় এবং শত্রুশক্তির সবচেয়ে বড় দখলদারিটি ঘটেছে জনগণের চেতনার ভূবনে। চেতনার মানচিত্রটি এভাবে শত্রুশক্তির দখলে গেলে রাজনৈতিক মানচিত্রের উপরও কি দখলদারি থাকে? তখন পুরা দেশ পরিণত হয় শত্রুশক্তির অধিকৃত ভূমিতে। রাষ্ট্রের উপর ইসলামের নিরংকুশ বিজয় নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার নিজস্ব ঘোষণাটি হলো: “তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি হিদায়েত ও সত্যদ্বীনসহ তাঁর রাসূলকে পাঠিয়েছেন। এবং সেটি এজন্য যে সেটি বিজয়ী হবে সকল দ্বীন তথা ধর্মের উপর।..”।–(সুরা সাফ, আয়াত ৯)। তাই বিজয় শুধু ভৌগলিক হলে চলে না, আদর্শিক ও ধর্মীয়ও হতে হয়। মুসলিম ভূমিতে তাই কোন রাজা, কোন স্বৈরাচারি শাসক বা কোন জনগোষ্ঠির সার্বভৌমত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না, তেমনি বৈধতা পেতে পারে না ইসলাম ভিন্ন অন্যকোন ধর্মমত বা মতাদর্শের বিজয়। বিজয়ী হওয়ার বৈধ অধিকার রাখে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন। প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব হলো ইসলামকে বিজয়ী করার লড়াইয়ে সৈনিক হয়ে যাওয়া। মুসলিম জীবনে এর চেয়ে গুরুত্পূর্ণ কোন কাজ নাই।
জিহাদশূণ্যতা ও হারাম রাজনীতি
আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার দায়ভার ফেরেশতাদের নয়, সে দায়ভারটি ঈমানদারদের। কারণ, এ পৃথিবী ফেরেশতাদের পরীক্ষাস্থল নয়; এখানে পরীক্ষা হয় তাদের যারা নিজেদের ঈমানদার রূপে দাবী করে। এবং পরীক্ষাটি হয় অর্পিত দায়ভার পালনের মধ্য দিয়ে। ফলে ঈমাদারকে শুধু নামাযী ও রোযদার হলে চলে না, মুজাহিদও হতে হয়। মু’মিনের বাঁচার ভিশনটি কি, সে সাথে তাঁর রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির মিশনই বা কি –সেটি সুরা সাফ’য়ের উপরুক্ত আয়াতটিতে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এরূপ একটি মিশনকে মু’মিনের জীবনে ফরজ করার জন্য পবিত্র কোর’আনের উপরুক্ত ঘোষণাটি মাত্র একবার ঘোষিত হওয়াই যথেষ্ট ছিল। অথচ মহান আল্লাহতায়লা সেটি ঘোষণা শুনিয়েছেন তিন বার। ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে দেশে দেশে ও যুগে যুগে মু’মিনদের জীবনে যে লাগাতর লড়াই –সেটির ধর্মীয়, নৈতিক ও দার্শনিক যৌক্তিকতা তো মহান আল্লাহতায়ালার এ ঘোষণা।
ইসলাম-অনৈসলামের দ্বন্দে ঈমানদারের জন্য নিরব ও নিষ্ক্রীয় থাকাটি যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো নিরেপক্ষ থাকা। কারণ, তাতে ইসলামের বিজয় আসে না। এজন্য ফরজ হলো লড়াইয়ের প্রতি অঙ্গণে ইসলামের পক্ষ নেয়া। ইসলাম কবুলের সাথে সাথে ঈমানদারের জীবনে তাই নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতের সাথে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদও এসে যায়। সে সাথে কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধও আসে। সেগুলি যেমন নবীজী (সা:)’র জীবনে এসেছিল, তেমনি এসেছিল প্রতিটি সাহাবীর জীবনেও। মুসলিম নামধারী হয়েও যারা রাজনীতিতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করতে চায়, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে, নবীজী (সা:) বেঁচে থাকতে কার হাতে ছিল মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি? কে ছিলেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান? কে পরিচালনা করতেন জিহাদ? তখন তো নিষিদ্ধ হয়েছিল তাদের রাজনীতি -যাদের লক্ষ্য জনগণকে জাহান্নামে নেয়া। এটি তো ভয়ানক অপরাধের রাজনীতি। তাদের এ অপরাধ তো চোরডাকাতদের অপরাধের চেয়েও ভয়ানক। চোরডাকাতগণ মানুষের অর্থে হাত দিলেও কাউকে জাহান্নামে নেয় না। এ কাজটি তো তাদের -যারা শরিয়তের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করে। নবীজী(সা:) ও সাহাবাযে কেরামের শাসনামলে মুসলিম ভূমিতে তাই এরূপ অপরাধীদের রাজনীতিকে কখনো অনুমতি দেয়া হয়নি। ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ যা করতে চায় -তা হলো নবী-আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। শরিয়ত বিরোধীতার এ রাজনীতি শত ভাগ হারাম –যেমন হারাম হলো পতিতাবৃত্তি, মদপান, জুয়া ও সূদ। কোন মুসলিম দেশে এ রাজনীতি বৈধতা পেতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোতে এ হারাম রাজনীতিই বিজয়ী। আর এ হারাম রাজনীতির বিজয়ের মূল কারণ, মুসলিম জীবনে জিহাদশূণ্যতা। এবং একমাত্র জিহাদের মাধ্যমেই বিজয়কে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে।
পরাজয় যেরূপে অনিবার্য হয়
রাষ্ট্রের অঙ্গনে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হবে, না অন্য ধর্ম বা বিধান প্রতিষ্ঠা পাবে -সে ফয়সালাটি কখনোই মসজিদ-মাদ্রাসার মেঝেতে হয় না। পীরের খানকাহ, তাবলিগের ইজতেমা বা সুফির আস্তানাতেও হয় না। সেটি নির্ধারিত হয় জিহাদের ময়দানে। তাই ইসলামের বিজয় নিয়ে যাদের সামান্যতম ভাবনা আছে তারা কি কখনো নিজেদের ইবাদত-বন্দেগী মসজিদ-মাদ্রাসা, পীরের খানকাহ, সুফির আস্তানা বা তাবলিগ ইজতেমায় বন্দি রাখতে পারে? তারা তো সকল সামর্থ্য নিয়ে হাজির হয় জিহাদের ময়দানে। নবীজীকেও তাই বদর,ওহুদ¸খন্দক খায়বর ও হুনায়ুনের যুদ্ধের ন্যায় বহু যুদ্ধে নামতে হয়েছে। নামতে হয়েছে লাগাতর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়েও।
ব্যক্তির যুদ্ধ, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি থেকেই ধরা পড়ে সে মূলত কোন পক্ষের। তাছাড়া কোন দল ও কোন মতাদর্শের প্রতিষ্ঠায় সে রায় দেয়, অর্থ দেয় বা শ্রম ও রক্ত দেয় –সেটিও কি গোপন থাকার বিষয়? মু’মিনের ঈমানদারী এবং কাফেরদের বেঈমানী তো এভাবেই প্রকাশ পায়। মদিনার মুনাফিকগণ নবীজী (সা:)’র পিছনে নিয়মিত নামায পড়েছে। কিন্তু তাদের মুনাফিকি ধরা পড়েছে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধের ময়দানে। ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো, জনগণের জীবন থেকে যখনই জিহাদ বিলুপ্তি হয়, তখনই ইসলাম বিলুপ্ত হয় দেশের রাজনীতি, আইন-আদালত, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসন থেকেও। দেশ এভাবেই অধিকৃত হয়ে যায় ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। ইসলাম ও মুসলিমের পরাজয় তো এভাবেই অনিবার্য হয়। এবং আজকের বাংলাদেশ তো তারই উদাহরণ। ১ম সংস্করণ ২২/০৩/২০১৪; ২য় সংস্করণ ০৪/০২/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018