নির্মূলের মূখে মায়ানমারের মুসলমান এবং বাংলাদেশের দায়িত্বহীনতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 1, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
নির্মূলের মুখে মায়ানমারের মুসলমান
মায়ানমারের মুসলমানেরা আজ ভয়ানক বিপদের মুখে। তাদের ঘরবাড়ি,দোকানপাঠ পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশ, সৈন্যরা লাশগুলোকে দাফন করতে না দিয়ে গায়েব করে দিচ্ছে। এশিয়ান ক্যারেসপন্ডেন্ট ডট কমের সাংবাদিক ফ্রান্সিস ওয়াদের রিপোর্ট,পুলিশ দাঙ্গাকারি বার্মিজদের সাথে মিলে মুসলমানদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। পুলিশ মুসলমানদের দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে।এমনও রিপোর্ট আসছে,নিহত ও আহত মুসলমানদের মাথামুড়িয়ে ও গায়ে গেরুয়া পোষাক পড়িয়ে ছবি তুলে বৌদ্ধ বলে বিশ্বময় প্রচার চালাচ্ছে।সমুদ্রে নামা ছাড়া মুসলমানদের সামনে আশ্রয় লাভের কোন স্থান নেই। বাংলাদেশই একমাত্র প্রতিবেশী মুসলিম দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে আসাও তাদের জন্য অসম্ভব করা হয়েছে। আহত ও ক্ষুদার্ত নারী-শিশুদের নিয়ে তাদের নৌকাগুলো দিবারাত্র সাগরে ভাসছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য এ এক নিদারুন দুরাবস্থা।
সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল (১৪/০৬/১২) রয়টার্স জানায়, বুধবার রাতেও বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের দুটো গ্রামে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সাম্প্রদায়িক এই দাঙ্গায় অন্তত ১,৬০০ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে গতকাল এএফপি জানায়, এই দাঙ্গায় অন্তত ৩০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং রাখাইন রাজ্যে স্থাপিত ৩৭ টি আশ্রয় শিবিরে অন্তত ৩১,৯০০ জন আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের সহায়তায় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকা, পুলিশ ও ‘লুন্টিন’ বাহিনী এই হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। গত ৬ দিনে শুধু মংডুতেই নিহত হয়েছে ৪ শতাধিক। এদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এদিকে নিজ দেশেই চরম নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশের পথও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পরিবার-পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। বুকফাটা কান্না আর মৃত্যুকে মেনে নিয়ে আবার মিয়ানমারে ফিরে যেতে হচ্ছে হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের। অনেকে আবার জীবন বাঁচাতে নৌকায় করে নদীতে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেকের লাশ ভাসছে বঙ্গোপসাগরে। জাতিসংঘের মতে, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সংখ্যালঘু হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা।(সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ, ১৫/০৬/১২)।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, ‘আমরা এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন, বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আসতে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের পুশব্যাক করছে।’ বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজিত নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এ কথা বলেন। এর আগে জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশকে একই আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ সরকারের বড় দায়িত্বহীনতা হলো, মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া উচ্ছেদপ্রক্রিয়াকে বিশ্ববাসী যেভাবে দেখছে, সরকার সেভাবে সেটিকে দেখছে না। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটিকে মায়ানমার সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামীর কাণ্ড বলে উদ্ধৃত করেছে। এভাবে সরকার একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক বিষয়কে বাংলাদেশের জামায়াতী ইসলামীর সৃষ্ঠ আভ্যন্তরীণ ব্যাপার রূপে চিত্রিত করলো। দায়িত্বহীনতা আর কাকে বলে!
ঘরবাড়ী আগুনে বিধ্বস্ত হলে পাশের প্রতিবেশী আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসে। তেমনি কোন দেশে একটি জনগোষ্ঠি নির্মূলের মুখে পড়লে প্রতিবেশী দেশ এগিয়ে আসে। কিন্তু পাশে সমুদ্র ছাড়া মিয়ানমারের মুসলমানদের সে রকম প্রতিবেশী নেই। তাদের দুর্ভাগ্য, তারা প্রতিবেশী রূপে পেয়েছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানে যখন সোভিয়েত আগ্রসন শুরু হয়ে তখন তিরিশ লাখ আফগান নাগরিক তিরিশ বছর যাবত পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০ লাখ আশ্রয় নিয়েছিল ইরানে। সাতচল্লিশে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মুসলমানগণ জানমাল বাঁচাতে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। একই ভাবে ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে প্রাণ বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী প্রতিবেশী আরব দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি সিরিয়ার হাজার হাজার নাগরিক আশ্রয় নিচ্ছে পাশ্ববর্তি তুরস্ক, জর্দান ও লেবাননে। ইতিহাসে এমন উদাহরণ ভূরি ভুরি। অসহায় উদ্বাস্তুতের প্রবেশ রুখতে কোন প্রতিবেশী দেশই দরজা বন্ধ করে দেয় না। মায়ানমারের মুসলমানেরা প্রতিবেশী থেকে সেরূপ আচরণ পায়নি।
বাংলাদেশের নতুন রেকর্ড
বাংলাদেশ অতীতে ৫ বার রেকর্ড করেছিল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বৃত্তকবলিত দেশ রূপে। এবার আরেক রেকর্ড যোগ হলো। সেটি হৃদয়হীনতায়। প্রতিবেশী রূপে বাংলাদেশ যে কতটা খারাপ সেটিই বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করলো। মায়ানমারের মুসলমানদের এটি এক বড় দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী,কোস্টাল গার্ড ও পুলিশ বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানভর্তি নৌকাগুলোকে বাংলাদেশের সীমান্তে ভিড়তে দিচ্ছে না। সীমান্ত রক্ষিরা তাদের পুশব্যাক করছে। কক্সবাজারের ১৭ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল খালেকুজ্জামান পিএসসি বলেন, সীমান্ত ও উপকূলীয় এলাকায় বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। গতকাল সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেনি। নাইক্ষ্যংছড়িস্থ ১৫ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুব বলেন, পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেনি। সীমান্ত এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। -(সূত্রঃ নয়াদিগন্ত, ১৪/০৬/১২)। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে না দেয়াই যে সরকারি নীতি এ হলো তার প্রমাণ। অথচ আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক বাংলাদেশ দায়বদ্ধ এমন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়া। জান বাঁচানোর স্বার্থে কেউ যদি অন্য দেশে প্রবেশ করে তবে কোন সভ্যদেশেই তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারি বলে না। জানা বাঁচানো প্রতিটি নাগরিকেরই মৌলিক মানবিক অধিকার। সেটি কোন দেশে বিপন্ন হলে সে অন্য যে কোন দেশে আশ্রয় নেয়ার অধিকার রাখে। সেটিই আন্তর্জাতিক নীতি।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে সরকারের প্রতি ইতিমধ্যে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি আবারও সে দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। সরকারের অনড় অবস্থানের ফলেই গতকাল ১১৪ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়নি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড। (সূত্রঃ আমার দেশ, ১৪/০৬/১২)।এভাবে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশ সরকার জানিয়ে দিল,দেশটি শুধু হাত পেতে ত্রান নিতেই জানে,দিতে নয়। তারা শুধু দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার সামর্থই রাখে না,বিপদে পড়া প্রতিবেশীদের প্রতি অতি নির্দয় ও নিষ্ঠুর হওয়ারও সামর্থ রাখে। একটি জনগোষ্ঠির বিবেকের পচন আর কত কাল এভাবে প্রকাশ পেতে থাকবে?
লক্ষণীয় হলো,নির্দয়তা শুধু সরকারের একার নয়। বরং আক্রান্ত যেন সমগ্র দেশ। মুসলিম উৎখাতের ন্যায় নিষ্ঠুরতা থামাতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলে যেমন কোন উদ্যোগ নেই,তেমনি সে মুসলিম-নির্মূল নীতির বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায়ও কোন প্রতিবাদ নাই। বাংলাদেশ সরকারের মানবতাশূন্য নীতির বিরুদ্ধে দেশের বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী, লেখক-বুদ্ধিজীবী, ছাত্রশিক্ষক ও আলেম-উলামাদের পক্ষ থেকেও কোন নিন্দাবাদ নাই। মায়ানমারের মুসলিম-নির্মূলে বিষয়টি নতুন নয়। আশির ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একই রূপ নির্মূল অভিযান শুরু হয়েছিল। হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তখন দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তাদের বহু হাজার মুসলমান এখন বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়ে আছে।
দেশহীন থেকে গৃহহীন
আরাকানের মুসলমানদের সাথে বড়ই অবিচার হলো তারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও তাদের সে দেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এর চেয়ে বড় অবিচার আর কি হতে পারে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে মাত্র ৫ বছর বৈধ বসবাসের সার্টিফিকেট দেখাতে পারলে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। অথচ মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের শত শত বছর ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্টে ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে বসতি স্থাপনকারিগণ যত বছর ধরে বসবাস করছে তার চেয়ে বেশী বছর যাবত আরাকানে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। অথচ তাদের নাগরিত্ব না দিয়ে এখন বহিস্কারের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। নাগরিকতা দেয়া হয়নি নিছক ধর্মীয় কারণে। আর এখন তাদের গৃহহীন করা হচ্ছে।
দেশেই নানা ধর্ম, নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মানুষ দিয়ে গড়ে উঠে। বাংলাদেশে যেমন মুসলমানের পাশাপাশি হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান আছে তেমনি বাংলাভাষীদের পাশে বহু অবাঙালীও আছে। বহু চাকমা,গারো,হাজং,মুনিপুরি,মগও আছে। শুধু এক ধর্ম,এক ভাষা ও এক বর্ণের মানুষ দিয়ে দেশ গড়ার প্রেরণাটি অতি অসুস্থ্য চেতনার। সে অসুস্থ্য চেতনার মানুষেরা ভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষদের নির্মূল করার ন্যায় ভয়ানক অপরাধটি ঘটায়। জার্মানীতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে সেটিই ঘটেছিল। তেমনটি ঘটেছে ইসরাইল ও বসনিয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আজ একই অপরাধ ঘটছে মায়ানমারে। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ থেকে ভিন্নতর ধর্ম ও ভাষা হওয়ার কারণেই কারো নাগরিকত্ব হরন করা যায় না। অথচ মায়ানমারে সেটিই হয়েছে। এমনটি হয়েছে মুসলিম ভীতি থেকে। মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরনের কারণ রূপে দেখানো হচ্ছে তারা এসেছে পার্শ্ববর্তি বাংলাদেশ থেকে। কথা হলো তারা যদি বাংলাদেশ থেকে গিয়েও থাকে সেজন্য কি তাদের নাগিরকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যায়? নানা দেশে বিচিত্র মানুষের যে সংমিশ্রন দেখা যায় তার কারণ এ নয় যে মানুষগুলো আসমান থেকে নাযিল হয়েছে। বরং আসে পাশ্ববর্তি দেশ থেকে। বাংলাদেশে বহু মানুষ ভারত থেকে এসে বসতি গড়েছে, সেটি যেমন শত শত বছর আগে,তেমনি অনেকের আগমনের বয়স ৬৫ বছরের বেশী নয়। তেমনি বহু মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়েও বসবাস করছে। মানুষ যেমন জন্ম নেয়,তেমনি মাইগ্রেশনও করে। সেটিই সভ্যতার রীতি। হাজার হাজার বছর ধরে সে রীতি চলে আসছে। কিন্তু সে মাইগ্রেশনের জন্য কি কারো নাগিরত্ব হরন করা যায়? অথচ সে নিদারুন অবিচার হচ্ছে মায়ানমারের মুসলমানদের সাথে।
মুসলিম বসতি হাজার বছরের
আরাকানে মুসলমানদের বসতি হাজার বছরেরও বেশী পুরোন তার পিছনে দলিল রয়েছে। সে দলিল রয়েছে খোদ মায়ানমারে। সেখানে মুসলমান বসতির সুত্রপাত প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক আরাকানের জাতীয় ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ ‘রাজোয়াং’ থেকে নিম্নোক্ত বিবরণটি উদ্ধৃত করেছেনঃ “খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ পাদে যখন আরাকান রাজ মহতৈং চন্দয় (Mahatoing Tsandya- 788-810 A.D.)রাজত্ব করিতেছিলেন, তখন কতকগুলি মুসলমান বনিক জাহাজ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ফলে আরাকানের দক্ষিন দিকস্থ ‘রনবী’(আধুনিক রামরী)দ্বীপে উঠিয়া পড়েন।তাঁহারা আরাকানীগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া রাজার সম্মুখে নীত হয়েছিলেন।রাজা তাঁহাদের দুরবস্থা দেখিয়া দয়া পরবশ হইয়া তাঁহাদিগকে স্বীয় রাজ্যে গ্রামে গিয়া বসবাস করিতে আদেশ দিয়াছিলেন।” ডঃ এনামুল হক মনে করেন যে,“রাজোয়াং–এ উল্লেখিত এ সব মুসলমান বণিক আরব দেশীয় ছিলেন এবং চাঁটগা থেকে উপকূল বেয়ে দক্ষিন মুখে যাবার পথে,কিংবা দক্ষিন উপকূল হয়ে উত্তরে চাটগাঁর দিকে এগুবার সময়ই ঝঞ্জাতাড়িত হয়ে সম্ভবতঃ তাঁরা রামরী দ্বীপে গিয়ে আশ্র্য় নিয়েছিলেন।” সুপ্রাচীন আরবীয় ঐতিহ্য অনুসারে একই সাথে জীবিকা অর্জন ও ধর্ম প্রচারের সুমহান চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে মুসলমানেরা দলে দলে নৌ ও স্থলপথে এশিয়া,ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সমুহে ছড়িয়ে পড়েছিল।এরই অংশ হিসেবে খৃষ্টীয় নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে বার্মায় মুসলিম উপনিবেশ গড়ে উঠে। জীবন-জীবিকার অনিবার্য প্রয়োজনে স্থানীয় মহিলাদেরকে বিবাহ-শাদী করে তাঁরা সেখানে ধনে-জনে বর্ধিত হতে থাকে।
পরীক্ষার মুখে বাংলাদেশের মুসলমান
আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ ভয়ানক বিপদে বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর বিশাল দায়ভার। আল্লাহতায়ালা মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করেন।কখনো তার নিজের উপর বিপদ দিয়ে,আবার কখনো প্রতিবেশীর উপর বিপদ দিয়ে। বাংলাদেশের মুসলমানগণ তাই এখানে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। এ পরীক্ষায় ফেল করলে শুধু মানব জাতির ইতিহাসেই তাদের কদর্যতা বাড়বে না, আল্লাহর দরবারেও তাদের ব্যর্থতা বাড়াবে। প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে প্রতিবেশী মাত্রই সর্ব সামর্থ নিয়ে সে আগুন থামানোর চেষ্টা করে। প্রতিবেশীর মাঝে সে তাড়না না থাকলে বুঝতে হবে সে ব্যক্তিটি অমানুষ। জন্তু-জানোয়ার ও উদ্ভিদের সে সামর্থ থাকে না বলেই তারা ইতর। প্রতিবেশী-সুলভ এমন কাজের জন্য মুসলমান হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। এমনকি অমুসলিম কাফেরগণও সে কাজ করে। তবে মুসলমানদের উপর সে পরীক্ষাটি আরো বেশী বেশী আসে। কারণ জাহান্নামের আগুন থেকে রেহাই দিয়ে জান্নাতে মৃত্যুহীন এক অনন্ত জীবন দেয়ার আগে আল্লাহতায়ালা তাদের যাচাই বাছাই করে নেন। তাই সে চুড়ান্ত পরীক্ষাগুলি আসে সে যাচাই বাছাইয়ের অপরিহার্য অংশ রূপে।সে পরীক্ষায় পাশ করার তাগিদে মুসলমান তাই শুধু প্রতিবেশীর ঘরের আগুন নেভাতে ছুটে যায় না, তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতেও সচেষ্ট হয়।
মুসলমানের পরিচয়টি শুধু আল্লাহর হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পিত গোলাম রূপেই নয়। আরেক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো সে অন্যান্য মুসলমানদের ভাই। সে পরিচয়টি মহান আল্লাহর দেয়া। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষণাটি হলো,“মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই,সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।” –(সুরা হুজরাত আয়াত ১০)।কাউকে ভাই বলাটি কোন ফাঁকা বুলি নয়।এটি মু’মিনের ঈমানের প্রকাশ। ফলে ভাই বলার মধ্য দিয়ে ঈমানদারের ঘাড়ে ঈমানী দায়ভারও এসে যায়। ইসলামের সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় বিশ্বভাতৃত্বের মজবুত বন্ধনটি গড়ে উঠে এ পরিচয়টির উপর। এ পরিচয়টি না থাকলে উম্মতে ওয়াহেদা গড়ে উঠার আর কোন ভিত্তিই থাকে না। তাই মুসলমান হওয়ার অর্থ যেমন আ্ল্লাহর পাকাপোক্ত গোলাম হয়ে যাওয়া,তেমনি অপর মুসলিমকে নিজের ভাই রূপে কবুল করে নেয়া। সেটি শুধু মুখে নয়,হৃদয় দিয়ে। চেতনা, কর্ম ও আচরণে সে ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ না ঘটলে সে মহান আল্লাহর দরবারে মুনাফিক রূপে চিত্রিত হয়। ভ্রাতৃত্বের সে মজবুত বন্ধনের কারণে সে অন্য কোন মুসলিমের বিপদে –তা সে রোহিঙ্গা হোক, বিহারী হোক, কাশ্মিরী হোক বা ফিলিস্তিনী হোক, সর্বাত্মক সাহায্যে নিয়ে ছুটে। মারাঠা হিন্দুদের হাতে নির্মূল হওয়া থেকে ভারতের মুসলমানদের বাঁচাতে তাই বাদশাহ আহম্মদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে আফগান সৈন্যরা নিজ অর্থ ও নিজ রক্ত দিয়ে লড়েছিল পানিপথের যুদ্ধে। মারাঠাদের শক্তি নির্মূল করার পরে আবার তারা নিজ দেশে ফিরে যায়। তেমনি রুশদের আগ্রাসন থেকে আফগান মুসলমানদের বাঁচাতে হাজার হাজার পাকিস্তানী, আরব, চেচেন লড়েছে আফগানিস্তানে গিয়ে। এ হলো মুসলমান হওয়ার দায়ভার। শুধু নামায-রোযার মধ্য দিয়ে সে দায়ভার পালিত হয় না, জানমালের কোরবানিও পেশ করতে হয়।
অন্য মুসলমানের বিপদে সাহায্য করায় যদি মুসলমানের জীবনে আগ্রহ না থাকে তবে বুঝতে হবে তার মুসলমান হওয়াতেই দারুন সমস্যা রয়ে গেছে। আল্লাহপ্রদত্ত ভ্রাতৃত্বের এ বন্ধনকে অস্বীকার করার অর্থ আল্লাহর দেয়া এ পরিচয়কে অস্বীকার করা। সেটি তাই আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ। শরিয়তের বিধানে এ বিদ্রোহ একটি কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ যে ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে নয়,সে নিশ্চিত ভাবেই দুষমণদের সাথে। মুসলমানদের সাথে সে ভ্রাতৃত্বের সে বন্ধন গড়তে হয় ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে। তাই আরবের আলী (রাঃ) ও উমর (রাঃ), ইথিওপিয়ার বেলাল (রাঃ), পারস্যের সালমান (রাঃ) এবং গ্রীকের সোহায়েল (রাঃ)সে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। এমন মুসলমানদের নিয়েই আল্লাহপাক গর্ব করেন;ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার গর্বে ভেসে যাওয়া বর্ণবাদীদের নিয়ে নয়। তাই শুধু মসজিদ মাদ্রাসা বাড়িয়ে আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়া যায় না,একক উম্মতের চেতনায় ভ্রাতৃত্বও গড়ে তুলতে হয়। সে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে খেলাফতও গড়তে হয়। নইলে আজ যে বিপদ আরাকানের মুসলমানদের উপর নেমে আসছে সেটি বাংলাদেশের মুসলমানদের উপরও একদিন নেমে আসবে। সেটি আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে মহা আযাব রূপে।
রোগ জাতিয়তাবাদের
জাতিয়তাবাদীদের বড় অপরাধ এবং সে সাথে চৃড়ান্ত বেঈমানীটি হলো তারা আল্লাহর আরোপিত প্যান-ইসলামিক ভ্রাত্বের পরিচয় মেনে নিতে রাজী নয়। তাদের কাছে বন্ধন বা ভ্রাতৃত্বের নিজস্ব মডেল বা ভিত্তি রয়েছে। সে মডেলটি ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে। সে মডেলের ভিত্তিতেই তারা দল গড়ে,এবং সে দলের রাজনীতি,স্বদেশ নীতি ও বিদেশ নীতি গড়ে। দেয়ালের সিমেন্ট খসে গেলে তার ইটগুলোও খসে পড়ে। তেমনি মুসলমানদের মধ্য থেকে প্যান-ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের মৃত্যু হলে মুসলমানগণও খন্ডিত হয়। দেহ থেকে হাতপা খন্ডিত হলে তাতে ব্যথাবেদনা থাকে না। তেমনি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বাঁধন ছিড়ে গেলে শুধু বিচ্ছিন্নতাই আসে না,খন্ডিতহ অঙ্গে বেদনাহীন চেতনাহীনতাও আসে। এজন্যই মায়ানামারের রোহিঙ্গাদের বিপদে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বাঙালী জাতিয়তাবাদীদের চেতনায় কোনরূপ দুঃখ নেই। ভারতীয় নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছিলেন, কোন তুর্কি সৈনিকের পাযে যদি কাঁটা বিদ্ধ হয় আর সে কাঁটার ব্যাথা যদি তুমি হৃদয়ে অনুভব না করো তবে খোদার কসম তুমি মুসলমান নও। -(মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রচনাবলি, ইসলামি ফাউন্ডেশন)। মাওলানা আযাদ যে সময় এমন কথা লিখেছিলেন তখন খেলাফত বাঁচাতে তুর্কি সৈনিকেরা শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াই লড়ছিল।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের পায়ে আজ কাঁটা বিঁধছে না,বরং গুলিবিদ্ধ হচ্ছে তাদের দেহ। এবং ভস্মিভূত হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ী-দোকানপাঠ। তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের নিজ দেশ থেকে। সে গুলির বেদনা এবং সে ঘরবাড়ী ভস্মিভূত হওয়ার দুঃখ কি বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা অনুভব করেন? যাদের মধ্যে সে বেদনা নাই তাদের কি মুসলমান বলা যায়? বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন,আরকানে মুসলিম নিধন করা মায়ানমারে আভ্যন্তরীন বিষয়।তিনি আরো বলেছেন,রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ ঠিক হবে না। দায়িত্বহীনতা আর কাকে বলে? অথচ আন্তর্জাতিক নীতি হলো,যখন কোন জনগোষ্টির বিরুদ্ধে নির্মূল প্রক্রিয়া চলে তখন সেটি আর সে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না। সেটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়। এমন প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো দায়িশীলতা,সেটি যেমন আল্লাহর প্রতি,তেমনি প্রতিবেশী মুসলমানদের প্রতি। বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে সে প্রতিবেশী হলো রোহিঙ্গা মুসলিম। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ কি তেমন দায়িত্বশীল রূপে নিজেদের পরিচয়টি দিতে পারছে? ১৫/০৬/১২
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018