পূর্ণ ইসলাম পালনও যখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক মানবিক অধিকারটি হলো মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমগুলির প্রতি পূর্ণ দাসত্ব নিয়ে বাঁচার স্বাধীনতা। এটি হলো পূর্ণ ঈমানদার রূপে বাঁচার স্বাধীনতা। মানব জীবনের এটিই হলো মূল এজেন্ডা। প্রাণে বাঁচার অধিকারের পর এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের বিষয় মানব জীবনে দ্বিতীয়টি নাই। তাই মুসলিম জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো মহান আল্লাহর পূর্ণ দাসত্বের সে অধিকার নিয়ে বাঁচার লড়াই। ইসলামে এটিই হলো পবিত্র জিহাদ। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি দাসত্বের সে স্বাধীনতাটুকু না থাকলে মানুষকে নিরেট কাফের হতে হয় এবং পরিনামে জাহান্নামের আগুনে যেতে হয়। শয়তান ও তার অনুসারী শক্তিবর্গ তো সেটিই চায়। এজন্যই তারা এ বিশেষ মৌলিক মানবিক অধিকারটুকু দিতে রাজি নয়। কারণ, সে অধিকার দিলে মানব সন্তানদের জাহান্নামের নেয়ার শয়তানী এজেন্ডা ব্যর্থ হয়। প্রতি যুগে এবং প্রতি দেশে শয়তানী শক্তিবর্গের মূল এজেন্ডা তাই পূর্ণ ইসলাম পালনের অধিকার কেড়ে নেয়া। এজন্যই তাদের অবিরাম যুদ্ধটি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে।

মক্কার দুর্বৃত্ত কাফেররা মুসলিমদের সে অধিকার দেয়নি। তাদের কাছে গুরুতর শাস্তি যোগ্য অপরাধ গণ্য হয়েছে পূর্ণ ইসলাম পালন। তাই তারা হযরত ইয়াসির (রা:) এবং তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া (রা:)‌’র ন্যায় মহান সাহাবীদেরকে অতি নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। হযরত বেলালকে মধ্যাহ্নের খর রৌদ্রে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে রাখতো। হযরত খাব্বাবকে শুইয়েছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্ব হওয়ার অধিকার না থাকার কারণেই মহান নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামদেরকে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করতে হয়েছিল। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল ইসলামী রাষ্ট্র। তবে হিজরত করেও তারা নিরাপত্তা পাননি। মক্কার কাফেরগণ এমন কি মদিনা থেকে মুসলিমদেরকে নির্মূলে নেমেছিল। নির্মূলের লক্ষ্যে কাফেরদের পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়েছিল বদর, ওহুদ এবং খন্দকের যুদ্ধ।

মুসলিম জীবনের জিহাদ হলো মূলত মহান আল্লাহ তা’আলার পূর্ণ দাসত্ব পালনের স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার লড়াই। যার জীবনে পূর্ণ পালনের অধিকার আদায়ের লড়াই নাই এবং আগ্রহ নাই পূর্ণ দ্বীন পালনে, এমন ব্যক্তি নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার হতে পারে না। নবীজী (সা:)’র যুগে এমন নামাজীদের মুনাফিক বলা হয়েছে। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ছিল তাদেরই একজন। সে নবীজী (সা:)’র পিছনে প্রথম সারিতে নামাজ পড়তো। কিন্তু সে নামাজ তাকে ঈমানদার বানাতে পারিনি। এ থেকে বুঝা যায়, ঈমানদার হতে হলে শুধু রোজা রাখলে ও নামাজে দাঁড়ালে চলে না, বরং রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধের ময়দানে ইসলামের পক্ষে লড়াইয়ে খাড়া হতে হয়। মুনাফিকদের সে সামর্থ্য থাকে না বলেই তারা মুনাফিক।    

যে দেশে পূর্ণ ইসলাম পালনের স্বাধীনতা নাই এবং সে স্বাধীনতা অর্জনের জিহাদও নাই, বুঝতে হবে সেদেশের জনগণের মাঝে মহান আল্লাহর পূর্ণ দাসত্ব নিয়ে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নাই। এমন লোকদের কারণেই বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে নবীজীর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে নাই। নবীজী (সা:)’র ইসলাম বাঁচলে তো দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেত। তখন আদালতে প্রতিষ্ঠা পেত শরীয়তী আইন। তখন জিহাদ দেখা যেত দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচারে’র প্রতিষ্ঠায়। নবীজী (সা:)র প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে না থাকাতে শরীয়তী আইনের বদলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ব্রিটিশ কাফিরদের প্রণীত কুফরী আইন। সুবিচার ও সুশাসনের  বদলে প্লাবন এসেছে দুর্বৃত্তি ও দুঃশাসনের। মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের বদলে মুসলিম দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাজা-বাদশাহ, ফ্যাসিস্ট শাসক বা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব। এর চেয়ে বড় বিদয়াত ও ভ্রষ্টতা আর কি হতে পারে?

মহান আল্লাহ তায়ালার দাসত্ব তথা ইবাদতের অর্থ শুধু নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত পালন নয়। বরং তাঁর সকল হুকুমের পূর্ণ পালন। এর অর্থ দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের বুকে মহান আল্লাহ তায়ালার আইন ও তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা। ইবাদতের আরো অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে পুরা একাত্ম হয়ে বাঁচা। তখন তাকে সকল রকম দুর্বৃত্তির নির্মূলে এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদে নামতে হয়। তখন প্রতিষ্ঠা দিতে হয় ইসলামী রাষ্ট্রের – যেমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। রাজার রাজ্য ছাড়া যেমন সে রাজার সার্বভৌমত্ব ও তার আইন বাঁচে না, তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর শরিয়ত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা পায়না। তাঁর এজেন্ডা তখন শুধু কুর’আনে থেকে যায়। কোন ঈমানদার কি কখনো তাঁর রবের এজেন্ডার সে পরাজয় মেনে নিতে পারে? দ্বীনের এমন পরাজয় তাঁর জীবনে যে জিহাদ আনবে -সেটিই তো স্বাভাবিক।   

সমস্যা হলো, ইসলামের আজকের শত্রুরাও মক্কার কাফেরদের মতই মুসলিমদেরকে ইসলামের পূর্ণ পালন নিয়ে বাঁচতে দিতে রাজি নয়। এবং রাজি নয় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে মেনে নিতে। তারা মানতে রাজি নয় কোন মুসলিম দেশে শরীয়ত প্রতিষ্ঠা পাক। এমন কি বহু মুসলিম দেশেও গুরুতর অপরাধ হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও শরিয়ত পালনসহ পূর্ণ ইসলাম পালন। এ জন্যই আরবের কাফিরগণ মদিনার বুকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে অংকুরে বিনষ্ট করতে সববেত ভাবে হামলা করেছিল। মক্কার কাফেরদের ন্যায় একই লক্ষ্যে যুদ্ধে নেমেছে আজকের সকল কুফর শক্তিও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো ঘোষণাই দিয়েছে, কোথাও কোন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলে সেটিকে বোমা মেরে অংকুরেই মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে। মদ্যপান, জুয়া, ব্যভিচার, উলঙ্গতা ও অশ্লীলতার পূর্ণ লাইসেন্স দিতে তারা রাজি আছে, কিন্তু রাজী নয় পূর্ণ ইসলাম পালনের অধিকার দিতে।

ইসলামের আধুনিক শত্রুগণ পূর্ণ ইসলাম নিয়ে বাঁচাকে ‌জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বলে। অনেকে মৌলবাদও বলে। সে অভিন্ন বয়ান বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলির মুসলিম নামধারী সেক্যুলারিস্টদের মুখেও। নামে মুসলিম হলেও তারা  আদর্শিক আপন জন দেশী-বিদেশী কাফির শক্তির। শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করাই তাদের রাজনীতি। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধকে তারা গণতন্ত্র ও লিবারালিজম বলে। তথাকথিত সে গণতন্ত্র ও লিবারালিজমে স্বাধীনতা নাই পূর্ণ ইসলাম পালনের। অথচ মুসলিমকে বাঁচতে হয় একমাত্র  মহান আল্লাহকে খুশি করতে। ফলে তাকে বাঁচতে পূর্ণ ইসলাম পালন নিয়ে। নবীজী (সা:) পথই হলো তাঁর একমাত্র পথ। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদই হলো তার ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি। আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রিয়তার হওয়া এবং জান্নাতে পৌছার কি এছাড়া ভিন্ন পথ আছে?  ২৩/০৩/২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *