বাংলাদেশের এতো ব্যর্থতা কেন?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

রোগ চেতনার জায়গাতে

বাংলাদেশের ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্ক নেই। দেহে পচন লাগলে এবং সে পচনের দ্রুত চিকিৎসা না হলে সেটি সারা দেহে ছড়ায়। সে পচন তখন দুর্গন্ধ ছড়ায়। তখন শুধু ঘরের লোকই নয়, প্রতিবেশীও টের পায়। বাংলাদেশের বেলায় সেটিই ঘটেছে। দেশটির পচন মূলতঃ নৈতিক। এবং রোগটি চেতনার জায়গাতে। মানুষ তার কর্ম ও দুষ্কর্মে উৎসাহ পায় হাত-পা থেকে নয়, বরং তার চেতনার ভূমি থেকে। সেটি রোগাস্ত্র হলে নৈতিক পচন সিম্পটম রূপে দেখা দেয়। নৈতিক পচনের বড় আলামত হলো দূর্নীতি। দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পরিচিতি আজ বিশ্বময়। নানা দেশে উন্নয়নের মডেল রূপে যেখানে আলোচিত হয় জাপান, কোরিয়া বা সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ সেখানে ব্যর্থতার মডেল। দেশের বড় ব্যর্থতা হলো, ভাল মানুষ গড়ার কারখানাগুলোই অকার্যকর হয়ে গেছে। ফলে প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ কোন ক্ষেত্রই আর ভাল মানুষের জোগান পাচেছ না। দূর্নীতির সাথে তীব্রতা পেয়েছে গুম, খুন, ফাঁসি, সন্ত্রাস ও ভোটডাকাতির রাজনীতি। অসুস্থ্য নৈতিকতা ও অসুস্থ্য রাজনীতি নিয়ে কি দেশের সুস্থ্যতা বাড়ে? বিশাল হয়েও ডায়নোসর যেমন বিশ্ব থেকে হারিয়ে গিয়ে ইতিহাস গড়েছে তেমনি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠি ইতিহাস গড়েছে দ্রুত নীচে নেমে। প্রশ্ন হলো কেন এ নৈতিক ব্যর্থতা? কেন এ পতনদশা?

অনেকেই ভাবেন, ব্যর্থতার কারণ বিশাল জনসংখ্যা। বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসন মূলতঃ এ মতের ধারকদের দখলে। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যসব উন্নয়ন-পরিকল্পনার চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় জন্মনিয়ন্ত্রণকে। তাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প বা কৃষির গুরুত্ব বুঝাতে ঘরে ঘরে কোন সরকারি কর্মচারির পদধুলি পড়ে না। কিন্তু কনডম বা জননিয়ন্ত্রন বড়ি হাতে প্রতিমাসে প্রতি ঘরে কেউ না কেউ পৌঁছবেই। বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে স্বচ্ছল বিভাগ হলো এটি। বিদেশী ঋণদাতাদেরও সর্বাধিক নজর এ বিভাগটির উপর। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এ অবধি যত বিদেশী অর্থ এ বিভাগটি পেয়েছে আর কোন বিভাগ তা পায়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতো বিনিয়োগ ও এতো মেহনতের পরও দেশ কি সামনে এগিয়েছে?

মুসলিমদের উপর ঈমানী দায়ভার হলো তারা নির্দেশনা নিবে ইসলাম থেকে। নইলে ঈমান থাকে না। প্রশ্ন হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সমস্যা মনে করা কি ইসলামে জায়েজ? এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ, মুসলিমের ঈমান শুধ হালাল পানাহারে বাঁচে না, সে জন্য ধ্যান-ধারণা ও দর্শনকেও হালাল হতে হয়। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্নটি নিছক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমাজনীতির বিষয় নয়, এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঈমান-আক্বিদার বিষয়ও। এর সাথে জড়িত মুসলিম থাকা না থাকার প্রশ্ন। মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তথা আশরাফুল মাখলুকাত হলো মানুষ; সোনা-রূপা, হীরা-জহরত, তেল-গ্যাস নয়। মানুষ শুধু মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ-সৃষ্টিই নয় বরং তাঁর নিজস্ব খলিফা। মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার মর্যাদাটি ফেরেশতার চেয়েও উর্দ্ধে। নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত পালনের ন্যায় নিজের এ মর্যাদার ধারণটিও ফরয, নইলে মুসলিম হওয়া যায় না। মর্যাদার ধারণটি দেয় দায়িত্ব নিয়ে বাঁচার প্রেরণা। কোন শিল্পির শ্রেষ্ঠ শিল্পকে তুচ্ছ বলার অর্থ সে শিল্পিকে অবমাননা করা। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে আপদ বললে অবমাননা হয় মহান আল্লাহতায়ালার। হেয় করা হয় তাঁর কুদরতকে। সারা জীবন নামায পড়ে বা রোযা রেখে কি সে অবমাননা মোচন হয়? তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির প্রতি এমন অবজ্ঞা নিয়ে মুসলমান কি পেতে পারে মহান আল্লাহতায়ালার রহমত? এটি কবিরা গুনাহ। এতে জন্ম নেয় আত্মঘৃনা। তাই ব্যক্তির কর্ম ও আচরণে পরিবর্তন আনতে হলে তার নিজের মনের গভীরে নিজকে নিয়ে যে রুগ্ন ধারণাটি বাসা বেঁধে আছে -সেটি পাল্টাতে হবে। অন্য পরিবর্তনগুলো আসতে পারে তার পরই।

 

আপদে পরিণত হয়েছে মানব  

অসুস্থ্য চেতনার নাশকতা ভাইরাসের চেয়েও ভয়ানক ও সংক্রাম হতে পারে। ভাইরাস মৃত্যু ঘটায় শুধু দেহের।  অসুস্থ্য চেতনার সংক্রমণে মৃত্যু ঘটে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিবেকের, চরিত্রের, মূল্যবোধের এবং সে সাথে জাতির। রোগাগ্রস্ত চেতনার কারণে পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায়, দূর্নীতি-সুনীতির ধারণাগুলিও পাল্টে গেছে। তেমন একটি রোগাগ্রস্ত চেতনার কারণেই সূদ, ঘুষ, দূর্নীতি, চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতির ন্যায় হারাম কর্ম বাংলাদেশে আচারে পরিণত হয়েছে। পাপকে দেহব্যবসা রূপে বৈধতা দিয়ে পতিতাপল্লী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে কি হবে, সফল ভাবে পাহারাদারি দিচ্ছে ব্যভিচারের। দেশে গবাদি পশুকে আপদ ভাবা হয় না। বরং সবাই তার বংশ-বিস্তার চায়। কিন্তু সে মর্যাদা মানুষের নেই। আপদে পরিণত হয়েছে মানব। এভাবে মানব তার নিজের মূল্য নিজের কাছেই হারিয়েছে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছে জন্মানোর আগেই। এ্যাবরশনের নামে দেশজুড়ে নীরবে গণহত্যা চলছে। এভাবে পাপের মহোৎসব হচ্ছে। দেশী-বিদেশী অর্থে অসংখ্য এনজিও কর্মী একাজে খুনীর বেশে নেমেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার অমুসলিম দেশেগুলিতেও এ্যাবরশনের নামে এরূপ মানবহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। আন্দোলনও হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি নেই। সরকার, জনগণ, মসজিদের ইমাম, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব জেনেও না জানার ভান করে। বরং জনসংখ্যা এভাবে কমানোতে অনেকেই খুশি। মানবহত্যা এভাবে সরকারি নীতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে জন্ম নিচ্ছে না মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া শিশুদের বাঁচানোর পক্ষে আন্দোলন। শিশুহত্যার পাশাপাশি খুনীদের হাত পড়ছে জীবিতদের গলায়ও। ফলে বেড়ে চলেছে হত্যা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাস। আগুণ দেওয়া হচ্ছে যাত্রীভর্তি বাসে। দিন-দুপুরে শত শত মানুষের সামনে পিটিয়ে মানুষ মারা হয় । ভাংগচুর করা হয় আদালতে। ধর্ষণে উৎসবও হয়। এই কি সভ্যতা? দেহে রোগ ধরলে মানুষ ডাক্তারের কাছে ছুটে। কিন্তু চেতনায় যে ভয়ানক রোগ -তার চিকিৎসায় আয়োজন কই? 

সম্পদের অভাবকে যারা সকল ব্যর্থতার কারণ বলেন -তাদের বিভ্রান্তিও কি কম? তাদের কথা, অভাব থেকেই স্বভাব নষ্ট হয়েছে। অথচ সবচেয়ে নষ্ট চরিত্র ও সবচেয়ে নষ্ট স্বভাব হলো বাংলাদেশের ধনীদের। দেশের অধিকাংশ ঘুষখোর, সূদখোর, মদখোর, ব্যভিচারি, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত রাজনীতিবিদ ও ঋণখেলাফী এসেছে তাদের মধ্য থেকে। অথচ বহু অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি স্বভাব-চরিত্রে অতি উত্তম দৃষ্টান্ত রাখছে। কথা হলো দর্শন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতি পদে যারা ব্যর্থ তারা কি সম্পদ সৃষ্টি করে? বরং আনে দারিদ্র্য। সম্পদ মানুষের সৃষ্টি এবং এ জন্য চাই সৃষ্টিশীল মানুষ। এমন মানুষ গড়ে উঠে শুধু দেহের গুণে নয়, বরং মনের গুণে। আর এমন মানবিক ভাবে বেড়ে উঠার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও দর্শন। অশিক্ষা, অপসংস্কৃতি ও দূর্নীতি একটি জনগোষ্টিকে শুধু সৃষ্টিহীনই করে না, অনাসৃষ্টিপূর্ণও করে। দারিদ্র্য ও দূর্ভিক্ষ এমন দেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বেলায় সেটিই হয়েছে। এদেশে দারিদ্র্য জন্ম নিয়েছে সর্ববিধ ব্যর্থতা থেকে, জাতির ব্যর্থতা দারিদ্র্যের কারণে নয়। বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ হলো সিঙ্গাপুর। আয়তন মাত্র ২৪০ বর্গ মাইল। জনসংখ্যা ৪৫ লাখ। লোকসংখ্যায় ঢাকা শহরের চেয়েও ক্ষুদ্রতর। প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বেশী। অথচ দেশটির বাৎসরিক বৈদেশিক রফতানি ৪৪১ বিলিয়ন ডলার (২০২০ সালের পরিসংখ্যান মতে)। অথচ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক রফতানি ছিল মাত্র ৪০.৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের তূলনায় সিঙ্গাপুরের রফতানী ১০ গুণেরও অধিক। সোনার খনি বা তেলের খনি নিয়ে  সিঙ্গাপুর এ অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেনি। বরং এ সাফল্য এনেছে দেশটির সৃষ্টিশীল মানুষ। মানুষকে তারা আপদ ভাবেনি বরং সোনার বা তেলের খনির চেয়েও মহামূল্যবান ভেবে তাদের উন্নয়নে মনযোগী হয়েছে। প্রতিটি মানব সন্তানের উপর তাদের বিনিয়োগটি বিশাল। ফল দাঁড়িয়েছে, তাদের একদিনের উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের বহু হাজার মানুষের চেয়েও অধিক। অথচ সেরূপ সামর্থ্য বাড়াতে বাংলাদেশে সে বিনিয়োগ  হয়নি। বরং কোটি কোটি এমন মানুষও আছে যাদের উপর সরকারের পক্ষ থেকে একটি পয়সাও বিনিয়োগ করেনি।

 

অভাবটি দর্শনে

বাংলাদেশের অভাব সম্পদে নয়, সেটি দর্শন বা ফিলোসফিতে। অভাবটি এখানে নিজেকে, স্রষ্টাকে ও বিশ্বকে জানার সামর্থ্যে। হাত,পা, মাথা ও দৈহিক বল পশুরও থাকে। কিন্তু পশুর জীবনে দর্শন বা ফিলোসফি নাই। তাই সে ইতর। এবং এরূপ ইতর হওয়ার কারণেই কুকুর-শৃগাল রাস্তায় হানাহানি করে। তবে মানুষ পশুর চেয়েও অধিক ইতর হতে পারে। পশু গণহত্যা, গণধর্ষণ ও বর্ণগত নির্মূল করে না, কিন্তু মানুষ করে। সেটি হয় দর্শনের অভাবে। দর্শন দেয় ভাবনার সামর্থ্য, দেয় ভাল-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায় চেনার সামর্থ্য। পবিত্র কোরআনে এরূপ ভাবনাশূণ্যদের পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। সে ইতর পর্যায় থেকে উপরে উঠার একমাত্র মাধ্যম হল ইলম বা জ্ঞান। তখন ব্যক্তির জীবনে গড়ে উঠে দর্শন বা ফিলোসফি। ব্যক্তি বা জাতির জীবনে উত্থান ও বিজয় শুরু হয় এখান থেকেই। তাই যারা দেশ গড়তে চায় তারা মানুষের বিশ্বাসে বা দর্শনে হাত দেয়। ইসলামে জ্ঞানার্জন এ জন্যই ফরজ। দর্শনই মানুষকে যেমন নিজেকে জানতে শেখায়, তেমনি জানায় তার স্রষ্টা ও স্রষ্টার সৃষ্ট বিশ্বজগতকেও। তাই এই ক্ষেত্রটিতে অজ্ঞতা বিরাজ করলে পুরাটা জীবনটি অন্ধকারে কাটে। জ্ঞানীগণ তাই বলেন,‘‘মান আরাফা নাফসাহু, ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু।’’ যে তার নিজেকে জানতে পেরেছে, সে তার প্রভূকেও জেনেছে। 

বাংলাদেশের মানুষের বড় ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রটিতে। আর এ ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নিয়েছে সকল ব্যর্থতা। ইসলামের আগমনে আরবের ভূগোলে বা জলবায়ুতে পরিবর্তন আসে নি। মাটির তলায় সোনার খনি বা তেলের খনিও আবিস্কৃত হয়নি। পরিবর্তন আসেনি মানুষের দৈহিক আকার-আকৃতি বা অবয়বে। বরং বিপ্লব এসেছিল তাদের জীবন দর্শনে। পরিবর্তন এসেছিল চিন্তার মডেলে। সে পরিবর্তনের ফলে জীবন ও জগত নিয়ে মানুষের ধ্যানধারণাই পাল্টে গিয়েছিল। পরিবর্তন এসেছিল তাদের কর্মে ও আচরণে। সে পরিবর্তনের পথ ধরে পাল্টে গিযেছিল মধপ্রাচ্যের ভূগোল, ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি তথা সবকিছূ। দর্শনের শক্তির কাছে পারমানবিক শক্তিও অতি তুচ্ছ। পারমানবিক শক্তি বলে আলোকিত হয় কিছূ শহর, চালিত হয় কিছূ কলকারখানা বা  জাহাজ। অথচ দর্শন আলোকিত করে এবং পাল্টে দেয় কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জগত। পাল্টে দিতে পারে বিশ্বের মানচিত্র। ইসলামের দেওয়া দর্শনের বলেই নিঃস্ব আরবেরা বিশ্বের সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছিল। পাল্টে দিয়েছিল তাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রুচীবোধ। ইসলামের পূর্বে আরবের মানুষ ভাবতো জীবনের শুরু ও শেষ ইহলোকেই, পরকাল বা বিচার দিন বলে কিছূ নেই। ভাবতো, মৃত্যুর পর তাদের হাড্ডিমাংস মাটিতে মিশে যাবে এবং ধুলায় হারিয়ে যাবে চিরতরে। ফলে সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করতো এ দুনিয়ার জীবনকে আনন্দময় করতে। বাংলাদেশে আজ যারা ঘুষ খায়, সূদ খায়, ব্যভিচারি করে বা এ্যাবরশন করে নিজ সন্তান হত্যা করে -তাদের মত আরবগণও সেদিন সন্ত্রাস করতো, মদ খেতো, ব্যভিচারি করতো, এমনকি নিজ সন্তানদেরকেও জীবন্ত করব দিত। কোর’আন তাদের সে জাহিলী অসভ্যতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ চলছে উল্টো দিকে। তারা কোর’আন ছেড়ে জাহিলী অসভ্যতার গভীরে ডুবছে।

 

শক্তি কোর’আনী দর্শনে

যে দর্শনটি জাহেলী আরবদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেটি হলো কোর’আনের দর্শন। সে আমলে তারা গ্রহ-নক্ষত্রের পরিচয় না জানলেও তাঁরা নিজেদের পরিচয়কে জেনেছিলেন সঠিক ভাবেই। এবং সেটি জেনেছিলেন যিনি স্বয়ং এ জীবন ও জগতের স্রষ্টা তাঁর কাছ থেকে। সেটি নবী করীম (সাঃ) মারফত। ফলে জেনেছিলেন, ইহকালীন এ জীবনটি অনন্ত অসীম জীবনের শুরু-পর্ব মাত্র। এ জীবন শেষে যেমন পুরস্কার বা প্রমোশন আছে তেমনি শাস্তি বা ডিমোশনও আছে। প্রমোশন ও ডিমোশন নির্ধারণে পরীক্ষাও আছে। দুনিয়ার এ জীবন মূলতঃ সেই পরীক্ষাকেন্দ্র। পরীক্ষা নেওয়াটিই হলো ইহকালীন জীবনের মূল লক্ষ্য। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরীক্ষার সমাপ্তি হয়, তবে তাতে জীবনের সমাপ্তি ঘটে না। শুরু হয় ফলাফল ভোগের পালা। মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষনাটি এসেছে এভাবে: “আল্লাযী খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লি ইয়াবলুয়াকুম আইয়োকুম আহসানা আমালা।” -(সুরা মুলক, আয়াত-১)। অর্থ: তিনি  মৃত্যু ও জীবনকে এজন্য সৃষ্টি করেছেন যে তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে কে আমলের দিক দিয়ে উত্তম। বস্তুত মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো কোরআনের এ ঘোষণা। এটুকু জানা না হলে জীবনে সব জানাশুনাই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরীক্ষার হলকে তখন শুধু নাট্যশালা, পানশালা বা কর্মশালা মনে হয়। মানুষ মত্ত হয় তখন ফূর্তিতে। কর্মজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী বা পেশাদার রূপে জীবনে সফল হওয়াটাই জীবনের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। উপার্জন, আনন্দ-উল্লাস বা নিছক সময় কাটানোই বাঁচবার উদ্দেশ্য মনে হয়। জানাই হয় না যে এ জীবন একটি পরীক্ষা কেন্দ্র। নিদারুন অজ্ঞতা থেকে যায় কিসে সফলতা এবং কিসে বিফলতা -সে বিষয়েও। অথচ এ পরম সত্যটুকু জানাতেই নবীগণ এসেছিলেন। এবং নাযিল হয়েছিল অন্যান্য আসমানি কিতাব ও পবিত্র কোরআন।

পরীক্ষাকালে কেউ নাচগান, আমোদ-ফুর্তি করে না। অলস অবকাশে অনর্থক সময়ও কাটায় না। তখন প্রতি মুহুর্তের চেষ্টাটি হয়, পরীক্ষার খাতায় কি করে নাম্বার বাড়ানো যায়। সাহাবায়ে কেরাম এ জীবনকে পরীক্ষাপর্ব রূপে গ্রহন করেছিলেন বলেই তারা দিবারাত্র নেক আমলে ব্যস্ত থাকতেন। নেক আমলে তাড়াহুড়া ছিল তাদের সর্ব-অস্তিত্ব জুড়ে। পবিত্র কোরআনেও সেটিরই তাগিদ এসেছে এভাবেঃ ‘সা’রিয়ু ইলা মাগফিরাতিম মির রাব্বিকুম’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৩৩)। অর্থ: “তাড়াহুড়া কর তোমার রব থেকে মাগফিরাত লাভে।” কারণ, পরীক্ষার শেষ ঘন্টাটি যে কোন সময় বীনা নোটিশে বেজে উঠতে পারে। তাই সন্নাসী সেজে সমাজ-সংসার, অর্থনীতি-রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, দাওয়াত ও জিহাদের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ ইসলামে নেই। সাহাবায়ে কেরাম যেমন অবিরাম দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন, তেমনি রাজনীতি ও প্রশাসনে নেমেছেন। জ্ঞানচর্চা যেমন করেছেন তেমনি জিহাদেও নেমেছেন। কর্মময় ছিলেন প্রতি ক্ষেত্রে। রাতে না ঘুমিয়ে অভাবী মানুষ খুঁজেছেন। খলিফা হয়েও পিঠে আটার বস্তা নিয়ে গরীবের ঘরে পৌঁছে দিতে ছুটেছেন। উটের পিঠে চাকরকে বসিয়ে নিজে রশি টেনেছেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, মরুভূমি ও সাগর অতিক্রম করেছেন। যখন কাগজ-কলম আবিস্কৃত হয়নি তখনও তারা জ্ঞানচর্চায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তাঁরা প্রতিটি মুহুর্ত কাটিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করার কাজে এবং পরকালের এ্যকাউন্টে সঞ্চয় বাড়াতে।

 

বিকল পাওয়ার হাউস

ঈমানদারের কল্যাণধর্মী প্রতিটি কর্মই হলো ইবাদত। এগুলিই হলো নেক আমল। একমাত্র নেক আমলের মাধ্যমেই সঞ্চয় বাড়ে আখেরাতের এ্যাকাউন্টে। নেক আমল বৃদ্ধির লাগাতর চেষ্টায় সৃষ্টিশীল প্রতিটি মুসলিম পরিনত হয় শক্তিশালী পাওয়ার হাউসে। ঈমানদার কখনোই কর্মহীন ও অলস হতে পারে না। তখন জাতীয় উন্নয়নে প্লাবন আসে। অথচ সে পাওয়ার হাউস বিকল হলে, বিপর্যয় শুরু হয় জাতীয় জীবনে। জাতি তখন ভিক্ষুকে পরিণত হয়। প্রকৃত ঈমানদারের এ সৃষ্টশীলতা বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরেছেন আল্লামা ইকবাল তার ফার্সি কবিতায়। লিখেছেন: “হরকে উ’রা লিয্যাতে তাখলিক নিস্ত, পিশে মা জুজে কাফির ও যিনদিক নিস্ত।” অর্থ: “যার মধ্যে নাই সৃজনশীলতা, আমাদের কাছে সে কাফির ও নাস্তিক ভিন্ন অন্য কিছূ নয়।” পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ওয়া লি কুল্লি দারাজাতিন মিম্মা আমিলু’ অর্থ: এবং মানুষের সকল মর্যাদা নির্ধারিত হবে তার কর্মের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ যার জীবনে কর্ম নেই, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার মর্যাদাও নেই। তাই ধর্মের লেবাসধারি কোন ব্যক্তির কর্মহীন পরগাছা জীবন আদৌ দ্বীনদারি নয়, এটি ধর্মহীনতা। বরং ঈমানের সাথে কর্মব্যবস্থা বাড়বে –সেটিই তো স্বাভাবিক। অথচ বাংলাদেশে সেটি অতীতে যেমন হয়নি, এখনো হচ্ছে না।  

মুসলিমকে প্রতি মুহুর্ত মহান আল্লাহতায়ালার যিকর নিয়ে বাঁচতে হয়। সেটি যেমন পানাহারে, তেমনি কর্মে। এভাবেই মৃ’মিনের জীবনে আল্লাহভীরুতা ও সততা আসে। মহান আল্লাহতায়ালার যে যিকর সূদ-ঘুষ বা হারাম থেকে বাঁচাতে পারে না -তাকে কি যিকর বলা যায়? মু’মিন ব্যক্তি শুধু উত্তম চাষাবাদ ও বীজই ছিটায় না, কাজের মধ্যে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে রহমতও চায়। এবং যুদ্ধে বিজয় চায় শুধু নামাযের জায়নামাযে নয়, বরং জিহাদের ময়দানে শত্রুর সামনে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। কারণ, সাহায্যদানের পূর্বে মহান আল্লাহতায়ালা বান্দাহর নিজের বিনিয়োগটি দেখতে চান। বিশাল বিশাল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিমগণ তখনই বিজয়ী হয়েছেন যখন সে লক্ষ্যে তারা নিজেদের প্রাণ কোরবানীতে দু’পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মুসলিমদের সে বিনিয়োগ দেখে মহান আল্লাহতায়ালা তাদের বিজয় বাড়াতে ফেরেশতা পাঠিয়েছেন। জিহাদ ছেড়ে স্রেফ জায়নামাযে যখন বিজয় চাওয়া শুরু হয়েছে, তখন থেকেই পরাজয় শুরু হয়েছে। সেরূপ জিহাদহীন দোয়া বনি ইসরাইলীদের জন্য আযাব নামিয়ে এনেছিল। তারা চেয়েছিল, তাদের ঘরে বিজয় এনে দিক মহান আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর ফেরেশতারা। একই পথ ধরেছে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম। বিনিয়োগের বদলে  তাদেরও দোয়া, মহান আল্লাহতায়ালা যেন তাঁর নিজ শক্তি বলে শত্রুদের ধ্বংস করে দেন। তাদের নিজেদের ভূমিকা যেন শুধু দর্শকের। এরূপ দোয়া এমন কি আরাফতের ময়দানে করলেও যে কবুল হয় না –সে প্রমাণ তো অনেক। বুঝতে হবে, ঈমানদারের কোন কর্মই দুনিয়াদারি নয়, বরং প্রতি কর্মই নেক আমল। দুনিয়াদারি নয় তাঁর যুদ্ধবিগ্রহ, জ্ঞানার্জন, রাজনীতি, ব্যবসা-বানিজ্য, চাষাবাদ, শিক্ষকতা, চিকিৎস্যকতা এবং লেখালেখি। পথের কাঁটা সরানো যেখানে উত্তম নেক আমল, সেখানে গলা থেকে বা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে কাঁটা সরানোর চেষ্টা দুনিয়াদারী হয় কি করে?

 

মুক্তি কীরূপে?

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবের বিরান মরুভূমিতে যে বিশ্ব-শক্তির জন্ম হয়েছিল -সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে আজও সেটিই সর্বাধিক গৌরবের। সেটি সম্ভব হয়েছিল কয়েক লাখ সৃষ্টিশীল মানুষের কারণে। তাদের একজনের যে রূপ সৃষ্টিশীল সামর্থ্য ছিল তা বাংলাদেশের একটি জেলার সবগুলো মানুষের মাঝেও সৃষ্টি হয়নি। তারা শুধু সম্পদেই সমৃদ্ধি আনেননি, বিপুল সমৃদ্ধি এনেছিলেন মানবতায় ও জীবনদর্শনে তথা ফিলোসফিতে। আজকের দেড়শত কোটি মুসলমানের অর্জন সে তুলনায় অতি তুচ্ছ। ভ্যাকসিন যেমন যক্ষা বা কলেরা থেকে বাঁচায়, তেমনি দর্শনই দেয় দূর্নীতির বিরুদ্ধে ইম্যুউনিটি বা প্রতিরোধশক্তি। দেয় চারিত্রিক বল। নির্মাণ করে নৈতিক মেরুদন্ড। নিছক উৎপাদন বাড়িয়ে দর্শনের এ দারিদ্র্য দূর হয়না। অর্জিত হয় না চারিত্রিক সুস্থ্যতা। এজন্যই বাংলাদেশে কৃষি বা শিল্প-উৎপাদন বাড়লেও ডুবছে দূর্নীতির প্লাবনে। ধ্বসেছে মেরুদন্ড। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পত্র-পত্রিকা ও মসজিদ-মাদ্রাসা এবং বুদ্ধিজীবীদের মূল কাজ ছিল দর্শনে সমৃদ্ধি আনা। জ্ঞানার্জন ইসলামে ফরয একারণেই। কারণ এর মাধ্যমেই ব্যক্তি পায় তাকওয়া এবং পুষ্টি পায় তাঁর রুহ বা আত্মা। নবীপাক (সাঃ) এজন্যই এক মুহুর্তের জ্ঞানার্জনকে সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ  বলেছেন। জ্ঞানীর কলমের কালীকে শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র বলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া এজন্যই শ্রেষ্ঠ সাদকায়ে জারিয়া।

কিন্তু বাংলাদেশে জ্ঞানার্জনের সে কাজটিই হয়নি। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যর্থ খাত। চাষিরা ও শ্রমিকেরা ক্ষেতে খামারে ও কারখানায় যতটুকু অগ্রগতি এনেছে -সেরূপ অগ্রগতি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ে ও বুদ্ধিবৃত্তিতে আনতে পারেননি। মসজিদ-মাদ্রাসা ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দেশে প্রচুর বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষিতের হার। কিন্তু জনমন সমৃদ্ধ হয়নি সুস্থ্য দর্শনে। বাড়িনি চরিত্র। শিক্ষালাভ ঈমানদারের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নামায-রোযার আগে এ ইবাদতকেই প্রথম ফরজ করা হয়েছিল। কিন্তু যে শিক্ষা দূর্নীতি, সন্ত্রাস ও পাপাচার বাড়ায় -তাকে কি শিক্ষা ইবাদত বলা যায়? এটি তো পাপাচার। অথচ বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জীবনের মূল পাঠটিও শিখাতে পারিনি। ফলে বেড়ে ঊঠেনি নৈতিক মেরুদন্ড সম্পন্ন সাহসী সৈনিক যারা দেশকে দুর্বৃত্তমূক্ত করবে এবং গড়বে সৃষ্টিশীল রাজনীতি। বরং কুশিক্ষা জীবনকে চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্র রূপে ভাবতে শিখিয়েছে। শিক্ষাঙ্গণ থেকে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য দুর্বৃত্ত -যারা দখল জমিয়েছে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে।

ব্যর্থতা প্লাবনের পানির ন্যায সর্বস্তরে ছেয়ে গেছে। ভ্রষ্টতার শিকার আলেম সম্প্রদায়ও। মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়ত প্রতিষ্ঠার রাজনীতি ফরয। সে ফরয পালনে অর্থদান, শ্রমদান এমনকি জীবন দানে এগিয়ে এসেছেন যেখানে প্রতিটি সাহাবী। অথচ সে জিহাদের রাজনীতিকে বহু আলেম দুনিয়াদারি বলছেন। এবং দ্বীনদারি বলছেন দুর্বৃত্ত শক্তির সাথে আপোষ, সহযোগিতা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান। ফলে দেশ সর্বার্থেই বিপর্যের পথে। এ ব্যর্থতার জন্য অন্যদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। যে দেশবাসী নিজেরাই আত্মহননের পথে ধেয়ে চলছে সে দেশের বিনাশে বিদেশী শত্রুর প্রয়োজন আছে কি? এমূহুর্তে বাাঁচতে হলে জাতিকে ফিরিয়ে নিতে হবে জীবনের মূল পাঠের দিকে –যার ছবক মহান আল্লাহপাক নবীদের মারফত দিয়েছেন। যে পথে আত্মাবিনাশী আরবরা বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল -একমাত্র সে পথই আজকের আত্মঘাতী বাংলাদেশীদেরও বাঁচাতে পারে। এ ছাড়া বিকল্প পথ আছে কি? ২২/১২/২০২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *