বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা ও ইমেজ সংকট
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on March 27, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
শুরু থেকেই ইমেজ-সংকট
যে কোন স্বাধীন দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুধু তার স্বরাষ্ট্র নীতি, প্রশাসন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং শিল্প-বাণিজ্য নয়, বরং অতি গুরুত্বপূর্ণ হল তার পররাষ্ট্র নীতি। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন তার ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তার ভাবমুর্তি বা ইমেজ। আর সেটিই তুলে ধরে তার পররাষ্ট্র নীতি। কোন দেশের নেতাই তার স্কুল-কলেজ, ক্ষেতখামার বা কলকারখানা নিয়ে অন্যদেশে হাজির হয় না, বরং হাজির হয় তার পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে। সে নীতি নিয়েই সে বিদেশীদের মুখোমুখি দাঁড়ায়, কথা বলে এবং বন্ধুত্ব গড়ে। একটি দেশের রাষ্ট্রীয় মেরুদণ্ড কতটা মজবুত সেটিই এখানে ধরা পড়ে। দাস ও মনিব -উভযে মনুষ্য প্রাণী হলেও, উভয়ের মুখের ভাষা ও দেহের ভাষা এক নয়। কে দাস আর কে মনিব -সে পার্থক্যটি বুঝতে তাই শিশুরও বেগ পেতে হয় না। তেমনি সুস্পষ্ট পার্থক্য বুঝা যায়, কোনটি স্বাধীন দেশ আর কোনটি পরাধীন। বাংলাদেশের বড় ব্যর্থতা এখানেই। মেরুদণ্ড সম্পন্ন একটি স্বাধীন দেশের পরিচয় নিয়ে দেশটি এখনও বিশ্বমাঝে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি। এক্ষেত্রে ব্যর্থতা বিশাল, এবং সেটি ১৯৭১ থেকেই।
বাংলাদেশের যে পরিচয়টি তার জন্ম থেকে বিশ্ববাসীর মগজে বদ্ধমূল হয়েছে তা হল, দেশটি পৃথক মানচিত্র পেয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সামরিক বিজয়ের প্রেক্ষিতে। ভারতের হাতে এর জন্ম, ভারতের পেটে এর অবস্থান এবং ভারতের পেটের মধ্যেই এর স্বাধীনতা -বাংলাদেশের এ পরিচয়টিই শুধু ভারত নয়, ভারত-অনুগত বাংলাদেশী রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীরাও বিশ্ববাসীর সামনে সেটি তুলে ধরে। এবং এ যুক্ত দেখিয়েই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির বিরুদ্ধেও যুক্তি পেশ করে। শেখ মুজিবও সে পরিচিতিটাই পাকাপোক্ত করেছিলেন ভারতের সাথে ২৫ সালা চুক্তি করে। ফল দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের মনিব আছে, কিন্তু বন্ধু নাই। কারণ অন্যের ঘরে হানা দিয়ে কে তার আশ্রিতের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়? এজন্যই কাশ্মীরের মুসলিমদের রক্তাত্ব স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে নিজস্ব কোন নীতি নাই। বরং নীতি তাই যা ভারত সরকারের নীতি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এটি শুধু ব্যর্থতার বিষয়ই নয়, প্রচণ্ড অপমানের বিষয়ও। এভাবে দেশের জন্য সৃষ্টি করেছে প্রচণ্ড এক ইমেজ সংকট। খোন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়া সে পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। বরং তাদেরকেই রাজনীতির অঙ্গণ থেকে বিলুপ্ত হতে হয়েছে। আজ মুজিব নেই। কিন্তু তাঁর আওয়ামী লীগ আছে, কণ্যা ও আত্মীয়স্বজন আছে, ভারত-সেবী বিশাল বুদ্বিজীবী বাহিনীও আছে। ফলে প্রবল ভাবে বেঁচে আছে ভারতসেবী নীতিটিও। ফলে বাংলাদেশ আজও অগ্রসর হচ্ছে পররাষ্ট্র নীতির সে নতজানু ধারা নিয়েই।
অধিকৃত বাংলাদেশ
ব্যক্তি ও তার পরিবারকে যেমন বহু মানুষের মাঝে বসবাস করতে হয়, রাষ্ট্রকেও তেমনি বাঁচতে হয় বহু রাষ্ট্রের মাঝে। সেখানে যেখানে চরম শত্রু আছে তেমনি পরম মিত্রও আছে। বেঁচে থাকার স্বার্থে কোনটি খাদ্য আর কোনটি অখাদ্য শুধু সেটুকু জানলে চলে না, কে শত্রু আর কে মিত্র সেটুকুও সঠিক ভাবে জানতে হয়। সমাজে বন্ধুহীন হওয়াতে নিরাপত্তা বাড়ে না। বন্ধু মনে করে বাঘের পিঠে সওয়ার হলেও নিস্তার মেলে না। পররাষ্ট্র নীতির মূল কাজ হল, কে শত্রু আর কে মিত্র -সেটিই প্রথমে সনাক্ত করা এবং সে অনুযায়ী দেশের নীতি নির্ধারণ করা। তাই পররাষ্ট্রনীতির কাজ দেশে দেশে স্রেফ দূতাবাস খুলা নয়, বরং নিজদেশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সুরক্ষিত করা। পরাধীন দেশের সে ভাবনা থাকে না। তাই তার পররাষ্ট্র নীতিও থাকে না। যাদের স্বাধীন দেশই নেই তাদের আবার পররাষ্ট্রনীতি কিসের? একারণেই দাস বা কারারুদ্ধ ব্যক্তির পারিবারিক বা সামাজিক জীবন থাকে না। কারারুদ্ধ ব্যক্তির অধীনতা কেবল কাজ-কর্ম ও চলাফেরায় নয়, বরং জেলের বাইরে গিয়ে বন্ধুত্ব গড়ার ক্ষেত্রেও। তেমনি অবস্থা পরাধীন রাষ্ট্রের। উপনিবেশিক শাসনামালেও ভারতের বিশাল ভূগোল ছিল। বিশাল জনসংখ্যা এবং বিপুল ঐশ্বর্যও ছিল। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। কারণ, ভারত তখন পরাধীন। ফলে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিটি ছিল ব্রিটিশের জাতীয় বিষয়, ভারতের নয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে যখন দুটি দেশ -মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের জন্ম হয়, তখন থেকেই দুটি দেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিও জন্ম নেয়। তবে সম্পন্ন দুটি ধারায়। দুটি দেশ একই উপমহাদেশে এবং একই জলবায়ুতে বসবাস করলেও তাদের শত্রু-মিত্র এক ছিল না। ফলে এক ছিল না তাদের পররাষ্ট্রনীতিও। বাংলাদেশ তখন ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পূর্ব-পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের ভূগোলে আবার পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনের পর পাকিস্তান ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন না আসলেও ১৮০ ডিগ্রি পাল্টে যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। পাল্টে যায় বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও।
উনিশ শ’ একাত্তরে পূর্ব-রণাঙ্গণে পাকিস্তান আর্মির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল ভারতীয় আর্মির হাতে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সে বিজয়ের ফলেই জন্ম নেয় বাংলাদেশ। সে যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীরও বহ হাজার সদস্য লড়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলীলটি ঢাকায় স্বাক্ষরিত হলেও সে দলীলে কোন বাংলাদেশীর স্বাক্ষর ছিল না। সে অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব যেমন ছিলেন না, তেমনি ছিলেন না মূক্তিবাহিনীর সেনাপতি। সেখানে ছিল দুটি পক্ষঃ বিজয়ী ভারত এবং পরাজিত পাকিস্তান। ভারতের পক্ষে স্বাক্ষর করেন জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। সেদিন সে দলীল স্বাক্ষরের খবরটিই বিশ্ববাসীর কাছে একমাত্র খবর ছিল না। সেদিন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান আর্মির পরাজয় ঘটেছিল বটে, কিন্তু তাতে বিদেশী সৈন্য থেকে বাংলাদেশের মূক্তি ঘটেনি। বিদেশী ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেদিনই পুরাপুরি অধিকৃত হয়েছিল এদেশ। এ খবরটিও সেদিন বিশ্বব্যাপী প্রচার পেয়েছিল। নিজ-গৃহের অভ্যন্তরে অন্যদের ডাকা নিজেই বিশাল অসম্মান। ভারতের বিজয়ে বাংলাদেশের উপর থেকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত হলেও তাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের সীমান্তের উপর বাংলাদেশের কোন নিয়ন্ত্রনই ছিল না। সে সামর্থ্যও তখন বাংলাদেশের ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারত মুখে স্বীকার করলেও নিজ দেশের সীমান্ত ও ভূ-খণ্ডের উপর সে স্বাধীনতার প্রয়োগ বাংলাদেশীদের হাতে হতে দেয়নি। বরং সে নিয়ন্ত্রনটি ছিল পূর্ণ ভাবে ভারতের। ফলে পাকিস্তান আর্মি যেসব বিমান, হেলিকপ্টার, ট্যাংক, কামান, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে যায় সেগুলো বাংলাদেশকে সরকার দখলে নিতে দেয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেগুলো নিয়ে যায় ভারতে। সে সাথে নিয়ে যায় কলকারখানার শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। এমন কি সেনানিবাসের ঘরে ঘরে যে টিভি, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক পাখা ছিল সেগুলিও ভারতীয় লুন্ঠন থেকে রেহাই পায়নি। একাত্তরে বাংলাদেশের ভুমির উপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হলে কি ভারতের হাতে কি এরূপ লুটপাট হতো? মুজিব সরকার সে লুন্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেনি। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চাকুরি হারিয়েছেন এবং কারাবন্দি হয়েছেন মেজর আব্দুল জলিল। অথচ এসব অস্ত্র ও মালামালের বৈধ মালিক ছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশীরাই এসব অস্ত্র কিনতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি রাজস্ব জুগিয়েছে। মাওলানা ভাষানী বলতেন, ভারত পাকিস্তান আর্মির ৯৩ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ভারতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশীরা তাদের নিজ অর্থে কেনা অস্ত্র থেকে কোন হিস্যা না পেয়ে আবার শূণ্য থেকে শুরু করতে বাধ্য হয়। এভাবেই কোমড় ভেঙ্গে দেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। ভারতীয়দের কাছে এই ছিল সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্যাদা ও মূল্যায়ন।
গোলামীর দাসখত
বাংলাদেশের প্রতি আগ্রাসী ভারতীয়দের আচরণে নতুন কিছু ছিল না; নতুন মাত্রা পেয়েছিল মাত্র। আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে সেটি অজানাও ছিল না। মাদাসক্তগণ তাদের নেশার বস্তুটি পেতে ঘরের অমূল্য সম্পদও তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে। তেমন অবিকল অভিন্ন আচরণ কনর ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতাগণও। মীর জাফর তো সে লিপ্সাতেই দেশের স্বাধীনতা বেঁচেছিল। ভারতীয় লোলুপ দৃষ্টি ও ষড়যন্ত্রের কথা শেখ মুজিব ষাটের দশক থেকেই জানতেন। তাজউদ্দিনও জানতেন। এরপরও শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি সে অভিযোগকে মিথ্যা বললেও পরবর্তীতে সে ষড়যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতা নিয়ে গর্ব করা হয়েছে। ভারতীয় স্বার্থের সেবাটি আওয়ামী লীগের কাছে কতটা গুরুত্ব পায় -সেটি ধরা পড়ে ভারতের সাথে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ৭ দফা দাস চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। সে দফাগুলো ছিল নিম্নরূপঃ এক). ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হবে। গুরত্বের দিক হতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূল সামরিক বাহিনী হইততে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হবে। (এ চুক্তির আলোকেই পরবর্তিতে গড়ে তোলা হয় রক্ষী বাহিনী। এবং ভারতীয় সে নিল নকশা অনুযায়ী মুজিবামলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কোন টাংক বা কামান কেনা হয়নি, সেনাবাহিনীকে মজবুত করার জন্য কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। অথচ সে দূর্দিনে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে রক্ষিবাহিনীকে শক্তিশালী করতে।) দুই). ভারত হতে সমরোপকরণ ক্রয় করতে হবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শানুযায়ী তা করতে হবে। ৩). ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে। ৪). বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ৫). বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হতে হবে। ৬). ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলি অনুযায়ী ভারত যে কোন সময় যে কোন সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং বাধাদানকারী শক্তিকে চুরমার করে অগ্রসর হতে পারবে। -(সূত্রঃ অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ১২৫ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০)।
১৯৭১য়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ কোন স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষে ছিল না। বরং এক্ষেত্রে ভারতের লক্ষ্য ছিল দ্বিমুখী। এক). ভারতের প্রধান শত্রু পাকিস্তানের বিনাশ। দুই). ভারতের আজ্ঞাবহ এক দুর্বল বাংলাদেশের সৃষ্টি। ভারতের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানের ন্যায় আরেক শক্তিশালী স্বাধীন দেশ গড়ে উঠুক সেটি ভারতের কাম্য ছিল না। এটি ছিল ভারতের সূদুরপ্রসারি প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটি যেমন ১৯৭১য়ের পূর্বে ছিল, তেমনি একাত্তরেও ছিল। আজও সেটিই তাদের নীতি। ভারত এক্ষেত্রে কোনরূপ গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়োজনও অনুভব করেনি। কারণ কসাই যখন তার অবোধ ছাগলটির গলায় চাকু চালাতে টেনে নেয় তখন সে ধারালো চাকুটি লুকানোর প্রয়োজনীয়তা দেখে না। আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্বু্দ্ধিতার কারণে ভারতের পক্ষ থেকে তাদের মূল্যায়নও এ থেকে ভিন্নতর ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভারত তাই নিজ অভিপ্রায় জানিয়ে দিতে কোন রূপ সংকোচ বা লজ্জাবোধ করিনি। ভারত সেটি জানিয়ে দিয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধে তাদের নিজেদের অর্থ ও রক্ত বিণিয়োগের বহু আগেই। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের সাথে সাক্ষরিত ৭ দফা চুক্তিটি হল সেটিরই প্রমাণ। ভারতের অতি ভাগ্যবান যে, একাত্তরে তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের ন্যায় মেরুদণ্ডহীন নতজানু ব্যক্তিদেরকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি রূপে পেয়েছিল। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সুযোগটি এত সহজে কেও পায়। কোন স্বাধীন দেশের স্বাধীনচেতা রাজনৈতিক নেতা কি এরূপ দাসখতে স্বাক্ষর দেয়? কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সেটিতে শুধু স্বাক্ষর করেনি, তা নিয়ে উৎসবও করেছে। ভারত সরকারের কুটিল বুদ্ধিমত্তা হল, তারা সে সুযোগ থেকে পুরা ফায়দা তুলতে সামান্যতম ভূল যেমন করেনি, তেমনি দেরীও করেনি। তাজউদ্দিনের পর একই রূপ ফায়দা লুটেছে শেখ মুজিব থেকেও। তাজউদ্দিন আহম্মদ যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করেছিলেন সেগুলোই সামান্য কিছু পরিমার্জিত করে শেখ মুজিব থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিল ২৫ সালা চুক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সে কালো ঘটনাটি ঘটে ১৯৭২ সালের ১৯ই মার্চ ঢাকার বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর কালে। আওয়ামী লীগ এটিকে ঘটা করে সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি বলে আত্মপ্রসাদ জাহির করলেও সেদিনের সকল বিরোধী দল তাকে ‘দাসত্ব চুক্তি’ বলে আখ্যায়ীত করেছিল। শেখ মুজিব আগরতলায় ষড়যন্ত্র করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর বঙ্গভবনে বসে যে চুক্তিটি তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন সেটি ছিল খোদ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।
নতজানু নীতির ধারাবাহিকতা
শেখ মুজিবের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তাঁর অনুসারিরা ভারতের প্রতি তার সে অনুসৃত নতজানু নীতিকে এখনও অনুকরণীয় আদর্শ মনে করে। ফলে ভারতকে নানা ছুতায় নিজ দেশে ডেকে আনার নেশাই আজও আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি। যখনই নিজেদের সামর্থে কুলাবে না, ভারতকে তারা ডাক দিবে তেমনই একটি চুক্তি করেছিলেন শেখ মুজিব। শেখ হাসিনার নীতিও সেটাই। সেটিরই প্রমাণ মেলে উইকি লিক্স কর্তৃক প্রকাশিত একট্ গোপন তথ্য থেকে। উইকি লিক্স প্রকাশ করেছে, পিলখানায় সামরিক অফিসার হত্যার পর শেখ হাসিনা ভারতের হস্তক্ষেপের জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখার্জির কাছে অনুরোধ করেছিলেন। আর প্রণব মুখার্জি তাতে সম্মতিও জানিয়েছিলেন। কথা হল, পিল খানায় সামরিক অফিসার হত্যার বিষয়টি ছিল বাংলাদেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয়। এনিয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপ আহবান করার যৌক্তিকতাটি কি? এতে কি দেশের মর্যাদা বাড়ে? হয় কি স্বাধীনতার হেফাজত? ভারতের প্রতি এমন এক নতজানু চরিত্রের কারণেই বাংলাদেশের মধ্য ট্রানজিট দিতে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের আপত্তি হয় না। বাংলাদেশের পররাষ্টনীতির এ এক ভয়ংকর দিক। পিলখানায় সামরিক অফিসার হত্যার পর ভারতের সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ ভারতীয় পত্রিকা ‘এশিয়ান এজ’য়ে দেয়া সাক্ষাতকারটি াভএ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশে খুবই সহজে এবং বার বার নয়াদিল্লীর ‘রাডার’ থেকে সরে যায়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডার পর আর তা হতে দেয়া হবে না।” এব্যাপারে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, সরকারকে এ ব্যাপারে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের আশংকা যে কতটা তীব্র সেটি কি এর পরও বুঝতে বাঁকি থাকে?
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর দেশটির পরারাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রন করত ভারত। বাংলাদেশ কোন দেশের সাথে বন্ধুত্ব করবে, কোন দেশের নেতা বাংলাদেশে সফরে আসবে এবং শেখ মুজিব কোথায় রাষ্ট্রীয় সফরে যাবেন সেটিও নির্ধারিত করতো ভারত। এ বিষয়টি অন্যদের কাছেও গোপন ছিল না। এজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে সাথে স্বাধীন দেশ রূপে ভূটান ও ভারত স্বীকৃতি দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বহুদেশ স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি দেয়নি তুরস্ক, ইরান, সৌদিআরব, ইন্দোনেশিয়ার ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশও। ফলে দেরী হয় জাতিসংঘে ঢুকতেও। অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তেমনটি ঘটেনি। প্রথম দিন থেকেই দেশটি একটি স্বাধীন দেশ রূপে বিশ্বের সকল মুসলিম ও অমুসলিম দেশের স্বীকৃতি পায়। সম্মানও পায়। জেলখানার বন্দীদশা থেকে বেরুলে যেমন জেলগেটে আপনজনেরা গলা জড়িয়ে মোবারকবাদ জানায়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ভাগ্যে সেটিই জুটেছিল। অথচ জেলে ঢুকলে সেটি জুটে না। শেখ মুজিবের বড় অপরাধ, বাংলাদেশকে তিনি ভারতের অধীনত এক গোলাম রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। ২৫ সালা চুক্তির নামে বাংলাদেশের গলায় গোলামীর সে শিকলটাই তিনি পড়িয়েছিলেন।
পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলঃ এক). অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে নিজ দেশের স্বাধীনতার সুরক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া; দুই). অন্য দেশের সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়া; তিন). চিহ্নিত শত্রুর সম্ভাব্য হামলা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশকে সাথে নিয়ে মজবুত প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা। এলক্ষ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বন্ধনকে ব্যবহার করা; চার).আঞ্চলিক শান্তির পাশাপাশি বিশ্বশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা। পাঁচ). পরাধীন বা অধিকৃত দেশের মজলুল মানুষের স্বাধীনতার লড়য়ে সহযোগিতা করা। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর বাইরেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। বাংলাদেশের পরিচয় শুধু একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে নয়। দেশটির বাড়তি কিছু বৈশিষ্ঠও রয়েছে, পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে যা অগ্রাহ্য হবার নয়। সেগুলো হলঃ ১). বাংলাদেশে একটি মুসলিম দেশ; জনসংখ্যা বিচারে মুসলিম বিশ্বে তার অবস্থান তৃতীয়; ২). বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়; এবং ৩). বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ।
ব্যক্তি যেমন তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়কে সাথে নিয়ে চলাফেরা করে, তেমনি রাষ্ট্রও। অন্যদেশের সাথে বন্ধুত্ব গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার এ পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির বড় ব্যর্থতা হল, বাংলাদেশ সে পরিচয় নিয়ে বিশ্ব মাঝে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি। মুজিব বাংলাদেশের বলিষ্ঠ মুসলিম পরিচয়টাকে লুকাতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তির নামের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় সে মুসলমান না অমুসলমান। তেমনি একটি দেশের শাসনতন্ত্রেও প্রকাশ পায় দেশবাসীর বিশ্বাস ও প্রায়োরিটি। ব্যক্তির বিশ্বাসগত ঈমানী পরিচয়টিই হল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। সেটি শুধু আল্লাহর দরবারেই নয়, বান্দার দরবারেও। শুধু বিয়ে-শাদীর বিষয়েই নয়, মেলামেশা, খানাপিনা, এমন কি একত্রে কাজ-কর্ম করার ক্ষেত্রেও। কোন হিন্দু এ পরিচয়টি না জেনে কাউকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করা দূরে থাক, তাকে ঘরেই তুলবে না। তার সাথে একত্রে পানাহারও করবে না। বিদেশীরাও তাই সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে দেশের পরিচয়টি জানতে চায়। কোন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন সমাজতন্ত্রি, কম্যুনিষ্ট, মুসলমান বা খৃষ্টান হয় তখন সেটি তারা শাসনতন্ত্রে বা আইনে লিপিবদ্ধ করতে ভূলে না। এটি লিখে বিশ্ববাসীর সামনে ঘোষণা দিয়ে দেয় সে কাদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহন করতে প্রাধান্য দিবে। সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়ার মত দেশগুলো যেমন শাসনতন্ত্রে নিজেদের পরিচয় সমাজতন্ত্রি রূপে লেখেছে তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ডলারের নোটের উপর We trust in God লিখতে ভূলেনি। বিলেতে রয়েছে ব্লাসফেমী আইন যা যীশু খৃষ্ট ও বাইবেলে বর্নিত গডের প্রোটেকশন দেয়। জাতীয় পতাকায় তারা ক্রস চিহ্নকে রেখেছে। এবং ভারত তুলে ধরেছে অশোকার ত্রিশুল মুর্তিকে। একই কারণে পাকিস্তান তার জন্ম থেকেই তার নামের সাথে ইসলামি প্রজাতন্ত্র লিখে আসছে। এভাবে প্রতিটি দেশের নেতারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর প্রবল বিশ্বাস ও চেতনার বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে নানা ভাবে তুলে ধরেন।
শেখ মুজিব লুকাতে পারেননি ইসলামের সাথে তার গাদ্দারি। তিনি বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে দেশবাসীর মূল পরিচয়কেই বিকৃত করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্র রূপে তুলে ধরাকে তিনি সাম্প্রদায়ীক গণ্য করেছেন, বরং ললাটে এঁটে দিয়েছেন তাঁর মনগড়া সেক্যুলারিজম, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের লেবেল। অথচ এগুলোর উপর ঈমান আনাই ইসলামে হারাম। ইসলামের প্রতি অঙ্গিকারহীনতার কারণে ভারতের সাথে যতটা একাত্ম হতে পেরেছেন তেমনটি মুসলিম বিশ্বের সাথে পারেননি। তাই ১৯৭৪ সালে যখন সকল মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় তখন সেখানে যেতেও প্রথমতঃ গরিমসি করেছেন, অবশেষে গেছেন অনেকটা অনাগ্রহ নিয়েই। তাকে নিতে জনা্ব ভূট্টোকে আসতে হয়েছিল। নীতির ক্ষেত্রে তার মেরুদণ্ডহীনতাও ছিল প্রকট। তাই যখন যেমন হাওয়া বইছে তখন তিনি সে হাওয়ায় শিকড়হীন লতাপাতার ন্যায় ভেসেছেন। তাই চল্লিশের দশকে তিনে ভেসে গেছেছেন মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে। ষাটের দশকে এসে ভেসেছেন ভারতীয় কংগ্রেসের দর্শনে। আবার সত্তরের দশকে এসে রাশিয়ান ধারার সমাজতান্ত্রিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আর এতে জগাখিচুড়ি বেঁধেছে পররাষ্ট্রনীতিতে। আন্তর্জাতিক মহলে তিনি কোন বলিষ্ঠ ও স্বকীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হতে পারেননি।
ভারতের কু-মতলব ও স্বাধীনতার ব্যয়ভার
স্বাধীন ভাবে বাঁচবার অধিকার প্রতিটি দেশের নাগরিকেরই ন্যূনতম অধিকার। এখানে কোন আপোষ চলে না। পররাষ্ট্রনীতির এটি প্রধানতম বিষয়। এ অধিকার যেমন ভারতের রয়েছে, তেমনি পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল এবং বাংলাদেশেরও রয়েছে। বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ রূপ মেনে নিলে এ অধিকারও বাংলাদেশকে ষোল আনা দিতে হবে। নিজের নিরাপত্তা মজবুত করতে যে কোন দেশের বন্ধু খোঁজারও পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এটি অধিকারটি স্বাধীনতার সাথে জড়িত। সে বন্ধু দেশটি বিশ্বের যে কোন দেশই হোক, ভারতের তাতে নারাজ হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ মিজাইল বা যুদ্ধবিমান কিনলে ভারতের নাখোশ হবার কিছু নেই। নাখোশ হলে বুঝতে হবে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের কু-মতলব রয়েছে। মতলব রয়েছে অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের। অথচ ভারত বাংলাদেশের সে অধিকার দিতে রাজী নয়। তাই মুখ ভার করে বসে বাংলাদেশ যুদ্ধ বিমান ও যুদ্ধ জাহাজ কিনলে। তাই এরশাদ আমলে বাংলাদেশ যখন চীন থেকে কয়েক খানি বিমান কেনেছিল তখন না নিয়ে ভারতে অসন্তোষের ঝড় উঠেছিল।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, প্রতিবেশীর মুখের দিকে চেয়ে নীতি নির্ধারণ করলে তাতে স্বাধীনতা বাঁচে না। স্বাধীনতার শর্ত, এখানে অধীনতা নিজের, বিদেশীদের নয়। তাই প্রতিবেশীর আচরণ কি হবে, তা নিযে কোন স্বাধীন দেশের সরকার বসে থাকে না। ঘর গড়তে হলে সে ঘরে যেমন ছাদ দিতে হয় তেমনি মজবুত বেড়া এবং দেয়ালও দিতে হয়। নইলে নিরাপত্তা মেলে না। ইজ্জতও বাঁচে না। পানাহারে আপোষ চললেও ঘরের বেড়া ও দেয়াল গড়ায় কেউ কি তাই আপোষ করে? বরং কে কতটা ইজ্জত-সচেতন তা তো ধরা পড়ে তার ঘরের বেড়া ও দেয়াল দেখে। তেমনি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ক্ষেত্রেও। এ জন্যই প্রতিটি দেশকে তার প্রতিরক্ষাকে মজবুত করতে হয়। মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যয় হয় তার নিজের ও পরিবারের ইজ্জত বাঁচাতে। এজন্য তাকে শুধু অর্থ নয়, প্রাণও দিতে হয়। এটিই ইজ্জত নিয়ে বাঁচার ব্যয়ভার। যার মধ্যে সে ব্যায়ভার বহনের ইচ্ছা নেই, বা সামর্থ্য নেই -এ সমাজে তার ইজ্জতও নেই। সেটি স্বাধীনতার প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও। বিদেশের বাজারে শুধু বস্ত্র, মাছ ও মানব রপ্তানী করে কি ইজ্জত বাড়ানো যায়? বিভিন্ন জাতি লাখে লাখে প্রাণ দেয়, হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যয়ে মজবুত বাহিনী গড়ে তোলে তো সে কারণেই। প্রতিরক্ষার সে সামর্থ্য না থাকলে সেদেশের স্বাধীনতাও সংকুচিত না হয়ে পারে না। অথচ ভারতের প্রতি নতজানু আওয়ামী লীগ নেতাদের রাজনীতিতে সে ভাবনা নেই। তাদের কথা, ভারত বিশাল দেশ। ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার সামর্থ্য নেই। ফলে তাদের কাছে প্রতিরক্ষায় অর্থব্যয় হল অর্থের অপচয়। খাঁচার পাখি যেমন খাঁচার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না, তেমনি এরাও ভাবতে পারে না ভারতীয় আধিপত্যবাদ-মূক্ত আজাদ জীবনের। এখন তারা ব্যস্ত স্বাধীনতার সংজ্ঞা পাল্টাতে, খাঁচার পরাধীন জীবনকেই তারা স্বাধীনতা বলে সংজ্ঞায়ীত করছে। এবং তা নিয়ে উৎসবও করছে। অথচ বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে যেমন দুর্বল নয়, আর ভারতও মার্কিন যুক্তরাষ্টের চেয়ে শক্তিশালী নয়। কিন্তু সে সত্যটিও নতজানু ভারতসেবীরা ভূলিয়ে দিচ্ছে।
তলাহীন ঝুড়ি ও অরক্ষিত স্বাধীনতা
অনেক সময় দুর্বল ও ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি থেকে জন্ম নেয় পরাধীনতা। আবার সফল পররাষ্ট্রনীতি বহু ক্ষুদ্র দেশেও স্বাধীনতার আনন্দ বয়ে আনে। সুইজারল্যান্ড ভৌগলিক ভাবে ক্ষুদ্র। সামরিক দিক দিয়েও দুর্বল। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলির প্রবল সামরিক শক্তির মাঝেও দেশটি স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছে। এবং সেটি তার সফল পররাষ্ট্রনীতির কারণে। বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডের চেয়ে দুর্বল নয়। স্থলভূমি দ্বারা ঘেরাও নয়। জনশক্তিতে বিশাল, রয়েছে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বিশাল অর্থনৈতিক বাজার। কিন্তু যেটি নাই সেটি হল সফল প্রতিরক্ষানীতির সাথে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি। শেখ মুজিব যে শিকল বাংলাদেশের গলায় পড়িয়েছেন সেটি থেকে এখনও বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। সফল পররাষ্ট্রনীতি গড়তে হলে প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রনীতি বুঝতে হয়। যেখানে বাঘ বা ডাকাতের বাস সেখানে ঘর বাঁধতে হলে বাড়তি সতর্কতা চাই। বেদীনীদের ন্যায় ঝুপড়ি বাঁধলে সেখানে নিরাপত্তা মেলে না। আর ঘর বাঁধার প্রবল বাসনা থাকলে সরঞ্জামের অভাব হয় না। এজন্য নিয়েতটি জরুরী। অথচ বাংলাদেশের ভারতপন্থিরা দেশবাসীকে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে নিয়তশূণ্য করে ফেলেছে। পাকিস্তান তার বিপদটি ১৯৪৭ সালে তার জন্ম থেকে বুঝেছিল বলেই আজ পারমাণবিক শক্তি। অথচ শেখ মুজিব ও তার সহচরগণ প্রতিবেশী ভারতের ব্যাপারে মূল্যায়নেই ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশ যে বাঘের পল্লিতে বাস করে সেটি তিনি বুঝতেও ভুলে গেছেন। এ বাঘের পেটে সিকিম গেছে। কাশ্মির গেছে। হায়দারাবাদ এবং মানভাদরও গেছে। বাংলাদেশও যায় যায়। এটি তিনি বুঝতেই পারেননি। বরং মুজিব ছিলেন অন্য জগতে। ভারতীয় নেতাগণ বাংলাদেশে নিষ্ঠুর লুন্ঠন করলে কি হবে, মুজিবের কাছে তারা মহা-মানব রূপেই গণ্য হয়েছে। ফলে সীমান্তকে সুরক্ষিত করার বদলে তিনি সেটিকে উদার ভাবে খুলে দিয়েছেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হতে বিশ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এলাকায় অবাধ বাণিজ্য প্রচলনের মানসে ১৯৭২ সালের ২৭শে মার্চ তিনি একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় বাজার। পাত্রের তলা যেমন সে পাত্রে পানি ধরে রাখে, সীমান্তও তেমনি দেশের সম্পদ ধরে রাখে। আর এ চুক্তির মাধ্যমে শেখ মুজিব বাংলাদেশের তলাটিই ধ্বসিয়ে দেন। ফলে দেশীয় সম্পদ, এমন কি বিদেশীদের দেয়া বহু হাজার কোটি টাকার রিফিলের মালও তখন আর দেশে থাকেনি। বরং ত্বরিৎ বেগে পৌঁছে গেছে ভারতের বাজারে। যে ভিক্ষুকের পাত্রে তলা থাকে না তাকে অন্যরা ভিক্ষা দিতেও অনিহী দেখায়। কারণ, দাতার ভয় দানের টাকাটিও ড্রেনে গিয়ে পড়বে। মুজিব আমলে তাই অনীহা জেগেছিল বহু দাতা দেশের মনেও। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি রূপে অভিহিত করেছিলেন তো সে ক্ষোভ নিয়েই।
পররাষ্ট্রনীতিকে দেশের অর্থনীতি থেকে পৃথক করা যায় না। দেশের বাণিজ্য বাড়াতে তথা অর্থনীতি মজবুত করার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা তাই দেশে দেশে ঘুরেন। বাংলাদেশের ন্যায় একটি দরিদ্র দেশে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসেডেন্ট বিল ক্লিন্টন এসেছেন মার্কিন কোম্পানীর জন্য বাজার খুঁজতে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি এক্ষেত্রেও চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিদেশে দূতাবাসের সংখ্যা বাড়লেও বাজার বাড়েনি। বরং হারিয়েছে প্রচুর। ব্যর্থ পররাষ্ট্র নীতির কারণে পাটজাত পণ্যের প্রতিষ্ঠিত বাজার হারিয়েছে সেই সত্তরের দশকেই। পাকিস্তান আমলে বহু কষ্টে গড়া সে বাজার সহজেই দখল করে নিছে ভারত। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বহু পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিলকেও সে মড়ক থেকে বাঁচানো যায়নি। অথচ সফল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাণিজ্য বেড়েছে ভারতের। সেদেশের মৃত পাটকলগুলো নবজীবন পেয়েছে। আর চা শিল্পের দশা? আজ বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে এক চা আমদানিকারক দেশে!
বিনাযুদ্ধে বেরবাড়ী
শত্রুমিত্র চিনতে শেখ মুজিবের নিজের ব্যর্থতা যে কতটা প্রকট ছিল তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। তিনি বাংলাদেশের ক্যারেন্সী নোট ছাপানোর দায়িত্ব দেন ভারত সরকারের উপর। যে পরিমান নোট ছাপতে দিয়েছিল তার চেয়ে বহু শত কোটি টাকার বেশী নোট ছেপে ভারত তা কালো বাজারীদের হাতে ছাড়ে। আর তা দিয়ে বাংলাদেশে যা কিছু মূল্যবান সম্পদ পাকিস্তানের ২৩ বছরে আনা হয়েছিল সে সম্পদও পানির দামে কিনে ভারতে নিয়ে যায়। পাচার হয়ে যায় বিপুল পরিমাণ খাদ্য সম্পদও। পাকিস্তান আমলে টাকার দাম ভারতীয় রূপীর চেয়ে শক্তিশালী ছিল। কিন্তু কালো টাকার প্রকোপে সেটি ভারতীয় রূপীর অর্ধেকে নেমে আসে। ভারতীয় লুন্ঠনের ফলেই শুরু হয় ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, বহু লক্ষ লোক তাতে না খেয়ে মারা যায়। বস্ত্রের অভাবে মহিলারা সে সময় ঝাল পড়তেও বাধ্য হয়েছিল। এই হল একটি দেশের ব্যর্থ পররাষ্ট্র নীতির ভয়াবহ পরিনতি যা শুধু বিশ্বজুড়া অপমানই অর্জন করেনি, দেশবাসীকে নিদারুন দারিদ্র্য এবং মৃত্যুও উপহার দিয়েছে। ভারত মুখে যাই বলুক, বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে দেশটি যে কতটা বদ্ধপরিকর সে প্রমাণ কম? এমনকি ভারতীয় জেনারেল ম্যানেক শ ভারতের এরূপ লুণ্ঠন-নীতির কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দৃষ্টিতে সে লুন্ঠন ধরা পড়েনি। নিজ দেশে এমন একটি নতজানু অভ্যন্তরীণ শক্তি থাকতে শত্রু-দেশকে কি দেশ-দখল, বাজার-দখল, মিডিয়া-দখলে একটি বুলেট ছুড়ারও প্রয়োজন পড়ে। তাই একটি গুলি না ছুড়েই ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশে অবিচ্চেদ্য অঙ্গ বেরবাড়ী। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব নিজে দিল্লি গিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদযুগলে সে ভূমি অর্পন করে এসেছিলেন। আর শেখ মুজিব কণ্যা শেখ হাসিনার নীতি? শেখ মুজিব তবুও ট্রানজিট দেননি, কিন্তু তিনি সেটিও দিয়ে দিয়েছেন। শেখ মুজিব ভারতীয় পণ্যের জন্য সীমান্ত থেকে ২০ মাইল এলাকা ছেড়ে দিয়েছিলেন, আর শেখ হাসিনা পুরা দেশই দিয়েছেন।
ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতি ও বন্ধুহীন বাংলাদেশ
আধুনিক কালে কোন দেশে দূর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। নেহায়েত জন-মানব শূণ্য মরুভূমি বা বনেজঙ্গলে বাস না করলে কেউ সাধারণত না খেয়ে মারা যায় না। এমন কি কুকুর বিড়ালও নয়। মানব সমাজে সব সময়ই কিছু বিবেকমান মানুষ থাক। মারা যাওয়ার আগেই তাই প্রতিবেশী বন্ধুজনেরা খাদ্য নিয়ে হাজির হয়। সভ্য মানব সমাজের এটিই রীতি। যখন না খেয়ে মানুষ মারা যায়, তখন বুঝতে হবে সমাজে সে পরিবারের আপন লোক বলে কেউ নাই। থাকলেও যিনি পরিবারের প্রধান তিনি আপনজনদের কাছে পরিবারের দূরাবস্থার কথা সঠিক ভাবে পৌঁছাতে পারেননি। তাই যে দেশে দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায়, বুঝতে হবে সেদেশের মানুষের উপর নিশ্চয়ই কোন দায়িত্বহীন, মায়ামমতাহীন কোন অযোগ্য, নিষ্ঠুর ও দূর্নীতিপরায়ন শাসক চেপে বসেছে। দুনিয়ার যত দেশেই যত দুর্ভিক্ষ হয়েছে তার মূল কারণ খাদ্যাভাব ততটা ছিল না, যতটা ছিল সরকারের ব্যর্থতা। বাংলাদেশে মুজিবামলে সেটাই হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশে যখন ভয়াবহ দূর্ভীক্ষ, মধ্যপ্রাচ্যে তখন অভূতপূর্ব প্রাচুর্য্য। ১৯৭৩ সালের আরব- ইসরাইল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলের পক্ষ নেয়। এর প্রতিবাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি তেলের দাম ১০ ডলার থেকে ৪০ ডলারে নিয়ে যায়। ফলে সেখানে শুরু হয় অর্থের সয়লাব। সৃষ্টি হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থা নের সুযোগ। লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী, ভারতী, শ্রীলংকান, মিশরী, সূদানী, এমনকি ফিলিপাইনীরাও সে শ্রম বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশীরা সেখানে যেতে পারিনি। বাংলাদেশী যাবে কি করে, তাদের জন্য তখনও সেসব দেশের দরজাই খোলা হয়নি। কারণ তখনও সৌদিআরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাত ও ওমানের মত দেশগুলা বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশরূপে স্বীকৃতিই দেয়নি। বাংলাদেশ তখনও মুজিবের নেতৃত্বে ভারতের কোলে বসা। মুজিবের কন্ঠে তখন ভারত-বন্দনার কীর্তন। এবং মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি। অথচ সমাজতন্ত্র বা কম্যিউনিজমকে তখন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলির রক্ষণশীল জনগণ মুর্তিপুজার ন্যায়ই ঘৃনা করে। মুজিবের এরূপ ভারত-বন্দনা দেখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তখনও বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ রূপে ভাবতেও সংশয়ে পড়তো। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকগণ শুধু চাকরির সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হয়নি, বঞ্চিত হয়েছে দুর্ভিক্ষ কালে মুসলিম দেশের অর্থনৈতিক সাহায্য থেকেও। অথচ ঠিক সে সময়ই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পাকিস্তান একটি প্রকাণ্ড যুদ্ধের পরও অতি দ্রুত সমৃদ্ধির দিকে এগুয়। তাদের মাথা পিছু আয় দ্রুত ভারতের দেড়গুণ হয়ে যায়। জনশক্তি রপ্তানীর মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার সে সময় এত বিপুল পরিমান বিদেশী মূদ্রা অর্জন করে যে, গোপন পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে সামনে এগুণোর কাজ তখনই সেদেশে বেগবান হয়। দেশটি নতুন ভাবে গড়ে তোলে তার সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানের শহর ও গ্রামগুলোতে দ্রুত বাড়তে থাকে আধুনিক ঘরবাড়ী। অথচ আর বাংলাদেশের মানুষ তখন মরছে না খেয়ে। লজ্জা নিবারণে পড়ছে মাছধরা জাল। যে দেশের নেতার ইসলামী দেশ রূপে পরিচয় দিতেই অনীহা, সেদেশটি মুসলিম দেশে থেকে স্বীকৃতি বা সহানুভুতিই বা পায় কেমনে? বাংলাদেশেীরা বস্তুত মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ঢুকার সুযোগ পায় শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর। দেরীতে যাওয়ার ফলে ভাল বেতনের চাকুরিতে ঢুকাও তাদের জন্য তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে, সেগুলো ইতিমধ্যেই পাকিস্তানী, মিশরী ও ভারতীয়দের কাছে হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই শেখ মুজিবের সরকার যে শুধু স্বরাষ্ট্র, শিল্প, শিক্ষা, কৃষি ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে ব্যর্থতা উপহার দিয়েছে তা নয়, উপহার দিয়েছে অতি ব্যর্থ পররাষ্ট্র নীতিও। সে ব্যর্থতাগুলোই বাড়িয়েছে যেমন দারিদ্র্য, তেমনি বিশ্বজুড়া অপমান।
ইতিহাস বিকৃতির অপরাধ এবং একই গর্তে বার বার
অথচ আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা থেকে ব্যর্থতার সে বিষয়গুলোই অতি ক্ষিপ্রতার সাথে লুকানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অথচ একটি দেশের জনগণ সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি পায় তার ব্যর্থতা থেকে। আগুণে হাত দেওয়ার পর সে বেদনাটি শিশুও বুঝে। সেটি এক চরম অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার কারণই শিশু আর কখনও আগুণে হাতে দেয় না। শত শত বই পড়েও সে অভিজ্ঞতাটি মেলে না। বাংলাদেশের ব্যর্থতার ইতিহাস থেকেও শিখবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তেমনি অনেক। সে বাস্তব বিষয়গুলো বিশ্বের কোন সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ও ক্লাস রুমে শেখাতে অসমর্থ। কারণ সে ব্যাপারে পূর্ব-অভিজ্ঞতা সেখানকার শিক্ষকদেরও নাই। একারণে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বরং বাংলাদেশের মত দেশের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যস্ত। যুগ যুগ ধরে বহু পিএইচডি থিসিস লেখা হবে এ নিয়ে। তাদের গবেষণার বিষয়, শায়েস্তা খানের বাংলাদেশ কীভাবে তলাহীন ভিক্ষা ঝুলিতে পরিণত হল? কীভাবেই বা দূর্নীতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম স্থান অধিকার করলো? কেনই বা দেশটিতে ১৯৭৪য়ে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ নেমে এল? এমন ধরণের গবেষণা করেই তো অর্মত্য সেন নবেল প্রাইজ পেলেন।
আওয়ামী লীগের অপরাধ অনেক। তবে দলটির অন্যতম বড় অপরাধ হল, অতীতের ব্যর্থতাগুলো থেকে শিক্ষা নেয়া থেকে দেশবাসীকে তারা বঞ্চিত করছে। আর সেটি লাগাতর ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে। নিজেদের কদর্য ইমেজ ঢাকতে তারা নিজেদের ব্যর্থতাগুলোকে গৌরবময় করেছে। খুনী যেমন প্রাণ বাঁচাতে লাশকে গোপন করে, এরাও তেমনি ১৯৭১য়ের ৭ দফা চুক্তি, ১৯৭২য়ের ২৫ সালা দাসচুক্তি, ১৯৭৪ য়ের দুর্ভিক্ষ, ১৯৭৫ য়ের বাকশাল ও গণতন্ত্র হত্যা, সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী, চল্লিশ হাজার বিরোধীদলীয় কর্মী হ্ত্যা, ভারতের হাতে বেরুবাড়ি তুলে দেয়া –এরূপ জঘন্য অপরাধগুলোকেও দাফন করতে চায়। বহুলাংশে সে কাজে তারা সফলও হয়েছে। ফলে যে ব্যর্থতার করুন ইতিহাস বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ভবিষ্যতে আলোর পথ দেখাতে পারতো সেটিও আজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে দেশবাসীর পা একই গর্তে বার বার পড়ছে। ভয়ানক অপরাধী ও অতি অযোগ্য মানুষেরা বার বার চেপে বসছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির মাধ্যমে প্রমাণিত হলো দেশ কতটা অপরাধীদের হাতে অধিকৃত। এ অধিকৃতির কারণেই দেশ ছুটে চলেছে দ্রুত বিপর্যয়ের দিকে। একটি দেশের জন্য এর চেয়ে ভয়ংকর বিপদের কারণ আর কি হতে পারে? প্রথম সংস্করণ ১৯/০৬/১১; দ্বিতীয় সংস্করণ ২৭/০৩/২০১৯
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018