বাংলাদেশে অপরাধীদের শাসন ও নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 24, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
অপরাধের শুরুটি দেশটির জন্ম থেকেই
অপরাধের অর্থ শুধু চুরি-ডাকাতি, খুন-রাহাজানী ও ধর্ষণ নয়; অপরাধ নানা ভাবে নানা রূপ নাশকতার মধ্য দিয়ে হতে পারে। সেটি হতে পারে মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের নাশকতা। হতে পারে আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। হতে পারে চিহ্নিত শত্রুর সাথে জোট বেঁধে নিজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। হতে পারে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর ডাকাতি। হতে পারে দেশকে শত্রুদের অধিকৃত করদ রাজ্যে পরিণত করার ষড়যন্ত্র। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে এ ধরণের অপরাধগুলি হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে যারা এ দেশটির জন্ম থেকেই ক্ষমতাসীন।
প্রতিটি অপরাধ নির্ধারিত হয় কর্মের নিয়ত থাাকে। এমন কি মানুষ খুন করলেও সেটি খুনের অপরাধ গণ্য হয়না -যদি খুনের নিয়ত না থাকে। অপর দিকে নিয়ত যেখানে ধর্ম, দেশ, গণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষতিসাধন -তবে সে ধরণের সকল কর্মই হলো অপরাধ। কোন কর্মকে পরিশুদ্ধ ও সঠিক হতে হলে কর্মের নিয়েতটি অবশ্যই হালাল হতে হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি কর্মের মূল্যায়ন করেন তার নিয়তের ভিত্তিতে। বুখারী শরিফের সেটিই হলো প্রথম হাদীস। নিয়ত হালাল হলে সে কর্মটি পবিত্র ইবাদতে পরিণত হয়। এবং নিয়ত হারাম হলে সেটি অপরাধ গণ্য হয়। আর প্রতিটি অপরাধই তো পাপ যা অপরাধীকে জাহান্নামে নেয়। এটি হলো ইসলামের অতি মৌলিক ধারণা -যা নিয়ে নানা ফেরকা ও নানা মজহাবের আলেমদের মাঝে কোন বিভেদ নাই। তাই নিয়ত হালাল হওয়াটি জরুরি শুধু প্রতিদিনের কাজ কর্মে নয়, বরং রাষ্ট্র নির্মাণের ন্যায় মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মেও।
প্রতিটি রাষ্ট্র নির্মাণের পিছনে অবশ্যই একটি মূল এজেন্ডা কাজ করে। সে এজেন্ডাটি যেমন পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রী, রাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী এজেন্ডা হতে পারে, তেমনি ইসলামী এজেন্ডাও হতে পারে। যারা পুঁজিবাদী তারা রাষ্ট্র নির্মাণ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত ও বিকশিত করার লক্ষ্যে। কম্যুনিস্টরা রাষ্ট্র নির্মাণ করে কম্যুনিজমকে প্রতিষ্ঠা দিতে। তেমনি জাতীয়তাবাদী ও গোত্রবাদীরা রাষ্ট্র নির্মাণ করে ভাষা ও গোত্র ভিত্তিক পরিচয়কে গৌরবময় করতে। অপর দিকে রাজতন্ত্রীরা রাষ্ট্র নির্মাণ করে রাজার সার্বভৌম শাসনকে প্রতিষ্ঠা দিতে। এসবই হলো রাষ্ট্র নির্মাণের পার্থিব এজেণ্ডা। এরূপ রাষ্ট্র নির্মাণের এজেণ্ডাতে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার কোন স্থান থাকে না। তাঁকে খুশি করাও তাদের লক্ষ্য নয়। পরকালে জান্নাত পাওয়াও এ রাষ্ট্র নির্মাণের কোন এজেণ্ডা নয়। আখেরাতের ভাবনাশূণ্য এরূপ রাষ্ট্রকে বলা হয় সেক্যুলার রাষ্ট্র। এরূপ সেক্যুলার রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াই তাই কখনোই ইবাদত রূপে গণ্য হয় না।
বুঝতে হবে, ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক, দৈহিক ও আর্থিক সামর্থ্যগুলি হলো মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দেয়া আমানত। তাঁর দেয়া সে সামর্থ্যগুলিকে সেক্যুলার রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে বিনিয়োগ করাটি হলো আমানতের খেয়ানত। শরিয়তের বিচারে এটি হারাম। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে এটি গাদ্দারী। যুদ্ধ এখানে মহান আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরূপ অপরাধ ব্যক্তিকে পরকালে জাহান্নামে হাজির করবে। এরূপ অপরাধীদের জন্য এটিই হলো প্রতিশ্রুত শাস্তি। ঈমানদারী হলো, এ ধরণের অপরাধ থেকে বাঁচা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারত নির্মাণের লক্ষ্যটি ইসলামশূণ্য ও সেক্যুলার হওয়ার কারণে অধিকাংশ ভারতীয় মুসলিম তাতে শরীক হয়নি। অধিকাংশ মুসলিম কংগ্রেসে যোগ না দিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিল।
অপরাধটি গাদ্দারীর
পৃথিবী পৃষ্ঠে রাষ্ট্র হলো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ধর্ম ও মতবাদের অনুসারীদের জীবনেই লড়াই থাকে; সে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য, এমন এক রাষ্ট্রের নির্মাণ -যা হাতিয়ার হবে ধর্ম ও মতবাদকে প্রতিষ্ঠা দেয়ায়। হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী, কম্যুনিস্ট -সবাই তাই রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে। রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সেরূপ একটি লক্ষ্য থাকে মুসলিমদেরও। নিজে রাষ্ট্র নির্মাণ করে এবং ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধান রূপে কাজ করে মহান নবীজী (সা:) সূন্নত রেখে গেছেন কীভাবে সে রাষ্ট্র নির্মিত হবে ও পরিচালিত হবে -সেটির। সে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিবে মুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু ও স্বাধীনতাকে। প্রতিষ্ঠা দিবে মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে। এবং সকল ধর্ম, সকল মতবাদ ও সকল জীবন বিধানের উপর বিজয়ী করবে ইসলামকে। মহান আল্লাহ তায়ালার সে এজেণ্ডা ঘোষিত হয়েছে নিম্নের আয়াতগুলিতে:
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ
অর্থ: “তিনিই হলেন সেই আল্লাহ, যিনি পথনির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ তার রাসূলকে পাঠিয়েছেন, যাতে তা সকল ধর্মের উপর বিজয় লাভ করে -যদিও তা মুশরিকদের কাছে অপছন্দের।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৯)। একই রূপ ঘোষণা এসেছে সুরা তাওবা ও সুরা ফাতাহতে। সুরা আনফালে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার কথা বলা হয়েছে এভাবে:
وَيُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَيَقْطَعَ دَابِرَ ٱلْكَـٰفِرِينَ
অর্থ: “এবং আল্লাহ চান, তাঁর কালেমা দিয়ে হককে হক রূপে প্রতিষ্ঠা করতে এবং শিকড় কাটতে চান কাফিরদের।” –(সুরা আনফাল, আয়াত ৭)।
لِيُحِقَّ ٱلْحَقَّ وَيُبْطِلَ ٱلْبَـٰطِلَ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُجْرِمُونَ
অর্থ: “তিনি চান হককে হক রূপে এবং বাতিলকে বাতিল রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে চান -যদিও অপরাধীরা সেটি অপছন্দ করে।” –(সুরা আনফাল, আয়াত ৮)।
প্রশ্ন হলো, পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডা এতো স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করার পরও ক’জন মুসলিম শাসক এবং ক’জন মুসলিম বাঁচছে সে এজেণ্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে? বস্তুত মুসলিম জীবনে সবচেয়ে গাদ্দারী তো মহান আল্লাহর এজেণ্ডার সাথে। তাঁর এজেণ্ডাকে বিজয়ী করার লড়াই ছেড়ে তারা বাঁচছে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজম, রাজতন্ত্র ইত্যাদি মতবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে। সর্বশক্তিমান মহান রব চাইলে তাঁর এ ঘোষিত এজেণ্ডা “কুন, ফা ইয়াকুন” ন্যায় এক হুকুমের বলেই তিনি কার্যকর করতে পারতেন। ফিরেশতাদের দিয়েও তিনি সে এজেণ্ডাকে বিজয়ী করতে পারতেন। কিন্তু সে কাজটি সমাধা করার দায় ফিরেশতাদের জন্য রাখা হয়নি; রাখা হয়েছে তাঁর মানব সৃষ্টির জন্য। এ কাজের জন্যই মানব সন্তানেরাই হলো তাঁর পক্ষ থেকে দায়প্রাপ্ত খলিফা। এজন্যই এ এজেণ্ডা পূরণে মানুষের উপর ফরজ করেছেন শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত নয়, তার আনসার তথা সাহায্যকারী হওয়াও। যেমন সুরা সাফ’য়ের ১৪ নম্বর আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে:
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُونُوٓا۟ أَنصَارَ ٱللَّهِ كَمَا
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও।”
তাই কে কতটা নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করলো -মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে শুধু তার হিসাব হবে না। সে কতটা তাঁর আনসার তথা সাহায্যকারী হলো -তারও নিশ্চিত হিসাব হবে। কারণ, তাঁর আনসার তথা সাহায্যকারী হওয়াও তো ফরজ। নিয়মিত নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও যে ব্যক্তি ইসলামকে বিজয়ী না করে বিজয়ী করলো জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, রাজতন্ত্রের, এবং আদালতে শরিয়তী আইনে বিচার না করে কাফিরদের প্রণীত আইনে বিচার করলো -সে কি আখেরাতে রক্ষা পাবে? মুসলিমগণ যে মহান আল্লাহ তায়ালার আনসার হতে ব্যর্থ হয়েছে তা যেমন মুসলিম দেশগুলিতে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি দেখে বুঝা যায়, তেমনি বুঝা যায় জাতীয়তাবাদ, রাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজমের বিজয় দেখে।
ব্যর্থতা মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে একাত্ম হওয়ায়
এ জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি পারিবারিক, অর্থনৈতিক বা পেশাদারী ব্যর্থতা নয়। বরং সেটি হলো, মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা হতে ব্যর্থতা। মানব সৃষ্ঠির মূল লক্ষ্য, মানব সন্তানেরা পরিণত হবে তার খলিফায়। কিন্তু তা না হয়ে গায়রুল্লাহ তথা শয়তানী শক্তির খলিফায় পরিণত হয়। মানব জীবনে সেটিই হলো সবচেয়ে বড় গাদ্দারী। এমন গাদ্দারগণ কি জান্নাতে’ স্থান পাবে? মহান রব’য়ের প্রকৃত খলিফা তো তারাই যাদের নিজেদের ব্যক্তিগত এজেণ্ডা পুরাপুরি একাত্ম হয় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে। তাদের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও লড়াই’য়ে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডা ছাড়া ভিন্ন কোন এজেণ্ডা থাকে না। আমৃত্যু সে আনসার হয় মহান আল্লাহ তায়ালার। তাই ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই ভারতের ন্যায় কোন কাফির দেশে আশ্রয় নেয় না। তাদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদেরকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করে ন। মু’মিনের নামাজ, রোজা, হজ্জ,যাকাতের ন্যায় প্রতিটি ইবাদতের মূল লক্ষ্য তো মহান আল্লাহর কুর’আনী ঘোষিত এজেণ্ডার সাথে একাত্ম করা। অথচ এখানেই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। নামাজ-রোজা পালন করেও তারা মহান আল্লাহ তায়ালার আনসার না হয়ে আনসার হয় সেক্যুলার, স্বৈরাচারী ও জাতীয়তাবাদী শাসকের। তারা আনসার হয় এমন কি ঔপনিবেশিক শত্রু শক্তির। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১০ লাখের বেশী আরব মুসলিম এবং আড়াই লাখ ভারতীয় মুসলিম ব্রিটিশদের আনসার হয়ে উসমানিয়া খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। বহু হাজার নিহত এবং আহতও হয়েছে। এদের কারণে মুসলিম ভূমিতে কাফিরগণ বিজয়ী হয়েছে, পরাজিত ও বিলুপ্ত হয়েছে খেলাফত এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ইসরাইল।
বাঙালি মুসলিমদের ইতিহাসও কি কম বেদনাদায়ক? একাত্তরে তারা আনসারে পরিণত হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী ভারতের। ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ভারতীয় সৈন্যদের সাথে কাঁধ কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে এবং ভারতের বিজয়কে নিজেদের বিজয় গণ্য করে উৎসব করেছে -যেমন রাজার গোলামগণ রাজার বিজয়কে নিজেদের বিজয় বলে। এরূপ গাদ্দারীর কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে পরাজিত হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডা। এবং বিজয়ী হয়েছে জাতীয়তাবাদ, রাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজমের মত মতবাদী রাজনীতি। এমন কি যারা সমাজে আলেম, ইমাম, ফকিহ, মোহাদ্দেস, পীর রূপে পরিচিত -তাদেরই বা ক’জন মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে একাত্ম? তাদের সংখ্যা তো বাংলাদেশে বহু লক্ষ। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে একাত্ম হলে তো তাদেরকে জিহাদে যোগ দিতে ও শহীদ হতে দেখা যেত। তাদের ব্যর্থতার কারণেই কোন মুসলিম রাষ্ট্রে বেঁচে নাই তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তার শরিয়তী আইন। প্রশ্ন হলো, যে নামাজ-রোজা, হ্জ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত ও দোয়াদরুদ ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে একাত্ম করে না -সে ইবাদত কি আদৌ ইবাদত? ইবাদতের অর্থ তো দাসত্ব। এবঙ দাসত্বের অর্থ হলো, তাঁর ইচ্ছা ও এজেণ্ডার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। যে ইবাদতে সে আত্মসমর্পণ নাই সেটি মুনাফিকি। এমন লোক দেখানো ইবাদত মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই এবং তার ৩ শত অনুসারীও পালন করতো। তারা এমন কি নবীজী (সা:)’র পিছনে নামাজ পড়েছে । কিন্তু তারা আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার সাথে একাত্ম না হয়ে একাত্ম হয়েছিল শয়তানের এজেণ্ডার সাথে। সেটি বুঝা যায় মুসলিম দেশের ইসলামের পরাজয় ও নানারূপ মতবাদের বিজয় দেখে।
নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র এবং একালের মুসলিম রাষ্ট্র
রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ ও কল-কারখানা নির্মাণ নয়, বরং তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হলো, নাগরিকদের পূর্ণ মুসলিম রূপে তথা মহান আল্লাহতায়ালার আনসার রূপে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা। এবং সে লক্ষ্যে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এবং সে সাথে রাষ্ট্রের আরো দায়িত্ব হলো, শয়তানী শক্তির প্রচারনা, প্রতারণা ও কুশিক্ষা থেকে জনগণকে রক্ষা করা। জনপদকে শুধু হিংস্র পশুর আত্রুমণ থেকে মুক্ত রাখতে চলে না, মুক্তি রাখতে হয় শয়তানী শক্তির সংক্রামক বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের নানারূপ নাশকতা থেকেও।
মহান আল্লাহতায়ালার আনসার রূপে বেড়ে উঠার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির কাজটি অনৈসলামী রাষ্ট্রে অসম্ভব। এজন্য চাই ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামী রাষ্ট্র বস্তুত কাজ করবে জনগণকে জান্নাতে নেয়ার বাহন রূপে। রাষ্ট্র সে কাজটি করে পরিকল্পিত শিক্ষানীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, প্রশাসনিক ও বৈচারিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডাকে বিজয় করার কাজটি হয়না বলেই নবীজী (সা:)কে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছিল এবং তাঁকে ১০টি বছর কাজ করতে হয়েছে সে রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রপ্রধান রূপে। নবীজী (সা:)’র ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ ও সে রাষ্ট্র পরিচালনার সূন্নতকে অব্যাহত রেখেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদার খলিফাগণ। সে রাষ্ট্রের উপর ভিত্তি করেই মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার।
অথচ অতি পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলেও সেরূপ একটি হালাল ও পবিত্র এজেণ্ডা নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়নি। এবং গুরুত্ব পায়নি মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডা ও নবীজী (সা:)’র সূন্নত। বরং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, বামপন্থী ও হিন্দুত্ববাদীদের। তারাই ছিল সে লড়াইয়ের মূল নেতা-কর্মী ও সৈনিক। তাদেরকে সামরিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক শাসিত একটি দেশ -যাদের ছিল সুস্পষ্ট একটি আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী এজেণ্ডা। বাংলাদেশ নির্মাণের মূল এজেণ্ডাটি ছিল, বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে দুর্বল করা এবং ইসলামের প্রভাবমুক্ত সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া। তাই বাংলাদেশের জন্মের মধ্যে রয়ে গেছে মহান আল্লাহতায়ালার এজেণ্ডার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। একারণেই এ রাষ্ট্রের জন্মদানে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার ন্যায় কাফির শাসিত শয়তানী শক্তি সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে; কোন মুসলিম দেশ এগিয়ে আসেনি।
অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম দেশ গড়া এবং সে দেশের ভূগোল বাড়ানোকে হালাল করেছেন এবং মুসলিম দেশ ভাঙ্গা ও সে দেশকে ক্ষু্দ্রতর করাকে হারাম করেছেন। ফলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা কোন হালাল লক্ষ্যে হয়নি; বরং হয়েছে একটি হারাম এজেণ্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। এবং বিজয় পেয়েছে ভারতের ন্যায় একটি কাফির শক্তি। এজন্যই পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে কোন ইসলামী সংগঠন, কোন আলেম, কোন ইমাম, কোন মাদ্রাসার শিক্ষক, কোন পীর সাহেব অংশ নেয়নি। কোন মুসলিম দেশও পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থণ দেয়নি। বাঙালি ফ্যাসিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের মুখোশটি ধর্মনিরপেক্ষতার হলেও শুরু থেকেই তাদের যুদ্ধটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম শক্তির উত্থান প্রতিরোধে। তাদের এজেণ্ডা এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদী এজেণ্ডা একাকার হয়ে গেছে। তাই ক্ষমতায় এসেই শেখ মুজিব ইসলামপন্থীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে, সকল ইসলামী দলের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয় এবং বহু নেতাকর্মীকে হত্যা বা কারাবন্দী করে।
অথচ ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিমের রাজনীতির চিত্রটি ভিন্নতর ছিল। তখন সর্বোচ্চ ইবাদত তথা জিহাদে পরিণত হয়েছিল হিন্দুদের অধিকৃতি থেকে মুক্তি লাভ এবং পাকিস্তানের নির্মাণ। ১৯৪৭’য়ে মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল, “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” অর্থ: “পাকিস্তানের লক্ষ্য কি? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” এভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব পেয়েছিল বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ, গুজরাতী ইত্যাদি পরিচয়ের মুসলিমদের “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র পতাকা তলে একতাবদ্ধ করা। ইসলামে এরূপ একতা ফরজ। ১৯৪৭’য়ে গুরুত্ব পেয়েছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান নির্মাণ করে দুর্বল মুসলিমদের পাশে অভিভাবক রূপে দাঁড়ানো। অথচ ১৯৭১’য়ে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল, “জয় বাংলা”। “জয় বাংলা”র স্লোগানে গুরুত্ব পেয়েছিল বাঙালিদের একতাবদ্ধ করা এবং তাদেরকে অবাঙালিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা। অথচ ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে অন্য মুসলিমদের থেকে এরূপ বিচ্ছিন্নতাই হলো হারাম তথা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
পাকিস্তান আজ পারমানবিক শক্তি। দেশটির জনসংখ্যা ২৫ কোটি। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ ২৫ কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তানের সাথে একাত্ম হলে দেশটি হতো ৪২ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। তখন পারমানবিক অস্ত্রধারীটি দেশটি বিশ্ব রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পারতো। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালি মুসলিম হওয়া তারা বিশ্বব্যাপী ভূমিকাও রাখতে রাখতে পারতো। তাই পাকিস্তান ভাঙ্গাতে লাভ হয়েছে ভারতের এবং ক্ষতি হয়েছে মুসলিম উম্মাহর -বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমের। বাংলাদেশীরা পরিণত হয়েছে ভারতের অধিকৃত প্রজায়। কোন মুসলিম কি মুসলিম উম্মাহর এতো বড় ক্ষতি করতে পারে? একাজ তো কাফিরদের। এরূপ একটি অবস্থা সৃষ্টির জন্যই পৌত্তলিক ভারত ১৯৭১’য়ে আড়াই লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গতে যুদ্ধ করে এবং সে যুদ্ধে বহু হাজার ভারতীয় সৈন্য নিহতও হয়েছে। তাই একাত্তরের যুদ্ধ ছিল ভারতীয় অর্থে, ভারতীয় অস্ত্রে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী দিয়ে ভারতীয় এজেণ্ডাকে বিজয়ী করার শত ভাগ ভারতীয় যুদ্ধ। অথচ ইসলামী চেতনাশূণ্য কিছু বাঙালি কাপালিক বলে, ভারত বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা দিতে যুদ্ধ করেছিল। একমাত্র ঈমানশূণ্য ও সুস্থ চেতনাশূণ্য বেকুবেরাই এমন অলীক কথা বলতে পারে।
জন্মই হারাম পথে
ইসলামে হারাম-হালালের বিধানটি শুধু পানাহারে নয়, বরং সে বিধান রয়েছে প্রতিটি কর্মে এবং রাজনীতিতে। ইসলামে কারো ঘর ভাঙ্গা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গা। হারাম কাজের পরিণতি কখনোই ভাল হয়না, বরং বিপর্যয় ডেকে আনে। এজন্যই শয়তান ও তার অনুসারীরা চায়, মুসলিমগণ বাঁচুক হারাম রাজনীতি নিয়ে। মুসলিম বিশ্ব আজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত, শক্তিহীন ও পরাধীন। এসবের কারণ তো এই হারাম তথা নিষিদ্ধ রাজনীতি। সে হারাম রাজনীতির পথ ধরেই আরবগণ ২২ টুকরোয় বিভক্ত। তারা নিজেরাই খেলাফত ভেঙ্গে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ, ফরাসী ও অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তির জন্য ফিলিস্তিনে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার রাস্তা খুলে দিয়েছে। আরবগণ ২২ টুকরোয় বিভক্তির হওয়াতে গাজার বন্দী মজলুমদের পাশে দাঁড়ানোর মত কোন শক্তিশালী আরব রাষ্ট্র নাই। এই হলো বিভক্তির নাশকতা। সে ভয়াবহ নাশকতা থেকে বাঁচাতেই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা বিভক্তিকে হারাম করেছেন এবং একতাকে ফরজ করেছেন। কিন্তু মুসলিমগণ বিদ্রোহ করেছে এবং বেছে নিয়েছে বিভক্তির হারাম পথ। সে হারাম পথে অখণ্ড আরব ভূমি ভেঙ্গে ২২টি আরব রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের।
মুসলিম উম্মাহর শক্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা যাদের কাছে গুরুত্ব পায় -তারা কি কখনো মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এরূপ নাশকতার কথা ভাবতে পারে? নিজের ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে তাদের কাছে অধিক গুরুত্ব পায় মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ। উম্মাহর স্বার্থ ও নিরাপত্তা নিয়ে এমন ভাবনার মাঝেই তো মুমিনের ঈমানদারী। একাত্তরের বাঙালি ঈসলাপন্থীগণ জানতেন, পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে নামলে সেটি হবে শয়তানের এজেণ্ডাকে বিজয়ী করার যুদ্ধ। এবং যারা শয়তানের এজেণ্ডাকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করে, তারা কি কখনো জান্নাত আশা করতে পারে? সেটি তো জাহান্নামের পথ। সেটি বুঝতেন বলেই তারা বিহারী ও পাক সেনাদের হাতে আপন জন হারানোর বেদনা নীরবে সহ্য করেছেন, ছবর করেছেন এবং অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছেন। কিন্তু যারা ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও বামপন্থী, সেরূপ কল্যাণকর ভাবনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। তাদের কাছে গুরুত্বপায় নিজ স্বার্থ, নিজ দল ও নিজ গোত্রের স্বার্থ। স্বার্থ উদ্ধারের সে লক্ষ্য নিয়ে তারা এমনকি পৌত্তলিক কাফিরদের কোলে গিয়ে উঠতেও রাজী। ক্ষমতালোভী মুজিব তাই ভারতের সাথে আঁতাত করেছে এবং একাত্তরে ভারতের হাতে বিজয় তুলে দিয়েছে।
উম্মাহর বিভক্তি যেহেতু হারাম, খেলাফত ভেঙ্গে ২২টি আরব রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে হারাম পথে। একই ভাবে পাকিস্তান ভেঙ্গে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। মুসলিম নামধারী বাঙালি ফ্যাসিস্টগণ ভারতীয় পৌত্তলিক কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাশকতা ঘটিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙ্গতে। বাঙালি মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে এটিই হলো সব চেয়ে বড় অপরাধ। বাংলাদেশে হয়তো অনেক কিছুই লেখা হবে; এবং অনেক কিছুই নির্মিত হবে। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলিমের ১৯৭১’য়ের অপরাধ নিয়ে হাজার বছর পরও বিশ্বের কোনে কোনে বিচার বসবে। সেদিন বাঙালি মুসলিমদের বিচারের কাটগড়ায় উঠানো হবে। তখন ঘৃণার ধিক্কার ধ্বনিত হবে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে নাশকতার নায়ক একাত্তরের বাঙালি মীর জাফরদের বিরুদ্ধে। সেদিন ধিক্কার কুড়াবে শেখ মুজিব,জেনারেল জিয়া, তাজুদ্দীন ও জেনারেল ওসমানীর ন্যায় নাশকতার নায়কগণ। মুসলিম উম্মাহর সে আদালতের বিচারক রূপে জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, হিন্দুত্ববাদী সেক্যুলারিস্ট ও বামধারার নাস্তিকদের কোন স্থান থাকবে না। সে আদালতের বিচারক হবেন ঈমানদারগণ। তাদের রায়ে একাত্তরের এই ভারতসেবীরা যে ঘৃণ্য অপরাধী রূপে গণ্য হবে -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে? তবে এই অপরাধীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ানক রায়টি অপেক্ষা করছে রোজহাশরের বিচার দিনে।
মুজিবের অপরাধনামা
বাঙালে মুসলিমের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধী হলো ফ্যাসিস্ট মুজিব। মীর জাফরের পর বাংলার ইতিহাসে এতো বড় অপরাধী আর কখনোই জন্ম নেয়নি। শেখ মুজিব এক দিকে যেমন ছিল গণতন্ত্রের শত্রু, ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী, ক্ষমতালোভী ও ভারতের সেবাদাস, অপর দিকে ছিল আদ্যপান্ত মিথ্যুক। মুজিবের কাছে পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানসৃষ্ট একটি শ্মশান। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ মুজিব “পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন” এ প্রশ্ন রেখে লক্ষ লক্ষ পোস্টার ছেপে সারা দেশের হাটে বাজারে ও রাস্তাঘাটে এঁটে দিয়েছিল। এ পোস্টার ছিল মিথ্যাপূর্ণ। উক্ত পোস্টারে দাবী করা হয় চাউল, আটা, চিনি, ডাল, তেল, কাগজ ইত্যাদি সকল প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য পশ্চিম পাকিস্তানের তূলনায় পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিগুণ। দাবী করা হয়, মূল্যের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য নাকি পাকিস্তানের সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পিত। অথচ এটি ছিল ডাহা মিথ্যা।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়, পাকিস্তানের হলো পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী। এদাবীর সম্পূর্ণ অসার ও ভিত্তিহীন। কলোনীর বাসিন্দারা কখনোই প্রভু দেশের শাসন ক্ষমতায় বসার সুযোগ পায়না, সব সময় গোলামই থাকতে হয়। বাংলার শিশুরাই সেটি বুঝে। বাংলা ১৯০ বছর ব্রিটিশের কলোনী ছিল। একজন বাঙালিও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ দূরে থাক, কোন ক্ষুদ্র মন্ত্রীও হতে পারিনি। অথচ পূর্ব পাকিস্তান কলোনী হলে পাকিস্তানের দুইজন রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছে বাঙালি হলো কি করে? তারা হলেন ঢাকার খাজা নাজিমুদ্দীন এবং মুর্শিবাদের জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। তিনজন প্রধানমন্ত্রী হলেন কিরূপ? তারা হলেন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিুদ্দীন, বগুড়ার মহম্মদ আলী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জাতীয় পরিষদ তথা পার্লামেন্টের স্পীকার হয়েছেন মৌলভী তমিজউদ্দীন খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আব্দুল জব্বার খান। পররাষ্ট্র মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদেও অনেক পূর্ব পাকিস্তানী বসেছেন। লক্ষ্যণীয় হলো, এ ইতিহাস বাংলাদেশের পাঠ্য বইয়ে পড়ানো হয়। বরং পূর্ব পাকিস্তানকে পেশ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী রূপে। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোন কালে বাঙালিগণ কখনোই নিজ শাসন করার সুযোগ পায়নি। শাসন করেছে অববাঙালি সুলতান ও মোঘলেরা।
আওয়ামী লীগ শোষণের যে বয়ান খাড়া করে সেটিও মিথ্যাপূর্ণ। লর্ড মাউন্টব্যাটনের ভাষায় পূর্ববাংলা ছিল rural slum তথা গ্রামীন বস্তি। অধিকাংশ মানুষ ছিল ভূমিহীন বর্গাদার কৃষক। অধিকাংশ মানুষের ছিল না রাজস্ব দেয়ার সামর্থ্য। জমিদার, স্বচ্ছল ব্যবসায়ী ও চাকুরিজীবী রূপে যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। ১৯৪৭’য়ের পর তাদের বেশীর ভাগই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থা সেরূপ ছিল না। সেখানে অধিকাংশ জমিদার ছিল মুসলিম। বহু শিল্পপতি, ভূস্বামী, বড় বড় চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ী ছিল মুসলিম। দাউদ, বাওয়ানী, সায়গল, হাবিব, আদমজীর মত বড় বড় ব্যবসায়ী ভারত ও বার্মা থেকে হিজরত করে পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায় পাকিস্তানের রাজস্বের মাত্র শতকরা ২৬ আদায় হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে, বাকি শতকরা ৭৪ ভাগ আদায় হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। অথচ উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ভাগ বরাদ্দ দেয়া হতো পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু সে তথ্যটি আওয়ামী লীগ নেতারা কখনোই মুখে আনেনি।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পাট উৎপাদিত হতো পূর্ব বাংলায়; কিন্তু ১৯৪৭’য়ে যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায় তখন এ প্রদেশে একটি পাটকলও ছিলনা। অথচ পাকিস্তানের ২৩ বছরে ৬০টির বেশী পাটকল প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্ত্রকল ছিল মাত্র ৪টি; ২৩ বছরে ৬০টি বেশী বস্ত্রকল প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলায় সমুদ্রগামী জাহাজ নঙ্গর করার মত কোন সমুদ্রবন্দর ছিলনা। পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয় চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দর। দেশে কোন বিমান বন্দরও ছিলনা। ঢাকায় নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। দেশে কোন সংসদ ভবনও ছিলন না, অথচ পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত, বিশালতম ও সুন্দরতম সংসদ ভবন।
১৯৪৭ সালে ঢাকায় ছিল ক্ষুদ্র আকারের একটি বিশ্ববিদ্যায় -যা কার্জন হলে সীমিত ছিল। পাকিস্তান আমলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন বিশাল করা হয়, এবং নির্মিত হয় অনেকগুলি আবাসিক হল। সে সাথে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সাভাবের নির্মিত হয় বিশাল আকারের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয় বহু আবাসিক হল। বৃহৎ আকারে নির্মিত হয় ইঞ্জিনীয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়। অথচ একাত্তরের পর প্রায় ৫০ বছরে সে মাপের বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে একটিও নির্মিত হয়নি। পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়েছিল ৭টি বড় আকারে মেডিক্যাল কলেজ ও কলেজ সংলগ্ন বড় বড় হাসপাতাল। নির্মিত হয়েছিল অনেকগুলি ক্যাডেল কলেজ ও মডেল স্কুল। ঢাকায় কোন ভাল রেল স্টেশনও ছিল না। কমলাপুরে নির্মিত হয়েছে বিশাল রেল স্টেশন। পাকিস্তানে ২৩ বছরে পূর্ব বাংলায় যেরূপ উন্নয়ন কাজ হয়েছে তা বাংলার সমগ্র ইতিহাসে আর কোন কালেই হয়নি।
জিয়ার অপরাধনামা
মুজিবের ন্যায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের অপরাধের তালিকাটিও বিশাল। জিয়ার সবচেয়ে অপরাধটি হলো, ১৯৭১’য়ে সেই সর্বপ্রথম পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। সেট ছিল শরীয়তবিরোধী একটি হারাম ঘোষণা। মুসলিম দেশ ভাঙ্গা সব সময়ই হারাম, সেটি হারাম ছিল একাত্তরেও। শরীয়তের আইনে এরূপ ঘোষণার শাস্তি গুরুতর। এমনকি শেখ মুজিবও এরূপ হারাম ঘোষণা দিতে সাহস করেনি। অথচ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য রূপে মেজর জিয়া অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করার জন্য কুর’আনের কসম খেয়েছিলেন। জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল সে কসমের সাথে বেঈমানী। এরূপ কসম ভাঙ্গা ইলামে কবিরা গুনাহ যা জাহান্নামে নেয়।
জেনারেল জিয়ার দ্বিতীয় অপরাধ, জাতীয়তাবাদী পরিচয় নিয়ে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’য়ের গঠন। বর্ণবাদ ও গোত্রবাদের ন্যায় জাতীয়তাবাদও ইসলামে হারাম। ইসলামী পরিভাষায় এটি আসাবিয়াত -যা শরিয়তে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি যেমন মূর্তিপূজারী হতে পারেনা, তেমনি বর্ণবাদী, গোত্রবাদী ও জাতীয়তাবাদীও হতে পারে না। এ হারাম রাজনীতির লড়াইটি মূলত মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে লড়াই। সকল মানব সন্তানের জন্ম হযরত আদম ও বিবি হাওয়া থেকে; বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের মাঝে বিভক্তি গড়া মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আদৌ কাম্য নয়। তিনি চান, মুসলিমদের মাঝে ভাতৃত্বের বন্ধন। অথচ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির লক্ষ্য, ইসলামের প্যান-ইসলামী চেতনার বিনাশ এবং নানা ভাষা ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াইকে ব্যর্থ করা। এ রাজনীতি সব সময়ই ফেতনা, ফ্যাসাদ ও বিভক্তির জন্ম দেয়। এবং ভিন্ন ভাষী ও ভিন্ন এলাকার মানুষদের ঘৃণা করতে শেখায়। মুসলিম উম্মাহ আজ যেরূপ ৫০টির বেশী টুকরোয় বিভক্ত -তার মূল কারণ তো এই জাতীয়তাবাদী ও গোত্রবাদী রাজনীতি। এ রাজনীতির নাশকতা যেহেতু গুরুতর, ফলে শরিয়তী আইনে এটি কঠোর শাস্তি যোগ্য অপরাধ। মুজিব ও জিয়া উভয়ই এ হারা ও সংক্রামক রাজনীতির প্রচারক। তারা উভয়ই তাই গুরুতর অপরাধী। এবং সে অপরাধে অপরাধী করেছে দেশের কোটি কোটি মানুষকেও।
জেনারেল জিয়ার তৃতীয় অপরাধটি গুরুতর যুদ্ধ অপরাধের। মেজর জিয়া হত্যা করে চট্টগ্রাম সেনানীবাসে তার উর্দ্ধতন কমাণ্ডিং অফিসার নিরস্ত্র কর্নেল জানজুয়াকে। কোন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে -সে যে বাহিনীরই হোক, তাকে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধাপরাধের সে শাস্তি থেকে জিয়া এ দুনিয়ায় বাঁচলেও আখেরাতে কি বাঁচবে? জেনারেল জিয়ার চতুর্থ অপরাধ, একাত্তরে সে ভারতের কোলে গিয়ে উঠেছিল এবং ভারতের আশ্রয়, পানাহার ও অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গতে যুদ্ধ করেছিল। কোন ঈমানদার কি কখনো কোন কাফিরের গৃহে আশ্রয় নেয়? বন্ধুত্ব করে কি কাফিরদের সাথে? যুদ্ধ করে কি কোন কাফির শক্তির পার্শ্বচর রূপে কোন মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে? পবিত্র কুর’আনে তো সেটি হারাম। কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর আয়াতে। নির্দেশ এসেছে:
لَّا يَتَّخِذِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْكَـٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ ٱللَّهِ فِى شَىْءٍ إِلَّآ
অর্থ: “মুমিনগণ যেন মুমিনদের ছাড়া কখনো কাফিরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ না করে; যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নাই।”
মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এটি এক গুরুতর হুশিয়ারি। উপরিউক্ত আয়াতের মূল কথা: একই সাথে বন্ধুত্ব কখনোই কাফিরদের সাথে ও মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে করা যায়না। যারা কাফিরদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করবে, তারা কখনোই বন্ধু রূপে পাবে না আল্লাহ তায়ালাকে। তাই মুজিব ও জিয়া এবং তাদের অনুসারীরা একাত্তরে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় কাফিরদের কোলে গিয়ে উঠার মধ্য দিয়ে তারা ছিন্ন করেছিল মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক। এবং যাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয় আল্লাহতায়ালার সাথে তারা কি কখনোই মুসলিম হতে পারে? কোন মুসলিম কি এমন ব্যক্তিদের নেতা রূপে গ্রহণ করতে পারে? তারা তো ভারতীয় কাফিরদের লোক। তারা যদি মুসলিম রূপে দাবী করে তবে বুঝতে হবে তারা মুনাফিক।
জেনারেল জিয়ার পঞ্চম অপরাধটি ছিল মজলুল অবাঙালিদের বিরুদ্ধে। ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে জান বাঁচাতে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েই যেন বিহারীরা ভয়ানক ভূল করেছিল। যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল – সেরূপ বিপদে তাদের পড়তে হয়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পর বাঙালি দুর্বৃত্তরা বিহারীদের ঘরবাড়ী ও দোকান-পাট কেড়ে নিয়ে বস্তিতে পাঠানো হয়েছিল। আর জিয়া এ গুরুতর অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সে দুর্বৃত্তদের হাতে সেসব দখলকৃত ঘরবাড়ী ও দোকান পাঠের মালিকানার দলিল তুলেদিয়েছিল। অপরাধ সবসময়ই অপরাধ। কিন্তু বিহারীদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধকে জিয়া বৈধতা দিয়েছিলেন। গৃহহারা বিহারীদের বস্তিতেই রাখা হলো। তাদের নিদারুন দুঃখকষ্ট জিয়ার বিবেককে স্পর্শ করেনি।
জিয়ার পঞ্চম অপরাধটি হলো, তিনি ব্যর্থ করে দিয়েছেন ১৯৭৫ সালের বিপ্লবের মূল স্পীরিটকে। বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বহুমুখী নাশকতা ছিল। সেটি যেমন ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ, গণহত্যা, গণতন্ত্র হত্যা ও সীমাহীন দুর্বৃত্তি, তেমনি চুরিডাকাতি ও লুটতরাজ। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ ডাকাতিতে নেমেছিল যেমন বিহারীদের ঘরবাড়ী ও সম্পদের উপর, তেমনি মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নিজামে ইসলামীর ন্যায় পাকিস্তানপন্থী দলগুলির নেতাকর্মীদের দোকানপাট, গৃহ ও কলকারখানার উপর। চুরিডাকাতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ রাতারাতি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, মহম্মদপুর, মীরপুরসহ সমগ্র বাংলাদেশে বড় বড় বাড়ী, দোকানপাট ও কলকারখানার মালিক হয়ে যায়। তারা শুরু করে বাঙালি পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিরামহীন যুদ্ধ। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের সবার জন্য রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা হয়; নেতাদের কারাবন্দী করা হয়। বহু নেতাকর্মীকে নির্মম ভাবে হত্যাও করা হয়। নিজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা জনাব এ্যাডভোকেট ফরিদ আহমেদকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের মধ্যে হত্যা করা হয় জনাব ফজলুল কাদির চৌধুরীকে। ১৯৭৫’য়ের আগস্ট বিপ্লবের পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের এসব অপরাধের তদন্ত ও তদন্ত শেষে বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোন তদন্ত করেননি এবং কাউকে বিচারের সামনে খাড়া করেননি। এগুলি হলো জিয়ার গুরুতর অপরাধ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিপ্লব এবং ফ্যাসিস্ট মুজিবের হত্যা ছিল বাঙালি মুসলিমদের জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রথম স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৪৭’য়ের ১৪ আগস্ট। মুজিবী শাসনের অবসান সুযোগ এনে দেয় আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তি ও দুঃশাসন থেকে দেশকে বাঁচানোর। সুযোগ আসে ভারতের অধিকৃতি থেকে বাঁচার। সুযোগ আসে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কবর দেয়ার। কিন্তু জেনারেল জিয়ার কাছে ১৯৭৫’য়ে অর্জিত স্বাধীনতা গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পায়নি আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কবর দেয়াটিও। বরং যারা সে স্বাধীনতা আনলো, সে সাহসী বীর সৈনিকদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। বিপ্লবের সে ফসলকে জিয়া নিজ হাতে তুলে নিল। অবশেষে জিয়ার দল বিএনপিই পুনর্জীবিত করে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে। অথচ যে দল একবার ফ্যাসিবাদের পথ বেছে নেয় সে দল আর কখনোই কোন সভ্য দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বৈধতা পায় না। তাই জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে কবরে পাঠালো, মৌলিক মানবাধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিল, হত্যা করলো হাজার হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে -সে আওয়ামী লীগ বৈধতা পায় কি করে? সে সাপ একবার ছোবল দিয়ে মানব হত্যা করেছে সে সাপকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায়? গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে তো গণতন্ত্রের শত্রুদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হয়। অথচ জেনারেল জিয়া সেটি করেননি; বরং যে আওয়ামী লীগকে শেখ মুজিব কবরে পাঠিয়েছিল তাকে আবার জীবিত করেন। বহু আওয়ামী দুর্বৃত্তদের নিজ দলে স্থান দিলেন।
জিয়া ও তার অনুসারীদের কাছে গর্বের কারণ ১৯৭৫’য়ের দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়; কারণ সে স্বাধীনতার লড়াইয়ে জিয়ার কোন ভূমিকা ছিলনা। জিয়ার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয় একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের হারাম ঘোষণা। এমন কি জিয়ার কাছে গুরুত্ব পায়নি খালিদ মোশাররফের বিরুদ্ধে সেপাহী-জনতার বিদ্রোহ। সেপাহী-জনতা খালেদ মোশাররফকে ভারতের চর রূপে সনাক্ত করেছিল, তাই তারা মেনে নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু ভারতে খুশি করতে জনগণের এ ভারত বিরোধী চেতনাকে জিয়া গুরুত্ব দেননি।
হাসিনার অপরাধনামা
বাংলার সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধী শাসক হলো শেখ হাসিনা। অপরাধ কর্মে সে তার পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার দীর্ঘ শাসনকালটি নানা রূপ নৃশংস অপরাধ কর্মে পরিপূর্ণ। চোর-ডাকাতগণ শুধু অর্থের উপর ডাকাতি করে। কিন্তু হাসিনা শুধু অর্থের উপর ডাকাতি করেনি, ডাকাতি করেছে জনগণের মৌলিক অধিকারের উপরও। এমন কি বেঁচে থাকার অধিকারের উপরও। সে ১৬ বছর শাসন করেছে গুম, খুন, হত্যা, বৈচারিক হত্যা ও গণহত্যার ন্যায় অপরাধকে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নৃশংস ফ্যাসিবাদের। হাসিনার অধিকৃত আদালত ও তার মেরুদণ্ডহীন বিচারকগণ বিরোধী দলীয় নেতাদের সাঁজানো মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে।
হাসিনা তার নিজের গদির নিরাপত্তা দেয়ার লক্ষ্যে RAB, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবীর ন্যায় জনগণের রাজস্বে প্রতিপালিত সশস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলিকে সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত করেছিল। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন ও নির্যাতন শেষে হত্যার জন্য সেনানীবাসগুলির অভ্যন্তরে গড়েছিল অসংখ্য আয়নাঘর। এমন কি হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়েছে ছাত্রদের মিছিলে। হাসিনা গণহত্যা চালিয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে। গণহত্যা চালিয়েছিল পিলখানায়। গণহত্যা চালিয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব কালে। প্রায় দেড় হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা এবং ২২ হাজারকে আহত করা হয়।
হাসিনা ও তার দুর্বৃত্তদের হাতে লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ বের করার লক্ষ্যে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। তিন মাসের অনুসন্ধান শেষে সে কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পেশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসিনার শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অন্য এক রিপোর্টে বলা হয়, হাসিনার ১৬ বছরে শাসনে ১২ লক্ষ কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে।
শাসকেরাই দেশের ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের গুণেই দেশ সামনে এগুয় বা পিছিয়ে পড়ে। উন্নয়নের অর্থ শুধু রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ ও কল-কারখানা নির্মাণ নয়। বরং পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, পরিশুদ্ধ পরিবার ও পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণ। শুরুতে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব নবীজী (সা:)। নবীজী (সা:)’র পর নেতৃত্ব দিয়েছে খোলাফায়ে রাশেদা। ফলে তারা নির্মাণ করতে পেরেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। অথচ বাংলাদেশে ইতিহাস গড়েছে পিছিয়ে পড়ায়। কারণ নেতৃত্বে ছিল অপরাধী শাসকগণ। রাষ্ট্রের গাড়িকে তারা ধাবিত করছে পতনের দিকে। সে পথ বেয়েই বাংলাদেশ ৫ বার দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হয়েছে। বাড়িয়েছে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বিজয় এনেছে শয়তানের। এদেশে পরাজয়টি মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার। এ পথে চলায় দেশটির জন্মের প্রথম দিন থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও হাসিনার ন্যায় অপরাধী শাসকগণ। বাঙালি মুসলিম ইতিহাসে তাদের নাশকতার অংকটি তাই বিশাল। ২৪/০৪/২০২৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাংলাদেশে অপরাধীদের শাসন ও নাশকতা
- বেঈমানদের উপর সংস্কারের দায়ভার?
- বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট ও সেক্যুলারিস্টদের অপরাধনামা
- বাঙালি মুসলিমের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম এবং সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ
- বাংলাদেশে হারাম রাজনীতির বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের আত্মঘাতী নাশকতা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- April 2025
- March 2025
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018