বাংলাদেশে ভারতীয় স্ট্রাটেজী ও বাঙালি মুসলিম জীবনে চ্যালেঞ্জ
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on December 1, 2023
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
বাংলাদেশে ভারতীয় যুদ্ধ
বাংলাদেশের ভূমিতে এখন দ্বিমুখী যুদ্ধের উত্তাপ। সেটি যেমন ইসলামের বিরুদ্ধে; তেমনি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। উভয় যুদ্ধই পরিচালিত হচ্ছে সরাসরি ভারত ও ভারতসেবী আওয়ামী বাকশালীদের পক্ষ থেকে। সে যুদ্ধটি যেমন রাজনীতির অঙ্গণে, তেমনি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। ভারতীয় এ যুদ্ধের মূল লক্ষ্য, বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণকে অসম্ভব করা। এ যুদ্ধের পিছনে কাজ করছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রচণ্ড ইসলামভীতি, মুসলিমভীতি ও গণতন্ত্রভীতি। তারা জানে, গণতন্ত্র বাঙালি মুসলিমের নিশ্চিত ক্ষমতায়ন ঘটাবে, যেমনটি ঘটিয়েছিল ১৯৪৭-পূর্বকালে। গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছিল বলেই বাংলার দরিদ্র মুসলিম কৃষক পরিবারের সন্তানগণ শক্তিশালী হিন্দু প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে পেরেছিল। ফলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় -ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবধি, ভারতের যে কোন প্রদেশের মুসলিমদের তূলনায় অধিক ভূমিকা রেখেছিল বাঙালি মুসলিমগণ। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ অবধি এই ১১ বছরে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীন -এই তিনজন বাঙালি মুসলিম হিন্দুপ্রধান কলকাতায় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী রূপে ক্ষমতায় বসেন। লক্ষণীয় হলো, শিক্ষা, সাহিত্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও কোন হিন্দু অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদে বসার সুযোগ পায়নি। বাংলার শাসনক্ষমতায় মুসলিদের এরূপ অবস্থান হিন্দুদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বাংলার ইংরেজ গভর্নরের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, বাঙালি মুসলিমগণ নিম্মজাতের। উচ্চজাতের হিন্দুগণ মুসলিম শাসন মেনে নিতে পারে না। মনের খেদে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলেছিলেন, “ভারত যদি ভাগ নাও হয়, বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে।” অর্থাৎ মুসলিম-প্রধান পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দু-প্রধান পশ্চিম বাংলাকে পৃথক করতেই হবে। এই হলো বাঙালি হিন্দুর মনে মুসলিমভীতি। এবং সে ভয় এখনো বিলুপ্ত হয়েছে?
একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে; কিন্তু ইসলাম এখনো বেঁচে আছে। ফলে ইসলাম আবারো বাঙালি মুসলিমদের হৃদয়ে আবারো ঈমানের জোয়ার আনতে পারে। বানের পানিতে ফসল বার আর ভেসে যায়, কিন্তু তাতে কৃষক চাষাবাদ ছেড়ে দেয়না। নতুন স্বপ্ন ও নতুন আশা নিয়ে সে আবারো চাষাবাদে নামে। মুসলিম জীবনে এরূপ বিপর্যয় বার বার আসে। বার বার ঈমানেও জোয়ার আসে। পাকিস্তান নিয়ে বাংলার মুসলিমগণ বিশাল স্বপ্ন দেখেছিল, সে স্বপ্ন নিয়েই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারাই প্রথম কাতারে ছিল। জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের ষড়যন্ত্রে সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য মারা যায়নি। সে স্বপ্ন নিয়ে ১৮ কোটি বাংলাদেশকে ঘিরে আবারো নির্মিত হতে পারে একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র। মুসলিম জীবনে সেটিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম। মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হয় ও মুসলিমগণ নিরাপত্তা পায় তো -একমাত্র সে পথেই। সে বিজয় এবং নিরাপত্তা লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে অর্জিত হয় না। জনসংখ্য ১০ গুণ বাড়লেও হয় না। ইসলামী রাষ্ট্রের বিকল্প একমাত্র ইসালামী রাষ্ট্রই। আজ ইসলামী রাষ্ট্র নাই; ফলে ইসলামের সে বিজয় নাই, মুসলিমদের জান, মাল ও ইজ্জতের সে নিরাপত্তাও নাই।
ইসলামী রাষ্ট্রের শুধু সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলই থাকে না, থাকে প্রবল আদর্শিক বলও। ভারতের ভয় এখানেই। মুসলিমের সে আদর্শিক বলটি ছিনিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই বাংলার মুসলিমদের উপর চাপানো হয় ধর্মনিরেপেক্ষবাদ। শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় বসিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাই বাঙালি মুসলিমদের ধর্মনিরেপেক্ষবাদের বটিকা সেবন করায়। ইসলামের উত্থান রোধে এটি এক মোক্ষম অস্ত্র। সেটিকে সংবিধানে ঢুকানোর ফলে ইসলামের পক্ষ নেয়াটি বাংলাদেশের আইনে সংবিধানবিরোধী অপরাধ গণ্য হয়। “আল্লাহতায়ালা সার্বভৌম ক্ষমতার ধিকারী -এ কথাটি বললে এবং আদালতে শরিয়তী আইনের বিচার চাইলে দেশের উচ্চ আদালতে দলের স্বীকৃতি হারাতে হয়। এবং নির্বাচনী কমিশনারের কাছে দলের নিবন্ধন হারাতে হয়। এই হলো বাংলাদেশে ঈমানদার হওয়ার শাস্তি। একাত্তরের পর এভাবেই রা বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
মুসলিমদের সে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপের কথা কি পাকিস্তানে ভাবা যেত? পাকিস্তান ছিল ইসলামিক রিপাবলিক। ইসলামের পক্ষে অবস্থান নেয়াই সে দেশে সরকারী নীতি। তাছাড়া মুসলিম হওযার অর্থ তো ইসলামের পক্ষে যুদ্ধ নিয়ে বাঁচা, নিরপেক্ষতা আদৌ কোন ঈমানদারী নয়। সেটি হারাম। এমন নিরপেক্ষতায় বিজয়ী হয় শয়তানের এজেন্ডা। অথচ বাংলাদেশে ইসলামের পক্ষ নেয়াটি অপরাধ গণ্য হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এভাবেই বাংলাদেশে হরণ করা হয় ধর্মীয় স্বাধীনতা। এখানেই ধরা পড়ে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের দখলদারী। ইসলামের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধটি এখানেই। বাংলাদেশে ইসলামের উত্থান রুখতে ভারতীয় এজেন্ডা যে কত প্রবল -সেটি এখান থেকেই ধরা পড়ে। মুজিব ও তার দল পরিণত হয় সে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে। মুজিবের সে লিগ্যাসি ধরা পড়ে হাসিনার রাজনীতিতেও।
কথা হলো, শরিয়ত পালন না করলে কি ইসলাম পালন হয়? কিন্তু ভারত ও মুজিবের ন্যায় ভারতসেবী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পূর্ণ ইসলাম পালনই অসম্ভব করে। চাপিয়ে দেয় হারাম রাজনীতি। এটি ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে মুজিবের ষোষিত যুদ্ধ। শেখ মুজিব মানব হত্যা, গণতন্ত্র হত্যা, ভারতের স্বার্থপূরণ, দুর্বৃত্ত প্রতিপালন, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির ন্যায় বহু গুরুতর অপরাধের নায়ক, কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধই হলো মুজিবের সবচেয়ে বড় অপরাধ। মুজিবের সে অপরাধমূলক নীতি আজও বেঁচে আছে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের এ রাজনীতিতে একজন হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, কম্যুনিস্ট ও নাস্তিক মনের আনন্দে অংশ নিতে পারে, কিন্তু যার মনে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে সেও কি এ রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে? অংশ নিলে সে কি মুসলিম থাকে? কারণ এ রাজনীতিতে অংশ নেয়ার অর্থ তো ইসলাম ও সত্যিকার ঈমনদারদের নির্মূলে যুদ্ধে নামা। শেখ হাসিনা সে যুদ্ধে আছে বলেই ইসলামপন্থী নেতাদের ফাঁসিতে চড়ায়, হিফাজতে ইসলামের উপর গণহত্যা চালায় এবং শত শত আলেমদের কারাবন্দী করে।
মুসলিমদের আদর্শিক বলটি কেড়ে নিলে কি প্রতিরোধের সামর্থ্য থাকে? তখন তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় ইসলাম থেকে এবং বাঁচে নামে-মাত্র মুসলিম রূপে। এভাবেই শেখ মুজিব ভারতের এজেন্ডা পূরণে বাঙালি মুসলিমদের শক্তিহীন করেছে। মুজিব সেটি করেছে রাজনীতির অঙ্গণ, শিক্ষাঙ্গণ ও মিডিয়া থেকে ইসলামকে বিদায় দিয়ে। অথচ আদর্শিক বলটিই তো মুমিনের ঈমান। সে প্রবল আদর্শিক বলের কারণেই আফগান মুসলিমগণ ব্রিটিশ, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় তিনটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করতে পেরেছে। একই কারণে ইসরাইল নির্মূল করতে পারছে না হামাসকে। ব্রিটিশ, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পৌত্তলিক ভারত শক্তিশালী নয়। মুসলিমদের বিরুদ্ধে পৌত্তলিক ভারতের একমাত্র বিজয়টি ছিল ১৯৭১’য়ে; এবং সেটি পৌত্তলিকদের পক্ষে বাঙালি মুসলিমের অস্ত্র ধরার কারণে।
লক্ষণীয় হলো, বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা রোধে ভারত কই’য়ের তেলে কই ভাজার নীতি গ্রহণ করেছে। এটিই হলো ভারতের একাত্তরের নীতি। ফলে বাংলাদেশে আজ যারা ভারতের পক্ষে যুদ্ধ লড়ছে -তারা কেউ ভারতীয় নাগরিক নয়; তারা বাংলাদেশী। এরা হলো ইসলাম থেকে বহু দূরে সরা সেক্যুলারিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট। ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো এদের কাছে গুরুতর অপরাধ। এমনকি ভারতের নিহত, ধর্ষিতা ও নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে কথা বলাটিও অপরাধ। তাদের কাছে প্রগতিশীলতা হলো এসব বিষয়ে নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয়া থাকা। নিরস্ত্র মুসল্লীদের বিরুদ্ধে শাপল চত্বরে যারা গণহত্যা ঘটালো, ইসলামপন্থী নেতাদের যারা ফাঁসিতে চড়ালো, যাদের হাতে শত শত আলেম আজও কারাবন্দী, যারা পবিত্র কুর’আনের তাফসির ও জিহাদের বই নিষিদ্ধ করে -এরা তো তারাই যারা একাত্তরে ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং ভারতকে বিজয়ী করেছিল। একাত্তরের ন্যায় ভারতের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাটি আজও অটুট এবং গভীর।
মুজিব-হাসিনার যুদ্ধ
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রতিহত করতে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো ভারত জরুরি মনে করে। কারণটি বোধগম্য। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বাঁচলে জনগণের ভোটেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা পাবে -যেমন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলন চলা কালে মুসলিম লীগের স্রোগান ছিল, পাকিস্তানের কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র বানানো। লক্ষ্য ছিল, ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিক চেতনার উর্দ্ধে নির্মিত হবে প্যান-ইসলামিক চেতনাভিত্তিক একটি ইসলামী জনকল্যাণ রাষ্ট্র। কিন্তু পাকিস্তানের ভিতরে ও বাইরে শত্রুর অভাব ছিল না। দেওবন্দী আলেমদের একটি বড় অংশ তো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই চায়নি। তারা যোগ দেয় কংগ্রসের শিবিরে। তাদের কাছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও আদালতে শরিয়ত পালনের চেয়ে অধিক গুরুত্ব পায় অখণ্ড ভারত নির্মাণের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা। পাকিস্তান সরকারের গভীরে ছিল ব্রিটিশদের হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উগ্র সেক্যুলার আমলা বাহিনী, সেনাবাহিনী, আদালত বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। ইসলামের প্রতি এসব সেক্যুলারিস্টদের কোন দরদ ছিলনা, তারা পরিচালিত হতো নিজ নিজ স্বার্থ হাছিলের নেশায়। রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে ছিল না যোগ্য ইসলামী নেতৃত্ব। ছিল না চেতনায় পুষ্টি জোগানোর মত সমৃদ্ধ ইসলামী সাহিত্য। জাতীয়তাবাদের প্রবল স্রোতে ভেসে যায় বাঙালি মুসলিমগণ। স্বার্থান্বেষী এ কুচক্রিমহলগুলি রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে লুটপাটের হাতিয়ার রূপে। ফলে বানচাল হয়ে যায় ইসলামীকরণের প্রচেষ্টা। মহান আল্লাহতায়ার এক বিশাল নিয়ামত এ ভাবেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
সভ্য ও বিজ্ঞ জনগণ কখনোই রাষ্ট্র ভাঙ্গে না, বরং সামর্থ্য থাকলে রাষ্ট্রের ভূগোল বাড়ায়। কারণ ভূগোল বাড়লে স্বাধীনতা এবং ইজ্জত বাড়ে। অপর দিকে ভূগোল ভাঙ্গলে পরাধীনতা ও অপমান বাড়ে। এজন্যই ইসলামে দেশভাঙ্গা হারাম। ফলে মুসলিমদের গৌরব যুগে অসংখ্য যুদ্ধে হয়েছে স্রেফ ভূগোল বাড়াতে, ভাঙ্গতে নয়। ভুগোল বাড়ানোর সে ধারাবাহিকতায় মুসলিমগণ বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে বিশ্বময় বেড়েছে তাদের প্রভাব ও সুনাম। অপর দিকে মুসলিমগণ ভূগোল ক্ষুদ্রতর করার ধারাবাহিকতায় এখন স্বাধীনতাহীন ও ইজ্জতহীন। ফলে মুসলিম ভূমি এখন বিশ্বের কোনে কোনে শত্রু শক্তির হাতে অধিকৃতি ও গণহত্যার শিকার। ফিলিস্তিন,কাশ্মীর, আরাকান, জিংজিয়াং (উইঘুর) এখন অধিকৃত জেলখানা। জেলখানা সে মুসলিম দেশগুলিও যেগুলি বাংলাদেশের মত অধিকৃত নৃশংস ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসকদের হাতে। সভ্য জনগণ সব সময়ই লড়াই করে শাসনক্ষমতা থেকে দুর্বৃত্তদের হটাতে। অথচ একাত্তরে বাঙালি মুসলিমগণ যুদ্ধ করেছে দেশ ভাঙ্গতে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কখনোই সংখ্যালঘিষ্ঠদের থেকে আলাদা হয়না, বরং দেশের সংহতি বাঁচাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু সেক্যুলারিস্ট বাঙালিদের দ্বারা ঘটেছে উল্টোটি। তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে সংখ্যালঘুদের থেকে। তাদের আরেক ইতিহাস, তারা রাজনীতি থেকে দুর্বৃত্তদের না সরিয়ে বরং মুজিবের ন্যায় বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধীকে বিজয়ী করেছে।
শেখ মুজিবের অপরাধের তালিকাটি বিশাল। মুজিব গণতন্ত্রের খুনি। আজীবন ক্ষমতায় থাকার নেশায় সে সকল বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করে এবং নিষিদ্ধ করে সকল বিরোধী পত্র-পত্রিকা। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার। তার যুদ্ধটি ছিল গণতন্ত্রকামী জনগণের বিরুদ্ধে। সশস্ত্র রক্ষিবাহিনী লেলিয়ে দিয়েছির বিরোধীদের নির্মূলে। মুজিব বাংলাদেশকে দিয়েছে ভয়াহ দুর্ভিক্ষ -যা কেড়ে নেয় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, আর ভারতকে দিয়েছে লুটপাটের লাগামহীন স্বাধীনতা। সে সুযোগ পেয়ে ভারত লুটে নেয় পাকিস্তান বাহিনীর ফেলে যাওয়া শত শত সামরিক যান, ট্যাংক, কামান, গোলাবারুদ, সামুদ্রিক জাহাজ -এমনকি আবাসিক গৃহের ফ্যান, ফ্রিজ, টিভি ও আসবাবপত্র। ভারতীয় পণ্যের জন্য মুক্ত করে দেয় দেশের বাজার। অথচ এ বাজার পেতে ব্রিটিশগণ এক কালে যুদ্ধ করেছে।
মুজিবের সে ফ্যাসিবাদকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবার ফিরিয়ে এনেছে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখানেই ভারতের বিশাল বিজয়। বিশার পরাজয় এখানে বাঙালি মুসলিমের। শেখ হাসিনা যদিও একদলীয় বাকশালী প্রথা পুণরায় ফিরিয়ে আনেনি, তবে গণতন্ত্রকেও বাঁচতে দেয়নি। কবরে পাঠিয়েছে জনগণের রায় দানের নিরপেক্ষ ভোটদান পদ্ধতিকে। ফলে ইজ্জত হারিয়েছে জনগণের ভোট। জনগণ হারিয়েছে স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এদেশে স্বাধীন ভাবে কথা বললে জেলে যেতে হয় বা গুম হতে হয়। হাসিনার শাসনেও নির্বাচন হয় -যেমন হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে। তবে সেটি জনগণের রায় নিতে নয়, বরং সেটি যেমন বিরোধী দলগুলিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এবং ব্যালট পেপার ডাকাতি করে সেগুলির উপর ইচ্ছামত সিল মারতে। সে ভোটডাকাতিতে ব্যবহার করা হয় দেশের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ভোটডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। সমগ্র মানব ইতিহাসে সেদিন বাংলার বুকে দুর্নীতির এক নতুন ইতিহাস নির্মিত হয়। ইতিহাসে সেটি চিরকাল বেঁচে থাকবে ক্ষমতাসীন দলের ভোটডাকাতির টেক্সট বুক কেস রূপে। সেদিন ভোটারগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটদানের সুযোগ পায়নি। ভোটকেন্দ্রে হাজির ভোটারদের বলা হয়, তাদের ভোট রাতেই দেয়া হয়ে গেছে। এ মাপের অপরাধ সাধারণ অপরাধীদের দ্বারা হয়না -কারণ তাদেরও কিছু লজ্জাশরম থাকে। সে কারণে সাধরণ চোরডাকাতেরা রাতের আঁধারে মুখ ঢেকে চুরি-ডাকাতি করে। কিন্তু চরম লজ্জাহীনতার প্রমাণ রেখেছে শেখ হাসিনা। ব্যালট পেপার ছিল পুলিশের হিফাজতে। নির্বাচনের আগের রাতেই পুলিশ বাহিনীর লোকেরা ব্যালট পেপারে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বক্স পূর্ণ করে। পরবর্তীতে ঐ রাতের ভোটডাকাতির দলিল পেশ করেছে নির্বাচনী কমিশন নিজেই। অথচ এই নির্বাচনী কমিশন নির্বাচনের পরের দিনই সুষ্ঠ নির্বাচনের সার্টিফিকেট দিয়েছিল। নির্বাচনের ৬ মাস পর নির্বাচনী কমিশন ভোটকেন্দ্র ভিত্তিক ভোটদানের একটি রিপোর্ট পেশ করে। সে রিপোর্ট অনুসারে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতকরা ১০০ ভাগ ভোটদান হয়। ১,২০৫টি ভোটকেন্দ্রে ভোটদানের হার ছিল ৯৬-৯৯%। এবং ৬,৪৮৪টি ভোটকেন্দ্রে ভোট দেয় ৯০-৯৫%। (সূত্র: সৈয়দ আবদাল আহমেদ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৮/০৭/২০২৩)। অপরাধী অপরাধ করে যায়। যত সাবধানতা অবলম্বনই করুক না কেন, অপরাধী কখনোই অপরাধ লুকাতে পারে না। অপরাধের স্পষ্ট সাক্ষী রেখে যায়। নির্বাচনী কমিশনের রিপোর্ট হলো সে রাতের ভোটডাকাতির দলিল।
এমন কি পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলিতেও ভোটদানের হার শতকার ৭০ ভাগের বেশী হয়না। বাংলাদেশেও সাবেক নির্বাচনগুলিতে সে হার ৭০% ভাগের উপরে যায়নি। ভোটার লিস্ট কখনোই প্রতিবছর তৈরী করা হয়না; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৪/৫ বছরের পুরনো। ফলে এমন বহু মানুষের নাম ভোটার লিস্টে থাকে যারা মৃত। অনেকে থাকে প্রবাসে। অনেকে আবার রোগ-ভোগে শয্যাগত -তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সামর্থ্য রাখেনা। কোন ভোটকেন্দ্রো শতকরা ১০০ ভাগ ভোটদানের অর্থ, তারাও ভোট দিয়েছে। এমন কান্ড তো ভোটডাকাতিতেই সম্ভব। কারণ ডাকাতেরা মৃত বা প্রবাসী ব্যক্তির ব্যালটেও সিল মারতে পারে। কোন সভ্য, ভদ্র ও বিবেকবান মানুষকি কখনো চুরি-ডাকাতির সমর্থন করে? চুরি-ডাকাতি করাই শুধু অপরাধ নয়, চুরি-ডাকাতিকে সমর্থন করাও তো গুরুতর অপরাধ। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামের যাবে চুরি-ডাকাতি, খুন, ধর্ষণের ন্যায় অপরাধ করার কারণে নয়, বরং অপরাধীদের পক্ষ নেয়াতে। ভারত যেমন মুজিবের বাকশালী ফ্যাসিবাদকে সমর্থন দিয়েছিল, এখনো সমর্থন দিচ্ছে ভোটডাকাত হাসিনার ভোটডাকাতি ও ফ্যাসিবাদকে। কারণ একটিই। ভারত চায়, ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে জনগণকে ক্ষমতাহীন করতে। এবং চায়, ক্ষমতার চাবিকাঠি থাকুক একান্ত ভারত-অনুগতদের হাতে।
গণতন্ত্রের বিনাশে ভারতীয় ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কি হবে -ভারত তা নিয়ে ভাবে না। বাংলাদেশী জনগণের স্বাধীনতা নিয়েও ভাবে না। ভারতের ভাবনা একটিই। সেটি হলো, বাংলাদেশ থেকে তার নিজের ভু-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। সে লক্ষ্য অর্জনেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাত্তরে ভারত যুদ্ধ করেছিল। ভারত চায়, বাংলাদেশে এমন এক সরকার -যারা সুরক্ষা দিবে ভারতীয় স্বার্থের। তবে ভারত শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদারী নিয়ে খুশি নয়। বরং চায়, বাংলাদশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত ঘিরে ভারতের যে ৭টি রাজ্য সেখানেও ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদারীতে বাংলাদেশ সর্বপ্রকার সহায়তা দিবে। বাংলাদেশের চেয়েও বৃহত্তর এ এলাকাটি হলো ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের জন্য একটি দুর্বল স্থান। কারণ, এ বিশাল এলাকায় হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ঠ; খৃষ্টানরা অধিক। ফলে ভারতের জন্য এটি আরেক কাশ্মীরে পরিণত হতে পারে। ভারত চায়, বাংলাদেশ সহযোগীতা করবে এ এলাকায় ভারতীয় স্বার্থের সংরক্ষণে। এবং নিশ্চয়তা চায়, বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীনতাকামীদের সহয়তা দিবে না। সে লক্ষ্যেই ভারত বাংলাদেশের বুক চিরে করিডোর নিয়েছে। চট্টগ্রামে বন্দর সুবিধাও নিয়েছে। এরূপ সুযোগ আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন সরকারই ভারতকে দেয়নি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অনুপ চেটিয়ার মতো স্বাধীনতাকামী নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এমনটি অন্য কোন সামরিক ও বেসমারিক সরকার করেনি। ফলে ভারতের সামনে আওয়ামী লীগের বিকল্প নাই। ভারত সেটি বুঝে। সেটি বুঝা যায় শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের অন্ধ সমর্থন দেখে।
আওয়ামী লীগ ভারতের অতি পরিক্ষিত বন্ধু -সেটি একাত্তরের বহু পূর্ব থেকেই । ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ায় ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। বিচারে তার মৃত্যুদন্ড হতে পারতো। এ ষড়যন্ত্র যে সত্যর ছিল -সেটি সে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা লে. কর্নেল শওকত আলী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন। বাংলাদেশের আর কোন রাজনৈতিক নেতা কি মুজিবের ন্যায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারতের চর রূপে কাজ করতে রাজী হয়েছে? এটি একমাত্র মুজিবের লিগ্যাসি। ভারত সেটি ভূলে যায় কি করে? আওয়ামী লীগের রাজনীতি বুঝতে হলে ভারতের সাথে মুজিবের এ সম্পর্ককে অবশ্যই বুঝতে হবে। সে বুঝে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ভারত তা সর্বসামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে। এটিই হলো বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতীয় নীতির অতি মৌলিক কথা।
ভারত জানে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা নাই। এখানেই ভারতের বড্ড সুবিধা। যে দলের বিপুল জনপ্রিয়তা থাকে, সে দলের রাজনীতিতে দেশপ্রেম ও শক্ত মেরুদন্ড থাকে। ফলে স্বাধীন বিদেশ নীতিও থাকে। অপর দিকে জনপ্রিয়তাহীন যে দলটি ভোটচুরি বা ভোটডাকাতি করে ক্ষমতায় আসে, সে দলকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে অতি বেশী পরনির্ভর হতে হয়। দেশে বন্ধু না থাকায় বিদেশে বন্ধু খুঁজতে হয়। আর বন্ধুত্ব কখনোই বিনা মূল্যে জুটেনা, বন্ধুর বহু জায়েজ-নাজায়েজ আবদারকেও পূরণ করতে হয়। অগণতান্ত্রিক সরকারগুলি এ কারণেই দেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতি ডেকে আনে। অনেক সময় পরাধীনতাও ডেকে আনে। বাংলাদেশের জন্য গুরুতর আশংকার কারণ এখানেই। তাই স্বাধীনতা বাঁচানোর প্রয়োজনে গণতন্ত্র বাঁচাতে হয়। এবং নির্মূল করতে অগণতান্ত্রিক সরকার। তখন সরকারের উপর জনগণের তদারকি বাড়ে। কিন্তু ভারত সেটি হতে দিতে রাজী নয়।
শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ভারত-নির্ভরতা অতি স্পষ্ট ভাবে দেখা গেছে ২০১৪‘য়র একদলীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ভোটডাকাতির পর। তখন বিদেশে ভোটডাকাত হাসিনার গ্রহণযোগ্যতার বাড়াতে ভারতীয় দূতাবাসগুলি প্রচুর কাজ করেছে। পাশ্চাত্য তখন প্রবল ইসলামভীতি। বাংলাদেশে ইসলাপন্থীদের কুপানোর কাজে হাসিনার বিকল্প নাই -এ তত্ত্ব ভারত পাশ্চাত্য দেশের সরকারগুলিকে বুঝিয়েছে। বিনিময়ে ভারতকে বহু কিছুই দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতকে করিডোর দেয়া, সমুদ্রবন্দরের সুবিধা দান, ভারতীয় আদানী কোম্পানীর জন্য বিশাল অংকের বাণিজ্যিক সুবিধা দান -এ সুবিধাগুলি কোন জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক সরকারই ভারতকে দিত না। অতীতেও কোন সরকার দেয়নি। কিন্তু হাসিনা সেগুলি সহজেই দিয়েছে। বরং ভারতকে বেশী বেশী দেয়া নিয়েই হাসিনার গর্ব। তাই গর্ব করে হাসিনা বলে, “ভারতে যা দিয়েছি -ভারত তা কখনোই ভূলতে পারবে না।” প্রভুকে দেয়া নিয়ে চাকর-বাকরগণ এরূপ কথাই বলে। কারণ প্রভু যা চায় তা দেয়া ছাড়া চাকর-বাকরের সামনে অন্য পথ থাকেনা।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণতন্ত্র-ভীতি অতি প্রকট। ভারত চায় না, কবর থেকে গণতন্ত্র আবার বাংলাদেশে ফিরে আসুক। কারণ, ভারতীয়রা জানে, গণতন্ত্র ফিরলে ভারতপন্থী সেক্যুলারিস্টদের পরাজয় অনিবার্য -যেমনটি ঘটেছিল ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ অবধি অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে। তখন নির্বাচিত হবে হিন্দুত্ববাদ বিরোধী ইসলামপন্থীরা -যারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধীতা করেছিল। সে আশংকার কথা খোদ শেখ মুজিব বলেছিলেন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরীকে -যা জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী তার বই “রাজনীতির তিন কাল”য়ে লিখেছেন। মুজিব তাঁকে বলেছিলেন, “দেশের অবস্থা যে পর্যায়ে গেছে তাতে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। ২৫ থেকে ৩০টির বেশী আসন আমরা পাবো না। তখন জামাত অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সাথে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে কচুকাটা করবে।” সে ইসলামভীতি ও গণতন্ত্রভীতি নিয়েই শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে কবরে পাঠান এবং বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একদলীয় রাজনীতির জন্ম দেন। মুজিব এভাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেন গণতন্ত্রের ঘাতক রূপে।
ষড়যন্ত্র করে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানো যায়। রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু মানুষের ঈমানকে হত্যা করা যায়না। ঈমানদারদের ঈমানী তাড়নো কখনোই বন্দুকের গুলীতে ও ষড়যন্ত্রে মারা যায়না, বরং তাতে আরো প্রবলতর হয়। এরই প্রমাণ, বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের তাড়না শুধু বেঁচেই নাই, বরং প্রবলতর হয়েছে। ফলে আজ বাংলাদেশের রাজপথে ইসলামপন্থীদের যে শক্তি -তা মুজিবের আমলে ছিল না। এমনকি পাকিস্তান আমলেও ছিল না। ভারতের এখানেই ভয়। সে ভয় নিয়েই ভারত চায়, ইসলামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে। সে লক্ষ্যপূরণে ভারত চায়, বাংলাদেশকে গাজা ও কাশ্মীরের ন্যায় উম্মুক্ত জেলখানায় পরিণত করতে। মুজিবের আমলে ভারত ইসলামপন্থীদের ফাঁসীতে চড়ানো বা শাপলা চত্বরের গণহত্যার কথা ভাবেনি। আবরার ফাহাদদের ন্যায় দেশপ্রেমিকদের পিটিয়ে হত্যার কথাও ভাবেনি। ইলিয়াস আলীর মত শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম-খুন করার কথাও ভাবেনি। কিন্তু এখন সেগুলিই করা হচ্ছে অতি জোরে শোরে এবং অতি নৃশংসতার সাথে। গুম-খুনের যে নৃশংস বর্বরতা ভারত কাশ্মীরে চালু রেখেছে, অবিকল সেটি বাংলাদেশে চালু রাখতে চায়। সে কাজ কখনোই কোন গণতান্ত্রিক সরকারের দ্বারা সম্ভব নয়। কারণ, গণতান্ত্রিক সরকারকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হয়। সেখানে জনগণের আদালতে জবাবদেহীতা থাকে। এরূপ নৃশংস বর্বর কর্ম একমাত্র সে সরকারই করতে পারে -যাকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হয়না। এমন কাজের জন্য চাই হাসিনা -যার ভোটের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, সে নিজেই নিজেকে ভোটডাকাতির মাধ্যমে নির্বাচিত করতে পারে। এজন্যই ভারত সরকার হাসিনার এতো অন্ধ সমর্থক।
শেখ হাসিনা ভারতীয়দের চেয়েও ভারতীয়। বিজিপি নেত্রী নুপুর শর্মা যখন নবীজী (সা:)’র বিরুদ্ধে কটুক্তি করে, তখন কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বিশাল বিশাল প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেরূপ প্রতিবাদ মিছিল বাংলাদেশে হতে দেয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে মিছিল করলে ভারতে কাউকে জেলে হতে হয়না। কাউকে পুলিশের গুলীতে মারা যেতে হয়না। কিন্তু বাংলাদেশে গুলী খেয়ে মারা যেতে হয় বা জেলে যেতে হয়। সেটির প্রমাণ, নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর কালে রাস্তায় প্রতিবাদ করায় বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা বা জেলে যেতে হয়েছে। শেখ হাসিনা তাই বাংলাদেশের কোন স্বাধীন প্রধানমন্ত্রী নয়, বরং বাংলাদেশ নামক কারাগারের কারাপ্রধান মাত্র।
চুক্তিবদ্ধ পরাধীনতা
১৯৪৭ সালে জন্ম থেকেই পাকিস্তান ছিল ভারতের প্রধান প্রতিপক্ষ। ভারতের অভিলাষ, দক্ষিণ এশিয়ার বুকে প্রধান শক্তি হওয়া। সে পথে মূল বাধা ছিল পাকিস্তান। তাই শুরু থেকেই ভারতের স্ট্রাটেজী ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা। ১৯৬২ সালে চীনের বিরুদ্ধে এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ জয় হয়নি। ফলে ভারতের সে স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। ভারত মোক্ষম সুযোগটি পায় ১৯৭১। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল ভারতের একান্তই নিজস্ব যুদ্ধ। পাকিস্তানের তখন প্রকট রাজনৈতিক সংকট। ভারত সে সংকট থেকে ফায়দা তুলেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা পূরণে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়েছে।
একাত্তরে ভারতের লক্ষ্য কখনোই বাংলাদেশেকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া ছিল না। বরং দিয়েছে চুক্তিবদ্ধ পরাধীনতা। সে চুক্তিবদ্ধ পরাধীনতার প্রমাণ, তাজুদ্দীনের সাথে ভারতের ৭ দফা এবং মুজিবের সাথে ২৫ দফা চুক্তি। ভারতের ভয়, বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হলে তাতে আবারো পাল্টে যেতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি। কারণ, সে পরিবর্তনে জড়িত হতে পারে পশ্চিম বাংলা ও আসামের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠি। সে ভয় নিয়েই ভারত ইসলামপন্থীদের নির্মূল চায়। ভারত সে নির্মূলের কাজটি শুরু করেছে আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে। সে পরিকল্পনার অংশ রূপেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে ইসলামপন্থী নেতাকর্মীদের এবং কারাবন্দী করা হয়েছে বহুশত আলেমকে। শাপলা চত্বরে গণহত্যা, পিল খানায় ৫৭ জন অফিসার হত্যা এবং বেছে বেছে গুম, খুন ও অপহরণের কান্ড মূলত একই লক্ষ্যে। একই পরিকল্পনার অংশ রূপে নির্বাচনে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে না ইসলামপন্থী দলগুলিকে।
পাকিস্তান আমলে মুজিব কাজ করেছেন ভারতের চর রূপে। ১৯৬৮’য়ের আগরতলা ষড়যন্ত্র হলো তার প্রমাণ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর কাজ করেছেন ভারতের খলিফা রূপে। ক্ষমতায় থাকা কালে মুজিবের কাজ ছিল, ভারতের এজেন্ডাকে প্রতিষ্ঠ দেয়া। মুজিব জানতেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির পুরা কাজটিই করে দিয়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। মুক্তি বাহিনী বা মুজিব বাহিনী একটি জেলা বা মহকুমা দূরে থাক একটি থানাকেও স্বাধীন করতে পারিনি। মুজিবকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ভারত। ফলে মুজিবের রাজনীতিতে ভারতের প্রতি ছিল প্রচণ্ড দায়বদ্ধতা। মুজিবের কাঁধে চাপানো প্রধান দায়টি ছিল, বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের উত্থানকে প্রতিহত করা। ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পড়ে মুজিব যুদ্ধ করেছেন ইসলামের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধের অংশ রূপে মুজিব নিষিদ্ধ করেছিলেন সকল ইসলামপন্থী দলকে। এবং জেলে তুলেছিলেন সেসব দলগুলির নেতাকর্মীদের। সে অভিন্ন যুদ্ধটি দেখা যায় হাসিনার রাজনীতিতেও। তাই গোলা-বারুদের যুদ্ধ দেখা গেছে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে।
শেখ মুজিব নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন স্কুলে পবিত্র কুর’আনের শিক্ষাদান। পাকিস্তান আমলে স্কুলে দ্বীনিয়াত নামে একটি বই পড়ানো হত। সেটি তিনি নিষিদ্ধ করেন। বন্ধ করেন রেডিও-টিভিতে পবিত্র কুর’আনের তেলাওয়াতও । পর অবশ্য জনগণের চাপে পুণরায় চালু করতে বাধ্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে “ইকরা বিসমে রাব্বিকাল্লাযী খালাকা” -পবিত্র কুর’আনের এই আয়াতটি লেখা ছিল। মুজিব সেটি তুলে দেন। ইসলামের বিরুদ্ধে মুজিবের শুরু করা যুদ্ধকে হাসিনা বেগবান করে। গ্রেফতার করে বহু শত আলেমকে, নিষিদ্ধ করে জিহাদ বিষয়ক বই, এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে কুর’আনের তাফসির ও জুম্মার খোতবার উপর -যাতে জিহাদের বয়ান শোনানো না হয়। অথচ জিহাদ হলো ইসলামের সর্বোচ্চ ইবাদত। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেয়ার হাতিয়ার।
ভারতের শাসক মহলে রয়েছে প্রচণ্ড জিহাদ ভীতি। কারণ, ভারত জানে জিহাদ একবার শুরু হলে সেটি থামানো যায় না। কাশ্মীরে ৬ লাখ সৈন্য মোতায়েন করেও জিহাদ থামাতে পারছে। তাই ভারত চায়, বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ প্রতিহত করার দায়িত্ব নিক বাংলাদেশ সরকার। ভারতের ভয়. বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হলে তা নিশ্চিত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীততে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে ও জাগরণ আনবে ভারতে ২২ কোটি মুসলিমদের মাঝে। ভারতের আশংকা, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনাটি নানা ভাষা, নানা বর্ণে ও শিয়া-সূন্নীতে বিভক্ত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশেই অধিক। পাকিস্তানে রয়েছে সেক্যুলারিস্ট সেনাবাহিনীর নৃশংস দখলদারী। ইসলামের উত্থান রুখতে এ সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর। অপর দিকে বাঙালি মুসলিমদের রাজনীতির অতীত ইতিহাসটি গৌরবজনক। এই বাঙালি মুসলিমগণই ১৯৪৭’য়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি পাল্টে দিয়েছিল; সেটি মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তানের জন্ম দেয়ার মধ্য দিয়ে।
ভারতের বর্তমান স্ট্রাটেজীক লক্ষ্য হলো, বাঙালি মুসলিমদের তেমন একটি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন থেকে নিবৃত রাখা। সেজন্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের এতো বিনিয়োগ। একারণেই বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের জন্য একটি রণক্ষেত্রে। চলমান এ যুদ্ধের মূল মালিকানা ভারতের। কারণ এ এলাকায় ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ প্রতিরোধের মূল যুদ্ধটি মূলত তাদেরই। আপাতত: এ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে প্রক্সি রূপে লড়ছে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধেও প্রক্সি রূপে আওয়ামী লীগ ও তার অধিনত মুক্তিবাহিনী লড়েছিল প্রথম ৮ মাস। কিন্তু বিজয় জুটেনি। একটি জেলাকেও তারা স্বাধীন করতে পারিনি। অবশেষে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারত তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে রণাঙ্গণে নামে। বুঝতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদটি কোন মামূলী রাষ্ট্র নির্মাণ নয়। এটি বিশাল এক এলাকার ভূ-রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দেয়ার জিহাদ। ভারত তাই দক্ষিণ এশিয়ার বুকে সেরূপ একটি রাষ্ট্র নির্মাণে বাধা দিবেই। তবে মুসলিম জীবনেও কোন সহজ রাস্তা নাই। তাকেও বাঁচতে হয়ে শত্রুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই। যেমনটি করেছিলেন গৌরব যুগের মুসলিমগণ। এটিই বাঙালি মুসলিম জীবনের মূল চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ এখানে শুধু স্বাধীন ভাবে বাঁচার নয়, বরং প্রকৃত ঈমানদার রূপে বাঁচার। ০ ১/১২/২০২৩
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018