বাংলাদেশে হারাম রাজনীতির বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের আত্মঘাতী নাশকতা
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on April 12, 2025
- Bangla Articles, Bangla বাংলা, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
বিজয় হারাম রাজনীতির
ইসলামে হারাম-হালালের বিধানটি শুধু পানাহার, কাজ-কর্ম ও আয়-উপার্জনে নয়, বরং রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণেও। যে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে মুসলিম উম্মাহর একতা, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বিপন্ন হয় এবং মুসলিম ভূমি কাফির শক্তির দ্বারা অধিকৃত হয় -সে রাজনীতি হারাম। এ রাজনীতিতে যারা নিহত হবে তারা জাহান্নামে যাবে। মুসলিম বিশ্বে এ রাজনীতি বিজয়ী হওয়াতে মুসলিম বিশ্ব আজ ৫০টির বেশী খণ্ডে বিভক্ত, শক্তিহীন ও পরাধীন। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আবাকান, ইয়েমেনসহ বিশ্বের কোণ কোণে মুসলিমগণ যেরূপ গণহত্যা ও বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছে এ হারাম রাজনীতির কারণে। মুসলিম দেশগুলিতে এ হারাম রাজনীতির বিজয় এনেছে জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী সেক্যুলারিস্টগণ। এরা যেমন খেলাফত ভেঙ্গেছে, তেমনি পাকিস্তানও ভেঙ্গেছে। ভাঙ্গাই তাদের এজেন্ডা, গড়া নয়। অপর দিকে যে রাজনীতিতে মুসলিম উম্মাহর একতা, নিরাপত্তা, শক্তি ও স্বাধীনতায় বৃদ্ধি ঘটে এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে -সে রাজনীতি শুধু হালালই নয়, বরং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সেটি পবিত্র জিহাদ। এ রাজনীতি বস্তুত সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণের রাজনীতি। এ রাজনীতিতে যারা নিহত হবে তারা শহীদ হবে এবং বিনা হিসাবে সরাসরি জান্নাতে যাবে। জিহাদের সে রাজনীতি দেখা গেছে নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। নবীজী (সা:)’র অর্ধেকের বেশী সাহাবা সে রাজনীতির জিহাদে শহীদ হয়ে গেছেন। সে রাজনীতির ফলে মুসলিম উম্মাহ মদিনার ক্ষুদ্র গ্রাম্য নগরী থেকে বিশ্ব শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
বাঙালি মুসলিম জীবনে জিহাদের রাজনীতি দেখা গেছে পাকিস্তান সৃষ্টির লড়াইয়ে। সে রাজনীতিতে যেমন বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, গুজরাতী, বেলুচ ইত্যাদি নানা ভাষী মুসলিমদের মাঝে একতা গড়ে উঠেছিল এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। অপর দিকে বাঙালি মুসলিম জীবনে হারাম রাজনীতির বিশাল বিজয় দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। হারাম রাজনীতি মাত্রই নাশকতার রাজনীতি। সে রাজনীতি যেমন উগ্র বাঙালি ফ্যাসিবাদ ও সেক্যুলারিজমের, তেমনি অগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের। একাত্তরের সে নাশকতার রাজনীতিতে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়া হয়েছে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে। খণ্ডিত করা হয়েছে রক্তে গড়া পাকিস্তানকে এবং বিজয়ী তুলে দেয়া হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের ঘরে।
বিজয় হিন্দুত্ববাদী বয়ানের
প্রশ্ন হলো বয়ান কি এবং বয়ানের গুরুত্বই বা কি? বয়ান আরবী শব্দ; এটি বার বার এসেছে পবিত্র কুর’আনে। বয়ান হতে পারে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা; পবিত্র কুর’আনে এরূপ অসংখ্য বয়ান এসেছেক। সুরা আল ইমরানের ১৩৮ নম্বর আয়াতে পবিত্র কুর’আনকে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বয়ানুন লিন্নাস অর্থাৎ মানব জাতির জন্য বয়ান বলা হয়েছে। সে আয়াতটি হলো:
هَـٰذَا بَيَانٌۭ لِّلنَّاسِ وَهُدًۭى وَمَوْعِظَةٌۭ لِّلْمُتَّقِينَ
অর্থ: “এই কিতাব (কুর’আন) হলো মানব জাতির জন্য বয়ান (statement), (জান্নাতের) পথ তথা সিরাতাল মুস্তাকীম এবং আল্লাহভীরু লোকদের জন্য ওয়াজ তথা নসিহত।”
বয়ান বা বায়িনাহ হতে পারে ব্যক্তির চেতনায় ভূমিতে ধারণকৃত বিশ্বাস বা চিন্তার ভাষ্যরূপ। বস্তুত প্রতিটি ব্যক্তির মনের গভীরে কাজ করে চিন্তা বা বিশ্বাসের একটি বিশেষ মডেল। বিশ্বাসের সে মডেল থেকেই নির্ধারিত হয় ব্যক্তির আচার-আচরণ, ধর্মকর্ম ও চরিত্র। চিন্তা বা বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণেই ঈমানদারের ধর্মকর্ম, আচার-আচরণ এবং চরিত্র কখনোই পৌত্তলিকের ন্যায় হয়না। প্রতিটি ব্যক্তি যে তার চিন্তার মডেল অনুযায়ী কাজ করে সে মহা প্রজ্ঞাময় কথাটিই সর্বজ্ঞানী আল্লাহ বলেছেন নিম্নের আয়াতে:
قُلْ كُلٌّۭ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِ فَرَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَنْ هُوَ أَهْدَىٰ سَبِيلًۭا ۦ
অর্থ: (হে নবী) আপুন বলুন, প্রতিটি ব্যক্তি কাজ করে নিজ ধ্যান-ধারণার মডেল (model of thought) অনুযায়ী; এবং তোমাদের প্রতিপালক জানেন ধ্যান-ধারণায় নির্মাণে কারা হিদায়েতপ্রাপ্ত।” –(সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৮৪)। ধ্যান-ধারণার নির্মাণে সবাই সঠিক হয়না, চেতনার সে ভূমি শয়তান ও তার অনুসারীদের দ্বারা অধিকৃতও হতে পারে। ফলে সে ব্যক্তি নাস্তিক, সংশয়বাদী, বস্তুবাদী বা মূর্তিপূজারীও হতে পারে। সঠিক চিন্তা-ভাবনার জন্যও চাই মহান আল্লাহ তায়ালার হিদায়েত; এবং যারা হিদায়েত পায় তাদের ধ্যান-ধারণার মডেল সঠিক হয়। উপরিউক্ত আয়াতে সেটিই বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে যে বয়ানটি বিজয় পেয়েছে সেটি ইসলমের নয়; বরং সেটি হিন্দুত্ববাদী চেতনার। সেটি সেক্যুলারিজম ও জাতীয়তাবাদের। ১৯৭১’য়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগলিক মানচিত্রই শুধু ভারতের হাতে অধিকৃত হয়নি, অধিকৃত হয়েছে বাঙালি মুসলিমের চেতনার ভূমিও। ফলে একুশে ফেব্রেয়ারী এলে হিন্দুদের ন্যায় নগ্নপদে গান গেয়ে গেয়ে বাঙালি মুসলিম সন্তানেরা ফুল হাতে বেদীমূলের হাজির হয়। নববর্ষ এলে নানা প্রতিকৃতি নিয়ে মঙ্গল যাত্রায় নামে। এসবই হলো হিন্দুয়ানী বয়ানের সাংস্কৃতিক রূপ। পাকিস্তান ভাঙ্গা, বিহারী হত্যা, শাপলা চত্বরে ইসলামপন্থীদের হত্যা ও দাড়ি-টুপি ধারীদের অবজ্ঞা করা -এসব হলো সে হিন্দুত্ববাদী বয়ানের রাজনৈতিক রূপ। কোন সামরিক বিজয়ই একাকী আসে না; বিজয়ী পক্ষটি প্রতিষ্ঠা দেয় নিজস্ব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বয়ানেরও। তখন নির্মিত হয় নতুন ধারার রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। তাই একাত্তরে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ভূগোল বদলায়নি, বদলে গেছে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির বয়ান ও সংস্কৃতি। এবং বদলে গেছে শত্রু-মিত্রের ধারণাও।
একটি দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে প্রতিস্থাপিত বয়ানই ঠিক করে দেয় সে দেশে কোন ভাবনা, কোন কর্ম, কোন আচরণ ও কোন রাজনীতি নন্দিত হবে এবং কোনটি নিন্দিত হবে। সে সাথে ঠিক করে দেয়, দেশবাসীর কাছে কারা শত্রু রূপে গণ্য হবে এবং কারা বন্ধু রূপে গণ্য হবে। ঠিক করে দেয়, কারা ফাঁসিতে ঝুলবে এবং কারা দেশের শাসক ও শ্রেষ্ঠজন রূপে বিবেচিত হবে। পৌত্তলিক বয়ানে দেবতার লিঙ্গও পূজনীয় হয়। তেমনি সেক্যুলার বয়ানে বিবাহবহির্ভুত যৌনমিলন বা ব্যাভিচারও প্রেম রূপে প্রশংসিত হয়। অথচ পবিত্র কুর’আনের বয়ানে প্রতিটি ব্যাভিচারই হত্যাযোগ্য অপরাধ -যদি অপরাধী বিবাহিত হয়। অবিবাহিত হলে প্রাপ্য শাস্তি হলো ১০০টি বেত্রাঘাত। তেমনি সেক্যুলার বিচারে পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার কাজটি অতি গর্বের কাজ মনে হয়। অথচ ইসলামী বিচারে এটি এক বিশাল ফিতনা -যার মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে গুরুতর নাশকতার কাজ। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুর’আনের সুরা বাকারার নম্বর আয়াতে এমন ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়ে গুরুতর বলেছেন। মুসলিম বিশ্ব বিভক্ত হয়েছে, দুর্বল হয়েছে এবং স্বাধীনতা হারিয়েছে কিছু খুনির হাতে কিছু হাজার মানুষ খুন হওয়ার কারণে নয়, বরং ফিতনা সৃষ্টিকারী দুর্বৃত্তদের হাতে রাষ্ট্র খুন হওয়ার কারণে। একাত্তরে সে কাজটি করেছে ভারতে আশ্রয় পাওয়া, অর্থ পাওয়া ও প্রশিক্ষণ পাওয়া জয় বাংলার সৈনিকেরা।
পৌত্তলিক চেতনার ধারকগণ যেমন মসজিদ-মাদ্রাসার রক্ষক হতে পারে না, তেমনি রক্ষক হতে পারেনা ইসলামী রাষ্ট্রেরও। এজন্যই গৌরবযুগে মুসলিম দেশের সেনাবাহিনীতে অমুসলিমদের নেয়া হয়নি। তাদের থেকে বরং জিজিয়া নেয়া হয়েছে। একই কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ রক্ষক হতে পারিনি প্যান-ইসলামী চেতনার উপর নির্মিত পাকিস্তানের; তারা বরং দেশটির বিনাশে আগ্রাসী ভারতীয় কাফিরদের সাথে একাত্ম হয়েছে। ইসলামী চেতনাশূণ্যতার কারণে মেজর জিয়া তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে ভারতের কোলে গিয়ে উঠেছে। একই কাজ করেছে মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা। সেদিন পাকিস্তানের বিনাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছিল মগজে বাসা বাধা চিন্তা মডেলটি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার হওয়ার কারণে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও বামধারার নেতাকর্মীদের মাঝে চেতনার সে মডেলের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই। পাকিস্তানের সৃষ্টিকে তারা যেমন মেনে নিতে পারি নাই, দেশটি বেঁচে থাকুক সেটিও তারা চায়নি। সেটি সম্ভব হয়েছিল কলকাতার হিন্দু বাবুদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে একাত্ম হওয়ার কারণে। তাদের ব্যর্থতাটি ইসলামের এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ায়। সে ব্যর্থতার কারণে তারা একাত্ম হতে পেরেছে শয়তানের পৌত্তলিক খলিফাদের সাথে। তাদের চেতনার মডেলটি ইসলামের হলে তারা কখনোই একাত্তরে ভারতীয় কাফিরদের কোলে আশ্রয় নিত না -যেমন রাখেনি কোন আলেম, কোন ইমাম, কোন পীর সাহেব এবং মাদ্রাসার কোন ছাত্র বা শিক্ষক।
প্রতিটি বিপ্লবের শুরু চিন্তার বিপ্লব থেকে
দেশবাসীর কর্ম, চরিত্র, ধর্ম ও রাজনীতি পাল্টাতে হলে প্রথমে তাদের চিন্তা-চেতনার মডেল বদলাতে হয়। চিন্তার সে মডেল পানাহার ও সম্পদের প্রাচুর্যে বদলায় না; সে কাজে সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। কুর’আনের জ্ঞানই হলো বিপ্লবের মূল বীজ। মুসলিমগণ সবচেয়ে ভাগ্যবান যে তাদের হাতে রয়েছে বিপ্লবের সবচেয়ে বড় পাওয়ার হাউস। কুর’আনী জ্ঞানই হলো সে বিপ্লবের মূল চাবিকাঠি। এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা সর্ব প্রথম নামাজ-রোজা ফরজ না করে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। সে জ্ঞানের ভিত্তিতেই নবীজী (সা:) তাঁর বয়ান খাড়া করেছেন এবং সে সাথে ইসলামের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞানচর্চা ও রাজনীতির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। পরিশুদ্ধ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র নির্মাণে এটিই হলো নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। মুসলিমদের আজকের ব্যর্থতার মূল কারণ, নবীজী (সা:)’র এ মহান সূন্নতকে তারা বহু শত বছর পূর্বেই বর্জন করেছে। তারা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ নিয়ে ভাবে না, বড় জোর ভাবে কিছু মসিজদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা নিয়ে। মসিজদ-মাদ্রাসা কখনোই আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়ত এবং তাঁর বৈচারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এজেণ্ডাকে বিজয়ী করে না। সেকাজের হাতিয়ার তো ইসলামী রাষ্ট্র।
রণাঙ্গণের যুদ্ধ, বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ এবং রাজনীতির ময়দানের লড়াই তো নতুন বয়ান নির্মাণের লড়াই। বয়ান যখন পাল্টে যায়, বিচার-বিবেচনার মানদণ্ডও তখন পাল্টে যায়। এমন কি মানুষের দর্শন, ধর্ম ও সংস্কৃতিও তখন পাল্টে যায়। পৌত্তলিকতায় যা ধর্মকর্ম মনে হয়, ইসলামে দীক্ষা নেয়ার সাথে সাথে সেটি গণ্য হয় মহাপাপ রূপে। কিন্তু বয়ান বদলানোর কাজে মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায় সে বয়ানের অভিভাবক রাষ্ট্রীয় শক্তি। কারণ ক্ষমতাসীনগণ তাতে নিজেদের বিপদ দেখতে পায়। অনৈসলামী রাষ্ট্রের শাসকগণ তাই কোন ইসলামী বয়ানকে বেড়ে উঠতে দেয়না। সে বাধা দূর করতে অপরিহার্য প্রয়োজন হলো রাষ্ট্রীয় বিপ্লব। নবীজী (সা:)কে তাই ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে হয়েছে। সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় ও সুরক্ষায় অসংখ্য যুদ্ধ লড়তে হয়েছে।
বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণই হলো নবীজী (সা:)’র জীবনের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। সে প্রকল্প সফল না হলে মুসলিমদের বিশ্বশক্তি রূপে বেড়ে উঠার কাজ পুরোপুরি ব্যর্থ হতো। তখন ইসলাম ব্যর্থ হতো বিশ্বব্যাপী দ্রুত প্রসার পেতে। তাই নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে যে অসংখ্য যুদ্ধ ছিল তার লক্ষ্য শুধু দেশের ভূগোল পাল্টানো ছিলনা, বরং ছিল জনগণের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি পাল্টানো। ইসলামে এটিই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত তথা জিহাদ। ইবাদত এখানে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার। যেখানে সে জিহাদ নাই, সেখানে কখনো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হয়না, তেমনি ইসলামের পক্ষে বয়ানও নির্মিত হয়না। তখন সে দেশে বিজয় পায় শয়তানী শক্তি। তখন ইসলাম চর্চা স্রেফ কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদে সীমিত হয়ে যায়। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন এবং সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার এজেণ্ডা তখন শুধু কিতাবেই থেকে যায়।
স্বাধীনতার যুদ্ধও যখন গুরুতর অপরাধ
মুসলিমের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল লক্ষ্য হতে হয় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধি। কিন্তু ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক স্বাধীন দেশগড়ার নামে যখন মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি, শক্তিহানী ও নিরাপত্তাহানীর যুদ্ধ শুরু হয় তখন সে যুদ্ধ হারাম। সে যুদ্ধ তো আত্মঘাতী নাশকতার যুদ্ধ। একাত্তরের যুদ্ধে সেরূপ একটি নাশকতা হয়েছে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। পাকিস্তান ভাঙ্গায় শুধু পাকিস্তান দুর্বল হয়নি, দুর্বল হয়েছে যেমন বাঙালি মুসলিম, তেমনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ -বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ। মুসলিম উম্মাহ হারিয়েছে তার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে -যা বেঁচে থাকলে আজ ৪০ কোটি জনসংখ্যার তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক শক্তি হতে পারতো। তাই পাকিস্তান ভাঙ্গাটি বাঙালি ফ্যাসিস্ট, উগ্র সেক্যুলারিস্ট ও বামপন্থী নাস্তিকদের কাছে স্বাধীনতার যুদ্ধ গণ্য হলেও শরিয়তী আইনে সেটি ছিল হারাম ও গুরুতর অপরাধ।
মুসলিমকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম হয়ে। আর মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা তো মুসলিম উম্মাহর একতা ও তাদের শক্তিবৃদ্ধি। তিনি চান মুসলিমগণ বাচুক বিশ্বশক্তির মর্যাদা নিয়ে। অপর দিকে শয়তানের এজেন্ডা হলো মুসলিম রাষ্ট্রের বিভক্তি, শক্তিহানী ও পরাধীনতা। একাত্তরে বাঙালির যুদ্ধটি ছিল যেমন মহান আল্লাহ তায়ালার এজেণ্ডার বিরুদ্ধে, তেমনি শয়তানী শক্তির এজেন্ডাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে। নাশকতা এখানে মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে। বিজয় এখানে পৌত্তলিক ভারতের ন্যায় ইসলামের শত্রুপক্ষের। ভারতে বিজয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর। তাতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের সেক্যুলার বয়ান। তাতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের খণ্ডিতকরণ যেমন উৎসব রূপে গণ্য হয়েছে, তেমনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধুর সম্মান দেয়া হয়েছে মুজিবের ন্যায় খুনি, ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্ত এবং ভারতের একনিষ্ঠ গোলামকে।
নির্মিত হয়েছে মিথ্যার পাহাড়
গরুছাগল, সাপ, মূর্তি ও লিঙ্গকে পূজনীয় করতে হলে মিথ্যার পাহাড় গড়তে হয়। হিন্দু ধর্মের কিতাবগুলি তো এমন গাজাখুরি মিথ্যা ও কল্পকথায় পরিপূর্ণ। বহু মাথা, বহু হাত, এমন কি মাথার উপর হাতির মাথা বসিয়ে দেবতাদের কল্পিত চিত্র গড়া হয়েছে। একই রূপ মিথ্যার পাহাড় গড়েছে দুর্বৃত্ত আওয়ামী ফ্যাসিস্টগণ। নিজেদের কুকীর্তিগুলি ঢাকতে তারা তিরিশ লাখ বাঙালি হত্যা ও দুই লাখ নারী ধর্ষণের মিথ্যা বয়ান খাড়া করেছে। সে মিথ্যা দিয়ে তারা প্রায় দুই লক্ষ নিরস্ত্র বিহারী হত্যা, হাজার হাজার বিহারী নারী ধর্ষণ এবং তাদের ঘরবাড়ী ও ব্যাবসা-বাণিজ্য দখলকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। তারা এতোটাই অসভ্য যে, তাদের কাছে উৎসব গণ্য হয়েছে ইসলামপন্থীদের হত্যা করে তাদের লাশের উপর নাচানাচি -যা ২০০৬সালে ২৮ অক্টোবর দেখা গেছে, আয়না ঘরে নৃশংস নির্যাতন এবং ইসলামী দলের নেতাদের বৈচারিক হত্যা।
শরীয়তী আইনে মুসলিম দেশ ভাঙ্গা হারাম এবং শত্রু শক্তির হামলার প্রতিরোধে খাড়া হওয়া ফরজ। আলেমদের মাঝে নানা বিষয়ে মতভেদ থাকলেও শরিয়তের এ মৌলিক বিধানটি নিয়ে কোন মতভেদ নেই। পাকিস্তান শুধু পশ্চিম পাকিস্তানীদের ছিল না, সেটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানীদের পাকিস্তানও। বরং পাকিস্তানের মূল নির্মাতা তো বাঙালি মুসলিমরাই। তাই সে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া দোষের হয় কি করে? বরং গাদ্দারী গণ্য হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। প্রকৃত ঈমানদারী তো এটাই, মুসলিম মাত্রই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় এবং আগ্রাসী ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদে নামবে। তাই পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার হারামকে হারাম জেনেই একাত্তরে কোন ইসলামী দল, কোন ফকিহ, কোন পীর, কোন আলেম, কোন মসজিদের ইমান পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেননি। তাদের কেউ ভারতে আশ্রয় নেয়নি এবং মুক্তিবাহিনীতেও যোগ দেয়নি। অথচ ভারতসেবী বাঙালি ফ্যাসিস্ট এবং বামধারার নাস্তিকগণ পাকিস্তান ভাঙার হারাম যুদ্ধটি লড়েছে ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক শক্তির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এবং যুদ্ধটি লড়েছে তাদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে।
বিজয়ী হয়েছে শয়তানের এজেন্ডা
শুধু ইসলামে নয়, প্রতিটি ধর্মেই দেশের ভূগোল ও জনগণের বিভক্তিকে ঘৃণা করা হয় এবং গুরুত্ব দেয়া হয় একতাকে। তাই ভারতের নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা প্রদেশের হিন্দুরা একতাবদ্ধ এক বৃহৎ ভারতের জন্ম দিয়েছে। ভারত সে কারণে এক গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি। তেমনি ইউরোপের জার্মান, ফরাসী, ইতালীয়, স্পানীশ, পোলিশ ইত্যাদি ভাষী খৃষ্টানরা জন্ম দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। ইসলামে হারাম শুধু ব্যাভিচার, শুকরের গোশতা, সূদ ও মদ খাওয়া নয়, হারাম হলো মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়াও। বিভক্তি গড়াটি বস্তুত শয়তানের এজেন্ডা। মহান আল্লাহ তায়ালা তো চান একতা। একতাই মুসলিম উম্মাহর শক্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেয়; বিভক্তি দেয় পরাজয় ও পরাধীনতা। অথচ একাত্তরে মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি মুসলিমগণ শয়তানের সে এজেণ্ডাকেই বিজয়ী করেছে। সেটি পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে। অথচ বিভক্তি মাত্রই মহান আল্লাহ তায়ালার আযাবকে অনিবার্য করে। সে ভয়ানক হুশিয়ারী শুনানো হয়েছে সুরা আল ইমরানের ১০৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ
অর্থ: “এবং তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা বিভক্ত হলো এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা আসার পরও ভিন্ন ভিন্ন মতের অনুসারী হলো; এরাই হলো তারা যাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব।” তাই মুসলিম দেশ বিভক্ত হলো অথচ আল্লাহর আযাব এলো না -সেটি কখনো ঘটে না। বাঙালি মুসলিম জীবনে সে আযাব এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, আওয়ামী দুঃশাসন, বিচার বহির্ভুত হত্যা, সীমাহীন দুর্বৃত্তি, গণতন্ত্রের কবর, বাকশালী ফ্যাসিবাদ এবং ভারতের অধিকৃতি ও লুণ্ঠন নিয়ে। আযাব এসেছে বিশ্বজোড়া তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির অপমান নিয়ে।
মহান আল্লাহ তায়ালার যা কিছু হুকুম করেন -সেটিই সাথে সাথে ফরজ হয়ে যায়। এবং তিনি যা কিছু নিষেধ করেছেন, সেটিই হারাম হয়ে যায়। একতাকে ফরজ এবং বিভক্তিকে হারাম করে সুরা আল ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে নির্দেশ এসেছে:
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟
অর্থ: “এবং তোমরা আঁকড়ে ধরো আল্লাহর রশিকে এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়োনা।”
তাই মুসলিম উম্মাহর একতার ভিত্তি ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতা নয়, বরং সেটি হলো আল্লাহর রশি। এবং আল্লাহর সে রশি হলো কালেমায়ে শাহাদত ও পবিত্র কুর’আন। তাই সমগ্র ভারত জুড়ে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল: “পাকিস্তান না কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” সেদিন মুসলিম লীগের “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র কালেমাই বাঙালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, গুজরাতী, বালুচ, পাঠান ইত্যাদি নানা ভাষার মুসলিমদের একতাবদ্ধ করেছিল। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। একতা এভাবেই দেয় শক্তি, বিজয়, নিরাপত্তা ও ইজ্জত।
কিন্তু মুজিবের অপরাধ হলো, সে বিদ্রোহ করেছিল মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধে। সে বেছে নিয়েছিল বিভক্তির হারাম পথ। তার নাশকতাটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। সে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র পবিত্র কালেমাকে বর্জন করে বেছে নিয়েছিল “জয় বাংলা”র কুফুরি স্লোগান। তার স্লোগান ছিল অন্য ভাষী ও অন্য অঞ্চলের মুসলিমদের থেকে বাঙালি মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করার স্লোগান। প্রশ্ন হলো, যে স্লোগান মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়ে -সেটি কি কখনো হালাল হতে পারে? সেটি তো হারাম। সেটি তো শয়তানের এজেন্ডা। একাত্তরে শয়তানের এজেণ্ডাকেই বিজয়ী করা হয়েছে। ১২/০৪/২০২৫
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাংলাদেশে হারাম রাজনীতির বিজয় এবং বাঙালি মুসলিমের আত্মঘাতী নাশকতা
- The Crime of Israel and its Western Partners and the Crime of the Muslims
- সেক্যুলারিস্ট বাঙালি মুসলিম ফ্যাসিস্টদের ফিতনা ও নাশকতা
- বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ
- পূর্ণ ইসলাম পালনও যখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- April 2025
- March 2025
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018