বাঙালী সেক্যুলারিষ্টদের ভারতপ্রেম এবং ইতিহাস বিকৃতি

সেক্যুলারিস্টদের ভারত-প্রেম ও অন্ধত্ব

গভীর প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ভারত প্রেম তেমনি অন্ধ করেছে বাঙালী জাতিয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের। এর ফল হলো, ভারতের জঘন্য অপরাধগুলোও তাদের নজরে পড়ে না। অথবা সেগুলো দেখেও তারা না দেখার ভান করে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অপরাধের তালিকাটি বিশাল। একাত্তরের যুদ্ধ শেষে হাজার হাজার কোটি টাকার পাকিস্তান আর্মির অস্ত্র লুন্ঠন, ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তার পানি লুন্ঠন, বর্ডার সিক্যিউরিটি ফোর্সের হাতে শত শত বাংলাদেশীর নিয়মিত হত্যা, বাণিজ্যের নামে বাংলাদেশের বাজার দখল এবং বাংলাদেশী পণ্য ভারতে ঢুকতে না দেয়া, ন্যায্য পাওনা তিনবিঘা দিতে অস্বীকৃতি, তালপট্টি দ্বীপ ছিনিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশের সমূদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ন্যায় অসংখ্য ও জঘন্য অপরাধ ভারত সরকারের। সম্প্রতি শুরু হয়েছে পাশ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলার ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশী অভিহিত করে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা।

তবে এ অপরাধগুলোই ভারত সরকারের একমাত্র অপরাধ নয়। আরো গুরুতর অপরাধ হল,বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বে তারা হাত দিয়েছে। ভারত কোমর বেঁধেছে বাংলাদেশের উপর সামরিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখলদারি প্রতিষ্ঠার। তাদের এ লক্ষ্য পূরণে তাদের সাথে দিবারাত্র কাজ করেছে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে তাদের অর্থে পালিত পঞ্চম বাহিনীর লোকেরা। ভারতের অপরাধগুলো আড়াল করার লক্ষ্যে এসব ভারতপ্রেমী বাংলাদেশীদের স্ট্রাটেজী হল,বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতকে নয় পাকিস্তানকে মূল শত্রুরুপে চিত্রিত করা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ –এ তেইশ বছর হল বাঙালী মুসলমানদের ইতিহাসে পাকিস্তানী আমল।। ভারতপ্রেমীদের কাজ হল,২৩ বছরের পাকিস্তানী যুগকে বাঙালী মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে কালো যুগ রূপে চিত্রিত করা। এ যুগে বাঙালীর অকল্যাণ ছাড়া কোন কল্যাণই হয়নি, সেটিই বার বার তুলে ধরা। এ যুগকে তারা বলে পাকিস্তানের উপনিবেশিক যুগ। তবে পাকিস্তানের যে ইতিহাস বিশ্ববাসীর জানা তা দিয়ে এ মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব। কারণ উপনিবেশিক রাষ্ট্র বলেতে যে ভাবে ব্রিটিশ, ফ্রাঞ্চ, স্পেনীশদের ন্যায় ইউরোপীয়দের বোঝানো  হয়ে থাকে, পাকিস্তান কোন কালেই সেরূপ রাষ্ট্র ছিল না। তাই তারা অন্য পথ ধরেছে। সে পথ ইতিহাস বিকৃতির।

কে শত্রু আর কে মিত্র, নতুন প্রজন্ম সে ধারণাটি পায় ইতিহাস-জ্ঞান থেকে। সে জ্ঞানের কারণেই মীর জাফরেরা জাতির কাছে ঘৃনীত হয়। শত্রু রূপে চিহ্নিত হয় উপনিবেশিক ব্রিটিশেরা। ফলে আগ্রাসী শক্তি শুধু দেশের রাজনীতি,সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে হাত দেয় না, ইতিহাসেও হাত দেয়। এজন্যই ভারতীয়দের বিণিয়োগ কোন কালেই বাংলাদেশের শিল্প ও কৃষিতে না থাকলে কি হবে, প্রচুর বিণিয়োগ বেড়েছে টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। মুজিব আমলে তাই শিল্প,শিক্ষা ও গণতন্ত্র ধ্বংস করার পাশাপাশি শত শত কোটি টাকার বিণিয়োগ হয়েছে ইতিহাসের বই লেখা ও প্রকাশনায়। বাংলাদেশে আজও  সে কাজটি অতি জোরে জোরে চলছে। ভারতীয় এ প্রজেক্টে বহু ভারতীয় লেখক,বুদ্ধিজীবী ও র’ এজেন্টের সাথে ময়দানে নেমেছে শত শত বাংলাদেশী সেক্যুলার লেখক,কলামিস্ট,সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। এরূপ প্রজেক্টের ফলেই একাত্তরে নিহত তিরিশ লাখের ন্যায় বহু বিকট আকারের মিথ্যাকে তারা বাজারে ছড়াতে সমর্থ হয়েছে।

বাঙালী মুসলমানের ইতিহাসে পাকিস্তানের তেইশ বছরের সময়টি অতি স্বল্প সময়ের। সম্রাট আকবর বা আও রঙ্গজেব একাই এর চেয়ে দ্বিগুণ সময়ের বেশী রাজত্ব করেছেন। তবে স্বল্প সময়ের হলেও বাঙালীর ইতিহাসে এ সময়টি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পূর্বে আর কখনই কোন বাঙালী মুসলমান তাদের নিজ ভূগোলের বাইরে বিশাল ভূ-খণ্ড জুড়ে প্রধানমন্ত্রি বা মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পায়নি। এই ছিল প্রথম ও শেষ সুযোগ। ইতিহাসের এ পর্বে শুধু যে একাত্তরের যুদ্ধ ঘটেছে তা নয়। ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৬৫-এ ভারতীয় আগ্রাসনের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও আছে। দেশটির প্রতিষ্ঠা ও বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে এ সময়টাতেই চলেছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের লাগাতর ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের ইতিহাস। সে ইতিহাসে যেমন বহু মীরজাফর আছে, তেমনি বহু হাজার লড়াকু মোজাহিদও আছে। ভারতসেবী শেখ মুজিব যেমন আছে,তেমনি আছে নবাব সলিমুল্লাহ,কায়েদে আজম, খাজা নাজিমুদ্দীন,সোহরাওয়ার্দী,শেরে বাংলা,নুরুল আমীনসহ বহু নেতাও। কিন্তু ভারতসেবী বুদ্ধিজীবীদের কাজ হয়েছে বেছে বেছে শুধু ভারতসেবী ব্যক্তিদের কর্মকে মহান রূপে তুলে ধরা। আর মানবিক করে দেখানো ভারতের ভূমিকাকে। এমন কি একাত্তরে ভারতের স্থল ও বিমান হামলা,মানবহত্যা এবং সীমাহীন লুন্ঠনও তাদের কাছে অপরাধ মনে হয় না। তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে বরং ভারত-বিরোধীদের চরিত্রহনন। এমন এক আত্মবিক্রীত চেতনার কারণে ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দুদের কুটীল ষড়যন্ত্রও তাদের কাছে কোন ষড়যন্ত্র গণ্য হয় না। অপরাধ গণ্য হয় না সাতচল্লিশে বাংলা বিভাগ এবং ১৯৬৫ সালের সামারিক হামলা। অপরাধ নয় ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ ও তিস্তামুখ বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানো,বা সীমান্তে হামলা চালিয়ে শত শত বাংলাদেশী হত্যাও।

 

আপত্তি পাকিস্তানের বেঁচে থাকাতে

১৯৭১-এ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের বিলুপ্তি ঘটেছে, কিন্তু শুধু এটুকু নিয়েই ভারতসেবী এ বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ খুশি নয। পাকিস্তান এখনও কেন বেঁচে আছে তাতেই তাদের আপত্তি। সে সাথে প্রচণ্ড দুঃখও। দেশটি আরো খণ্ডিত হোক এবং বিলুপ্ত হোক, সেটাই তাদের ঐকান্তিক বাসনা। তাদের সে বাসনাটি প্রায়ই ফুটে উঠে তাদের লেখালেখি ও রাজনীতিতে। বাঙালী জাতিয়তাবাদী এ পক্ষটির অনেকে নামে মুসলমান হলেও ১৯৪৭-যে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন চাইনি, তেমনি আজও  চায়না দেশটি বেঁচে থাকুক। তাদের সহানুভুতি তাই পাকিস্তানের সীমান্ত্রপ্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি। অথচ কোন মুসলিম দেশের বিভক্তি বা অকল্যাণ কামনা করা ইসলামে হারাম। এটি কবিরা গুনাহ। তাই কোন মুসলমানের এটি কামনা হতে পারে না, এমন কামনা তো দুষমনদের। মুসলমানের কাজ তো পরস্পরে একতা গড়া, বিভক্তি গড়া নয়। পবিত্র কোরআনে তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম হল, “তোমার আল্লাহর রশিকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধর, পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না।” বিভক্তি বা বিচ্ছিন্নতা তাই ইসলামে হারাম। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের মাঝে ইসলামের অনুসরণ যখন তীব্রতর ছিল তখন মুসলিম ভূগোলের আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বাড়লেও রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়েনি। পরবর্তীতে বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে ইসলামে অঙ্গিকারহীন জাতীয়তাবাদী দুর্বৃত্তদের হাতে নেতৃত্ব যাওয়াতে।   

পাকিস্তানের বিনাশ যে বাঙালী সেকুলারিস্টদের কাছে আজও কতটা কাঙ্খিত তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে “জয় হিন্দ” ও “জয় বাংলা”র ন্যায় স্লোগান নিয়ে সিন্ধু প্রদেশেও গড়ে উঠেছিল জি.এম সৈয়দের বিচ্ছিন্নতাবাদী “‌‍জিয়ে সিন্ধ” আন্দোলন। সে আন্দোলনের ভিত্তিটা ছিল ভাষাভিত্তিক সিন্ধি জাতিয়তাবাদ। একই ভাবে সীমান্ত প্রদেশে তখন দানা বেঁধেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী পাঠানদের পখতুনিস্তান আন্দোলন। বিদ্রোহ গড়ে তোলা হয়েছিল বেলুচিস্তান প্রদেশেও। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পিছনে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল ভারত সরকারের। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের সংশ্লিষ্টতার সে বিবরণ তুলে ধরেছেন ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার “ইনসাইড র” বইতে। কিন্তু ভারতীদের মদদ সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতাবাদী সে আন্দোলন সিন্ধু ও সীমান্ত প্রদেশে বহু আগেই মৃত্যু বরণ করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় হল, বাংলাদেশের বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের চিন্তা-চেতনায় এখনও তা বেঁচে আছে। তাই শেখ হাসিনার সরকার সম্প্রতি পুরস্কৃত করলো পাকিস্তানের আমৃত্যু শত্রু মৃত জি.এম সৈয়দকে। অথচ এসব ভারতপ্রেমীরা এমনটি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে ভাবে না। জি.এম সৈয়দকে পুরস্কৃত করা এতটাই মহৎ কর্ম হয়ে থাকলে পুরস্কৃত করা উচিত ছিল আসামের উলফা নেতা এবং মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও। কারণ তারাও তো ভাষা ও অঞ্চল-ভিত্তিক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখে। অথচ তাদের পুরস্কৃত করা দূরে থাক, শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া উলফা নেতাদের গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এতটা প্রশংসনীয় হলে উলফাদের হাতে ১০ ট্রাক পৌছানোর জন্য তার নায়কদের জেলে না পুরে পুরস্কৃত করা উচিত ছিল। সে কাজটি গোপনে অন্যদের করতে না দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নিজের পক্ষ থেকে করা উচিত ছিল, যেমন ভারত করছে এবং এখনও করছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সত্য হল, ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের প্রদেশগুলোতে চলমান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার পক্ষ নিয়েছে দখলদার ভারতীয় বাহিনীর। তাদের কাছে অখণ্ড ভারতে স্বাধীনতার আওয়াজ তোলাই অপরাধ। অথচ তাদের কাছে তেমন একটি বিদ্রোহ পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য যদি সেটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হয়। তাই কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী ও আসামের উলফা নেতাদের প্রতি সামান্যতম সমর্থন দিতে রাজী নয়। অথচ সমর্থণ দিচ্ছে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। অথচ সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ বা বেলুচিস্তানকে কখনই সামরিক শক্তির বলে পাকিস্তানভূক্তি করা হয়নি, তারা পাকিস্তান ভূক্ত হয়েছিল স্বেচ্ছায়। অথচ কাশ্মীরকে ১৯৪৮ সালে ভারতভূক্ত করা হয়েছিল সে দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে; এবং সামরিক শক্তিবলে। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী এ এলাকাটি তাই অধিকৃত। আন্তর্জাতিক চাপে কাশ্মীরীদের ভাগ্য নির্ধারণে ভারত সেখানে গণভোট অনুষ্ঠানের ওয়াদাও করেছিল। কিন্তু সে ওয়াদা ভারত আজও পালন করেনি। ফলে স্বাধীনতার লড়াই চলছে ভারতীয় দখলদারির বিরুদ্ধে। সে দখলদারি বহাল রাখতে সেখানে অবস্থান নিয়েছে ৭ লাখ ভারতীয় সৈন্য। সে দখলদার ভারতীয় সৈন্যদের হাতে সেখানে ইতিমধ্যেই ৭০ হাজারের বেশী মুসলমানের মৃত্যু ঘটেছে, এবং ধর্ষিতা হয়েছে বহু হাজার মুসলিম নারী। আর্ন্তজাতিক মহলে প্রতিবাদ উঠলেও আওয়ামী সেক্যুলারিস্টদের মনে তা নিয়ে কোন নিন্দাবাদ নেই।

 

জিন্নাহ বিদ্বেষ ও ইতিহাস বিকৃতি

ঘৃনা-বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা মনের সুস্থ্যতা নয়, বরং জটিল নৈতিক রোগ। দৈহিক রোগে খাদ্য, পথ্য ও ঔষধ গ্রহণের সামর্থ লুপ্ত হয়। নৈতিক রোগ কেড়ে নেয় সত্য মেনে নেয়ার সামর্থ। বিশেষ করে সে সত্যটি যদি হয় রাজনৈাতিক প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক স্বার্থে তখন বরং বাড়ে মিথ্যাচর্চা ও ইতিহাস বিকৃতি। ১৯৪৭-এ ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশের ষড়যন্ত্র এবং একাত্তরের যুদ্ধে তিরিশ লাখের মৃত্যুর ন্যায় হিমালয়-সম মিথ্যার বিশাল বিশাল পাহাড় গড়া হয়েছে সে নৈতিক রোগের কারণেই। বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের মন যে শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই বিষপূর্ণ তা নয়, তাদের বিদ্বেষ ও ঘৃনা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিরুদ্ধেও। এটা নিশ্চিত যে, গান্ধি না হলেও ভারত স্বাধীন হত। কিন্তু জিন্নাহ না হলে ১৯৪৭-এ ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব ছিল। কারণ সে লড়াইটি শুধু মুসলিম বিদ্বেষী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল আধিপত্যবাদী ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের বিরুদ্ধেও। তখন প্রয়োজন ছিল এমন এক যোগ্য নেতার যিনি ভাষা, বর্ণ, গোত্র, আঞ্চলিকতা, মজহাব ও ফেরকার উর্দ্ধে উঠে সর্বভারতীয় মুসলমানদের একতাবদ্ধ করার সামর্থ রাখেন। কাজটি শুধু রাজপথে জনসভা ও বিক্ষোভের ছিল না। প্রয়োজন ছিল এমন এক প্রজ্ঞাবান উকিলের যিনি ব্রিটিশের দরবারে মুসলমানে দাবী-দাওয়া নিয়ে যোগ্যতার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনী লড়াই লড়তে পারেন। ভারতীয় মুসলমানগণ সেদিন সে গুণগুলি জিন্নাহর মধ্যে দেখেছিলেন। তারাই মি. জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম”’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। এ খেতাব ছিল মি.জিন্নাহর সে বিরল গুণেরই স্বীকৃতি। নেতা হিসাবে তাঁকে বেছে নেয়া যে সঠিক ছিল, কায়েদে আজম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেটি তিনি প্রমাণ করে গেছেন।

সত্য তো এটাই, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাতেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আধুনিক ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। শুধু পাকিস্তানের ইতিহাসে নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ৭ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসে জিন্নাহর স্থান এজন্যই অতি উচ্চে। সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে ভারত বিজয়ের পর ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাসে এটাই হল সবচেয়ে বড় বিজয়। ভারতীয় মুসলমানগণ পেশাওয়ার থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মীর থেকে মাদ্রাজ -এ বিশাল দেশে নানা ভাষা, নানা ফেরকা,নানা মাজহাবে তখন বিভক্ত। কোন একটি বিশেষ গোত্র, বর্ণ, অঞ্চল, ফেরকা বা ভাষাভাষীর নেতা হওয়া সহজ,এমন কি হালাকু ও চেঙ্গিজের ন্যায় বর্বর ব্যক্তিও নেতাও নেতা হতে পারে। এমন কি সম্ভব হয়েছিল শেখ মুজিবের ন্যায় গণহত্যাকারি বাকশালী স্বৈরাচারির পক্ষেও। কিন্তু এসবের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে বিশাল এলাকা জুড়ে বিভক্ত এক জনগোষ্ঠির নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় বিরল প্রতিভা, গভীর প্রজ্ঞা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের। তেমন এক বিস্ময়কর প্রতিভা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের বলেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতীয় মুসলমানদের নেতা হতে পেরেছিলেন। জিন্নাহর জীবনে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, বাঙালী, পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধি, গুজরাতি, শিয়া, সূন্নী, দেওবন্দি, বেরেলভী নানা ভেদ-ভেদাভেদের এ বিভক্ত মানুষকে তিনি একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেদিন নানা বাধা অতিক্রম করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সে একতার বলেই।

অথচ আজকের ন্যায় সেদিনও নেতার অভাব ছিল না। বাংলা, পাঞ্জাব, আসাম, বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশসহ ভারতের প্রতি প্রদেশেই তখন মুসলমানদের বহু নেতা ছিল। কিন্তু কায়েদে আজম ছিলেন সেসব নেতাদেরও নেতা। ‘কায়েদে আজম’ অর্থ শ্রেষ্ঠ নেতা। সে শ্রেষ্ঠ নেতাকে সেদিন মেনে নিয়েছিলেন এবং তার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন শেরে বাংলা ফজলূল হক,সোহরাওয়ার্দী,নাযিমউদ্দীন,নুরুল আমীন,ভাষানী,আবুল হাশিম,আকরাম খান ও শেখ মুজিবসহ বাংলা ও আসামের মুসলিম নেতারাও। বাংলাদেশের ন্যায় দেশে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় দল গড়লে মানুষ দলে দলে সে দলে শামিল হয়। এখানে সামরিক বাহিনীর চাপ প্রচণ্ড কাজ দেয়। কিন্তু সেদিন তাদের উপর কেউ চাপ প্রয়োগ করেনি। জিন্নাহর নেতৃত্বকে তারা সেদিন স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছিলেন।

জিন্নাহর সে বিরল ও বিশাল ব্যক্তিত্ব যে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের আলোড়িত করেছিল তা নয়, আন্দোলিত করেছিল সমগ্র ভারতের মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের্। এমনকি বাংলা সাহিত্যেও কায়েদে আজমকে নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে তা কোন বাঙালী নেতাকে নিয়ে লেখা হয়নি। তবে ভারতের আধিপত্যবাদী বর্ণহিন্দুগণ পাকিস্তান আন্দোলনকে যেমন মেনে নিতে পারিনি, তেমনি মেনে নিতে পারিনি সে আন্দোলনের নেতাকেও। ফলে জিন্নাহ পরিণত হয়েছিলেন তাদের পরম শত্রুতে। তাদের মনে জিন্নাহ-বিদ্বেষ এতটাই তীব্র ছিল যে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদেরও তারা এতটা গালি দেয়নি যতটা দিয়েছে জিন্নাহকে। সে ঘৃনা নিয়ে তারা জিন্নাহকে বলেছে ‘হাফ এডুকেটেড’ ব্যারিস্টার। বলেছে ক্ষমতালোভী, বলেছে সাম্প্রদায়িক। তবে তাদের সে ঘৃনা অনাকাঙ্খিত ছিল না। কারণ, তিনি তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলেন। অখণ্ড ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য নির্মানের স্বপ্নকে যিনি ভণ্ডুল করলেন, তাঁকে তারা শ্রদ্ধা দেখাবে সেটি কি আশা করা যায়?

 

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিষ-উদগীরণ

বাংলাদেশের বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের আচরণ শুধু অদ্ভূদই নয়, বিস্নয়করও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তাদের প্রচণ্ড গর্ব। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না পেলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা যে অসম্ভব ছিল সে বোধ কি তাদের আছে? বাংলাদেশের মুসলমানদের চেয়ে অধিক মুসলমানের বাস ভারতে, কিন্তু তাদের কি স্বাধীন হওয়ার সামর্থ আছে? সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের জিন্নাহবিরোধী হওয়ার হেতু আছে। কিন্তু বাংলাদেশীরা জিন্না্হবিরোধী হয় কি করে? তবে ইতিহাসের শিক্ষা,দাসদের নিজস্ব দর্শন,ধর্ম,জীবনবোধ বা সংস্কৃতি যেমন থাকে না। তেমনি বিচারবোধও থাকে না। মনিবের ধর্ম, দশর্ন ও সংস্কৃতিকেই তারা আপন করে নেয়। তেমনি মনিবের রায় বা ব্চিারই তাদের বিচার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের খৃষ্টান হওয়া ও তাদের অনুকরণে পোষাক-পরিচ্ছদ ও নামগ্রহণ করার কারণ তো এটাই। একই রূপ অবস্থা বাংলাদেশের ভারতসেবী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের জীবন ও জগত জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতির তীব্র জোয়ার তো একারণেই। ভারতীয় হিন্দুর ন্যায় তাদের মনেও প্রবল ঘৃনা পাকিস্তান ও তার প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আজমের বিরুদ্ধে। তাদের মন ও মনন যে কতটা বিষপূর্ণ সম্প্রতি তারই প্রকাশ ঘটেছে ভারতসেবী এ শিবিরের অন্যতম লেখক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখায়। গত ১২ সেপ্টম্বর (২০১১) দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় কায়েদে আজমের মৃত্যু দিবস উপলক্ষ্যে “আজ ‘কায়েদে আজম’ বেঁচে থাকলে কী ভাবতেন কী করতেন” শিরোনামে তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধটিতে তিনি অনেক অসত্য কথা বলেছেন,ঘটিয়েছেন জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি। উদগীরণ ঘটেছে তার মনে দীর্ঘ দিন ধরে জমা বিষের। লেখাটি শুরু করেছেন ভারতের মুসলমানদের দুরাবস্থা নিয়ে। অথচ সে নিদারুন দুরবস্থার জন্য তিনি ভারতকে দায়ী না করে দায়ী করেছেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা  ও তার নেতা কায়েদে আজমকে। ভারত সরকার ও তার মুসলিমবৈরী নীতি নিয়ে তিনি একটি কথাও লিখেননি। এদিক দিয়ে তিনি ভারতীয়দের চেয়েও ভারতীয়। মুসলমানদের এ পশ্চাদপদতা নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একটি কমিশন নিয়োগ করেছিলেন, সে কমিশন তার রিপোর্টও পেশ করেছে। সে রিপোর্টে মুসলমানদের এ নিদারুন দুরাবস্থার কারণ রূপে কায়েদ আজম বা পাকিস্তানের নাম নেই, যেমনটি আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী উল্লেখ করেছেন।

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর লেখাটি শুরুটা করেছেন এভাবে, “খবরটি ঢাকার একটি কাগজে বের হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ভারত তার দেশের মুসলমানদের সংখ্যা কম করে দেখাচ্ছে। ২০০১ সালে ভারতের আদমশুমারিতে দেখানো হয়েছে মুসলমানদের সংখ্যা ১৩ কোটি ৮০ লাখ। কিন্তু আমেরিকার হিসাব মতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। নয়াদিল্লির মার্কিন দূতাবাসের হিসাবে এই সংখ্যা ১৬ থেকে ১৮ কোটি।” আব্দুল গাফফার চৌধুরি তাঁর নিবদ্ধে মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো এ গোপন খবরটি উদ্ধৃত করে বুঝাতে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ভারত সরকার মুসলমানদের জনসংখ্যা নিয়ে কেন এ মিথ্যাচার ঘটাচ্ছে এবং মার্কিনীদের কাছেই বা কেন বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ মনে হল তা নিয়ে জনাব চৌধুরি কোন মন্তব্যই করেননি। সে খবরের গভীরে যাওয়ার চেষ্টাও করেননি। অথচ মার্কিন দূতাবাসের গোপন রিপোর্টের মূল লক্ষ্য ছিল, মুসলমানদের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করার ভারতীয় ষড়যন্ত্রটি তুলে ধরা। কোন দেশই তার দেশের সৈন্যদের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করে না। ভারতও তেমনি প্রকাশ করছে না মুসলমানদের প্রকৃত সংখ্যা। এখানে কাজ করে ভারতীয় বর্ণহিন্দু শাসক শ্রেণীর মুসলিম ভীতি। তাদের ভয়, মুসলমানদের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ পেলে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। সরকারি চাকুরিতে তারা আরো অংশিদারীত্ব দাবী করবে। তাতে আঘাত পড়বে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠিত কায়েমী স্বার্থে। বিষয়টি মার্কিনী দূতাবাসের কাছে ধরা পড়লেও আব্দুল গাফফার চৌধুরি তা নিয়ে নীরব। ভূতের ভয়ে আতংকগ্রস্ত মানুষ যেমন সব কিছুর মধ্যে ভূত দেখতে পায় তেমন অবস্থা জনাব চৌধুরির। আর এ রোগ তাঁর একার নয়, সকল ভারতসেবীরই। তাদের কাছে পাকিস্তান দায়ী শুধু বাংলাদেশের দুরাবস্থার জন্যই নয়, ভারতীয় মুসলমানদের পশ্চাদপদতার জন্যও।

 

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির মিথ্যাচারিতা

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির বুদ্ধিবৃত্তিক মিথ্যাচারিতা এবং সে সাথে বড় ধৃষ্টতা হল, যে কায়েদে আজমের প্রতি বাংলার প্রায় সকল নামকরা মুসলিম নেতা শ্রদ্ধা দেখালো তাকে তিনি অপরাধী রূপে খাড়া করেছেন। তিনি লিখেছেন, “গতকাল (রোববার) যখন আমার হাতে আসা ঢাকার কাগজে এই খবরটি পড়ছি, তখন চকিত মনে পড়ল, আজ ১১ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৮ সালের এই দিনে পাকিস্তানি মুসলমানদের দ্বারা সম্বোধিত ‘কায়েদে আজম’ ইন্তেকাল করেন। তিনি অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন ১০ কোটি মুসলমানকে একটি আলাদা জাতি বলে দাবি করে দেশটিকে ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ছুরিতে ভাগ করেছিলেন। মৃত্যুর ৬৩ বছর পর আজ যদি তিনি কবর থেকে হঠাৎ জেগে উঠতেন এবং জানতেন খণ্ডিত ভারতেই এখন মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি অথবা মার্কিন হিসাব অনুযায়ী ১৬ থেকে ১৮ কোটি, তাহলে তিনি কী করতেন? কী ভাবতেন? আরেকটি পাকিস্তান দাবি করতেন কি?” আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির দাবী, ‘জিন্নাহ শুধু পাকিস্তানীদের দ্বারা কায়েদে আজম রূপে সম্বোধিত হতেন’ এ কথাটি সত্য নয়। প্রকৃত যে সত্যটি তিনি ইচ্ছা করেই গোপন করেছেন তা হল, মি. জিন্নাহ ‘কায়েদে আজম’ রূপে সবচেয়ে বেশী সম্বোধিত হয়েছেন অবিভক্ত বাংলায়। এর প্রমাণ, জিন্নাহ যখন ‘কায়েদে আজম’ উপাধি পান তখন তার দল মুসলিম লীগের সরকার ছিল একমাত্র বাংলাতেই, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ বা সিন্ধুতে নয়।  বাংলা ছিল তার রাজনীতির মূল দূর্গ। পাকিস্তানের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশী বুঝেছিল বাংলার মুসলমানরাই। ১৯৪০ সালে ২৩শে মার্চ লাহোরের মিন্টো পাকে মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাবটি যিনি পেশ করেছিলেন তিনিও কোন পাঞ্জাবী, সিন্ধি বা  পাঠান ছিল না, ছিল বাঙালী মুসলমান ফজলুল হক।

“ভারতের বর্তমান ১৮ কোটি মুসলমানদের নিয়ে তিনি কী করতেন” -এ প্রশ্নের জবাব কায়েদে আজম  বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিই দিতেন। জবার কি দিতেন সেটি অন্য কারো পক্ষে বলা অসম্ভব। তবে বেঁচে থাকলে তিনি প্রচণ্ড আনন্দ পেতেন এ দেখে যে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা কতটা অপরিহার্য ও সঠিক ছিল। কংগ্রেসে পক্ষে তার “শো বয়” মাওলানা আবুল কালাম আযাদ যত কথাই বলুক, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের শাসনে মুসলমানদের যে কোন কল্যাণ নেই সেটি আজ ভারতের মুসলমানদের অধঃপতিত অবস্থা নিজেই প্রমাণ করছে। হিন্দুদের অধীনে ভারতীয় মুসলমানদের বঞ্চনা ও দুর্দশাগত যে জীবনের তিনি আশংকা করেছিলেন সেটিই সঠিক প্রমানিত হয়েছে। ভারতের সকল মুসলমানকে মুক্তি দিতে না পারলেও অন্তত দুই-তৃতীয়াংশকে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের ন্যায় দুঃসহ যাতনা থেকে উদ্ধার করাটি কি কম সফলতা? ডুবন্ত জাহাজের অর্ধেকের বেশী লোককে বাঁচানো কি কম কথা? পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তিরিশ কোটি মানুষ আজ পরাধীনতামূক্ত স্বাধীন জীবন পেয়েছে তো ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের বরকতেই। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং পারমাণবিক শক্তিধারি একমাত্র এ মুসলিম রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠা কি কম অর্জন? আজকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভারতের পেটের মধ্যে থাকলে তাতে ভারতের আয়োতন নিঃসন্দেহে আরো বিশাল হতো। ভারতীয় বর্ণবাদী উচ্চবর্ন হিন্দুদের সাম্রাজ্য লিপ্সা হয়তো আরো বলবান হতো। কিন্তু তাতে মুসলমানের কি গৌরব বাড়তো? জেলখানায় কয়েদীর সংখ্যা বাড়লে কি তাদের শক্তিও বাড়ে? পরাধীন ১৮ কোটি ভারতীয় মুসলমানের সাথে বরং যোগ হত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আরো বত্রিশ কোটি মুসলমান।

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির মত ভারতসেবী বুদ্ধিজীবীদের সমস্যা হল, তাদের গৌরব মুসলমান হওয়াতে নয়, বরং সেক্যুলার বাঙালী হওয়াতে। সে সুবাদে ভারতের সেক্যুলার বাঙালী হিন্দুদের সাথে তাদের মনের সংযোগ। ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে বহু আগেই। ফলে বিশ্বে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে তারা আনন্দ পান না, বরং কষ্ট পান সে রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা ও বলবান হওয়াতে। তাদের আনন্দ তো মুসলিম রাষ্ট্রের বিভক্তি ও বিনাশে, বরং উল্লাস বাড়ে ভারতের শক্তি ও গৌরব বৃদ্ধিতে। তাই স্বপ্ন দেখেন, অবশিষ্ঠ পাকিস্তান কবে টুকরো টুকরো হয়ে বিলুপ্ত হয় তা নিয়ে। তাদের কষ্ট তো ভারতের বিভক্তিতে। তাই ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি নিয়ে তারা কংগ্রেস ও বিজেপীর ক্যাডারদের ন্যায় মর্মবেদনায় ভোগেন।

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরি লিখেছেন, “ধর্মের ভিত্তিতে জাতিত্ব নির্ধারণ এবং দেশ ভাগ করার মতো সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক বুদ্ধি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো একজন আধুনিকমনা, পাশ্চাত্য শিক্ষিত নেতাকে কেমন করে পেয়ে বসেছিল তা ভাবলে এখন বিস্মিত হতে হয়। … তিনি অবিভক্ত ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের মধ্যে ৪ কোটিকে ভারতে রেখে ৬ কোটিকে নিয়ে পাকিস্তান গঠন করেছিলেন। ..তার বুদ্ধিতে কি এই কথা ধরা পড়েনি যে, এই চার কোটি মুসলমান ভারতে বাস করেই কালক্রমে ১৪ কোটি হয়ে দাঁড়াতে পারে! তখন তারা ভারতীয় হতে চাইলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছে সমান মর্যাদার ভারতীয় বলে গৃহীত হতে না-ও পারেন। তখন তাদের স্বার্থ, নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা ক্রমাগত ক্ষুণ্ণ হতে থাকবে বই বাড়বে না। ভারতে এখন মুসলমানদের ভাগ্যে তাই ঘটছে।”

জিন্নাহর বিরুদ্ধে তাঁর দোষারোপ, ধর্মের ভিত্তিতে তিনি জাতিত্ব নির্ধারণ করেছেন। সেক্যুলারিস্টদের এটি এক প্রবলতম রোগ। তাদের কাছে মানব জাতির বিভক্তিটা ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও ভৌগলিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। ধর্মীয় পরিচয় তাদের কাছে গুরুত্বহীন। অথচ মহান আল্লাহর কাছে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো তার ধর্মীয় পরিচয়। জান্নাতে স্থান প্রাপ্তি ঘটবে সে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে, ভাষা, বর্ণ বা অঞ্চলের ভিত্তিতে নয়। তাই আল্লাহর কাছে মানব জাতির বিভক্তিটা মূলত ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরিদের বিভাজনের সে নীতি ১৯৪৭-এ উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানের কাছে তাই গুরুত্ব পায়নি বাঙালী পরিচয়টিও। ফলে সেদিন বাংলার মুসলমানগণ বাঙালী হিন্দুদের সাথে একাত্ব না হয়ে একাত্ব হয়েছিল অবাঙালী মুসলমানদের সাথে। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির কাছে সেটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক মনে হলেও সেটিই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানাদের চেতনা। এবং এ চেতনা জনাব জিন্নাহর একার ছিল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি ছিল সে চেতনা।  পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে বটে, কিন্তু সে চেতনার কি মৃত্যু ঘটেছে? মৃত্যু ঘটলে কি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের কি কোন ভিত্তি থাকে? তা হলে পশ্চিম বাংলার ন্যায় বাংলাদেশও ভারতে বিলীন হয়ে যেত।

 

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে!

কায়েদে আযমের নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে দায়ী আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরি লিখেছেন, “তিনি ভারতের মুসলমানদের উপকার করার বদলে তাদের যে অপকার করে গেছেন, তার প্রমাণ আজকের ব্যর্থ এবং বিধ্বস্ত রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং ভারতের মুসলমানদের বর্তমান দুর্দশা ও দুরবস্থা।” আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরি এখানে ভারতের মুসলমানদের বর্তমান দুর্দশার সাথে পাকিস্তানের বিধ্বস্ত অবস্থার জন্যও জনাব জিন্নাহকে দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ, “জিন্নাহ উপকার করার বদলে অপকার করেছেন।” অথচ প্রকৃত সত্য হলো, পাকিস্তানের বর্তমান দুরাবস্থার জন্য দায়ী আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির ন্যায় সেক্যুলার নেতৃবৃন্দের নীতিহীনতা, জিন্নাহ নন। শেখ মুজিবের মত যেসব নেতারা ১৯৪৭-এ প্যান-ইসলামী চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে অবাঙালীদের সাথে মিলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তারা পরবর্তীতে সে নীতিতে অটল থাকতে পারেননি। তারা লিপ্ত হয়েছেন ক্ষমতা দখলের নোংরা রাজনীতিতে। এবং হাত মিলিয়েছেন পাকিস্তানের শত্রু পক্ষের সাথে। ফলে যে পক্ষটি ভারতের মুসলমানদের দুর্দশা বাড়িয়ে চলেছে তারাই ব্যর্থতা বাড়াচ্ছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের। জিন্নাহ বিশাল একটি ভূমি এবং সে সাথে সম্ভাবনার দ্বারকে উম্মূক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের মুসলমানদের ব্যর্থতা যে সে অমূল্য ভূমিকে তারা সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। এজন্য কি তাই জিন্নাহকে দায়ী করা যায়? এবং সে দায়ভার সবচেয়ে বেশী ছিল বাংলাদেশীদের। কারণ পাকিস্তানের ৫৬% জনগণ তো ছিল তারাই। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির যুক্তি, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার ফলেই ভারতীয় মুসলমানদের দুর্দশা বেড়েছে। এবং ভারতে বেড়েছে মুসলিম বৈরীতা। প্রশ্ন হল, ভারত সরকারকে মুসলিম বৈরী না হয়ে মানবিক হতে কি কায়েদে আজম নিষেধ করেছিলেন? পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই বা দায়ী হয় কি করে? কংগ্রেস ধর্মের উর্দ্ধে উঠে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের কল্যাণ চায় সে কথা ১৯৪৭ এর পূর্ব থেকেই বলে আসছে। কিন্তু সেটির বাস্তব প্রয়োগ কোথায়? সেটি কি মসজিদ-নির্মূল, মুসলিম হত্যা ও ধর্ষণ এবং তাদের বঞ্চনা বাড়িয়ে? তবে কায়েদে আযমের অসামান্য প্রজ্ঞা হল, তিনি ভারতীয় হিন্দুদের মনের কুৎসিত রূপটি যতটা নিখুঁত ভাবে দেখেছিলেন সেটি আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরিদের মত সেক্যুলারদের চোখে আজও ধরা পড়েনি। এমনকি হিন্দু সন্ত্রাসীদের হাতে বাবরী মসজিদের ধ্বংস, শত শত মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা, গুজরাতে মুসলিম নিধন, কাশ্মীরে গণহত্যা ও দখলদারি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফারাক্কা,টিপাইমুখ বাঁধ,সীমান্তে কাঁটাতার এবং বিএসএফের হাতে শত শত বাংলাদেশী হত্যার পরও। অথচ আজ থেকে ৭০ বছর আগেই কায়েদে আজম  সেটি সুস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেরেছিলেন। ফলে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে সেদিন তিনি অপরিহার্য ভেবেছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও সে বিপদ বুঝবার সামর্থ আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর মত লোকগুলোর বেড়েছে কতটুকু? পুলিশের চোখের সামনে দিন-দুপুরে ভারতে মসজিদ ধ্বংস করা হয়, ধর্ষিতা হয় হাজার হাজার মুসলিম নারী, এবং ধর্ষনের পর তাদেরকে আগুণে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সে অপরাধের জন্য কাউকে গ্রেফতার করা হয় না, আদালতেও তোলা হয় না। অরুন্ধুতি রায়ের মত বহু বিবেকমান ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হত্যা, ধর্ষন, লুটতরাজের ন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু সে প্রতিবাদের ভাষা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর মুখে যেমন নাই তেমনি নাই তাদের নেত্রী শেখ হাসিনারও নাই। নেই ভারতের কংগ্রেসী মুসলিম নেতাদেরও নেই। তারা বরং পাকিস্তানের সৃষ্টিকেই অনর্থক মনে করেন।

 

এতই কি তুচ্ছ তেইশ বছরের অর্জন? 

প্রশ্ন হল, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার ফলে মাত্র তেইশ বছরে মুসলমানদের যে উপকার হয়েছে সেটি কি এতটাই তুচ্ছ? ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা পাকিস্তানের বা বাংলাদেশের মুসলমানদের চেয়ে অধিক। কিন্তু পাকিস্তানের করাচী বা লাহোর বা ইসলামাবাদের ন্যায় একটি মাত্র শহরে যতজন ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আর্মি অফিসার, বিচারপতি, আইনবিদ, প্রশাসনিক আমলা আছে এবং তাদের হাতে যে পরিমান ধন-সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে তা কি ভারতের সমুদয় মুসলমানের আছে? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ২৩ বছরে যত জন বাঙালী মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, আর্মি অফিসার, বিচারপতি, আইনবিদ, প্রশাসনিক আমলা হতে পেরেছে তা ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরেরও কি তার দশভাগের এক ভাগ হতে পেরেছিল? তাছাড়া জনগণের উন্নয়নের মাপকাঠি শুধু সম্পদ, চাকুরি-বাকুরি ও শিক্ষা নয়, বরং বড় মাপকাঠি হল, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, জানমালের নিরাপত্তা, সুরক্ষিত ইজ্জত-আবরু এবং স্বাধীন জীবনের উপলদ্ধি। এক্ষেত্রেও পাকিস্তানের মুসলমানদের অর্জন কি কম? পাকিস্তানের একজন মুসলমান যতটা স্বাধীনতা, জানমালের নিরাপত্তা ও ইজ্জত-আবরু নিয়ে বসবাস করে তা কি কোন ভারতীয় মুসলমান কল্পনা করতে পারে?

জিন্নাহকে পাকিস্তানীরা কায়েদে আজম  তথা শ্রেষ্ঠ নেতা বলে সম্মান দেখায় সেটি আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাল লাগেনি। তাঁকে বরং হাফ এডুকেটেড ব্যারিস্টার বলে হেয় করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেষ্ঠ বলার চেষ্টা করেছেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব যে শ্রেষ্ঠ সেটি প্রমানের জন্য তিনি তাঁর এক পাকিস্তানী সাংবাদিক বন্ধুর মন্তব্য পেশ করে লিখেছেন, “লন্ডনে এক পাকিস্তানি সাংবাদিক-বন্ধু আমাকে বলেছেন, ‘তোমরা বড় ভাগ্যবান তাই শেখ মুজিবের মতো নেতা পেয়েছিলে। তিনি সময়মতো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের জংলি ফৌজি শাসন থেকে মুক্ত করে আলাদা স্বাধীন দেশ না করলে এখন পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে তোমরাও একদিকে তালেবানি সন্ত্রাসে জর্জরিত এবং অন্যদিকে মার্কিনী ড্রোন হামলার শিকার হতে। তোমরা এখন এই গ্রেট লিডারের সামান্য ভুলত্রুটির যতই সমালোচনা কর, একথা ভুললে চলবে না, তিনি তোমাদের স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একটি স্বাধীন নেশন স্টেট উপহার দিয়ে গেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সহমরণে তোমাদের যেতে হয়নি।’ আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির যে বন্ধুটি শেখ মুজিবকে গ্রেট লিডার বলেছেন সে শেখ মুজিব যে বাংলাদেশকে “তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি” রূপে বিশ্ব মাঝে পরিচিত করেছিলেন সে বিষয়টি কি তিনি জানেন না? জিন্নাহর পাকিস্তান আর যাই হোক তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি হয়নি। তিনি পাকিস্তানে একদলীয় বাকশালও প্রতিষ্ঠা করেননি। নিরস্ত্র দেশবাসীর উপর রক্ষিবাহিনীর নির্মম অত্যাচারও নামিয়ে দেননি। বরং আজকের যে বাংলাদেশ সেটিও সম্ভব হয়েছে জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায়।  

 

বাঙালীর চেতনা ও সাহিত্যে কায়েদে আজম

কায়েদে আজমকে কেন কাযেদে আজম বলা হল, তা নিয়েও আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ক্ষোভ। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানী আমলে নিছক ঘটা করেই কায়েদে আজমের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করা হত। তার সাথে বাঙালীর মনের যোগ ছিল না। তাঁর অভিযোগ, জনাব জিন্নাহকে কায়েদে আজম বলার সাথে তাঁর জন্মদিবস ও মৃত্যু দিবস পালনে বাঙালীদের বাধ্য করা হত। কিন্তু তাঁর এ কথা যে অসত্য সে সাক্ষী খোদ বাংলা সাহিত্য। কায়েদে আজম বাঙালী ছিলেন না। কিন্তু তারপরও তাঁকে নিয়ে বাঙালী কবি-সাহিত্যিকেরা যত কবিতা লিখেছেন তা কি আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির গ্রেট লিডারকে নিয়েও কি লেখা হয়েছে? ভয়ভীতিতে সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। কাউকে কবিতা লিখতে বাধ্য করা যায় না। কবিতা লেখার প্রেরণাটি মনের গভীর থেকে। কায়েদে আজমের প্রতি বাঙালী মুসলমানের শ্রদ্ধাবোধ যে কতটা গভীর ও অকৃত্রিক ছিল বাংলা কবিতা থেকে তার কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। অন্য কেউ নন, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরিদের স্বপক্ষীয় কবি খোদ বেগম সুফিয়া কামাল কায়েদে আজমকে নিয়ে লিখেছেন,

“তসলীম লহ, হে অমর প্রাণ! কায়েদে আজম, জাতির পিতা!

মুকুট বিহীন সম্রাট ওগো! সকল মানব-মনের মিতা।

অমা-নিশীথের দুর্গম পথে আলোকের দূত! অগ্রনায়ক!

সিপাহসালার! বন্দী জাতিরে আবার দেখালে মুক্তি-আলোক।”

                 – (মাহে নও। ডিসেম্বর ১৯৫৯)।

 

অন্য এক কবিতায় তিনি লিখেছেন,

“জাতির পতাকা-তলে একত্রিত সকলে তোমারে

স্মরণ করিছে বারে বারে,

তোমার আসন আজও  সকলের হৃদয়ের মাঝে

তোমারে লইয়া ভরে আছে।

যুগে যুগে তুমি তব দানের প্রভায়

চিরঞ্জীব হয়ে র’বে আপনারী দিব্যি মহিমায়।

কায়েদে আজম। তবদান

মহাকাল-বক্ষ ভরি রহিবে অম্লান।”

                -(মাহে নও। ডিসেম্বর ১৯৫৫)

 

সুফিয়া কামাল আরেক কবিতায় লিখেছেন,

“হে সিপাহসালার! তব দৃপ্ত মনোরথে

ছুটাইয়া টুটাইয়া জিন্দানের দ্বার

আনিলে প্রদীপ্ত দীপ্তি ঘুচায়ে শতাব্দী অন্ধকার

মৃত্যু নাহি যে প্রাণের ক্ষয় নাহি তার দেয়া দানে

লভি আজাদীর স্বাদ, এজাতি-জীবন তাহা জানে

তোমার জনম দিনে, তোমার স্মরণ দিনে

কায়েদে আজম! তব নাম

কোটি কন্ঠে ধ্বনি ওঠে, কহে, লহ মোদের সালাম।”

                         –(পাক-সমাচার। ডিসেম্বর: ১৯৬৩)। 

 

কায়েদে আজম স্মরণে সিকান্দার আবু জাফর লিখেছেন,

“ডোবেনি যে রবি, নেভেনি যে আলো

মুছিবে না কোন কালে,

এই কালে পৃথিবীর ভালে

জ্যোতি-প্রদীপ্ত উজ্বল সেই

সূর্য্যের প্রতিভাস

সে রচিয়া গেছে মৃত্যুবিহীন

আপনার ইতিহাস।

সে ছড়ায়ে গেছে মৃত্যুঞ্জয়ী

মহাজীবনের বীজ,

সে ফোটায়ে গেছে লক্ষ বুকের

তিমির সরসী নীরে

চির প্রভাতের আনন্দ সরসিজ।

মৃত্যু ‘অতীত জীবন তাহার

মৃত্যু সাগর তীরে

দিগন্তহীন সীমা বিস্তৃত জীবনের মহাদেশে

যুগ-যুগান্ত সে আসিবে ফিরি ফিরে।

বহু মৃত্যুর দিগন্ত হতে সে এনেছে কেড়ে

জীবনের সম্মান;

ক্ষয় নাহি তার নাহি তার অবসান।  

অযুত মৌন কন্ঠ ভরিয়া নব জীবনের গান

ফোটা যে বারে বারে

মৃত্যু কি তারে স্তব্ধ করিতে পারে? 

           -(শাহেদ আলী সংকলিত, ১৯৮৯)

 

 

আওয়ামী লীগ আমলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং বাংলা এ্যাকাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ডঃ মাযহারুল ইসলাম লিখেছেন,

“সহসা আলোর পরশ লাগালো

প্রাণে প্রাণে এক চেতনা জাগলো

আধার দুয়ার খুলে গেল সম্মুখে

কে তুমি হে নব-পথ-সন্ধানী আলোকদ্রষ্টা?

কে তুমি নতুন মাটির স্রষ্টা?

যে এনেছে বুক জুড়ে আশ্বাস

যে দিয়েছে সত্তা নিয়ে বাঁচবার বিশ্বাস

অগণন মানুষের হৃদয়-মঞ্জিলে

-সে আমার কাযেদে আজম

আমার তন্ত্রীতে যার ঈমানের একতার

শৃঙ্খলার উঠিছে ঝংকার

সুন্দর মধুর মনোরম।” -(শাহেদ আলী সংকলিত, ১৯৮৯)

 

ড. মাজহারুল ইসলাম অন্য এক কবিতায় কায়েদে আজম সম্পর্কে লিখেছেন,

“আঁধারের গ্লানিভরা জাতির জীবন

কোথাও ছিল না যেন প্রাণ স্পন্দন

মৃত্যু­-তুহীন দিন গুণে গুণে এখানে ওখানে

শুধু যেন বারবার চলিষ্ণু পখের প্রান্তে ছেদ টেনে আনে

ম্লান পথ হয়ে ওঠে আরো ঘন ম্লান

আঁধারে বিলীন হলো মুক্তি-সন্ধান।

তারপর মৃত্যু-জয়ী সে এক সৈনিক

সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে নেমে এলো আঁধারের পথে

চোখে মুখে অপূর্ব স্বপন

হাতে আঁকা অপরূপ নতুন দেশের রূপায়ন

এ মাটিতে সে এক বিস্ময়,

মৃত বুকে প্রাণ এলো

মুক্তির চেতনা এলো।

প্রাণ যাক তবু সেই স্বপ্ন হোক জয়

নির্বিকার ত্যাগের আহবান!

পথে পথে রক্তের আহবান।

  -মাটির ফসল, -(শাহেদ আলী সংকলিত,১৯৮৯)

 

বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক এবং ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জনাব আবু হেনা মোস্তাফা কামাল কায়েদে আজমের সম্মানে লিখেছেন,

“প্রদীপ্ত চোখে আবার আকাশকে দেখলাম

পড়লাম এক উজ্বল ইতিহাসঃ

সে ইতিহাসের পাতায় পাতায় একটি সোনালী নাম…

আবার আমরা আমরা চোখ তুলে তাই দেখলাম এ আকাশ।

 

তোমাকে জেনেছি আকাশের চেয়ে বড়—

সাগরের চেয়ে অনেক মহত্তর—

কেননা ক্লান্ত চোখের পাতায় নতুন আলোর ঝড়

তুমি এনে দিলে । নতুন জোয়ার ছুঁয়ে গেল বন্দর।

        -(মাহে নওঃ ডিসেম্বর ১৯৫৩)     

 

কায়েদে আজমের মৃত্যুতে সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন,

“অনুর্বর প্রহরে আমার-প্রাণ দিলে সুর দিলে তুমি,

আমার মৃত্তিকালদ্ধ ফসলের ভিত্তিভূমি তুমি।

প্রতিকূল প্রহরের প্রবঞ্চনা ফিরে গেল অসীম কুন্ঠায়,

আসলাম দীপ্ত পথে খরতর সূর্যের আশায়।

তুমি সে সূর্যের দিন,তুমি তার আরম্ভের প্রভা,

সবুজের সমারোহ জীবনের দগ্ধ দিন

প্রাণের বহ্নিব মোহে জেগে উঠে নতুন সঙ্গীতে-

অপূর্ণ জীবন আজ পরিপূর্ণ হলো বন্ধু তোমার ইঙ্গিতে।

মানব কন্ঠে যে সুর জাগালে তুমি,

সে সুরে এবার তুলে কল্লোল আমার জন্মভূমি।

–        নয়া সড়ক (বার্ষিকী), (সংকলনে শাহেদ আলী, ১৯৮৯)।

  

পাকিস্তানে লড়াই ও আত্মসমর্পিত বাঙালী সেক্যুলারিস্ট

 পাকিস্তান কেন আজও বেঁচে আছে সেটিই জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরির কাছে বিস্ময়। তাঁর কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের ব্যর্থতাগুলো। ১৯৪৭শে দেশটির প্রতিষ্ঠার কারণে যে ৩০ কোটি মানুষ স্বাধীন জীবনের স্বাদ পেল সেটি তাঁর কাছে কোন গুরুত্বই পেল না। তিনি পাকিস্তানের প্রতি নিজের ঘৃনাবোধটি তুলে ধরেছেন এভাবে, “ভারত থেকে ভাগ করে এনে তৎকালীন যে ছ’কোটি মুসলমানের জন্য তিনি ‘সাধের পাকিস্তান’ গড়লেন, তার অবস্থাই বা এখন কী? .. রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীদের অংশ পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যায়। খণ্ড পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশ হিংস্র জঙ্গিবাদের এখন লীলাভূমি এবং মিত্র আমেরিকার বর্বর ড্রোন বোমা হামলায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। পাকিস্তানের মুসলমানরা শিয়া-সুন্নি, আহমদিয়া-সুন্নি, মোহাজের ও অমোহাজের ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত হয়ে আত্মঘাতী বিবাদে লিপ্ত এবং আল কায়দা ও তালেবানরা সেখানে তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।” 

এটি সত্য, পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক। সেখানে ড্রোন হামলা আছে, বোমা বিস্ফোরণও আছে। কিন্তু দেশটির বেঁচে থাকার লড়াই তো আজ থেকে নয়, তার জন্ম থেকেই। শুধু ড্রোন নয়, দেশটিকে ১৯৪৮, ১৯৬৫ ও ১৯৭১-এ তিনটি বড় বড় যুদ্ধও লড়তে হয়েছে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও ভারতের ন্যায় আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান একটি ফ্রণ্টলাইন স্টেট। সে যুদ্ধ এখনও চলছে। তবে ভারতপন্থি জাতিয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের কাছে বাংলাদেশ যেমন অরক্ষিত ও অধিকৃত, পাকিস্তানে সেটি ঘটেনি। বরং তারা জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের পরাজিত করেছে সিন্ধুতে, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে। সীমান্ত প্রদেশে ছিল কংগ্রেসী সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফ্ফার খানের ঘাঁটি। শেখ মুজিবের বহু আগে তাঁর জন্ম। রাজনীতিতে তাঁর শিকড়ও ছিল গভীরে। পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম আঘাতটি হেনেছিল তাঁর অনুসারিরাই। কিন্তু সে ঘাঁটিতে তাঁর অনুসারিরা আজ পরাজিত। তাঁর সে পাখতুনিস্তান আন্দোলন আজ বিলুপ্ত। সিন্ধুতে “জিয়ে সিন্ধ” আন্দোলনও ছিল পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আরেক ষড়যন্ত্র। কিন্তু আজ  তারাও সেখানে পরাজিত।

দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার পরাজয়ে,এবং সে সাথে বিশ্বশক্তির মঞ্চ থেকে দেশটির বিলুপ্তিতে। লড়াইয়ের সে চেতনা নিয়েই পাকিস্তান গড়ে তুলে পারমানবিক বোমা ও দূরপাল্লার মিজাইলের ভাণ্ডার। নিজ দেশে নির্মাণ করছে যুদ্ধি বিমান যা বিদেশেও বাজার পাচ্ছে। পাকিস্তান আজ লড়াইয়ে লিপ্ত খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমর্থন দিচ্ছে কাশ্মরীদের। তাছাড়া দেশটির অভ্যন্তরে দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে সেক্যুলারিষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইও। দ্বিজাতি তত্ত্ব শুধু ভারতে নয়, প্রবল ভাবে সক্রিয় পাকিস্তানেও। সেখানে আল্লাহর অনুসারি মুসলমান যেমন আছে, তেমনি শয়তানের অনুসারি প্রচণ্ড দুষমনও আছে। ফল লাগাতর লড়াইও আছে। দেশটি একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে পরাজিত হয়েছে,কিন্তু সে পরাজয়ের পরও যুদ্ধ শেষ হয়নি। লড়াই চলছে অবিরাম। অবিরাম লড়াই যে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সেটিই তো শক্তি, সাহস ও জীবনের লক্ষণ। সভ্যতা তো সেখানেই নির্মিত হয়, যে এলাকার মানুষ লাগাতর লড়াই করতে জানে। তেমন লড়াই কি বাংলাদেশে আছে? কোন অধিকৃত দেশের মজলুল মুসলমানের সমর্থনে বাংলাদেশ কোনকালেও কি কিছু করেছে? নবীজীর আমলে মাত্র ১০ বছরে সাহাবায়ে কেরাম যত যুদ্ধ লড়েছেন বাঙালীরা কি বিগত ৭ শত বছরেও লড়েছে? লড়েনি। ফলে সভ্যতা গড়ে উঠেছে আরবের ধূসর মরুতে, বাংলাতে নয়। আত্মসমর্পিত দাস জীবনে লড়াই থাকে না, অস্থিরতাও থাকে না। কিন্তু তাতে কি গৌরব বাড়ে? গড়ে উঠে কি উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি? বাংলাদেশে যুদ্ধ নাই, কিন্তু তাতে কি ইজ্জত বেড়েছে? বরং ৫ বার জুটেছে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের খেতাব। যে কোন সৃষ্টি কাজে প্রচণ্ড প্রসব বেদনা আছে। লক্ষ্য যেখানে স্বাধীনতা ও সম্মান নিয়ে বাঁচা, সেখানে লাগাতর এ লড়াই থেকে কি নিস্তার আছে? প্রতি কদম সেখানে এগুতে হয় লড়াই করে। বিজয় আনতে হয় বিপুল রক্তের দামে। পাকিস্তানীরা আজ সে মূল্যটিই দিচ্ছে। এমন কি নবীজীর সামনেও এছাড়া বিকল্প পথ ছিল না। পাকিস্তানের দিল্লির কাছে আত্মসমর্পিত মন নিয়ে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরিরা কি সে সত্যটি বুঝেন? ২৮/০৯/১১

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *