বাঙালী সেক্যুলারিস্টদের একাত্তরের অপরাধ ও বাংলাদেশের আজকের সংকট
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on February 26, 2021
- Bangla Articles, সমাজ ও রাজনীতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
বাঙালী মুসলিম জীবনে একাত্তর
পরীক্ষা শুধু ব্যক্তির জীবনে আসে না; জাতীয় জীবনেও আসে। জাতীয় জীবনে পরীক্ষায় পাশের উপর নির্ভর করে জাতি হিসাবে বিশ্ব মাঝে বিজয় ও সন্মান নিয়ে বাঁচা। প্রতিটি জাতির মাঝেই কিছু ভাল লোক থাকে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়টি সে স্বল্প সংখ্যক মানুষদের কারণে অর্জিত হয় না। এখানে বিচার হয় সমগ্র জনগণের। জনগণের পরীক্ষা হয় ঈমান, ঐক্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, শত্রু-মিত্রের পরিচয়, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ভাঙ্গার বদলে গড়ার সামর্থ্য নিয়ে বাঁচার যোগ্যতার। সে পরীক্ষায় ফেল করলে বাড়ে পরাজয়, বিপর্যয় ও অপমান। তেমন একটি পরীক্ষা ১৯৭১’য়ে বাঙালী মুসলিম জীবনেও এসেছিল। বাঙালী মুসলিমগণ সে পরীক্ষায় নিদারুন ভাবেই ফেল করেছে। তারা চিনতে ব্যর্থ হয়েছে শত্রুকে। ফলে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের ন্যায় শত্রুর পেটে। অন্যরা গড়া নিয়ে গর্ব করে, বাঙালীরা গর্ব করে ভাঙ্গা নিয়ে। সেটি বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ভাঙ্গার। কবরে পাঠিয়েছে গণতন্ত্রকে। এনেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাব। বাঙালীর সমগ্র ইতিহাসে এমন বিপর্যয় ও অপমান আর কোন কালেই জুটেনি। বাঙালী মুসলিম ইতিহাসের এ হলো এক কালো অধ্যায়। এবং জনগণের চেতনা ও চরিত্রের গভীর পচনটি ধরা পড়ে শেখ মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচারী, গণতন্ত্র হত্যাকারী, তিরিশ হাজারের বেশী মানবহত্যকারী ও ভারতের এজেন্টকে জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু বলার মধ্য দিয়ে।
মুসলিম জীবনের পুরস্কারটি বিশাল। সেটি জান্নাত। জান্নাতের এক ইঞ্চি ভূমিও হিমালয়ের সমান স্বর্ণ দিয়ে কেনা যায় না। সে পুরস্কার লাভের জন্য পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। এবং সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি হয় রাজনীতিতে। কারণ মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন বিজয়ী হবে কি হবে না, সেটি মসজিদ-মাদ্রাসা এবং নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে মুসলিমগণ রাজনীতির অঙ্গণে ইসলামকে কতটা বিজয়ী করতে পারলো তার উপর। একমাত্র রাজনীতির অঙ্গণেই পরীক্ষা হয় অন্যায়ের নির্মূলে ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় শ্রম, অর্থ, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগের সামর্থ্যের।
অন্যদের কাছে রাজনীতি ক্ষমতাদখলের হাতিয়ার। ফলে সে রাজনীতিতে যেমন মিথ্যাচার ও ভন্ডামী আছে, তেমনি সন্ত্রাস ও ভোটডাকাতিও আছে। আছে শত্রুদেশকে নিজ দেশের অভ্যন্তরে ডেকে আনার ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশে সেরূপ ষড়যন্ত্র যেমন একাত্তরে ঘটেছে, তেমনি আজও হচ্ছে। কিন্তু ঈমানদারের কাছে রাজনীতি হলো ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামিকরণের ইবাদত। তাই এটি পবিত্র জিহাদ। ইবাদতের রাজনীতির সে পবিত্র সূন্নত প্রতিষ্ঠা করতেই নবীজী (সা:) নিজে আমৃত্যু রাষ্ট্র-প্রধান থেকেছেন। এটিই নবীজী (সা:)’র শ্রেষ্ঠ সূন্নত। এ পথেই আসে ইসলামের বিজয়। তখন মহান আল্লাহতায়ালার জমিনে প্রতিষ্ঠা পায় তাঁরই সার্বভৌমত্ব।
প্রশ্ন হলো, মহান নবীজী (সা:) যে আসনে বসেছেন সে আসনে কি চোর-ডাকাত, ভোট-ডাকাত ও দুর্বৃত্তদের বসানো যায়? সেটি হলে, ঘটে উল্টোটি। তখন দেশ দুর্বৃত্তিতে রেকর্ড গড়ে –যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশে। গলিত আবর্জনার মাঝে সভ্য জীবন অসম্ভব। জীবন দুর্ভিষহ হয় দেশ দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে। তাই সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মটি দুর্বৃত্ত শাসনের নির্মূল। ইসলাম এ কাজকে জিহাদ তথা শ্রেষ্ঠ ইবাদতের মর্যাদা দিয়েছে। এজন্যই দেশের শাসনক্ষমতা দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হলে, তাদের সরানো প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ হয়ে যায়। এ ফরজ ইবাদতটি পালিত না হলে তখন নবীজী (সা:)’র শিক্ষাও পালিত হয়না। তখন শত্রুর হাতে শুধু পরাজয়ই আসে না, আসে মহান আল্লাহতায়ার পক্ষ থেকে আযাব। দুর্বৃত্ত শাসন তখন আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হয়।
প্রতি পেশা, প্রতি কর্ম ও প্রতি আচরনে পথ দেখায় পবিত্র কোর’আন। কিন্তু বেঈমানেরা সে পথে চলতে রাজি নয়। তারা চায়, নিজেদের স্বৈরাচারি স্বার্থসিদ্ধি। এবং সে স্বৈরাচারি স্বার্থসিদ্ধিকে বাধাহীন করার স্বার্থেই তারা দেশের সংবিধান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত, প্রশাসন, পুলিশ ও সেনাদফতরের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশাবলির প্রবেশাধিকার দিতে রাজি নয়। অথচ মু’মিনের ঈমানদারি হলো, ইসলামের প্রতিটি বিধান মেনে চলায় আপোষহীন হওয়া। তাই শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতে ফরজ-ওয়াজেব মানলে চলে না, ফরজ-ওয়াজেব এবং নবীজী (সা:) সূন্নতগুলি মানতে হয় রাজনীতিতেও। এ ক্ষেত্রে অবহেলা বা বিদ্রোহ হলে অনিবার্য হয় অনন্ত-অসীম কালের জন্য জাহান্নামের আগুণে পৌঁছা।
মাত্র একটি হুকুম অমান্য করায় অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়েছে ইবাদতে মশগুল থাকা ইবলিস। একই কারণে, রাজনীতির অঙ্গণে মহান আল্লাহতায়ালার কোন একটি হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটলে নামাযী ব্যক্তিও শয়তানকে পরিণত হয়। ঈমানদার ব্যক্তির জীবনে প্রতিক্ষণের ভাবনা তাই প্রতিপদে পবিত্র কোর’আনে বর্নিত বিধানের পূর্ণ অনুসরণের –সেটি রাজনীতিতে হোক বা শিক্ষা-সংস্কৃতি বা আইন-আদালতে হোক। প্রদর্শিত সে পথটি হলো সিরাতুল মুস্তাকীম। এখানে অবাধ্য বা বিদ্রোহী হলে ঈমান থাকে না। অন্য কোন সফলতাই এমন ব্যক্তিকে জাহান্নামে পৌঁছা থেকে বাঁচাতে পারে না। ঈমানদারের জীবনে প্রতি মুহুর্তে এটিই হলো পরীক্ষা। জান্নাতপ্রাপ্তি তো ঘটে সে পরীক্ষায় পাশের মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহতায়ালার সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“মানুষ কি ভেবে নিয়েছে যে, ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং পরীক্ষা করা হবে না? আমরা তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছি এবং জেনে নিয়েছি ঈমানের দাবিতে কারা সাচ্চা এবং কারা মিথ্যাবাদি।” –(সুরা আনকাবুত, আয়াত ২-৩)। জীবনের চুড়ান্ত পরীক্ষাটি হয় রাজনীতিতে। এখানে নিরপেক্ষ থাকার উপায় নাই, তাকে একটি পক্ষকে সমর্থণ দিতেই হয়। ফলে ধরা পড়ে সে কোন পক্ষে দাঁড়ালো, ভোট দিল বা অস্ত্র ধরলো। নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতে সেরূপ কোন পক্ষ নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না; ফলে সুযোগ থাকে নিজের মুনাফিকি লুকানোর। বাঙালী মুসলমানের জীবনে একাত্তর এসেছিল তেমনি এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা পর্ব নিয়ে।
একই উৎসবে বাঙালী মুসলিম ও ভারতীয় কাফের!
বাঙালী মুসলিমের একাত্তরের পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধজয়টি দেশ-বিদেশের জাতীয়তাবাদী, সমাজবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, মুর্তিপূজারী, গো-পূজারী, ইহুদী-খৃষ্টান ও নাস্তিকদের কাছে অতি প্রশংসিত। প্রতিবছর সে বিজয় নিয়ে বাংলাদেশে যেমন উৎসব হয়, তেমনি উৎসব হয় ভারতেও। এ উৎসবটি বাঙালী মুসলিমগণ ভারতীয় কাফেরদের সাথে একত্রে করে। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে এমন ঘটনা দ্বিতীয়টি নাই। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার কাছেও কি বাঙালী মুসলমানের একাত্তরের কর্মটি শ্রেষ্ঠ কর্ম রূপে বিবেচিত হবে? একাত্তর নিয়ে বহু বই লেখা হয়েছে, বহু আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের সে পরীক্ষাপর্বে মহান আল্লাহতায়ালার বিধান কতটুকু মানা হয়েছে -সে বিচার কি কখনো হয়েছে? তা নিয়ে লেখা হয়েছে কি কোন বই? অথচ এটি ঈমানী দায়বদ্ধতা যে প্রতিটি মুসলিম তার প্রতিটি কর্মকে মিলিয়ে দেখবে -কতটা মানা হয়েছে কোর’আনের বিধানকে। প্রচণ্ড অবজ্ঞা হয়েছে এ ক্ষেত্রে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে এ নিয়ে বিচার অবশ্যই বসবে। তখন কি জবাব হবে বাঙালী মুসলিমের? প্রতিটি মুসলিমকে সেদিন শুধু নামায-রোযার হিসাব দিলেই চলবে না, রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহে তার নিজস্ব ভূমিকারও হিসাব দিতে হবে।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে রাজনীতির গুরুত্বটি অপরিসীম। জীবন ও জগত নিয়ে ব্যক্তির ধ্যান-ধারনাগুলি কীরূপ এবং সে কোন পক্ষের লাঠিয়াল -সেটি জায়নামাজে প্রকাশ পায় না। প্রকাশ পায় রাজনীতিতে। মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধানের প্রতি কে কতটা অনুগত বা বিদ্রোহী -সেটিরও প্রকাশ ঘটে রাজনীতিতে। রাজনীতির বিজয়ী পক্ষই নির্ধারণ করে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় নীতি, অর্থনীতি, আইন-আদালত কোন দিকে পরিচালিত হবে। রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ আনে ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উপর। মহান রাব্বুল আ’লামীন তাই মানব জাতির এরূপ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরব থাকেন কীরূপে? তাই তাঁর যুদ্ধটি স্রেফ মুর্তিপূজারি, অগ্নিপূজারি, দেব-দেবী পূজারি বা নাস্তিকদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ফিরাউন-নমরুদদের ন্যায় রাজনীতির কর্ণধারদের বিরুদ্ধেও। নিজেদের এবং সে সাথে অন্যদের জীবনকে যারা সিরাতুল মোস্তাকীমে পরিচালিত করতে চায় -রাজনীতির নিয়ন্ত্রনকে স্বহস্তে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প পথ নেই। খোদ নবীজী (সা:) ও তাঁর মহান খলিফাদের এ জন্যই রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসতে হয়েছে। রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে বসা ও নেতৃত্বের দায়ভার স্বহস্তে নেয়া তাই নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। ইসলামের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় এ সূন্নত পালনের মধ্য দিয়ে। মহান নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের জানমালের বেশীর ভাগ ব্যয় হয়েছে সে সূন্নত পালনে। ইসলামে এটি পবিত্রতম জিহাদ। রাজনীতির ময়দানে ঈমানদার ব্যক্তি তাই নীরব দর্শক নয়,তার অবস্থান বরং প্রথম সারিতে।
বিকল্প নাই ঐক্য ও সামরিক বলের
রাজনীতিতে মূল ফরজটি হলো অসত্য ও অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। হারাম হলো যারা শরিয়তের প্রতিষ্ঠা বিরোধী এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিরোধী তাদের সমর্থণ করা ও তাদের ভোট দেয়া বা তাদের পক্ষে যুদ্ধ করা। কিন্তু রাজনীতির ফরজ পালন কি এতোই সহজ? বিশ্ব তো অধিকৃত আল্লাহর শত্রুপক্ষের হাতে; এবং পরাজিত মহান আল্লাহতায়ালার কোর’আনি বিধান ও তাঁর সার্বভৌমত্ব। কোন একক ভাষা ও একক দেশের মুসলমানদের পক্ষে কি সম্ভব মহান আল্লাহর দ্বীনের শত্রুদের পরাজিত করা? নানা ভাষা ও নানা বর্ণের শত্রুগণ তো গড়েছে আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন। ইরাক ও আফগানিস্তান দখলে রাখতে এ কোয়ালিশন পাঠিয়েছিল ৪০টি দেশের সেনাবাহিনী। মুসলিমগণ কি তাই ভাষা, ভূগোল, অঞ্চল বা বর্ণের নামে বিভক্ত হতে পারে?
বিভক্তি কোন কালেই বিজয় ও স্বাধীনতা আনে না। আনে পরাধীনতা। ইসলামে ভাষা বা বর্ণভিত্তিক বিভক্তির জাতীয়তাবাদি রাজনীতি এজন্যই কবিরা গুনাহ। অথচ সে কবিরা গুনাহর রাজনীতিই ১৯৭১ সালে বিজয়ী হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এবং সে বিজয় নিয়ে আজ উৎসবও হয়। ভাষাভিত্তিক রাজনীতি করে বাংলার মুসলিমদের পক্ষে কি একাকী সম্ভব ছিল ১৯৪৭য়ে স্বাধীনতা অর্জন? ভারতের বাঙালী, গুজরাটি, মারাঠী, বিহারী,পাঞ্জাবী, তামিল, কাশ্মিরী ও আসামী হিন্দুগণ ভাষার ভেদাভেদ ভূলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে আজও একতাবদ্ধ। তারা একতাবদ্ধ ছিল ১৯৪৭’য়েও। অথচ রাজনীতির ময়দানের এরূপ একতাবদ্ধ হওয়াটি হিন্দুদের উপর ধর্মীয় ভাবে ফরজ নয়। কিন্তু অনিবার্য ফরজ হলো মুসলিমদের উপর। একাকী স্বাধীনতার পথ ধরতে গিয়ে কাশ্মিরের শেখ আব্দুল্লাহ যা অর্জন করেছে তা হলো ভারতের পদতলে অধীনতা। স্বাধীনতা ও সম্মান কি আছে বিশেরও বেশী টুকরায় বিভক্ত আরব মুসলিমদের? বাংলার মুসলিমদের ১৯৪৭’য়ের সৌভাগ্যটি হলো, কাশ্মিরী নেতা শেখ আব্দুল্লাহর ন্যায় ভাষা বা প্রদেশের নামে তারা উপমহাদেশের অন্য ভাষাভাষী মুসলিমদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। বরং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছে। নইলে বাংলাদেশও পরিণত হতো ভারতের পদতলে পিষ্ট আরেক কাশ্মিরে।
মুসলিম হওয়ার চ্যালেঞ্জটি বিশাল। মু’মিনের জীবনে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধটি তো অনিবার্য। শয়তান ও তার অধিপত্যবাদি কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে লড়াই এখানে প্রতিদিনের। যে মুসলিমের জীবনে সে যুদ্ধটি নাই,বুঝতে হবে তার ঈমান ও মুসলিম হওয়া নিয়েই বিশাল শূণ্যতা আছে। ইসলামের শত্রুপক্ষ কি চায়, নবীজী (সা:)’র ইসলামের ন্যায় যে ইসলামে শরিয়ত আছে, জিহাদ আছে এবং খেলাফত আছে -তা নিয়ে মুসলিমগণ বেড়ে উঠুক? তারা কি চায় বিশ্বের কোন এক ইঞ্চি ভূমিতেও শরিয়ত প্রতিষ্ঠা পাক? তারা তো বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজ রূপে দেখে। সে ভিলেজে মদ্যপায়ী, ব্যভিচারি, সমকামী, গো-পূজারি, মুর্তিপূজারি ও নাস্তিকদের জন্য পর্যাপ্ত স্থান ছেড়ে দিতে তারা রাজী। কিন্তু নবীজী (সা:)’র যুগের ইসলাম নিয়ে যারা বাঁচতে চায় তাদের জন্য কি সামান্যতম স্থানও ছেড়ে দেয়? বরং তাদের বিরুদ্ধে তো নির্মূলের ধ্বনি। সেটি শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রতি দেশেই। মু’মিনের জীবনে সমগ্র বিশ্বটাই তাই রণাঙ্গন।এ রণাঙ্গণে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার অবস্থানটি তাদের পক্ষে। যুদ্ধরত মু’মিনদেরকে তিনি গ্রহণ করেছেন নিজ বাহিনী তথা হিযবুল্লাহ রূপে। আর তার নিজ বাহিনীর লোকদের কি তিনি জাহান্নামের আগুণে ফেলতে পারেন? মু’মিনের জীবনে এর চেয়ে বড় অর্জন আর কি হতে পারে?
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে অতি প্রিয় হলো, যুদ্ধরত মুজাহিদগণ যুদ্ধ করবে সীসাঢালা প্রাচীরসম একতা নিয়ে। তাঁর নিজবাহিনীর মাঝে অনৈক্য তাঁর অতি অপছন্দের। পবিত্র কোরআনে সেটি ঘোষিত হয়েছে এভাবে: “নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ করে এমন কাতারবদ্ধ ভাবে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর।” –(সুরা সাফ,আয়াত ৪)। মুসলিম জীবনে একতা তাই অনিবার্য কারণেই এসে যায়। সেটি যেমন সমাজ জীবনে, তেমনি দেশের রাজনীতি ও বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে। যেখানে অনৈক্য, বুঝতে হবে সেখানে ঈমানে শূন্যতা রয়েছে। অনৈক্যের অর্থই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা। অথচ আজ সে অবাধ্যতাই মুসলিম বিশ্বে জোয়ারের ন্যায় ছেয়ে আছে। মুসলিম জাহান আজ ৫৭ টুকুরোয় বিভক্ত। ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রের কি স্বাধীনতা থাকে? থাকে কি নিজ দেশে শিক্ষা-সংস্কৃতি,অর্থনীতি,আইন-আদালত ও প্রশাসনে আল্লাহতায়ালার প্রদর্শিত পথ মেনে চলার স্বাধীনতা? স্বাধীনতার খরচটি তো বিশাল। সে খরচ জোগানোর জন্য চাই রাষ্ট্রের বিশাল ভূগোল। সে জন্য চাই একতা। এবং হারাম হলো বিভক্তি।
ইসলামের শত্রুপক্ষ তো চায় বিশ্বের প্রায় দেড় শত কোটি মুসলিম বেঁচে থাকুক ইসলামকে বাদ দিয়ে। এক্ষেত্রে তাদের সামনে উত্তম মডেল হলো বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশের ডি-ইসলামাইজড সেক্যুলারিস্টগণ। এ অবাধ্যদের জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ নেই। নেই শরিয়তের প্রতি বিশ্বাস। নেই জিহাদ ও ইসলামের প্রতিষ্ঠায় সামান্যতম অঙ্গিকার। যা আছে তা হলো ইসলামের প্রচার ও প্রসার রোধে লাগাতর ষড়যন্ত্র। আছে দুর্বৃত্তি। আছে ইসলামপন্থীদের নির্মূলে সর্বাত্মক যুদ্ধ। কিন্তু এরপরও তাদের দাবী, তারা মুসলিম। আফগানিস্তান দখলের পর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাবুলে দাঁড়িয়ে বলেন, “শরিয়তি আইনকে আফগানিস্তানে ফিরে আসতে দেয়া হবে না।” মুসলিম ভূমিতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলার সাহস কাফেরগণ পায় কোত্থেকে? আফগানিস্তানের আাইন কীরূপ হবে সেটি কি জার্মানী বা অন্য কোন কাফের দেশ থেকে অনুমতি নেয়ার বিষয়? ইসলামের শত্রুগণ কি আব্বাসীয়, উমাইয়া বা উসমানিয়া খেলাফতের আমলে এমন আস্ফালন উচ্চারণ করতে পেরেছিল? অথচ তখনও তো তারা সেটিই চাইতো। প্রশ্ন হলো, শরিয়ত ছাড়া কি ইসলাম পালন হয়? পবিত্র কোরআনের মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, “আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী যারা বিচার করে না তারাই কাফের,..তারাই জালেম,..তারাই ফাসেক। -(সুরা মায়েদা,আয়াত ৪৪,৪৫,৪৭)।
কেন এ পতন?
রাষ্ট্রের শক্তি ও সামর্থ্য বিশাল। এটিকে নিয়ন্ত্রনে না রাখলে পাগলা হাতির ন্যায় তছনছ করে দিতে পারে ধর্ম ও সভ্য জীবন-যাপনের সকল আয়োজন। আজকের বাংলাদেশে তো তারই উদাহরণ।দেশ অধিকৃত হয়েছে ভয়ংকর চোর-ডাকাতদের হাতে। ফলে বিপন্ন শুধু ইসলামই নয়, মানুষের জানমাল এবং ইজ্জত-আবরুও। আল্লাহর দ্বীন পালন কি শুধু মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়িয়ে চলে? সেটি সম্ভব হলে নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের জীবনে কেন এতো যুদ্ধ? কেনই বা তাদেরকে রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসতে হলো? নবীজী (সা:)’র জীবনের বড় শিক্ষা: ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্য চাই রাষ্ট্রীয় শক্তির পূর্ণ ব্যবহার। চাই রাজনৈতিক ও সামরিক বল। ছোট্ট এক টুকরো ভূমির উপর কি বিশাল দুর্গ গড়া যায়? শ্রেষ্ঠ সভ্যতার নমুনা রূপে বিশ্বমাঝে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য তো চাই বিশাল মানচিত্র। চাই নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মানুষের মাঝে গভীর একতা। নবীজী (সা:) তাই দ্রুত ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতে মনোযোগী হয়েছিলেন। ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা বাড়াতে তাঁকে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে হয়েছে।এবং মৃত্যুর আগে সাহাবাদের নসিহত করেছেন রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানি কন্সটান্টিনোপল দখল করতে। এটি ছিল নবীজী (সা:)’র স্ট্রাটেজিক ভিশন। মুসলমানদের জানমালের সবচেয়ে বড় কোরবানি হয়েছে তো মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তি বাড়াতে। পরিপূর্ণ দ্বীন পালন, সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ ও বিশ্বমাঝে সুমহান মর্যাদায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ সৃষ্টি হয়েছে তো এভাবেই। আজও মুসলিমদের সামনে এটিই নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নত। তাই যারা মুসলিম দেশের ভূগোলকে খণ্ডিত করে তারা শত্রু মূলত নবীজী (সা:)’র আদর্শ্যের। একাত্তরে সে শত্রুতাটি হয়েছে মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে।
মুসলিম বিশ্বের আজ বেহাল অবস্থা। যে আসনে বসেছেন মহান নবীজী (সা:) ও তাঁর খলিফাগণ সে পবিত্র আসনে বসেছে চোরডাকাত, ভোটডাকাত ও কাফের শক্তির সেবাদাসেরা। খেলাফতের আওতাধীন সে বিশাল ভূগোল যেমন নাই, সে সামরিক বলও নাই। বিলুপ্ত হয়েছে মহান আল্লাহর শরিয়ত। আগ্রহ নেই পূর্ণ ইসলাম পালনের। মুসলিমদের পতনের শুরু তখন থেকেই যখন আলেমগণ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও সংস্কারকে বাদ দিয়ে স্রেফ মসজিদ ও মাদ্রাসার চার দেয়ালের মাঝে নিজেদের কর্মকে সীমিত করেছে। পতনের মূল কারণ, সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি রূপে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে মহান নবীজী (সা:) যে সূন্নত রেখে যান -সেটির প্রতি গুরুত্ব না দেয়া। শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় জিহাদে অংশ নেয়া দূরে থাক, আলেমগণ তাদের ওয়াজে জিহাদের কথা মুখে আনতে ভয় পান। ভয়ের কারণ, সন্ত্রাসী রূপে চিহ্নিত হওয়ার। আল্লাহতায়ালার ভয়ের চেয়ে অধিক ভীতু বান্দার ভয়ে।
মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা, সংহতি ও ভূগোল বৃদ্ধি ইসলাম ধর্মে অতি পবিত্র ইবাদত। মুসলমান এ কাজে যেমন অর্থ দেয়, তেমনি প্রাণও দেয়। হযরত আবু বকর (রা:) তাঁর ঘরের সমুদয় সম্পদ নবীজী (সা:)’র সামনে এনে পেশ করেছিলেন। অন্যান্য সাহাবাদের অবদানও ছিল বিশাল। মু’মিনের অর্থদান ও আত্মদানে মুসলিম ভূমিতে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যাই বাড়ে না, বিলুপ্ত হয় দুর্বৃত্তদের শাসন এবং প্রতিষ্ঠা পায় মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধান পালনের উপযোগী পরিবেশ। যে দেশে জিহাদ নাই সে দেশে সেরূপ পরিবেশ গড়ে উঠে না। বরং শাসক রূপে তখন ঘাড়ের উপর চেপে বসে চোর-ডাকাতগণ। বাংলাদেশে অবিকল সেটিই হয়েছে। মুসলিমদের গৌরব কালে মুসলিমদের জানমাল, শ্রম ও মেধার বেশীর ভাগ ব্যয় হয়েছে জিহাদে, ফলে নির্মিত হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। কে মু’মিন আর কে মুনাফিক -সেটিও কোন কালে মসজিদের জায়নামাজে ধরা পড়েনি। ধরা পড়েছে জিহাদে। ওহুদের যুদ্ধের সময় নবীজী (সাঃ)র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার। কিন্তু তাদের মধ্যে ৩০০ জন তথা শতকরা ৩০ ভাগই ছিল মুনাফিক -যারা নবীজী (সা:)’র জিহাদী কাফেলা থেকে সিটকে পড়ে। তারা যে শুধু নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করতো তা নয়, মহান নবীজী (সা:)’র পিছনে দিনের পর দিন নামাযও পড়েছে। জিহাদ এভাবেই সাচ্চা মু’মিনদের বাছাইয়ে ফিল্টারের কাজ করে। মুখোশ খুলে যাবে এ ভয়ে মুনাফিকগণ তাই ফিল্টারের মধ্য দিয়ে যেতে ভয় পায়। এদের পক্ষ থেকে জিহাদের বিরুদ্ধে এজন্যই এত প্রচারণা। তারা তো চায়, মুসলিম সমাজ দেহে লুকিয়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে।
সাতচল্লিশের অবদান ও একাত্তরের ষড়যন্ত্র
মুসলিম জনসংখ্যা আজ বিশাল। কিন্তু কোথায় সে সামরিক ও রাজনৈতিক বল? কোথায় সে ইজ্জত? শক্তি ও ইজ্জত তো বাড়ে অর্থত্যাগ ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে। রাজনৈতিক বল বাড়াতে যেমন চাই আত্মত্যাগী বিশাল জনবল, তেমনি চাই বিশাল ভূগোল। বিশাল ভূগোলের কারণেই ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি আজ বিশাল। অথচ ভারতে বাস করে বিশ্বের সর্বাধিক দরিদ্র মানুষ। ক্ষুদ্র কাতার, কুয়েত ও দুবাই কি মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে ৫০ গুণ বাড়িয়েও সেরূপ সামরিক ও রাজনৈতিক বল পাবে? বৃহৎ ভূগোলের বিকল্প বৃহৎ ভূগোল, অর্থ নয়। মুসলিম উম্মাহর সামরিক ও রাজনৈতিক বল বাড়াতেই ইখতিয়ার মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির ন্যায় মহান তুর্কি বীর বাংলার বুকে ছুটে এসেছিলেন। তেমনি এক মহান লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে উপমদেশের মুসলমানগণ নানা ভাষা, নানা প্রদেশ ও নানা বর্ণের ভেদাভেদ ভূলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম দেয়। সেটাই ছিল সাতচল্লিশের অবদান। এর মূলে ছিল প্যান-ইসলামিক চেতনা।
হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী, নাস্তিক, বামপন্থি এরা কেউই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে শুরু থেকেই মেনে নিতে পারিনি। মেনে নিতে পারেনি ভারত। কারণ ইসলাম ও মুসলিমের শক্তি ও গৌরব বৃদ্ধিতে তারা কেউই খুশি নয়, বরং সেটিকে হুমকি মনে করে। ফল দেশটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় ১৯৪৭ থেকেই। তাদের একই মঞ্চে দেখা গেছে ১৯৭১ সালে। শত্রুপক্ষের সে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হন শেখ মুজিব। তার রাজনীতি ছিল ষড়যন্ত্রের রাজনীতি; এবং লক্ষ্য ছিল ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গা। পাকিস্তানের জেল থেকে ফেরার পর সহরোওয়ার্দী উদ্দ্যানের সভায় শেখ মুজিব সে ষড়যন্ত্রের কথাটি ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি। (এ নিবন্ধের লেখক সে বক্তৃতাটি নিজ কানে শুনেছেন)। সেদিন মুজিব বলেছিলেন: “বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু একাত্তর থেকে নয়, উনিশ শ’ সাতচল্লিশ থেকেই”। ১৯৪৭য়ে শুরু করা সে ষড়যন্ত্রটি বিজয়ী হয় ১৯৭১’য়ে। তখন ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনে মৃত্যু ঘটে তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃবহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের। অথচ পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বাংলার মুসলিমদের ভূমিকা ছিল উপমহাদেশের অন্য যে কোন ভাষার মুসলিমদের চেয়ে অধিক। তারাই ছিল দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। নিজেদের হাতে গড়া শিশু রাষ্ট্রকে তারা নিজেরাই হত্যা করে এবং বিপুল উৎসব বাড়ায় ভারতের ন্যায় কাফের শিবিরে। মহান আল্লাহতায়ালা কি তাতে খুশি হবেন?
যে ব্যক্তি স্বর্ণের বিশাল টুকরো মামূলী পাথর মনে করে – সে স্বর্ণখন্ডটি হারিয়ে যাওয়ায় তারা মনে দুঃখ জাগে না। ফলে জীর্ণ কুঠিরে বাসও সে আহম্মকের জীবনে শেষ হয়না। তেমন এক চেতনাহীনতার কারণে বহু বাঙালীর মনে দুঃখবোধ হয়নি পলাশীর প্রান্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা অস্ত যাওয়াতে। বরং ইংরেজ বাহিনীর বিজয় উৎসব দেখতে বহু হাজার বাঙালী রাজধানী মুশিদাবাদের সড়কের দু’পাশে ভিড় জমিয়েছল। সে চেতনাহীনতার কারণে বাংলার বুকে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বড় রকমের কোন জিহাদ হয়নি। বাঙালী মুসলিম জীবনে একই রূপ চেতনাহীনতা পুণরায় দেখা দেয় ১৯৭১’য়ে। ফলে সেদিন কাফেদের বিজয়ও তাদের নিজেদের বিজয়ে পরিণত হয়েছে। ঢাকার রাস্তায় ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন দুপাশে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড বিজয়-উল্লাস করেছে।
১৯৭০’য়ে নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিশাল সাফল্যের বড় কারণ, ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রের সে গোপন বিষয়টি তিনি গোপন রাখতে সমর্থ হয়েছিলের। জনগণ জানলে কি তার মত ভারতীয় চর ও ষড়যন্ত্রকারিকে ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে ভোট দিত? বাংলার মুসলিমদের বড় ব্যর্থতা, একাত্তরে তারা ইসলামের শত্রুদের চিনতে ভয়ানক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ঘুমের ঘোরে বিষাক্ত গোখরা শাপকে গলায় পেঁচিয়ে নেয়ার বিপদ তো ভয়াবহ। একাত্তরে সেটিই ঘটেছে। সে ভূলের পরিনাম হলো, আজ শুধু পদ্মা, তিস্তা ও সুরমার পানি নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অস্তিত্বেও আজ টান পড়েছে। বাংলাদেশে আজ যে যুদ্ধাবস্থা তা তো একাত্তরের যুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা।
নবীজী(সা:)’র লিগ্যাসি ও শয়তানের লিগ্যাসি
মৃত্যুর পরও অনেকের লিগ্যাসি বহুকাল বেঁচে থাকে। সমগ্র মানব ইতিহাসে ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা:)’র লিগ্যাসিটি তূলনাহীন। সেটি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ গড়ার ও সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মাণের। তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ ইতিহাস গড়েন মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুম পালনে। নবীজী (সা:)’র লিগ্যাসি হলো নানা বর্ণ, নানা ভাষা ও নানা ভূ-খন্ডের মানুষের মাঝে গভীর ভাতৃত্ব গড়ার। শুধ ধর্মীয় বলেই নয়, রাজনৈতিক ও সামরিক বলেও তিনি মুসলিমদের শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দিয়ে যান। তাই স্রেফ মুর্তিপূজা, নাস্তিকতা ও নানারূপ পাপাচার থেকে মুক্তিদানই নবীজী (সা:)’র একমাত্র সাফল্য নয়, মুক্তি দিয়েছেন ভাষাপূজা, বর্ণপূজা, গোত্রপূজা ও জাতিপূজা থেকেও। অথচ সেগুলোই ছিল আরবের বুকে বহু শত বছর যাবৎ রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের মূল কারণ। নবীজী (সা:) এভাবে তাদেরকে মুক্তি দিয়েছিলেন বিশাল প্রাণহানি ও সম্পদহানি থেকে। ফলে পারস্যের সালমান ফারসী (রা:),আফ্রিকার বেলাল(রা:), রোমের সোহায়েব (রা:)’র সাথে আরবের আবু বকর (রা:), উমর(রা:) বা আলী (রা:)’র কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে কাজে কোনরূপ সমস্যা দেখা দেয়নি। সমগ্র মানব ইতিহাসে একমাত্র সে সময়টিই ছিল সবচেয়ে গৌরবের। একমাত্র তখনই বড় বড় বিজয় এসেছে এবং নির্মিত হয়েছে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। ঈমানের দায়বদ্ধতা এবং সে সাথে সফলতা হলো নবীজী (সা:)’র সে লিগ্যাসি নিয়ে বাঁচায়।
মানব সমাজে শয়তানও বেঁচে আছে তার লিগ্যাসী নিয়ে। সেটি মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার। বাংলাদেশে যারা একাত্তরের চেতানার ধারক তারা বাঁচছে শয়তানের লিগ্যাসী নিয়ে। তাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তি বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহটি অতি প্রকট। তাদের রাজনীতিতে প্রবল হলো ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে নির্মূলের সুর। শয়তান শুধু মুর্তিপূজায় ডাকে না। ডাকে গোত্রপূজা, বর্ণপূজা, শ্রেণীপূজা, ভাষাপূজা, দলপূজা, দেশপূজা ও জাতিপূজার দিকেও। এরূপ ডাকার কাজে শয়তানের যেমন নিজস্ব পুরোহিত বাহিনী আছে, তেমনি বিপুল সংখ্যক পূজামন্ডপও আছে। আছে বিশাল প্রশাসনিক অবকাঠামোও। তথাকথিত শহীদ মিনারের নামে হাজার হাজার পূজাস্তম্ভ গড়া হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। মুর্তিপূজার ন্যায় স্তম্ভপূজায় নগ্নপদে হাজির হয় লক্ষ লক্ষ বাঙালী নরনারী।
নবীজী (সা:)’র যুগে আরব কাফেরদের মাঝে শুধু যে মুর্তিপূজা ছিল –তা নয়। ছিল গোত্রপূজা, বর্ণপূজা ও জাতিপূজা। ছিল মুসলিম নির্মূলের যুদ্ধ। জাহেলী যুগে গোত্র বা বর্ণের নামে যুদ্ধ একবার শুরু হলে সেটি আর থামতো না। পূর্বপুরুষদের শুরু করা যুদ্ধগুলিকে তাদের সন্তানেরাও বছরের পর বছর চালিয়ে যেত। বাংলাদেশের ইসলামবিরোধীগণও বেঁচে আছে শয়তানের সে লিগ্যাসি নিয়ে। একারণেই ইসলামপন্থীদের নির্মূলের যে যুদ্ধটি একাত্তরে শুরু হয়েছিল, তাদের রাজনীতিতে এখনো তা বেঁচে আছে। একাত্তরের লিগ্যাসি হলো উম্মাহর বিভক্তি ও কাফেরদের ঘরে বিজয় তুলে দেয়ার। একাত্তরে ভারতের যুদ্ধজয়ে শুধু পাকিস্তান দুর্বল হয়নি; দুর্বল হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশের মুসলিমগণও। সে সাথে আশাহত হয়েছে ভারতের মুসলিমগণ। একাত্তরের পর দারুন ভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার কাজটি। এবং বেগবান হয়েছে মুসলিম সন্তানদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজ। একাজে দেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে হাতিয়ার রূপে। রাজনীতিতে ইসলামের শত্রুপক্ষ এতটাই প্রবল যে, ইসলামপন্থিদের জন্য সামান্য স্থান ছেড়ে দিতেও তারা রাজি নয়। আগ্রাসনের শিকার হয়েছে বাংলার মুসলিম সংস্কৃতি। এবং মুসলিমগণ বিচ্যুৎ হচ্ছে ইসলামের মূল মিশন থেকে।
ইসলামের শত্রুপক্ষের স্ট্রাটেজী মুসলিম সন্তানদের স্রেফ ইসলাম থেকে দূরে সরানো নয়, বরং মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করা এবং সে ক্ষুদ্র ও ভগ্ন মানচিত্র গুলোকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখা। মুসলিম উম্মাহকে শক্তিহীন রাখার এটাই শয়তানি স্ট্রাটিজী। সে স্ট্রাটেজীর অংশ রূপেই অখন্ড আরব ভূমিকে বিশেরও বেশী টুকরোয় বিভক্ত করা হয়েছে। তাই একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজটি শেখ মুজিবের একার ছিল না। প্রকল্পটি একক ভাবে শুধু ভারতেরও ছিল না। ভাঙ্গার কাজে ভারতকে যে শুধু সোভিয়েত রাশিয়া ও ইসরাইল অস্ত্র জুগিয়েছে তাও নয়। বরং এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল শয়তানী শক্তিবর্গের আন্তর্জাতিক কোয়ালিশন; এবং সেটি পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। পাকিস্তানের মুল অপরাধটি এ ছিল না যে, দেশটিতে স্বৈরাচার বা বৈষম্য ছিল। বরং বর্বরতম স্বৈরাচারের শিকার তো আজকের বাংলাদেশ এবং বেশী আঞ্চলিক বৈষম্য তো ভারতে। শয়তানী শক্তির টার্গেট হওয়ার মূল কারণ, পাকিস্তান ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র এবং ভারতের ন্যায় একটি শত্রুশক্তির প্রতিবেশী।
গৌরব গড়াতে, ভাঙ্গাতে নয়
মুসলিমদের গৌরব গড়াতে, ভাঙ্গাতে নয়। ইসলামে অতি নিন্দনীয় হারাম কাজ হলো কোন কিছু ভাঙ্গা। অকারণে গাছের একটি ডাল ভাঙ্গাও হারাম। তেমনি অতিশয় হারাম কর্ম হলো মুসলিম দেশের ভূগোল ভাঙ্গা। এজন্যই কোন মুসলিম দেশভাঙ্গায় ঈমানদারের হৃদয়ে মাতম উঠে; এবং তাতে উৎসব হয় কাফির শিবিরে। তাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গড়াটি সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে যতটা প্রশংসা কুড়িয়েছে, ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি সেটি পায়নি। ভারত ও ভূটান ছাড়া কোন মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসেনি। পাকিস্তান ভাঙ্গার সে দিনটিতে অনেকেই বরং চোখের পানি ফেলেছে। (লেখক সে বর্ণনা শুনেছেন ভারত ও আফ্রিকার মুসলিমদের থেকে)। মুসলিম দেশ ভাঙ্গার এ কর্মটি বরং আনন্দের প্রচন্ড হিল্লোল তুলেছে ভারতের ন্যায় কাফের দেশগুলোতে। কলকাতার রাস্তায় সেদিন মিষ্টি বিতরণ হয়েছে। আর কাফেরগণ যা নিয়ে উৎসব করে -তাতে কি মহান আল্লাহতায়ালা খুশি হন? তাতে কি মুসলিমদের কোন কল্যাণ হয়?
মুসলিম দেশের ভাঙ্গন রোধে সীমান্তের এক মুহুর্তের পাহারাদারিকে নবীজী (সাঃ) সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলেছেন। এমন একটি চেতনা কারণে সময়ের তালে মুসলিম দেশের ভূগোল বিশাল আকারে বৃদ্ধি পেলেও সে ভূগোলে শত শত বছরেও ভাঙ্গন আসেনি। অথচ ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে বহু দেশে বিভক্ত হয়েছে ইউরোপ। দেশগুলি বছরের পর বছর রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধেও লিপ্ত থেকেছে। এর বিপরীত, মুসলিমদের ইতিহাস হলো বিভক্তির দেয়াল ভাঙ্গার। দেয়াল ভাঙ্গার মধ্য দিয়েই আরব, ইরানী, তুর্কি, কুর্দি, মুর, বার্বার ও অন্যান্য ভাষার মুসলিমগণ ইউরোপের চেয়ে কয়েকগুণ বৃহৎ ভূখন্ড জুড়ে অভিন্ন উম্মাহ ও বিশাল রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। বিভক্তি তো তখনই শুরু হয়েছে যখন তারা ইসলাম থেকে দূরে সরেছে। বিভক্তি তাই পথভ্রষ্টতার দলিল। শেখ মুজিব ও তার অনুসারি বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ যে পথভ্রষ্টদের দল –তা নিয়ে কি তাই সন্দেহ থাকে?
ভাতৃত্ব, সৌহার্দ-সম্পৃতি ও একতা মুসলিম উম্মাহর জীবনে একাকী আসে না, সাথে আনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত সাহায্যও। যুদ্ধের ময়দানে তাদের সাহায্যে এমন কি বিপুল সংখ্যয় ফেরেশতাগণও নেমে আসেন। সে সাহায্যের বরকতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয়েছে বিশাল বিশাল শত্রু বাহিনীর উপর। পরাজিত করছে পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের ন্যায় দুই বিশ্বশক্তিকে। অনৈক্যে বিজয় জুটেনা, দেশও বাঁচে না। অনৈক্যে যা জুটে তা হলো অপমানকর পরাজয় ও গোলামী। এবং আনে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কঠিন আযাব। সে আযাবের প্রতিশ্রুতি শোনানো হয়েছে সুরা আল-ইমরানের ৫ নম্বর আয়াতে। আযাবের অংশ রূপেই লক্ষ লক্ষ মুসলিম তখন গণহত্যার শিকার হয়। শহরের পর শহর তখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।এবং দেশ অধিকৃত হয় শত্রুবাহিনীর হাতে। একাত্তরে বাংলাদেশে তো সেটিই ঘটেছে।
ঈমানদারীর দায়বদ্ধতা
মুসলিমকে শুধু নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত পালনের সামর্থ্য অর্জন করলে চলে না। তাকে নিজ ভাষা, নিজ বর্ণ ও নিজ জন্মভূমির বাইরে অন্য মুসলিমদের সাথেও শান্তিপূর্ণ বসবাসের সামর্থ্য অর্জন করতে হয়। সে সামর্থ্য হিন্দুদের আছে। ভারত তার দৃষ্টান্ত। ইহুদীদেরও আছে। সে দৃষ্টান্তু ইসরাইল। পাশ্চাত্যেরও আছে। সে দৃষ্টান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট। নানা ভাষার ও নানা বর্ণের মানুষ যেমন ভারতে, তেমনি ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একত্রে এক ভূগোলে বসবাস করে। কিন্তু সে সামর্থ নেই মুসলিমদের। তারা বেছে নিয়েছে ভাষা ও বর্ণের নামে ভিন্ন ভিন্ন দেশ গড়ার পথ। অথচ রাজনৈতিক একতা কাফেরদের ধর্মে ফরজ নয়। কিন্তু অন্য দেশ, অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমকে মু’মিন ব্যক্তির ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। প্রতিটি মু’মিনের উপর ঈমানী দায়বদ্ধতা হলো মহান আল্লাহতায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত সে পবিত্র ভাতৃত্বের সম্পর্কের প্রতি সম্মান দেখানো। নইলে অবমাননা হয় খোদ মহান আল্লাহতায়ালার। সে ফরজটি ১৯৪৭ সালে পালিত হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭১’য়ে পালিত হয়নি। বরং প্রচণ্ড অবাধ্যতা হয়েছে।
ভিন্ ভাষা, ভিন্ বর্ণ ও ভিন্ জাতীয়তার নামে মুসলিম ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ও বিভক্তিটা স্থায়ী করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সীমানার নামে দেয়াল খাড়া করা কি ঈমানদারী? নিজ গৃহে ভাইয়ের প্রবেশ রুখতে কি দেয়াল গড়া যায়? ইসরাইল বা ভারতের ন্যায় শত্রুদেশ এমন দেয়াল গড়তে পারে। কিন্তু সে দেয়াল মুসলিম দেশ গড়ে কি করে? খেলাফতের যুগে সেরূপ দেয়াল ছিল না। ফলে সে বিশাল মুসলিম খেলাফতের যে কোন প্রান্ত থেকে মক্কা-মদিনা বা অন্য কোন শহরে পৌঁছতে ভিসার প্রয়োজন পড়তো না। মুসলিম ভূমিতে আপন রূপে গৃহিত হওয়ার জন্য মুসলমান পরিচিতিটাই সে জন্য যথেষ্ট ছিল।
ভিন্ন ভিন্ন ভাষার নামে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সেগুলীর নামে বিভক্তির সীমান্তরেখাগুলি হলো মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর বিদ’য়াত। আত্মবিনাশী এ বিদ’য়াতকে বাঁচাতে গড়া হয়েছে শত শত কোটি ডলার ব্যয়ে বিশাল বিশাল সামরিক বাহিনী। শুরু হয়েছে ভিসার প্রচলন। আর আলেমদের অপরাধ হলো, ছোটখাটো বিদ’য়াত নিয়ে উচ্চকন্ঠ হলেও এরূপ বিধ্বংসী বিদ’য়াত নিয়ে তাদের মুখে কোন কথা নেই। ঈমানের রোগ নির্ণয়ে মাপকাঠি অনেক। তবে রোগটি নির্ভূল ভাবে ধরা পড়ে অন্য ভাষা,অন্য দেশ ও অন্য বর্ণের মুসলিমকে নিজ ভাই রূপে আলিঙ্গণের অসামর্থ্যতায়। কারণ, সেজন্য তো চাই ঈমানে পর্যাপ্ত বল। চাই বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদের উর্দ্ধে উঠার সামর্থ্য। বাঙালী মুসলিমদের ঈমানের সে অসামর্থ্যতা প্রকট ভাবে ধরা পড়েছে একাত্তরে। স্রেফ ভাষা, বর্ণ ও জন্মস্থান ভিন্ন হওয়ার কারণে একাত্তরে হাজার হাজার বিহারীকে বাংলার বুকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষিতা হয়েছে তাদের নারীরা। জীবিতদেরকে রাস্তায় নামিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকেও দখলে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিহারী বস্তিগুলো সে অপরাধের সাক্ষিরূপে এখনো বেঁচে আছে। এরূপ নৈতিক রোগ নিয়ে ইউরোপীয়রা বিশ্বের নানা দেশে বর্ণ ও জাতিগত নির্মূলে নেমেছে। নির্মূলের পর সেখানে নিজেদের কলোনি গড়েছে। আর বাংলাদেশের বুকে বহু দুর্বৃত্ত বাঙালী নেমেছে বিহারী মহল্লায়। বাংলাদেশের সরকার এসব দুর্বৃত্তদের পুরস্কৃত করেছে তাদের দখলকৃত ঘরবাড়ি ও দোকানপাঠের উপর মালিকানার সনদ দিয়ে।
লক্ষাধিক নবীরাসূল একত্রে কোন জনপদে প্রেরিত হলেও কি তাদের মাঝে কোন বিরোধ সৃষ্টি হতো? তাদের মাঝে কি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র ও সেসব রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার নামে সীমানা গড়া হতো? এক্ষেত্রে আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতাটি বিশাল। এখানে ধরা পড়ে ঈমান বেড়ে উঠার ব্যর্থতা। শুধু নামায-রোযার মধ্য দিয়ে কি এ ব্যর্থতার আযাব এড়ানো যায়? এরূপ ব্যর্থতা নিয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় বান্দা হওয়া যায়? অনৈক্য ও বিভক্তি যে কতটা সর্বনাশা -সেটি বুঝতে কি ইতিহাস পাঠের প্রয়োজন পড়ে? প্রমাণ তো মুসলিমগণ নিজেরাই। বিশ্বে তাদের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে মুসলিম রাষ্ট্রও। কিন্তু তাতে কি তাদের শক্তি, সামর্থ্য ও প্রতিরক্ষা বেড়েছে? বেড়েছে কি স্বাধীনতা ও মান-ইজ্জত? সংখ্যায় প্রায় দেড় শত কোটি হওয়া সত্ত্বেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ বিশ্বের কোন প্রতিষ্ঠানেই কি তারা সাড়ে ৬ কোটি ব্রিটিশ বা সাড়ে ৬ কোটি ফরাসীদের সামনে কি সমান অধিকার নিয়ে দাঁড়াতে পারে?
অর্জিত আযাব
এরূপ ব্পির্যয় ও অপমান থেকে বাঁচাতেই মহান আল্লাহতায়ালা শুধু চুরি-ডাকাতি, মদ-জুয়া, ব্যাভিচার ও মিথ্যাচারকে হারাম করেননি, হারাম করেছেন ভাষা, গায়ের রং, আঞ্চলিকতা নিয়ে মুসলিম ভূগোলকে বিভক্ত করার রাজনীতি।পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালার হুশিয়ারি,“সবাই মিলে তোমরা আঁকড়ে ধরো আল্লাহর রশিকে,এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়োনা।” –(সুরা আল ইমরান, অয়াত ১০৩)। এভাবে তিনি কঠোর ভাবে সাবধান করেছেন অনৈক্য থেকে বাঁচতে। আরো হুশিয়ার করেছেন এ বলে,“তোমারা তাদের মত হয়োনা,যারা সুস্পষ্ট নির্দেশ আসার পরও বিভক্ত হয়,এবং ভেদাভেদ গড়ে। এদের জন্যই নির্দিষ্ট রয়েছে বিশাল আযাব।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)। উপরুক্ত প্রথম আয়াতটিতে পবিত্র কোরআন চিহ্নিত হয়েছে আল্লাহর রশি রূপে। মুসলিমদের উপর ফরজ হলো, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আল্লাহর এ রশিকে আঁকড়ে ধরা ও বিভক্তি থেকে বাঁচা। দ্বিতীয় আয়াতটিতে স্পষ্ট হুশিয়ারি হলো, আল্লাহতায়ালার আযাব নামিয়ে আনার জন্য মুর্তিপূজারি বা নাস্তিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। সে জন্য মহান আল্লাহতায়ালার রশিকে পরিত্যাগ করা ও নিজেদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিই যথেষ্টে। বিভক্তির চুড়ান্ত রূপটি হলো বিভক্ত রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রগুলির নামে গড়ে উঠা দেয়াল। বিগত বহু শত বছর যাবত মুসলিম চেতনায় মহান আল্লাহতায়ালার এ হুশিয়ারিটি মুসলিমদের মাঝে এতটাই প্রকট ভাবে বেঁচেছিল যে মুসলিম জনগণ কখনোই মুসলিম ভূখন্ডকে বিভক্ত করার কাজে অংশ নেয়নি। ভাষা, বর্ণ,অঞ্চলের নামে দেশও গড়া হয়নি। এমন কি ১৯৭১’য়েও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোন ইসলামি দলের নেতাকর্মী, কোন আলেম বা কোন পীর-মাশায়েখ পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থণ করেনি। সে লক্ষে তারা ভারতে যায়নি এবং অস্ত্রও ধরেনি।
বাংলাদেশের মুসলিমগণ আজ ভয়ানক আযাবের গ্রাসে। দেশে আজ যুদ্ধাবস্থা। তবে এ আযাব তাদের স্বহাতে অর্জিত। যে পাপের কারণে এ আযাব তাদেরকে ঘিরে ধরেছে সেটির শুরু আজ নয়, বরং একাত্তরে। একাত্তরে যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাদের কাছে মহান রাব্বুল আলামীনের উপরুক্ত হুশিয়ারিটি আদৌ গুরুত্ব পায়নি। তাদের হাতে আল্লাহর রশিটি যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না মুসলিম উম্মাহর একতা, সংহতি ও কল্যাণের ভাবনা। তারা তো ধরেছে ভারতের রশি। ভারতের রশির টানেই তারা দিল্লিতে গিয়ে পৌঁছে। সে রশি দিয়েই শেখ মুজিব ও তার অনুসারিগণ বাংলাদেশকে ভারতের দাসত্বের জালে আবদ্ধ করে। বাঙালী মুসলিমের স্বাধীনতার কথা তাদের কাছে একটু্ও গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পায়নি মুসলিম উম্মাহর ইজ্জত-আবরুর কথাও। সেটি গুরুত্ব পেলে কি মুজিব ভারতের সাথে ২৫ সালা দাসচুক্তি স্বাক্ষর করতো? বাস্তবতা হলো, ভারতীয় কাফেরদের অস্ত্র কাঁধে নিয়ে মুজিবের অনুসারিরা ভারতের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। ভারত এজন্যই বাংলাদেশের বুকে তাদের এ বিশ্বস্থ্য দাসদের চিরকাল ক্ষমতায় রাখতে চায়। এবং নির্মূল করতে চায় তাদের যারা ভারতের অধীনতা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে চায়।
তেমন একটি রাজনৈতিক প্রয়োজনে বর্তমান অবৈধ সরকারের ভোট-ডাকাতি যত কদর্য রূপেই হোক, ভারত সেটিকে শতভাগ বৈধতা দেয়। ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলে এ দাসগণ যে ইতিহাসের আবর্জণায় যাবে -তা নিয়ে কি ভারতীয়দের মনেও কোন সন্দেহ আছে? আধিপত্যবাদি দেশ তো অন্যদেশের অভ্যন্তরে এমন দাসদেরই খোঁজে। ভারতের কাছে মুজিব ও তার বাকশালী সহরচদের কদর তো এজন্যই এত অধীক। স্বাধীনচেতা মানুষদের তারা বরং শত্রু জ্ঞান করে। ফলে বাংলাদেশে বুকে তাদের নির্মূলের এতো আয়োজন। শুধু ভারতীয় র’য়ের এজেন্ট, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও দলীয় গুন্ডাবাহিনীই শুধু নয়, আদালতের বিচারকদেরও এ নির্মূল কাজে ময়দানে নামানো হয়েছে। পদসেবী এ দাসদের ক্ষমতায় রাখতে ভারত বরং একাত্তরের ন্যায় আরেকটি যুদ্ধ লড়ে দিতেও রাজী। সাম্রাজ্যবাদীদের সেটিই তো চিরাচরিত রীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দাসদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সেরূপ যুদ্ধ বিশ্বের নানা দেশে লড়ছে। ভারত সেরূপ যুদ্ধ বাংলাদেশে লড়বে -তাতেই বা বিস্ময়ের কি? এ সহজ বিষয়টুকু বুঝার জন্য কি পন্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে? ১ম সংস্করণ ০৪/০৪/২০১৫; ২য় সংস্করণ ২৬/০২/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018