বিপ্লবের ফসল কি আবারো বানে ভেসে যাবে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

যে আসন্ন বিপদ থেকে ছাত্ররা বাঁচিয়েছে

বাংলাদেশ যে দুরাবস্থায় পৌঁছেছে তা কোন একক ব্যক্তি ও দলের নয়, এটি হলো অতীতের বহু ব্যক্তি, বহু সরকার ও বহু দলের বহু বছরের বড় বড় ভূল, নিদারুন অবহেলা ও গুরুতর অপরাধের সম্মিলিত অর্জন। ব্যর্থতা ও অপরাধগুলি শুধু সরকারের পক্ষ থেকে হয়নি, বরং বহু ব্যর্থতা ও অপরাধের বড় বড় কাণ্ড ঘটেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দল, বুদ্ধিজীবী, আলেম এবং জনগণের পক্ষ থেকেও। জনগণও নির্দোষ নয়, তারা বহুবার ব্যর্থ হয়েছে এবং অপরাধের কাণ্ড ঘটিয়েছে। দুর্বৃত্ত ফ্যাসিস্ট, গণতন্ত্রের খুনি এবং ভারতের এজেন্টকে ভোট দিয়ে তারা বার বার বিজয়ী করেছে। গুরুতর অপরাধীকে তারা নেতা, পিতা ও বন্ধুর আসনে বসিয়েছে। কোন দেশই শুধু সরকারের জন্য ব্যর্থ হয়না, প্রতিটি ব্যর্থতায় জনগণেরও বিশাল অংশদারিত্ব থাকে। সরকার ও জনগণ একত্রে যেমন সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্র গড়ায় ইতিহাস গড়তে পারে, তেমনি ইতিহাস গড়তে পারে একত্রে নিচে নামাতেও। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।  

ফ্যাসিস্ট হাসিনার বড় অপরাধটি হলো, সে এই রুগ্ন ও পশ্চাদপদ জনগণের মাথার উপর মরণ আঘাত হেনেছিল। সে দেশের সকল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে খুন, গুম, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ডাকাতি, ভোট ডাকাতির হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। চাকর-বাকরে পরিণত করেছিল দেশের বিচারক, জেনারেল, সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের। নৃশংস খুনিতে পরিণত করেছিল দেশের পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও তার দলীয় নেতাকর্মীদের। সে পরিকল্পিত ভাবে বন্ধ করেছিল স্বাধীন ভাবে কথা বলা ও বেড়ে উঠার পথ। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ভারতীয় রাডারের  নীচে এক করদ রাজ্যে । ভারত যা চাইতো -তা দেয়াই রাজনীতির রাজনীতির মল মিশন ছিল। এমন কি ভারত থেকে পদ্মা-তিস্তার পানির ন্যায় ন্যায্য কিছু আনাও তার কাছে গুরুত্ব পায়নি। ভারতের জন্য বাকি ছিল কেবল সামরিক ভাবে বাংলাদেশকে দখলে নেয়ার। আরো কিছুকাল হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে ভারত সে সামরিক দখলদারীও প্রতিষ্ঠা করতো। ছাত্র-জনতার কৃতিত্ব হলো তারা ত্বরিৎ বিপ্লব করে সে ভয়ংকর বিপদ থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে। এ বিশাল অবদানের জন্য তারা ইতিহাসে বেঁচে থাকবে।

হঠাৎ কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে মৃত্যুও কারো জীবনে হঠাৎ আসে না; মৃত্যুর বহু পূর্ব থেকেই মৃত্যুর প্রক্রিয়া শুরু হয়। মৃত্যু হলো সে প্রক্রিয়ার শেষ বিন্দু। চিকিৎস্যকের কাজ হলো সে প্রক্রিয়াকে সনাক্ত করা এবং চিকিৎসা করা। বিষয়টি সত্য যে কোন জাতির ক্ষেত্রেও। দৈহিক অসুস্থতার ন্যায় মানবের নৈতিক ও চারিত্রিক অসুস্থতারও কারণ রয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালা শুধু ব্যক্তির নৈতিক ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধির পথই দেখাননি, দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধিরও পথও। নবীজী (সা:) মহান আল্লাহতায়ালার দেখানো সে পথটিট চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন নিজ হাতে রাষ্ট্র নির্মাণ করে। জাতির বিবেকবান নাগরিকদের দায়িত্ব হলো অসুস্থতার আলামত গুলির উপর নজর রাখা এবং জনগণকে সময় মত জানিয়ে করা। সে কাজটি না হলে জাতির পা একই গর্তে বার বার পড়ে। পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশে সে কাজটি বহুকাল যাবত হয়নি। স্বৈরাচারকবলিত এ দেশটিতে শাসকের গুণকীর্তন প্রচুর প্রশ্রয় পেলেও কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল বিপদের ভয়ানক বিষয়গুলিকে জনসম্মুখে তুলে ধরা। ফলে জাতির অনেক ভয়ানক রোগের কথা অজানা রয়ে গেছে জনগণের কাছে।      

                                                     

শুরুর কাজটিই কখনো হয়নি

রাষ্ট্র নির্মাণে নামার আগে নবীজী (সা:) ব্যক্তি নির্মাণের কাজটি শুরু করেছিলেন। অথচ বিগত প্রায় হাজার বছরে বাঙালি মুসলিম জীবনে সে কাজটিই কখনোই হয়নি। ব্যক্তি নির্মাণের কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো জ্ঞান ও দর্শন। প্রতিটি রাজনৈতিক বিপ্লবের আগে জনগণের দর্শনে বিপ্লব আনতে হয়। তাই রুশো ও ভল্টেয়ার ছাড়া ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লের কথা ভাবা যায় না। তেমনি পবিত্র কুর’আন ছাড়া ভাবা যায়না মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবের কথা -যা এনেছিলেন মহান নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবাগণ। মানবের চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রকে বিশুদ্ধ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইটি হয় চেতনার ভূবনে -রাজনীতির মাঠে বা রণাঙ্গণে নয়। সে লড়াই’য়ের মূল অস্ত্রটি হলো জ্ঞান। এবং সে বিশুদ্ধ জ্ঞানের ‌একমাত্র উৎস হলো ওহীর জ্ঞান। পবিত্র কুর’আন নাযিলের পর সে জ্ঞানের একমাত্র সঠিক উৎসটি হলো পবিত্র কুর’আন। চেতনার ভূবনের এ লড়াইকে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন “জিহাদান কবিরা” অর্থাৎ বড় জিহাদ। লক্ষণীয় হলো সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা রণাঙ্গণের অস্ত্রের জিহাদকে বড় জিহাদ বলেননি। এ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের গুরুত্ব বুঝা যায়। চেতনার ভূমিতে লড়াই’য়ের নির্দেশটি এসেছে পবিত্র কুর’আনে সুরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে। হুকুম দেয়া হয়েছে:

فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا

অর্থ: “অতঃপর তোমরা কাফিরদের (ধর্ম, মতবাদ, জীবন দর্শন, বিধান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির) অনুসরণ করো না, তাদের বিরুদ্ধে বড় জিহাদটি করো  কুর‌’আন দিয়ে।”

ইসলামের বিধান হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে যখন কোন হুকুম আসে -সে হুকুম পালন করা প্রত্যেকের উপর ফরজ হয়ে যায়। সে হুকুমটি নবীজী (সা:)’র উপর এলেও সেটির পালন ফরজ হয় প্রতিটি মুসলিমের উপর। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত এভাবেই ফরজ হয়েছে। উপরিউক্ত আয়াতে যে জিহাদকে “জিহাদকে কবিরা” বলা হয়েছে সেটি অস্ত্রের জিহাদ নয়। অস্ত্রের জিহাদ তো অস্ত্র দিয়ে লড়তে হয়। কিন্তু এখানে নির্দেশ এসেছে কুর’আন দিয়ে জিহাদের। এর অর্থ হলো এ জিহাদ লড়তে হবে কুর’আনের জ্ঞান দিয়ে। সে জিহাদ যেমন নিজের চেতনার ভূমিতে, তেমনি আশেপাশের অন্যদের চেতনার ভূমিতেও -তথা সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। এটিই হলো মু’মিনের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ।

যেহেতু চেতনার ভূমিতে জিহাদে অংশ নেয়া প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ -তাই কুর’আন বুঝা এবং কুর’আনের জ্ঞানার্জন করাটিও প্রতিটি মুসলিম নর ও নারীর উপর ফরজ। অজ্ঞ থাকাটি তাই কবিরা গুনাহ। না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াতে সে জিহাদের সামর্থ্য সৃষ্টি হয়না; ফলে তাতে জিহাদের ফরজও আদায় হয় না। আর বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে বিজয়ী না হলে তার পক্ষে রাজনৈতিক ও অস্ত্রের জিহাদে অংশ নেয়া    অসম্ভব হয়। নবীজী (সা:)‌’র যুগে জিহাদ থেকে দূরে থাকা লোকদের মুনাফিক বলা হয়েছে -যা কাফিরদের চেয়েও অধিক ঘৃণীত ও নিকৃষ্ট। তাই মুসলিম জীবনে গুরুত্বপূর্ণ শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো জিহাদে অংশ। নামাজ-রোজা পালন না করে যেমন মুসলিম হওয়া যায়না, তেমনি জিহাদে অংশ না নিয়ে কেউ মুসলিম হতে পারে না। তাই নবীজী (সা:)‌’র যুগে এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যিনি জিহাদে অংশ নেননি।

বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের ফরজ পালন করতে গিয়েই প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের মাঝে জ্ঞানের বিশাল বিপ্লব এসেছিল।  সে সময় আরবী ভাষা সীমিত ছিল স্রেফ জাজিরাতুল আরব নামক উপদ্বীপে -যা ছিল পারস্য উপসাগর, ওমান সাগর ও লোহিত সাগর দিয়ে তিন দিকে ঘেরা। আধুনিক সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত, ওমান ও ইয়ামেন নিয়ে হলো জাজিরাতুল আরব। এ বাইরের অঞ্চলের জনগণের ছিল নিজস্ব ভৌগলিক পরিচিতি ও ভাষা। তাই জিহাদে কবিরা’র ফরজ আদায় করার প্রয়োজনে ইরাক, সিরিয়া, মিশর, সুদান, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, মৌরতানিয়ার মত দেশের নাগরিকগণ মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করে। ইরানী মুসলিম জনগণও সে পথে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু বর্ণবাদী-জাতীয়তাবাদী ইরানী রাজাগণ সে আরবীকরণের প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। সেটিই ইরানীদের ভিন্ন রাজনৈতিক ধারায় নিয়ে যায়। মুসলিম উম্মাহর মাঝে ইরানীরাই হলো বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদের জনক। ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্র ভূমি থেকে। অথচ ইরানীরা আরবী ভাষা গ্রহণ করলে এবং প্যান-ইসলামে দীক্ষা নিলে সম্ভবত তারাই হতো মুসলিম উম্মাহর নেতা। কারণ, আরবী ভাষী অন্যদের তুলনায় তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সামর্থ্য ছিল অধিক। কিন্তু সে সুযোগ তারা হারিয়েছে। এজন্যই ইমাম খোমিনী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহর নেতা হতে পারেননি।            

                                                                                                                                                  নবীজী (সা:) তাঁর নবুয়তের জীবনের প্রথম ১৩টি বছর বাস করেছেন মক্কার কাফির সমাজে। সেখানে তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে কোন অস্ত্রের যুদ্ধ লড়েননি, লড়েছেন বুদ্ধিবৃত্তিক তথা দর্শনের লড়াই। কাফিরদের চেতনা ও দর্শন পাল্টানোর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পাল্টিয়েছেন ইসলামে দীক্ষা দেয়া নতুন মুসলিমদের দর্শন ও চেতনা। আর ব্যক্তির দর্শন ও চেতনা পাল্টে গেলে পাল্টে যায় তার চরিত্র, আচরণ, কর্ম ও রাজনীতি। সমগ্র মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবগুলি সৃষ্টি হয়েছে নবীজী (সা:)’‌‌র হাতে তাঁর নবুয়তের প্রথম ১৩ বছরে। তাঁর সাফল্যের কারণ, একটি জনগোষ্ঠির দর্শন বা চিন্তার মডেল পাল্টানোর কাজটি আর কখনোই এতোটা গভীর ভাবে আর কোন কালেই হয়নি। বাঙালি মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার কারণ, মানবের চেতনা পরিশুদ্ধির সে প্রথম কাজটি কখনোই তাদের জীবনে হয়নি। সে কাজটি সুলতানী আমলে যেমন হয়নি, তেমনি মোঘল ও নবাবী আমলেও হয়নি। পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী আমলেও নয়। পরিতাপের বিষয় হলো এখনো সে কাজটি হচ্ছে না। এমনকি ইসলামপন্থীদের মধ্যে হাজারে ক’জন আছে যারা কুর’আনকে সরাসরি আরবী থেকে বুঝতে পারে? একজনও কি হবে? তরজমা পড়ে তো আর কুর’আন থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার কাজটি তেমন হয়না।  অথচ ব্যক্তি জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিপ্লবের ক্ষেত্রে এটিই হলো প্রথম ধাপ। ভিত নির্মাণের কাজটি না করে যেমন মজবুত দালান নির্মাণের কাজটি হয়নি, তেমনি চেতনা রাজ্যে পরিশুদ্ধি বা বিপ্লব না এনে পরিশুদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি হয়না।

 

বিপ্লব কি তবে ব্যর্থ হবে?

 পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের অতীত গৌরবের ইতিহাস থেকে এই সহজ পাঠটি কেউ নিচ্ছে না। বাংলাদেশে সংঘটিত আগস্ট বিপ্লবের পর অনেকেই রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবী তুলছে। দাবী উঠেছে সংবিধান সংশোধন, পুলিশ সংস্কার, প্রশাসংনিক সংস্কার, আদালতের সংস্কার ইত্যাদি নানা সংস্কারের।  সরকারি মহল থেকেও সংস্কারের উপর গুরুত্বের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা কেউই জনগণের সংস্কারের কথা বলছেন না। এবং জনগণের সংস্কারে জিহাদটি জনগণের চেতনার ভূমিতে লড়তে হয় এবং সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। সে লড়াই’য়ে জিততে হলে যে মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র পবিত্র কুর’আনকে ব্যবহার করতে হয় -সে কথাটি কেউ বলছে না। এমন কি যারা বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতা-কর্মী এবং আলেম-আল্লামা তারাও বলছেন না। এটিই হলো সবচেয়ে বড় শংকার কারণ। কারণ, মনে হচ্ছে, বিপ্লব কি ভাবে সফল হয় -সেটিই তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিপ্লবের অর্থ ব্যক্তির বদল নয়, সেটি দর্শনের বদল।  সেটি চিন্তা-চেতনার মডেলের বিপ্লব। বিপ্লবের এ মূল ভূমিতে বিপ্লব না এলে বিপ্লব সফল হবে কিরূপে?   

রাষ্ট্রীয় বিপ্লব বাংলার ভূমিতে এর আগেও এসেছে। তাতে সরকারের বদল হলেও সেসব বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেছে। কারণ রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের শুরুর কাজটি শুরুতে করা হয়নি। ভিত না গড়েই প্রাসাদ নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে। বাঙালি মুসলিম জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব এসেছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশের ১৯০ বছর গোলামীর পর সেটিই ছিল বাঙালি মুসলিম জীবনে প্রথম স্বাধীনতা। কিন্তু সে বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায়। ব্যর্থ হওয়ার কারণ, পাকিস্তান সরকার ভৌতিক অবকাঠামো ও শিল্প কারখানা নির্মাণে গুরুত্ব দিয়েছিল, কিন্তু জনগণের বিশ্বাস ও দর্শনের মেরামতে গুরুত্ব দেয়নি। গুরুত্ব পায়নি মহান আল্লাহতায়ায়লার দেয়া মানব উন্নয়ন ও রাষ্ট্র উন্নয়নের রোডম্যাপ -যা নবীজী (সা:) শতভাগ অনুসরণ করেছিলেন। ঘোড়ার আগে তারা গাড়ি জুড়েছিলেন। ষাটের দশকে পাকিস্তান তৃতীয় বিশ্বের বুকে দ্রত শিল্প উন্নয়নের মডেল রূপে প্রশংসাও পেয়েছে। প্রখ্যাত Time ম্যগাজিনে তা নিয়ে প্রচ্ছদ নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।  অর্থনীতিতে প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পাকিস্তান পরিদর্শনে টিম আসতো উন্নয়নের মডেল দেখতে।  কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে।

পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে অর্থনৈতিক কারণে নয়। বৈষম্যের কারণেও নয়। প্রবল আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে ভারত এখনো টিকে আছে। পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে মানব উন্নয়নে তথা চেতনায় পরিশুদ্ধি আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। ষাটের দশকে বাঙালি ছাত্র-জনতার চেতনার ভূমি দখলে নেয় জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ, সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদগুলি। ফলে খড়-কুটো ও কচুরি পানা’র ন্যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ভেসে যায় সে জঞ্জালের স্রোতে। অথচ রাষ্ট্রের ও বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব ছিল সেসব বিষাক্ত মতবাদের দূষণ থেকে ছাত্র-জনতার চেতনাকে সুরক্ষা দেয়া। এর জন্য জরুরি ছিল বিপুল সংখ্যক বুদ্ধিবৃত্তিক যোদ্ধা। কিন্তু আল্লামা ইকবালের মৃত্যুর পর সেরূপ যোদ্ধা  পাকিস্তানীদের মাঝে আর পয়দা হয়নি। সে সময়ের সরকার, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও আলেমদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায়নি মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সে “জিহাদে কবিরা”র কাজ। ফলে শত্রুশক্তি বিনাযুদ্ধেই বিজয় পেয়েছে।

পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশ আজ সে একই পথে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের কোন লক্ষণ নেই। “জিহাদে কবিরা”য় কোন প্রয়োজনীয় লোকবল নাই। দেশের সরকার, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও আলেমগণ এখনো সে পথেই চলছে -যে পথ অতীতে স্রেফ ব্যর্থতাই উপহার দিয়েছে। বুঝতে হবে, দ্রুত বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আনতে ব্যর্থ হলে এ রাজনৈতিক বিপ্লব সহজেই মারা যাবে -যেমন মারা গেছে ১৯৪৭’য়ের স্বাধীনতার বিপ্লব। তখন দায়িত্ব পালেন ব্যর্থতার কারণে আসবে ভয়ানক আযাব।  ১৫/০৯/২০২৪

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *