বিবিধ ভাবনা (৩৪)

ফিরোজ মাহবুব কামাল

১. নবীজী (সা:)’র ইসলাম ও আজকের ইসলাম

সৈনিককে শুধু প্রশিক্ষণ নিলে চলে না, দেশরক্ষায় যুদ্ধেও নামতে হয়। সেটি না হলে দেশের সাথে গাদ্দারী হয়। সেরূপ গাদ্দার সৈনিকদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে দেশের স্বাধীনতা বাঁচে না। তেমনি মুসলিম জীবনে শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত থাকলে চলে না। অসত্যের নির্মূল, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও আদালতে শরিয়ত পালন করতে জিহাদেও নামতে হয়। এটিই নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামের ইসলাম। মুসলিমগণ বিশ্বশক্তি রূপে খাড়া হয়েছিল তো এ ইসলাম নিয়ে বাঁচার কারণে।

আজকের মুসলিমগণ যে ইসলাম নিয়ে বেঁচে আছে -সেটি নবীজী (সা:)’র ইসলাম নয়। আজকের ইসলামে নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত আছে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়ত, ঐক্য ও জিহাদ নাই। মুসলিমগণ বাঁচছে নবীজী (সা:)’র ইসলামের সাথে গাদ্দারী নিয়ে। ফলে তাদের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সে শক্তি ও ইজ্জত নাই। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার খাতায় কি তারা মুসলিম রূপে গণ্য হবে? স্থান পাবে কি জান্নাতে? জান্নাতে যেতে হলে তো নবীজী (সা:)’র ইসলামের অনুসারি হতে হয়।

 

২. বিজয় ডাকাতদের

বাংলাদেশে গণতন্ত্র কবরে গেছে; চলছে ডাকাততন্ত্র। এবং বিজয়ী ডাকাতাগণ। ডাকাততন্ত্রে ভোট লাগে না, লাগে ডাকাতির সামর্থ্য। সে সামর্থ্য রয়েছে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীও এখন হাসিনার ডাকাত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ডাকাতপাড়ায় দালানকোঠা দেখে বলা যায় না যে উন্নতি হয়েছে। উন্নয়নের পরিমাপে জরুরি হলো গণতন্ত্র্ কতটা প্রতিষ্ঠা পেল এবং জনগণ কতটা মানবিক অধিকার পেল সেটি। ডাকাতের গ্রামকে সভ্য গ্রাম বলা হয় না। তেমনি ডাকাত অধিকৃত দেশকেও সভ্য দেশ বলা যায় না। দেশে তখন প্রতিষ্ঠা পায় ডাকাত পাড়ার সংস্কৃতি। সে সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠা ও সন্মান পায় ডাকাতগণ। ডাকাত বিরোধীদের তখন গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। 

 ৩. ছোট ডাকাত ও বড় ডাকাত

ছোট ডাকাতেরা মানুষের অর্থ ডাকাতি করে। বড় ডাকাতেরা জনগণের ভোটের উপর ডাকাতি করে। তখন সমগ্র দেশ ও দেশের সম্পদ ডাকাতদের হাতে চলে যায়। আমলা বাহিনী, আদালত বাহিনী, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীও তখন ডাকাতদের বাহিনীতে পরিণত হয়। জনগণকে তখন সে ডাকাত প্রতিপালনে রাজস্ব জোগাতে হয়।

বাংলাদেশে ডাকাতদের জৌলুস বাড়ছে এবং গরীব মানুষ আরো দরিদ্র হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশ, অভাবের তাড়নায় মানুষ সন্তান বিক্রি করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর মটর সাইকেল  চালায়, আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজরকে দেয়া হয় ৫০ লাখ টাকার জিপ ও সে সাথে জোগানো হয় তেলের খরচ। মুজিব আমলেও সেটিই হয়েছিল। ক্ষুধায় মানুষ বুমি খেয়েছে, আর মুজিব সোনার মুকুট পড়িয়ে ছেলের বিয়ে দিয়েছে। দেশ ডাকাতদের দখলে যাবে এবং তাদের জৌলুস বাড়বে না –সেটি কি হয়? তাই কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে বাংলাদেশে শান্তি আনা যাবে না, সে জন্য ডাকাত তাড়াতে হবে।

৪. উৎসব ভাংঙ্গা নিয়ে

মুসলিমকে শুধু নামায-রোযা নিয়ে ভাবলে চলে না। তাকে ভাবতে হয় মুসলিম উম্মাহর ইজ্জত ও নিরাপত্তা নিয়েও। ন্ইলে শত্রুশক্তির গোলাম হতে হয়। সভ্য মানুষেরা তাই যেমন মজবুত ঘর গড়ে তেমনি শক্তশালী রাষ্ট্রও গড়ে। অতীতে তাই মুসলিমগণ তাদের জানমালের বিশাল ভাগ বিনিয়োগ করেছিলেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। বৃহৎ ভূগোলের যে শক্তি সে শক্তি শত কোটি বিচ্ছিন্ন মানুষের থাকে না। সে শক্তি হাজার হাজার মসজিদ-মাদ্রাসারও থাকে না। একেই বলে power of geopolitics। ভূগোল বাড়লেই শক্তি বাড়ে। অতীতের মুসলিমগণ সেটি বুঝতেন; তাই ভূগোল বাড়াতে তারা বিপুল অর্থ ও রক্ত ব্যয় করেছেন। সে সুস্থ্য বিবেক বোধ দেখা গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে বাঙালী মুসলিম লীগ নেতাদের মাঝে। আর আজকের মুসলিমগণ রক্ত ব্যয় করে ভূগোল ভাংঙ্গতে। তাদের উৎসব দেশ ভাংঙ্গা নিয়ে, গড়া নিয়ে নয়। ১৯৭১’য়ের পর সে উৎসবটি ব্যাপক ভাবে দেখা যায় বাংলাদেশের বাঙালী মুসলিমদের মাঝে।

মহান আল্লাহতায়ালা শুধু ব্যক্তির নামায-রোযার হিসাবই নেন না, হিসাব নেন কিসে তার আনন্দ-উৎসব সেটিরও। কারণ, আনন্দ-উৎসবের মধ্যে ধরা পড়ে তার প্রকৃত ঈমান ও চেতনা। মুসলিম দেশ ভাংঙ্গলে সাহস ও শক্তি বৃদ্ধি পায় কাফেরদের। তাতে পরাজয় ও গোলামী বাড়ে মুসলিম উম্মাহর। তাই যারা মুসলিম দেশ ভাংঙ্গাকে সমর্থন করে ও তা নিয়ে উৎসব করে -তারা বাঙালী, আরব, কুর্দি, হিন্দু, খৃষ্টান ও বৌদ্ধ হতে পারে কিন্তু প্রকৃত মুসলিম হতে পারে না। তারা মিত্র কাফের শক্তির। যেমনটি দেখা গেছে মুজিব ও তার অনুসারিদের ক্ষেত্রে। একখানি প্লেট ভাংঙ্গলেও একজন সুস্থ্য মানুষের মনে কষ্ট হয়। একটি মুসলিম দেশ ভেংঙ্গে গেল অথচ মনে কষ্ট পেল না, সেটি কি করে সম্ভব? সেটি সম্ভব একমাত্র ঈমান না থাকাতে। 

একাত্তরে তাই কোন ইসলামী দল ও আলেম পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সমর্থন করেনি। এটি ছিল ভারতপন্থী ও রুশপন্থী আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টির কাজ। বিশ্বের কোন মুসলিম দেশও দেশভাংঙ্গার এ কাজকে সমর্থন করেনি; সমর্থন করেছে ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া ও ভূটানের ন্যায় কাফের রাষ্ট্র।   

৫. আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুতি ও মুসলিমদের গাদ্দারী

সুরা বাকারায় মহান আল্লাহতায়ালার ওয়াদা: “ফাজকুরুনি, আজকুরুকুম”। অর্থ: তোমরা আমার স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো। এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁর স্মরণে থাকার জন্য কোন পীরদরবেশের মধ্যস্থতার দরকার নেই। আল্লাহতায়ালার স্মরণ নিয়ে বাঁচার অর্থ শুধু তাঁর নাম ও কুদরতের স্মরণ নিয়ে বাঁচা নয়। বরং সেটি হলো, তাঁর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়বদ্ধতাটি সর্বদা স্মৃতিতে নিয়ে বাঁচা। সে দায়িত্ব থেকে গাফেল হয়ে যাওয়ার ভয়টিই হলো তাকওয়া।

প্রতিটি ঈমানদারের উপর সে অর্পিত দায়ভারটি হলো, নিজ নিজ জনপদে তাঁর খলিফা তথা প্রতিনিধি রূপে দায়িত্ব পালন। সে দায়িত্বপালনে মুমিন ব্যক্তি পরিণত হয় আমৃত্যু তাঁর সৈনিকে। সে তখন বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনকে বিজয়ী করার স্মরণ নিয়ে। আর যে ব্যক্তি প্রতি মুহুর্ত বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা নিয়ে, বস্তুত তাঁর প্রতি হলো তাঁর এ বিশেষ ওয়াদা। যারা তাঁর আইনকে এ পৃথিবীপৃষ্ঠে বিজয়ী করতে আত্মনিয়োগ করে, নিশ্চয়ই তিনি তাদেরকে বিজয়ী করবেন আখেরাতে।

অথচ মুসলিম জীবনে এক্ষেত্রে গাদ্দারীটি বিশাল। তারা বাঁচছে স্মৃতিতে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা ধারণ না করেই। তারা যে তাঁর খলিফা -সে ধারণাটিও বিলুপ্ত হয়েছে। তারা রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী ও সেক্যলারিস্ট, অর্থনীতিতে সূদখোর, প্রশাসনে ঘুষখোর, সংস্কৃতিতে হিন্দুয়ানী এবং আদালতে কাফেরদের আইনের অনুসরারি। সর্বত্রই বিদ্রোহ। স্মৃতিতে মহান আল্লাহতায়ালার স্মরণ থাকলে কি এমনটি হতো? 

৬. রাষ্ট্রের গুরুত্ব ও মুসলিমের ব্যর্থতা

মানুষের সবচেয়ে বড় উপকারটি অর্থদানে হয়না। সেটি হয় জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর মধ্য দিয়ে। সেটি সম্ভব হয় কোরআনের জ্ঞান দিয়ে। সে কাজটি একজন ব্যক্তি যেমন করতে পারে, তেমনি একটি সংগঠনও করতে পারে। কিন্তু পৃথিবী পৃষ্টে জান্নাতে নেয়ার সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকল্পটি হলো ইসলামী রাষ্ট্র। সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তখন কাজ হয়, অসত্যের নির্মূল ও সত্যের প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়া তখন মানুষকে জান্নাতের পথে নেয়ার বাহনে পরিণত হয়।

রাষ্ট্রই হলো মানব সভ্যতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে রেখে ইসলামী বিধানকে প্রতিষ্ঠা দেয়া অসম্ভব। বিষয়টি নবীজী (সা:) বুঝতেন এবং আল্লাহতায়ালাও চাইতেন বলেই মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর প্রথম কাজ হয় নিজের ঘর না গড়ে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়া। মুসলিমগণ যে তৎকালে সুপার পাওয়ারে পরিণত হয় তার কারণ হলো এই ইসলামী রাষ্ট্র। লক্ষ লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে কি সেটি সম্ভব হতো? বিজয় ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে হলে শুধু নামায-রোযা বুঝলে চলে না, বুঝতে হয় রাষ্ট্রের গুরুত্ব এবং power of geopolitics। মুসলিমদের আজকের ব্যর্থতা এখানেই। তারা ব্যর্থ হয়েছে নবীজী(সা:)’র আদর্শে ইসলামী রাষ্ট্র গড়তে্। রাষ্ট্র অধিকৃত হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের হাতে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে তথা জাহান্নামে নেয়ার কাজে। ফলে রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে মানবের সবচয়ে বড় শত্রুতে। কোন হিংস্র পশুর হাতে এতো বড় ক্ষতি হচ্ছে না।  

৭. ঈমানদারী ও বেঈমানীর পরিচয়

ঈমানদারের পরিচয় হলো ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে সে সবার সামনে থাকে। তাকে দেখা যায় অন্যায়ের নির্মূলে ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়। দেখা যায় মুসলিমদের মাঝে ঐক্য গড়তে। সে চেতনায় প্যান-ইসলামীক হয়। তার নৈতিক সামর্থ্যটি দেখা যায় ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে অন্যদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ায়। বেঈমানের পরিচয় হলো, সে প্রচণ্ড স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ হাছিলে তাকে সবার আগে আগে দেখা যায়। এবং ইসলামকে বিজয়ী করার বদলে তারা প্রচেষ্টা হয় ইসলাম ও মুসলিমকে পরাজিত করায়। তার রাজনীতিতে থাকে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে মুসলিম উম্মাহর দেহে বিভক্তির দেয়াল গড়ার এজেন্ডা। মুসলিম দেশগুলোতে এরাই বিজয়ী। মুসলিম উম্মাহর এরাই ঘরের শত্রু।  ০৯/০৩/২০২১।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *