বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি ও বাঙালি মুসলিমের বিপর্যয়

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 বেঈমানের বুদ্ধিবৃত্তি এবং ঈমানদারের বুদ্ধিবৃত্তি

মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তি ও নাশকতাটি ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকর্ম, পেশাদারীত্ব বা অর্থনীতিতে ঘটে না, সেটি ঘটে বুদ্ধিবৃত্তিতে। তেমনি মানব জীবনের সবচেয়ে বড় নেককর্মটিও ঘটে বুদ্ধিবৃত্তিতে। জীবনের যাত্রাটি জান্নাতের পথে হবে, না জাহান্নামের পথে হবে -সে সিন্ধান্তটি গৃহীত হয় বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। তাই বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বুদ্ধিবৃত্তিতে যারা শ্রেষ্ঠ তারাই সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের নেতৃত্ব পায়। বুদ্ধিবৃত্তিতে যারা নিকৃষ্ট ও মৃত, পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে বোবা, বধির, অন্ধ, বিবেকহীন, ভারবাহী গাধা, গবাদী পশু, পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট ইত্যাদি নানা উপাধীতে চিত্রিত করেছেন। মগজ যেমন দেহ চালায়, বুদ্ধিবৃত্তির নায়কগণ তেমনি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালায়। বুদ্ধিবৃত্তিই নির্ধারণ করে উম্মাহর ভাগ্য। তাই ইসলামে ইবাদত শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, তাসবিহ-তাহলিল নয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত হলো চিন্তাভাবনা করা। নবীজী (সা)’র হাদীস: “আফজালুল ইবাদাহ তাফাক্কুহ।” অর্থ: উত্তম ইবাদত হলো চিন্তাভাবনা করা। চিন্তাভাবনার বার বার হুকুম এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকেও। ব্যক্তির বিবেককে জাগ্রত করতে পবিত্র কুর’আনে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন “আ’ফালাতাক্বিলুন”, “আ’ফালাতাদাব্বারুন”, “আফালা তাফাক্কারুন”। প্রশ্ন এখানে, তোমরা কেন বুদ্ধিকে কাজে লাগাও না, কেন ধ্যানমগ্ন হওয়া না এবং কেন চিন্তা-ভাবনা করো না?

সত্যের বিরুদ্ধে নাশকতায় বেঈমানের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটি হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি। বেঈমানের জীবনে এখান থেকেই পাপের পথে যাত্রা শুরু হয়। বস্তুত বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রষ্টতাই ব্যক্তিকে জাহান্নামে নেয়। দেশ বা জাতি কখনোই কৃষক, শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের নিরক্ষরতা বা মুর্খতার জন্য বিপর্যস্ত হয় না। তাদের কারণে আযাবও আসে না। মুসলিম উম্মাহর বুকে বিভক্তি, নৈরাজ্য, পরাজয়, বিপর্যয় ও আযাব আসে মূলত রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী বা আলেম রূপে যারা পরিচিত তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তির কারণে। কারণ দেশের চালকের সিট তাদেরই দখলে। বুদ্ধি দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে ও নেতৃত্ব দিয়ে এরাই দেশকে নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালিত করে। এরাই রাজনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, মূল্যবোধ ও জনজীবনে পরিবর্তন বা বিপ্লব আনে। এরা দুর্বৃত্ত ও বিভ্রান্ত হলে জ্ঞানদান বা পথ দেখানোর নাম করে তারাই জনগণের জীবনে পথভ্রষ্টতা বাড়ায়। বিপর্যস্ত করে জাতিকে। এমন কি ধর্মকে তারা অর্থ-উপার্জন ও ক্ষমতা বিস্তারের হাতিয়ারে পরিণত করে। বনি ইসরাইলীগণ যেরূপ পথ হারিয়েছিল ও আযাবের কবলে পড়েছিল -সেটি তাদের কৃষক-শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের কারণে নয় বরং আলেম বা বুদ্ধিজীবীদের কারণে। পথভ্রষ্ট সে আলেমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমগ্র বনিইসরাইলীদের জন্য বিপদ ডেকে এনেছিল। তাদের কারণেই সাধারণ বনি ইসরাইলীগণ সেদিন পথহারা হয়েছিল।

বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি

বনি ইসরাইলীদের ন্যায় একই রূপ বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি ও নাশকতা ঘিরে ধরেছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অঙ্গণে সকল নাশকতার শুরু এ বুদ্ধিবৃত্তিক নাশকতা থেকে। ফলে দেশে যতই বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকাশনা সংস্থা, পত্র-পত্রিকা, বই-পত্র ও বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ততই বাড়ছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমেরবিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা। কারণ, এগুলি পরিণত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক নাশকতার ঘাঁটিতে। এজন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুশত প্রফেসর দল বেঁধে যখন ২০১৮ সালের ভোটডাকাতির নির্বাচনকে সুষ্ঠ নির্বাচন বলে তখন বিস্ময়ের কিছু থাকে না। অথচ শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে ২০১৮ সালের ভোটডাকাতি ছিল সর্ববৃহৎ ডাকাতি। বিশ্বের কোন একটি ডাকাত দল এক রাতে বড় জোর কোন একটি গ্রাম বা মহল্লার সবগুলি বাড়ীতে ডাকাতি করে। কিন্তু এর পূর্বে কোন দেশেই কোন ডাকাত দল এক রাতে সমগ্র দেশ জুড়ে সফল ডাকাতি করতে পারিনি। সে সফলতা শেখ হাসিনা ও তার ডাকাত বাহিনীর। এ বিশাল ডাকাত বাহিনীটি গড়ে উঠেছিল দেশের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নির্বাচনি কমিশন, মিডিয়া ও দলীয় রাজনৈতীক ক্যাডারদের দিয়ে। শেখ হাসিনার সফল ডাকাতির সে ইতিহাস বাংলার ইতিহাসে শত শত বছর বেঁচে থাকবে। বহু শত বছর পরও নতুন বাঙালি প্রজন্ম বিস্ময়ে ধিক্কার দিবে দেশের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নির্বাচনি কমিশন কীরূপে দেশব্যাপী ডাকাতে পরিণত হলো? বিবেকে এরূপ মহামারী কীরূপে ঘটলো?

অপর দিকে শেখ হাসিনার ন্যায় ডাকাত দলের নেত্রীকে শ্রদ্ধেয় ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলার চেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বৃত্তি আর কি হতে পারে? বিশ্বের কোন দেশের কোন সভ্য মানুষ কি কোন ডাকাতকে শ্রদ্ধা জানায়? এটি তো ডাকাত পাড়ার সংস্কৃতি। সেখানে সবচেয়ে সবচেয়ে নৃশংস ডাকাতকে নেতা বানানো হয়। অথচ ডাকাত পাড়ার সে সংস্কৃতি নিয়ে উৎসব হয় বাংলাদেশে। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, ধর্ষণ ও চুরি-ডাকাতির কারণে নয়। বরং দুর্বৃত্তদের সমর্থণ করা ও তাদের প্রতি সম্মান জানানোর কারণে। কারণ, সেটিই হলো ঈমানশূণ্যতা ও সত্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বেঈমানীর দলিল। এরূপ বেঈমানগণই যুগে যুগে নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধে খাড়া হয়েছে। এবং আজ খাড়া হচ্ছে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে। এরাই সর্বদেশে ও সর্বকালে অনুগত সৈনিক হয় ফ্যাসিবাদী ফিরাউনদের। বাংলাদেশে শাপলা চত্বরের গণহত্যাও তো এদেরই সৃষ্টি।

জাহিলিয়াত হলো মানব চরিত্রের সবচেয়ে ভয়ানক রোগ। মুর্তিপূজা, গরুপূজা, চুরিডাকাতি, মিথ্যাচারসহ সকল পাপের জন্ম এ জাহিলিয়াত থেকেই। সে জাহিলিয়াত ধরা পড়ে দৃর্বৃত্ত শক্তির সমর্থণ করার মধ্য দিয়ে। মুসলিম জীবনে জিহাদের শুরু জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ দিয়ে। এটিই হলো ঈমানদারের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। মানব জীবনের এটিই হলো শ্রেষ্ঠ নেক কর্ম। যারা এ জিহাদ সফল হয়, তারাই শত্রুর সামনে অস্ত্রের জিহাদে শরীক হয় এবং শহীদ হয়। এরাই বিনা হিসাবে জান্নাতে যায়। মুসলিম হওয়ার জন্য শর্তই হলো সর্বপ্রথম মনের অন্ধকার সরানোর জিহাদে নামা। সিরাতাল মুস্তাকীমের পথে যাত্রাটি শুরু হয় এখান থেকেই। মনের অন্ধকার সরানোর এ জিহাদকে সফল করার জন্যই কুর’আনের জ্ঞানার্জনকে সর্বপ্রথম ফরজ করা হয়েছে। কারণ, একমাত্র কুর’আনই দেয় মনের অন্ধকার সরানোর আলো। জান্নাতের দরজা জাহেলদের জন্য বন্ধ; তাদের জন্য যা নির্দিষ্ট তা হলো জাহান্নামের আগুন। তাদের জন্য আযাব দুনিয়াতেও –যার প্রতিশ্রুতি বার বার শুনানো হয়েছে পবিত্র কুর’আনে।

 

অন্তহীন কল্যাণের পথ ও অকল্যাণের পথ

মানুষ হিদায়েত পাবে না পথভ্রষ্ট হবে, জান্নাতের পথে চলবে না জাহান্নামের দিক যাবে -সেটি ব্যক্তির উত্তম পানাহার, গৃহ ও দৈহিক বলের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ও সঠিক সিদ্ধান্তের উপর। তাই বুদ্ধিবৃত্তির সামর্থ্যই ব্যক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। যে শিক্ষা সে সামর্থ্যে বৃদ্ধি আনে -সেটিই শ্রেষ্ঠ নেক আমল। সঠিক বুদ্ধিবৃত্তির জন্য চাই সঠিক জ্ঞান। তাই শ্রেষ্ঠ নেক আমলটি অর্থদান বা বস্ত্রদান নয়, সেটি হলো জ্ঞানদান। জ্ঞানই মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায় ও জান্নাতে নেয়। নবীরাসূলগণ ধনী ছিলেন না, অর্থদানের সামর্থ্য তাদের ছিল না। তারা বিতরণ করেছেন ওহীর জ্ঞান। তাই জ্ঞানদান নবীরাসূলদের সূন্নত। এটিই চুড়ান্ত কল্যাণের পথ। সঠিক জ্ঞানের বলেই মানুষ আল্লাহকে ভয় করতে শেখে। জাহেলদের মনে সে ভয় সৃষ্টি হয়না। মহান আল্লাহতায়ালা তাই পবিত্র কুর’আনে বলেছেন, “ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা।” অর্থ: মানবসৃষ্টির মাঝে একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে।

যাদের মাঝে আল্লাহর ভয়টি প্রবল, বিপ্লব আসে তাদের কর্মের প্রায়োরিটিতে। সে আমলেই তারা বেশী মনযোগী হয় -যা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে বেশী পছন্দের। সাহাবাগণ তাই নবীজী (সা:)কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আল্লাহতায়ালার কাছে কোন আমলটি সবচেয়ে বেশী পছন্দের? মহান আল্লাহতায়ালা সে প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সুরা সাফ’য়ের ৪ নম্বর আয়াতে। বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। অর্থাৎ জিহাদ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সে জিহাদের দুটি রূপ। এক). বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। নবীজী (সা:) এ জিহাদটি শুরু করেছিলেন তাঁর মক্কী জীবনে নবুয়ত প্রাপ্তির শুরু থেকেই। এ জিহাদ মানুষের মনের ভূবন থেকে জাহিলিয়াত তথা অন্ধকার নির্মূলের। এ জিহাদ মানুষকে সত্যের পক্ষে সৈনিক রূপে গড়ে তোলার। দুই). সশস্ত্র জিহাদ। এ জিহাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের বুকে মিথ্যা, দুর্বৃত্তি ও জুলুমের অবকাঠামো নির্মূলের। কারণ এ অবকাঠামো বেঁচে থাকলে মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। নবীজী (সা:) এ জিহাদটি মদিনায় হিজরতের পর শুরু করেছিলেন। এ জিহাদের মধ্য দিয়েই নির্মূল হয় দুর্বৃত্তদের শাসন। প্রতিষ্ঠা দেন ইসলামী রাষ্ট্রের এবং তাতে মুসলিমগণ পায় শরিয়তসহ পূর্ণ ইসলাম পালনে সুযোগ।এবং নির্মিত হয় ইসলামী সভ্যতা।

জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা ব্যক্তির মুসলিম রূপে বেড় উঠার সামর্থ্যই কেড়ে নেয়। একমাত্র জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই জুটে ইসলামের পথে হিদায়াত। অর্জিত হয় আল্লাহর ভয়। তখন দূর হয় অজ্ঞতার আযাব। এজন্যই জ্ঞান বিতরণের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মানব-সেবা বা জন-কল্যাণের মাধ্যম নেই। জ্ঞানার্জনের কাজটি যথার্থ না হলে কোন ইবাদতই সঠিক ভাবে হয় না। হিদায়াত লাভও হয় না। ঈমানদার মানব ও সভ্য রাষ্ট্র গড়ার কাজটি হয়নি।  কিন্তু বনি ইসরাইলের আলেমগণ সে মহৎ কর্মকে ব্যবসায় পরিণত করেছিল। এমন কি মহান আল্লাহতায়ালার পবিত্র কালামকে তারা বিক্রয় করতো। বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানচর্চার ন্যায় সে শ্রেষ্ঠ ইবাদতকে হিদায়েত লাভে ও হিদায়াত দানে নয়, বরং নিজেদের আয় এবং জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি বাড়ানোর কাজে ব্যবহৃত করেছিল। তাদের কারণেই বনি ইসরাইলীগণ ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী বিধানকে প্রতিষ্ঠা দিতে। তারা তাওরাতকে সীমিত রেখেছে স্রেফ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পাঠের মাঝে। ফলে হযরত মূসা (আ:)’র উপর নাযিলকৃত শরিয়ত তাই ইসরাইলেও প্রতিষ্ঠা পায়নি। পররিতাপের বিষয় হলো, মুসলিম আলেমগণ আজ অভিশপ্ত বনি ইসরাইলী আলেমদেরই পথ ধরেছে।ফলে কোটি কোটি ঘরে না বুঝে কুর’আন পাঠের আয়োজন হলেও দেশের আদালতে পালিত হচ্ছে না শরিয়ত। শরিয়তের এরূপ বিলুপ্তি নিয়ে আলেমদের মাঝে কোনরূপ ক্ষোভ ও আন্দোলন নাই। তারা ব্যস্ত অর্থ না বুঝিয়ে স্রেফ কুর’আনের তেলাওয়াত শেখানোর চাকুরি নিয়ে।  

 

চলমান যুদ্ধ ও নিরস্ত্র বাঙালি মুসলিম

ঝড় শুরু আগে আকাশে প্রথমে কালো মেঘ জমতে থাকে। তেমনি ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাত্ব যুদ্ধ শুরুর আগে শত্রুর পক্ষ থেকে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে যুদ্ধ শুরু হয়। অনেক আগে থেকেই তেমনি একটি যুদ্ধ বাঙালি সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও হিন্দুদের পক্ষ থেকে চলছে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। এ চলমান যুদ্ধে বলা যায় ইসলামের শত্রুগণই বিজয়ী পক্ষ। কারণ, রণাঙ্গণে তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রবল প্রতিপক্ষ নাই। যে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ, তারা এই যুদ্ধে যেমন নিরস্ত্র, তেমনি নিষ্ক্রিয়। ইসলামপন্থীদের পক্ষে লড়াকু বুদ্ধিবৃত্তিক সৈনিক নাই। বাংলাদেশে নামাজী ও রোজাদারের সংখ্যাটি বিশাল হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের হাতিয়ার যে কুর’আনের জ্ঞান –সেটিই তাদের হাতে নাই। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুপক্ষ সহজেই বিজয়ী হয়েছে। এ পরাজয় নিয়ে তাদের মাঝে কোন অনুশোচনাও নাই।

বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি না হলে সশস্ত্র জিহাদে সৈনিক জুটে না। বদর, ওহুদ, খন্দকসহ মদিনা যুগের প্রতিটি সশস্ত্র জিহাদের শ্রেষ্ঠ সৈনিকগণ তো তারাই যারা গড়ে উঠেছিলেন মক্কী যুগের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের অঙ্গণ থেকে। পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের জীবনে অস্ত্রের যুদ্ধ না থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদটি তাদের সবার জীবনেই ছিল। ইসলামের সর্বশেষ নবী হযরত মহম্মদ (সা:)য়ের জীবনে যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ ছিল, তেমনি ছিল সশস্ত্র জিহাদও। এদিক দিয়ে তিনি সকল নবী-রাসূলদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। একমাত্র তিনিই জন্ম দিতে পেরেছেন সর্ববৃহৎ বিশ্বশক্তির এবং মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার। তাঁর জীবনে বু্দ্ধিবৃত্তিক জিহাদের শুরু নবুয়তপ্রাপ্তির শুরু থেকেই। এযুদ্ধের মূল হাতিয়ার ছিল পবিত্র কুর’আন। নবীজী (সা:)’র উপর সে জিহাদের নির্দেশ আসে এভাবে: “জাহিদু বিহি জিহাদান কবিরা।” অর্থ: ইহা (কুর’আন) দিয়ে বড় জিহাদটি করুন। কুর’আন দিয়ে জিহাদ করার অর্থ কুর’আনের জ্ঞান দিয়ে যুদ্ধ করা। এ জিহাদ হলো মানবের মনের ভূবন থেকে শয়তানের দখলদারীত্ব বিলোপ। এজন্যই জরুরি হলো কুর’আন বুঝা। যার কুর’আনের জ্ঞান নাই -সে এই যুদ্ধে অস্ত্রহীন। তাই যারা কুর’আন বুঝার বদলে কুর’আন তেলাওয়াতে দায়িত্ব সারে -তাদের সামর্থ্য থাকে না বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে অংশ নেয়ার। আর যার বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে নাই তারা কি ইসলামের পক্ষে কোন রাজনৈতিক ও সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে পারে? অধিকাংশ বাঙালি মুসলিমের একই অবস্থা। তারা এই জিহাদে নীরব দর্শক মাত্র।          

 

মিথ্যার শক্তি ও সত্যের শক্তি

সত্য ও কুর’আনী জ্ঞানের শক্তি অপরিসীম। তবে মিথ্যা ও অজ্ঞতার শক্তিও ভয়ংকর। সে শক্তির বলেই দেশে দেশে মিথ্যা ও অজ্ঞতা আজও বেঁচে আছে এবং ইসলাম পরাজিত। বাংলাদেশ তারই উদাহরণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের এ দেশটিতে বিজয় মিথ্যা ও অজ্ঞতার। আলোর মশাল জ্বালানো না হলে অন্ধকারই বেঁচে থাকে। তেমনি সত্য ও জ্ঞানের মশাল জ্বালানো না হলে মিথ্যা ও অজ্ঞতাই বিজয়ী হয়। বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতা এখানে বুদ্ধিদীপ্ত ঈমানদার রূপে বাঁচায়। ব্যর্থতা এখানে বুদ্ধিবৃত্তির। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ যে ভাবে কুর’আনী সত্য ও জ্ঞানকে নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে সেরূপ নামার কাজটি হচ্ছে না। মুসলিমগণ ব্যর্থ হচ্ছে সত্যকে চিনতে ও সত্যের পক্ষে সৈনিক হতে।

মানব জাতির ইতিহাস মূলত সত্য ও মিথ্যার মাঝে যুদ্ধের ইতিহাস। সে যুদ্ধের শুরু হাবিল ও কাবিল থেকে। সত্যের পক্ষটি যখনই লড়াকু সৈন্য পেয়েছে তখনই সত্য বিজয়ী হয়েছে। ঈমানদার হওয়ার অর্থ স্রেফ নামাজী ও রোজাদার হওয়া নয়, আমৃত্যু সত্যের পক্ষে আমৃত্যু সৈনিক হওয়া। ঈমানদার মাত্রই তাই আমৃত্যু মুজাহিদ। নবীজীবনের এটিই তো শিক্ষা। এ শিক্ষার বলেই সাহাবাগণ সত্যের পক্ষে সৈনিক রূপে খাড়া হয়েছেন এবং সত্যকে বিজয়ী করেছেন। সিরাতাল মুস্তাকীমে থাকলে জিহাদ যে অনিবার্য –নবীজী (সা:) সেটিই শিখিয়ে গেছেন। যে ব্যক্তির জীবনে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত থাকলেও সে ব্যক্তি সিরাতাল মুস্তাকীমে নাই। মুসলিমদের ব্যর্থতা এখানেই। বিপুল সংখ্যায় নামাজী, রোজাদার ও হাজী হলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে মুজাহিদ হতে। বিপুল সংখ্যায় সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্টদের দলে ভিড়লেও ব্যর্থ হচ্ছে জিহাদে যোগ দিতে। তাদের জীবনে নিজেকে, নিজের পরিবারকে ও নিজের দলকে বিজয়ী করার বিরামহীন লড়াই থাকলেও আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ নাই। এমন মুসিলমদের কারণেই মুসলিম দেশে বিজয় অসত্য ও অজ্ঞতার।

মানবের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মিথ্যা ও অজ্ঞতা। সকল পাপ ও সকল দুর্বৃত্তির জন্ম মিথ্যা ও অজ্ঞতা থেকে। মিথ্যা ও অজ্ঞতা গলা জড়াজড়ি করে চলে। বিষাক্ত জীবাণু ও হিংস্র পশু মানুষকে জাহান্নামে নেয় না, কিন্তু নেয় মিথ্যা ও অজ্ঞতা। তাই পাপ, দুর্বৃত্তি ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে হলে বাঁচতে হয় অজ্ঞতা ও মিথ্যাচার থেকে। পানাহারের পর জ্ঞানার্জনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানব জীবনে নাই। ইলম দেয় আল্লাহর ভয় এবং কাজ করে মিথ্যার বিরুদ্ধে মোক্ষম হাতিয়ার রূপে। জ্ঞান বাড়ায় সত্য ও অসত্যকে চেনার সামর্থ্য। দেয় সত্যকে বিজয়ী করার প্রেরণা। প্রকৃত আলেম তাই আমৃত্যু সত্যের পক্ষে যোদ্ধা হয়। যে আলেমের জীবনে যুদ্ধ নাই, বুঝতে হবে আলেম ও ঈমানদার হওয়ায় তার জীবনে বিশাল ব্যর্থতা রয়েছে। একজন আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তি হিদায়াত তথা সত্য পথ পাবে -সেটাই কাক্ষিত। পথভ্রষ্টতা বা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাই কোন আলেম বা বুদ্ধিজীবীর অলংকার হতে পারে না। সেটি অজ্ঞতা বা মুর্খতার পরিচয়।পবিত্র কুর’আনে এমন পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে বোবা, বধির ও অন্ধ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে এরূপ ব্যক্তিগণ গবাদী পশুর চেয়েও অধম। তাই কে কতটা আলেম বা জ্ঞানী -মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে বিচারটি হয় তার হিদায়াত লাভ বা সত্য পথে চলার সামর্থ্য থেকে। এবং বুঝা যায় তাঁর মাঝে তার মাঝে আল্লাহর ভয় দেখে। মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট দেখে নয়।

অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি জ্ঞানকে সংজ্ঞায়ীত করেছেন “মাখাউফুল্লাহ” তথা আল্লাহর ভয় রূপে। এর অর্থ দাঁড়ায়, যার মধ্যে আল্লাহর ভয় নাই -তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকতে পারে, কিন্তু জ্ঞান নাই।  ইহুদী আলেমদের অনেকেরই বিস্তর পড়াশুনা ছিল, কিন্তু তাতে সত্য পথে চলার সামর্থ্য বাড়েনি। বরং বেড়েছিল সত্য পথ থেকে বিচ্যুতি। তাদের সে অপরাধগুলোকে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে একবার নয়, নানা সুরায় নানা ভাবে ব্যক্ত করেছেন। সম্ভবত তার কারণ, ধর্মের লেবাসধারী আলেমগণও যে কতটা স্বার্থপর, ধর্মব্যবসায়ী ও পথভ্রষ্ট হতে পারে -সেটি বুঝানোর জন্য। তাদের সে ব্যর্থতাগুলো বর্ণনা করেছেন মুসলিম আলেমদের সাবধান করার জন্য – তারা যেন বনি ইসরাইলের আলেমদের পথ অনুসরণ না করে। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো,তাদের সে পথই অনুসরণ করে চলেছে মুসলিম সমাজের আজকের আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তিরা।

 

বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতা এবং অর্জিত বিপর্যয়

বাঙালি মুসলিমদের আজকের বিপর্যয়গুলি তাদের নিজ হাতের কামাই। এর কারণ, বুদ্ধিবৃত্তিক সভ্য মানব রূপে বাঁচায় তাদের নিদারুন ব্যর্থতা। অথচ পৃথিবী পৃষ্ঠে মানুষই হলো একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক জীব। বুদ্ধিবৃত্তির জন্যই তারা সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। বুদ্ধিবৃত্তির বলেই মানব নিজেকে অনন্ত অসীম কালের জন্য নিজেকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তুলে। সে বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যটি লোপ পেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পশুর চেয়েও নীচে নামে। সেই নীচে নামাটি কি বাঙালি মুসলিমদের মাঝে কম? বাংলাদেশে আজ যেরূপ গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি –এ জন্য কি দেশের জন্তু-জানোয়ারেরা দায়ী? কোন সভ্য দেশে কি এমনটি ঘটে? দেশবাসীর মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থতা থাকলে কি দেশ কখনো এ পর্যায়ে পৌঁছতো? জনগণের মানবিক পরিচয় তো সভ্যতর মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের মাঝে, দুর্বৃত্তিতে প্লাবন আনাতে নয়।   

বাংলাদশের মত মুসলিম দেশে হাজার হাজার ধর্মীয় মাদ্রাসা। সে গুলিতে ছাত্রদের সংখ্যা বহু লক্ষ। কিন্তু তাদের মাঝেই বা সেরূপ সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তি কই? তাদের ইলমচর্চার লক্ষ্য শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নয়। আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করাও নয়। এমন কি অনেকে সে লক্ষ্যে পবিত্র কুর’আন পাঠ করে না। সে কাজে অন্যদের অনুপ্রেরিতও করে না। সেটি লক্ষ্য হলে, অন্যকে অর্থ বুঝে পবিত্র কুর’আন পড়ার জন্য নসিহত করতো। পবিত্র কুর’আন হলো হিদায়েত লাভের একমাত্র গ্রন্থ । অথচ সে পবিত্র কুর’আনকে তারা পাঠ করে নিছক ছওয়াবের আশায়, ফলে প্রয়োজন বোধ করে না অর্থ জানার। কুর’আন হলো সঠিক ভাবে পথচলার রোডম্যাপ। যারা সে পথে চলতে চায় একমাত্র তারাই সে রোডম্যাপ বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু যারা পথ চলে নিজেদের পছন্দের পথটিতে এবং গুরুত্ব দেয় না মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সিরাতাল মুস্তাকীমের, তারা যে কুর’আন বুঝায় গুরুত্ব দিবে না -সেটিই স্বাভাবিক।

না বুঝে কুর’আন তেলাওয়াতের ছওয়াব কতটা জুটছে -সেটি একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালাই বলতে পারেন। কিন্তু হিদায়াত যে জুটছে না -সে প্রমাণ তো প্রচুর। ইসলামী রাষ্ট্র নাই, শুরাভিত্তিক শাসন নাই, আদালতে শরিয়ত নাই, স্কুল-কলেজে পবিত্র কুর’আন-হাদীসের শিক্ষাদান নাই, মুসলিমদের মাঝে ঐক্য নাই, দুর্বৃত্তি নির্মুল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ নাই –এগুলিই কি বলে দেয় না যে মুসলিম জীবনে হিদায়াতও নাই।কুর’আনের সাথে এর চেয়ে বড় অবাধ্যতা ও বেয়াদবি আর কি হতে পারে? তাদের দ্বারা ওয়াজ, শিক্ষকতা ও লেখালেখির ন্যায় সমাজ বিপ্লবের এ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলো ব্যবহৃত হয় নিছক নিজেদের ভক্ত বৃদ্ধি, নাম-যশ বৃদ্ধি এবং বেশী বেশী অর্থপ্রাপ্তির লক্ষ্যে, সত্য পথটি পাওয়া বা অন্যদের সে পথটি দেখানোর জন্য নয়। একটি জনগষ্ঠির জীবনে এর চেয়ে বড় রোগ আর কি হতে পারে?

মানুষকে পথ দেখানোর কাজ মূলত মহা দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার। পবিত্র কুর’আনে তাই বলা হয়েছে¸ “ইন্না আলায়নাল হুদা।” অর্থ: “নিশ্চয়ই পথ দেখানোর কাজটি আমার।” আর মহান আল্লাহতায়ালা সে কাজটি করেন নবী-রাসূল নিয়োগ করে এবং তাদের কাছে ফেরেশতা মারফত ওহি পাঠিয়ে। তাদের অবর্তমানে সে কাজটি করেন নবী-রাসূলদের অনুসারী জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তথা আলেমগণ। কিন্তু সে আলেমগণ নিজেরাই যখন বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয় তখন সে জাতির সঠিক পথ পাওয়ার আর কোন রাস্তা থাকে না। তখন বিভ্রান্তি, বিপর্যয় ও পতন অনিবার্য হয়। মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে মর্যাদায় জ্ঞানী বা আলেমগণ যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি তাদের ব্যর্থতার শাস্তিও ভয়ানক। তারা একমাত্র তখনইসঠিক পথ দেখায় যখন তারা নিজেরা সত্য পথের পথিক হয়। তারা পথভ্রষ্ট হলে অন্যরাও তাদের কারণে পথভ্রষ্ট হয়। সাপ-শকুন, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, গরু যে প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি মানুষের কাছে পূজণীয় হয়ে উঠেছে -তার শুরুটি সমাজের সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার কারণে হয়নি, বরং সেটির শুরু সমাজে যারা জ্ঞানী, আলেম, ধার্মিক বা পুরোহিত নামে পরিচিত তাদের অজ্ঞতা ও পথভ্রষ্টতার কারণে।

 

জুটছে কি হিদায়েত?

মানব জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনটি সম্পদ লাভ, নাম-যশ বা সন্তান লাভ নয়, সেটি হলো হিদায়েত লাভ তথা সত্যপথ প্রাপ্তি। বান্দার জন্য মহান আল্লাহর এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। হিদায়েত লাভ তথা সত্য পথ প্রাপ্তিটি চিন্তাশূণ্য নির্বোধদের জীবনে ঘটে না। সর্বশ্রেষ্ঠ এই দানটি পেতেও যোগ্যতা ও প্রচেষ্ঠা লাগে। মহান করুণাময়ের ওয়াদা: “আল্লাযীনা জাহাদু ফি’না লা নাহদিয়ান্নাহুম সুবুলানা।” অর্থ: “যারাই আমাদের রাস্তায় জিহাদ করবে অবশ্যই তাদেরকে আমরা আমাদের পথ দেখিয়ে দিব।” এখানে যে জিহাদটির কথা বলা হয়েছে সেটি হলো বুদ্ধিবৃত্তির প্রচেষ্ঠার জিহাদ। যে পথটির কথা বলা হয়েছে সেটি হলো জান্নাতের পথ তথা  সিরাতুল মুস্তাকীম। এই জিহাদ যারা করে তারাই পায় সিরাতাল মুস্তাকীম। তাই সত্যপথ প্রাপ্তি হলো জ্ঞানদীপ্ত বুদ্ধিবৃত্তির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।

মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামতটি পাওয়ার জন্য নামাজের প্রতি রাকাতে মহান আল্লাহর কাছে “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম” বলে ঈমানদারকে আকুতি জানাতে হয়। সিরাতাল মুস্তাকীম পাওয়াটি যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া, সে লক্ষ্যে করা দোয়াটিও তাই মহান আল্লাহতায়ালার শেখানো সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া। তবে সে দোয়া কবুলের শর্ত হলো, “ইয়্যাকানাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তায়ীন” অর্থাৎ “একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং একমাত্র আপনার থেকেই সাহায্য চাই” এ চেতনায় আল্লাহতায়ালার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও আত্মনিবেদন নিয়ে বাঁচা। আনুগত্য ও ইবাদতের হকদার যেমন একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা, তেমনি সাহায্যও চাইতে হবে একমাত্র তাঁরই কাছে। অন্যের ইবাদত যেমন কুফরি, তেমনি কুফরি হলো আল্লাহতায়ালা ভিন্ন অন্য কারো মুখাপেক্ষি হওয়া। যার চেতনায় নাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, নাই তাঁর উপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা, নাই কুর’আনী রোডম্যাপ অনুসরণে আগ্রহ, নাই ইসলামকে বুঝার বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ -এমন ব্যক্তিগণ কখনোই হিদায়াত পায় না। বছরের পর বছর নামাজ-রোজা সত্ত্বেও এমন ব্যক্তিরা জীবনভর পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তই থেকে যায়। বাংলাদেশের মত দেশে এমন নামাজী ও রোজাদারদের দেখা যায় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম রাজনীতির পথে।  তারা কাফেরদের সাথে মিলে লড়াই করে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা রুখতে।  

 

যাত্রা বিপর্যের পথে

মহান আল্লাহতায়ালা যেমন তার বান্দাদের “সিরাতাল মুস্তাকীম”য়ের দিকে ডাকেন, শয়তানও তেমনি ডাকে তার নিজস্ব পথে তথা জাহান্নামের পথে। বিশ্বজোড়া বিভ্রান্তি, পথভ্রষ্টতা, পাপাচার তথা জাহান্নামের পথে কোটি কোটি মানুষের যে ভিড় -তা তো শয়তান ও তার অনুসারীদের পথে চলা মানুষদের কারণেই। পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে, “যারা ঈমান এনেছে তাদের বন্ধু হলো আল্লাহ, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর যারা কাফির  তাদের বন্ধু হলো শয়তান, সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ২৫৭)। তাই ধর্মে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলার ব্যক্তি যত ডিগ্রিধারীই হোক, কাউকে সে সত্য পথ দেখাতে পারে বা তার সে যোগ্যতা আছে -সেটি বিশ্বাস করাই শিরক। বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বড় বিপদটি এখানেই। দেশবাসীকে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য, কল্যাণ-অকল্যানের ছবক দিচ্ছে ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা। দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আইন-আদালতসহ সর্বক্ষেত্রে তারাই পথপ্রদর্শকে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষদের অনেকেই তাদেরকে সজ্ঞানে অনুসরণ করছে। এরাই জিহাদকে এরা সন্ত্রাস বলছে এবং শরিয়তকে পশ্চাদপদতা বলে। এবং নানা ভাবে সিরাতাল মুস্তাকীমকে আড়াল করছে জনগণের দৃষ্টি থেকে। ফলে বাড়ছে সত্য পথ থেকে বিচ্যুতি।এবং দেশজুড়ে বাড়ছে মিথ্যার প্রসার ও প্রতিষ্ঠা; সেটি যেমন ধর্ম নিয়ে, তেমনি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি নিয়ে। অথচ ইতিহাস থেকেই জাতি পথচলায় নির্দেশনা পায়। জানতে পারে অতীতের ভূলগুলি। চিনতে পারে কে শত্রু এবং কে মিত্র।

কোন দেশে বসবাসটি সুখের করতে হলে¸ সে দেশের ক্ষতিকর জীবজন্তু, পোকামাকড়, রোগ-জীবাণুকে জানতে হয়। নইলে তাদের কারণে প্রাণনাশ হয়। একই কারণে চিনতে হয় ক্ষতিকর মানুষদেরও। সেজন্যই একটি জাতিকে তার ইতিহাস জানতে হয়। সে ইতিহাস দেয় শত্রু-মিত্রদের চিনবার সুযোগ। বাংলাদেশীদের বিপদের কারণ, কুর’আন না বুঝার কারণে আল্লাহতায়ালার দ্বীনের হিদায়াত লাভ যেমন জুটছে না, তেমনি সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের কারণে প্রচণ্ড ভাবে বাড়ছে মিথ্যা চর্চা ও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুতি। ফলে জুটছে না দেশের প্রকৃত ইতিহাস এবং নিজেদের শত্রুমিত্র চেনার সুযোগ। ফলে ইসলামের শত্রু, দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, গণতন্ত্রের হত্যাকারিও শ্রদ্ধেয় ও মানননীয় নেতা, নেত্রী, বন্ধু ও আদর্শ রূপে গৃহীত হচ্ছে। এভাবে বিপদাপন্ন হচ্ছে দেশবাসীর ঈমান-আক্বীদা এবং দেশের স্বাধীনতা। ফলে বিপন্ন হচ্ছে মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। এবং বিপদে পড়ছে অনন্ত-অসীম কালের আখেরাতের জীবন। মুসলিম জীবনে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে? আরো বিপদের বিষয় হলো, সে ব্যর্থতা ও বিপর্যয় থেকে কীরূপে বাঁচা যায় –তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও নাই। ১ম সংস্করণ ২৪/০৫/২০২২; ২য় সংস্করণ ০৭/০৭/২০২২।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *