বেঈমানদের বিরুদ্ধে যেমন ঈমানদার, আগ্রাসী ভারত ও তার সেবাদাসদের বিরুদ্ধে তেমনি রাজাকার

ফিরোজ মাহবুব কামাল

 রাজাকারের প্রাসঙ্গিকতা                          

রাজাকার প্রসঙ্গটি আবার রাজনীতিতে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্ররা জোর গলায় স্লোগান তুলেছে, “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার”। অথচ একাত্তরের রাজাকারদের তো আজকের ছাত্ররা দেখিনি। তাই  প্রশ্ন হলো, ছাত্ররা কেন এরূপ স্লোগান তুললো? এর পিছনে কারণ কি? ১৯৭১’য়ের পর থেকে বিগত ৫৪ বছর ধরে রাজাকারদের বিরুদ্ধে চলেছে বিরামহীন বিষোদগার। তাদেরকে ধর্ষক ও খুনি রূপে চিত্রিত করা হয়েছে? তাদেরকে স্বাধীনতার শত্রু বলা হয়েছে। কিন্তু এতো কিছু করার পরও ছাত্ররা কেন “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার” স্লোগান তুললো? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ শিশু নয়; তাদের মুখে এমন স্লোগান হঠাৎ উঠেনি। এর সুস্পষ্ট ও বোধগম্য কারণ রয়েছে। শেখ হাসিনার ন্যায় নৃশংস ফ্যাসিস্ট, গণতন্ত্রনের খুনি, শাপলা চত্বরে গণহত্যাকারী এবং ভোটডাকাত রাজাকার শব্দটিকে গালি রূপে ব্যবহার করেছে। এবং সেটি তাদের বিরুদ্ধে যারা অন্যায্য কোটাপদ্ধতির বিলুপ্তি চায় এবং চাকুরিতে তাদের ন্যায্য অধিকার চায়। 

রাজাকার শব্দটি কোন মামূলী শব্দ নয়, এ শব্দটির মধ্য দিয়ে একটি দর্শন ও চেতনা কথা বলে। প্রশ্ন হলো কি সে দর্শন ও চেতনা? রাজাকার শব্দটি ফার্সি শব্দ। এ শব্দটির অর্থ স্বেদচ্ছাসেবী। অর্থাৎ নিজ ইচ্ছা প্রনোদিত হয়ে যে ব্যক্তি কোন মহৎ কর্মে উদ্যোগী হয় -তাকেই রাজাকার বলা হয়। ১৯৪৮ সালে মুসলিম শাসিত স্বাধীন হায়দারাবাদের উপর যখন ভারতীয় সেনা বাহিনী হামলা করে, তখন সে হামলার বিরুদ্ধে যেসব মুসলিম যুবক স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশ নেয় তারাই উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজাকার নামে পরিচিত। আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ভারতের সেনা হামলার মুখে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য সে যুদ্ধটি ছিল হায়দারাবাদের রাজাকারদের পবিত্র জিহাদ।

বস্তুত সেসব মুজাহিদ জিহাদে যোগ দেয় তারা সবাই রাজাকার। এখানে কোন জোর-জবরদস্তি কাজ করে না। মানুষ জিহাদে যোগ দেয় স্বেচ্ছায় এবং স্রেফ ঈমানের তাগিদে। তাই রাজাকারের মধ্যে কাজ করে জিহাদের দর্শন। উল্লেখ্য যে, ভারত পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিচ্ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই। কারণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাক -সেটি ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতাগণ শুরুতেই চায়নি। দেশটি তার অখণ্ড মানচিত্র নিয়ে বেঁচে থাকুক -সেটিও চায়নি। পাকিস্তানকে ভারত শত্রু রাষ্ট্র রূপে গণ্য করে; এবং অখণ্ড ভারত নির্মাণের পথে মূল বাধা মনে করে।  ফলে পাকিস্তানকে ভাঙ্গাই ভারতের মূল স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের হাতে সে সুযোগ আসে ১৯৭১ সালে। ভারতের সে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রজেক্টের সাথে জড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিব ও তার অনুসারীগণ।

এক্ষেত্রে স্বরণীয় যে, মুজিব সেরূপ একটি ষড়যন্ত্রকে সফল করার জন্য ১৯৬৬ সালে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW’র সাথে মিলে আগরতলা ষড়যন্ত্র করেছিল যাতে মুজিব ধরা পড়ে। তার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলনের জোয়ারে মুজিব মুক্তি পায়। মুক্তি পেয়ে মুজিব নতুন কৌশল নেয়।  পাকিস্তানের স্বৈরাচার নির্মূল ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের ইস্যুকে মুজিব পাকিস্তান ভাঙ্গার ইস্যু পরিণত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার প্রতিশ্রুতে ভোট নিয়ে মুজিব সে ভোটকে পাকিস্তানের ভাঙ্গার ম্যান্ডেট রূপে ব্যবহার। অথচ নির্বাচন কালে মুজিব কখনোই পাকিস্তান ভাঙ্গার কথা প্রকাশ্যে বলেনি, পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছে। 

একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আসন্ন সেনা হামলাটি সুস্পষ্ট হতে থাকে। সে হামলা থেকে নিজেদের মাতৃভূমি পাকিস্তানকে বাঁচাতে সে সব বাঙালি মুসলিম যুবক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয় এবং যুদ্ধে অংশ নেয় -বাংলার ইতিহাসে তারাই রাজাকার নামে পরিচিত।  রাজাকারদের রণাঙ্গণ ছিল দেশের অভ্যন্তরে, সীমান্তে নয়। সীমান্তে যুদ্ধ করে পাকিস্তানের সেনা বাহিনী। তাদের কাজ ছিল জনগণের জানমাল, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও সড়ক অবকাঠামোকে সুরক্ষা দেয়া।  সে যুদ্ধ তাদের কাছে পবিত্র জিহাদ গণ্য হয়েছিল। রাজাকার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তাদের কারণে মুক্তি বাহিনী পাকিস্তানপন্থী কিছু নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা এবং ব্রিজ উড়িয়ে দিতে পারলেও পূর্ব পাকিস্তানের কোন জেলা বা মহকুমা দূরে থাক কোন থানাও দখলে নিতে পারিনি।

কি করে মূল্যায়ন হবে রাজাকারদের?

রাজাকারগণ এখন আর সামনে নাই। প্রশ্ন হলো, কি করে মূল্যায়ন হবে রাজাকারদের? এ কাজটি সহজ। সে জন্য দেখতে হবে, কাদের বিরুদ্ধে ছিল রাজাকারদের যুদ্ধ? সে জন্য জরুরি হলো, শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ন্যায় খুনি, ভোটডাকাত, নৃশংস ফ্যাসিস্ট ও ভারতের ন্যায় হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের পদলেহী গোলামদের সঠিক ভাবে চেনা। যে ব্যক্তি নেকড়েকে চেনে, তার পক্ষে সহজ হয়ে যায় সে ব্যক্তিকে চেনাও যে নেকড়ের সামনে প্রতিরোধে খাড়া হয়। তাই ফ্যাসিস্ট মুজিব ও হাসিনার চেনার কাজটি সঠিক ভাবে হলে, যে সব রাজাকারদের চেনার কাজটিও সহজ হয়ে যায় -যারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে খাড়া হয়েছিল। অপর দিকে তাদের চেনায় ভূল হলে রাজাকারদের চিনতেও ভূল হবে।

যারা মুজিবের ন্যায় ভারতের সেবাদাস, গণতন্ত্রের খুনি ও ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তকে পিতা, নেতা ও বন্ধুর আসনে বসায়, সে সব ইসলামশূণ্য জাহেলদের কাছে রাজাকারগণ অপরাধী গণ্য হবে -সেটিই অতি স্বাভাবিক। ধর্ষক দুর্বৃত্ত যেমন ধর্ষিতা অসহায় নারীকে গালি দিয়ে তৃপ্তি পায় -ইসলাম থেকে দূরে সরা এসব সেক্যুলারিস্টগণও তেমনি রাজাকারদের গালি দিয়ে তৃপ্তি পায়। ইসলামকে বিজয়ী করতে শহীদ হতে যারা দু’পায়ে খাড়া -তাদেরকে এই সব ইসলামশূণ্য জাহিলগণ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি বলে।

ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টদের কাছে রাজাকারদের অপরাধ, তারা তাদের জন্মভূমি অখণ্ড পাকিস্তানকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের হামলা থেকে বাঁচাতে  চেয়েছিল। তারা পরাজিত হয়েছে, কিন্তু সেদিন তাদের নিয়েত ও আদর্শ পরাজিত হয়নি। তাদের কাছে পাকিস্তান শুধু পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি ও বেলুচদের দেশ ছিলনা, ছিল তাদের নিজেদেরও মাতৃভূমি। রাজাকারদের স্বপ্ন ছিল, তারা বেড়ে উঠবে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল-ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে উঠে -যেমনটি বেড়ে উঠেছিলেন সাহাবাগণ ও গৌরব যুগের মুসলিম। তারা মনে করতো জাতীয়তাবাদী স্রোতে ভেসে যাওয়া হারাম। নবীজী (সা:) হাদীস: যারা গোত্রীয় চেতনা নিয়ে যুদ্ধ নিয়ে যুদ্ধ করে এবং গোত্রীয় যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করে তারা আমার  উম্মত নয়। -(সুনানে আহমেদ)।  নবীজী (সা:)’র যুগে জাতীয়তাবাদ ছিল না, ছিল গোত্রবাদ। তবে গোত্রবাদ, জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদ হলো সমগোত্রীয় আদর্শ; ইসলামে এ মতবাদগুলি হারাম। অথচ মুজিবের রাজনীতি ছিল এই হারাম মতবাদের উপর। রাজাকারগণ এই হারাম রাজনীতি থেকে নিজেদের বাচাতো পেরিছিল। তাছাড়া রাজাকারদের যুক্তি ছিল,  ভারতে যদি বাঙালি, পাঞ্জাবী, গুজরাতী, বিহারী, মারাঠী ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার হিন্দুগণ একত্রে বসবাস করতে পারে, তবে নানা ভাষী পাকিস্তানীরা কেন পারবে না? হিন্দুদের উপর ধর্মীয় ভাবে একতা ফরজ নয়, কিন্তু মুসলিমদের উপর তো ফরজ, এবং বিভক্তি হারাম।

 

রাজাকারের স্বপ্ন

রাজাকারদের স্বপ্ন ছিল, পাকিস্তানকে তারা গড়ে তুলবে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি অভিভাবক রাষ্ট্র (civilisational state) রূপে -যেমন অভিভাবক রাষ্ট্র রয়েছে ইহুদী, হিন্দু ও খৃষ্টানদের। কারণ, উসমানিয়া খেলাফতের বিলুপ্তির পর মুসলিমদের জন্য আর কোন অভিভাবক রাষ্ট্র (civilisational state) ছিল না। রাষ্ট্র রূপে যা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে -তা হলো বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের ন্যায় কিছু নেশন স্টেট অথবা  ট্রাইবাল স্টেট। মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ নিয়ে ভাবার সময় এসব জাতীয় ও গোত্রীয় রাষ্ট্রের নাই। এসব দেশের শাসকগণ ভাবে শুধু রাইনিজেদের ক্ষমতার নিরাপত্তা নিয়ে। সে লক্ষ্য এমনকি তারা মুসলিম বিরোধী ভারত ও ইসরাইলের মত অপরাধী রাষ্ট্রের সাথে মিতালী গড়ে। তাই মিশর, জর্দান ও আমিরাতের ন্যায় দেশগুলি ইসরাইলের সাথে এবং বাংলাদেশ ভারতের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছে। ফলে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা ও উইঘুরের মজলুম মুসলিমদের পাশে দাঁড়াবার কেই নেই। অথচ নবীজী (সা:)’র সবচেয়ে বড় সূন্নত হলো, তিনি নির্মাণ করেছিলেন ইসলামী রাষ্ট্র -যা ছিল তৎকালীন গোত্রবাদী চেতনার উর্দ্ধে এক প্যান-ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু জাতীয়তাবাদী অআওয়ামী লীগ ও তার অনুসারীগণ ছিল প্যান-ইসলামী চেতনাকে জঙ্গিবাদ বলে।  

                                                                                                                                               

                                                                                                                                               

পাকিস্তান নিয়ে রাজাকারের বিশাল স্বপ্ন ছিল। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে থাকলে সে দেশটি হতো চীন ও ভারতের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ এবং সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। এখন লোক সংখ্যা হতো  ৪০ কোটির বেশী এবং হাতে থাকতো কয়েক শত পারমানবিক বোমা। থাকতো বিশাল সামরিক বাহিনী। গড়ে উঠতো বিশাল অর্থনৈতিক বাজার। তখন আগ্রাসী ভারত পদ্মার পানি, তিস্তার পানিসহ অসংখ্য পানির উপর ডাকাতি করতে পারতো না। নিতে পারতো না বাংলাদেশের পেটের উপর দিয়ে করিডোরের সুবিধা।  সীমান্তে হত্যা করতে পারতো না নিরস্ত্র বাঙালি মুসলিমদের। তখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে থাকতো সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে বাঙালি মুসলিমদের প্রভাব। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প ও কৃষি পণ্য পেত পশ্চিম পাকিস্তানের ২৪ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। 

বিশ্বের বহুদেশের ন্যায় পাকিস্তানেও সামরিক স্বৈরাচারসহ বহু রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। সেসব সমস্যাগুলিকে রাজনৈতিক ভাবেই সমাধান করা যেত। কিন্তু সে পথে যেতে চায়নি ইসলামের প্রতি অঙ্গীকারশূণ্য শেখ মুজিব। কারণ তাতে পাকিস্তান বেঁচে যেত। মুজিব সেজন্যই সে পথে যায়নি। মুজিব বেছে নেয় ভারতের সাথে জোট বেঁধে পাকিস্তান ভাঙ্গার পথটি। সেটি ছিল গৃহে সাপ ঢুকেছে এ বাহানা দেখিয়ে পুরা গৃহকেই আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার মত ব্যাপার।

পাকিস্তান ভাঙ্গার ফলে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান দুর্বল হয়নি, দুর্বল হয়েছে বাংলাদেশও। সর্বোপরি দুর্বল হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। লাভবান হয়েছে একমাত্র হিন্দু ভারত। এজন্যই বাঙালি সেক্যুলারিস্টগণ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে ভারতের সাথে ১৬ ডিসেম্বর উৎসব করলেও ঐদিন বিশ্বের বহু মুসলিম কেঁদেছে। ঝড়ে কারো ঘর ভেঙ্গে গেলে বিবেকবান মানুষ মাত্রই দুঃখিত হয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ভেঙ্গে গেল, অথচ তাতে দুঃখ পেল না -এমন মানুষকে কি ঈমানদার বলা যায়? বিভক্তি ইসলামে হারাম; তাই ঈমানদার মাত্রই বিভক্তি তথা মুসলিম দেশ ভাঙ্গায় দুঃখিত হয়। মনের সে দুঃখ নিয়ে কোন মুসলিম দেশই বাংলাদেশকে সাথে সাথে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি মুসলিম দেশগুলি কয়েক বছর দেরী করেছে। স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে এসেছে ভারত, রাশিয়ার মত কাফির রাষ্ট্র। অথচ পাকিস্তান যেদিন প্রতিষ্ঠা পায়, স্বীকৃতি দানে সেদিন মুসলিম রাষ্ট্রগুলির মাঝে হিড়িক পড়ে যায়।

কোন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি কখনোই দেশ ভাঙ্গে না; বরং ভূগোলে বৃদ্ধি আনে। দেশ থেকে আলাদা হয় সংখ্যালঘুরা। কিন্তু ক্ষমতালোভী এবং ইসলামী চেতনাশূণ্য  মুজিব করেছে উল্টোটি। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি হওয়ার কারণে বাঙালি মুসলিমসদের সামনে বিশ্বরাজনীতিতে এবং সে সাথে মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি প্রভাব ফেলার যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল  -তা থেকেই মুজিব বাঙালি মুসলিমদের বঞ্চিত করে দেয়। বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে এটিই হলো মুজিবের সবচেয়ে বড় অপরাধ। তার সে অপরাধটি ছিল সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। মুজিব শুধু তার মনিব ভারতের এজেন্ডাকেই বিজয়ী করেছে।

অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচেছে মাত্র ২৩ বছর এবং দেশটিতে গণতন্ত্র বেঁচেছিল মাত্র ১১ বছর। সে ১১ বছরে পাকিস্তানের ৩ জন প্রধানমন্ত্রী এবং ২ জন রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন ছিলেন বাংলার ভূমি থেকে। স্পীকারসহ আরো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদ পেয়েছে বাঙালি মুসলিম। উল্লেখ্য যে, অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন শুধু রাজাকারগণ নন, বরং পক্ষ নিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সহোরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, নুরূল আমীন, শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাসদের মত বাংলার অতি দেশপ্রেমিক সন্তানগণ। তাদেরকে কি বাঙালির স্বাধীনতার শত্রু বলা যায়? একমাত্র ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলারিস্ট্গণই পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াতে রাজাকারদের গালি দিতে পারে, কোন ঈমানদার নয়। বরং যে কোন দেশপ্রেমিক ঈমানদারের কাছেই রাজাকারগণ তাদের নিয়েত ও আত্মত্যাগের জন্য অতি শ্রদ্ধেয় গণ্য হবে।

 

রাজাকারদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার

রাজাকারদের নিয়ে অনেকে বহু মিথ্যা বয়ান বাজারে ছেড়েছে। তারা বলে, কিছু অশিক্ষিত বেকার, রিকশাচালক, দিন মজুর,ক্ষেত মজুর ধরণের রাজনৈতিক জ্ঞানশূণ্য লোক স্রেফ অর্থ উপার্জনের লোভে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। তারা আরো বলে, পাকিস্তানের পক্ষে শতকরা এক ভাগ বাঙালিও ছিল না।  তারা এসব উদ্ভট মিথ্যা কথা বলে নিরেট অজ্ঞতা নিয়ে। হয়তো তারা ১৯৭১’য়ের ঘটনাবলী স্বচোখে দেখেননি। পাকিস্তান ভাঙ্গা‌র প্রকল্প ছিল ইসলাম থেকে দূরে সরা আওয়ামী লীগ, কম্যুনিস্ট পার্টি, ভাষানী ন্যাপের কিছু অংশ ও মস্কোপন্থী ন্যাপ। তাদের বাইরে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নিজামী ইসলামী, পাকিস্তান ডিমোক্রাটিক পার্টি, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইত্যাদি বহু দল। তাদের জনসমর্থনও ছিল। এজন্যই সাধারণ জনগণ একাত্তরকে গোলযোগের বছর বলে; খুব কম লোকই এমন আছে -যারা একাত্তরকে স্বাধীনতার বছর বলে। কারণ, পাকিস্তান আমলে তারা পরাধীন ছিল সে কথা ভারতসেবী বাকশালীরা বিশ্বাস করলেও সাধারণ মানুষ সেটি মনে করতো না।

রাজাকারদের নিয়ে অনেকে বহু মিথ্যা কথা বলে স্রেফ মানুষের সামনে রাজাকারদের মর্যাদা খাটো করতে। এমন  কি কিছু ইসলামী দলের নেতাকর্মীরাও রাজাকারদের সম্পর্কে আজগুবি মিথ্যা বলে রাজাকারদের সাথে নিজেদের সম্পর্কহীনতা প্রমান করতে এবং সেক্যুমলার মহলে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা ও ইমেজ বাড়াতে। অথচ একাত্তরে তারা নিজেরা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তারা এখন চেষ্টা করে এটি প্রমাণ করায়, তারা যেন কোন কালেই রাজাকার ছিল না। ফলে রাজাকার বললে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। 

 

রাজাকারের  জিহাদ এবং যুদ্ধাপরাধীদের যুদ্ধ

নামাজীকে নামাজী বললে সে ক্ষেপে যাবে কেন? সে তো ইবাদত করছে।  তেমনি রাজাকারকে রাজাকার বললেই বা সে ক্ষেপবে কেন? রাজাকারগণ তো একাত্তরের লড়াইকে পবিত্র জিহাদ গণ্য করেছে। বস্তুত এই রাজাকারগণই বাংলার মাটিতে বহু হাজার সত্যিকার শহীদের জন্ম দিয়েছে। অথচ বাংলা যখন ইংরেজদের দখলে যায় তখনও এতো মানুষ শহীদ হয়নি। তাদের জিহাদ ছিল হিন্দুত্ববাী কাফির ও তাদের সহযোগী বাঙালি ফ্যাসিস্ট, কম্যুনিস্ট, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হলো, যারা সেদিন ভারতীয় কাফিরদের অর্থ, আশ্রয় ও খাদ্যে প্রতিপালিত হয়ে তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে এবং ভারতের বিজয় বাড়িয়েছে -তারা কি কখনো শহীদের জন্ম দিতে পারে? অথচ বাংলদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় এ প্রশ্ন তোলা হয়না। এমন কি আলেমদের মহলেও নয়। অথচ কাফির, মুনাফিক, সোসালিস্ট, সেক্যুলারিস্ট ও জাতীয়তাবাদীদের প্রতিটি যুদ্ধই তো হারাম ও যুদ্ধাপরাধ। তাদের প্রতিটি যুদ্ধই তো মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে পরাজিত করার লক্ষ্যে। একাত্তরে তাদের যুদ্ধ ইসলামের পক্ষে ছিল না; বরং সেটি ছিল ভারতীয় কাফিরদের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে।  ফলে যারা একাত্তরের ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছে তারাই হলো বাংলার ইতিহাসে সবচেয় বড় যুদ্ধাপরাধী। তাদের গাদ্দারী ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর তাদের অপরাধ হলো, গণতন্ত্র হত্যার, শাপলা চত্বরে গণহত্যার, চুরি-ডাকাতির, ভোটডাকাতির, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির এবং ইসলামপন্থী নেতাদের  ফাঁসি দেয়ার।

একাত্তরের বড় রাজাকার ছিলেন আব্দুস সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, আব্দুল আলীমের ন্যায় ব্যক্তিগণ।  সংসদের ভিতরে ও বাইরে তাবদেরকে রাজাকার বলা হতো, কিন্তু তা নিয়ে কি তারা কখনো নিজেদের মাথা গরম করেছেন? করেন নি? কারণ, পাকিস্তানের পক্ষ নেয়াকে তারা কখনোই অপরাধ মনে করেননি, তা নিয়ে বরং গর্ব করতেন। শাহ আজিজুর রহমান জুলফিকার আলী ভূট্রোর সাথে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতে। শাহ আজিজুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; আব্দুর রহমান বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার অর্থ যে বাংলাদেশীদের স্বাধীনাতার শত্রুতা নয় -সেটি তারা প্রধানমন্ত্রী  ও প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থেকে প্রমাণ করে গেছেন। তারা কখনোই মনে করেননি যে, অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানোর অর্থ বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়া। বরং তারা অখণ্ড পাকিস্তানের মাঝে বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতার সুরক্ষা ভেবেছিলেন। অবিকল সে ভাবনাটি ছিল একাত্তরের প্রতিটি রাজাকারের। এবং অভিন্ন সে ভাবনাটি ছিল ১৯৪৭’য়ের মুসলিম লীগ নেতাদেরও।  স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার বিশাল খরচ আছে। ১৯৪৭ সালে সে খরচ যুগোনোর সামর্থ্য বাংলাদেশের অতি সীমিত। ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী রাষ্ট্রের পাশে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা দেয়া সম্ভব -সেটি বিশ্বাস করলে ১৯৪৭’য়ের মুসলিম লীগ নেতাগণই সে সময়ই স্বাধীন বাংলাদেশ বানাতেন। 

 

পরাজয় বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে

একাত্তর নিয়ে মিথ্যাচার শুধু ভারতসেবী আওয়ামী-বাকশালীদের পক্ষ থেকে হয়নি, সেটি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে তথাকথিত ইসলামপন্থীদের পক্ষ থেকেও। অথচ ঈমানদারের দায় শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়, বরং সেটি হলো প্রতিক্ষেত্রে সত্যের পক্ষে ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া। সাক্ষ্য গোপন করা কবিরা গুনাহ। এটি হারাম।  সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়াকে শাহাদতে হক্ক বলা হয়। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয় নবীজী (সা:) নবুয়তপ্রাপ্তির ১১ বছর পর মিরাজে গমন কালে।  নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বে ১১ বছর কাটিয়েছেন তিনটি ফরজ ইবাদত নিয়ে। এক). সত্যের পক্ষে এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ায়। দুই). পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনে। তিন). অমুসলিমদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত

পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিমদের মাঝে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের পালন বাড়লেও সত্যের পক্ষে সাক্ষ্যদানের কাজটি তেমন হচ্ছে না। বরং হচ্ছে সত্য গোপনের কাজ। তাই রাজাকারদের নিয়ে সত্য বলা হচ্ছে না। সত্য বলা  হচ্ছে না মুজিব ও তার অনুসারীদের গাদ্দারী নিয়ে। ফলে বাংলাদেশের মাটিতে বিজয়ী হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষ এবং ভারতসেবীদের বয়ান।  অথচ রাজনীতি বাঁচাতে হলে নিজেদের রাজনৈতিক বয়ান তথা narrative কে বাঁচাতে হয়। এ যুদ্ধে পরাজিত হলে রাজনীতি বাঁচেনা। বয়ান তথা narrative বাঁচানোর যুদ্ধকেই বলে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ। প্রতি রাজনৈতিক জিহাদের আগে আসে এই বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। পবিত্র কুর’আনে সেটিকে জিহাদে আকবর বলা হয়েছে। সে জিহাদের অস্ত্র হলো পবিত্র কুর‌’আন। তাই হুকুম এসেছে:

فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا

অর্থ: “অতঃপর কাফিরদের অনুসরণ করো না; এবং তাদের বিরুদ্ধে এই কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো।” –(সুরা ফুরকান, আয়াত ৫২)। 

বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলি বয়ান তথা narrative’য়ের যুদ্ধে হেরে গেছে। উপরিউক্ত আয়াতে নিষেধ করা হয়েছে কাফিরদের বয়ান অনুসরণকে। অথচ বাংলাদেশের ইসলামপন্থীগণ অনুসরণ করছে ইসলামের বিরোধী পক্ষের বয়ান।  একাত্তর নিয়ে ইসলামের শত্রুপক্ষের যে বয়ান সেটিই এখন তাদের বয়ান। সে বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়ের কারণেই বহু ইসলামী দলের নেতাকর্মীগণ একাত্তরের রাজাকারদের সাথে নিজেদের সম্পর্কহীনতার কথা বলেন। যেন তারা তাদের কেউই ছিলনা। অথচ একাত্তরে সেসব দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী পাকিস্তান বাঁচাতে শহীদ হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে নেয়া এবং ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাড়ানো ছাড়া তাদের কোন অপরাধই ছিলনা। একাত্তরে তাদের নিজ নিজি দলের কি ভূমিকা ছিল সেটি যদি তারা ভুলে যান, তবে তাদের উচিত একাত্তরের যুদ্ধকালীন নয় মাসের দৈনিক পত্রিকাগুলি পড়া।

ইসলামপন্থী দলের নেতাকর্মীদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরাজয়ের নমুনা হলো, যেসব ইসলামী সংগঠন একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদেরই অনুসারীগণ ১৬ ডিসেম্বর এলে ঢাকার রাস্তায় সবচেয়ে বড় মিছিলটি করে; এবং স্লোগান দেয়, “স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রাখবো।” প্রশ্ন হলো, এ স্লোগানের মধ্যে সত্যতা কতটুকু? কারণ, যেসব ছাত্ররা এসব স্লোগান তুলে তাদের জন্ম হয়ছে একাত্তরের পর। ফলে তারা কোথায় স্বাধীনতা আনলো? এবং তারা যাদের মতাদর্শের অনুসারী তারা তো একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ বানানোর লড়াইয়ে ছিলনা। তারা যুদ্ধ করেছে পাকিস্তান বাঁচাতে। 

রাজনৈতিক বয়ানের তথা narrative ‘য়ের যুদ্ধে দেওবন্দী আলেমগণ যে কতটা পরাজিত তার নমুনা মিলে দেওবন্দী আলেম মাওলানা মামুনূল হকের এক বক্তৃতা থেকে। তাকে এক ভিডিও’তে বলতে শোনা যায়, জামায়াতে ইসলামীর সাথে একতা সম্ভব নয়, কারণ তারা একাত্তরের ভূমিকার জন্য এখনো মাফ চাননি। মাওলানা মামুনূল হক সম্ভবত জানেন না, একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দেওবন্দী আলেমদের শীর্ষ নেতা ছিলেন কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী সাহেব এবং পটিয়া মাদ্রাসা মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ সাহেব। তারা ছিলেন নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা। পাকিস্তান ভাঙ্গাকে তারা হারাম বলতেন এবং পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াইকে তারা জিহাদ বলতেন। উল্লেখ্য যে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের কোন প্রখ্যাত আলেম এবং পীর সাহেবও সমর্থণ করেননি। সেটিকে তারা হারাম বলেছেন। মাওলানা মামুনূল কি জানেন না, কওমী মাদ্রাসার অসংখ্য ছাত্র রাজাকার বাহিনীতে  যোগ দিয়েছিল।   

মাওলানা মামুনূল হকের এক বক্তৃতা শুনে মনে হয় তিনি ভেসে গেছেন একাত্তরের চেতনাধারী ইসলামের বিপক্ষ শক্তির রাজনৈতিক বয়ানে। জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে ইসলামের শত্রুশক্তির যে বয়ান, সে বয়ান তাঁরও। মূল সমস্যা হলো, বাংলাদেশের ইতিহাসের এ সত্যগুলি তুলে ধরানোর কোন চেষ্টাই হয়নি। বরং হয়েছে সত্য গোপন।  রাজনৈতিক বয়ানে সত্যতা  না থাকায় দিন দিন বাড়ছে রাজনৈতিক সংকট এবং বাড়ছে ইসলামপন্থী শক্তির রাজনৈতিক পরাজয়।

 

কারা ছিল রাজাকার এবং কি ছিল তাদের ভূমিকা?

প্রশ্ন হলো, কারা ছিল রাজাকার? পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি প্রধান ইসলামী ছাত্র সংগঠন ছিল। একটি ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ। এ ছাত্র সংগঠনটি ছিল স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনীয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামপন্থী ছাত্রদের। অপরটি ছিল জমিয়তে তালাবিয়া আরাবিয়া। এটি ছিল আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রদের একক এবং প্রধান প্রতিষ্ঠান।  এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ স্বপ্ন দেখতো, পাকিস্তান পরিণত হোক একটি ইসলামী রাষ্ট্রে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তাদের লড়াই ছিল ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে।  ইসলামী ছাত্র সংঘ দ্রুত বেড়ে উঠছিল। তারা কয়েকটি বছর সময় পেলে রাজনীতির ইতিহাসটি ভিন্নতর হতো। তারা বুঝতে পারে, পাকিস্তান ভাঙ্গাটি ইসলাম বিরোধী, ভারতপন্থী ও বামপন্থীদের যৌথ প্রজেক্ট। তাদের সে প্রজেক্ট রুখতেই পাকিস্তান বাঁচানোর লক্ষ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাকর্মীগণ রাজাকার বাহিনীতে যোগ। তখন দেশের সকল ইসলামপন্থি সংগঠনের ন্যায় তাদের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় ভারতীয় ষড়যন্ত্রের হাত থেকে পাকিস্তান বাঁচানো। তারা বুঝতে পারে, একমাত্র পাকিস্তান বাঁচলেই বাংলার এ ভূমিতে ইসলামপন্থীদের রাজনীতি বাঁচবে এবং মুসলিমগণ নিরাপত্তা পাবে। নইলে এদেশে স্বাধীনতা পাবে একমাত্র ভারতসেবী ইসলামের শত্রুপক্ষ। পরবর্তীতে তাদের সে ধারণা শতভাগ সঠিক প্রমাণিত হয়। তবে রাজাকার বাহিনীতে শুধু তারাই ছিল না, তাদের সাথে যোগ দিয়েছিল মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামী পার্টির বহু কর্মী। যোগ দিয়েছিল কওমী মাদ্রাসার বহু ছাত্ররা। যোগ দিয়েছিল বহু পীরের মুরিদ।

সে সময় দেশের অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারমান ছিলেন মুসলিমের লীগের সদস্যরা। উল্লেখ্য যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা দখলের আগে মুসলিম লীগই ছিল পাকিস্তানে ক্ষমতায়। অন্যান্য যে কোন দলের তূলনায় গ্রাম এলাকায় মুসলিম লীগের লোকবলই ছিল অধিক। থানা পর্যায়ের অধিকাংশ ব্যবসায়ী, স্কুল ও মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি, সমাজ কর্মী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং গ্রামের মাতবরই ছিল মুসলিম লীগের। তারাই পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিয়ে জেলা শহর, থানা শহর ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। এসব শান্তি কমিটির সদস্যগণ নিজেদের আপনজনদেরও ভর্তি করেন রাজাকার বাহিনীতে। তখন দেশের শীর্ষ উলামাগণ ফতোয়া দিয়েছিলেন পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াইটি জিহাদ। রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের পিছনে সে জিহাদী জজবাও ভূমিকা রেখেছিল। তাছাড়া তাদের মধ্যে ছিল ভারত বিরোধী চেতনা। কারণ তারা একথা বিশ্বাস করতেন, হিন্দু শাসিত ভারত বাঙালি মুসলিমদের শত্রু।

 

পাক বাহিনী কেন আত্মসমর্পণ করলো?

সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে পাক আর্মির সৈনিক সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫ হাজার। আত্মসমর্পণের পর যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানীকে ভারতের জেলে নিয়ে যাওয়া হয় -তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি বেসামরিক লোকজন। কাশ্মীরে জনসংখ্যা মাত্র ৯০ লাখ; কিন্তু সেখানে ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা ৬ লাখের বেশী। ক্ষুদ্র পাকবাহিনীর নজর ছিল ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে সীমান্তরক্ষায়। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষিত রাজাকারদের প্রতিরোধের কারণেই মুক্তিবাহিনী তার সাড়ে ৮ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশের কোন জেলা বা মহকুমা দূরে থাক একটি থানাও দখলে নিতে পারিনি। তাদের কারণে মুক্তি বাহিনী কোন জেলা বা থানা শহরে ঢুকতে পারতো না।

একাত্তরে প্রচণ্ড বন্যা এসেছিল। প্লাবিত হয়েছিল গ্রাম-গঞ্জ। মুক্তিবাহিনীকে থাকতে হতো নদীর চরে, হাওরে নৌকায় ভেসে বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রামে। অথবা বনে জঙ্গলে। শহরে ঢুকতে তারা ভয় পেত। নভেম্বরে বন্যার পানি নামে যায়, তখন রাজাকারদের পক্ষ থেকে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর উচ্ছেদে তীব্র লড়াই। ভারত বুঝতে পারে মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে আর যাইহোক পাকিস্তান ভাঙ্গা সম্ভব নয়।  ভারত নিজে যুদ্ধে নামে। ডিসেম্বরের শুরুতেই ভারত পাক বাহিনীর ৫ গুণ বেশী সৈন্য নিয়ে হামলা শুরু হয়। প্রতিরোধ অসম্ভব জেনে পাকিস্তান বাহিনীর দ্রুত পিছুহটা শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, পাক বাহিনীর পিছু হটার পরও কিছু কিছু থানা শহর রাজাকারগণ নিজ দখলে রাখে। প্রায় আড়াই লাখ সৈন্য নিয়ে ভারতীয় বাহিনী ৪৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে কোন শক্তিশালী বিমান বা নৌবাহিনী ছিল না।

পশ্চিম পাাকিস্তানের অনেকেই স্বীকার করেন যে, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পাকিস্তান সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল বাঙালি মুসলিমগণ। পাকিস্তান আন্দোলন চলা কালে মুসলিম লীগের সরকার ছিল একমাত্র বাংলা প্রদেশে। একে বারে শেষ পর্যায়ে সিন্ধু প্রদেশে বিজয় পায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের আলোচকগণ আজকাাল সে কথাটি বার আলোচনায় আনেন। তাদের ধারণা ছিল, অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচাতে এ বাঙালি মুসলিমগণই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রুখবে। কারণ, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের সবেচেয়ে বেশী জানতো তারাই। পাকিস্তানের আর কোন এলাকার অধিবাসীরা হিন্দু জমিদারী ও মহাজনদের দ্বারা এতোটা নির্যাতিত ও শোষিত হয়নি যতটা হয়েছে বাঙালি মুসলিমগণ। কিন্তু সেই বাঙালি মুসলিমগণই যখন পাকিস্তানের অখন্ডতা বাঁচানোর বদলে ভারতীয় বাহিনীর  দোসরে পরিণত হয় -তখন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর অফিসারদের পলিসি পাল্টে যায়। তখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করা ও রক্ত দেয়া তারা অনর্থক মনে করে।  অধিক রক্তক্ষয় এড়াতে  ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। তখন দেশ দখলে যায় ভারতীয় বাহিনীর হাতে। ভারত-অধিকৃত সে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতা তুলে দেয়া হেলিকপ্টার যোগে কলকাতা থেকে আগত আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। লক্ষণীয় হলো, এসব নেতাদের কাউকেই এক দিনের জন্যও রণাঙ্গণে যুদ্ধে যেতে হয়নি। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের উপর ভারতের স্বার্থ বাঁচাতে তাজুদ্দীন এবং মুজিব দাসচুক্তি স্বাক্ষর করে। একথা নিশ্চিত, বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে ভারত হামলা না করলে মুক্তিবাহিনীর একার পক্ষে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের পরাজিত করা অসম্ভব ছিল। ১৯/০৭/২০২৪                 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *