ভারতের বাংলাদেশ ভীতি এবং নানামুখি নাশকতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 18, 2020
- বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
কারণঃ ইসলাম ভীতি
ভারতীয় রাজনীতি, বিদেশনীতি ও সমরনীতির মূল চরিত্রটি শুধু চীন ও পাকিস্তানভীতি নয়, বরং বাংলাদেশভীতিও। প্রচণ্ড পাকিস্তানভীতির কারণেই দেশটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে এবং দেশটিকে খন্ডিত করতে প্রকান্ড যুদ্ধ শুরু করে। ভারতের যুদ্ধ বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও। এবং সে যুদ্ধটি সীমান্তে না হলেও লাগাতর হচ্ছে দেশটির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে। এবং সেটি ১৯৭১ সাল থেকেই। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাজুদ্দীনের সাথে ৭ দফা চুক্তি করেছিলেন এবং শর্ত লাগিয়েছিলেন যাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে না পারে। এবং শর্ত চাপানো হয়, অন্য কোন দেশের সাথে সম্পর্ক গড়তে হলে ভারতের অনুমতি নিতে হবে। একই উদ্দেশ্যে মুজিবকে দিয়ে ভারত ২৫ সালা দাসচুক্তি সই করিয়ে নিয়েছিল। এবং বাংলাদেশের সেনা বাহিনীকে দুর্বল রাখতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অব্যবহৃত বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজ দেশে নিয়ে যায়।
ভারতের এরূপ বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতার মূল কারণ, ইসলাম ভীতি। ভারতীয়রা জানে, ইসলামী দর্শন, কোর’আনের জ্ঞান এবং জিহাদী চেতনা প্রতিটি মুসলিমকে দেয় বিজাতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অদম্য সাহস। দেয় ঈমানী বল ও আপোষহীনতা। ইসলামে নামায-রোযার যেমন ফরজ, তেমনি ফরজ হলো সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিরোধে দাঁড়ানো। অতীতে আফগান মোজাহিদ যে শক্তির বলে ব্রিটিশ বাহিনী ও পরে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাজিত করেছিল সেটি অস্ত্রবল ছিল না। অর্থবলও নয়। বরং সেটি ছিল ইসলামী চেতনার বল। আজও সে শক্তির বলে তারা মার্কিনীদের পরাজয় করে চলেছে। বিগত ২০ বছরের যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও তার ৪০টি মিত্রদেশগুলি কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। প্রাণনাশ হয়েছে তাদের বহু হাজার সৈনিকের। কিন্তু আফগান মুজাহিদদের পরাজিত করতে পারেনি। এমন কি আফগানিস্তানের অর্ধেক ভূমিকেও কখনো দখলে নিতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশ আফগানিস্তান নয়। বাংলাদেশীরা সংখ্যায় আফগানদের থেকে ৪ গুণের অধিক। এতবড় বিশাল জনশক্তির মাঝে ইসলামি চেতনার বিস্ফোরণ হলে তা কাঁপিয়ে দিবে সমগ্র ভারতকে।
বাংলাদেশের মূল শক্তি তার ভূগোল নয়, সম্পদও নয়; বরং জনশক্তি। এবং জনশক্তির সাথে ইসলামের সংযোগ হলে জন্ম নেয় এক মহাশক্তি। তখন সংযোগ ঘটে সর্বময় শক্তির অধিকারি মহান আল্লাহতায়ালার সাথে। তখন যুদ্ধের তারা একা থাকে না, তাদের সাথে যোগ দেয় ফেরেশতারাও। মরুর নিঃস্ব আরবেরা তো বিশ্বশক্তিতে ময়দানে পরিণত হয়েছিল মহান আল্লাহতায়ালার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হওয়াতে। ১৯৪৭ সালে এই বাঙালী মুসলিমগণই ভারতের ভূগোল ভেঙ্গে দিয়েছিল এবং জন্ম দিয়েছিল বিশ্বের সরববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের। তেমন একটি রাজনৈতিক ভূমিকম্প বাংলাদেশের জনগণ আবারো সৃষ্টি করতে পারে। ভারত তাই বাঙালী মুসলিমদের তাদের শক্তির মূল উৎস কোর’আন থেকে দূরে সরাতে চায়। আর একাজে ভারতের সুবিধা হল, আওয়ামী লীগকে তারা নতজানু কলাবোরেটর রূপে পেয়েছে। বাঙালী হিন্দুদের চেয়েও এ কাজে তারা ভারতের প্রতি বেশী বিশ্বস্ত ও তাঁবেদার। ভারত সে সুযোগটিকেই কাজে লাগাতে চায়।
একাত্তরের বিজয়কে ধরে রাখার স্বার্থে আওয়ামী লীগের কাঁধে লাগাতর বন্দুক রাখাটিই ভারতের জাতীয় নীতি। তবে এলক্ষ্যে ভারতের শাসকচক্র শধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপরই পুঁজি বিনিয়োগ করছে না। তাদের স্ট্রাটেজী, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা নয়। তাই পুঁজি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশের মিডিয়া, সাংস্কৃতিককর্মী, সাহিত্যকর্মী, আলেম-উলামা, ছাত্র-শিক্ষক, এমন কি ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের উপরও। সে সাথে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে ভারতে পড়ার সুযোগও করে দিয়েছে। ভারত জানে, তাদের জাল থেকে আওয়ামী লীগ কখনোই হারিয়ে যাওয়ার নয়। ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে এ দলটি নিজ গরজেই ভারতের পক্ষ নিবে। কারণ, ভারতের হাতে যেমন আছে বাঙালী হিন্দুর ভোট, তেমনি আছে বিশাল রাষ্ট্রীয় পুঁজি এবং ভারত-প্রতিপালিত মিডিয়া। নির্বাচনী জয়ের জন্য এগুলো জরুরী। তবে ভারত চায়,অন্যদেরও পক্ষে আনতে এবং সকল ভারতপন্থিদের জোটবদ্ধ রাখতে। এ জন্যই আওয়ামী লীগকে বাধ্য করে সকল ভারতপন্থিদের সাথে মহাজোট গড়তে ও তাদেরকে ক্ষমতার ভাগী করতে।
পাকিস্তানের ব্যর্থতা ও ভারতের বিজয়
বাংলাদেশের উপর ভারতের আজকের অধিকৃতি বুঝতে হলে পাকিস্তানের অতীত ব্যর্থতাগুলি বুঝতে হবে। পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি অর্থনৈতিক ছিল না। প্রশাসনিকও নয়। বরং সেটি ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রগুলিতে পাকিস্তানের ব্যর্থতাই ভারতের বিজয়কে সহজ করে দেয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের ব্যর্থতাকে কখনোই সামরিক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্যান-ইসলামী চেতনার ভিত্তিতে। ১৯৪৭’য়ে মুসলিম লীগের দুটি মূল স্লোগান ছিল “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর” এবং “পাকিস্তান কি মতলব কিয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। ছিল আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাস এবং পরস্পরের মাঝে ঈমানী বন্ধন।
একটি আদর্শিক দেশকে বাঁচাতে হলে আদর্শকে মজবুত ও গণভিত্তি দিতে হয়। নইলে দেশ ভেঙ্গে যায়। পাকিস্তানের ২৩ বছরে আমলে বহু বিশ্ববিদ্যালয়, বহু ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ ও মেডিকেল কলেজ, বহু ডিগ্রি কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, মডেল স্কুল, জেলা স্কুল, ক্যান্টনমেন্ট ও কলকারাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে যা কিছু হয়েছে -এ ছিল তার চেয়ে বহু গুণ অধিক। পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার ভারতের চেয়েও অধিক ছিল। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানটি দখলে নেয় ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুপক্ষ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গণে জোয়ার আসে সেক্যুলারিজম ও সোসালিজমের। সে জোয়ারে ভাসতে থাকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক। এতে মারা পড়ে ১৯৪৭’য়ের প্যান-ইসলামিক চেতনা। আর ইসলামী চেতনা না বাঁচলে সে চেতনাধারি দেশটির অস্তিত্বও যে সংকটে পড়বে -সেটিই তো স্বাভাবিক। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় একাত্তরে রণাঙ্গনে হলেও আদর্শিক পরাজয়টি হয়েছিল বহু আগেই্। সেটি বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে। এবং সেটি ভারতসেবী ও ইসলামবিরোধী বুদ্ধিজীবীদের হাতে। এরাই একাত্তরে ভারতের হাতে বিজয় তুলে দেয়। এবং বাংলাদেশের ভূমিতে এরাই আজ ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদার।
কোন দেশকে বাঁচাতে হলে শুধু অস্ত্রধারি সৈনিক হলে চলে না, কলমধারি লড়াকু সৈনিকও চাই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল লড়াইটি করেছিল এই কলমধারি সৈনিকগণই। ফলে ১৯৪৭’য়ে একটি তীরও ছুঁড়তে হয়নি। পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা কলমের কসম খেয়ে কলমের শক্তিকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তির রণাঙ্গনে ইসলামের পক্ষে তেমন শক্তিমান সৈনিক ছিল না। যারা ১৯৪৭ সালের পূর্বে সক্রিয় ছিলেন তারাও ১৯৪৭ সালের পর লড়াই ছেড়ে দর্শকের গ্যালারিতে স্থান নিয়েছিলেন। ২৩ বছরে একখানি বইও এ নিয়ে লেখা হয়নি, কেন ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হলো? ১১ শত মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাঙালী মুসলিমদের জোট বাঁধাই বা কেন জরুরি হলো? ভারত তো ১৯৪৭ সালের আগে অখন্ডই ছিল। কিন্তু সে ভূগোলকে ভাঙ্গার প্রয়োজন কেন দেখা দিল? ২৩ বছরে সেসব প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের ছাত্ররা দেশে বিদেশে কত জীবজন্তু, লতা-পাতা, কবিতা-পুথির উপর গবেষণা করে, পিএইচডি ডিগ্রিও নেয়। কিন্তু অখন্ড ভারত ভেঙ্গে কেন পাকিস্তান সৃষ্টি হল -তা নিয়ে কোন গবেষণা হয়নি। তেমন কোন বইও লেখা হয়নি। আজ যেরূপ অখন্ড ভারতের পক্ষে কথা বলা হচেছ এবং বাঙালী মুসলিম মনে যেভাবে অখন্ড ভারতের মোহ বাড়ছে, সেটি কখনোই হতো না যদি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা নিয়ে ছাত্রদের প্রকৃত ইতিহাস জানানো হতো। রাতের অন্ধকারে সুবিধা হয় চোর-ডাকাত-দুর্বিত্তদের। তেমনি জ্ঞানের অভাবে সুবিধা হয় শত্রুদের। তখন জনপ্রিয়তা পায় মিথ্যা প্রচরণা। অজ্ঞ থাকা এজন্যই কবীরা গুনাহ।
অনেকেই বলে,“পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলেই মুসলিমদের জন্য ভাল হতো। অখন্ড ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হতো এবং এ বিশাল জনসংখ্যা ভারতে শক্তিশালী মুসলিম শক্তির জন্ম ঘটাতো”। তারা বলে,“পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের কোন কল্যাণটি হয়েছে?” কিন্তু প্রশ্ন হলো, অখন্ড ভারতে থাকাই যদি কল্যাণকর হতো তবে ভারতে বসবাসকারি প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের এতো দুরাবস্থা কেন? বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে যত মুসলিমের বাস তার চেয়ে বেশী মুসলিমের বাস ভারতে। কিন্তু ভারতে বসবাসরত মুসলিমদের শক্তি বা শান্তি বিগত ৭০ বছরে কতটুকু বেড়েছে? বরং বেড়েছে বঞ্চনা, নির্যাতন ও অপমান। হিন্দু গুন্ডাদের হাতে নিহত, ধর্ষিতা ও পথে ঘাটে চড়-থাপ্পর খাওয়াটি তাদের জীবনে অতি নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার। এ নিয়ে কোন বিচার হয় না, কারো শাস্তিও হয় না। কাশ্মিরে জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগ হলো মুসলিম; কিন্তু তাতে কি তাদের নিজ প্রদেশ শাসনের অধিকার মিলেছে? বরং ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্বশাসনের যে বিধান রয়েছে, কাশ্মিরীদের থেকে সেটিও কেড়ে নেয়া হয়েছে। সমগ্র কাশ্মির এখন উন্মুক্ত কারাগার।
প্রশ্ন হলো, অখন্ড ভারতের শতকরা ৩০ বা ৪০ ভাগ মুসলিম হলে তারা কি শতকরা ৬০ বা ৭০ ভাগ হিন্দুর সাথে প্রতিযোগিতায় পারতো? নিরাপত্তা পেত কি তাদের জানমাল? ব্রিটিশ শাসকদের নীতি ছিল মুসলিম দলন ও হিন্দু পালন। ব্রিটিশের সহযোগিতা পেয়ে হিন্দুরা মুসলিমদের থেকে শিক্ষাদীক্ষা, চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বানিজ্যে ও অর্থনীতিতে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিল। পুলিশ দফতর, আদালত, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গণ, মিডিয়াসহ সর্বত্র ছিল হিন্দুদের আধিপত্য। নিজেদের সে প্রতিষ্ঠিত সুযোগ-সুবিধাগুলি থেকে মুসলিমদের জন্য সামান্যতম ছাড় দিতেও তারা রাজী ছিল না। সমাজের প্রতি স্তরে তখন মুসলিমদের প্রতি কদম এগুতে হতো হিন্দুদের ভিড় ঠেলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর সর্বস্তরে মুসলিমদের জন্য যেরূপ খালি স্থান সৃষ্টি হয়েছিল ভারতে সেটি অভাবনীয় ছিল। অপর দিকে ভারতের রাজনীতিতে তখন তীব্রতর হচ্ছিল মুসলিম বিরোধী উগ্রতা। সর্বত্র যেন মুসলিম নিধনে দাঙ্গা দাঙ্গা ভাব। হিন্দু নেতারা প্রকাশ্যেই বলা শুরু করেছিল, হিন্দুস্থান হিন্দুদের জন্য। হিন্দুস্থানে থাকতে হলে হিন্দু হতে হবে, নইলে তল্পি তল্পা নিয়ে কোন মুসলিম দেশে চলে যেতে হবে। বিজিপি নেতারা আজও সেটিই বলে। শুরু করেছিল ‘শুদ্ধি’র নামে মুসলিমদের হিন্দু বানানোর আন্দোলন। হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষী বিষাক্ত মন যে চিকিৎসার সম্পূর্ণ অযোগ্য –সেটি সঠিক ভাবে বুঝেছিলেন কায়েদে আযম মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর সহচর মুসলিম নেতৃবৃন্দ। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন অচিরেই শেষ হবে। কিন্তু অখন্ড ভারত ভূমিতে একবার হিন্দু শাসনের যাঁতাকলে পড়লে -তা থেকে আর মুক্তি মিলবে না। ফলে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। অন্যান্য মুসলিমদের সাথে বাঙালী মুসলিমগণও তখন নামে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”এর আন্দোলেন। ইতিহাসের এ পাঠ বাংলাদেশের স্কুলের বই থেকে পরিকল্পিত ভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এবং সেটি ভারতসেবী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা দেবার স্বার্থে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সংখ্যালঘুদের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য এ শতাব্দির শুরুতে একটি তদন্ত কমিশন ঘটনা করেছিলেন। সে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে যে তথ্যগুলো বেরিয়ে এসেছে তা অতি করুণ। শিক্ষা ও চাকুরিতে মুসলমানদের অবস্থা ভারতের নমশুদ্রদের চেয়েও খারাপ। ভারতে মুসলিমদের অবস্থা ১৯৪৭’য়ে যা ছিল তা থেকেও বহু নিচে নেমেছে। অর্থনৈতিক বঞ্চনার পাশাপাশি তারা নিয়মিত মারা যাচ্ছে মুসলিম-বিরোধী গণহত্যায়। মুসলিম মহিলারা হচ্ছে ধর্ষণের শিকার। দাঙ্গার নামে তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালানোটি হিন্দুদের কাছে যেন উৎসবের বিষয়। ভারতীয় জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ মুসলিম; কিন্তু সরকারি চাকুরিতে তাদের সংখ্যা শতকরা ৩ ভাগেরও কম।
পাকিস্তানের ব্যর্থতা অনেক, কিন্তু দেশটির অর্জন কি এতোই তুচ্ছ? পাকিস্তানের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালগুলিতে যত মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করে ভারতে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা তার ১০ ভাগের এক ভাগও নয়। অথচ একটি দেশের মানুষ কতটা সামনে এগুচ্ছে বা কীরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক শক্তিসঞ্চয় করছে তা পরিমাপের একটি নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা। ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে অতি নগন্য প্রফেশনালদের সংখ্যা। পাকিস্তানের একমাত্র করাচী শহরে যতজন ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী,আইনবিদ, প্রফেসর, বিজ্ঞানী, আমদানী-রফ্তানীকারক ও সামরিক অফিসারের বসবাস সমগ্র ভারতীয় মুসলিমদের মাঝেও তা নেই। তাছাড়া পাকিস্তানে যতজন পারমানবিক বিজ্ঞানী বা পদার্থ বিজ্ঞানীর বসবাস তা ভারতীয় মুসলিমদের মাঝে দূরে থাক, ৫৭টির বেশী মুসলিম দেশের মাঝে কোন দেশেই নাই। সম্প্রতি ব্রিটিশ পত্রিকায় প্রকাশ, পাকিস্তানের আনবিক বোমার সংখ্যা ফ্রান্সের প্রায় সমকক্ষ। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একমাত্র তাদের হাতেই রয়েছে আনবিক বোমাধারি দূরপাল্লার মিজাইল -যা ভারতীয় প্রযুক্তির চেয়ে অগ্রসর। রয়েছে যুদ্ধ বিমান তৈরীর সামর্থ্য। একাত্তর থেকে পাকিস্তান অনেক সামনে এগিয়েছে। দেশটি আজও বেঁচে আছে সে সামরিক শক্তির জোরেই। নইলে ভারত ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে কয়েক টুকরোয় বিভক্ত করে ফেলতো। একাত্তরের পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW সেটির পরিকল্পনাও এঁটেছিল। ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার বই “Inside RAW”য়ে সে বিষয়ে বিস্তর বিবরণ তুলে ধরেছেন। সামরিক শক্তির বিচারে পাকিস্তানই হলো সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। এ কারণেই দেশটি তার জন্ম থেকেই সকল আন্তর্জাতিক ইসলাম-বিরোধী শক্তির টার্গেট। অখন্ড ভারতে বসবাস করলে শক্তি সঞ্চয়ের কি এরূপ সুযোগ মিলতো? শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তো পায়ের তলায় মাটি চাই, স্বাধীনতাও চাই। ভারতের মুসলিমদের কি সেটি আছে? বন্দীদের সংখ্যা জেলে যতই বৃদ্ধি পাক তাতে কি জেলবাসীদের শক্তি বাড়ে?
ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও
বীজ সব জায়গায় গজায় না, বেড়েও উঠে না। বনেজঙ্গলে পড়লে গজালেও বেড়ে উঠে না। ভারতে মুসলিম প্রতিভা যে নাই -তা নয়। প্রতিটি শিশুরই বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। কিন্তু ভারতে মুসলিম শিশুর বেড়ে উঠার অনুকূল পরিবেশই নাই। সামনে এগুনোর পথ নাই। ভারতের কাছে বাংলাদেশের বড় অপরাধ, দেশটি তার মুসলিম নাগরিকদের ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দিয়েছে। ভারতের দৃষ্টিতে ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠার অর্থই হলো মৌলবাদী বা সন্ত্রাসী হওয়া। একই ধারণা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। ভারত মনে করে বাংলাদেশ সন্ত্রাসী উৎপাদনের ঘাঁটি। একই রূপ অভিযোগ পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেও। ভারত চায়, বাংলাদেশের সরকারও ভারতের ন্যায় মুসলিমদের ইসলাম নিয়ে বেড়ে উঠাকে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করুক। ভারতের প্রতি নতজানু হাসিনা ভারতের সে দাবীটি যে কতটা মেনে নিয়েছে তা বুঝা যায় ঘরে ঘরে পুলিশ নামিয়ে জিহাদ বিষয়ক বই বাজেয়াপ্ত করা থেকে। সেটি দেখা যায়, কোর’আনের তাফসিরকারকদের দেশ ছাড়া করা বা কারাবন্দী করা থেকে।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা অনর্থক বললে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টিও অনর্থক হয়ে দাঁড়ায়। তাই পাকিস্তানের সৃষ্টিকে অনর্থক বা অনাসৃষ্টি বলাটি মামূলী ব্যাপার নয়, এটি এক গভীর ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেও। বাংলাদেশ তার সমগ্র মানচিত্রটা পেয়েছে মূলত পাকিস্তান থেকে। বাংলাদেশীরা একাত্তরের পর এক ইঞ্চি ভূমিও এ মানচিত্রে বাড়ায়নি। তাই বাংলাদেশীদের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ১৯৪৭’য়ে অর্জিত স্বাধীনতা। ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা জুটেছে বটে, স্বাধীনতা নয়। ১৯৭১’য়ের ১৬ই ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা দিবস বললে পূর্বের পাকিস্তানী ২৩ বছরকে ঔপনিবেশিক বিদেশী শাসন বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তখন অর্থ দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন। কিন্তু সেটি হলে কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর ঢাকার খাজা নাযিম উদ্দিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হন কি করে? বগুড়ার মহম্মদ আলী এবং আওয়ামী লীগের সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন কি করে? পশ্চিম পাকিস্তানীরা কি তা মেনে নিত। মিথ্যা কথায় হিসাব মিলানো যায় না। তাই হিসাব মেলে না পাকিস্তানী আমলকে ঔপনিবেশিক আমল বললে। তবে সে মিথ্যাটি বলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের স্বার্থপরতা আছে। সেটি নিজেদের অপরাধগুলিকে গৌরবময় করার স্বার্থে। সে সাথে লক্ষ্য, প্রভুরাষ্ট্র ভারতের আগ্রাসী চরিত্রকে আড়াল করা। কিন্তু যারা সে অপরাধে জড়িত নয় এবং লিপ্ত নয় ভারতের লেজুড়বৃত্তিতে, অন্ততঃ তাদের তো সত্য কথাগুলো নির্ভয়ে বলা উচিত।
মুসলিম ইতিহাসে অপরাধীদের তালিকাটি বিশাল। মীর জাফরের ন্যায় কেউ বা অপরাধ করেছে মুসলিম ভূমিকে বিদেশী শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে। কেউ বা ভয়ানক পরাধ করেছে মুসলিম দেশকে খন্ডিত করার মাধ্যমে দুর্বল করে। মুজিব অপরাধ করেছে উভয় ভাবেই। মুজিবের কারণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানই শুধু দুর্বল হয়নি, দুর্বল হয়েছে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ। সে সাথে ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের হাতে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভূ-প্রাকৃতিক ও সামরিক ভাবে ঘেরাও হয়ে গেছে বাংলাদেশ। এরই ফলে যেমন গোলামী এসেছে, তেমনি এসেছে সীমাহীন লুন্ঠন। ফলে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষও। এবং তাতে মৃত্যু হয়েছে বহু লক্ষ বাংলাদেশীর। এমন কি পানি শূণ্যতায় মারা পড়েছে বাংলাদেশের নদীগুলিও।
মুজিবের নাশকতা
একই সাথে মহান আল্লাহতায়ালা ও ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক কাফের শক্তিকে খুশি করা যায় না। যে কোন একটিকে বেছে নিতে হয়। শেখ মুজিব এবং তার অনুসারি বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ মহান আল্লাহতায়ালার বদলে ভারতের কাফের শাসকদের খুশি করার পথটি বেছে নিয়েছে এবং উৎসব বাড়িয়েছে দিল্লির শাসকমহলে। মহান আল্লাহতায়ালা কখোনই মুসলিমদের বিভক্তি, পরাজয় ও শক্তিহানীকে পছন্দ করেন না। যা মুসলিমদের পরাজয় আনে তা মহান আল্লাহতায়ালার আযাব ডেকে আনে। এজন্য যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে, সে কখোনই কাফেরদের বিজয় বাড়ায় না। এমন কাজ তো শয়তানের অনুসারি কাফেরদের, ঈমানদারের। অথচ মুজিব ও তার সাথীরা সেটিই করেছে একাত্তরে।
মীর জাফরের গাদ্দারীর পিছনে তার স্বার্থ হাসিলের বিষয়টি ছিল। তেমন একটি স্বার্থপরতা মুজিবেরও ছিল। সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে একাত্তরের ন্যায় পরাজয়টি বিরল। পৌত্তলিক কাফেরগণ তাদের সমগ্র ইতিহাসে কোন কালেই মুসলিমদের উপর এরূপ বিজয় পায়নি। ইন্দিরা গান্ধি তাই দর্প ও গর্ব ভরে বলতে পেরেছিল, “হাজার সাল কি বদলা লে লিয়া”। এবং সেটি মুজিবের কারণে। বাংলার মুসলিম ইতিহাসে এটিই হলো সবচেয়ে কলংকিত অধ্যায়। একাত্তরে যেটি জুটেছে সেটি হলো, ভারতীয় প্রভাব বলয়ে অন্তর্ভুক্তি। ১৯৭১’থেকে ভারত বাংলাদেশকে গণ্য করে তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা সীমানার ভিতরের একটি দেশ। যেমন নিযামের হায়দারাবাদ গন্য হত ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। নিযাম সে আমলে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। অথচ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নিজদেশের প্রতিরক্ষায় কোন ট্যাংক বা দূরপাল্লার একখানি কামানও কিনতে দেয়নি। ভারতের বাইরে কোন বৃহৎ শক্তির সাথে সম্পর্কও গড়তে দেয়নি। ইচ্ছামত ট্রানজিট নিতে ব্রিটিশেরা দেশটির মধ্য দিয়ে জালের মত রেল লাইন বসিয়েছিল। তাই ১৯৪৮ সালে ভারত-ভূক্ত করতে ভারতকে বেগে হতে হয়নি। দুর্বল এক আশ্রিত রাষ্ট্রের অবকাঠামো ব্রিটিশেরা পূর্ব থেকেই সে দেশে নির্মাণ করে গিয়েছিল।
বাংলাদেশেও তেমনি গোলামীর এক মজবুত অবকাঠামো নির্মান করছে ভারত ও তার বাংলাদেশী সহযোগীরা। সেটি যেমন বুদ্ধিবৃত্তিক, তেমনি সাংস্কৃতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক। নিযাম শাসিত হায়দারাবাদের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশগণ যেমন যথেচ্ছারে ট্রানজিট নিয়েছিল, একই ভাবে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট নিচ্ছে ভারত। এবং ভারত কখনোই চায় না বাংলাদেশ পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তান ও চীনের সাথে সম্পর্ক মজবুত করুক এবং উচ্চমানের অস্ত্র সংগ্রহ করুক। একমাত্র অজ্ঞতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রাটই বাংলাদেশের এ বন্দিদশাকে ভুলিয়ে দিতে পারে। এমন অজ্ঞতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রাটে পরাধীনতাও স্বাধীনতা মনে হয়। বাংলাদেশের ভারতপন্থিদের কাজ হয়েছে বাঙালী মুসলিমদের মাঝে সে বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রাটকেই আরো তীব্রতর করা। একাত্তরে ভারতের ঘরে যেমন বিজয় তুলে দিয়েছিল, এখনো সেই একই খেলা তারা লাগাতর খেলে যাচ্ছে। ১ম সংস্করণ ০৭/০৬/১১; ২য় সংস্করন ১৭/১১/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018