মজলুম রোহিঙ্গা মুসলিম এবং শেখ হাসিনার অমনুষ্যনীতি
- Posted by Dr Firoz Mahboob Kamal
- Posted on June 10, 2019
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
শেখ হাসিনার অমনুষ্যনীতি
শেখ হাসিনার রাজনীতি, বিদেশনীতি ও শাসননীতি যে কতটা বিবেকবর্জিত ও অমানবিক সেটি কি কোন গোপন বিষয়? বহুবার বহু বীভৎস্যতা নিয়ে সেটি ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। একটি লাশের বদলে দশটি লাশ ফেলার রাজনীতি,লগি-বৈঠা নিয়ে বিরোধী দলীয় কর্মীদের হত্যা,যাত্রী ভর্তি বাসে আগুণ,লেখক-সাংবাদিক-আলেম ও বিরোধী দলীয় নেতাদের গুম-খুণ ও গ্রেফতারি –এমন কার্যকলাপকে কি সুস্থ্য ও বিবেকমান মানুষের রাজনীতি বলা যায়? অথচ এরূপ অমনুষ্যনীতিই হলো শেখ হাসিনার রাজনীতি। সে নীতিরই পুনঃরায় প্রকাশ ঘটলো মজলুল রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যে। গতকাল ২৭/০৭/১২ তারিখে আল -জাজিরা ইংরেজী টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাতকারে তিনি যা বলেছেন সেটি যেমন হৃদয়শূণ্য তেমনি মানবতাশূন্য। তিনি বলেছেন,রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে কোন স্থান নাই।যুক্তি দেখিয়েছেন,বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ,অতএব রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। তিনি বলেছেন,“সমস্যাটি মায়ানমারের।অতএব বিদেশীদের উচিত,এ নিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি না করে মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা।”
আল -জাজিরার সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল,“হত্যা ও নির্যাতন থেকে প্রাণের ভয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছিল তখন বাংলাদেশের কোষ্টাল গার্ডগণ তাদের ঢুকতে দেয়নি,এবং বলপূর্ব্বক তাদেরকে মায়ানমারে প্রবেশে বাধ্য করেছিল। এটি কি অমানবিক নয়?” জবাবে হাসিনা বলেন,“না,এটি সঠিক নয়। বাংলাদেশের কোষ্টাল গার্ডগণ রোহিঙ্গাদের সাথে কোনরূপ অমানবিক আচরণ করেনি,তাদেরকে বরং খাদ্য, পানীয় ও ঔষধ দিয়েছে এবং মায়ানবারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে রাজী করেছে।” উক্ত সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,“আপনার সরকার কি মায়ানমারে সরকারের সাথে রোহিঙ্গাদের এ সংকট নিয়ে কোন রূপ যোগাযোগ করেছে? জবাবে বলেন,“হাঁ আমরা যোগযোগ করেছি”। সে যোগাযোগে মায়ানমার সরকারের কাছে তাঁর সরকারের কি দাবী ছিল সেটি না বলে শেখ হাসিনা কার্যতঃ মায়ানমার সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হন এবং বলেন, “মায়ানমার সরকার সমস্যার সমাধারে চেষ্টা করছে। অবস্থার উন্নতি ঘটেছে এবং উদ্বাস্তু আসাও বন্ধ হয়েছে।” আল জাজিরার সাংবাদিক তার এ জবাবে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন,“প্রধানমন্ত্রি আপনি এসব বিশ্বাস করেন?” শেখ হাসিনার মুখে এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না। তিনি বরং বিব্রত হন এবং নীরব হয়ে যান। মায়ানমার সরকারের নীতি যে পরিবর্তন হয়েছে তার প্রমাণ কোথায়? ক’দিন আগেই সেদেশের প্রেসিডেন্ট সকল রোহিঙ্গাদের তার দেশে থেকে অপসারণের দাবী করেছেন।
আল জাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনার মূল যুক্তিটি ছিল,বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ অতএব রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটিতে জায়গা কোথায়? কিন্তু সমস্যা কি জনবহুল হওয়া নিয়ে? সমস্যা তো হৃদয়হীনতায়। কাউকে বিপদে জায়গা দেয়ার জন্য ঘরের জায়গাটির চেয়ে বড় প্রয়োজন হলো মনের জায়গার। মনে জায়গা না থাকলে দেশ বিশাল হলেও তখন বিপদগ্রস্তের জন্য কোন জায়গা থাকে না। আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের জনসংখ্যা আজকের তুলনায় অর্ধেকও ছিল না। কিন্তু তখনও দেশে অভাব ছিল। প্রচণ্ডতা দারিদ্রতা ছিল। সর্বক্ষেত্রে নানারূপ পশ্চাদপদতা ছিলও। দেশে তখনও দুর্ভিক্ষ আসতো। কিন্তু সে অভাবের দিনেও বাংলার মানুষ ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের জন্য জায়গা করে দিয়েছে। কারণ তখন জনগণ ও সরকারের মনে তাদের জন্য বিশাল জায়গা ছিল। অথচ শেখ মুজিব ও তার দলের কারণে বাংলাদেশ শুধু ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ি রূপেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়নি, রাজনীতিতেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে প্রকট ভিক্ষুক-সংস্কৃতি। ফলে বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার শুধু হাত পেতে নিতেই জানে, দিতে নয়। রোহিঙ্গাদের প্রবেশের বিরুদ্ধে এজন্যই তারা সীমান্তে কোষ্টাল গার্ড বসেয়েছে।
বাস্তবতা হলো,মানুষ শুধু পেট নিয়ে আসে না,বরং বিস্ময়কর মেধা এবং কর্মক্ষম হাত-পা নিয়েও আসে।মেধার কারণে বিশ্বের জনসংখ্যা বিগত শত বছরে বহুগুণ বাড়লেও তার চেয়েও বেশী বেড়েছে সম্পদ। ফলে আজ থেকে হাজার বছর আগে বিশ্বের স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে রূপ বাস করতো সে তুলনায় বহুগুণ বেশী প্রাচুয্য নিয়ে বাস করে আজকের মানুষ। তাছাড়া মানুষের পানাহারের দায়িত্ব তো মহান আল্লাহর। কোন ব্যক্তিই তার রেযেক ছাড়া জন্ম নেয় না। ঈমানদারের তো এটিই বিশ্বাস। সে বিশ্বাস না থাকলে তাকে কি মুসলমান বলা যায়? কিন্তু শেখ হাসিনা যে চেতনা নিয়ে কথা বলেছেন সেখানে সে ঈমান কোথায়? বাংলাদেশে প্রতিবছর বহু লক্ষ লোক জন্মসূত্রে যোগ দিচ্ছে। আজ থেকে ৩০ বছর পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা আজকের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। ৬০ বছর পর হয়তো ৪ গুণ হবে। জনসংখ্যা তো এভাবেই বাড়ে। তখন কি বাংলাদেশের মানুষ খাদ্যাভাবে ও স্থানাভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? দ্বিগুণ বা চারগুণ জনসংখ্যার দায়ভার তো বাংলাদেশকেই সেদিন বইতে হবে। ইনশাল্লাহ তারা শুধু বেঁচেই থাঁকবে না উন্নতিও করবে। বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ পাট নয়,চা বা চিংড়ি মাছ নয়। গার্মেন্টস বা পশুচর্মও নয়। বরং সেটি দেশের জনগণ। আল্লাহর এ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে আপদ বা বোঝা বললে শুধু সে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিরই অপমান হয় না,বরং চরম অবমাননা হয় মহান স্রষ্টা মহান আল্লাহর। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার আল্লাহর বিরুদ্ধে সে অবমাননার রাজনীতিই করে চলেছে। তাছাড়া প্রাণ বাঁচাতে আসা কোন মানুষই প্রতিবেশীর ঘরে আজীবন বসবাসের জন্য আসে না। আশ্রয় চায় সীমিত সময়ের জন্য। বিপদ কেটে গেলে তারা দ্রুত নিজ ঘরে ফিরে যায়। কারণ প্রতিবেশীর ঘর তা যত ভালই হোক, কখনোই নিজ ঘরের মত হয় না। তারা তো চায় তা তাদের নিজ ঘরটি দ্রুত আবার বাসের যোগ্য হোক। তাই আশ্রয়দাতা প্রতিবেশী দেশগুলির লক্ষ্য হয়,উদ্বাস্তুদের নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার মত একটি পরিস্থিতি দ্রুত সৃষ্টি করা। রাজনীতি তো এভাবেই মানবিক পরিচয় পায়।
হাতছাড়া হলো মহাসুযোগ
বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মান-মর্যাদা ইতিমধ্যেই তলায় ঠেকেছে। শেখ হাসিনার পিতার আমলে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি রূপে। আওয়ামী লীগ তখন ইতিহাস গড়েছিল ব্যাপক দূর্নীতি এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ আবার মুজিব আমলের সে পুরোন পরিচিতি ফিরে পেয়েছে। দেশটি এখন আবার বিশ্বের অতি দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সম্প্রতি সরকারি দলের ভয়ানক দূর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণে বরাদ্দকৃত ঋণও বাতিল করে দিল বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সাহায্যদানকারি সংস্থা। ঠিক এ মূহুর্তে রোহিঙ্গা বিষয়ে মানবতা ও মানবিক অধিকারের পক্ষ নিয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্ব মাঝে দাঁড়ানোর সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের। যে গৃহে ১০ জন মানুষের ভাত পাক হয় সে গৃহে ২ জন মেহমান খাওয়াতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যে বাংলাদেশের জনগণ ১৬ কোটি মানুষের আহার জোগাতে পারে তারা কি মায়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা এক বা দুই লাখ মানুষকে কয়েকটি মাস বা বছর খাওয়াতে পারতো না? ইমেজ সৃষ্টির এমন সুযোগ ফি বছর আসে না। আসে মাঝে মধ্যে। কিন্তু জাতির নীতি-নৈতিকতা ও মান-মর্যাদার পরীক্ষা এর মধ্য দিয়েই হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সে পরীক্ষায় দারুণ ভাবে ফেল করেছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকট যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক বিষয়, তাদের বসবাস ও পানাহারের খরচ জোগাতে জাতিসংঘ এবং অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসতো। পাকিস্তানে ৩০ লাখ আফগান যখন আশ্রয় নিয়েছে তখন তাদের সাহায্যে দেশটিতে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যও এসেছে। বিদেশীরা তো আর বিপর্যস্ত মানুষকে সমুদ্রে বা আকাশে ভাসমান রেখে খাওয়াতে পারে না? এমন দুর্যোগ মুহুর্তে প্রতিবেশী দেশকে উদ্বাস্তুদের জন্য শুধু মাথাগোঁজার জায়গা দিতে হয়,বাঁকি দায়ভার অন্যরা নিয়ে নেয়। সে সুযোগটুকুই বাংলাদেশ সরকার দেয়নি। বাংলাদেশ নিয়ে এজন্যই আন্তর্জাতিক মহলের প্রচণ্ড হতাশা।
হাসিনা সরকারের বড় অপরাধ, মজলুমের পক্ষ নেয়ার জন্য যে নৈতীক বল দরকার সেটি এ সরকার দেখাতে পারেননি। নৈতীক বল তো আসে সুনীতি থেকে। যাদের বিশ্বজুড়া পরিচিতি দুর্নীতিবাজ রূপে,সেরূপ একটি সরকারের পক্ষে সেটি থাকার কথাও নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নীতি হওয়া উচিত ছিল, প্রাণে বাঁচতে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মায়ানমার সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা। একাজে বাংলাদেশে সরকার বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সমর্থণ পেত। সমর্থণ পেত প্রায় ৬০টি মুসলিম দেশের। তখন ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ একটি শান্তিকামী ও মানবতাবাদী দেশ রূপে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেত। কিন্তু শেখ হাসীনার সরকার সে পথে এগুয়নি। বরং বেছে নিয়েছে অমানবিক বিবেকশূণ্যতার পথ। বাংলাদেশ যে স্রেফ জনসংখ্যাতেই বেড়েছে,মানবতায় নয় -সেটিই শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ববাসীর সামনে পুণঃরায় প্রকাশ করে দিল।
তবে শেখ হাসিনার সরকার শুধু যে অমানবিক তাই নয়, প্রচণ্ড আহাম্মকও। সেটি প্রকাশ করে দিল সরকারের মন্ত্রীরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপুমনি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গাদের নির্মূল প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশের জামায়াত-শিবিরের কাণ্ড বলে চিত্রিত করেছে। শুধু মানবিক গুণ নয়, ইতিহাস-জ্ঞানও যে নেহায়েত কম সেটিও কি এর পর বুঝতে বাঁকী থাকে? রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মূল প্রক্রিয়ার যখন শুরু,তখন বাংলাদেশে জামায়াত বা শিবির বলে কিছু ছিল না। বার্মিজ জাতিয়তাবাদীদের হাতে রোহিঙ্গাদের নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু হয় শতাধিক বছর আগে। থেমে থেমে লাগাতর চলছে সে নিধন প্রক্রিয়া। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ১৯৪২ সালে। তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মায়ানমারের ব্রিটিশ শাসকগণ তখন জাপানীদের হাতে মার খাচ্ছিল। সে অরাজক পরিস্থিতিতে বার্মিজগণ তখন নির্মূলকর্মে নামে। ১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ তারিখে ৫,০০০ রোহিঙ্গা মুসলমানকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। এর পর চলতে থাকে থেমে থেমে মুসলিম নিধন। এরূপ নির্মূল প্রক্রিয়ার ফলে মায়ানামারে বৌদ্ধ জনসংখ্যা বাড়লেও এ এলাকায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়েনি। বরং সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের মারমুখো বৌদ্ধদের সংখ্যা। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ,রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংখ্যা বহু বছর আগে প্রায় দশ লাখ ছিল। কিন্তু সে সংখ্যা এখন ৮ লাখের বেশী নয়। লাগাতর এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রায় তিনি লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। প্রায় ২৪ হাজার আশ্রয় নিয়েছে মালয়েশিয়ায়।বহু রোহিঙ্গা মুসলমান বহু কষ্টে দূরবর্তী থাইল্যান্ড,ভারত,ব্রুনাই,সৌদি আরব এবং পাকিস্তানেও আশ্রয় নিয়েছে। শেখ হাসিনা বা দিপুমনি কি এরপরও বলবেন,রোহিঙ্গা নির্মূলের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি জামায়াত-শিবিরের কাণ্ড?
আলোড়িত বিশ্ব এবং অনড় হাসিনা
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ নির্মূল প্রক্রিয়া শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী মহলে কোন বিবেকবোধ জাগ্রত না করলে কি হবে,বিশ্বের বহুদেশে তা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমনকি ভারতের মত একটি অমুসলিম দেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ অমুসলিম রাজনৈতিক নেতারা রাজধানী দিল্লির রাজপথে নেমে এসেছেন। পত্রিকায় প্রকাশ,দিল্লিস্থ্ মায়ানমারের দূতাবাসের সামনে ভারতের সমাজবাদী দল,ইউনাইটেড জনতা দল, সিপিআই, ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাশ লীগের নেতারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবীতে ধর্না দিয়েছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উপর চাপ দিচ্ছেন,এ গণহত্যা দমনে তার সরকার যেন উদ্যোগ নেয়। গত ২৭/০৭/১২ তারিখে জুম্মার নামায শেষে হাজার হাজার মানুষের বিশাল মিছিল হয়েছে মায়ানমার থেকে বহু দূরে তেহরানের রাজপথে। অথচ ঢাকায় তার অর্ধেক মানুষের মিছিলও এ অবধি হয়নি। হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল করাচীর রাজপথে। মিছিল হয়েছে পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে। এ গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তুমুল লেখালেখি হয়েছে নবজাগরিত মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশের পত্র-পত্রিকায়। সুস্থ্য দেহে ক্ষুদ্র মাছি বসলেও সবল হাতখানি তেড়ে আসে। কিন্তু অসাড় দেহে জোরে ধাক্কা লাগালেও তা খাড়া হয় না। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের নীরবতাই প্রমাণ করে বিবেকে কতটা অসুস্থ্য এ সরকারের কর্তব্যক্তিরা।
মায়ানামার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। রাশিয়া বা চীনও নয়। দীর্ঘকাল সামরিক স্বৈরাচার কবলিত একটি অনুন্নত দেশ। গণতন্ত্র,ব্যক্তি-স্বাধিনতা ও দেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সরকারের পরিচালিত যুদ্ধটি নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে মায়ানমারের সরকার ইতিমধ্যেই পৃথিবী জুড়ে বহু বদনাম কুড়িয়েছে। কারেন বিদ্রোহসহ বহু বিদ্রোহ বহু যুগ ধরে চলছে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। এমন একটি বহুল পরিচিত অমানবিক সরকারের বিরুদ্ধে অতি সহজেই বাংলাদেশে সরকার একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারতো। বিশ্বপরিস্থিতি ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। মজলুম রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়ালে বিশ্বের বহুদেশ ও বহুসংস্থা বাংলাদেশকে বাহবা দিত। বাংলাদেশে যে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা এতকাল বসবাস করছে তাদেরও ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ সৃষ্টির জন্য এটি ছিল মোক্ষম সময়। কিন্তু হাসিনা সরকার সে পথে এগুয়নি। বরং ধরেছে ভিন্ন পথ। সেটি মানবতা-বিরোধী পথ। ফল দাড়িয়েছে, শেখ হাসিনার মগজের সুস্থ্যতাই নিয়ে বিদেশী সাংবাদিকের সন্দেহ জেগেছে। আল-জাজিরার সাংবাদিকের প্রশ্নে তো সে সংশয়ই ফুটে উঠেছে।
রাজনীতি যেখানে ছাগলনীতি
গরু-ছাগলের একটি নীতি আছে।সেটি স্রেফ জৈবীক ভাবে বাঁচা। এমন বাঁচার মধ্যে পাশের প্রতিবেশীর প্রতি কোন কল্যাণ-চিন্তা থাকেনা। কোন নীতিবোধ বা দাযিত্বশীলতাও থাকে না। পশু তো এজন্যই পশু। এজন্যই পশু থেকে কোনরূপ মানবিক আচরণ আশা করা যায় না। গরু-ছাগলের বিশাল পাল থেকে একটিকে ধরে নিয়ে চোখের সামনে গলায় ছুড়ি চালালেও তাতে গরু-ছাগলের ঘাস-পাতা খাওয়ায় ছেদ পড়ে না। পবিত্র কোরআনে ঈমানহীন মানুষকে শুধু পশু নয়,পশুর চেয়েও অধম বলা হয়েছে। প্রতিবেশীর বেদনায় বহু মানুষও যে পশুর মতই বেদনাহীন হয় সে প্রমাণ কি কম? শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের সেটিই হলো নীতি। তাই রোহিঙ্গা মুসলমানদের যতই জবাই করা হোক বা তাদের নারীদের যতই ধর্ষণ করা হোক ও তাদের ঘরবাড়ীতে যতই আগুণ দেয়া হোক, তাতে শেখ হাসিনা ও তার অনুসারিদের মনে সামান্যতম দংশনও হয় না। গুজরাতে যখন তিন হাজারের বেশী মুসলিম নারী-শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করা হলো,এবং মুসলিম বস্তিতে আগুণ দেয়া হলো,তখনও আওয়ামী শিবিরে তাই কোন প্রতিবাদ উঠেনি। প্রতিবাদ তখনও উঠেনি যখন উগ্র হিন্দুরা অযোধ্যায় বাবরী মসজিদকে উৎসবভরে ধ্বংস করে। তখনও আওয়ামী তখনও নিন্দায় রাস্তায় নামেনি যখন ১৯৮৩ সালে আসামের নেলীতে ৫০০০ মুসলমানদের একদিনে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। অথচ তা নিয়ে সেদিন সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আলোড়ন উঠেছিল। এই তো ক’দিন আগে আসামের কোকরাজরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হলো। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও কি আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে কোন কিছু বলা হয়েছে? কাশ্মীরের মুসলমান দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে হত্যা,ধর্ষণ ও জেলজুলুমের মধ্যে আছে কিন্তু তা নিয়ে কি আওয়ামী লীগ কোন দিনও কি কোন প্রতিবাদ করেছে? অথচ বাংলাদেশে কোন হিন্দু বা বৌদ্ধদের গায়ে আঁচড় লাগলে তা নিয়ে ফিল্ম বানিয়ে শাহরিয়ার কবিরের ন্যায় আওয়ামী ঘরানার ক্যাডারগণ তা বিশ্বময় প্রচার করে।তাদের দায়বদ্ধতা যে কোথায় এরপরও কি বুঝতে বাঁকি থাকে?
মায়ানমার সরকারের ফ্যাসীবাদী স্ট্রাটেজী
জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী সাম্প্রতিক হামলাতে ৫০ থেকে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান নিজেদের ঘরবাড়ী থেকে স্থানচ্যুত হয়েছে। তবে ঘরবাড়ি থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করাটাই মায়ানমার সরকারের একমাত্র অপরাধ নয়। হিউমান রাইট্স ওয়াচের মতে তাদেরকে দাস-শ্রমিক রূপে কাজ করতেও বাধ্য করা হচ্ছে। বিয়েশাদী করতে তাদেরকে সরকার থেকে অনুমতি নিতে হয়।পত্রিকায় প্রকাশ,সন্তানের সংখ্যা অনুর্দ্ধ দুই জন রাখতেও তাদের উপর চাপ দেয়া হয়। দেশের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতেও তাদেরকে সরকার থেকে অনুমতি নিতে হয়। আরো গুরুতর বিষয় হলো,রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংস পলিসির নেতৃত্ব দিচ্ছে বৌদ্ধ পুরোহিতগণ। তারা রোহিঙ্গাদের কালা ও বর্বর রূপে আরোহিত করছে। অথচ তারা ভূলে গেছে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠিতা বিহারের গৌতম বুদ্ধও শ্বেতাঙ্গ বা গৌর বর্ণের ছিলেন না। বিভিন্ন এনজিও সূত্রে প্রকাশ,রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছতেও এ বৌদ্ধ পুরোহিতগণ বাধা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় ও স্থাপনায় তারা পোষ্টার এঁটে দিয়েছে এ হুশিয়ারি জানিয়ে যে,রোহিঙ্গাদের সাথে যেন কোনরূপ সংশ্রব না রাখা হয় এবং তাদের কোনরূপ সাহায্য করা না হয়।
তবে রোহিঙ্গা নিমূল প্রক্রিয়ায় শীর্ষে রয়েছে সেদেশের সরকার। গত ১৯/৭/১২ মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেন সেইন বলেছেন,“রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো তাদেরকে সকলকে মায়ানমার থেকে সরিয়ে নিয়ে কোন তৃতীয় দেশে বা জাতিসংঘের তত্বাবধানে কোন ত্রান শিবিরে রাখা।” অতি সহজ সমাধান! তিনি যে কতটা অসুস্থ্য চেতনার জীব,তা কি এর পরও বুঝতে বাঁকি থাকে? যারা কট্টোর বর্ণবাদী বা জাতিয়তাবাদী তারা এরূপ নির্মূল প্রক্রিয়ার বাইরে কোন কিছু যেন ভাবতেই পারে না। এমন এক চেতনা নিয়েই হিটলার জার্মানীতে বসবাসরত ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে তাদের নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়েছিল। আর বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা একাত্তরে বিহারী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল তাদেরকে হত্যা করে বা তাদেরকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে। হাজার হাজার বিহারীকে তখন উৎসবভরে হত্যাও করা হয়েছিল এবং উৎখাত করা হয়েছিল তাদের ঘরবাড়ী ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। ঘরবাড়ী হারানো সে হাজার হাজার বিহারীরা বিগত ৬০ বছরের বেশী কাল ধরে বস্তিতে বসবাস করে সে বর্ণবাদী বাঙালীদের অমনুষ্যনীতিরই সাক্ষর বহন করছে। আর আজ সে অভিন্ন অমুনষ্যনীতির শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা।এখানেও কারণ অভিন্ন। সেটি ভাষা ও বর্ণভিত্তিক কট্টোর জাতিয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ। মায়ানমারে সেটি বার্মিজ জাতিয়তাবাদ। তাদের কথা,মায়ানমার শুধু বার্মিজদের জন্য,এখানে অবার্মিজ রোহিঙ্গাদের কোন স্থান নেই। কিন্তু কথা হলো, যে মায়ানমারে শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা বসবাস করলো তারা যদি সে মায়ানমারে স্থান না পায় তবে অন্যরা কেন তাদেরকে স্থান দিবে? তারা দেখে না যে পাশ্ববর্তী মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ হলো তারা যারা সে দেশে গিয়েছিল চীন ও দক্ষিণ ভারত থেকে। তাদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা। মালয়েশিয়া থেকে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেছে, কিন্তু চাইনিজ এবং ভারতীয় তামিলদের কি সেদেশ থেকে নির্মূল করা হয়েছে? বহু লক্ষ ভারতীয় ও চাইনিজ ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকার বহুদেশে। নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা ধর্মের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি বিশ্বের প্রতিদেশে। তারা সেসব দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করছে। এটিই যে কোন সুস্থ্য সমাজের নীতি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সে অধিকার দিতে রাজী নয় মায়ানমার সরকার। অথচ মিয়ানমারের মুসলমানদের বসবাস শত শত বছর পূর্ব থেকে। আরাকানে এক সময় সুলতানি শাসনও ছিল। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ভাষা চর্চা পেয়েছে আরাকান রাজ্যসভায়। কবি আলাওল ছিলেন আরাকান রাজ্যসভার সভাকবি। মায়ানমারে মুসলমানদের এ দীর্ঘ উপস্থিতি ও ঐত্হ্যকে মায়ানমারে বর্ণবাদীরা নির্মূল করতে চায়। কথা হলো এতবড় ভয়ানক অপরাধের বিরুদ্ধে নিন্দা করতে কি বিশাল মানবতা লাগে?
শেখ হাসিনার আদর্শিক আত্মীয়
কোন দেশের জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের নিন্দা করার মত নৈতীক বল অপরদেশের ফ্যাসিষ্টদের থাকে না। তাদের মধ্যেও একটি আদর্শিক বন্ধন থাকে। তাই জার্মানীতে যখন ইহুদীদেরকে হাজারে হাজার গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হচ্ছিল সে নৃশংসতার নিন্দা বিশ্বের কোন জাতিয়তাবাদী বা বর্ণবাদীরা করেনি। বরং বহু ভারতীয় ও বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা তো হিটলারের ন্যায় সে বর্বর ব্যক্তিটির সাথে বন্ধুত্বও গড়েছে। লক্ষণীয় হলো, মায়ানমারের বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট থেন সেইন ও তার সহিংস অনুসারিদের সাথে শেখ হাসিনা ও তাঁর রাজনৈতিক ক্যাডারদের ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও আদর্শিক পার্থক্য নাই। বরং আদর্শিক দিক দিয়ে তারা বরং পরস্পরের ঘনিষ্ট আত্মীয়। যে অপরাধটি শেখ মুজিবের ফ্যাসীবাদী ক্যাডারগণ অতীতে বিহারীদের সাথে করেছে এবং আজ করছে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, সেটিই তো বার্মিজ ফ্যাসিষ্টগণ করছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে। ফলে কোন নৈতীক বল নিয়ে শেখ হাসিনা বার্মিজ নৃশংসতার নিন্দা করবে? বরং শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা পরিণত হয়েছে মায়ানমার সরকারের নির্লজ্জ স্তাবকে। তারা মায়ানমার সরকারকে দায়ী না করে বরং দায়ী করেছেন বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য অবস্থার উন্নতি হয়েছে সে সার্টিফিকেটও দিয়েছেন শেখ হাসিনা। আল জাজিরা টিভির সাথে সাক্ষাতকারে তো শেখ হাসিনা সেটিই বলেছেন। কথা হলো,মায়ানমারে যদি অবস্থার উন্নতি হয়েই থাকে তবে কেন বাংলাদেশে তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের অবস্থান? তাদেরকে কেন সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না? ৩০/০৭/১২
শেখ হাসিনার অমনুষ্যনীতি
শেখ হাসিনার রাজনীতি, বিদেশনীতি ও শাসননীতি যে কতটা বিবেকবর্জিত ও অমানবিক সেটি কি কোন গোপন বিষয়? বহুবার বহু বীভৎস্যতা নিয়ে সেটি ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। একটি লাশের বদলে দশটি লাশ ফেলার রাজনীতি,লগি-বৈঠা নিয়ে বিরোধী দলীয় কর্মীদের হত্যা,যাত্রী ভর্তি বাসে আগুণ,লেখক-সাংবাদিক-আলেম ও বিরোধী দলীয় নেতাদের গুম-খুণ ও গ্রেফতারি –এমন কার্যকলাপকে কি সুস্থ্য ও বিবেকমান মানুষের রাজনীতি বলা যায়? অথচ এরূপ অমনুষ্যনীতিই হলো শেখ হাসিনার রাজনীতি। সে নীতিরই পুনঃরায় প্রকাশ ঘটলো মজলুল রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যে। গতকাল ২৭/০৭/১২ তারিখে আল -জাজিরা ইংরেজী টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাতকারে তিনি যা বলেছেন সেটি যেমন হৃদয়শূণ্য তেমনি মানবতাশূন্য। তিনি বলেছেন,রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশে কোন স্থান নাই।যুক্তি দেখিয়েছেন,বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ,অতএব রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। তিনি বলেছেন,“সমস্যাটি মায়ানমারের।অতএব বিদেশীদের উচিত,এ নিয়ে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি না করে মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা।”
আল -জাজিরার সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল,“হত্যা ও নির্যাতন থেকে প্রাণের ভয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেষ্টা করছিল তখন বাংলাদেশের কোষ্টাল গার্ডগণ তাদের ঢুকতে দেয়নি,এবং বলপূর্ব্বক তাদেরকে মায়ানমারে প্রবেশে বাধ্য করেছিল। এটি কি অমানবিক নয়?” জবাবে হাসিনা বলেন,“না,এটি সঠিক নয়। বাংলাদেশের কোষ্টাল গার্ডগণ রোহিঙ্গাদের সাথে কোনরূপ অমানবিক আচরণ করেনি,তাদেরকে বরং খাদ্য, পানীয় ও ঔষধ দিয়েছে এবং মায়ানবারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে রাজী করেছে।” উক্ত সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,“আপনার সরকার কি মায়ানমারে সরকারের সাথে রোহিঙ্গাদের এ সংকট নিয়ে কোন রূপ যোগাযোগ করেছে? জবাবে বলেন,“হাঁ আমরা যোগযোগ করেছি”। সে যোগাযোগে মায়ানমার সরকারের কাছে তাঁর সরকারের কি দাবী ছিল সেটি না বলে শেখ হাসিনা কার্যতঃ মায়ানমার সরকারের মুখপাত্রে পরিণত হন এবং বলেন, “মায়ানমার সরকার সমস্যার সমাধারে চেষ্টা করছে। অবস্থার উন্নতি ঘটেছে এবং উদ্বাস্তু আসাও বন্ধ হয়েছে।” আল জাজিরার সাংবাদিক তার এ জবাবে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন,“প্রধানমন্ত্রি আপনি এসব বিশ্বাস করেন?” শেখ হাসিনার মুখে এ প্রশ্নের কোন জবাব ছিল না। তিনি বরং বিব্রত হন এবং নীরব হয়ে যান। মায়ানমার সরকারের নীতি যে পরিবর্তন হয়েছে তার প্রমাণ কোথায়? ক’দিন আগেই সেদেশের প্রেসিডেন্ট সকল রোহিঙ্গাদের তার দেশে থেকে অপসারণের দাবী করেছেন।
আল জাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনার মূল যুক্তিটি ছিল,বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ অতএব রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটিতে জায়গা কোথায়? কিন্তু সমস্যা কি জনবহুল হওয়া নিয়ে? সমস্যা তো হৃদয়হীনতায়। কাউকে বিপদে জায়গা দেয়ার জন্য ঘরের জায়গাটির চেয়ে বড় প্রয়োজন হলো মনের জায়গার। মনে জায়গা না থাকলে দেশ বিশাল হলেও তখন বিপদগ্রস্তের জন্য কোন জায়গা থাকে না। আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের জনসংখ্যা আজকের তুলনায় অর্ধেকও ছিল না। কিন্তু তখনও দেশে অভাব ছিল। প্রচণ্ডতা দারিদ্রতা ছিল। সর্বক্ষেত্রে নানারূপ পশ্চাদপদতা ছিলও। দেশে তখনও দুর্ভিক্ষ আসতো। কিন্তু সে অভাবের দিনেও বাংলার মানুষ ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের জন্য জায়গা করে দিয়েছে। কারণ তখন জনগণ ও সরকারের মনে তাদের জন্য বিশাল জায়গা ছিল। অথচ শেখ মুজিব ও তার দলের কারণে বাংলাদেশ শুধু ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ি রূপেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়নি, রাজনীতিতেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে প্রকট ভিক্ষুক-সংস্কৃতি। ফলে বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার শুধু হাত পেতে নিতেই জানে, দিতে নয়। রোহিঙ্গাদের প্রবেশের বিরুদ্ধে এজন্যই তারা সীমান্তে কোষ্টাল গার্ড বসেয়েছে।
বাস্তবতা হলো,মানুষ শুধু পেট নিয়ে আসে না,বরং বিস্ময়কর মেধা এবং কর্মক্ষম হাত-পা নিয়েও আসে।মেধার কারণে বিশ্বের জনসংখ্যা বিগত শত বছরে বহুগুণ বাড়লেও তার চেয়েও বেশী বেড়েছে সম্পদ। ফলে আজ থেকে হাজার বছর আগে বিশ্বের স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে রূপ বাস করতো সে তুলনায় বহুগুণ বেশী প্রাচুয্য নিয়ে বাস করে আজকের মানুষ। তাছাড়া মানুষের পানাহারের দায়িত্ব তো মহান আল্লাহর। কোন ব্যক্তিই তার রেযেক ছাড়া জন্ম নেয় না। ঈমানদারের তো এটিই বিশ্বাস। সে বিশ্বাস না থাকলে তাকে কি মুসলমান বলা যায়? কিন্তু শেখ হাসিনা যে চেতনা নিয়ে কথা বলেছেন সেখানে সে ঈমান কোথায়? বাংলাদেশে প্রতিবছর বহু লক্ষ লোক জন্মসূত্রে যোগ দিচ্ছে। আজ থেকে ৩০ বছর পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা আজকের তুলনায় দ্বিগুণ হবে। ৬০ বছর পর হয়তো ৪ গুণ হবে। জনসংখ্যা তো এভাবেই বাড়ে। তখন কি বাংলাদেশের মানুষ খাদ্যাভাবে ও স্থানাভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? দ্বিগুণ বা চারগুণ জনসংখ্যার দায়ভার তো বাংলাদেশকেই সেদিন বইতে হবে। ইনশাল্লাহ তারা শুধু বেঁচেই থাঁকবে না উন্নতিও করবে। বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ পাট নয়,চা বা চিংড়ি মাছ নয়। গার্মেন্টস বা পশুচর্মও নয়। বরং সেটি দেশের জনগণ। আল্লাহর এ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে আপদ বা বোঝা বললে শুধু সে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিরই অপমান হয় না,বরং চরম অবমাননা হয় মহান স্রষ্টা মহান আল্লাহর। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার আল্লাহর বিরুদ্ধে সে অবমাননার রাজনীতিই করে চলেছে। তাছাড়া প্রাণ বাঁচাতে আসা কোন মানুষই প্রতিবেশীর ঘরে আজীবন বসবাসের জন্য আসে না। আশ্রয় চায় সীমিত সময়ের জন্য। বিপদ কেটে গেলে তারা দ্রুত নিজ ঘরে ফিরে যায়। কারণ প্রতিবেশীর ঘর তা যত ভালই হোক, কখনোই নিজ ঘরের মত হয় না। তারা তো চায় তা তাদের নিজ ঘরটি দ্রুত আবার বাসের যোগ্য হোক। তাই আশ্রয়দাতা প্রতিবেশী দেশগুলির লক্ষ্য হয়,উদ্বাস্তুদের নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার মত একটি পরিস্থিতি দ্রুত সৃষ্টি করা। রাজনীতি তো এভাবেই মানবিক পরিচয় পায়।
হাতছাড়া হলো মহাসুযোগ
বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মান-মর্যাদা ইতিমধ্যেই তলায় ঠেকেছে। শেখ হাসিনার পিতার আমলে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি রূপে। আওয়ামী লীগ তখন ইতিহাস গড়েছিল ব্যাপক দূর্নীতি এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ আবার মুজিব আমলের সে পুরোন পরিচিতি ফিরে পেয়েছে। দেশটি এখন আবার বিশ্বের অতি দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সম্প্রতি সরকারি দলের ভয়ানক দূর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণে বরাদ্দকৃত ঋণও বাতিল করে দিল বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সাহায্যদানকারি সংস্থা। ঠিক এ মূহুর্তে রোহিঙ্গা বিষয়ে মানবতা ও মানবিক অধিকারের পক্ষ নিয়ে মাথা উঁচু করে বিশ্ব মাঝে দাঁড়ানোর সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের। যে গৃহে ১০ জন মানুষের ভাত পাক হয় সে গৃহে ২ জন মেহমান খাওয়াতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যে বাংলাদেশের জনগণ ১৬ কোটি মানুষের আহার জোগাতে পারে তারা কি মায়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা এক বা দুই লাখ মানুষকে কয়েকটি মাস বা বছর খাওয়াতে পারতো না? ইমেজ সৃষ্টির এমন সুযোগ ফি বছর আসে না। আসে মাঝে মধ্যে। কিন্তু জাতির নীতি-নৈতিকতা ও মান-মর্যাদার পরীক্ষা এর মধ্য দিয়েই হয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সে পরীক্ষায় দারুণ ভাবে ফেল করেছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা সংকট যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক বিষয়, তাদের বসবাস ও পানাহারের খরচ জোগাতে জাতিসংঘ এবং অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসতো। পাকিস্তানে ৩০ লাখ আফগান যখন আশ্রয় নিয়েছে তখন তাদের সাহায্যে দেশটিতে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যও এসেছে। বিদেশীরা তো আর বিপর্যস্ত মানুষকে সমুদ্রে বা আকাশে ভাসমান রেখে খাওয়াতে পারে না? এমন দুর্যোগ মুহুর্তে প্রতিবেশী দেশকে উদ্বাস্তুদের জন্য শুধু মাথাগোঁজার জায়গা দিতে হয়,বাঁকি দায়ভার অন্যরা নিয়ে নেয়। সে সুযোগটুকুই বাংলাদেশ সরকার দেয়নি। বাংলাদেশ নিয়ে এজন্যই আন্তর্জাতিক মহলের প্রচণ্ড হতাশা।
হাসিনা সরকারের বড় অপরাধ, মজলুমের পক্ষ নেয়ার জন্য যে নৈতীক বল দরকার সেটি এ সরকার দেখাতে পারেননি। নৈতীক বল তো আসে সুনীতি থেকে। যাদের বিশ্বজুড়া পরিচিতি দুর্নীতিবাজ রূপে,সেরূপ একটি সরকারের পক্ষে সেটি থাকার কথাও নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নীতি হওয়া উচিত ছিল, প্রাণে বাঁচতে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মায়ানমার সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা। একাজে বাংলাদেশে সরকার বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সমর্থণ পেত। সমর্থণ পেত প্রায় ৬০টি মুসলিম দেশের। তখন ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ একটি শান্তিকামী ও মানবতাবাদী দেশ রূপে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেত। কিন্তু শেখ হাসীনার সরকার সে পথে এগুয়নি। বরং বেছে নিয়েছে অমানবিক বিবেকশূণ্যতার পথ। বাংলাদেশ যে স্রেফ জনসংখ্যাতেই বেড়েছে,মানবতায় নয় -সেটিই শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ববাসীর সামনে পুণঃরায় প্রকাশ করে দিল।
তবে শেখ হাসিনার সরকার শুধু যে অমানবিক তাই নয়, প্রচণ্ড আহাম্মকও। সেটি প্রকাশ করে দিল সরকারের মন্ত্রীরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপুমনি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গাদের নির্মূল প্রক্রিয়াকে বাংলাদেশের জামায়াত-শিবিরের কাণ্ড বলে চিত্রিত করেছে। শুধু মানবিক গুণ নয়, ইতিহাস-জ্ঞানও যে নেহায়েত কম সেটিও কি এর পর বুঝতে বাঁকী থাকে? রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্মূল প্রক্রিয়ার যখন শুরু,তখন বাংলাদেশে জামায়াত বা শিবির বলে কিছু ছিল না। বার্মিজ জাতিয়তাবাদীদের হাতে রোহিঙ্গাদের নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু হয় শতাধিক বছর আগে। থেমে থেমে লাগাতর চলছে সে নিধন প্রক্রিয়া। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ১৯৪২ সালে। তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মায়ানমারের ব্রিটিশ শাসকগণ তখন জাপানীদের হাতে মার খাচ্ছিল। সে অরাজক পরিস্থিতিতে বার্মিজগণ তখন নির্মূলকর্মে নামে। ১৯৪২ সালের ২৮শে মার্চ তারিখে ৫,০০০ রোহিঙ্গা মুসলমানকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। এর পর চলতে থাকে থেমে থেমে মুসলিম নিধন। এরূপ নির্মূল প্রক্রিয়ার ফলে মায়ানামারে বৌদ্ধ জনসংখ্যা বাড়লেও এ এলাকায় মুসলিম রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়েনি। বরং সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের মারমুখো বৌদ্ধদের সংখ্যা। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ,রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংখ্যা বহু বছর আগে প্রায় দশ লাখ ছিল। কিন্তু সে সংখ্যা এখন ৮ লাখের বেশী নয়। লাগাতর এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে প্রায় তিনি লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। প্রায় ২৪ হাজার আশ্রয় নিয়েছে মালয়েশিয়ায়।বহু রোহিঙ্গা মুসলমান বহু কষ্টে দূরবর্তী থাইল্যান্ড,ভারত,ব্রুনাই,সৌদি আরব এবং পাকিস্তানেও আশ্রয় নিয়েছে। শেখ হাসিনা বা দিপুমনি কি এরপরও বলবেন,রোহিঙ্গা নির্মূলের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি জামায়াত-শিবিরের কাণ্ড?
আলোড়িত বিশ্ব এবং অনড় হাসিনা
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ নির্মূল প্রক্রিয়া শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী মহলে কোন বিবেকবোধ জাগ্রত না করলে কি হবে,বিশ্বের বহুদেশে তা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমনকি ভারতের মত একটি অমুসলিম দেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ অমুসলিম রাজনৈতিক নেতারা রাজধানী দিল্লির রাজপথে নেমে এসেছেন। পত্রিকায় প্রকাশ,দিল্লিস্থ্ মায়ানমারের দূতাবাসের সামনে ভারতের সমাজবাদী দল,ইউনাইটেড জনতা দল, সিপিআই, ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাশ লীগের নেতারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবীতে ধর্না দিয়েছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উপর চাপ দিচ্ছেন,এ গণহত্যা দমনে তার সরকার যেন উদ্যোগ নেয়। গত ২৭/০৭/১২ তারিখে জুম্মার নামায শেষে হাজার হাজার মানুষের বিশাল মিছিল হয়েছে মায়ানমার থেকে বহু দূরে তেহরানের রাজপথে। অথচ ঢাকায় তার অর্ধেক মানুষের মিছিলও এ অবধি হয়নি। হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল করাচীর রাজপথে। মিছিল হয়েছে পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে। এ গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তুমুল লেখালেখি হয়েছে নবজাগরিত মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশের পত্র-পত্রিকায়। সুস্থ্য দেহে ক্ষুদ্র মাছি বসলেও সবল হাতখানি তেড়ে আসে। কিন্তু অসাড় দেহে জোরে ধাক্কা লাগালেও তা খাড়া হয় না। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের নীরবতাই প্রমাণ করে বিবেকে কতটা অসুস্থ্য এ সরকারের কর্তব্যক্তিরা।
মায়ানামার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। রাশিয়া বা চীনও নয়। দীর্ঘকাল সামরিক স্বৈরাচার কবলিত একটি অনুন্নত দেশ। গণতন্ত্র,ব্যক্তি-স্বাধিনতা ও দেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সরকারের পরিচালিত যুদ্ধটি নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে মায়ানমারের সরকার ইতিমধ্যেই পৃথিবী জুড়ে বহু বদনাম কুড়িয়েছে। কারেন বিদ্রোহসহ বহু বিদ্রোহ বহু যুগ ধরে চলছে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। এমন একটি বহুল পরিচিত অমানবিক সরকারের বিরুদ্ধে অতি সহজেই বাংলাদেশে সরকার একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারতো। বিশ্বপরিস্থিতি ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। মজলুম রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়ালে বিশ্বের বহুদেশ ও বহুসংস্থা বাংলাদেশকে বাহবা দিত। বাংলাদেশে যে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা এতকাল বসবাস করছে তাদেরও ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ সৃষ্টির জন্য এটি ছিল মোক্ষম সময়। কিন্তু হাসিনা সরকার সে পথে এগুয়নি। বরং ধরেছে ভিন্ন পথ। সেটি মানবতা-বিরোধী পথ। ফল দাড়িয়েছে, শেখ হাসিনার মগজের সুস্থ্যতাই নিয়ে বিদেশী সাংবাদিকের সন্দেহ জেগেছে। আল-জাজিরার সাংবাদিকের প্রশ্নে তো সে সংশয়ই ফুটে উঠেছে।
রাজনীতি যেখানে ছাগলনীতি
গরু-ছাগলের একটি নীতি আছে।সেটি স্রেফ জৈবীক ভাবে বাঁচা। এমন বাঁচার মধ্যে পাশের প্রতিবেশীর প্রতি কোন কল্যাণ-চিন্তা থাকেনা। কোন নীতিবোধ বা দাযিত্বশীলতাও থাকে না। পশু তো এজন্যই পশু। এজন্যই পশু থেকে কোনরূপ মানবিক আচরণ আশা করা যায় না। গরু-ছাগলের বিশাল পাল থেকে একটিকে ধরে নিয়ে চোখের সামনে গলায় ছুড়ি চালালেও তাতে গরু-ছাগলের ঘাস-পাতা খাওয়ায় ছেদ পড়ে না। পবিত্র কোরআনে ঈমানহীন মানুষকে শুধু পশু নয়,পশুর চেয়েও অধম বলা হয়েছে। প্রতিবেশীর বেদনায় বহু মানুষও যে পশুর মতই বেদনাহীন হয় সে প্রমাণ কি কম? শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের সেটিই হলো নীতি। তাই রোহিঙ্গা মুসলমানদের যতই জবাই করা হোক বা তাদের নারীদের যতই ধর্ষণ করা হোক ও তাদের ঘরবাড়ীতে যতই আগুণ দেয়া হোক, তাতে শেখ হাসিনা ও তার অনুসারিদের মনে সামান্যতম দংশনও হয় না। গুজরাতে যখন তিন হাজারের বেশী মুসলিম নারী-শিশু-বৃদ্ধকে হত্যা করা হলো,এবং মুসলিম বস্তিতে আগুণ দেয়া হলো,তখনও আওয়ামী শিবিরে তাই কোন প্রতিবাদ উঠেনি। প্রতিবাদ তখনও উঠেনি যখন উগ্র হিন্দুরা অযোধ্যায় বাবরী মসজিদকে উৎসবভরে ধ্বংস করে। তখনও আওয়ামী তখনও নিন্দায় রাস্তায় নামেনি যখন ১৯৮৩ সালে আসামের নেলীতে ৫০০০ মুসলমানদের একদিনে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। অথচ তা নিয়ে সেদিন সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আলোড়ন উঠেছিল। এই তো ক’দিন আগে আসামের কোকরাজরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হলো। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও কি আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে কোন কিছু বলা হয়েছে? কাশ্মীরের মুসলমান দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে হত্যা,ধর্ষণ ও জেলজুলুমের মধ্যে আছে কিন্তু তা নিয়ে কি আওয়ামী লীগ কোন দিনও কি কোন প্রতিবাদ করেছে? অথচ বাংলাদেশে কোন হিন্দু বা বৌদ্ধদের গায়ে আঁচড় লাগলে তা নিয়ে ফিল্ম বানিয়ে শাহরিয়ার কবিরের ন্যায় আওয়ামী ঘরানার ক্যাডারগণ তা বিশ্বময় প্রচার করে।তাদের দায়বদ্ধতা যে কোথায় এরপরও কি বুঝতে বাঁকি থাকে?
মায়ানমার সরকারের ফ্যাসীবাদী স্ট্রাটেজী
জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী সাম্প্রতিক হামলাতে ৫০ থেকে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান নিজেদের ঘরবাড়ী থেকে স্থানচ্যুত হয়েছে। তবে ঘরবাড়ি থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করাটাই মায়ানমার সরকারের একমাত্র অপরাধ নয়। হিউমান রাইট্স ওয়াচের মতে তাদেরকে দাস-শ্রমিক রূপে কাজ করতেও বাধ্য করা হচ্ছে। বিয়েশাদী করতে তাদেরকে সরকার থেকে অনুমতি নিতে হয়।পত্রিকায় প্রকাশ,সন্তানের সংখ্যা অনুর্দ্ধ দুই জন রাখতেও তাদের উপর চাপ দেয়া হয়। দেশের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতেও তাদেরকে সরকার থেকে অনুমতি নিতে হয়। আরো গুরুতর বিষয় হলো,রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংস পলিসির নেতৃত্ব দিচ্ছে বৌদ্ধ পুরোহিতগণ। তারা রোহিঙ্গাদের কালা ও বর্বর রূপে আরোহিত করছে। অথচ তারা ভূলে গেছে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠিতা বিহারের গৌতম বুদ্ধও শ্বেতাঙ্গ বা গৌর বর্ণের ছিলেন না। বিভিন্ন এনজিও সূত্রে প্রকাশ,রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছতেও এ বৌদ্ধ পুরোহিতগণ বাধা দিচ্ছে। রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় ও স্থাপনায় তারা পোষ্টার এঁটে দিয়েছে এ হুশিয়ারি জানিয়ে যে,রোহিঙ্গাদের সাথে যেন কোনরূপ সংশ্রব না রাখা হয় এবং তাদের কোনরূপ সাহায্য করা না হয়।
তবে রোহিঙ্গা নিমূল প্রক্রিয়ায় শীর্ষে রয়েছে সেদেশের সরকার। গত ১৯/৭/১২ মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেন সেইন বলেছেন,“রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো তাদেরকে সকলকে মায়ানমার থেকে সরিয়ে নিয়ে কোন তৃতীয় দেশে বা জাতিসংঘের তত্বাবধানে কোন ত্রান শিবিরে রাখা।” অতি সহজ সমাধান! তিনি যে কতটা অসুস্থ্য চেতনার জীব,তা কি এর পরও বুঝতে বাঁকি থাকে? যারা কট্টোর বর্ণবাদী বা জাতিয়তাবাদী তারা এরূপ নির্মূল প্রক্রিয়ার বাইরে কোন কিছু যেন ভাবতেই পারে না। এমন এক চেতনা নিয়েই হিটলার জার্মানীতে বসবাসরত ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে তাদের নির্মূলের পরিকল্পনা নিয়েছিল। আর বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা একাত্তরে বিহারী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল তাদেরকে হত্যা করে বা তাদেরকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে। হাজার হাজার বিহারীকে তখন উৎসবভরে হত্যাও করা হয়েছিল এবং উৎখাত করা হয়েছিল তাদের ঘরবাড়ী ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। ঘরবাড়ী হারানো সে হাজার হাজার বিহারীরা বিগত ৬০ বছরের বেশী কাল ধরে বস্তিতে বসবাস করে সে বর্ণবাদী বাঙালীদের অমনুষ্যনীতিরই সাক্ষর বহন করছে। আর আজ সে অভিন্ন অমুনষ্যনীতির শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা।এখানেও কারণ অভিন্ন। সেটি ভাষা ও বর্ণভিত্তিক কট্টোর জাতিয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ। মায়ানমারে সেটি বার্মিজ জাতিয়তাবাদ। তাদের কথা,মায়ানমার শুধু বার্মিজদের জন্য,এখানে অবার্মিজ রোহিঙ্গাদের কোন স্থান নেই। কিন্তু কথা হলো, যে মায়ানমারে শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা বসবাস করলো তারা যদি সে মায়ানমারে স্থান না পায় তবে অন্যরা কেন তাদেরকে স্থান দিবে? তারা দেখে না যে পাশ্ববর্তী মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ হলো তারা যারা সে দেশে গিয়েছিল চীন ও দক্ষিণ ভারত থেকে। তাদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকেরা। মালয়েশিয়া থেকে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেছে, কিন্তু চাইনিজ এবং ভারতীয় তামিলদের কি সেদেশ থেকে নির্মূল করা হয়েছে? বহু লক্ষ ভারতীয় ও চাইনিজ ছড়িয়ে আছে আফ্রিকা, ইউরোপ এবং আমেরিকার বহুদেশে। নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা ধর্মের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি বিশ্বের প্রতিদেশে। তারা সেসব দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করছে। এটিই যে কোন সুস্থ্য সমাজের নীতি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সে অধিকার দিতে রাজী নয় মায়ানমার সরকার। অথচ মিয়ানমারের মুসলমানদের বসবাস শত শত বছর পূর্ব থেকে। আরাকানে এক সময় সুলতানি শাসনও ছিল। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা ভাষা চর্চা পেয়েছে আরাকান রাজ্যসভায়। কবি আলাওল ছিলেন আরাকান রাজ্যসভার সভাকবি। মায়ানমারে মুসলমানদের এ দীর্ঘ উপস্থিতি ও ঐত্হ্যকে মায়ানমারে বর্ণবাদীরা নির্মূল করতে চায়। কথা হলো এতবড় ভয়ানক অপরাধের বিরুদ্ধে নিন্দা করতে কি বিশাল মানবতা লাগে?
শেখ হাসিনার আদর্শিক আত্মীয়
কোন দেশের জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের নিন্দা করার মত নৈতীক বল অপরদেশের ফ্যাসিষ্টদের থাকে না। তাদের মধ্যেও একটি আদর্শিক বন্ধন থাকে। তাই জার্মানীতে যখন ইহুদীদেরকে হাজারে হাজার গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হচ্ছিল সে নৃশংসতার নিন্দা বিশ্বের কোন জাতিয়তাবাদী বা বর্ণবাদীরা করেনি। বরং বহু ভারতীয় ও বাঙালী জাতিয়তাবাদীরা তো হিটলারের ন্যায় সে বর্বর ব্যক্তিটির সাথে বন্ধুত্বও গড়েছে। লক্ষণীয় হলো, মায়ানমারের বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট থেন সেইন ও তার সহিংস অনুসারিদের সাথে শেখ হাসিনা ও তাঁর রাজনৈতিক ক্যাডারদের ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও আদর্শিক পার্থক্য নাই। বরং আদর্শিক দিক দিয়ে তারা বরং পরস্পরের ঘনিষ্ট আত্মীয়। যে অপরাধটি শেখ মুজিবের ফ্যাসীবাদী ক্যাডারগণ অতীতে বিহারীদের সাথে করেছে এবং আজ করছে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, সেটিই তো বার্মিজ ফ্যাসিষ্টগণ করছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে। ফলে কোন নৈতীক বল নিয়ে শেখ হাসিনা বার্মিজ নৃশংসতার নিন্দা করবে? বরং শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা পরিণত হয়েছে মায়ানমার সরকারের নির্লজ্জ স্তাবকে। তারা মায়ানমার সরকারকে দায়ী না করে বরং দায়ী করেছেন বাংলাদেশের ইসলামপন্থিদের। মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য অবস্থার উন্নতি হয়েছে সে সার্টিফিকেটও দিয়েছেন শেখ হাসিনা। আল জাজিরা টিভির সাথে সাক্ষাতকারে তো শেখ হাসিনা সেটিই বলেছেন। কথা হলো,মায়ানমারে যদি অবস্থার উন্নতি হয়েই থাকে তবে কেন বাংলাদেশে তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের অবস্থান? তাদেরকে কেন সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না? ৩০/০৭/১২
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018