মুসলিম উম্মাহর ব্যর্থতার প্যাথলজি

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ব্যর্থতার প্যাথলজি

মুসলিম উম্মাহর সর্বত্র জুড়ে শুধু ব্যর্থতা। সে ব্যর্থতা যেমন রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামরিক অঙ্গণে, তেমনি নৈতিক, চারিত্রিক ও ঈমানের অঙ্গণে।  সভ্য মানুষেরা ইতিহাস গড়ে গড়ায়, আর অসভ্য মানুষেরা ইতিহাস গড়ে ভাঙ্গায়। মহান আল্লাহতায়ালার গড়াকে পছন্দ করেন এবং অপছন্দ করেন ভাঙ্গাকে। ইসলামে ভাঙ্গার কাজ হারাম, আর গড়ার কাজ হলো পবিত্র ইবাদত। যদি কোন কাফের জাতিও গড়ায় উদ্যোগী তবে মহান আল্লাহতায়ালা তাদের সাহায্য করেন। আর যদি কোন মুসলিম জনগোষ্ঠিও ভাঙ্গার পথ বেছে নেয় -তবে তাদেরকে তিনি আযাব দিয়ে শাস্তি দেন। এটিই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। বিগত প্রায় ১০০ বছরে ধরে মুসলিমগণ লাগাতর ইতিহাস গড়ছে শুধু ভাঙ্গায়। তারা খেলাফত ভেঙ্গেছে। ২২ টুকরোয় ভেঙ্গেছে আরব ভূমিকে। খেলাফতের পর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানও ভেঙ্গেছে। ভাঙ্গার শাস্তিও তারা পেয়েছে এবং এখনো পাচ্ছে। দেশ ভাঙ্গলে স্বাধীনতাও হারাতে হয়। তখন পরাজয় ও পরাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হয়। আরবগণ হারিয়েছে গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার অধিকার। তারা এতোই শক্তিহীন যে ইসরাইলের ৭০ লাখ ইহুদীর সামনে খাড়া হওয়ার সামর্থ্যও তাদের নাই। ফলে গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনীরা। গাজার ৩৫ হাজার নারী, শিশু ও নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারালেও তার মাঝে প্রতিরোধ নাই। বাংলাদেশীরা এক সময় ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি; এখন পরিণত হয়েছে ভারতের রাডারের নীচে এক আশ্রিত রাষ্ট্রের গোলাম প্রজা। বাঙালি মুসলিমগণ হারিয়েছে মৌলিক মানবাধিকারের সাথে ভোটদানের অধিকারও।   

মুসলিম বিশ্বে এরূপ ভাঙ্গা-ভাঙ্গির কারণ যেমন রাজনৈতিক ও সামরিক, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক। প্রতিটি রোগের পিছনেই প্যাথলজি থাকে, তেমনি প্যাথলজি থাকে প্রতিটি ব্যর্থতার পিছনেও। তবে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায় ব্যর্থতা। এবং তাদের সে ব্যর্থতার মূল প্যাথলজি হলো, কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতা। নবীজী (সা:)’র অতি প্রসিদ্ধ হাদীস: “প্রতিটি মুসলিম নর ও নারীর উপর জ্ঞানার্জন ফরজ।” এবং পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা: “ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা” অর্থ: বান্দাদের মাঝে একমাত্র জ্ঞানবানগণই আমাকে ভয় করে। এর অর্থ দাঁড়ায়, যার মধ্যে জ্ঞান নাই, তার মধ্যে আল্লাহতায়ালার ভয়ও নাই। এবং যার মধ্যে আল্লাহতায়ালার ভয় নাই, সে মুসলিম হয় কি করে? তখন সে বাঁচে আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নিয়ে। সে বিদ্রোহের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতি তো সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। ফলে নবীজী (সা:) যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা দেন সে ইসলাম মুসলিম বিশ্বের কোথাও বেঁচে নাই। নবীজী (সা:)’র ইসলাম বাঁচলে তো তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইনের বিচার, প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব এবং দুর্বৃত্তির নির্মূলে ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ দেখা যেত। কিন্তু সে ইসলঅম কি কোথাও নজরে পড়ে? এজন্যই ইসলামের শুরু নামাজ-রোজা দিয়ে হয়নি, হয়েছে কুর’আন থেকে জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে।  অথচ আজ কুর’আন না বুঝাটাই মুসলিম সংস্কৃতি। জীবনে একবার পুরো কুর’আন শরীফ বুঝে পড়েছে এমন মুসলিম কি এক লাখের মাঝেও একজন হবে?

দৈহিক ভাবে বাঁচার জন্য পানাহার জরুরি, তেমনি ঈমান নিয়ে বাঁচার জন্য জরুরি হলো ইলম বা জ্ঞানার্জন। ইসলামে এটি ফরজ। এবং যা কিছু মুসলিমের উপর ফরজ -তা অর্জিত না হলে মুসলিম হওয়া অসম্ভব করে। জ্ঞানশূণ্য ব্যক্তিকে অজ্ঞ বা জাহিল বলা হয়। জাহিল ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব হলো মুসলিম হওয়া। এখানে যে জ্ঞানকে ফরজ করা হয়েছে সেটি সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, চিকিৎসা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের জ্ঞান নয়, সেটি পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, কৃষিবাদ বা অন্য কিছু বানানোর জন্য এ পৃথিবী পৃষ্ঠে পাঠাননি।  যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি মানবকে সৃষ্টি করেছেন সেটি এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, মানব হবে তাঁর অনুগত দাস বা গোলাম। আর উত্তম দাস হতে হলে তো মনিবের হুকুমগুলি জানতে হয় এবং সেগুলিকে হুযথার্থভাবে মেনে চলতে হয়। আর মহান আল্লাহতায়ালার সে হুকুমগুলি জানতে হলে তো কুর’আন সঠিক ভাবে বুঝতে হয় এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে হয়। পবিত্র কুর’আন হলো এ পৃথিবী পৃষ্ঠে জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার। এটি এসেছে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। তাই প্রশ্ন হলো, জ্ঞানের এ সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার থেকে জ্ঞান সংগ্রহ না করে কি জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় হয়?

ভাষা কাজ করে জ্ঞানের দুয়ারে ঢুকার চাবি রূপে। তাই যার হাতে সে চাবি নাই সে ব্যর্থ হয় জ্ঞান আহরনে। কুর’আন বুঝতে হলে এজন্যই জরুরি হলো আরবী ভাষার জ্ঞান। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অজ্ঞ ব্যক্তি কখনোই চিকিৎস্যক হতে পারে না, তেমনি কুর’আনে জ্ঞানে জাহিল ব্যক্তি কখনোই পূর্ণ মুসলিম হতে পারে না। প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের সকল সাফল্যের মূলে ছিল জ্ঞানর্জনের ফরজ আদায়ে বিশাল সাফল্য। তারা কুর’আন বুঝার গুরুত্ব বুঝেছিলেন। এবং কুর’আন বুঝার কাজটি সহজ করতে গিয়ে মিশর, সিরিয়া, ইরাক, সুদান, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, আলজিরিয়া, মৌরতানিয়ার ন্যায় বহু দেশের জনগণ তাদের মাতৃভাষা কবরে পাঠিয়ে আরবী ভাষা শিখেছেন এবং সরাসরি মহান আল্লাহতায়ালার নিজের ভাষাতেই কুর’আনকে বুঝেছেন। কোন তরজমার ধার ধারেননি। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ ব্যর্থ হচ্ছে কুর’আনী জ্ঞানার্জনের সে ফরজ আদায়ে। এমন ব্যর্থ হচ্ছে কুর’আন বুঝার গুরুত্ব বুঝতে। কুর‘আন না বুঝার কারণে তারা ব্যর্থ হচ্ছে একতার গুরুত্ব এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বুঝতে। এবং অজ্ঞতার কারণেই তাঁরা বাঁচছে আদালতে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা না দিয়ে। কুর’আন হলো জান্নাতের রোডম্যাপ। কুর’আন না বুঝাতে তার বিচ্যুৎ হয়েছে জান্নাতে রোডম্যাপ থেকে এবং ধাবিত হচ্ছে জাহান্নামের দিকে। সেটি বুঝা যায় কুর’আনের পথ ছেড়ে জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের পথে ধাবিত হওয়া থেকে।

প্রশ্ন হলো, কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা নিয়ে কি কোন ইবাদতই সঠিক ভাবে হয়? ঈমান একমাত্র তখনই বাঁচে ও বেড়ে উঠে যখন তা পুষ্টি পায় ওহীর জ্ঞান তথা পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান থেকে -যারা ঘোষণা এসেছে সুরা আনফালের দুই নম্বর আয়াতে। মুসলিম জীবনে কুর’আন বুঝার গুরুত্ব এতোই অধিক যে, সুরা ক্বামারে কুর’আন বুঝার প্রতি আহবান জানিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বানী এসেছে ৪ বার। উক্ত সুরার ১৭, ২২, ৩২ ও ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

وَلَقَدْ يَسَّرْنَا ٱلْقُرْءَانَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍۢ

অর্থ: “এবং নিশ্চয়ই আমি সহজ করে নাযিল করেছি কুর’আনকে -যাতে মানুষ উপদেশ বা নির্দেশনা নিতে পারে; কিন্তু আছে কি কেউ যে গ্রহণ করবে এ কিতাব থেকে উপদেশ ও নির্দেশনা?   

মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বার বার আহবান সত্ত্বেও মুসলিম নামধারীগণ ব্যক্তিগণ সে আহবানে সাড়া দেয়নি।  সারা দিলে তো তাদের মাঝে কুর’আন বুঝায় আগ্রহ দেখা যেত। বরং তাদের আগ্রহ দেখা যায় বিশ্বের অন্য ভাষা কিছু শেখার ক্ষেত্রে। বিদেশী সরকার বা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ভাল গোলাম হওয়ার জন্য তারা ইংরেজী ভাষা বা অন্য ভাষা শিখছে। নিজ সন্তানদের বিদেশী ভাষায় দক্ষতা বাড়াতে পর্যাপ্ত অর্থ ও সময়ও ব্যয় করছে। মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের সাথে যাদের এমন গাদ্দারী তারা কি তাঁর করুণা পেতে পারে? পায় কি জান্নাতের পথ? অথচ মহান নবীজী (সা:)’র সূন্নত হলো তিনি তাঁর কাজের শুরুটি নামাজ-রোজা দিয়ে শুরু না করে কুর’আন দিয়ে শুরু করেছিলেন। এবং সেরূপ করাই ছিল মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়েছে নবুয়তের প্রায় ১১ বছর পর, অথচ কুর’আন বুঝা শুরু হয়েছে নবুয়তের প্রথম দিন থেকেই। কারণ মুসলিম হওয়ার শুরুটি মূলত এখান থেকেই। কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা নিয়ে পূর্ণ মুসলিম হওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হলো সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণ। বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম দেশের ব্যর্থতার মূল কারণ তো এই অজ্ঞতা ও জাহিলিয়াত।          

 

ঈমানদারের আলামত ও বেঈমানের আলামত

হযরত ইমাম ইবনে কাইয়্যেম (রহ:) অতি জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “একজন মানুষ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কতটা প্রিয় -সেটি সে নিজেই জানতে পারে। সে জন্য তাকে দেখতে হবে, কি ধরনের কাজে সে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে।” মহা করুণাময় আল্লাহতায়ালার অনুমতি ছাড়া গাছের একটি মরা পাতাও ঝরে পড়ে না -এটিই হলো ঈমানদারের আক্বীদা। তেমনি তাঁর অনুমতি ছাড়া কোন ব্যক্তি কোন ভাল বা মন্দ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে না। কোন কাজে নিয়েত, প্রস্তুতি ও আত্মনিয়োগটি ব্যক্তির নিজের; কিন্তু সে কাজে সাফল্য আসে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। সে জান্নাত বা জাহান্নাম পায় তার নিয়েত, প্রস্তুতি ও আত্মনিয়োগের জন্য; সাফল্যের জন্য নয়। সাফল্য বা বিজয় আসে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। তাই বুঝতে হবে, যারা মহান রাব্বুল আলামীনের প্রিয় বান্দা তাদেরকে তিনি কখনোই জাহান্নামের পথে তথা দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকার সামর্থ্য দেন না। সে পাপ থেকে তিনি তাদেরকে নিজ করুণায় উদ্ধার করেন এবং সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর বহাল রাখেন। তাছাড়া সুরা বাকারার ২৫৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা:

ٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ يُخْرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ أَوْلِيَآؤُهُمُ ٱلطَّـٰغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ ٱلنُّورِ إِلَى ٱلظُّلُمَـٰتِ ۗ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلنَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَـٰلِدُونَ

অর্থ: “যারা ঈমান আনলো তাদের অভিভাবক হলো আল্লাহ, তাদেরকে তিনি অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নেন; এবং যারা কুফুরি করলো অর্থাৎ আল্লাহকে অস্বীকার করলো তাদের অভিভাবক হলো তাগুত (তথা শয়তান ও তার অনুসারীরা), তাদেরকে তারা আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নেয়। ঐসব লোকেরাই হলো জাহান্নামের বাসিন্দা, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে।” 

উপরিউক্ত আয়াতে ঈমানদারদের জন্য রয়েছে বিশাল সুখবর। সেটি হলো, তাদের অভিভাবক অন্য কেউ নন, বরং সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালা। তাঁর পক্ষ থেকে এ মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তিনি ঈমানদারদের জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে আসেন এবং পথ দেখান সিরাতাল মুস্তাকীমের। অর্থাৎ নিজ দায়িত্বে তিনি অসম্ভব করেন তাদের জন্য জাহান্নামের পথে চলা। এটিই হলো চুড়ান্ত বিজয়ের পথ। ঈমানদার হওয়ার এটিই হলো সবচেয়ে বড় সুফল। সে সাথে এ ঘোষণাও এসেছে, যারা বেঈমান তাদের চলতে হয়ে শয়তানের প্রদর্শিত জাহান্নামের পথে। সেটি পাপের পথ তথা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ। তারা ব্যর্থ হয় সিরাতাল মুস্তাকীম চিনতে ও সে পথে চলতে। বেঈমানদের জীবনে এটি হলো সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।  

তাই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ঈমানদার হওয়া। এবং সবচেয়ে ভয়ানক বিপর্যয়ের কারণ হলো বেঈমান হওয়া। তবে প্রশ্ন হলো, কারা সেই ঈমানদার? কারা বেঈমান? ঈমানদার হওয়ার অর্থ কি শুধু মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর নবী-রাসূল, তাঁর নাযিলকৃত কিতাব, ফিরেশতা, আখেরাত, জান্নাত ও জাহান্নামের ন্যায় বিষয়গুলিকে বিশ্বাস করা? লক্ষ লক্ষ সূদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যচারী, ব্যভিচারী, সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, স্বৈরাচারি ও নৃশংস ফ্যাসিস্টও মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে তাঁর কিতাব, ফিরেশতাকুল, আখেরাত, জান্নাত ও জাহান্নামের উপর। এরূপ বিশ্বাসের কারণে তারা কি আল্লাহতায়ালাকে পায় অভিভাবক রূপে? পায় কি তাঁর পক্ষ থেকে প্রটেকশন? প্রটেকশন যে পায় না -সে প্রমাণ তো অনেক। প্রটেকশন পেলে তারা কি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও স্বৈরাচারি রাজনীতির নেতা-কর্মী হয় কিরূপে?  শুধু বিশ্বাস করলেই কেউ ঈমানদার হয়না। বিশ্বাসের সাথে আমলও থাকতে হয়। সে আমল হলো মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বিধানকে বিজয়ী করা জিহাদ। যার মধ্যে সে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে তার ঈমানও নাই। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা হুজরাতে ১৫ নম্বর  আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ   

অর্থ: “মু’মিন তথা ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, অতঃপর আর কোন রূপ সন্দেহ পোষণ করে না; এবং নিজেদের সম্পদ ও জান দিয়ে জিহাদ করে আল্লাহর পথে তথা আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে, ঈমানের দাবীতে এই লোকগুলিই হলো সত্যবাদী।”   

ঈমানের দাবী যে কেউ করতে পারে না। কালেমায়ে শাহাদতও পাঠ করতে পারে। কিন্তু তাতে কেউ ঈমানদার হয়না। যারা মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন ও তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদে নাই -বুঝতে হবে তারা ঈমানদার নয়। কুর’আনে ঘোষিত তাঁর সে এজেন্ডাটি হলো, সকল ধর্ম ও সকল মতবাদের উপর ইসলামের বিজয়। কুর’আনের ভাষায় সে এজেন্ডা হলো, “লি’ইউয’হিরাহু অআলা দ্বীনি কুল্লিহি”। যারা সে জিহাদে নাই তারা বেঈমান ও পথভ্রষ্ট। তাদের নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাত তাদের ঈমানদার বানাতে পারেনা। নবীজী (সা:) পিছনে প্রথম কাতারে নামাজ পড়েও আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাই ঈমানদার হতে পারনি। তাদের ন্যায় পথভ্রষ্টদের প্রকৃত অভিভাবক হলো অভিশপ্ত শয়তান।

বেঈমানদের পথ দেখানোর দায়িত্ব কখনোই মহান আল্লাহতায়ালা নেন না। ফলে তাদের জন্য অসম্ভব হয় সিরাতাল মুস্তাকীম পাওয়া। এটিই বেঈমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় বঞ্চনা। সিরাতাল মুস্তাকীম পাওয়াটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় দান। সে সিরাতাল মুস্তাকীম পায়, একমাত্র সেই জান্নাত পায়। এজন্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া হলো, “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম” -যা নামাজের প্রতি রাকাতে করতে হয়। তাই যারা বেঈমান – সিরাতাল মুস্তাকীম দিয়ে তাদেরকে পুরস্কৃত করার প্রশ্নই উঠেনা। তবে বুঝতে হবে, শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন তেলাওয়াত, দোয়া-দরুদ, তাবলিগ, চিল্লাহ, গাশত, ইজতেমা নিয়ে বাঁচাটি সিরাতাল মুস্তাকীম নয়। এগুলি পালন করেও অনেকে পথ হারায় এবং বেছে নেয় জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, গোত্রবাদ, স্বৈরাচার, রাজতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের ন্যায় হারাম মতবাদের অন্ধ গলি পথ। এরাই হলো তারা -যারা ক্ষমতা পেলে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন ও তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ডাকে বিজয়ী করার বদলে সেগুলিকে পরাজিত করে রাখে। বাংলাদেশসহ প্রতিটি মুসলিম দেশে জাহান্নামের এমন অন্ধকার পথে চলা লোকদের সংখ্যাটি বিশাল। এদের কারণেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি ইসলামী রাষ্ট্র।

সিরাতাল মুস্তাকীম চেনার সামর্থ্যটিই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সামর্থ্য। জ্ঞানলাভ বা জ্ঞানদানের মূল লক্ষ্য হলো, ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে সে সামর্থ্য সৃষ্টি করা। তাতে ব্যর্থ হলে, ব্যর্থ হয় পুরা শিক্ষাব্যবস্থা। সিরাতাল মুস্তাকীম চিনতে হলে, যেমন কুর’আন বুঝতে হয়, তেমনি শিক্ষা নিতে হয় নবীজী (সা:)’র জীবন থেকে। নবীজী (সা:)’র জীবন হলো পবিত্র কুর’আনের শো-কেস -অর্থাৎ কুর’আন দেখা যায় নবীজী (সা:)’র জীবনের দিকে তাকালে। তাই মহান আল্লাহতায়ালার কি ধরণের মানুষ চান -তারই নমুনা হলেন নবীজী (সা:) । সিরাতাল মুস্তাকীম কাকে বলে -সেটি নবীজী (সা:) স্বয়ং সে পথে চলে মানব জাতির সামনে সুস্পষ্ট করে গেছেন। সে পথে নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন শিক্ষা, দোয়া-দরুদ এবং দ্বীনের তাবলিগ যেমন আছে, তেমনি আছে হিজরত, আছে প্যান-ইসলামিক একতা এবং আছে দুর্বৃত্ত শক্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। আছে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। যারা কুর’আন বুঝেনি এবং নবীজী (সা:)’র জীবনীও পাঠ করেনি -তাদের পক্ষে সিরাতাল মুস্তাকীম চেনা এবং সে পথে চলা অসম্ভব। এজন্যই মুসলিমকে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ফরজ পালন করলে চলেনা, পালন করতে জ্ঞানার্জনের ফরজও। সেটি যেমন কুর’আন থেকে তেমনি নবীজী (সা:)’র জীবন থেকে। এজন্যই জ্ঞানার্জনকে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার সর্বপ্রথম ফরজ করেছিলেন। অথচ এক্ষেত্রেই মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এবং অন্য সকল ব্যর্থতার জন্ম জ্ঞানার্জনের ব্যর্থতা থেকে।

যে ব্যক্তির জীবন চলে চুরি-ডাকাতি, ভোটডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্র, সন্ত্রাস, সেক্যুলার রাজনীতি, ধর্মব্যবসা, ওয়াজ ব্যবসা, কম্যুনিজম ও জাতীয়তাবাদের পথে -বুঝতে হবে তার ব্যর্থতাটি করুণাময় মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ায়। এরা প্রিয়তর হয় শয়তান ও তার পৌত্তলিক, নাস্তিক ও জালিম খলিফার কাছে। মহান রাব্বুল আলামীন এমন ব্যক্তিদের গলার রশি ঢিল করে দেন। এমন ব্যক্তিরাই দেশে দেশে শয়তানের সৈনিক হয় এবং ছুটে চলে জাহান্নামের দিকে। তারা যদি নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করে, বুঝতে হবে, সেটি নিছক প্রতারণা। এরাই হলো মুনাফিক। অথচ মুসলিম দেশগুলি আজ এদের হাতেই অধিকৃত। তারাই মুসলিম দেশে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে রেখেছে। এবং বিলুপ্ত করে রেখেছে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এরাই হলো সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি।

অপর দিকে যে ব্যক্তির ব্যস্ততা পবিত্র কুর’আন বুঝা এবং মানুষের কাছে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান পৌঁছিয়ে দেয়ায় -বুঝতে হবে তাঁর উপর রয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার অসীম রহমত। বেঈমানের বিপুল ধন-সম্পদ ও বহু সন্তান-সন্ততি থাকতে পারে, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতটি সে পায়না। সে নেয়ামতটি হলো জান্নাতের পথ। বেঈমানদের ছুটতে হয় জাহান্নামের দিকে। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সেটিই হলো তাদের জন্য আযাব। এবং অন্তহীন আযাব রয়েছে জাহান্নামে। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বান্দাকে সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি দেন। সেটি হলো তাঁর সার্বভৌমত্ব, তাঁর শরিয়তী আইন এবং অন্যায়ের নির্মূল ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জিহাদে সম্মানিত সৈনিকের। তাদেরকে দেন শহীদের মর্যাদা। এ পবিত্র জিহাদে তিনি কখনোই মুসলিম নামধারী মিথ্যাবাদী, সূদখোর, ঘুষখোর, মদখোর, ব্যভিচারী, জাতীয়তাবাদী, সোসালিস্ট, কম্যুনিস্ট, সেক্যুলারিস্টদের নিয়োগ দেন না। ধর্মের লেবাসধারী মুনাফিকদের কখনোই জিহাদের ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে শামিল হওয়ার সুযোগ দেন না।  

 

উৎসব যেখানে ব্যর্থতা নিয়ে

একটি দেশ ব্যর্থ হয় সে দেশের ভূমি, আলো-বাতাস ও জলবায়ুর ব্যর্থতার কারণে নয়, বরং সেটি জনগণের ব্যর্থতার জন্য। কারণ, দেশ গঠিত হয় জনগণকে নিয়ে, জীবজন্তু, গাছপালা ও আলো-বাতাস নিয়ে নয়। পাকিস্তান ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। বেঁচে থাকলে আজ দেশটি গণ্য হতো চীন ও ভারতের পরই পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র রূপে। এদেশটি ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশাল নেয়ামত -যা জুটেছিল ২৭ রমজানের রাতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙ্গে গিয়ে প্রমাণ করলো, এ রাষ্ট্রের সরকার ও জনগণ কতটা ব্যর্থ, অযোগ্য ও অঙ্গীকারহীন এ বিশাল আমানতের হেফাজতে। অথ্চ এ ব্যর্থতা নিয়ে বাঙালি মুসলিমের কত উৎসব! ১৬ ডিসেম্বর এলে সে উৎসব হয় ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সাথে। যারা এভাবে কাফিরদের বিজয় ও উৎসব বাড়ায় তারা কি মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করতে পারে?

১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠা পাায় তখন উপমহাদেশের মুসলিমদের স্লোগান ছিল: “পাকিস্তান কা মতলব কিয়া? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। এর অর্থ: পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা পাবে একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব; এবং দেশটির আদালতে চলবে একমাত্র তাঁরই আইন। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে বিশাল গাদ্দারীট হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে কৃত সে ওয়াদার সাথে। তবে পাকিস্তানের সে ব্যর্থতা ও অপরাধের বড় ভাগীদার হলো বাঙালি মুসলিমগণ; কারণ তারাই ছিল দেশটির জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ  তাদের অপরাধ, তারা এ দেশটির প্রতিরক্ষায় না নেমে পাকিস্তানের চিরশত্রু হিন্দুত্ববাদী ভারতের সাথে মিলে ধ্বংসে নেমেছে। বিজয় তুলে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী কাফিরদের শিবিরে। মুসলিম উম্মাহর সাড়ে চৌদ্দশত ইতিহাসে মুসলিমগণ কি কখনো পৌত্তলিকদের ঘরে এরূপ  কোন বিজয় তুলে দিয়েছে? একাজ একমাত্র বাঙালি মুসলিমের। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এ নিয়ে বাঙালি মুসলিমদের বহু শত বছর পরও অপরাধীর কাটগড়ায় তোলা হবে। এবং ঘৃণা কুড়াতে হবে।

কাফিরদের ঘরে বিজয় তুলে দেয়া দূরে থাক, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করাকে মহান আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন -এ বিষয়ে কড়া নির্দেশ এসেছে সুরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর আয়াতে এবং সুরা মুমতেহানার ১ নম্বর আয়াতে। কারণ, এটি মুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের বিষয়। এভাবে মহান আল্লাহতায়ালা গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন মুসলিম উম্মাহর এসব ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়েও। এ বিষয়ে মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে অধিক আর কে জানে? স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে দেশের ভূগোলকে বাঁচাতে হয়। এবং সম্ভব হলে সে ভূগোলে বৃদ্ধি আনতে হয়। তাই মুসলিম দেশের ভূগোল বৃদ্ধির প্রতিটি যুদ্ধকে পবিত্র ইবাদত তথা জিহাদ বলা হয়। খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া খেলাফত, আব্বাসীয়া খেলাফত ও উসমানিয়া খেলাফতের খলিফাগণ তো সে নীতিকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। তাদের সে নীতির ফলে মুসলিমগণ তখন বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছে। হারাম হলো মুসলিম দেশকে ক্ষুদ্রতর করা। কারণ ভূগোল ক্ষুদ্রতর হলে বিপন্ন হয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা। তখন আনন্দ বাড়ে শত্রু শিবিরে। বাঙালি মুসলিমদের গুরতর অপরাধ হলো, তারা পৌত্তলিক ভারতের সাথে মিলে পাকিস্তান ভেঙ্গেছে এবং মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করেছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল -সে উদ্দেশ্যকেই তারা ব্যর্থ করে দিয়েছে। তাই একাত্তরের যুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী ভারতের বিজয় নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলারিস্ট, কম্যুনিস্ট ও নাস্তিক মহলে যতই উৎসব হোক, যার মাঝে সামান্যতম ঈমান আছে – সে কি কখনো উৎসব করতে পারে? পাকিস্তান আজ বেঁচে থাকলে ৪৪ কোটি জনসংখ্যার পারমানবিক অস্ত্রধারী এই বিশাল দেশটি ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা ও কাশ্মীরীদের পাশে শক্ত ভাবে দাঁড়াতে পারতো।  বাঙালি মুসলিম পেত বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলার। কিন্তু ভারতসেবী বাঙালি কাপালিকগণ সে স্বপ্ন ব্যর্থ করে দিয়েছে।    

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে উপমহাদেশের মুসলিমদের মনে জোয়ারটি ছিল প্যান-ইসলামিক চেতনার। ফলে ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা এবং ভৌগলিক দূরত্ব তাদের মধ্যে বিভক্তি গড়েনি। তখন নানা ভাষী ও নানা প্রদেশের পাকিস্তানীদের মাঝে সিমেন্ট লাগানোর কাজটি করেছে ইসলাম। কিন্তু ১৯৭১’য়ে জোয়ারটি ছিল সেক্যুলারিজম, বর্ণবাদ, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী ফিতনার। এ জাহিলী মতবাদগুলি পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ইসলামী এজেন্ডাকে বিজয়ী করার রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি থেকে দূরে সরায় এবং কেড়ে নিয়ে প্যান-ইসলামিক চেতনার সিমেন্ট। খাড়া করে হিন্দুত্ববাদীদের শিবিরে। তীব্রতর করা হয় বাঙালি ও অবাঙালি মুসলিমদের মাঝে ঘৃণা ও মনের দূরত্ব -যা পরবর্তীতে বিভক্ত করে পাকিস্তানকে। সে মনের দূরত্বকে তীব্রতর করেছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামরিক বাহিনীর স্বৈরশাসন ও দুর্বৃত্তি।  কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের এজেন্ডায় স্বৈরাচার, দুর্বৃত্তি ও বৈষম্যের নির্মূল গুরুত্ব পায়নি, বরং গুরুত্ব পেয়েছিল সে স্বৈরাচার ও বৈষম্যকে বাহানা বানিয়ে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করা। পাকিস্তান ভাঙ্গার পর তারা নিজেরাই অধিক স্বৈরাচারী, অধিক জালেম ও অধিক দুর্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রের দাবী তুললেও বাংলাদেশ হওয়ার পর তারাই গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে দেয় এবং এক দলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা দেয়।                                                                         

ঈমানদারকে শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তেলাওয়াত নিয়ে বাঁচলে চলেনা। তাকে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, স্বাধীনতা ও নিরপত্তা নিয়েও ভাবতে হয়। শুধু  ভাবলেই চলে না,  সে ভাবনাগুলি নিয়ে জিহাদেও নামতে হয়। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের জীবনে যেমন সে ভাবনা দেখা গেছে, তেমনি জিহাদও দেখা গেছে। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ সে ভাবনা নিয়ে বাঁচে না, সে জিহাদ নিয়েও বাঁচে না। চেতনা থেকে সে ভাবনা এবং কর্ম থেকে জিহাদ বিলুপ্ত হলে, সে ব্যক্তি আর মুসলিম থাকে না। খেফাফত ভেঙ্গে মুসলিম ভূমি টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও সে ভাবনাশূণ্য ব্যক্তিটির হৃদয়ে কোন মাতম হয়না। বরং বিভক্তি নিয়ে সে উৎসব করে। এবং উৎসব হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতেও। এটি ঈমানদারীর লক্ষণ নয়। একটি মুসলিম জনগোষ্ঠি ইসলাম থেকে কতটা দূরে সরেছে -এ হলো তারই দলিল।   

 

পুরস্কৃত হয় কি মুনাফিকি?

যেদেশে মুসলিমদের বসবাস, সেদেশে শুধু শয়তানের অনুসারীদের জীবনেই যুদ্ধ থাকে না, যুদ্ধ থাকে প্রতিটি মুমিনের জীবনেও। মুমিনের   সে অবিরাম যুদ্ধটিই হলো জিহাদ। নামাজ-রোজা ছাড়লে কেউ মুসলিম থাকে না। তেমনি জিহাদ ছাড়লে কেউ মুসলিম থাকে না। তাই নবীজী (সা:)‌’র পিছনে নামাজ পড়েও মুসলিম হতে পারিনি আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার তিনশত সাথী।  প্রশ্ন হলো, দেশ যখন হিন্দুত্ববাদের সেবকদের হাতে অধিকৃত, শরিয়ত এমন দেশে যেদেশে বিলুপ্ত এবং যুদ্ধ যেদেশে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে -সেদেশের মুসলিমদের জীবনে জিহাদ থাকবে না -সেটি কি ভাবা যায়? জিহাদের আযান দেন  মহান আল্লাহতায়ালার। পবিত্র কুর’আনে ছত্রে ছত্রে সে আযান।  পবিত্র কুর’আনে মাহে রমযানের রোজার হুকুম দিয়েছেন মাত্র একবার, কিন্তু জিহাদের হুকুম এসেছে অসংখ্যবার। নবীজী (সা:)‌’র যুগে জিহাদের আযানে সাড়া দেননি -এমন মুসলিম একজনও ছিল না। অথচ আজ মুসলিম দেশ থেকে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন বিলুপ্ত করা হলেও জিহাদের আযানে সাড়া দেয়ার জন্য মুসলিম নাই। মুসলিমগণ বাঁচছে পূর্ণ ইসলাম পালন ছাড়াই। ফলে ১৫০ কোটি মুসলিম ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা দিতে।

কোন ঈমানদার কি নিজ দেশে ইসলামের শত্রুশক্তির শাসন মেনে নেয়? মেনে নেয় কি শরিয়তের বিলুপ্তি? মেনে নেয় কি বর্ণ, ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি? মেনে নেয় কি জিহাদের বিলুপ্তি? এগুলি মেনে নেয়ার অর্থ তো ইসলামের বিলুপ্তিকে মেনে নেয়া। এমন আত্মসমর্পণ নিয়ে বাঁচা কখনোই কোন ঈমানদারের মিশন হতে পারে না। কোন মুসলিম ভূমি ইসলামের শক্তির হাতে অধিকৃত হলে সে অধিকৃতি থেকে মুক্তির জন্য মুসলিম জীবনে জিহাদ আসবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু বাঙালি মুসলিমের জীবনে কোথায় সে জিহাদ? কোথায় সে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের তাড়না? সেরূপ একটি প্রবল তাড়না না থাকলে বুঝতে হবে, আগ্রহ নাই মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করায়। তখন বুঝতে হবে, বাঁচতে চায় বিদ্যমান পরাজয় নিয়ে। প্রশ্ন হলো, যারা বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের পরাজয় মেনে নিয়ে, তারা কি তাঁর নিকট থেকে কোন রূপ প্রতিদান আশা করতে পারে?

 

জালেম শাসক ও তার বেঈমান সৈনিকদের জীবনেও রক্তাক্ত যুদ্ধ থাকে। সেসব যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সৈনিক প্রাণ দেয়। ইতিহাস এমন যুদ্ধের বিবরণে পরিপূর্ণ। এভাবে তারা প্রমাণ করে, এইসব বেঈমানদের জীবনে তাদের নিজ বিশ্বাস ও এজেন্ডার সাথে মুনাফিকি নাই। তারা যা বিশ্বাস করে সেটিকে বিজয়ী করতে যুদ্ধ করে এবং সে যুদ্ধে বিপুল সংখ্যায় প্রাণদানও করে।  এজন্যই বেঈমানগণ দেশে দেশে বিজয়ী। অথচ প্রতিদান রূপে তারা যা পায় -তা অতি সামান্য। পরকালে তারা যাবে নিশ্চিত জাহান্নামের আগুনে। কিন্তু যারা অনন্ত-অসীম কালের জন্য জান্নাত পেতে চায় -তাদের জীবনে নিজ বিশ্বাসের সাথে ঈমানদারী কই? ঈমানদারী থাকলে তো আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ এবং সে জিহাদে কুরবানী দেখা যেত -যেমন দেখা গেছে নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের জীবনে। ঈমানদার হওয়ার অর্থ তো নিজের জীবন ও সম্পদকে জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রয় করে দেয়ার। সে বিক্রয়নামার কথা বলা হয়েছে সুরা তাওবার ১১১ নম্বর আয়াতে। এবং যারা নিজের জীবনকে বিক্রয় করে জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জন্য জিহাদের নির্দেশ এসেছে সুরা নিসার ৭৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

 

۞ فَلْيُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يَشْرُونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا بِٱلْـَٔاخِرَةِ ۚ وَمَن يُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًۭا

 

অর্থ: “অতএব যারা দুনিয়ার জীবনকে বিক্রয় করেছে আখেরাতের বিনিময়ে -তাদের অবশ্যই আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা উচিত। এবং যে যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, অতঃপর সে যুদ্ধে নিহত হয় অথবা বিজয়ী হয় – শ্রীঘ্রই আমি তাদের বিরাট পুরস্কার দিব।”

 

এখন প্রশ্ন হলো, যারা নিজেদের পেশ করে ঈমানদার রূপে -তাদের জীবনে জান্নাতের বিনিময়ে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ কই? তারা কি তবে বাঁচছে, মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মুনাফিকি নিয়ে? আল্লাহতায়ালা কি কখনো মুনাফিকদের বিজয় দেন? পবিত্র কুর’আনে মুনাফিকদের কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলা হয়েছে। কাফিরদের চেয়েও অধিকতর কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি রয়েছে তো তাদের জন্য । জাহান্নামে তাদের অবস্থানটি হবে সবচেয়ে ভয়ংকরতম স্থানে। দুনিয়াতেও কি মুনাফিকদের অবস্থান কাফিরদের চেয়ে উত্তম হতে পারে? উত্তম যে নয়, তার প্রমাণ তো তারা নিজেরাই। তারা বাঁচছে গোলামী, অপমান, ধ্বংস ও  আযাব নিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *