রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব

ফিরোজ মাহবুব কামাল

জনগণের দায় এবং অপরাধের আযাব

গাড়ি গর্তে পড়ে এবং নিরীহ যাত্রীদের মৃত্যু ঘটে অযোগ্য চালকের কারণে। ফলে প্রতিটি দায়িত্বশীল সরকারের গুরু দায়িত্বটি হয় যাতে অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স না যায় -সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। বিষয়টি অবিকল জাতির বেলায়ও। চাষাবাদ, শিল্প, পশুপালন, গৃহনির্মাণ বা ব্যবসাবাণিজ্যে ব্যর্থতার কারণে কোন জাতিই ধ্বংস হয় না। সে ব্যর্থ্যতায় দারিদ্র্য আসলেও ভয়াবহ আযাব আসে না। জাতির জীবনে আযাব আসে এবং ধ্বংস হয়, নেতার আসনে আল্লাহতায়ালার অবাধ্য কোন দুর্বৃত্তকে বসালে। ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তকে যারা নেতা ও খোদা বানিয়েছিল এবং তার পক্ষে অস্ত্র ধরেছিল -তারা মিশরবাসীকে কোন কল্যাণ দেয়নি। ফিরাউনের অপরাধের সাথে মিশরবাসীদের অপরাধ তখন একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাদের সে অপরাধ মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ভয়াবহ আযাবকে সেদিন অনিবার্য করে তুলেছিল।  সে আযাব শুধু ফিরাউনের উপর আসেনি, মিশরবাসীর উপরও এসেছে। বাঙালি মুসলিমগণও একই রূপ গুরুতর অপরাধ করেছে মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের শত্রু, ভারতের বেতনভুক দালাল, নৃশংস ফাসিস্ট, চোর-ডাকাতদের লালনকর্তা এবং ইসলামের ঘোরতর দুশমনকে নেতা, পিতা ও বন্ধুর আসনে বসিয়ে। ফলে প্রতিশ্রুত আযাব এসেছে বাঙালি মুসলিম জীবনে। সেটি এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, বিশ্বজুড়া তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি হওয়ার অপমান ও হাজার হাজার মানুষের জীবনে নির্যাতন ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের দায়ভারটি বিশাল। জনগণের ঈমান, যোগ্যতা ও বিবেকের পরীক্ষাটি হয় নেতা নির্বাচনের সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র দেয় সুযোগ্য নেতা নির্বাচন করে কল্যাণের পথে চলার বিশাল সুযোগ। সে সুযোগ করে দেয় দুর্বৃত্ত নেতা নির্বাচন করে আযাব ডেকে আনারও। ফলে গণতান্ত্রিক দেশে আযাবের জন্য শুধু দুর্বৃত্ত সরকারই দায়ী নয়, দায়ী তারাও যারা সে দুর্বৃত্তদের নির্বাচিত করে। একটি জাতি কতটা অযোগ্য ও বেঈমান -সেটি যাচাইয়ের জন্য তাই জরিপের প্রয়োজন পড়ে না; সেটি নির্ভূল ভাবে বুঝা যায় সেদেশের দুর্বৃত্ত শাসককে দেখে। ঈমানদারদের স্বভাব হলো, তারা কখনোই দুর্বৃত্ত শাসককে মেনে নেয় না। গ্রামে হিংস্র পশু ঢুকলে গ্রামবাসী যেমন একতাবদ্ধ হয়ে সেটিকে হত্যা করে, তেমনি একতাবদ্ধ হয়ে নির্মূল করে জালেম শাসককে। সে রকম একটি লড়াই জালেম শাসকের বিরুদ্ধে না থাকলে বুঝতে হবে জনগণের মাঝে বিবেকবোধ, বিচারবোধ ও ঈমানের প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। গরু-ছাগল বাঘ তাড়ায় না, বরং বাঘের হাতে নিহত হওয়াই তাদের রীতি। তেমনি পশু-সুলভ কাপুরুষগণ জালেমের শাসকের বিরুদ্ধে খাড়া হয়না; বরং সে শাসন নীরবে মেনে নেয়।

 

নির্বাচন পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়

একটি দেশের সাধারণ নির্বাচন জনগণের জন্য কঠিন পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়। তখন পরীক্ষা হয় ভোটারের বিবেকবোধ, বিচারবোধ ও ঈমানের। সে পরীক্ষায় তো তারাই পাশ করে যারা সাক্ষ্য দেয় সত্য ও ন্যায়-পরায়ন ব্যক্তির পক্ষে। এবং ভোট দেয় মিথ্যা ও দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে। দেশের অধিকাংশ মানুষ এক্ষেত্রে ভূল করলে দেশবাসীর  ভাগ নির্ধারিত হয় দুর্বৃত্তদের দ্বারা। তখন রাষ্ট্রের ড্রাইভিং সিটে বসে ক্ষমতালোভীরা। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে বাঙালি মুসলিমগণ সে ভূলটিই করেছে। অথচ তখনও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে মুজিবের চেয়ে বহুগুণ বেশী সৎ ও যোগ্য মানুষ ছিল। কিন্তু বাঙালি মুসলিম তাদের ভোট দেয়নি।  তারা বিপুল ভোটে বিজয়ী করছে মুজিবের ন্যায় হিন্দুত্ববাদের দালাল, গণতন্ত্রের খুনি, নৃশংস ফ্যাসিস্ট, ইসলামের পরীক্ষিত শত্রু এবং দুর্বৃত্তদের লালনকর্তাকে। এমন অপরাধের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভূলের দায় পরিশোধ করতে হয়। নিজের ক্ষমতালাভকে নিশ্চিত করতে মুজিব একাত্তরের যুদ্ধকে অনিবার্য করে এবং ভারতের ন্যায় চিহ্নিত শত্রুকে দেশের ভিতরে ডেকে আনে।

 

জনগণ ভূল করে এবং আযাব অনিবার্য করে

জনগণও দলবদ্ধ ভাবে ভূল করে এবং ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনে। সে ভূলের পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ ও প্রাণনাশী হতে পারে তারই দুটি উজ্বল দৃষ্টান্ত হলো হিটলারের আমলের জার্মানী এবং মুজিব-হাসিনা আমলের বাংলাদেশ। হিটলারের ন্যায় এক ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তকে নির্বাচিত করে জার্মান জাতি তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদটি ডেকে এনেছিল। তাতে জার্মান জনগণকে একটি বিশ্বযুদ্ধের আযাবে পড়তে হয়েছে এবং তাতে মৃত্যু ঘটেছে প্রায় ৮০ লক্ষ জার্মানীর। ধ্বংস হয়েছে দেশটি বহু লক্ষ ঘরবাড়ী ও শিল্প কারখানা। তেমনি বাংলাদেশীগণ ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবের মত একজন ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তকে নির্বাচিত করে ভয়াবহ যুদ্ধ ডেকে এনেছে। এতে হাজার হাজার বাঙালি-অবাঙালির জীবনে মৃত্যু এসেছে। বহু লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। বহু বাঙালি-অবাঙালি নারী ধর্ষিতা হয়েছে। এতে এসেছে আগ্রাসী হিন্দু ভারতের গোলামী। এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এসেছে বহু লক্ষ মানুষের জীবনে অনাহারের দুর্বিসহ যাতনা এবং মৃত্যু।

গণতন্ত্রের কথা বলে মুজিব প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল ফেরাউনী মডেলের এক দল-এক নেতার বাকশালী স্বৈরাচার। গণতন্ত্রকে পাঠিয়েছিল কবরস্থানে। কেড়ে নিয়েছিল কথা বলার স্বাধীনতা। বিদ্রোহী জনগণকে নিয়ন্ত্রনে আনতে দেশব্যাপী দাবড়িয়ে দিয়েছিল নৃশংস রক্ষিবাহিনী। তাতে নিহত হয়েছিল প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ -পাকিস্তানের এই প্রথম ২৩ বছরের রাজনীতিতে মুজিব বিজয় পায়নি; ফলে বাঙালি জীবনে এতোবড় বিপর্যয় আসেনি।

বাংলাদেশের মানুষ একই রূপ ভূল করেছে ২০০৮ সালে হাসিনার ন্যায় ভোট-ডাকাত স্বৈরাচারীকে নির্বাচিত করে। সে ভূলের কারণে জনগণ হারিয়েছে ভোটের অধিকার। গণতন্ত্র গেছে নির্বাসনে। এবং পেয়েছে চুরিডাকাতি, ভোট-ডাকাতি, গুম-খুন-ধর্ষণ এবং ফাঁসির রাজনীতি। জনগণের রাজস্বের অর্থ এবং প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় হয়েছে শেখ হাসিনার বিশাল ডাকাত দলের প্রতিপালনে। 

 

কে নেতা হওয়ার যোগ্য এবং কে পরিত্যাজ্য?

বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এমন একটি দেশে কে নেতা হওয়ার জন্য যোগ্য বা অযোগ্য –সে বিষয়ে বিচারের মানদন্ডটি যে কোন অমুসলিম দেশ থেকে ভিন্নতর। কারণ, মুসলিম দেশ এবং অমুসলিম দেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চরিত্র এবং লক্ষ্য যেমন এক নয়, তেমনি এক নয় উভয় দেশের নেতার উপর অর্পিত দায়ভারও। এমন একটি ভিন্নতার কারণেই ১৯৪৭ সালে বাঙালি মুসলিমগণ গান্ধি বা নেহেরুর ন্যায় হিন্দুদেরকে নেতা রূপে গ্রহণ করেনি। তারা অবাঙালি মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে নেতা রূপে বরণ করেছিল এবং পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। বাঙালি মুসলিমদের সে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা আজও বিলুপ্ত হয়নি। এবং ভবিষ্যতেও সেটি বিলুপ্ত হওয়ার নয়। এমন একটি মুসলিম দেশের নেতাকে শুধু বাঙালি হলে চলে না, তাকে তার রাজনীতিতে দেশটির মুসলিম জনগণের বিশ্বাস ও আশা-আকাঙ্খারও প্রতিফলন ঘটাতে হয়। সে প্রতিফলনটি ঘটানোর কারণে মহম্মদ আলী জিন্নাহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের কাছে কায়েদে আজম হতে পেরেছিলেন।

মুজিব-হাসিনার রাজনীতির ব্যর্থতাটি বিশাল। তাদের রাজনীতিতে যে বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে সেটি হলো চরম ক্ষমতালিপ্সা ও ভারতীয় এজেন্ডা পূরণের রাজনীতি। মুজিবের রাজনীতিতে গুরুত্ব পেয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্রকে বিজয়ী করা রাজনীতি। সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে ১৯৭১’য়ে। মুজিবের সে রাজনীতিতে গণতন্ত্র ও বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নপূরণ কখনোই স্থান পায়নি। বরং সেগুলি স্থান পেয়েছে কবরে। মুজিবের সে গণবিরোধী রাজনীতি এতোটাই ঘৃণা কুড়িয়েছিল যে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাকে বিরোধীদলের রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল। এবং চালু করতে হয়েছিল একদলীয় বাকশালী রাজনীতিকে। সে সাথে নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল সকল বিরোধী দলীয় পত্র-পত্রিকা এবং মিটিং-মিছিলকে। হাসিনাকেও মুজিবের পথ ধরতে হয়েছিল। গদীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেতাদের গুম, খুন ও ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। এবং ভোটের বাক্সের উপর ডাকাতি করেছে। প্রশ্ন হলো, এমন দুর্বৃত্ত ডাকাতগণ কি কোন সভ্য দেশের নেতা হতে পারে? সেটি তো কোন ডাকাত সর্দারকে মসজিদের ইমাম বানানোর মত। সভ্য দেশে এমন চোর-ডাকাতদের স্থান হয় কারাগারে।

 

আবারো কি বিজয়ী করবে কবিরা গুনাহর রাজনীতিকে?

পবিত্র ক্বাবার ইমামের চেয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের শাসককে অধিকতর ঈমানদার ও যোগ্যবান হতে হয়। সেটির প্রমাণ, হযরত আবু বকর  (রা:), হযরত উমর (রা:), হযরত  উসমান (রা:) ও হযরত আলী (রা:)’র ন্যায় খলিফাগণ অধিক ঈমানদার ও যোগ্য ছিলেন ক্বাবার ইমামের চেয়ে। তারাই মুসলিম ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র।  ক্বাবার ইমামের ভূলে কিছু লোকের নামাজে ক্ষতি হয়, কিন্তু তাতে জাতি শত্রুর হাতে পরাজিত ও অধিকৃত হয়না। কিন্তু সে ভয়ানক ক্ষতিটি হয় রাষ্ট্রের শাসক অযোগ্য ও বেঈমান হলে। তারই প্রমাণ শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা।

বুঝতে হবে, শাসকের স্থানে বসেছেন খোদ নবীজী (সা:)। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ বিপুল ভোট দিয়ে সে আসনে বসিয়েছে মুজিব ও হাসিনার ন্যায় ইসলামের জঘন্য শত্রু, দুর্বৃত্ত ও হিন্দুত্ববাদের দালালকে। এসবই ঘটেছে মহান আল্লাহতায়ালার রাডারের নীচে। দেশে লাখ লাখ মসজিদ নির্মাণ করে কি এতবড় পাপ থেকে মুক্তি মেলে? বাঙালি মুসলিমগণ কি তাদের অতীতের ঐতিহাসিক পাপগুলি  নিয়ে ভাববে না? সে ভূল থেকে কি শিক্ষা নিবে না? তারা কি সে ভাবনাশূণ্যতা নিয়ে আগামী নির্বাচনে আবারো ভয়ানক পাপ করতে যাচ্ছে ইসলামের চিহ্নিত সেক্যুলার শত্রুদের নির্বাচিত করে?  

বুঝতে হবে,  রাজনীতি হলো ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ। তাই এটি ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাজনীতিতে সেক্যুলার হওয়ার অর্থই হলো ইসলামের পক্ষ পরিত্যাগ করা। সেক্যুলারিস্টগণ যে ইসলামের পক্ষে নয় -সে কথাটি তারা প্রকাশ্যেই বলে। তারা মুসলিম পরিচিতি নিয়ে রাজনীতি করতে রাজী নয়। তারা রাজনীতি করতে চায় মুসলিম পরিচয়টি বর্জন করেই। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, তাকে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিসহ সর্বত্র ইসলামের পরিচয় বহন করতে হয়। আমৃত্যু তাকে ইসলামের পক্ষে খাড়া হতে হয়, প্রয়োজনে যুদ্ধও করতে হয়। এটি ঈমানদার হওয়ার শর্ত। জান্নাতে যেতে হলে ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদে অবশ্যই থাকতে হবে।  কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের কাছে জিহাদ হলো সন্ত্রাস। তারা তাই সে পথে নেই। সেক্যুলারিস্টগণ তাই কখনোই ইসলামের বন্ধু হতে পারে না। এরাই ইসলামের শত্রু পক্ষ। রাজনীতির অঙ্গণে ইসলামকে পরাজিত ও পরিত্যক্ত রাখাই তাদের নীতি। তাই সেক্যুলারিস্টদের রাজনীতিতে শয়তান খুশি হয়। এদের ভোট দেয়ার অর্থ তাই শয়তানকে বিজয়ী করা। এদের রাজনীতি তাই কবিরা গুনাহর রাজনীতি। বাঙালি মুসলিমগণ কি আবারো সেই কবিরা গুনাহর রাজনীতিকেই বিজয়ী করবে?  ১৬/১২/২০২৪    

                                                                                                                 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *