রাজাকারের দর্শন ও একাত্তরের সেক্যুলারিস্ট ব্যাখ্যা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 3, 2020
- Bangla Articles, বাংলাদেশ
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
যে দুর্বৃত্তিটি ইতিহাস রচনায়
দুর্বৃত্তি, সন্ত্রাস ও ধোকাবাজী শুধু বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতিকেই গ্রাস করেনি, সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তিটি হয়েছে দেশটির ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে। যে দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কীর্তিটি হলো দেশটিকে বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের মাঝে দুর্বৃত্তিতে পাঁচবার প্রথম স্থানে পৌঁছে দেয়া, সে দেশে ইতিহাস রচনায় সততা ও সুবিচার স্থান পাবে সেটি কি আশা করা যায়? বরং ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো অতি ভয়ংকর দুর্বৃত্তদের মিথ্যা কাহিনীতে পূর্ণ হবে -সেটিই কি কাঙ্খিত নয়? মহান নবীজী (সাঃ)র হাদীসঃ “মিথ্যাচারিতা হলো সকল পাপের মা”। আর প্রতিটি দুর্নীতিই তো পাপ। ফলে যেখানে প্রচণ্ড দুর্নীতি বা দুর্বৃত্তি আছে, বুঝতে হবে সেখানে প্রচণ্ড মিথ্যাচারও আছে। এবং মিথ্যার জরায়ু যেখানে যত বিশাল,ততই বিশাল আকারে প্রসব হয় দুর্নীতি ও পাপাচার। বাংলাদেশ দুর্নীতিতে যেভাবে ৫ বার বিশ্বের প্রথমস্থান অধিকার করেছে সেটি তো দুর্নীতির জরায়ু অতি বিশাল হওয়ার কারণেই। সে মিথ্যাচারিতারই স্বাক্ষর হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের বই। আলোচ্য নিবদ্ধে সে ভয়ংকর মিথ্যাচারিতার কিছু উদাহরণ পেশ করা হবে।
মিথ্যুকদের জন্য আল্লাহতায়ালার শাস্তিটাও যে অতি ভয়ানক -সে প্রমাণও কি কম। মিথ্যার সাথে আযাবও আসে -সে হুশিয়ারিটা তো মহান আল্লাহর।মিথ্যুকদের দেশ মাত্রই তাই আযাবের দেশ। অতীতে মিথ্যুকদের সাথে আল্লাহতায়ালার আচরণটি কীরূপ ছিল তা থেকে তাই শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বহুবার বলা হয়েছে,“ফাসিরু ফিল আরদ, ফানজুর কাইফা কানা আ’কিবাতুল মোকাজ্জীবীন” অর্থঃ “অতঃপর তোমরা পৃথিবী ভ্রমন কর এবং দেখ যারা মিথ্যুক ছিল তাদের পরিণতিটি কি হয়েছিল”।প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি আযাব কম? ফিরাউন-নমরুদ-হিটলার-মুজিব-হাসীনাদের স্বৈরাচারি শাসন নিজেই তো মহাআযাব।এমন আযাবে মানুষ সভ্য ভাবে বাঁচবার অধিকার হারায়। মানুষ তখন গুম হয়, বন্দী হয় এবং বন্দী হয়ে রিমান্ডে যায় ও লাশ হয়। এমনকি নেতারাও লাশহয়ে সিঁড়িতে পড়ে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা তখন হাওয়ায় হারিয়ে যায়। আযাব আসে দুর্ভিক্ষের বেশে। আসে ঘুষ, সস্ত্রাস ও ধর্ষণের বেশে। আসে বিশ্বজুড়া অপমানের বেশে। দেশ তখন “ভিক্ষার তলাহীন ঝুলি”, “দূর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম” এরূপ বিশ্বজুড়া নানা কুখ্যাতি পায়। তখন জলোচ্ছ্বাস, প্লাবন ও ঘুর্ণিঝড় আসে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে। মুজিবামলে ৩০ হাজার রাজনৈতীক নেতাকর্মী লাশ হয়েছিল। দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে লাশ বানানো হয়েছিল আরো কয়েক লাখ মানুষকে। কোরআনে বর্নিত আদ-সামুদ, মাদায়েনের অধিবাসী এবং ফিরাউনের বাহিনীর উপরও আযাব এসেছিল। কিন্তু সে সব আযাবের কোনটিতে কি এত মানুষ লাশ হয়েছিল?
বাড়ীতে আগুণ লাগলে এবং সে আগুন না থামালে একে একে সবগুলো ঘরই পুড়ে যায়। তেমনি দেশে দূর্নীতি ঢুকলে সেটি শুধু রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ও অফিস-আদালতে সীমিত থাকে না। প্রবেশ করে প্রতিক্ষেত্রে এবং ধ্বসিয়ে দেয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। আগুন নেভানো এবং দূর্নীতি নির্মূল ইসলামের তাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আল্লাহর উপর ঈমান আনার পরই মু’মিনের উপর অলংঘনীয় হুকুমটি হলো “আমারু বিল মা’রুফ ওয়া নিহিয়ানিল মুনকার” অর্থাৎ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল। মু’মিনের জীবনে তখন দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু হয়। অথচ বাংলাদেশে সে দুর্বৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ হয়নি। দুর্বৃত্তি নির্মূল না করে বরং সেটিকে বাড়ানো হয়েছে। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের আনুগত্য। কিন্তু সে আনুগত্য “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল” পালনে হয়নি। আল্লাহর আনুগত্য নামায-রোযাতেই সীমিত হয়ে আছে। ফলে সমগ্র দেশ অধিকৃত হয়ে গেছে দুর্বৃত্তদের হাতে। “ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বৃত্তির নির্মূল” -মহান আল্লাহর এ হুকুমটিকে শুধু কোর’আনেই রয়ে গেছে। অফিস-আদালত, রাজনীতি ও অর্থনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণে এ মিশন প্রতিষ্ঠা পায়নি। এমন কি প্রচণ্ড ধোকাবাজি হয়েছে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা এবং দুর্বৃত্তকে দুর্বৃত্ত রূপে জানার ক্ষেত্রেও। ফলে ভয়ংকর দুর্বৃত্তরা নির্বাচিত হচ্ছে শাসকরূপে।
মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানটি চিকিৎসা, রসায়ন বা প্রকৌশল বিজ্ঞান নয় বরং সেটি ইতিহাস বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এ শাখাটি মানুষকে সবচেয়ে গুরুত্বপূণ ছবকটি দেয়, দেয় সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে জানার সামর্থ। দেয়, চিন্তা-ভাবনা ও অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার সামর্থ্য। দেয়, সমাজের মানবরূপী দুর্বৃত্ত কীটদের চেনার কান্ডজ্ঞান। মানব সভ্যতার বড় বড় বিপর্যয়গুলো মহামারি, সুনামী ও ভূমিকম্পের কারণে হয়নি। হয়েছে এ দুর্বৃত্তদের হাতে। ইতিহাস সামর্থ্য দেয় তাদের অনুসৃত পথ পরিহারের। ফিরাউন-নমরুদ-হিটলার-মুজিব যে অতি স্বৈরাচারি দুর্বৃত্ত এবং তাদের দর্শন ও রাজনীতি যে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিধ্বংসী -সেটি অন্য কোন বিজ্ঞানের বই পড়ে জানা যায় না। সে জন্য ইতিহাসের বই পড়তে হয়। তেমনি হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে মহান আল্লাহতায়ালার রাসূল এবং মানবের শ্রেষ্ঠ বন্ধু -সেটিও ইতিহাসের শিক্ষা। ইতিহাস তো এভাবেই মানুষের চলার পথে সঠিক ও বেঠিক এ দুটো পথই দেখায়। এভাবে বাঁচায় জাহান্নামের আগুণ থেকে। পবিত্র কোরআনে তাই পদার্থ, চিকিৎসা, রসায়ন বা প্রকৌশল বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হয়নি। বরং তুলে ধরা হয়েছে হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) অবধি মানব জাতির অতি শিক্ষণীয় নির্ভূল ইতিহাস। বার বার বর্ণিত হয়েছে ইতিহাসের নানা পর্বে নানা মানুষের সফলতা ও বিফলতার কারণগুলোও। তুলে ধরা হয়েছে হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত লুত (আঃ), হযরত সালেহ (আঃ), হযরত শোয়েব (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ)এর ন্যায় শ্রেষ্ঠ মানুষদের সাথে দুর্বৃত্তদের আচরন এবং তাদের ভয়াভয়ানক পরিণতি। মহান আল্লাহতায়ালা চান চিন্তাশীল মানুষগুলো ইতিহাসের এশিক্ষা নিয়ে দিবারাত্র চিন্তাভাবনা করুক ও শিক্ষা নিক। কম্পিউটার, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ, রেডিও-টিভি, পারমাণবিক শক্তি –এসব না থাকাতেও সর্বশ্রেষ্ট সভ্যতার নির্মাণে আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বেও কোন সমস্যা হয়নি। কারণ বিজ্ঞানের এসব নব্য আবিস্কারগুলি জীবনে সম্ভোগ বাড়াতে সহায়ক হলেও মানবিক গুণে বেড়ে উঠার জন্য অপরিহার্য নয়। এক্ষেত্রে জরুরী হলো,কোনটি ন্যায়, কোনটি সত্য এবং কোনটি জান্নাতের পথ সেটি চেনার সামর্থ্য। চাই সিরাতুল মোস্তাকীম তথা সঠিক রোডম্যাপ। আজ থেকে চৌদ্দ শত বছর আগেই মুসলিমগণ সেটি পেয়েছিল। মহান নবীজী (সাঃ) সে পথটি স্বহাতে দেখিয়ে গেছেন এবং মু’মিনদের মাঝে সে সামর্থ্যও সৃষ্টি করেছেন। ফলে তারা বেড়ে উঠতে পেরেছিল মহানমানব রূপে এবং গড়ে তুলতে পেরেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।
মিথ্যাচারি দুর্বৃত্তদের অপরাধ স্রেফ মানবতা ধ্বংসী অস্ত্র আবিস্কার বা রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহ নয়, বরং সবচেয়ে বড় অপরাধটি সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় বিচারের সামর্থ্য কেড়ে নেয়ায়। সে লক্ষ্যে দুর্বৃত্তদের টার্গেট শুধু দেশের অর্থভাণ্ডার, প্রশাসন, ব্যবসা-বানিজ্য ও রাজনীতি নয়, বরং ইতিহাসের বই। বাংলাদেশে তাই মিথ্যা ইতিহাস লিখতে বিনিয়োগ হচ্ছে সরকারি কোষাগারের শত শত কোটি টাকা। অতীতে এরূপ মিথ্যাসেবীরা রাম, রাবন, হনুমান,অসুর, গনেশ,মনসার নামে কত আজগুবি কল্পকথাই না শিখিয়েছে। সেসব মিথ্যার গায়ে আবার ধর্মের লেবাসও পড়িয়েছে। কল্পিত কেচ্ছাকাহিনীর সে বইগুলোকে ধর্মগ্রন্থ রূপেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এভাবে গরু-ছাগল, শাপ-শকুন ও মুর্তিকে ভগবানের আসনে বসিয়েছে। প্রচারের শক্তি বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টরাও বুঝে। কারণ তাদেরও তো পুজনীয় কেউ চাই। গরু-ছাগল ও শাপ-শকুন যদি পুজনীয় হতে পারে তবে তাদের নেতাই বা কম কিসে? তেমন একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলার ইতিহাসে তারা সীমাহীন মিথ্যাচার ঢুকিয়েছে। স্বৈরাচারি বাকশালী দুর্বৃত্তকে দেয়া হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ বাঙালীর খেতাব। যে প্রক্রিয়ায় অতীতে নমরুদ-ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল স্রেফ নেতারূপে নয়, বরং ভগবান রূপে এবং হত্যা-যোগ্য গণ্য হয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ)এর মহান নবীগণ -সেটিই হচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে দুর্বৃত্তদের নেতা বা নেত্রী হওয়ার পাশাপাশি হত্যা ও জেল-জুলুম নেমে এসেছে নবী-রাসূলদের অনুসারিদের উপর।
কারা রাজাকার?
বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু আলোচিত প্রসঙ্গ হলো রাজাকার এবং তাদের একাত্তরে ভূমিকা। কিন্তু কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের দর্শন ও মিশন? বাঙালী হয়েও কেন তারা পাকিস্তানের পক্ষ নিল? বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় কেন তারা জানপ্রাণ দিয়ে বিরোধীতা করলো? কেন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে নির্যাতীত হলো এবং নিজের রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হলো? বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টদের এত আক্রোশ কেন রাজাকারদের বিরুদ্ধে? দেশে হাজার হাজার সন্ত্রাসী আছে, বহু হাজার দুর্নীতিবাজ অফিসার আছে, অসংখ্য খুনি, ধর্ষক ও চোর-ডাকাতও আছে। তাদের হাতে শেয়ার বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। বহু হাজার কোটি টাকা চুরি হয়ে গেছে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে। লুট হয়ে গেছে হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি, নদীর তীর ও সমুদ্র সৈকত। কিন্তু তাদের নির্মূলে সরকারের পক্ষ থেকে কি কোন উদ্যোগ আছে? ক’জনের বিচার হয়েছে? তাদের বিচারের কথা দেশের সেক্যুলারিস্টগণ মুখে আনে না। তাদের নির্মূলের দাবী নিয়ে কোন নির্মূল কমিটিও গড়া হয়নি। যেসব খুনির বিচার হয়ে মৃত্যুদন্ড হয়েছিল দেশের প্রেসিডেন্ট তো তাদের সাজা মাফ করে নতুন খুন ও নতুন সন্ত্রাসের আজাদী দিয়েছে। কিন্তু ফাঁসীতে ঝুলাতে চায় রাজাকারদের। হেতু কি? বাংলাদেশের স্বাধীনতা কি রাজাকারদের হাতে বিপন্ন? এ প্রশ্নগুলি অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিষয়টি শুধু আজকে নয়, শত শত বছর পরও বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে।
“রাজাকার” শব্দটি এসেছে ফার্সী থেকে। ভারতীয় উপমহাদশে রাষ্ট্র ভাষা রূপে বহু শত বছর ফার্সী ছিল । সে সূত্র ধরে হাজার হাজার ফার্সী শব্দের ন্যায় রাজাকার শব্দটিও উর্দুতে স্থান পায়। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বেচ্ছাসেবক। তবে রাজাকার শব্দের সাথে একটি গৌরবজনক ইতিহাসও জড়িত। সেটি আধিপত্যবাদী কাফের হামলার বিরুদ্ধে মুসলমানের জিহাদের। নিযাম শাসিত হায়দারাবাদের উপর যখন ভারতের আগ্রাসী হামলা শুরু হয় তখন স্বাধীনতা বাঁচাতে সেদেশের মুসলমানগণ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিরোধকারি সে মোজাহিদগণ নিজেদের রাজাকার রূপে অভিহিত করে। একই আগ্রাসী ভারত ও তার এজেন্টেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সে ঐতিহ্য নিয়েই একাত্তরে বাংলার হাজার হাজার মুসলমান গড়ে তোলে রাজাকার ফোর্স। একাত্তরের যুদ্ধটি আওয়ামী লীগের কাছে ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গার লড়াই, আর রাজাকারদের কাছে ছিল পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াই। ভারতের লক্ষ্য ও আওয়ামী লীগের লক্ষ্য তখন একাকার হয়ে যায়। ভারত তখন আওয়ামী ঘরানার যুবকদের নিয়ে নিজভূমিতে নিজ অর্থে ও নিজ পরিকল্পনায় গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। লক্ষ্য পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি। রাজাকার হলো তারা যারা একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গার আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় কাফেরদের যৌথ প্রজেক্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দীর্ঘ নয় মাস এ রাজাকারগণই দেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগ ও তার মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজাকারদের প্রতিরোধের মুখে ৯ মাসের লড়াইয়ে মুক্তি বাহিনী বাংলাদেশে কোন জেলা দূরে থাক,কোন থানার উপরও দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। বড় জোর তারা কিছু পুল-কালভার্ট ধ্বংস করতে পেরেছিল এবং নিরস্ত্র কিছু আলেম,পীস কমিটির কিছু সদস্য এবং পাকিস্তানপন্থি কিছু নিরস্ত্র মানুকে হত্যা করতে পেরেছিল। ভারত বুঝতে পারে,পাকিস্তান আর্মিকে পরাজিত করা দূরে থাক রাজাকারদের মোকাবেলা করার সামর্থও মুক্তিবাহিনীর নেই। ভারতের বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ যখন পাকিস্তানে ভাঙ্গতে ব্যর্থ হচ্ছিল,তখনই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বুঝতে পারেন,এ যুদ্ধে তাঁর নিজে নামা ছাড়া বিকল্প নাই। ফলে তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। যুদ্ধ শুরু হয় স্থল, বিমান ও সমুদ্র পথে। এমন একটি যুদ্ধের পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে ভারত বিপুল অস্ত্র সংগ্রহ করে রাশিয়া থেকে। অথচ পাকিস্তান সে সময় ব্যস্ত ছিল দেশে নির্বাচন,সে নির্বাচন শেষে দেশের শাসনতনন্ত্র তৈরীর গভীর সংকট নিয়ে। রাজনৈতীক দলগুলো কাউকে কোন ছাড় দিয়ে আপোষে রাজী ছিল না। ভারতের বিরুদ্ধে তেমনি একটি প্রকান্ড যুদ্ধ লড়ার কোন প্রস্তুতি পাকিস্তানের ছিল না। কাশ্মীরের জনসংখ্যা এক কোটিরও কম। অথচ সেখানে ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা ৬ লাখ। অথচ সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে নিয়মিত সৈন্যের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫ হাজার –এর মধ্যে ৩৪ হাজার ছিল রেগুলার ফোর্স এবং ১১ সিভিলিয়ান ফোর্স। (তথ্যটি জেনারেল নিয়াজী তার লিখিন দি বিট্রায়াল ও ইস্টপাকিস্তান বইতে দিয়েছেন।)যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানীকে যুদ্ধবন্দি রূপে ভারতে নেয়া হয় তাদের অর্ধেকের বেশী ছিল বেসামরিক ব্যক্তি ও তাদের পরিবার-পরিজন। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে, ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপে দেশটি বিভক্ত হয় ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বর।
বিজয় নিরেট মিথ্যার
একাত্তরে বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাঙালী প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছে -সেটি যেমন মিথ্যা, তেমনি মিথ্যা হলো ১৯৭১য়ের ২৬ মার্চ অর্জিত হওয়ার কেচ্ছাটিও। তেমনি নিরেট মিথ্যাচার হলো পাকিস্তান ভাঙ্গার লড়াইকে স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা। কোন লড়াইকে স্বাধীনতার লড়াই বলতে হলে সে দেশকে অন্য দেশের দ্বারা অধিকৃত বা উপনিবেশ হতে হয়। একাত্তরে যে দেশ পরাধীনই ছিল না, সে দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয় কি করে? ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট অবধি পাকিস্তানভূক্ত প্রদেশগুলি ব্রিটেশের হাতে পরাধীন ছিল বলেই ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের কথা আসে। প্রশ্ন হলো ১৯৭১য়ের ২৫ শে মার্চ অবধি কি বাংলাদেশ পরাধীন ছিল? তবে কি সে পরাধীনতার শুরু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে? তাহলে ১৯৫৪সালের নির্বাচনে ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিবাচনি মেনিফেস্টোগুলোতে কেন সে পরাধীতার উল্লেখ নাই? পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে কেনই বা তখন উচ্চারিত হয়নি স্বাধীনতার দাবী? তারা কি তখন মায়ের কোলে দুগ্ধ পানকারি শিশু? ১৯৭১’য়ের ২৬’শে মার্চে কে প্রথম প্রথম আবিস্কার করলো যে পূর্ব পাকিস্তান পরাধীন? তবে বাংলাদেশের সমস্যা হলো, গরু-ছাগল, শাপ-শকুনকে ভগবান বলার মত বাঙালীর সংখ্যা যেমন বহু কোটি, তেমনি এসব নির্ভেজাল মিথ্যাও যে বাজার পাবে -সেটিই স্বাভাবিক। ফলে মিথ্যার প্রবল জোয়ারে তাই ভাটা আসছে না।
শেখ মুজিব সে স্বাধীন বাংলাদেশের জনক -সেটিও আরেক মিথ্যা। তিনি তো স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি। ফলে সে স্বাধীনতা তিনি আনলেন কখন? বলা হয় স্বাধীনতা এনেছে মুক্তিবাহিনী। ২৬শে মার্চ কি মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছিল যে স্বাধীনতা আনবে? সত্যতো এটাই, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল ১৯৪৭য়ের ১৪ আগষ্ট। সেটি পাকিস্তানের বৃহ্ত্তর প্রদেশ রূপে। নিজের গৃহের নিজ বিছানায় শুয়ে যে ব্যক্তি “বাড়ী যাব” “বাড়ী যাব” বলে –তখন বুঝতে হবে সে আদৌ সুস্থ্য নয়। সেটি ঘটে জ্বরের প্রকোপে মানসিক বিকারগ্রস্ততায়। যখন আধুনিক চিকিৎস্যা ছিল না তখন টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া বা নিউমোনিয়ার ন্যায় রোগে বহু মানুষের গায়েই এরূপ প্রচণ্ড জ্বর উঠতো। তখন বিকারগ্রস্ত হয়ে আবোল তাবোল বলতো। মুজিব এবং তাঁর সাথীরাও তেমনি বিকারগ্রস্ত হয়েছিলেন। তবে সেটি ক্ষমতার নেশায়। ফলে স্বাধীন দেশে বাস করেও তারা স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলেন। শেখ হাসিনাও তেমনি ক্ষমতার নেশায় বিকারগ্রস্ত হয়েছিলেন ২০০১ সালে নির্বাচনী পরাজয়ের পর। দেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত সরকারি বাসভবনকে তখন নিজের নামে দখলে নেয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ষড়যন্ত্র করেছিলেন সামরিক ক্যুর। এমন এক বিকাগ্রস্ততায় তিনি কর্মীদেরকে এক লাশের বদলে দশ লাশ ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন বিকারগ্রস্ততা সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের জীবনেও আসে। কারণ নির্দ্বিধায় মানব হত্যা ও তার সম্পদ লুট মানসিক সুস্থ্যতা নিয়ে কেউ করে না, এরজন্যও তো এমন বিকারগ্রস্ততা চাই।
অথচ সত্য অন্যত্র। একাত্তরে যা অর্জিত হয়েছে সেটি স্বাধীনতা নয়,বরং স্বাধীন পাকিস্তানের বিভক্তি। সেটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে। সে বিভক্তির পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে ভারতের সাথে তাজুদ্দীনের ৭ দফা এবং মুজিবের ২৫ দফা চুক্তির জালে আটকা এক পরাধীন বাংলাদেশ। সেটিও ১৯৭১য়ের ২৬ মার্চে নয়, বরং ১৯৭১য়ের ১৬ ডিসেম্বর। ১৬ই ডিসেম্বর অবধি দেশে-বিদেশে স্বাধীন পাকিস্তানের সর্ব বৃহৎ প্রদেশ রূপে পরিচিত ছিল,এবং নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান। তাছাড়া এ বিচ্ছিন্নতা মুজিবের বা মুক্তিবাহিনীর বাহুবলে আসেনি, এসেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে। এযুদ্ধে যতজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মারা গেছে তার চেয়ে বেশী মারা গেছে ভারতীয় সৈনিক। স্বৈরাচারি বাকশালী মুজিবকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পিতা বলা যেমন নিরেট মিথ্যা ও প্রতারণা, তেমনি মিথ্যা ও প্রতরণা হলো তাঁকে স্বাধীনতার জনক বলাও। ভারতের এজেন্ট ছাড়া তার অন্য কোন পরিচিতি আছে কি? বাংলাদেশের জনক রূপে যিনি পুরা কৃতিত্বের দাবীদার তিনি ইন্দিরা গান্ধি। এবং মূল যুদ্ধটি করেছে ভারতীয় সৈনিকেরা।ভারতীয় সেনা বাহিনীর সেটি অজানা ছিল না। তাই ১৬ই ডিসেম্বরে জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কোন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারকে রাখা হয়নি।
একাত্তরে বাংলাদেশের মাটিতে দুটি পক্ষ ছিলঃ একটি অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষের,অপরটি বিপক্ষের। এক পক্ষের সাফাই শুনে আদালতে বিচার হয় না। রাজাকারদের মূল্যায়নে নতুন প্রজন্ম তেমন একটি বস্তুনিষ্ঠ বিচার করবে সে পথও খোলা রাখা হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের দর্শন ও ভূমিকা নিয়ে রাজাকারদের কোন ভাষ্য নেই। এভাবে অবিচার হয়েছে রাজাকারদের সাথে। নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ভারতভক্ত সেক্যুলারিস্টদের চাপিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ এক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে। কি ছিল রাজাকারদের ভাবনা? কি ছিল তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য? তারা কি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার শত্রু? এসব নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ -বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম সঠিক ধারণাটি পায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজাকারদের বিরুদ্ধে অশ্লিল গালিগালাজ ছাড়া সে প্রশ্নের কোন বস্তুনিষ্ঠ গভীর আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ –বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম রাজাকারদের ব্যাপারে যা কিছু শুনেছে তা তাদের শত্রুদের থেকে। মিথ্যাসেবীরা সত্যের প্রচারের মাঝে নিজেদের মৃত্যু দেখতে পায়। তাই সর্বশক্তি দিয়ে সত্যের প্রচারে বাধা দেয়। ফিরাউন তার মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে হযরত মূসা (আঃ)এর সত্য প্রচারে শুধু বাধাই দেয়নি, তাঁকে হত্যা করার লক্ষ্যে সাগর অবধি ধেয়ে গিয়েছিল। মক্কার পথে নবীজী (সাঃ) দ্বীনের দাওয়াতে বেরুলে তাঁর উপর পাথর বর্ষণ করতো। তায়েফ নগরীতে তো পাথরের আঘাতে নবীজী (সাঃ)কে প্রচণ্ড ভাবে রক্তাত্ব করা হয়েছিল।একই রূপ সত্যভীতি বাংলাদেশের ভারতসেবী সেক্যুলারিস্টদের। একাত্তর নিয়ে নিজেদের রচিত মিথ্যাকে বাঁচাতে রাজাকারদের মুখ খুলতে দেয়া দূরে থাক তারা তাদেরকে ফাঁসীতে ঝুলাতে চায়। একাত্তরে নিয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার চেষ্টা করেছেন পশ্চিমবাংলার গবেষক শর্মিলা বোস। অথচ তাঁর লেখা “ডেড রেকনিং” বইটিকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ছিল পূর্ব পাকিস্তানী। দেশটির জনগণকে কেউ ঘুমপাড়ানীর গান গাইয়ে পাকিস্তান ভূক্ত করেনি। ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবে বাংলাদেশের নাম ছিল না। সে লাহোর প্রস্তাবে সংশোধন আনেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব হোসেন সহরোয়ার্দী। সেটি আনেন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী মিটিংয়ে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জনাব সহরোয়ার্দী। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমান খান। আতাউর রহমান খানের সে মন্ত্রীসভায় খোদ মুজিবও মন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় জনাব সহরোয়ার্দী পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস রূপে ১৪ আগষ্ট পালন করেছেন। দিবসটিকে খোদ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও পালন করেছেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতার সুরক্ষার পক্ষে তারা প্রতিবছর বিভিন্ন দিবসে পত্রিকায় বানীও দিয়েছেন। মুজিব নিজে জনসভার ভাষনে অসংখ্যবার “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” স্লোগান দিয়েছেন। এভাবে নিজেরাই প্রমাণ করেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান পরাধীন হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশও হয়নি। বরং বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশের সর্ববৃহৎ প্রবেশ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কায়েদে আযমের মৃত্যুর পর দেশটির রাষ্ট্র প্রধান রূপে যিনি তাঁর পদে বসেছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন ঢাকার নওয়াব পরিবারের জনাব খাজা নাজিমুদ্দীন। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী রূপে তিন বার বসেছেন তিন পূর্বপাকিস্তানী। ব্রিটিশের অধীনে ১৯০ বছরে পরাধীন জীবনে সেটি কি একবারের জন্যও ঘটেছে? ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ লাহোরের মিন্টো পার্কে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে যিনি স্বাধীন পাকিস্তানের প্রস্তাব পেশ করেন তিনিও ছিলেন বাঙালী শেরে বাংলা ফজলুল হক। তাছাড়া যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ দেশটির প্রতিষ্ঠা সে সংগঠনটির জন্মও হয়েছিল ঢাকায়, সেটি ১৯০৬ সালে। অথচ বাংলাদেশে ইতিহাসে এসব নিরেট সত্যগুলোকে ছাত্রদের দৃষ্টি থেকে পরিকল্পিত ভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। শেখ মুজিবকে বহুদলীয় গণতন্ত্রী বলে জাহির করা হয়। কিন্তু সেটি যে নিরেট মিথ্যাচার সেটি তিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করে। কথা হলো,রাজাকারগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী হবে কেন? তারা বিরোধীতা করেছে বিচ্ছিন্নতার। বিচ্ছিন্নতাকে স্বাধীনতা বলা তো মিথ্যাচার। পূর্ববাংলার মুসলমান তো স্বাধীনতা পেয়েছে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট,সেটি স্বাধীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হওয়ার মধ্য দিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানীরা ২২টি বছর ধরে সে স্বাধীনতা দিবসটি মহা ধুমধামে উদযাপনও করেছে। বিচ্ছিন্নতার বিরোধীতাকে কি স্বাধীনতার বিরোধী বলা যায়?
প্রতারণার রাজনীতি
১৯৭০য়ের নির্বাচনে মুজিব ভোট নিয়েছেন ৬ দফায় উল্লেখিত স্বায়ত্বশাসনের দাবী জানিয়ে। নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরীর ওয়াদা দিয়ে। সে প্রতিশ্রুতির কথা সত্তরের নির্বাচনি মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ ঘোষণাও করেছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে পশ্চিম-পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল সে কথাটি সত্তরের কোন নির্বাচনি জনসভাতেই তিনি বলেননি। তিনি পূর্ব-পাকিস্তানকে পৃথক করতে চান –সে দাবীও কোথাও বলেননি। সত্তরের নির্বাচনী বিজয়ী পরই হঠাৎ তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন। এবং সেটি আগ্রাসী ভারতের সাহায্য নিয়ে। অথচ সেজন্য তিনি জনগণ থেকে কোন ম্যান্ডেটও নেননি। ফলে জনগণ কেন তার এ নতুন নীতিতে সমর্থণ দিবে? তিনি ভারতের সাথে গোপন চুক্তি আগরতলাতে করলেও সেরূপ চুক্তি তো পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ করেনি।
১৯৭২ সালে পাকিস্তানের জেল থেকে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারিতে সহরোয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় তিনি বলেন, পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজটি তিনি একাত্তরে নয়, ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছেন। প্রতারণা আর কাকে বলে! তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানী শোষণ, বাঙালীদের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা, পূর্ব পাকিস্তানের উপনিবেশ হওয়ার কিচ্ছা কি তবে শুধু পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজকে জায়েজ করার স্বার্থে? আওয়ামী লীগের সাথে পাকিস্তান ভাঙ্গার এ প্রকল্পে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয় তৎকালীন মস্কোপন্থি ন্যাপ, আন্ডারগ্রাউন্ড জগতের বহুধা বিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য সোসালিস্ট ও ন্যাশনালিস্ট দলগুলি। আদর্শিক ভাবে তারা সবাই ছিল ইসলামের বিপক্ষ শক্তি। অর্থাৎ পাকিস্তান ভাঙ্গাটি ছিল ইসলামের শত্রুশক্তির সম্মিলিত প্রজেক্ট। অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নেয় কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগের দুই গ্রুপ, নুরুল আমীন সাহেবের পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, ফরায়েজী আন্দোলনসহ অন্যান্য ইসলামন্থি দল। সেক্যুলারিস্ট ও ন্যাশনালিস্টদের পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পকে সমর্থণ দেয়নি দেশে কোন আলেম, মসজিদের ইমাম, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামি ব্যক্তিত্ব। বামপন্থিদের মাঝে যারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন তারা হলেন ভাষানী ন্যাপের মশিহুর রহমান যাদু মিয়া গ্রুপ এবং যশোরের জনাব আব্দুল হকের পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি। উপজাতীয়দের মাঝে পাকিস্তানের পক্ষ নেন চাকমা রাজা ত্রিদীব রায়। তৎকালে পূর্ব পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম ছিলেন কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাহার আলী। তিনি ছিলেন নিজামে ইসলাম পার্টির নেতা। তার নেতেৃত্বে অনুষ্ঠিত হতো সমগ্র দেশে সবচেয়ে বড় ঈদের জামায়াত। তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গার যে কোন উদ্যোগকে হারাম বলে ফতোয়া দেন। পাকিস্তান বাঁচানোর যুদ্ধকে তিনি জিহাদ বলে ঘোষণা দেন। একই রূপ বক্তব্য দিয়েছেন হাটহাজারি মাদ্রাসার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা সিদ্দিক আহম্মদ।একই রূপ অভিমত ছিল অন্যান্য বরেন্য আলেমদেরও। কোন হাক্কানী আলেম পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নিয়েছেন -এমন নজির আছে কি?
প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে নানা মত থাকে,নানা প্রতিপক্ষও থাকে। সে মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। কারণ, দেশের কল্যাণের বিষয়টি নিয়ে সবাই একই ভাবে না। বিপরীত মুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিন বদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসবে। কিন্তু প্রতিটি বিজয়ী পক্ষই যদি নিজেদের পছন্দমত ইতিহাস লেখা শুরু করে তবে তাতে দেশে বহু রকমের ইতিহাস রচিত হবে। বাংলাদেশে তেমন ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু হয়েছে একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। দলীয় উদ্যোগে ইতিহাস রচনার সাথে তাই গুরুত্ব পেয়েছে বিপক্ষীয় নেতাদের গায়ে কালিমা লেপনের কাজ। রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে, আর নিজেদেরেক চিত্রিত করেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যে শত শত আলেম, হাজার হাজার পাকিস্তানপন্থি ও বিহারী খুন হলো, তাদের শত শত ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুন্ঠিত ও ভস্মিভূত হলো, শত শত রেলব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস হলো -বাংলাদেশের ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। লক্ষাধিক বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থিদের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়। তাদের ঘরবাড়ি,ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন ঝড়ো হাওয়ায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নাই। আজও বহুলক্ষ বিহারী রাস্তার পাশে বস্তিতে যেভাবে বসবাস করছে –সেটিই বা কীরূপে হলো? ইতিহাসে সে বিবরণও নাই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শত শত ট্যাংক ও যুদ্ধাস্ত্রগুলো কোথায় গেল -সে বিবরণও নাই। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ যে ভারতীয় বাহিনী লুটে নিয়ে গেল -বাংলাদেশের ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে এভাবেই লুকানো হয়েছে ভারত ও তার সেবাদাস আওয়ামী ক্যাডারদের ভয়ংকর অপরাধগুলি।
রাজাকারের দর্শন
মানুষের রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্ত ব্যক্তিটিও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন, জগত ও ন্যায়নীতি নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎসটি ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ। কিন্তু রাজাকারগণ কোত্থেকে পেল জাতীয়তাবাদী জোয়ারের প্রবল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর সাহস? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবের উত্তর নেই। ফলে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে একাত্তরের বিষয়ে সীমাহীন অজ্ঞতা নিয়ে। এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই -এটি হলো মহান আল্লাহর দেয়া অতি মর্যাদাপূর্ণ খেতাব। মুসলিমদের দায়িত্ব হলো আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত সে খেতাবকে ধরে রাখা। ভাইদের মাঝে ভাষা,বর্ণ,গোত্র বা ভূগোলের নামে বিভক্তির দেয়াল গড়া হারাম। প্যান-ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের দর্শন নিয়ে নানা ভাষাভাষি মুসলমান একই জায়নামাযে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেমন কাতার বাঁধে, তেমনি কাব্বাকে ঘিরে একাকার হয়ে তাওয়াফ করে। শত শত বছর ধরে মুসলমানগণ সে ভাতৃত্বকে ধরে রেখেছে। এমন একটি বিশ্ব ভাতৃত্ব থেকেই জন্ম নিয়েছিল বাঙালী, পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান এরূপ নানা ভাষাভাষি মানুষ নিয়ে অখণ্ড পাকিস্তান নির্মানের ভাবনা। সে ভাবনা থেকেই ১৯৭১’য়ে জন্ম নেয় অখন্ড পাকিস্তান বাঁচানোর চেতনা। সেটিই হলো রাজাকারের চেতনা। তেমন একটি চেতনা নিয়েই ১৯৬৫ সালে ভারতীয় সামরিক হামলার বিরুদ্ধে পাঞ্জাবী, বিহারী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালীরাও লড়েছে। এ চেতনায় জুলুম, শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অনুমতি আছে, কিন্তু মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অনুমতি নাই। ভারতের কাছে মুসলমানদের এ অটুট ঐক্য পছন্দ হয়নি। কারণ অখণ্ড রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে পাকিস্তান ছিল প্রবল বাধা। ফলে সে ঐক্যে ফাটল ধরাতে বিপুল অর্থব্যয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পদলেহী বিশাল সেবাদাস বাহিনী গড়ে তোলে। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ মূলত সে ভারতীয় ষড়যন্ত্রেরই ফসল। ভারতসেবী আওয়ামী পক্ষটির কাছে স্বৈরাচার,অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামায় কোন আগ্রহ ছিল না, বরং ছিল ক্ষমতার প্রচণ্ড মোহ। সে মোহ নিয়েই মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচার ও দুর্বৃত্তের নেতৃত্বে শুরু হয় দেশভাঙ্গার যুদ্ধ। সে যুদ্ধে ভারতকেও ডেকে আনে। দেশভাঙ্গার এমন যুদ্ধে কি কোন মুসলমান অংশ নিতে পারে? ইসলামে তো এটি হারাম। অথচ স্বৈরাচার ও শোষন-বিরোধী আন্দোলনে নামলে বহু পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে মুজিব সমর্থণ পেত। সেরূপ সমর্থন তিনি ১৯৬৯ সালেও পেয়েছেন। আইয়ুব সরকারের জেলখানা থেকে মুজিবকে মুক্তি দেয়ার পক্ষে সে সময় জোড়ালো দাবী জানিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা। এমনকি একাত্তরে মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার দাবী জানিয়েছিল জামায়াতে ইসলামিসহ বহু দল। কিন্তু দেশভাঙ্গার কাজে মুজিবের সমর্থণ করাটি তাদের জন্য ছিল অনতিক্রম্য রেড-লাইন। শুধু রাজনৈতীক কারণেই নয়,ধর্মীয় কারণেও। পাকিস্তান ভাঙ্গার ন্যায় একটি হারাম কাজের পক্ষ নেয়াটি ধর্মভীরু মুসলিমদের জন্য অসম্ভব ও অঅচিন্তনীয় ছিল। এটি হতো মহান আল্লাহর হুকুমের সাথে গাদ্দারি। বরং মু’মিনের দায়িত্ব হয় সর্বশক্তি দিয়ে কোন মুসলিম দেশভাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আলেমদের মাঝে নানা বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও এবিষয়ে বিরোধ নাই। ফলে একাত্তরে পাকিস্তান বাঁচানোর লড়াই নিয়েও আলেমদের মাঝে কোন বিরোধ ছিল না। এটিই রাজাকারের দর্শন। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার মূল অনুপ্রেরণাটি এসেছিল সে দর্শন থেকে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতিয়তাবাদী দর্শন। ভাষাগত চেতনার ভিত্তিতে রাজনীতি করা, মানচিত্র গড়া, সে মানচিত্রে বসবাসকারি অবাঙালীদের নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যা করাটি ছিল তাদের মিশন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার মূল উৎস হলো এটি। অথচ ইসলামে এটি সুস্পষ্ট কুফরি। এ চেতনাটি আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক। একাত্তরের সংঘাত চলাকালীন ৯ মাস ধরে দেশের বরেণ্য আলেম-উলামাগণ ইসলামের সে মৌলিক শিক্ষাটি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে আমলের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিবৃতিগুলি তার প্রমাণ। তাই বহু শত আলেম,মাদ্রাসার বহু হাজার ছাত্র, পীরদের হাজার হাজার মুরীদ রাজাকার হলেও তাদের কেউ মু্ক্তিযোদ্ধা হয়েছে -সে প্রমাণ নগণ্য বা নাই বললেই চলে। আওয়ামী বাকশালীদের পক্ষ থেকে দাড়ি-টুপিধারিদের ঢালাও ভাবে রাজাকার বলার মূল কারণটি তো এখানেই।
সেক্যুলারিস্টদের বিস্ময়
একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষনে প্যান-ইসলামিক ও জাতিয়তাবাদী –চিন্তার এ দু’টি মডেলকে অবশ্যই বুঝতে হবে। নইলে দুই পক্ষের বিচারে প্রচণ্ড অবিচার হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্মে, আচরণে, রুচীবোধে ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য তা তো এই ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার বা দর্শনের মডেলের পার্থক্যের কারণেই। এ ভিন্নতা খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর ভিন্নতার কারণে নয়। তাই একই রূপ খাদ্যপানীয় ও একই জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ যেমন রাজাকার হয়েছে, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাও হয়েছে। মানুষ মরে যায়, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১’য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭’য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে। চেতনার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হলো দর্শন। আর দর্শন তো বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। এবং সেটি যদি হয় ইসলামী দর্শন, তবে সেটি তো মৃত্যুহীন। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারের। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এটি গণ্য হয় সাম্প্রদায়ীক চেতনা রূপে। চেতনায় সেক্যুলার হওয়ার কারণে ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদীরা ভাবতেই পারে না, মানুষ কিভাবে অন্য ভাষা, অন্য বর্ণ ও অন্য অঞ্চলের মানুষকে রাজনীতির ময়দানে আপন রূপে গ্রহণ করতে পারে। তাই ১৯৪৭ সালে ১২শত মাইলের ব্যবধানের দুইটি ভিন্ন এলাকাল মুসলিমদের একত্রে পাকিস্তান সৃষ্টিটি ইসলামি চেতনাশূন্য সেকুলারিস্টদের কাছে আজগুবি মনে হয়। তাদের কাছে বরং প্রিয়তর মনে হয় পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের সাথে একাত্ম হয়ে যাওযায়। তারা ভাবতেই পারে না, একজন বাঙালী মুসলইম কীরূপে অবাঙালী মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারে।
একাত্তরের উপর প্রকট বিস্ময় নিয়ে সম্প্রতি এক উপসম্পদকীয় লিখেছেন দৈনিকের যুগান্তরের সাংবাদিক এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরকারি পক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী মাহবুব কামাল। ১৯/১২/১২ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তাঁর কাছে বিস্ময়ের বিষয় পাকিস্তানের মত একটি দেশের ২৩ বছর বেঁচে থাকাটি নয় বরং দেশটির জন্ম লাভ নিয়ে। তাঁর প্রশ্ন, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পোষাক-পরিচ্ছদ, ভিন্ন খাদ্যপানীয় -এত ভিন্নতা নিয়ে বাঙালী মুসলিমগণ কীরূপে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে এক দেশ গড়লো? এ বিস্ময়টি শুধু জনাব মাহবুব কামালের একার নয়, প্রতিটি সেকুলারিস্ট, প্রতিটি ন্যাশনালিস্ট ও প্রতিটি নাস্তিকেরও। তারা গোত্রীয় বন্ধন, ভাষার বন্ধন, খাদ্য-পানীয়, জলবায়ু, পোষাক-পরিচ্ছদের বন্ধনের বাইরে অন্য কোন বন্ধনের কথা ভাবতেই পারেনা। তাদের কাছে ধর্মীয় বন্ধন কোন বন্ধনই মনে হয় না। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো ভূগোল, ভাষা, বর্ণ ও গোত্রীয় সীমারেখার উর্দ্ধে উঠে অন্য দেশে, অন্য গোত্রে বন্ধু খুঁজে বের করা। তাদের সাথে করে এক উম্মতে মুহাম্মদী গড়ে তোলা। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু নানা ভিন্নতা নিয়ে একত্রে জায়নামাযে দাঁড়ানো নয়, বরং রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহের ময়দানে একত্রে দাঁড়ানোও। এর মধ্যেই মু’মিনের ঈমানদারি। সে ঈমানদারি যেমন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টিতে দেখা গেছে, তেমনি দেখা গেছে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের জিহাদে। সে জিহাদে আফগানদের সাথে এককাতারে শামিল হয়েছিল পাঞ্জাবী, পাঠান, আরব, চেচেন, বাঙালী, ইন্দোনেশিয়ান মোজাহিদ। সেরূপ একতা ও ভাতৃত্ব আজ দেখা যাচ্ছে সিরিয়ার সেক্যুলারিস্ট স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদে। যাদের মাঝে সে ঈমানদারি নাই, সে বেঈমানেরা যেমন পাকিস্তানের সৃষ্টিতে বিস্মিত হবে, তেমনি বিস্মিত হবে দেশটি ২৩ বছর বেঁচে থাকাতেও। সেটিই ফুটে উঠেছে জনাব মাহবুব কামালের নিবদ্ধে। তবে তাঁর জন্য আরেক বিস্ময় হলো, আগ্রাসী ভারতের হামলা না হলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যেমন সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি যুগ যুগ তা বেঁচেও থাকতো। ভারতের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়তো শতাধিক পারমানবিক বোমার অধিকারি আজকের পাকিস্তানকে ভাঙ্গা। তাছাড়া ইরান, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিমদেশগুলোতে ইসলামপন্থিদের হাতে সেক্যুলারদের যে বিপর্যয়, তেমন একটি বিপর্যয় থেকে বাঙালী সেক্যুলারিস্টগণ রেহাই পেত? তখন স্বৈরাচারি মুজিবের সৈনিকেরা কি রাজপথ ধরে রাখতে পারতো? পেরে উঠতো কি ইসলামী চেতনায় উজ্জিবীত রাজাকারদের সাথে?
পূর্ব পাকিস্তান ছিল অখন্ড পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠদের এলাকা। কোন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি বিচ্ছন্নতা চায়? এরূপ নজির কি সমগ্র মানব ইতিহাস আছে? বিচ্ছিন্নতার দাবী করে তো দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠরা। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্য থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ যে রাজাকার রূপে শপথ নিবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছিল। এ সহজ সত্যটি মাহবুব কামালগণ না বুঝলেও ভারতীয় নেতাগণ ঠিকই বুঝেছিল। তাই কাল বিলম্ব না করে তারা একাত্তরে দ্রুত হামলা করেছিল। এখন তাদের ভয়, তাদের পূর্ব সীমান্তে আরেক পাকিস্তান নিয়ে। একাত্তরে তারা পাকিস্তানী সৈনিকদের কয়েদী করতে পারলেও বাঙালী রাজাকারদের নির্মূল করতে পারিনি। ফলে তাদের কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তারা তাই আরেক একাত্তর চায়। একাত্তরের ন্যায় ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে তাই আরেক যুদ্ধ শুরুও হয়ে গেছে। এ যুদ্ধকে ভারতের তল্পিবাহক সরকার নাম দিয়েছে রাজাকার নির্মূলের যুদ্ধ। হাসিনা ও তার সাথীরা যে রাজাকার নির্মূলে আপোষহীন –সে ঘোষণাটি বার বার দিয়েছে। ভারত সরকার একাত্তরে যেমন আওয়ামী লীগের পাশে ছিল, সেরূপ এবারও থাকবে -সহরোয়ার্দী উদ্দানের এক সমাবেশে সে ঘোষণাটি দিয়েছিল বাংলাদেশে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তি।
“আমার দেশ” পত্রিকার সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের বিস্ময়টিও কম নয়। ১২/১২/১২ তারিখে তাঁর পত্রিকায় তিনি এক বিশাল উপসম্পাদকীয় লিখেছেন জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে। তার প্রশ্ন, জামায়াত কেন একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিল। এজন্য তিনি জামায়াতের রাজনৈতীক কাণ্ডজ্ঞান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ তিনি ভূলে গেছেন, শুধু জামায়াত নয় বহু সংগঠন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, মশিহুর রহমান, আব্দুল আলীম, আব্দুল মতীন চৌধুরি, সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরির ন্যায় এমন বহু ব্যক্তি যাদেরকে বিএনপি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রী রূপে বসিয়েছিল। কিন্তু জনাব মাহমুদুর রহমান তাদের কাউকে আসামীর কাঠগড়ায় খাড়া করেননি। তাদের রাজনৈতীক কান্ডজ্ঞান ও দেশপ্রেশ নিয়েও প্রশ্ন করেননি। কিন্তু প্রশ্ন তুলেছেন শুধু জামায়াত নেতাদের বেলায়। জনাব মাহবুব কামালের মত জনাব মাহমুদুর রহমানও একাত্তরের বিচার করেছেন চিন্তার সেক্যুলার মডেলে। চেতনার মডেল পাল্টে গেলে বিচারও পাল্টে যায়। চিন্তার মডেল সেক্যূলার হলে জ্বিনাও প্রেম মনে হয়। পতিতাবৃত্তির ন্যায় জঘন্য জিনাকে বাঁচিয়ে রাখাটিও জায়েজ গণ্য হয়। বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ তো সে বিচার নিয়েই কাফেরদের প্রচলিত পতিতাবৃত্তিকে একটি পেশা রূপে বাঁচিয়ে রেখেছে। ইসলামে জ্বিনার চেয়ে জঘন্য হলো সূদ। বলা হয়েছে সেটি নিজের মায়ের সাথে জ্বিনার সমতূল্য। অথচ বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টদের কাছে সেটিও জায়েজ। আরেক গর্হিত হারাম হলো, কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গা। অথচ সেক্যুলারিস্টদের কাছে সেটিও জায়েজ মনে হয়। জনাব মাহমুদুর রহমান তেমন এক সেক্যুলার চেতনায় বলিয়ান হয়েই কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গাকে স্বাধীনতা মনে করেছেন। আর যারা সে হারাম কাজে অংশ নেননি তাদের কান্ডজ্ঞান ও দেশপ্রেম নিয়েই তিনি অভিযোগ খাড়া করছেন। তিনি সম্প্রতি বিচারপতি নিজামূল হকের স্কাইপী সংলাপ ছেপে দেশের ইসলামপন্থিদের কাছে সুনাম অর্জন করেছিলেন,আর সে মুহুর্তটিকে তিনি বেছে নিয়েছেন একাত্তর নিয়ে নিজের সেক্যুলার ব্যাখ্যা ছড়ানোর মোক্ষম সময় রূপে।
সেক্যুলারিস্ট ও ন্যাশনালিস্টের কথা, পাকিস্তানে স্বৈরাচার ও শোষণ ছিল। অতএব একত্রে থাকা অসম্ভব ছিল। এটি সত্য যে, পাকিস্তানে স্বৈরাচার ছিল। কিন্তু স্বৈরাচার তো বাংলাদেশেও আছে। বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরাচার কি পাকিস্তানের স্বৈরাচারের চেয়েও কম স্বৈরাচারি? আজকের পাকিস্তান তো বাংলাদেশের চেয়ে বহু গণতন্ত্রি। তাছাড়া পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ এবং ১৯৭১’য়ে জেনারেল ইয়াহিয়া যে মাপের নির্বাচন দিয়েছিল সেটি কি বাংলাদেশে আশা করা যায়? কোন কালেই পাকিস্তানে একদলীয় বাকশাল চাপানো হয়নি, সেটি বাংলাদেশে হয়েছে। মুজিব আমলে যেমন ৩০ হাজার রাজনৈতীক কর্মিকে হত্যা করা হয়,অথচ পাকিস্তানে এমন কুকর্ম কোন সরকারের পক্ষ থেকেই ঘটেনি। এমনকি মুজিবকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে -সে অভিযোগও খোদ মুজিবের মুখে কোন সময় শোনা যায়নি। আজ যেরূপ রাজনৈতীক বন্দীদের হাতপায়ে ডান্ডাবেরি পড়ানো হয়, সেটিও সে সময় হয়নি। পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য মুজিব ভয়নাক অপরাধী রূপে প্রমাণিত হলেও তাকে জেলে ফাস্ট ক্লাস দেয়া হয়েছে। ১৯৭১’য়ে তাকে যখন জেলে নেয়া হয়,তখন তার পরিবারের জন্য ভরন পোষন দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানে অনেক ব্যর্থতা ছিল, কিন্তু সেজন্য কি দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বপাকিস্তানীরা কি কম দায়ী? অবাঙালীদের হাতে পূর্ব পাকিস্তানে শতাধিক শিল্প-কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু কোন বাঙালী কি একখানি কারখানাও পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করেছে? তাছাড়া স্বৈরাচারের কারণে কোন দেশের ভূগোলকে কি দায়ী করা যায়? বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সন্ত্রাস আছে বলেই কি আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা বৃহত্তর সিলেট জেলাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে হবে? বা বাংলাদেশ ভেঙ্গে চট্টগ্রামকে আলাদা করতে হবে? মুসলিম দেশভাঙ্গা জায়েজ গণ্য হলে বহু আগেই বিশাল মুসলিম খেলাফত ভেঙ্গে হাজার বছর আগেই শ’খানেক বাংলাদেশ নির্মিত হতো। খেলাফত তো বেঁচেছিল নানা ভাষাভাষি মুসলমানদের ঈমানী বন্ধনের কারণে। সে ভূগোল পাহারা দেয়ার জন্য তখন কি বিশাল সেনাবাহিনী ছিল? ছিল কি আজকের মত এত ক্যান্টনমেন্ট, সামরিক লজিস্টিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা?
বিপদ অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার
কিছু কাল আগে জার্মানীর নেত্রী চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল মূল্যবান নসিহত খয়রাত করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি ড্যাভিড ক্যামরনকে। ক্যামেরান তাঁর দেশ গ্রেট ব্রিটেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ইংরেজদের একসময় বিশ্বজো্ড়া সাম্রাজ্য ছিল, সে সাম্রাজ্যে কোন সময় সূর্য অস্ত যেত না। সে গর্ব নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউনাইটেড স্টেটস অব ইউরোপের সামান্য প্রদেশ হতে তার শরমে বাধে। এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ক্যামেরনকে বলেছেন, পৃথিবীটি খুবই গোলমেলে কঠিন জায়গা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বিশ্বরাজনীতিতে গ্রেট ব্রিটেন কোন পাত্তাই পাবে না। সম্প্রতি ব্রিটেনবাসীদের উদ্দেশ্যে নসিহত দিতে গিয়ে একই সুরে কথা বলেছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তিনি বলেছেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমাদের সামনে ইস্যু ছিল: যুদ্ধ অথবা শান্তি এ দুটির একটিকে বেছে নেয়া। আমরা শান্তির পথ বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন কথা হলো, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে আমরা বিশ্বরাজনীতিতে relevant অর্থাৎ প্রাসঙ্গিক থাকবো না; irrelevant তথা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বো।” তাই তিনি নসিহত করেন, ব্রিটেনবাসীকে ইউরোপীয় রাজনীতির কেন্দভূমিতে থাকার।
এ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও টনি ব্লেয়ার যেটি আজ বুঝেছেন সেটি সহরোয়ার্দী, নাজিমুদ্দীন, ফজলুল হল, আকরাম খাঁ, তমিজুদ্দীন খাঁ, আব্দুস সবুর খান,নুরুল আমীন বুঝেছিলেন ১৯৪৭ সালেই। নবাব সলিমুল্লাহ বুঝেছিলেন আরো আগে। তাই তিনি সর্বভারতের মুসলিম নেতাদের ঢাকাতে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা তখন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে থাকার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এসব দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতাগণ শুধু উপমহাদেশের নয়, বিশ্বের মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে থাকার চেষ্টায় ছিলেন। কারন পাকিস্তান ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তারা বাঙালী মুসলমানদের জন্য যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। অথচ ইসলামে অঙ্গিকারশুণ্য আওয়ামী কাপালিকরা সেটি সম্পূর্ণ পণ্ড করে দেয়। তারা বেছে নেয় মুসলিমদের দুর্বল করার পথ। আর তাতে সহায়তা দিতে দ্রুত এগিয়ে প্রতিবেশী কাফের রাষ্ট্র ভারত। বাংলাদেশের জন্য প্রাপ্য নদীর ন্যায্য পানি বা চুক্তিমোতাবেক পাওনা তিন বিঘা করিডোর দিতে ভারত রাজী না হলে কি হবে,পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য বিপুল অর্থ ও অস্ত্রের বিনিয়োগ করে।
প্রশ্ন হলো,পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী রূপে পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাজিমুদ্দীন, বগুড়ার মহম্মদ আলী বা শহীদ সহরোয়ার্দী বিশ্বরাজনীতিতে যে গুরুত্ব পেতেন সেটি কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পায়? হোয়াইট হাউসে তাদের দাওয়াত দিয়ে নেয়া হত। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের লবিং কোম্পানীগুলোকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ফি দিয়ে তোষামদে লাগিয়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখানে প্রবেশের সুযোগ পায় না। বরং অপমান এতটা বেড়েছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কলকাতার সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী রূপে আখ্যায়ীত হয়েছিলেন –যেরূপে আখ্যায়ীত করা হয় ভারতের ত্রিপুরা, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, সিকিম, মেঘালয়, মিজোরাম রাজ্যের সরকার প্রধানদেরকে। খোদ ভারতের কাছেও বাংলাদেশ কতটা ইজ্জতহীন সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে?
বিশ্বরাজনীতির উত্তাল বিশাল সমুদ্রে ডিঙ্গি নৌকা নয়, বিশাল জাহাজ ভাসাতে হয়। আওয়ামী লীগের নৌকা বাংলার খাল-বিলে ভাসানো যায়, কিন্তু সেটি কি বিশ্বরাজনীতির বিশাল সাগরেও পাত্তা পায়? বরং বাংলাদেশ আজ ভারতের কাছেও গুরুত্ব পাচ্ছে না। বিশ্ব রাজনীতিতে দূরে থাক, মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ওআইসির কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে গত ৪০ বছরে স্থান পায়নি। পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছরে কোন বাঙালী মুসলমান কি সীমান্তে গুলির খাদ্য হয়েছে? পাকিস্তানের সীমান্তে ভারতের বিএসএফের কি গুলি ছুড়ার সাহস আছে? অথচ বাংলাদেশে কিশোরী ফালানীকে হত্যা করে তারা কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে পোষ্টার বানিয়েছিল। বার্মার আরকানে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমান কি পাকিস্তানী আমলের ২৩ বছরে কখনো ঘরহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে? হয়েছে কি গুলির খাদ্য? অথচ এখন হচ্ছে। কারণ তারা জানে বাংলাদেশ একটি মেরুদণ্ডহীন শৃঙ্খলিত রাষ্ট্র। নাই প্রতিবাদের সাহস। ভারত সে সামর্থ চূর্ণ করেছে ১৯৭১’য়েই।
আওয়ামী সেক্যুলারিষ্টদের অপরাধ অনেক। বাংলাদেশকে তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি বা বিশ্বের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্ত দেশ রূপে পরিচিত করাটাই তদের প্রধান অপরাধ নয়। বরং সেটি হলো,বাংলার মুসলমানগণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক হওয়ার কারনে ১৯৪৭থেকে বিশ্বরাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সে সুযোগ পেয়েছিল তা থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত করেছে। সে সাথে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভারতের গোলামীর জিঞ্জিরে। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আরেক কাশ্মীরে। আজ হোক কাল হোক -এনিয়ে তাদের এ অপরাধের ব্চিার হবেই। পাকিস্তানের বিভক্তিটি ছিল ন্যাশনালিস্ট, সোসালিস্ট,সেক্যুলারিস্টদের প্রজেক্ট। এ প্রজেক্টের পক্ষে অর্থ, অস্ত্র ও পরিকল্পনা এসেছে প্রতিবেশী কাফের রাষ্ট্র থেকে। ফলে ইসলামের বিশ্বব্যাপী গৌরব নিয়ে যারা ভাবেন, মুসলিম উম্মহকে যারা আবার সিভিলাইজেশনাল ফোর্স হিসাবে খাড়া করতে চান -তারা এ প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিল না। পঞ্চাশের দশকের ইরানের প্রধানমন্ত্রি শরিফ মোসাদ্দেক মুজিবের চেয়ে অনেক বেশী সৎ ও দেশীপ্রেমিক নেতা ছিলেন। তিনি বিদেশী তেল কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন। স্বৈরাচারি শাহকেও বিতাড়িত করে দেশকে প্রজাতন্ত্রি করেছিলেন। কিন্তু এরপরও ইরানের ইসলামিস্টগণ তাঁকে মাথায় তুলেনি। কারণ মোসাদ্দেকের অপরাধ, তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। ইসলামে জাতীয়তাবাদী হওয়াটি মুর্তিপূজার চেয়ে কম জঘন্য নয়। মুসলিম বিশ্বের বুকে সবচেয়ে বড় বড় অপরাধগুলো পৌত্তলিকদের হাতে হয়নি। হয়েছে ভাষা, বর্ণ, ভূগোল-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দুর্বত্তদের হাতে। আজ ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়ায় যা কিছু হচ্ছে -তা তো জাতীয়তাবাদের কামাই। এরাই ধ্বংস করেছে ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান খেলাফত –যার প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল খোদ নবীজী(সাঃ)র হাতে। আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, মুসলিম ঐক্য ও মুসলিমদের বিজয় নিয়ে সেক্যুলারিস্টদের সামান্যতম অঙ্গিকার থাকলে একাত্তর নিয়ে তাদের মূল্যায়নটি ভিন্নতর। মুক্তিবাহিনী নয়, রাজাকারগণ শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে চিত্রিত হতো।
ইঁদুর বিশাল রুটির কিছুটা মুখে পুড়ে গর্তে ঢুকে, সমগ্র রুটি নিয়ে সে ভাবে না। জাতিয়াবাদী ইঁদুরেরাও তেমনি মুসলমানদের বহু রক্ত, বহু অর্থ ও বহু প্রাণের বিনিময়ে গড়া বিশাল ভূগোল থেকে যেটুকু মুখে ঢুকে সেটুকু নিয়ে গর্তে ঢুকেছে। অথচ এ বিশাল ভুগোল গড়তে মুসলমানদের শত শত বছর লেগেছিল। মুজিব তাই সমগ্র পাকিস্তানের কল্যাণ নিয়ে ভাবেনি। আরব বিশ্ব এদের কারণেই আজ বাইশ টুকরোয় বিভক্ত। এমন ইঁদুরগণ কি দেশেবিদেশে সম্মান পায়? গর্তের এ কীটগুলো কি বিশ্বরাজনীতির মধ্যমঞ্চে আসতে পারে? এমন বন্দীদশায় থেকে কি একতা গড়া যায়? অথচ ইসলাম তো এরূপ গর্ত থেকে বেরিয়ে উম্মতে ওয়াহেদা গড়ার নির্দেশ দেয়। বলে,বিভক্তির দেয়াল গুড়িয়ে দিতে;এবং নিষেধ করে ভূগোলে হাত দিতে। ভারতের বাঙালী, পাঞ্জাবী, মারাঠী, বিহারী, গুজরাতি, উড়িয়া, আসামী, মাদ্রাজী হিন্দুরা নিজ নিজ ভাষার পরিচয় নিয়ে কি পৃথক পৃথক রাষ্ট্রের দেয়াল গড়েছে? ভারতের বিশাল অঙ্গণে হিন্দুরা যেভাবে মুক্তভাবে চলাফেরা, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে,বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারণে মুসলিম বিশ্বে কি সেটি সম্ভব? অথচ অধিকাংশ মুসলিম দেশ তো এদের হাতেই অধিকৃত। বাংলাদেশের ভারতপন্থি সেক্যুলারিস্টগণ তাদের প্রভুদের থেকে অন্তত এ শিক্ষাটি নিলে বাঙালী মুসলমানেরা অনেক লাভবান হতো। তাতে নিস্কৃতি মিলতো শুধু একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও বিভক্তি থেকেই নয়, বরং ১৯৭৩’য়ে তলাহীন “ভিক্ষার ঝুলি”র অপমান, চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ, দুর্ভিক্ষে বহু লক্ষ মানুষের মৃত্যু, পঁচাত্তরে গণতন্ত্র হত্যা ও আজকের স্বৈরাচারি দুর্বৃত্তদের দুঃশাসন থেকেও। ১ম সংস্করণ ২৬/১২/১২; ২য় সংস্করণ ৩/১১/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018