রাষ্ট্র কিরূপে জান্নাতের বাহন হয় ও জনগণ কিরূপে জান্নাতের যোগ্য হয়?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ঈমান ও নেক আমল: জান্নাতের চাবি

মহান আল্লাহতায়ালার কাছে  সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তির ঈমান ও তাঁর আমেলুস সালেহ তথা নেক আমল। পবিত্র কুর’আনের কোন কোন আয়াতে শুধু ঈমানকে মাগফিরাত লাভ ও জান্নাত লাভের চাবি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার কোথাও ঈমান ও আমেলুস সালেহকে জান্নাতের চাবি বলা হয়েছে। লক্ষণীয় হলো, সে আয়াতগুলিতে ঈমান ও নেক আমলের পাশে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের কথা বলা হয়নি। উল্লেখ না করার কারণটিও সুস্পষ্ট। মাথা টানলে নাক, মুখ, চোখ ও কান সবকিছুই আসে; ফলে আলাদা ভাবে নাক, মুখ, চোখ ও কান টানার কথা না বললেও চলে। যে ব্যক্তি মুমিন তাঁর জীবনে নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদ তো থাকবেই। ফলে উপরিউক্ত আয়াতে সেগুলির আলাদা উল্লেখ নাই।

সুরা হাদীদের ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা গুরুত্ব দিয়েছেন শুধু ঈমানের উপর। যে ঈমান আনলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর তাদেরকে সিদ্দিক ও শহীদদের মর্যাদা দিয়েছেন। আর শহীদ তো তারাই যারা বিনা হিসাবে জান্নাত পায়। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে:

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦٓ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصِّدِّيقُونَ ۖ وَٱلشُّهَدَآءُ عِندَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَكَذَّبُوا۟ بِـَٔايَـٰتِنَآ أُو۟لَـٰٓئِكَ أَصْحَـٰبُ ٱلْجَحِيمِ     

অর্থ: “এবং যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, এরাই হলো তারা -যারা সিদ্দিক ও শহীদ। এবং আল্লাহর কাছে তাদের জন্য রয়েছে প্রতিদান এবং নূর। এবং যারা কুফুরি করলো এবং আল্লাহর দ্বীনকে মিথ্যা বললো, -তারাই হলো জাহান্নামের বাসিন্দা।”   

প্রশ্ন হলো, যে ঈমানের কারণে মহান আল্লাহতায়ালা তার বান্দাকে সিদ্দিক ও শহীদের মর্যাদা দিবেন, সে ঈমান কি শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল, আসমানী কিতাব, আখেরাত ও জান্নাত-জাহান্নামের উপর বিশ্বাস? এরূপ বিশ্বাস তো বাংলাদেশের বহু ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাবাদী ও প্রতারকও রাখে। সে ঈমান কি সিদ্দিক ও শহীদের মর্যাদা দেয়? পুরস্কৃত করবে আখেরাতে? বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ঈমানকে যে ভাবে বুঝে সেটিই কি প্রকৃত ঈমান? ঈমানের প্রকৃত অর্থ বুঝতে হলে সেটি বুঝতে হবে খোদ মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। ঈমানের সংজ্ঞা দিয়েছেন মহান আল্লাহতায়ালা নিজে এবং সেটি সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ 

অর্থ: “মুমিন তথা ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর এবং অতঃপর তা নিয়ে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব করলো না এবং নিজেদের সম্পদ ও প্রাণ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করলো। ঈমানের দাবীতে এই লোকগুলিই হলো সত্যবাদী।” তাই ঈমান শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস নয়, বরং সে বিশ্বাসের সাথে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার জিহাদ নিয়ে বাঁচা। সে জিহাদ যেমন নিজের মাঝে ও অন্যদের মাঝে বিরাজমান জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে, তেমনি মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলে এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠায়। কিন্তু যে ঈমান ব্যক্তির জীবনে সে জিহাদ উৎপাদন করে না এবং নেক আমলেও উদ্যোগী করে না -সেটি ঈমান নয়। সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে সে কথাটিই বলা হয়েছে। বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয় একই সুরার ১৪ নম্বর আয়াতের দিকে নজর দিলে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে:

۞ قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّا ۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَـٰكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَـٰنُ فِى قُلُوبِكُمْ ۖ وَإِن تُطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَـٰلِكُمْ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ رَّحِيمٌ

অর্থ: “আরবগণ বললো, তারা ঈমান এনেছে। হে নবী, আপনি বলুন, “তোমরা ঈমান আনো নাই। বরং বলো, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।” ঈমান এখনো তোমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে নাই। এবং যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অনুসরণ করো, তোমাদের আমলের কিছুই কমতি করা হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।”  

 

বাঙালি মুসলিমের এতো ব্যর্থতা কেন?

মুসলিম শব্দটির “আসলামা” ক্রিয়া পদের বিশেষ্য রূপ। “আসলামা” শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা। অর্থাৎ যে ইসলামে আত্মসমর্পণ করে সেই মুসলিম হয়।  প্রশ্ন হলো, মুসলিম এবং মুমিনের মধ্য পার্থক্যটি কি? আত্মসমর্পণের বিষয়টি হলো মুখ দিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে সাক্ষ্য দান। সে সাক্ষ্য দানের কাজটি হয় কালেমায়ে শাহাদত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে, সে সাক্ষ্যদানের ফলে একজন ব্যক্তি মুসলিমে পরিণত হয়। আইনের চোখে সে ব্যক্তি একজন মুসলিম। সে সাক্ষ্যদানের সাথে তার হৃদয়ে তথা মনের গভীরে কতটা পরিবর্তন আসলো সেটি দেখা হয়না। দেশে আইন সেটি দেখে না। কিন্তু ঈমানদার হতে হলে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে সাক্ষ্য দান দিলে চলে না, তাকে ইসলামের পথে আরো সামনে এগুতে হয়। তাকে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার নিয়তকে হৃদয়ে ধারণ করে জিহাদের পথে নামতে হয় এবং সে জিহাদে নিজের অর্থ, সময়, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করতে হয়। একমাত্র তখনই সে ব্যক্তিকে প্রকৃত ঈমানদার বা মুমিন বলা হয়। ঈমানদার হতে যারা ব্যর্থ হয় তাদেরই অনেকে মুনাফিকে পরিণত হয়। উপরিউক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায়, মুমিন হলো একমাত্র সে ব্যক্তি যার জীবেন থাকে ঈমানের সাথে আল্লাহ তায়ালার পথে জিহাদ।   

পবিত্র কুর’আনে ঈমানের সাথে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নেক আমলের। যারা ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো, তাদেরকে মাগফিরাত ও উত্তম প্রতিদানের কথা সুখবর শোনানো হয়েছে। সে কথা ঘোষিত হয়েছে সুরা আনকাবুতের ৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّـَٔاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ ٱلَّذِى كَانُوا۟ يَعْمَلُونَ

অর্থ: “এবং যারা ঈমান আনলো এবং নেক আমল করলো, অবশ্যই আমি তাদের দোষগুলিকে মিটিয়ে দিব এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করবো তারা যা করেছিল তার চেয়ে উত্তম কিছু দিয়ে।”‍  সুরা আনকাবুতের নম্বর ৯ আয়াতে বলা হয়েছে:

      وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِى ٱلصَّـٰلِحِينَ

অর্থ: “এবং যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, আমরা অবশ্যই তাদেরকে নেকবান্দাদের সান্নিধ্যে পৌছাবে। তথা জান্নাতে পৌঁছাবো।”  

উপরিউক্ত আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর হওয়া এবং জান্নাত পাওয়ার জন্য জরুরি যেমন ঈমানদার হওয়া, তেমনি জরুরি হলো নেক-আমলকারী হওয়া। কথা হলো আমেলুস সালেহা তথা নেক আমল বলতে কি বুঝায়? যা কিছু ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর -তা সবই নেক আমল। তবে সবচেয়ে বড় নেক আমল হলো সেটি যা আখেরাতে জান্নাতে নেয় বা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। অর্থ দান, বস্ত্র দান, গৃহ দান, চিকিৎসা দান -এমন কি রাস্তা থেকে একটি কাঁটা সরানোও নেক আমল। তবে এ পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বড় নেক আমল হলো জিহাদ। কারণ, জিহাদই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার হাতিয়ার। এ জিহাদই ব্যক্তিকে তাঁর রবের সাথে একাত্ম করে। এ জিহাদ যেমন আখেরাতে জান্নাতে নেয় তেমনি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। সে জিহাদটি যেমন জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ হতে পারে, তেমনি হতে পারে দুর্বৃত্ত শক্তির নির্মূল ও সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ও সামরিক লড়াই। জিহাদ হলো পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের লড়াই। জিহাদ এখানে অগণিত জনগণকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর। এমন জিহাদ রাষ্ট্রকে জান্নাতের বাহনে পরিণত করে। তাই এ পৃথিবীতে জিহাদের চেয়ে উত্তম নেক আমল আর কি হতে পারে?

একটি সমাজ কতটা বর্বরতামুক্ত সভ্য ও সুন্দর হবে -তা নির্ভর করে সে সমাজে কতটা জিহাদ সংগঠিত হলো এবং সে জিহাদ কতটা বিজয়ী হলো -তার উপর। এমন জিহাদের কারণেই গৌরব যুগের মুসলিমদের হাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল। যে দেশে জিহাদ নাই সে দেশে মসজিদ ও মাদ্রাসা যতই নির্মিত হোক না কেন, সে দেশে সভ্য মানুষ, সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মিত হয় না। রাষ্ট্র তখন জাহান্নামের বাহনে পরিণত হয়। এমন দেশে মুসলিমের সংখ্যা যতই হোক, বুঝতে হবে সে দেশে প্রকৃত ঈমানদারদের সংখ্যা অতি নগন্য। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে তেমন একটি দেশে।

ইসলামের এজেন্ডা মানুষকে শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজী বানানো নয়, বরং মূল এজেন্ডা হলো প্রকৃত ঈমানদার তথা মুমিন বানানো। এবং মুমিন তথা ঈমানদার হওয়ার অর্থ আল্লাহভীরু, সভ্য ও সৎকর্মশীল হওয়া। একমাত্র তখনই মুসলিম দেশে দুর্নীতিমুক্ত সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠে। অথচ বাংলাদেশে বহু লক্ষ মসজিদ ও কোটি কোটি নামাজী, রোজাদার তৈরী হলেও ঈমানদার বানানোর কাজটি হয়নি। ফলে সম্ভব হয়নি দেশ থেকে দুর্বৃত্তির প্লাবন দূর করা। মুমিন না হওয়াতে নামাজ-রোজা পালন করেও অনেকে ঘুষ খায়, মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে এবং রাজনীতির ময়দানে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।  এরূপ ব্যর্থতা মূল কারণ, ঈমানদার মানুষ গড়ার কাজটি মহান আল্লাহ তায়ালা যেখান থেকে শুরু করেছিলেন বাংলাদেশে সে কাজটি শুরু থেকেই সেখান থেকে হয়নি। মহান আল্লাহ তায়ালা সে কাজটির শুরু করেছিলেন কুর’আনী জ্ঞানার্জনকে প্রতিটি নর-নারীর উপর ফরজ করে। সে কুর’আনী জ্ঞানের মাধ্যমেই ব্যক্তির হৃদয়ে প্রবেশ করে ইসলামের মূল বাণী, সে তখন বুঝতে পারে মহান আল্লাহ তায়ালার মূল এজেন্ডা; তখন সৃষ্টি হয় সে এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার তাড়না। একমাত্র এ পথেই একজন মুসলিম ব্যক্তি পরিপূর্ণ মু‌’মিন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।  না বুঝে তেলাওয়াতে ঈমানদার বানানোর সে কাজটি হয় না। বাংলাদেশের মুসলিমদের এজন্যই এতো ব্যর্থতা। তারা কুর‌’আন পড়ে ও মুখস্থ করে বটে, কিন্তু না বুঝার কারণে কুর’আনের বাণী তাদের হৃদয়ে ঢুকে না। আর যে কুর’আন তারা বুঝে না, সে কুর’আনের সাথে তারা একাত্ম হবে কি করে? পবিত্র কুর’আন তো আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার কথা বলে। ফলে নিয়মিত নামাজ-রোজা পালন করলেও মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে তাদের দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে।

পবিত্র কুর’আন হলো সিরাতাল মুস্তাকীম তথা জান্নাতের রোডম্যাপ। রোডম্যাপ না বুঝে কি রোডম্যাপকে অনুসরণ করা যায়? বিচ্যুতি তখন অনিবার্য হয়ে উঠে। বাঙালি মুসলিম জীবনে সে বিচ্যুতিটি প্রবল ভাবে দেখা যায় জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী ও বামধারা সেক্যুলার রাজনীতির স্রোতে বিপুল সংখ্যায় ভেসে যাওয়া দেখে। ১৯৭১’য়ে সে বিচ্যুতিটি দেখা গেছে পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী ভারতের সাথে একাত্ম হওয়া দেখে। তারা যদি কুর’আনের পথে থাকতো তবে কি তারা এভাবে ভারতের কোলে গিয়ে উঠতো?

 

যে পথ বিজয় আনে ও জান্নাতে নেয়

আজ যারা বাংলাদেশের কল্যাণ চায়, তাদের কাজের শুরুটি হতে হবে সে পথেই যে পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন নবীজী (সা:) এবং তাঁর যুগের আরব মুসলিমগণ। বিশুদ্ধ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে সেটিই হলো নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। সে সূন্নতের মূল কথাটি হলো, মুসলিমদের মুসলিমের স্তরে না রেখে তাদেরকে মু’মিনের স্তরে পৌঁছানোর কাজটি প্রথমে করতে হয়। সে কাজটি দেশে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যায় বৃদ্ধি এনে সম্ভব নয়। শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজীর সংখ্যা বাড়িয়েও সম্ভব নয়। অসংখ্য মানুষ নামাজী, রোজাদার ও হাজী হয়েও বেঈমান হয় এবং রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে ইসলামের শত্রুতে পরিণত হয়। তাই আরব মুসলিমদের শুধু কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করিয়ে দায়িত্ব পালন শেষ করেননি; নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দিয়েও তাদের যাত্রা শুরু হয়নি। বরং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করার আগে তাদের উপর পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছিল।

আলোর শিখা যেমন রাতের অন্ধকার দূর করে, কুর’আনী জ্ঞানের আলো তেমনি দূর করে মনের অন্ধকার। এ ক্ষুদ্র মানব জীবনের সবটুকুই সময়ই যুদ্ধময়; তবে এ জীবনের প্রথম যুদ্ধটি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধটি হয় জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে। জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে এ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধকে সুরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে জিহাদে কবির তথা বড় জিহাদ বলা হয়েছে। এ জিহাদের মূল অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন। এ যুদ্ধে যারা পরাজিত হয় তাদের পক্ষে অসম্ভব হয় সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা। তারা চলে জাহান্নামের পথে। অপর দিকে যারা বিজয়ী হয় জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদে, তারাই ইসলামকে বিজয়ী করার প্রতিটি রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সশস্ত্র জিহাদের মুজাহিদ হয়।  

কাউকে মুসলিম থেকে মুমিনের পর্যায়ে তুলতে হলে তার হাতে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের অস্ত্র পবিত্র কুর’আনকে তুলে দিতে হয়। তাই মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো কুর’আন থেকে জ্ঞানদান। এবং সেটি হতে বাল্যকাল থেকেই। এখানে অবহেলা হলে শয়তান তার উপর অধিকার জমিয়ে নেয়; ফলে পরবর্তীতে অতি কঠিন হয় তাকে জান্নাতের পথে নেয়া। তাই পিতামাতার উপর অর্পিত  সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি সন্তানকে শুধু পানাহার দেয়া নয়, বরং তাকে কুর’আনের জ্ঞান দেয়া। সন্তানের জন্য বিশাল সহায় সম্পদ রেখে না গেলেও সে জাহান্নামে যাবে  না, কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচা তার জন্য কঠিন হবে -যদি সে কুর’আনের জ্ঞান না পায়। তাই সন্তান যদি জাহান্নামে যায় তবে রোজ হাশরের বিচার দিনে পিতা-মাতাকেও আসামীর কাটগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং জবাব দিতে হবে দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য। শিশুকে চোখের সামনে পানিতে পড়তে দেখে না বাচানো কবিরা গুনাহ। তেমনি কবিবরা গুনাহ হলো নিজ সন্তানকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য কুর’আনের জ্ঞান না দেয়া। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালা যখন কাউকে সন্তান দেন তখন বুঝতে হবে তাঁর জীবনে পরীক্ষাও শুরু হয় অভিভাবক রূপে সে কতটা সফল -সেটির। জান্নাতে যেতে হলে এ পরীক্ষাতেও পাশ করতে হয়।  

মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মিথ্যা ও অসত্যের বিরুদ্ধে আমৃত্যু জিহাদ নিয়ে বাঁচা। প্রাথমিক পর্যায়ে সে জিহাদটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক। যার হাতে সে জিহাদের অস্ত্র কুর’আন নাই, তার জন্য পরাজয় সুনিশ্চিত। সে ভেসে যায় সমাজে বহমান জাহিলিয়াতের স্রোতে। বাঙালি মুসলিমদের হাতে সে জিহাদের অস্ত্রটি তুলে দেয়ার কাজটি আদৌ হয়নি। তাদেরকে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে, কিন্তু কুর‌’আনী জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব বুঝানো হয়নি। কুর’আন থেকে জ্ঞান আহরণের সামর্থ্য না বাড়িয়ে শুধু তেলাওয়াতের সামর্থ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে তাদের পরাজয়টি সর্বত্র। তারা ভেসে গেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও বাম ধারার রাজনীতির স্রোতে। ভাসতে ভাসতে তারা এমন কি চিহ্নিত শত্রুদের কোলে গিয়েও উঠেছে এবং তাদের অধিনত সৈনিকে পরিণত হয়েছে -একাত্তরে যেমনটি দেখা গেছে বহু হাজার বাঙালি মুসলিমের জীবনে।

গৌরবের যুগে আরব মুসলিমদের বিজয়ের মূল কারণ, তাদের মুসলিম জীবনের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল সবচেয়ে বড় জিহাদটির মধ্য দিয়ে। নামাজ-রোজা ফরজ করার আগে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় সে জিহাদের অস্ত্র পবিত্র কুর’আন। ইসলাম কবুলের প্রথম দিন থেকেই প্রতিটি নর ও নারীর উপর সে কুর’আন থেকে শিক্ষালাভকে ফরজ করা হয়। অথচ ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও মাহে রমযানের এক মাস রোজা ফরজ করা হয়েছে নবীজী (সা:)’র নবুয়ত প্রাপ্তির ১১ বছরের বেশী কাল পর। এর অর্থ, আরব মুসলিমদের যাত্রা শুরু হয় জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল দিয়ে। ফলে নামাজী হওয়ার বহু আগেই তাদের মুজাহিদ হতে হয়। সে জিহাদে লিপ্ত থাকার ফলে তারা শক্তি পায় রাজনৈতিক ও সশস্ত্র জিহাদের। সে জিহাদের বরকতেই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ হয়েছিল এবং মুসলিমগণ দ্রুত বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সর্বকালের মুসলিমদের জন্য সেটিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নত। বাঙালি মুসলিমদের সামনেও ঈমানদার হওয়া এবং স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও গৌরব নিয়ে বাঁচার এ ছাড়া ভিন্ন পথ আছে কি?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *