রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ফিতনা কেন মানব হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ?

রাষ্ট্র যেমন হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমলের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার, তেমনি হতে পারে অতি ভয়াবহ পাপ কর্মের নৃশংসতম হাতিয়ার। রাষ্ট্র হতে পারে ফিতনা সৃষ্টির হাতিয়ারও। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয় জাহান্নামের বাহনে -যেমনটি হয়েছে ফিরাউন-নমরুদদের ন্যায় দৃর্বৃত্তদের শাসনে। এজন্যই ইসলামে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ নয়, সেটি হলো দুর্বৃত্তদের শাসনের নির্মূল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ। একাজ ইসলামে পবিত্র জিহাদ -যা শাহাদতের তথা আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পাওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। এজন্যই নবীজী (সা:)’র  অর্ধেকের বেশী সাহাবা ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণে এবং সে রাষ্ট্রের সুরক্ষায় শহীদ হয়ে গেছেন। মুসলিমদের পরাজয়ের শুরু তখন থেকেই যখন মুসলিমগণ সে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতে আগ্রহ হারিয়েছে।

পবিত্র কুর’আনে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা ফিতনাকে মানব হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ রূপে চিহ্নিত করেছেন। এটি মগজে ধাক্কা দেয়ার মত ঘোষণা। সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বয়ান এসেছে পবিত্র কুর‌’আনে। যেমন সুরা বাকারায় এবং সুরা আল ইমরানে। সুরা বাকারাতে বলা হয়েছে:

وَٱلْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ ٱلْقَتْلِ ۚ وَلَا تُقَـٰتِلُوهُمْ عِندَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَـٰتِلُوكُمْ فِيهِ ۖ فَإِن قَـٰتَلُوكُمْ فَٱقْتُلُوهُمْ ۗ كَذَٰلِكَ جَزَآءُ ٱلْكَـٰفِرِينَ

অর্থ: “ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। তোমরা তাদের সাথে মাসজিদে হারামের নিকট যুদ্ধ করবে না -যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ করে।  যদি তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ করে তবে তোমরা তাদেরনকে হত্যা করবে। কাফিরদের জন্য সেটিই পরিণাম।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ১৯১)।  একই রূপ কুর’আনী ঘোষণা এসেছে এভাবে:

وَٱلْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ ٱلْقَتْلِ ۗ وَلَا يَزَالُونَ يُقَـٰتِلُونَكُمْ حَتَّىٰ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ ٱسْتَطَـٰعُوا۟

অর্থ: “হত্যা অপেক্ষা ফিতনা অধিক অন্যায় কর্ম। তারা অর্থাৎ কাফিরগণ তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অবিরাম করতেই থাকবে যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে না নেয় -যদি সেটি সম্ভব হতো।” -(সুরা বাকারা, আয়াত ২১৭)।

মানুষের আদালতে সাধারণতঃ কাউকে হত্যা করা গণ্য হয় সবচেয়ে বড় অপরাধ রূপে। পৃথিবীর যে কোন দেশের আদালতে খুনের মামলার শাস্তি তাই সবচেয়ে কঠোর। এটিই মানুষের বিচার। কিন্তু সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার বিচারটি ভিন্ন। খুনের চেয়েও গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে ফিতনা। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে রায়টি ঘোষিত হয়েছে উপরিউক্ত দু’টি আয়াতে। সে রায়ে ফিতনাকে মানব-হত্যার চেয়েও অধিকতর গর্হিত অপরাধ বলা হয়েছে। যে কোন মানুষের কাছেই প্রশ্ন জাগবে, কেন এরূপ বিচার? বিষয়টি গভীর ভাবে ভাববার ও অনুধাবনের বিষয়। এ বয়ানের মাঝে রয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। মহান আল্লাহতায়ালার এ বয়ানের সত্যতা বুঝতে হলে প্রথমে ফিতনার সঠিক অর্থ এবং তার বিপদটি বুঝতে হবে। একমাত্র তখনই বুঝা যাবে এ বিচারে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার হিকমার ও প্রজ্ঞার গভীরতা। তখন বুঝা যাবে ফিতনা কেন হত্যার চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ।

ফিতনার আভিধানিক অর্থ বহুবিধ। ফিতনা শব্দের উৎপত্তি ফাতানা ক্রিয়াপদ থেকে। J.G. Hava রচিত  Arabic English Dictionery for Advanced Learners অনুসারে ফাতানার অর্থ হলো: to rouse anyone to rebellion, to seduce, to allure, to decieve anyone. ফিতনা বলতে বুঝায়: কাউকে ইসলামের বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে বা পাপে উস্কানি দেয়া বা সে কাজে প্রলুব্ধ করা। অর্থাৎ কাউকে পূর্ণ ইসলাম পালনে বাধা দেয়া এবং তার জন্য পূর্ণ বা প্রকৃত মুসলিম হওয়া অসম্ভব করা। ফিতনা হতে পারে ইসলামের নামে কাউকে প্রতারিত করা এবং তার জন্য সিরাতাল মুস্তাকীম চলা অসম্ভব করা । সেটি হতে পারে কুর’আন-হাদীসের ভূল ব্যাখ্যা, পীর-মুরিদী, কবর পূজা, ফেরকাবাজীর মধ্য দিয়েও হতে পারে।  

বুঝতে হবে, যেখানেই মানব সন্তানদের বসবাস, সেখানেই সর্বক্ষণ বিচরণ শয়তান ও তার অনুসারীদেরও। শয়তানের এজেন্ডা হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির জন্য জান্নাতের পথে চলা অসম্ভব করা। এভাবে মানুষকে জান্নাতে নেয়ার মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে ব্যর্থ করে দেয়া। একাজে শয়তান ও তার অনুসারীদের এজেন্ডা বহুবিধ। তাদের মূল কাজটি হলো, নানাভাবে মুসলিমদের জন্য সিরাতাল মুস্তাকীম খুঁজে পাওয়া এবং সে পথে চলা অসম্ভব করা। সে লক্ষ্য অর্জনে শয়তান প্রথমে অসম্ভব করে মুসলিম সমাজে ও রাষ্ট্রে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানদান। তাই যেদেশের মানুষ কুর’আন বুঝে না এবং বুঝতে আগ্রহীও নয় -বুঝতে হবে সেদেশে শয়তান সফল হয়েছে ফিতনা সৃষ্টিতে। শয়তানী শক্তি ফিতনা সৃষ্টির কাজে হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মপালনের অঙ্গণকে। মানব জীবনে সবচেয়ে বড় বিপদটি ঘটে তখন যখন সে ফিতনার জালে আটকা পড়ে। তখন জান্নাতের পথ তথা সিরাতাল মুস্তাকীম হারাতে হয় এবং জাহান্নামে যেতে হয়।

ফিতনার অন্য একটি অর্থ হলো, কাউকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলা। এখানে পরীক্ষা হয় ব্যক্তির ঈমানের, তাকওয়ার ও প্রজ্ঞার। রণাঙ্গণে কাফির শত্রুকে সরাসরি অস্ত্র হাতে সামনে দেখা যায়। তাই যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে চিনতে বেশী বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন পড়ে না। তাই সে পরীক্ষায় সে সহজে পাশ করে। কাফির শত্রুর বিরুদ্ধে সে পবিত্র জিহাদে একজন অল্প জ্ঞানের মানুষও শহীদ হয় এবং সরাসরি জান্নাত পায়। কিন্তু রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ফেরকার অঙ্গণে কাফির শত্রুকে চিনতে তথা শয়তানের সৃষ্ট জাহান্নামের পথটি চিনতে এমন কি বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র-শিক্ষকগণও শূণ্য নাম্বার পেয়ে ফেল করে। পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া সহজ, কিন্তু কঠিন হলো শয়তানের বিছানো ফিতনার জাল থেকে বাঁচা। এজন্যই বাংলাদেশে ফিতনার জাল থেকে বাঁচতে ব্যর্থ হয় তারাও  যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিধারী। ফিতনার  জালে আটকা পড়ে এমন কি তারাও যারা নিয়মিত নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, দোয়া-দরুদ পালন করে এবং সমাজে আলেম, আল্লামা, ইমাম, মুফতি রূপে পরিচিত। ঈমানের পরীক্ষায় তাদের ব্যর্থ হওয়ার চিত্রটি সুস্পষ্ট ধরা পড়ে তখন, যখন তারা জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট, সেক্যুলারিস্ট, রাজতন্ত্রী ও স্বৈরাচারী শাসকের সমর্থক, কর্মী ও কলাবোরেটর হয়। ব্যর্থ হওয়ার সে চিত্রটি আরো বুঝা যায়, যখন তারা মুসলিম দেশ ভাঙ্গা নিয়ে বা মুসলিম বিশ্বের বিভক্ত মানচিত্র নিয়ে গর্ব করে।   

খুনিরা মানুষ খুন করে, কিন্তু তারা কাউকে জাহান্নামে নেয় না। খুনিরা সেরূপ নিয়েত নিয়ে কাউকে খুনও করেনা। কাউকে জাহান্নামে নেয়া তাদের এজেন্ডাও নয়। কিন্তু জাহান্নামে নেয়ার সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে শয়তানের অনুসারী ফিতনা সৃষ্টিকারীরা। অথচ কাউকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো যেমন এ জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ নেক কর্ম; তেমনি সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হলো কাউকে জাহান্নামে নেয়া। ফিতনা সৃষ্টিকারী সে অপরাধটিই করে। তারা সে অপরাধ কর্মটি করে মানবকে মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে। সেটি করে পূর্ণ ইসলাম-পালন ও পূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে অসম্ভব করে। ফিতনা সৃষ্টিকারীদের কারণেই বাংলাদেশের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নবীজী (সা:)’র প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বেঁচে নাই। বেঁচে আছে তাবলিগী ইসলাম, পীর-মুরিদীর ইসলাম, সুফিদের ইসলাম, দেওবন্দীদের ইসলাম, বেরেলভী ইসলাম, সালাফীদের ইসলাম, ইত্যাদি নানা নামের ইসলাম। নবীজী (সা:)’র ইসলাম যদি বেঁচে থাকতো তা হলে দেশটিতে শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল বাঁচতো না, দেখা যেত ইসলামী রাষ্ট্র, সে রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পেত মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব এবং আদালতে দেখা যেত শরিয়তী আইন। তখন প্রতিষ্ঠা পেত শুরা ভিত্তিক শাসন এবং সমাজে দেখা যেত দুর্বৃত্তির নির্মূলে ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় লাগাতর জিহাদ। তখন স্কুল-কলেজে দেখা যেত কুর’আন শিক্ষার আয়োজন এবং জনগণের মাঝে দেখা যেত ভাষা-বর্ণ-আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে প্যান-ইসলামী ভাতৃত্ব। আজ তো সে ইসলামের কোনটাই নাই। অথচ নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের আমলে ইসলাম তার পূর্ণ সামগ্রিকতা নিয়ে বেঁচেছিল। আজ মসজিদ-মাদ্রাসা বেড়েছে, মুসলিম নামধারীদের সংখ্যাও বেড়েছে, কিন্তু বেঁচে নাই নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত সে পূর্ণ ইসলাম। এবং নাই সে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম (মুসলিমে কামেল)। ফলে নাই সে যুগের মুসলিমদের ন্যায় বিশ্বশক্তির মর্যাদা ও শক্তি।      

 

রাষ্ট্রের সামর্থ্য এবং রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?

বাংলাদেশ হলো ফিতনা সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রের একটি নমুনা বা মডেল। মুজিব ও হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রের সে সামর্থ‌্যটি দারুনভাবে বৃদ্ধি পায়। এদেশটিতে পরিকল্পিত ভাবে অসম্ভব করা হয়েছিল পূর্ণ ইসলাম পালন এবং সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা। পূর্ণ ইসলাম পালন করতে হলে এবং সিরাতাল মুস্তাকীমে চলতে হলে তো কুর’আনী জ্ঞান চাই, আদালতে চাই শরিয়তের প্রতিষ্ঠা, শাসনতন্ত্রে চাই মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, চাই শুরা ভিত্তিক শাসন, মুসলিমদের মাঝে চাই প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব এবং চাই দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলি পালন করা অসম্ভব। এদেশের সংবিধানে ইসলামের পক্ষ নেয়াই সাম্প্রদায়িকতা ও অপরাধ। রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত হতো হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের খুশী করতে; আল্লাহকে খুশি করতে নয়।  হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের খুশী করতেই মুজিবের আমলে ইসলামের নামে সংগঠিত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় সকল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে এবং নেতাকর্মীদের কারাবন্দী করা হয়। হাসিনার আমলে ইসলামপন্থী নেতাদের ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছে। এবং নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য  নিবন্ধন দেয়া হয়নি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলিকে।

পৃথিবী পৃষ্ঠে রাষ্ট্রই হলো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করার চুড়ান্ত সামর্থ্য রাখে রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। রাষ্ট্রের শাসকগণ চাইলে মুসলিম নাগরিকদের ধর্মপালন অসম্ভব করতে পারে -যেমনটি এক সময় দেখা গেছে সোভিয়েত রাশিয়ায়। এখন সেটি দেখা যাচ্ছে চীনে। মুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু ও মসজিদ-মাদ্রাসা রাষ্ট্রীয় হামলার মুখে পড়ছে হিন্দুত্ববাদী ভারতে। মুসলিমগণ রাষ্ট্র গড়ে এ লক্ষ্যে যে, পূর্ণ ইসলাম পালনে ও পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার কাজে রাষ্ট্র সহায়ক ও সম্পূরক পরিবেশ সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্র সে কাজটি করে যেমন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা দিয়ে, তেমনি কুশিক্ষা, অপসংস্কৃতি, পাপ কর্ম ও দুর্বৃত্তি নির্মূল করে। তখন রাষ্ট্র  পরিণত হয় ব্যক্তি ও সমষ্ঠির পরিশুদ্ধির হাতিয়ারে। এবং পরিণত হয় জান্নাতের বাহনে। অথচ সে রাষ্ট্র যদি দুর্বৃত্তদের হাতে অধিকৃত হয় তখন সে রাষ্ট্র দারুল ফিতনা বা ফিতনার ভূমিতে পরিণত হয়। তখন সে রাষ্ট্রের পলিসি হয় জনগণকে মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করা। সেটি করে শিক্ষানীতি, মিডিয়া, বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের মধ্য দিয়ে। এমন রাষ্ট্র পরিণত হয় শয়তানের হাতিয়ারে ।

ফিতনা সৃষ্টিকারীদের দখলে রাষ্ট্র গেলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠাগুলির পক্ষ থেকে বিরামহীন যুদ্ধ শুরু হয় মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলামী পরিভাষায় যুদ্ধরত এমন রাষ্ট্রকে বলা হয় দারুল হারব।  সে রাষ্ট্র অসম্ভব করে আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা। এভাবে অসম্ভব করে পূর্ণ ইসলাম-পালন।  ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের এমন শত্রুতামূলক এবং বিদ্রোহাত্মক অবস্থান অসম্ভব করে পূর্ণ মুসলিম রূপে বাঁচা ও বেড়ে উঠা। এমন রাষ্ট্র আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে বাঁচতে শেখায় অর্থাৎ কাফিরে পরিণত করে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সম্মিলিত ক্ষমতা বিশাল। রাষ্ট্রের হাতে থাকে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, প্রচারযন্ত্র ও প্রশাসন। লক্ষ লক্ষ মসজিদ এবং হাজার হাজার মসজিদ গড়েও সে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্র যে দিকে নিতে চায়, জনগণকে সে দিকেই যেতে হয়। সেটির প্রমাণ, কম্যুনিস্ট বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাশিয়ার মসজিদগুলি আর মসজিদ থাকেনি, সেগুলি ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত হয়েছে। এবং তার ফল হলো, মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল এলাকার মুসলিমগণ আর মুসলিম থাকেনি, নামাজ-রোজা ছেড়ে তাদেরকে কম্যুনিস্টে পরিণত হতে হয়েছে।

একই কারণে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের পৌত্তলিক গান গাইতে হয় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের -এমন কি দ্বীনি মাদ্রাসাতেও। হাসিনার আমলে মাদ্রাসার কক্ষে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি টানাতে হতো।  মহান আল্লাহতায়ালা চান নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্য ভাতৃসুলভ একতা। কিন্তু ফিতনার প্রচারক সেক্যুলারিস্টগণ প্রতিষ্ঠা দেয় ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চলের নামে বিভক্তির দেয়াল এবং অসম্ভব করে একতার প্রতিষ্ঠাকে। মহান আল্লাহতায়ালা চান মানুষ চলবে সিরাতাল মুস্তাকীম তথা কুর’আনী রোডম্যাপ বেয়ে। চলবে জান্নাতের পথে। কিন্তু ফিতনা সৃষ্টিকারীরা নিতে চায় জাহান্নামের দিকে। এভাবেই রাষ্ট্র পরিণত হয় জাহান্নামের বাহনে। 

স্বৈরশাসক: নাশকতার নায়ক

মুসলিম উম্মাহর শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন হওয়ার মূল কারণ, জনশক্তির কমতি ও সম্পদের ঘাটতি নয়। বরং সেটি হলো মুসলিম বিশ্বজুড়ে স্বৈরশাসকদের সম্মিলিত নাশকতা। তারা সে নাশকতাটি ঘটায় গোত্র, ভাষা, অঞ্চল ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তার নামে ফিতনা সৃষ্টি করে। তাদের কারণে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচার, প্রশাসন, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিণত হয়েছে ফেতনা সৃষ্টির হাতিয়ারে। স্বৈরশাসকদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পায় তাদের নিজ গদির সুরক্ষা। তাদের রয়েছে প্রচণ্ড ইসলামভীতি। কারণ, ইসলামের স্বৈরশাসনের কোন স্থান নাই। রাজার পুত্র রাজা হবে -সে বিধান ইসলামে নাই। তার প্রমাণ, হযরত আবু বকর (রা:), হযরত উমর (রা:), হযরত উসমান (রা:) এবং হযরত আলী (রা:)’য়ের ন্যায় খলিফাদের কেউই রাজপুত্র ছিলেন না। শাসকের আসনে বসেননি তাদের সন্তানগণও। ইসলামের রয়েছে শুরার বিধান। এখানে রক্তের উত্তরাধিকারের স্থলে গুরুত্ব পায় তাকওয়া ও যোগ্যতা। কিন্তু স্বৈরশাসকগণ খোলাফায়ে রাশেদার সে সূন্নতের কাছে আত্মসমর্পণে রাজী নয়; তারা বিদ্রোহী সে ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে। বরং ফিরাউনের নীতিই তাদের নীতি। মুসলিম উম্মাহর বুকে যে কুফুরী ধারাটির শুরু এজিদের হাতে এবং আজও সে ধারা প্রবল ভাবে বেঁচে আছে প্রতিটি স্বৈরশাসকের মাঝে। 

অথচ ইসলাম বলতে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত বুঝায় না, বুঝায় খোলাফায়ে রাশেদার শাসনব্যবস্থাও। খোলাফায়ে রাশেদাগণ অনুসরণ করেছিলেন নবীজী (সা:)কে। আর যারা নবীজী (সা:)কে অনুসরণ করে, তারাই অনুসরণ করে আল্লাহতায়ালাকে -যা বলা হয়েছে সুরা নিসার ৮০ আয়াতে।  বলা হয়েছে:

مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ ٱللَّهَ

অর্থ: “যে অনুসরণ করে রাসূলকে, সেই অনুসরণ করলো আল্লাহকে।” 

প্রশ্ন হলো, আজকের মুসলিমদের মাঝে কোথায় নবীজী (সা:)’র অনুসরণ? বুঝতে হবে, ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আবিস্কারের বিষয় নয়, সেগুলি অনুসরণের বিষয়। অনুসরণ সেটিকেই করতে হয় যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল খোদ নবীজী (সা:)’র হাতে বা নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের হাতে। তাই যারা নবীজী (সা:)’র সত্যিকার অনুসারী হতে চায়, তাদের অনুসরণ করতে হয় খোলাফায়ে রাশেদার অনৃসৃত ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে। সে নীতির অনুসরণ ছাড়া পূর্ণ মুসলিম হওয়া অসম্ভব। অথচ আজ মুসলিম বিশ্বে নবীজী (সা:)’র সূন্নত বেঁচে নাই, বরং বেঁচে আছে এজিদের সূন্নত। প্রশ্ন হলো, স্বৈরশাসনের নির্মূল এবং খোলাফায়ে রাশেদার প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি পূর্ণ ইসলাম পালনের কথা ভাবা যায়? কিন্তু সেটি হতে দিতে রাজী নয় স্বৈরশাসকগণ। এজন্যই মুসলিম ভূমিতে নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামের মূল শত্রু বিদেশী কাফিরগণ নয়, বরং তারা হলো স্বদেশী স্বৈরশাসকগণ। কারণ, তারা জানে, ইসলামের উত্থানের অর্থই তাদের স্বৈর শাসনের বিলুপ্তি। ফলে স্বৈরশাসক মাত্রই ঘোরতর ইসলামবিরোধী। নিজেদের গদি বাঁচাতে তারা পৌত্তলিক কাফির শক্তির সাথে কোয়ালিশন গড়তেও রাজী -যেমনটি মুজিব ও হাসিনা করেছিল।

স্বৈরশাসক মাত্রই ঘোরতর শত্রু মুসলিম উম্মাহর একতার। কারণ, একমাত্র বিভক্তি বাঁচলে তাদের স্বৈরশাসন বাঁচে। ফলে মুসলিম রাষ্ট্রকে খণ্ডিত করার মধ্যেই তাদের আনন্দ। স্বৈরাচারী মুজিব তাই পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। এবং আরব স্বৈরশাসকগণ ২২ টুকরোয় ভেঙ্গেছে আরব ভূমিকে। এরূপ বিভক্তির মূল পরিকল্পনাকারী হলো ব্রিটিশসহ সাম্রাজ্যবাদী কাফির শক্তি। তারাই তাদের প্রতিরক্ষা দিচ্ছে। যেখানেই কিছু তেলের কূপ আবিস্কৃত হয়েছে -সেখানেই স্থানীয় এক স্বৈরশাসকের জন্য রাষ্ট্র নির্মাণ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর আজকের বিপন্ন দশার মূল কারণ তো এই স্বার্থান্বেষী স্বৈরশাসকগণ। মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় নাশকতাটি ঘটেছে তো তাদের হাতেই। এবং সেটি মুসলিম ভূমিকে খণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে। তাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা মুসলিম উম্মাহর নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নয়, বরং নিজেদের শাসন বাঁচানো। বিশাল ভূ-খণ্ডের একতাবদ্ধ ভূ-রাজনৈতিক শক্তিরূপে মুসলিম উম্মাহর উম্মেষ ঘটলে ক্ষুদ্র চিন্তার এসব ছোটলোক স্বৈরশাসকগণ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে যেত।

স্বৈরশাসকদের প্রতিদিন কাটে প্রচণ্ড গণভীতি নিয়ে। তাদের ভয়, এই বুঝি বিক্ষুব্ধ জনগণ তীব্র রোষ নিয়ে প্রাসাদ ঘিরে ধরলো। জনগণের হাত থেকে নিজেদের শাসন বাঁচতেই শেখ মুজিব বিশাল রক্ষি বাহিনী গড়েছিল। হাসিনা সমগ্র সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে রক্ষি বাহিনীতে পরিণত করেছিল। এবং সমগ্র দেশকে পরিণত করেছিল জেলখানায়। সব দেশে সব স্বৈরশাসকদের একই রীতি। জনগণকে বন্দী ও শক্তিহীন করা হলে সমগ্র জাতি বন্দী ও শক্তিহীন হয়। অথচ সে নাশকতার কাজটিই করে স্বৈরশাসকগণ। ৪০ কোটি আরবদের সম্পদ কি কম? কিন্তু তারা পদানত ৭০ লাখ ইসরাইলীদের হাতে। এমন পরাজয়ের মূল কারণ, ইসরাইলীগণ মুক্ত, কিন্তু ৪০ কোটি আরব নিজ দেশে বন্দী। তাদের সে বন্দীদশাটি হলো ইতিহাসের অতি নৃশংস স্বৈরশসকদের হাতে। প্রতিটি আরব রাষ্ট্রই হলো যেন দেয়াল ঘেরা বিশাল কারাগার; শাসকগণ হলো সেসব রাষ্ট্রের কারাপ্রধান মাত্র। এবং কারাবন্দী হলো প্রতিটি আরব নাগরিক। বন্দী মানুষদের পানাহারে বেঁচে থাকার অধিকার থাকে মাত্র, কিন্তু অধিকার থাকে না স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার। বন্দী মানুষের অবস্থা হাত-পা বাধা মানুষের মত। ফলে বন্দী মানুষদের সংখ্যা যত বিশালই হোক মুষ্টিমেয় স্বাধীন মানুষের বিরুদ্ধেও তারা জিততে পারেনি। এ জন্যই মুক্ত ও স্বাধীন ইসরাইলীদের কাছে বিশাল আরব জনগোষ্ঠি নিয়মিত পরাজিত ও নিগৃহীত হচ্ছে।

ইসরাইলের অভ্যন্তরে আরবদের যেরূপ মিছিল, মিটিং ও পত্রিকা প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, সেরূপ স্বাধীনতা নাই সৌদি আরব, মিশর, আরব আমিরাত, কুয়েত, জর্দান, মরক্কো, কাতারের ন্যায় দেশগুলিতে। এসব স্বৈর-কবলিত দেশগুলিতে মিছিল, মিটিং করার শাস্তি জেল নয়, বরং মৃত্যুদণ্ড। মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট রূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ মুরসী। মুসলিমদের এরূপ গণতন্ত্রপ্রেম ও জনগণের এরূপ শক্তিবৃদ্ধি গণতন্ত্রের চিহ্নিত শত্রুদের ভাল লাগেনি। ভাল লাগেনি সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের শাসকদের ন্যায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশাহদেরও। ফলে প্রেসিডেন্ট ডক্টর মুহাম্মদ মুরসীকে সরাতে আয়োজন করা হয় সামরিক অভ্যুত্থানের। এরই ফলে স্বৈরশাসন মিশরে আবার ফিরে এসেছে। নিরস্ত্র প্রেসিডেন্ট মুরসীকে তাঁর পদ থেকে হটিয়ে কারাগারে নেয়া হয় এবং সেখানে তার মৃত্যু ঘটানো হয়। এবং দেশটির সর্বময় ক্ষমতার মালিকরূপে আবির্ভুত হয় সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দাল ফাতাহ আল-সিসি। সে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ২০১৩ সালে কায়রোর আল-আদাবিয়ার ময়দানে জমা হয়েছিল বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ ও শিশু। কিন্তু সে শান্তিপূর্ণ ধর্না অপরাধ রূপে গণ্য হয় এবং ১২ শতের বেশী নিরস্ত্র নাগরিককে মেশিন গান ও কামান দেগে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনী পরিচালিত সে গণহত্যায় যারা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকে কারারুদ্ধ করা হয়। বহু বছর যাবত তাদের কারাবন্দী থাকতে হয়। সে বন্দীদের মধ্য থেকে ৭৫ জনকে ফাঁসির হুকুম শুনিয়েছিল স্বৈরাচারের তল্পিবাহক আদালত। জনগণের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে স্বৈরাশাসকগণ যে কতটা নৃশংস -এ হলো তার নজির।

স্বাধীনতা না থাকার অর্থ: নিজ প্রতিভা, নিজ সামর্থ্য ও নিজ সৃষ্টিশীলতা নিয়ে বেড়ে উঠায় অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। প্রশ্ন হলো, মৌলিক মানবিক গুণ নিয়ে বাঁচা ও বেড়ে উঠা অসম্ভব করা হলে কি কখনো মানবতা বাঁচে? সেটি তো মানবতাশূণ্য করার অসভ্য চেষ্টা। এটি তো মানবতা বিরোধী অপরাধ। স্বৈরশাসক মাত্রই তাই মানবতাবিরোধী অপরাধী। এরাই জনগণের পরম শত্রু। পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ মুসলিম দেশ শাসিত হচ্ছে এ শত্রুদের দ্বারা। মুসলিম উম্মাহর  পরাধীনতা, শক্তিহীনতা ও ইজ্জতহীনতার মূল কারণ এই স্বৈরশাসন। স্বৈরশাসকগণ জনগণের শক্তিকে ভয় পায়, ফলে তাদের শাসন-নীতির মূল লক্ষ্য, জনগণকে শক্তিহীন রাখা। জনগণকে শক্তিহীন রাখার উম্মাহকে শক্তিহীন রাখা। এরূপ শক্তিহীন রাখার মধ্যেই তারা নিজেদের গদির নিরাপত্তা ভাবে। ফলে স্বৈর শাসনের বিরামহীন যুদ্ধটি জনগণের বিরুদ্ধে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *