সংস্কৃতির গুরুত্ব ও অপসংস্কৃতির বিপদ
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 19, 2020
- শিক্ষা ও সংস্কৃতি
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
পরিচয় সংস্কৃতিতে
জাতি কতটা সভ্য বা উন্নত -সেটির পরিমাপ দেয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে পরিচয় মেলে একটি জনগোষ্টির চিন্তা-চেতনা, চরিত্র, রূচীবোধ, চালচলন বা জীবনবোধের। পশু বা উদ্ভিদের জীবনে সময়ের তালে বাঁচার প্রক্রিয়ায় উন্নতি আসে না। তাই তাদের পরিচয় সব সময় একই থাকে। কিন্তু মানুষ তার সমাজকে নিয়ে সামনে এগোয়, পূর্বের চেয়ে উন্নততর ও সভ্যতর হয়। হাজার বছর পূর্বে পশুরা যা খেতো আজকের জন্তু-জানোয়ারের খাদ্য, পানীয় বা বাসস্থান অবিকল একই। কিন্তু মানুষ সামনে এগিয়েছে। আর সামনে এগোনোর এই যে প্রক্রিয়া সেটিই হলো সংস্কৃতি। এটি হলো সংস্কারের তথা পরিশুদ্ধির পদ্ধতি। যে কোন জীবন্ত ও সুস্থ্য জাতির জীবনে এ প্রচেষ্টা ক্রীয়াশীল থাকাটি শুধু কাঙ্খিতই নয়, অপরিহার্যও। সমাজে সে প্রক্রিয়া কতটা সফল এবং কার্যকর -সংস্কৃতি সেটারই পরিমাপ দেয়। খনির স্বর্ণ আর অলংকারের স্বর্ণ এক নয়, উভয়ের মাঝে যে পার্থক্য তার পশ্চাতে থাকে দীর্ঘ পরিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। তেমনি সভ্য মানুষ আর অসভ্য মানুষও এক নয়। এক নয় উভয়ের আচার-আচরণ, পোষাক-পরিচ্ছদ এবং বাঁচবার রূচীবোধও। এ পার্থক্যের মূলে থাকে একটি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। সংস্কারের এ ক্রীয়াশীল প্রক্রিয়াকেই বলা হয় সংস্কৃতি। কোন জাতির সভ্যতর রূপে বেড়ে উঠার পিছনে এ প্রক্রিয়াটাই মূল।
প্রশ্ন হলো, কি সেই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া? কি সে উপাদান যার ভিত্তিতে একটি জাতি অন্য একটি জাতি থেকে ভিন্নতর সংস্কৃতির জন্ম দেয়? কি করে ভিন্নতর হয় নানা জনগোষ্ঠির জীবনবোধ ও চরিত্র? সচারচরই বলা হয়, মুসলিমগণ সংস্কৃতিতে অমুসলিমদের থেকে ভিন্ন। কিন্তু কি সে ভিন্নতা? কেন সে ভিন্নতা? এবং কি ভাবে গড়ে উঠে সে ভিন্নতা? সংস্কৃতি বুঝতে হলে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। জীবনমাত্রই গতিময়, এ গতি যেমন উর্ধ্বমুখী হতে পারে, তেমনি অধোমুখীও হতে পারে। কোন জাতি যেমন বিশ্বশক্তি হতে পারে, তেমনি কিছুকাল পর আন্যজাতির গোলামও হতে পারে। ব্যক্তি বা জাতীয় জীবনেও স্থিতিবস্থা বলে কিছু নেই। এগুতে না পারলে পিছিয়ে যেতে হয়। মানবজাতির ইতিহাস এ উত্থান-পতনের ইতিহাসে ভরপুর। এককালের বহু সভ্য জাতি কালের গতিতে পিছিয়ে গেছে। মুসলিমগণ নিজেরাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরন। আজকের তুলনায় চৌদ্দশত বছর পূর্বেও তারা বহুগগুণ উন্নত ছিল। এরূপ এগিয়ে ও পিছিয়ে যাওয়ার পিছনে কাজ করে জাতীয় জীবনে একটি সফল সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া সক্রীয় থাকা না থাকার বিষয়টি।
ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সংস্কারের প্রেরণা আসে ধর্মীয় বিশ্বাস বা দর্শন থেকে। মুসলিম জীবনে সে ধর্ম বিশ্বাস বা দর্শনটি হলো ইসলাম। সভ্য-অসভ্য, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ে ইসলামই হলো মানদন্ড। সে মানদন্ডের ভিত্তিতে বাঁচবার মধ্যে আসে রূচীবোধ। আসে চিন্তা-চেতনা, চরিত্র, কর্ম ও বাঁচবার প্রক্রিয়াতে পরিশুদ্ধি। ভূমি,ভাষা, জলবায়ু বা গাত্রবর্ণ এমন একটি রূচীবোধ বা মানদন্ড দিতে পারে না। ফলে ভাষা, জলবায়ু ও বর্ণ অভিন্ন হওয়া সত্বেও একই ভূমিতে বিভিন্ন ধর্ম ও আদর্শের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়। মানুষ উদ্ভিদ নয় যে ভূমি বা জলবায়ু থেকে তার বাঁচবার উপকরণ সংগ্রহ করবে। ব্যক্তির দৈহিক ও জৈবিক সত্ত্বার চেয়ে নৈতিক সত্ত্বাটিই মূল। এ নৈতিক সত্ত্বা জন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ্র সৃষ্টি। এবং তার নৈতিক শিকড় পুষ্টি পায় আদর্শ থেকে, ভূমি থেকে নয়। অভিন্ন আরব ভূমিতে একারণেই বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। বহুবিধ অনৈসলামিক সংস্কৃতির পাশে জন্ম হয়েছে ইসলামি সংস্কৃতির। ইসলামী বিশ্বাসের কারণেই বিপ্লব আসে মুসলিমদের বিশ্বাস, কর্ম, আচরণ ও রূচীবোধে। সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্টিত হয় আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে ব্যক্তি ও সমাজ সংস্কারের প্রক্রিয়া। ফলে আরবের প্রাক-ইসলামিক যুগের হানাহানীর পরিবর্তে স্থান পায় ইস্পাতদৃঢ় মুসলিম ভাতৃত্ব। যুদ্ব-বিগ্রহ ও অশান্তির স্থলে প্রতিষ্টা পায় পারস্পরীক সৌহার্দ্য ও সম্পৃতি। যারা এক কালে ইর্ষা, ঘৃণা ও হানাহানী নিয়ে বাঁচতো, তাদের মুখ থেকে উৎচারিত হতে থাকে একে-অপরের প্রতি প্রাণঢালা সালাম তথা শান্তির দোয়া। এভাবেই মানব ইতিহাসে জন্ম নেয় শ্রেষ্ঠতম মানব বা শান্তিময় বিশ্ব সৃষ্টির সংস্কৃতি।
ইসলামি সংস্কৃতি ও অনৈসলামি সংস্কৃতি
ইসলামকে বাদ দিয়ে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠে সেটি আর যাই হোক মুসলিমের সংস্কৃতি নয়। মুসলিম থেকে যেমন ইসলামকে পৃথক করা যায় না, তেমনি তাকে পৃথক করা যায় না ইসলামি সংস্কৃতি থেকেও। সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির বিশ্বাস ও চেতনার প্রতীক। বিশ্বাস বা চেতনা দৃশ্যময় নয়, কিন্তু সেটি দৃশ্যময় হয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। রোগের যেমন লক্ষণ থাকে, স্বাস্থ্যেরও তেমনি বৈশিষ্ঠ্য থাকে। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালাতে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী উভয়েরই সনাক্তকরণের কিছু লক্ষণ থাকে। আল্লাহতায়ালাতে অবিশ্বাসীর জীবনে শ্লিলতার বদলে অশ্লিলতার প্রকাশটিই স্বাভাবিক। কারণ, তার জীবনের লাগামটি থাকে খেয়ালখুশী বা জৈবিক প্রবৃত্তির হাতে। এমন প্রবৃত্তিপরায়ন ব্যক্তির পোষাক-পরিচ্ছদ, আমোদ-আহ্লাদ ও জীবন-যাপনে কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না, ফলে থাকে অশ্লিলতা। থাকে অপরাধপ্রবনতা।
কিন্তু মুসলিমের প্রতিটি কর্ম ও আচরন আল্লাহর ভয়ে বিমূর্ত। আল্লাহর ভয় তার চাওয়া-পাওয়ার উপর শক্ত লাগাম পড়িয়ে দেয়। ফলে তার জীবন হয় নিয়ন্ত্রিত। কি আনন্দ-উল্লাস, কি দুঃখ-বিষাদ -সব কিছুতেই থাকে আল্লাহর উপর অটল নির্ভরতা। মুসলিমের শোকপ্রকাশ ও উৎসবের প্রক্রিয়া এজন্যই অমুসলিমদের থেকে ভিন্নতর। শোকে-দঃখে সে বলে “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হি রা’জীয়ুন”। অর্থ: নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্যই এবং আল্লাহতেই ফিরে যাবো। ফলে থাকে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ফিরে যাওয়া ও তাঁর কাছে জবাবদেহীতার গভীর ভাবনা। এমন ভাবনা থেকেই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় মুসলিমের জীবন। কিন্তু অমুসলিমের জীবনে সে জবাবদেহীতা থাকে না। ফলে তার রূচীবোধ, জীবনবোধ ও সংস্কৃতি মুসলিম থেকে ভিন্নতর। এজন্যই বাংলাদেশে মুসলিম এবং অমুসলিম প্রায় হাজার বছর পাশাপাশী বসবাস করলেও তাদের উভয়ের আনন্দ-উল্লাস বা উৎসব কখনোই একই মোহনাতে মিলিত হয়নি। পানি ও তেলের ন্যয় আলাদাই রয়ে গেছে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে কারো স্মরণে দাড়িয়ে নীরবতা, বেদীমূলে বা ফটোতে মাল্যদানের যে সংস্কৃতি -সেটি অমুসলিমদের; সেটি কোন মুসলিমের হতে পারিনি। মুসলমানেরা বরং বিদেহী আত্মার মাগফেরাতে দোওয়া-দরুদের মজলিস বসায়, কবর জেয়ারত করে, গরীব মিসকিনকে দান খয়রাত করে। এটিই হলো ইসলামি সংস্কৃতি। শহীদ মিনারের নামে স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা, তাতে মাল্যদান এবং নগ্ন-পায়ে দাড়িয়ে নীরবতা পালনের যে সংস্কৃতিকে আপামর বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলা হয় -সেটি সত্য নয়। ইসলামে অঙ্গিকারহীন সেক্যুলারগণ এ সংস্কৃতির জনক, কোন নিষ্ঠাবান মুসলিম নন। কখনোই এটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সংস্কৃতি হতে পারেনি। তাছাড়া সাংস্কৃতিক কর্ম মুসলিমের কাছে নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে পৌঁছবার মাধ্যম মাত্র। মানুষের মাঝে গুণের উংকর্ষ ঘটিয়ে ইসলাম তাঁকে ফেরেশতার পর্যায়ে পৌঁছাতে চায়, এবং ইসলামি সংস্কৃতি হলো সে প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। মানব শিশু মুসলিম রূপে জন্মালেও সে প্রকৃত মুসলিম রূপে বেড়ে এ সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। নইলে অসম্ভব হয় মুসলিম হওয়া। তাই সে সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় বেড়ে উঠাটি মুসলিমের কাছে কোন বিনোদন নয়, আনন্দ-উল্লাসও নয়, এটি গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। এ কাজে মেধাদান, শ্রমদান ও অর্থদান জ্বেহাদের সমতূল্য। এবং এমন কাজে ব্যবহৃত কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।
আল্লাহতে বিশ্বাসী ও অনুগত হলে জীবন শ্লিল ও রূচীশীল হয়, আসে পবিত্রতা। ইসলাম পবিত্রতার প্রতিষ্টা চায় শুধু মসজিদে নয়, বরং সমগ্র সমাজে ও রাষ্ট্রজুড়ে। এমনকি আনন্দ-উৎসব ও শোক-দুঃখের আসর গুলোতেও। সমাজের কোন ক্ষুদ্রতর অংশ আনন্দ-উংসব বা সাংস্কৃতিক ক্রীয়াকর্মের নামে অশ্লিলতা ও নোংরামীতে আক্রান্ত হোক -ইসলাম তা চায় না। কারণ এগুলো রোগ। আর রোগমাত্রই সংক্রামক। এগুলির শুরু ক্ষুদ্রতর স্থান থেকে হলেও আস্তে আস্তে সমগ্র রাষ্ট্রকে গ্রাস করে। তাই যে অশ্লিলতার শুরু নাটকের মঞ্চ, সিনেমা হল, যাত্রা দল বা নিষিদ্ধ পল্লীতে, সেগুলি সেখানে সীমাবদ্ধ থকে না। আগুনের ন্যায় ঘর থেকে ঘর, গ্রাম থেকে গ্রামকে গ্রাস করে। এজন্যই ব্যক্তি ও জাতির পরিশুদ্ধির প্রয়োজনে ইসলাম সমাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গণ থেকেও অশ্লিলতার নির্মূল চায়। সাংস্কৃতি পরিশুদ্ধির এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সমাজ পরিশুদ্ধির প্রয়োজনে ইসলাম শুধু ব্যক্তির মৌখিক কালেমা পাঠের মধ্যেই দায়িত্ব সাড়ে না, বরং তাকে একটি বিশেষ মডেলে গড়ে তুলতে চায়। আর সে মডেল হলো, রাসূলে পাকের (সা) মডেল। কালেমা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সেটি শুরু হয় বটে, তবে শেষ হয় না। এজন্য তাকে চিন্তা-চেতনা, আমল-আখলাক বিশুদ্ধকরণের বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। ইসলামি সংস্কৃতি হলো সে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। আরবীতে এটিকে বলা হয় তাহযীব। তাহযীব হলো আরবী ব্যকারণের বাবে তাফয়ীলে হাযযাবা শব্দের ক্রিয়া বিশেষ্য। এ বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া কাজ না করলে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম করার প্রক্রিয়াই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ মানুষ বইপত্র বা স্কুল-কলেজ থেকে যা শেখে তার চেয়ে বহুগুণ বেশী শেখে সংস্কৃতি থেকে। জীবনের মূলপাঠটি সে সেখান থেকেই লাভ করে। তাকে কেন সৎ হতে হবে, কিভাবে সৎ হতে হবে, কেন ধর্মে একনিষ্ট হতে হবে, কেন অপরের দুঃখে দুখী এবং সুখে সুখী হতে হবে, কিভাবে বড়দের সন্মান ও ছোটদের সন্মান করতে হবে, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বা মেহমানকেই বা কিভাবে আপ্যায়ীত করবে এবং জীবনের মূল ফিলোসফি কি -সে গুলো সে শেখে সংস্কৃতি থেকে। ফলে স্কুলে না গিয়েও সে জ্ঞানবান হয়।
অজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় শত্রু
ইসলাম শুধু কালেমা, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত শেখায় না। ইসলামী রাষ্ট্র, শিক্ষাকেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও গড়তে বলে। শুধু কালেমা, নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতে পরিশুদ্ধি সম্ভব হলে আজকের মুসলিমগণও প্রাথমিক যুগের ন্যায় মহামানব রূপে বেড়ে উঠতো। অথচ আজকের দেড়শত কোটির অধিক মুসলিম সাহাবাদের তূলনায় হাজার ভাগের এক ভাগও কি অর্জন করতে পেরেছে? পারেনি। সে আমলে কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তাঁরা প্রতি কর্মে নির্দেশনা নিতেন পবিত্র কোর’আন ও হাদীস থেকে। আজকের মুসলিমদের ব্যর্থতার মূল কারণ, তাদের মাঝে বিলুপ্ত হয়েছে কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান। এবং বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামী সংস্কৃতির সে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া। একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য কি এর চেয়ে বেশী কিছু লাগে?
অজ্ঞতায় কোন সভ্যতা গড়ে উঠেনা। কোন সংস্কৃতিও নির্মিত হয় না। কোন সভ্যতর মানুষও তাতে সৃষ্টি হয়না। অজ্ঞতাই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। এজন্যই ইসলামের প্রথম জিহাদটি অজ্ঞতার বিরুদ্ধে। প্রতিটি নর-নারীর উপর প্রথম ফরজ বিধানটিও তাই জ্ঞানার্জন, নামায-রোযা নয়। এবং মহান আল্লাহতায়ালার প্রথম ওহীর নির্দেশটি ছিল “ইকরা” অর্থাৎ পড়ো। এভাবেই মহান আল্লাহতায়ালা সুস্পষ্ট করেছেন প্রতিটি ব্যক্তিকে কি ভাবে তাঁর পছন্দের মানব রূপে বেড়ে উঠতে হবে। কিন্তু আজকের মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে অজ্ঞতায়। জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ ভান্ডার যে পবিত্র কোর’আন -তা থেকে তারা জ্ঞান নেয়া ছেড়ে দিয়েছে বহু আগেই। তারা দায়িত্ব সারছে না বুঝে তেলাওয়াতে। ভাবটি এমন, তারা শুধু সওয়াব চায়, হিদায়েত চায় না। হিদায়েত পেতে হলে তো কোর’আন বুঝতে হয়। বুঝার চেষ্টা করতে তারা রাজী নয়। না বুঝে তেলাওয়াতে যে অজ্ঞতা দূর হয় না, জ্ঞানার্জনের ফরজও যে তাতে আদায় হয় না এবং মহান আল্লাহতায়ালাও যে এরূপ অজ্ঞ থাকাতে খুশি হন না -সে হুশই বা ক’জনের? অমুসলিমের উপর মুসলিমের শ্রেষ্ঠত্ব তো কোর’আন-লব্ধ জ্ঞান ও দর্শনে। কিন্তু অজ্ঞতায় ও দর্শনহীনতায় কি শ্রেষ্ঠত্ব বাঁচে?
ইসলামের শত্রপক্ষের স্ট্রাটেজী মসজিদ-মাদ্রাসাগুলি ধ্বংস করা নয়। সেটি হলো মুসলিমদের কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান থেকে দূরে সরানো। ইসলামের সংস্কৃতিক প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করার এটিই হলো সফল স্ট্রাটেজী। বীজকে গজাতে দেওযার পর তাকে বেড়ে উঠার সুযোগ না দিলে সেটি নিস্ফল আয়ু পায় মাত্র, ফল দেয় না। মুসলিম সন্তানের জন্মরোধ করতে না পারলেও মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে তারা বন্ধ করতে চায়। এক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে। এবং সেটি ঔপনিবেশিক কাফের শক্তির হাতে অধিকৃত হওয়ার পর থেকেই। এরই ফল হলো, আজকের প্রায় দেড়শত শতকোটি মুসলিম ইসলামের বিজয় বা গৌরব বাড়াতে কোন অবদানই রাখতে পারছে না। এহেন নিস্ফল জীবনের সবচেয়ে জাজ্বল্যমান ও নিকৃষ্টতর উদাহরণ হলো বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম। দেশটিতে পবিত্র কোর’আন অক্ষত থাকলেও পশ্চাদপদতায় রেকর্ড গড়েছে। পরিশুদ্ধির বদলে বাড়িয়েছে কদর্যতা এবং দূর্নীতি বিশ্বে বার বার প্রথম হওয়ার রেকর্ড গড়েছে। দূর্নীতি, মিথ্যাচার, গুম-খুনের রাজনীতি, সন্ত্রাস ও ভিক্ষাবৃত্তি দেশটিতে একটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। পতিতাবৃত্তি ও উলঙ্গতার ন্যায় পাপাচারকে না রুখে বরং সেগুলিকে আরো ব্যাপকতর করা হচ্ছে। বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার বদলে যে দূষিতকরণ প্রক্রিয়া উপনিবেশিক শত্রুরা চালু করেছিল -তাকে উৎখাত না করে বরং আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। ফলে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও অন্য মুসলমানদের কল্যানে কিছু করা দুরে থাক, নিজেদের কল্যানেও কিছু করতে পারছে না।
বিধ্বস্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অসংখ্য। বহু প্রতিষ্ঠান অপসংস্কৃতির তথা দূষিতকরণ প্রক্রিয়ারও। ইসলামী সংস্কৃতির মূলকেন্দ্র হলো মসজিদ। এটিই হলো মর্তের বুকে মহান আল্লাহতায়ালারএকমাত্র নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই দ্বীনের আলো মহল্লার অন্ধকার সরায়। এ জন্যই শয়তানের মূল টার্গেট হলো মসজিদ। কিন্তু ইসলাম বিরোধী শক্তি ইসলামী সংস্কৃতির এ প্রাণকেন্দ্রকে বহুলাংশেই প্রাণহীন ও অকার্যকর করে রেখেছে। মহান আল্লাহতায়ালার এ পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহৃত হচ্ছে নিছক নামাজ আদায়ের স্থানরূপে। নামাজের সময় ব্যতীত লক্ষ লক্ষ মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনগুলি অধিকাংশ সময়ই অব্যবহৃত থাকে। দ্বীনশিক্ষা, মানুষের মাঝে ভাতৃত্ব গড়া, সমাজসেবা, জুলুমের বিরুদ্ধে জ্বিহাদ সংগঠিত করা এবং জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার যে কাজ একদিন মসজিদের জায়নামাজে হতো -তা আজ বিস্মৃতপ্রায়। অথচ এসব কাজের জন্য সে সময় মসজিদ ভিন্ন মুসলিমদের অন্য কোন প্রতিষ্ঠানই ছিল না। ক্লাব, যাত্রাদল, সিনেমা ও নাট্যমঞ্চ এগুলি জন্ম ও পরিচর্যা পেয়েছে অমুসলিমদের হাতে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে যে সংস্কৃতি চর্চা হয় সেটিও মুসলিমের নয়। ইসলামের আলোকে এগুলি আদৌ সংস্কৃতি নয়, বরং অপসংস্কৃতি। এবং এ অপসংস্কৃতির নাশকতাটি ভয়ংকর।
পবিত্রতা শুধু নামাযে থাকলে চলে না। পবিত্রতা থাকতে হয় প্রতিটি কর্মে। কারণ, নামাযের পাশাপাশি প্রতিটি কর্মের জন্যও মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে দায়বদ্ধ। মসজিদের জায়নামাযের যে পবিত্রতা সেটি অন্যত্র সম্ভব নয়। তাই সমাজীকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনে অন্যরা ক্লাব গড়লেও পবিত্রতার স্বার্থে মুসলিমগণ শুধু মসজিদই গড়েছে। তবে নিছক কয়েক মিনিটের জন্য জায়নামাযে আসাতে ব্যাক্তির জীবনে পরিশুদ্ধি আসে না। নবীজী (সা) তাঁর সাহাবাদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আল্লাহতায়ালার এ পবিত্র ঘরে নবীজী (সাঃ)’র সাহচর্য্যে কাটিয়েছেন এবং দ্বীনের আলোকে নিজেদের আলোকিত করেছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে এটিই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ক্লাসরুম। শিক্ষক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মহান নবীজী (সাঃ)। মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব সৃষ্টি হয়েছেন এ ক্লাসরুম থেকে। কিন্তু আজকের চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুসলিম বিশ্বে আজ লক্ষ লক্ষ মসজিদ। কিন্তু মসজিদের জায়নামাজে নবীজী (সাঃ)’র সে পবিত্র সূন্নত বিলুপ্ত করা হয়েছে বহু আগেই।
পবিত্র কোর’আনের জ্ঞানই মানুষকে মুসলিম বানায়। মুসলিম সমাজের গাঢ় অন্ধকার দেখেই বলা যায়, দ্বীনের আলো এখানে পূর্ণভাবে জ্বালানো হয়নি। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অন্ধকার সরাতে আল্লাহর এ প্রতিষ্টান মসজিদ আদৌ কোন সফলতা দিতে পারেনি। ফলে নির্মিত হয়নি সুস্থ্য সংস্কৃতি। এবং নির্মিত হয়নি ইসলামি রাষ্ট্র। ফলে মুসলিমদের মুসলিম হওয়াতেই বেজায় ফাঁকি রয়ে গেছে। মুসলিমদের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ এই ফাঁকিবাজি। ইসলামের বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াকে রুখতে শত্রুশক্তি মসজিদকে যেমন নিষ্ক্রিয় করেছে, তেমনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নাচগান, যাত্রা, নাটক, সিনেমা, মদ্যপান, বেশ্যাবৃত্তির ন্যায় নানান অশ্লিলতার। এগুলোর ফলে মুসলিমদের চেতনা যেমন অসুস্থ্য হয়েছে, তেমনি দিন দিন কদর্যতা বাড়ছে তাদের রুচীবোধ ও আচার-আচরনে।
সাংস্কৃতিক নাশকতা
সাহিত্য সংস্কৃতির অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জ্ঞানের বিস্তারে সাহিত্য পাইপলাইনের কাজ করে। কিন্তু অশ্লিল সাহিত্য এ পাইপলাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে চেতনার ভুবনে রোগের বিস্তার ঘটায়। দূষিত পানিতে দেহ রোগাগ্রস্থ হয়, দুষিত সাহিত্যে রোগাগ্রস্থ হয় সমগ্র চেতনা। চেতনার এ রোগাগ্রস্থ্যতার কারণেই মানুষ চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষন ও রাহাজানিতে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশে আজ সেটিই হচ্ছে। সংস্কৃতি হলো মানুষকে সভ্যতর করার শিল্প। মানুষ সভ্যতর হয়, সমাজ সামনে এগোয়, এবং রাষ্ট্র সমৃদ্ধতর হয় -এ শিল্পের গুণেই। বাংলাদেশে আজ যে অবাধ ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, হত্যার সয়লাব, সেটিই প্রমাণ করে এ সৃষ্টিশীল শিল্প এদেশে গড়ে উঠেনি। বরং বেড়েছে মানুষকে অসভ্যতর করার শিল্প অর্থাৎ অপসংস্কৃতি। এটির টানে আমরা যেন আঁধারের দিকে ছুটছি। আর এরূপ আঁধারের দিকে নেওয়াই তো শয়তানের কাজ, এবং সে বেঈমানদের সুহৃদ। সুরা বাকারা’তে তো সেটিই বলা হয়েছে।
সংস্কৃতির লেবাসে যুগে যুগে মানুষকে মহান আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত করাই শয়তানের সনাতন ধর্ম। শয়তানের এ ধর্ম কিতাব নির্ভর নয়, বরং সংস্কৃতি নির্ভর। সংস্কৃতির ছদ্দবেশে সে ব্যক্তির পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়াকে চিরতরে রুখতে চায়। বাংলাদেশে ইসলামের উপর জঘন্যতম হামলা আসছে এই সাংস্কৃতিক কর্মীদের পক্ষ থেকেই। মৌলবাদ নির্মূল করার নামে এরাই ইসলামকে নির্মূল করতে চায়। এদের কারণে জাতিকে সভ্যতর করার মাধ্যমগুলো আজ বিপর্যস্ত। কবিতার নামে, যাত্রা-নাটক ও সিনেমার নামে এরা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে দিন দিন আরো অসুস্থ্যতর করছে। বাড়ছে উলঙ্গতা, বাড়ছে অশ্লিললতা, বাড়ছে নেশাগ্রস্থতা। তাতে পাড়ার বখাটে ছেলেরা ধর্ষণে উৎসাহ পাচ্ছে। ফলে পাড়ায় পাড়ায় যতই বাড়ছে নাট্যদল, ক্লাব, ভিডিও, সিনেমা হল ততই বেড়ে চলেছে সমাজে অসুস্থ্য মানুষের ভিড়। এদের কারণে ৫০ বছর পূর্বে জাতি নীতি-নৈতিকতা ও মুল্যবোধের মানদন্ডে যে পর্যায়ে ছিল তার চেয়ে অনেক নীচে নেমেছে। সংস্কৃতি চর্চার নামে এ পতন-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ইসলামের নির্মূলে শত্রুশক্তির একটি তীরও ছোড়ার প্রয়োজন পড়বে না।
সাংস্কৃতিক ভিন্নতাই রাজনৈতিক ভিন্নতার জন্ম দেয়। সে ভিন্নতার কারণেই দেশবাসী ভিন্ন মানচিত্র পায়। সেটি বিলুপ্ত হলে বাংলাদেশের পৃথক থাকার যুক্তি বা ভিত্তিই বিলুপ্ত হবে। তখন বিপর্যস্ত হবে দেশটির স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব। বাংলাদেশের ভারতপন্থি সাংস্কৃতিক কর্মীরা বস্তুত সে কাজেই দ্র্রুত অগ্রসর হচ্ছে। একারণেই এদের প্রতিপালনে ভারতের বিপুল বিনিয়োগ। বাংলাদেশে এ অবধি কোন শিল্পে তেমন বিনিয়োগ না করলেও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মে ও মিডিয়াতে। দিন রাত মগজ ধোলাইয়ের কাজ করছে ভারতীয় টিভিও।সে সাথে দলে দলে আসছে ভারতীয় নাট্যকর্মী, গায়ক-গায়িকা ও সিনেমাকর্মী। একাজে যেসব বাংলাদেশী ভারতের একনিষ্ট সেবক -তাদেরকে তারা পুরস্কৃতও করছে।
জাতিকে বাঁচাতে হলে চেতনার দূষিতকরণ প্রক্রিয়াকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হয়। এবং যে পাইপ লাইনগুলি ঘরে ঘরে সংস্কৃতির নামে জাতি ধ্বংসের জীবাণু পৌঁছে দিচ্ছে -বিচ্ছিন্ন করতে হয় সেগুলির সংযোগও। নিজ ধর্ম ও নিজ সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচার স্বার্থে জাতিকে শুধু ভৌগলিক সীমানা পাহারা দিলে চলে না, সাংস্কৃতিক সীমানাও পাহারা দিতে হয়। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটিই হচ্ছে না। ফলে প্লাবনের পানির ন্যায় ধেয়ে আসছে শত্রু শক্তির সাংস্কৃতিক স্রোত। তাই এ মুহুর্তে জরুরি শুধু সংস্কৃতির সংস্কারই নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রতিরক্ষাও। নইলে ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকাই যে কঠিন হবে -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? ১ম সংস্করণ ০৩/০৮/২০০৩; ২য় সংস্করণ ১৮/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের স্বপ্নবিলুপ্তি ও সংকট
- বাঙালি মুসলিমের শক্তি এবং ভারতের বাংলাদেশ ভীতি
- রাষ্ট্র কিরূপে ফিতনা ও নাশকতার হাতিয়ার?
- সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির রায়ের ইজ্জত সুনিশ্চিত করত হবে
- একাত্তর প্রসঙ্গ, কিছু আলেমের বিভ্রান্তি এবং মুসলিমের জিহাদে কবিরা
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018