হজ্জের লক্ষ্য ও মুসলিমদের ব্যর্থতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on July 19, 2021
- Bangla Articles, ইসলাম
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
হজ্জ কেন সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান?
মানব জীবনে বহুবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কিন্তু হজ্জ কেন সকল প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শ্রেষ্ঠতর? কেন অনন্য? কোন অনুষ্ঠানই শুধু ধর্মীয় হওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠতর হয় না। সেসব অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত হওয়াতেও তা কল্যাণকর হয় না। উলুধ্বনি,শঙ্খা ধ্বনি ও বিচিত্র বেশধারনেও কল্যাণ আসে না। ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর গঙ্গাস্নানে হাজির হয়। কিন্তু গঙ্গার পানিতে কি চেতনা ও চরিত্রের ময়লা পরিষ্কার হয়? পবিত্র হয় কি মন? বিপ্লব আসে কি চেতনালোকে ও চরিত্রে? চারিত্রিক বিপ্লব তো দেহ ধৌত করায় আসে না। বিচিত্র বেশধারণ বা দেব-দেবী, সাধুসন্নাসী ও ভগবানের নামে নানারূপ রূপকথা, লোককথা বা অলৌলিক কিচ্ছাকাহিনী পাঠেও আসে না।সে জন্য তো চাই এমন এক বিপ্লবী দর্শন যা মানব মনের গভীরে প্রবেশ করে এবং আঘাত হানে ও বিপ্লব আনে চেতনার মূল ভূমিতে। এবং বিলুপ্ত করে ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে জমে উঠা অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারের বিশাল আবর্জনাকে। এভাবেই তো পরিশুদ্ধি আসে মানবের চেতনা ও চরিত্রে। তখন বিপ্লব আসে সমাজ ও রাষ্ট্রজুড়ে। এভাবেই তো উচ্চতর সভ্যতা নির্মিত হয়। তবে সে বিপ্লবের জন্য শুধু বিপ্লবী দর্শনই জরুরি নয়, অপরিহার্য হলো এমন কিছু বিপ্লবী মহানায়ক যিনি শুধু কথা দিয়ে নয়, নিজের কর্ম, চরিত্র ও ত্যাগের মধ্য দিয়েও মানুষকে পথ দেখায়। এভাবেই তো সমাজে অনুকরণীয় আদর্শ গড়ে উঠে। মানব ইতিহাসের সে আদর্শ মহানায়কেরা হলেন নবীরাসূল।
মানবের কল্যাণে মহান আল্লাহতায়ালা শুধু আসমানী কিতাবই নাযিল করেননি, সমাজের মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে নবী রূপে নিযুক্ত করেছেন। ইসলাম শুধু মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাসকেই অনিবার্য করে না, বরং অনিবার্য করে নবীরাসূলদের বিশ্বাস করা ও তাদেরকে মেনে চলাকেও। নবীরাসূলদের মাধ্যমে মানুষকে পথ দেখানো এবং সমাজ জুড়ে বিপ্লব আনাই মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত। মানুষের দায়িত্ব হলো মহান আল্লাহর সে মিশনের সাথে একাত্ম হওয়া। কুর’আনে তাই বলা হয়েছে, “তিনিই সেই মহান আল্লাহ যিনি উম্মিদের মাঝে তাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাসূল নিযুক্ত করেছেন যিনি তাদের সামনে পাঠ করে শোনান তাঁর আয়াত এবং তাদের মধ্যে আনেন পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা, এবং শিক্ষা দেন কিতাব এবং প্রজ্ঞা। এবং এর পূর্বে তারা ছিল সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।”–(সুরা জুমু’আ, আয়াত ২)। মানব জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বা বিপর্যয়টি খাদ্যাভাবে বা অর্থাভাবে আসে না। ভগ্ন স্বাস্থ্যেও নয়। সেটি আসে সত্য থেকে বিচ্যুতি তথা পথভ্রষ্টতার কারণে। অপর দিকে সত্যকে খুঁজে পাওয়া ও বিভ্রান্তু থেকে মুক্তির মাঝেই মানবের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণ। মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার তাই উড়োজাহাজ, আনবিক বোমা, রেডিও-টিভি, রবোট বা কম্পিউটার নয়।সেটি হলো জীবন ও জগতের স্রষ্টা নিয়ে সত্যের আবিষ্কার। আর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো সে সত্যকে না চেনা ও সেটিকে খুঁজে না পাওয়ার ব্যর্থতা। সত্য-আবিস্কারের সফলতাটিই ব্যক্তির জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতাটি দেয়। সেটি হলো, অনন্ত অসীম কালের জন্য জান্নাতপ্রাপ্তি। আর সত্য আবিস্কারে ব্যর্থ হলে সে ব্যর্থতাটি ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিয়ে হাজির করে। সমাজ এবং রাষ্ট্র তখন দুর্বৃত্তদের দিয়ে ভরে উঠে। পৃথিবীর বুকেও তখন জাহান্নামের আযাব নেমে আসে।
সমগ্র মানব ইতিহাসে সত্য আবিস্কারে সবচেয়ে সফল ও শিক্ষণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন হযরত ইব্রাহীম (আ:)। এই একটি মাত্র কারণেই তিনি সমগ্র মানব ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কোন পয়গম্বরের ঘরে তাঁর জন্ম হয়নি। বরং জন্ম হয়েছিল পৌত্তলিক এক পিতার ঘরে। মূর্তিপূজা ও মূর্তিনির্মাণই ছিল তার পেশা। কিন্তু সে কলুষিত পরিবেশে জন্ম নিয়েও পৌত্তলিকতার স্রোতে তিনি ভেসে যাননি। বরং সত্যের আবিস্কারে নিজের সকল প্রতিভা ও সামর্থ্যকে নিয়োজিত করেছিলেন। জীবনের শুরু থেকেই তাঁর মনে অদম্য আগ্রহ ছিল, কে এই বিশাল বিশ্বজগতের স্রষ্টা -সে সত্যটি জানার? মানব জীবনের এখানেই শ্রেষ্ঠত্ব। পশু স্রেফ পানাহার নিয়ে ভাবে, সত্য নিয়ে তার ভাবনা নাই। সে স্বভাব পশুবৎ মানুষেরও। ইব্রাহীম (আ:)’য়ের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে তার মধ্যে দেখা যায় মানবিক গুণের পূর্ণতাটি। যখন তিনি সে সত্যকে খুঁজে পেলেন তখন শুরু হলো জীবনের প্রতি পদে সে পথে চলায় প্রচন্ড আপোষহীনতা। সত্যের পথে চলায় জীবনের কোরবানীও তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হয়। তাই নমরুদের বাহিনী যখন জ্বলন্ত আগুনের মাঝে ফেলে তাঁকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা করলো তখনও এ মহান ব্যক্তিটি সে সত্য থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হননি। যথন নিজের একমাত্র শিশু ইসমাঈলের কোরবানির হুকুম এলো তখনও সে হুকুম পালনে তিনি সামান্যতম ইতস্তত করেননি। মানব ইতিহাসের এ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে মহান আল্লাহতায়ালা সম্মানিত করেছেন নিজের বন্ধু রূপে গ্রহন করে। প্রশংসা করেছেন তাদেরও যারা তাঁর সে মহান আদর্শ কে অনুসরণ করে। তাই পবিত্র কুর’আনের ঘোষণা,“তাঁর অপেক্ষা দীনে কে উত্তম যে সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠ ভাবে ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ করে? এবং আল্লাহ ইব্রাহীমকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন।”- (সুরা নিসা, আয়াত ১২৫)। সত্যের অন্বেষণ ও অনুসরণে প্রবল সদ্বিচ্ছা ও লাগাতর প্রচেষ্টা থাকলে আল্লাহতায়ালার সাহায্যলাভও ঘটে। তখন সফলতাও জুটে। হযরত ইব্রাহীম (আ:)’য়ের জীবনের সেটিও আরেক শিক্ষা। মানুষ তো পুরস্কার পায় তার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার কারণে। সুরা আনকাবুতে তাই মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, “আল্লাযীনা জাহাদু ফিনা, লা’নাহদি’আন্নাহুম সুবুলানা।” অর্থ: যারাই আমার রাস্তায় প্রচেষ্টা করে, আমরা অবশ্যই তাদের পথ দেখাই আমাদের রাস্তার।” হযরত ইব্রাহীম (আ:) মহান আল্লাহতায়ালার বন্ধু হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছেন তো সে মহান নিয়েত ও প্রচেষ্টার বলেই।
হযরত ইব্রাহীমকে মহান আল্লাহতায়ালা ভূষিত করেছেন মুসলিম মিল্লাতের আদি পিতা রূপে। অথচ মানব ইতিহাসে প্রতিভাধর ব্যক্তির সংখ্যা কি কম? তাদের হাতে আবিষ্কারের সংখ্যাও কি কম? কুর’আন নাযিলের শত শত বছর আগেও এসব প্রতিভাধরদের হাতে মিশরের পিরামিড, চীনের প্রাচীর ও ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগিচা নির্মিত হয়েছে। ইতিহাসে সেগুলো বিস্ময়কর আবিস্কার রূপে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কিন্তু মানব-প্রতিভার সে বিনিয়োগ নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা খুশি হননি, কারণ সে প্রতিভাবান মানুষেরা ব্যর্থ হয়েছে সত্যকে খুঁজে পাওয়ার ন্যায় অতি মৌলিক কাজে। এক্ষেত্রে তাদের মনযোগ ছিল অতি সামান্যই। আজও কি এরূপ প্রতিভাধারিদের ব্যর্থতা কম? বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে তারা নবেল প্রাইজ পেলেও সত্যকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা মুর্খ। তাদের সে মুর্খতা হাজার হাজার বছর আাগের গুহাবাসীর চেয়ে কি কম? ফলে তাদের জীবনে বেড়েছে সত্যচ্যুতি ও বিভ্রান্তি। অসভ্য গুহাবাসীর ন্যায় তাদের জীবনেও এসেছে তাই আদীম অজ্ঞতা ও পাপাচার। সনাতন মিথ্যা তো আজও বেঁচে আছে মিথ্যার পক্ষে এসব প্রতিভাধারিদের অস্ত্র ধরার কারণে। এসব প্রতিভাবান আবিষ্কারকদের দুস্কৃতির কারণেই বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়েছে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় বড় ক্ষতিগুলো হয়েছে সত্য আবিষ্কারে ব্যর্থতা ও ভ্রান্ত পথে মেধার বিপুল বিনিয়োগের ফলে। তাই সত্য আবিস্কারে হযরত ইব্রাহীমের নানা প্রচেষ্টার কথা পবিত্র কুর’আনে বার বার বর্নিত হলেও এসব প্রতিভাধর আবিষ্কারকদের নিয়ে এক ছত্রও উল্লেখ নাই। মহান আল্লাহর প্রিয় বন্ধু এবং মানব ইতিহাসের সে মহান নায়ক হযরত ইব্রাহীম (আ:)’য়ের মহান চরিত্রকে ঘিরেই হজ্জের পুরা অনুষ্ঠান। তাই হজ্জের গুরুত্ব ও শিক্ষাকে বুঝতে হলে হযরত ইব্রাহীম (আ:)’য়ের দর্শন ও কর্মকে বুঝতে হবে। তাঁর ন্যায় এক মহান সত্য-আবিষ্কারককে মধ্য মঞ্চে রেখে মহান আল্লাহতায়ালা সত্যপ্রেমিক মানুষদেরকে বহু কিছুই শেখাতে চান। সে শিক্ষাটি মূলত মহান আল্লাহর প্রতিটি হুকুমের কাছে আজীবন আত্মসমর্পণের। সেটিই হযরত ইব্রাহীম (আ:)’র সূন্নত। হজ্জের এখানেই অনন্যতা। হজ্জ এ জন্যই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান।
বিশ্বজনীন হজ্জ
হজ্জ বিশ্বজনীন। এক্ষেত্রটিতেও হজ্জের আরেক শ্রেষ্ঠত্ব। সত্যকে যেমন ভাষা, বর্ণ বা ভৌগলিকতা দিয়ে বিভক্ত করা যায় না, তেমনি বিভক্ত করা যায় না হজ্জকেও। পৃথিবীর নানা দেশের নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মানুষ সেখানে জমা হয়। হজ্জের মঞ্চে পৃথিবীর সবচেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিটি যেমন জমা হয়, তেমনি তার পাশেই জমা হয় সবচেয়ে শেতাঙ্গ ব্যক্তিটিও। একই মঞ্চে জমা হয় নানা দেশের শিয়া-সূন্নী, হানাফী-শাফেয়ী, হাম্বলী-মালেকী, দেউবন্দী-বেরেলভীগণ। তাদের মাঝে ফেকাহগত বিরোধ থাকলেও হজ্জ নিয়ে কোন বিরোধ নাই। দিন-ক্ষণ নিয়ে বিরোধের কোন সুযোগও নেই। সেটি বেঁধে দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। এমন মহামিলন ও এমন আচার কি আর কোন ধর্মে আছে? বাঙালী হিন্দুর দুর্গা পুজায় কি কোন বিহারী, গুজরাতী, মারাঠি বা পাঞ্জাবী হিন্দু যোগ দেয়? আবাঙালী হিন্দুর দেউয়ালীতেই বা ক’জন বাঙালী যোগ দেয়? তেমনি কাথলিক খৃষ্টানদের কোন অনুষ্ঠানে কি ইউরোপীয় প্রটেষ্টান্ট, মিশরীয় কপটিক, গ্রীক অর্থোডক্স বা আর্মেনিয়ান খৃষ্টানগণ নজরে পড়ে? খৃষ্টান ধর্মে কি এরূপ কোন অনুষ্ঠান আছে যেখানে ইউরোপীয় খৃষ্টানদের সাথে আফ্রিকান বা ভারতীয় খৃষ্টানদের যোগ দেয়াটি ফরজ? অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি তো এভাবে বেঁচে আছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, বর্ণ ও ভূগোল-ভিত্তিক বিভক্তির পরিচয় নিয়ে। কোথায় সে বিশ্বজনীন রূপ? হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শিখ ও জৈন ধর্মের ন্যায় বহু ধর্মের ভিত্তিটা এতটাই বর্ণ ও আঞ্চলিকতায় আচ্ছন্ন যে এসব ধর্মের অনুসারিরূপে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ও ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। এভাবে এ ধর্মগুলি কাজ করেছে মানব সমাজে বিভক্তি ও অকল্যাণ বাড়াতে। অথচ হজ্জ শেখায় বিশ্বজনীন ভাতৃত্ব ও একতা। হজ্জ তাই পৃথিবীর সকল দেশ ও সকল ভাষার মুসলিমদের একই সময়ে, একই সাথে একই মঞ্চে হাজির করে। আল্লাহর বিধান যে কতটা নিখুঁত ও কল্যাণধর্মী -এ হলো তার নমুনা।
অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানগুলির ন্যায় হজ্জ নিছক ধর্মীয় আচার নয়। পাদ্রী ও পুরোহিতের মন্ত্র পাঠে তা শেষ হয় না। বরং হজ্জ দেয় আত্মত্যাগের এক বিপ্লবী দর্শন। শুরুটি হয় দীর্ঘ যাত্রাপথের বিপুল অংকের অর্থব্যয় দিয়ে। এভাবে হজ্জ গড়ে সম্পদ ব্যয়ের অভ্যাস। শুরু হয় দৈহিক কসরতও। সে সাথে দেয় গভীর আধ্যাত্মিকতা, দেয় সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রূপে বেড়ে উঠার মহাপ্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের আয়োজনে হজ্জ বস্তুত অনন্য। এর কারণ, হজ্জে পালনীয় প্রতিটি বিধান বেঁধে দেয়া হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। ইসলাম যেমন মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া একমাত্র ধর্ম, হজ্জও তেমনি তাঁরই দেয়া পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হজ্জের কোন বিধানই মানুষের পরিকল্পিত নয়। সমগ্র অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায়, ফলে হজ্জের সাথে কি অন্য ধর্মের কোন অনুষ্ঠানের তুলনা হয়?
হজ্জের শিক্ষা ও মুসলিমদের ব্যর্থতা
কিন্তু হজ্জ যে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান -সে চেতনাটি মুসলিমদের মাঝে কতটুকু? মহান আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ এ আয়োজন থেকে শিক্ষা হাসিলের আয়োজনই বা কতটুকু? হজ্জ পালিত হয় জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত লাগাতর নানা পর্ব দিয়ে। হজ্জের সাথে আসে ঈদুল আযহা। হজ্জ পর্বটি মক্কা শরীফে পালিত হলেও ঈদুল আযহা পালিত হয় সমগ্র বিশ্বজুড়ে। হজ্জের শিক্ষাটিই বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয় এই ঈদুল আযহা। কিন্তু কি সে শিক্ষা? কি এর দর্শন? ঈদুল আযহা কি শুধু পশু কোরবানি? ছোট্ট একটি সামাজিক অনুষ্ঠানেরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। হজ্জের লক্ষ্য কি স্রেফ হজ্জ পালন? বহু অর্থ ও বহু শ্রম ব্যয়ে বিশ্বের নানা দেশ থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ কেন মক্কায় হাজির হয়? সামর্থবানদের উপর কেন এটি ফরজ? ক্বাবাকে ঘিরে কেন ৭ বার তাওয়াফ? কেন মিনায় তিন দিন অবস্থান? আরাফাতে কেন মহাজমায়েত? মোজদালেফায় খোলা অকাশের নিচে কেন শয়ন? শয়তানের স্তম্ভে কেন তিন দিন ধরে পাথর নিক্ষেপ? কেন সাফওয়া ও মারওয়ার মাঝে নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধার দৌড়াদৌড়ি? সেটিও একবার নয়,সাতবার! কেন লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানি? এগুলি কি নিছক আচার? এগুলির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ কোন দর্শন ও উদ্দেশ্য থাকলে সেটিই বা কি? যে ইবাদতে এত অর্থব্যয়, শ্রমব্যয় ও সময়ব্যয় তা থেকে মুসলিম উম্মাহই বা কতটুকু লাভবান হচ্ছে? প্রতি বছর হাজী হয়ে ফিরছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ, তাতেই বা তাদের কি কল্যাণ হচ্ছে? বিষয়গুলি অতিশয় ভাবনার। কিন্তু মুসলিমদের মাঝে সে ভাবনা কই? হজ্জের প্রতি পর্বের প্রতিটি অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকারি যে মহান আল্লাহতায়ালা সে হুশ বা ক’জনের?
যে পাঁচটি খুঁটির উপর ইসলামের ভিত্তি তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো হজ্জ। তাই হজ্জকে বাদ দিয়ে ইসলামের পূর্ণ ইমারত নির্মাণ করা যায় না। এবং ইসলামের এ বিশাল ইমারতটি ধ্বসিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজন নেই পাঁচটি খুঁটির সবগুলি ধ্বংসের, যে কোন এই একটি খুঁটির বিনাশই সে জন্য যথেষ্ট? আল্লাহতায়ালার কাছে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা। খলিফা রূপে তার দায়িত্বটি পৃথিবীর বুকে আল্লাহতায়ালার প্রতিনিধিত্বের। মানুষ আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্ঠি শুধু এ পরিচয়ের কারণেই, দৈহিক শক্তি বা অন্য কোন গুণের কারণে নয়। আর সে পরিচয়ে বেড়ে উঠা ও টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য হলো লাগাতর প্রশিক্ষণ। সে প্রশিক্ষণের পূর্ণ নির্দেশনা এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। ইসলামের বিধানগুলো মূলত সে প্রশিক্ষণেরই পূর্ণ প্যাকেজ। সে প্রশিক্ষণ পূর্ণ করতেই নামায-রোযার বিধান যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে হজ্জ-যাকাত ও জিহাদের বিধান। মহান আল্লাহতায়ালা চান, প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তি সে প্রশিক্ষন নিয়ে বেড়ে উঠুক। কারণ, একমাত্র সে ভাবে বেড়ে উঠার মধ্যেই মু’মিন ব্যক্তির সফলতা। তখন সে সফল হয় পৃথিবী পৃষ্ঠে খেলাফতের দায়িত্বপালনে। আল্লাহপাক তো মু’মিনের জীবনে সে সফলতাটিই দেখতে চান। মু’মিন জান্নাত পাবে খেলাফতের দায়িত্ব পালতে সফল হওয়ার বিনিময়ে। যার মধ্যে সে প্রশিক্ষণ নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের সামর্থও নাই। আর সে প্রশিক্ষণের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো হজ্জ। তাই সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যার মধ্যে হজ্জ নাই, বুঝতে হবে আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনে তার কোন আগ্রহও নেই। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “সামর্থ্য থাকা সত্বেও হজ্জ না করে যার মৃত্যু হলো সে খৃষ্টানরূপে না ইহুদীরূপে মারা গেল -তা নিয়ে তাঁর কিছু যায় আসে না।” অর্থাং তার জন্য নবীজী(সা:) সুপারিশ করতে রাজি নন। বোখারী শরীফের হাদীসে বর্নীত হয়েছে, নবীজী(সা:) হযরত আয়েশাকে বলেছেন, হজ্জই তাঁর জন্য জিহাদ।
মর্যাদা শ্রেষ্ঠ ইবাদতের
ইসলামে কোনটি শ্রেষ্ঠ এবাদত -তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। সে প্রশ্ন জেগেছিল ইমাম হযরত আবু হানিফার (রহ) মনেও। হজ্জ সমাপনের পর তিনি বলেছেন, হজ্জই শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ) বলেছেন, যাদের মনে আল্লাহর প্রতি প্রবল ভালোবাসা,তারা তৃপ্তি পেতে পারেন হজ্জে গিয়ে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, হজ্জ কেন শ্রেষ্ঠতম ইবাদত? কেনই বা এটি আল্লাহর আশেকদের আত্মতৃপ্তি লাভের মাধ্যম? ইসলামে ইবাদত মূলত দৈহিক, শারিরীক ও আত্মিক। একমাত্র হজ্বেই ঘটে সবগুলোর সমন্বয়। হজ্জের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। কালেমায়ে শাহাদত উচ্চারনে দৈহিক কসরত নেই। তাতে অর্থব্যয়ও নেই। এতে পাহাড়-পর্ব্বত, বিজন মরুভুমি, নদনদী বা সমুদ্র-মহাসমুদ্র অতিক্রমেরও প্রয়োজন পড়ে না। তেমন দৈহীক কসরত নেই জায়নামাযে দাঁড়িয়ে নামায আদায়ে। এতটা কষ্টস্বীকার, এতটা অর্থব্যয় ও সময়ব্যয় হয় না রোযাতেও। যাকাতে অর্থব্যয় হলেও তাতে হজ্জের ন্যায় অর্থব্যয় নেই। শ্রমব্যয় এবং সময়ব্যয়ও নেই। বস্তুত হজ্জের মধ্যে রয়েছে ইবাদতের সমগ্রতা তথা পূর্ণ প্যাকেজ। এযুগে বিমানযোগে হজ্জের যে সুযোগ সেটি নিতান্তই সাম্প্রতিক। বিগত চৌদ্দ শত বছরের প্রায় সমগ্রভাগ জুড়ে মুসলিমরা হজ্জ করেছে পায়ে হেঁটে বা উঠ, ঘোড়া ও গাধার মত যানবাহনে চড়ে। তখন দৈহিক ক্লান্তির ভারে হজ্জে গিয়ে অনেকেই আর নিজ ঘরে ফিরে আসতেন না,পাড়ী জমাতেন পরপারে। তাই সে আমলে শেষ বিদায় নিয়ে দূর-দেশের লোকেরা মক্কার পথে বেরুতেন। হজ্জ পালনে যে প্রচন্ড শারিরীক কসরত তার মূল্যয়াণ করতে হবে সে আঙ্গিকেই।
গড়ে হিজরতের অভ্যাস
ইসলামের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো হিজরত। আল্লাহর খলিফা রূপে গড়ে তোলার এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণও। হিজরত এখানে নিজ ঘর, নিজ পরিবার-পরিজন, নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার। নবীজী(সা:) ও সাহাবায়ে কেরাম মক্কা ছেড়ে মদিনায় গিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে ফিলিস্তিন, মিশর ও হিজাজের পথে পথে হাজার হাজার মাইল ঘুরেছেন। হিজরত করেছেন হযরত ইউসুফ (আ:), হযরত ইয়াকুব (আ:) ও হযরত মূসা (আ:)’য়ে র ন্যায় আরো বহু নবী-রাসূল। নিজ দেশ, নিজ ঘর, নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবার-পরিজনের বাঁধনে যে স্থবির জীবন, তাতে আবদ্ধ হলে আল্লাহর পথে চলাটি অসম্ভব। হজ্জ গড়ে তোলে সে স্থবিরতা ছিন্ন করে হিজরতের অভ্যাস। ব্যক্তিকে তার আপন ঘর থেকে হজ্জ বাইরে নিয়ে আসে। জীবনে আনে গতিময়তা। হিজরত ছাড়া উচ্চচতর জীবনবোধ ও সভ্যতার নির্মান কি সম্ভব? ইতিহাসের সবগুলো উচ্চতর সভ্যতাই তো মহাজিরদের সৃষ্টি। বলা হয়ে থাকে, ‘সফর নিছফুল ইলম।” অর্থ: ভ্রমন হলো জ্ঞানের অর্ধেক। জ্ঞানার্জন ইসলামে ফরজ। হজ্জ তো সফরকেও অনিবার্য করে তোলে। এভাবে সুযোগ করে দেয় অন্যদের দেখার এবং তাদের থেকে শেখার। হজ্জ দেয় নানা দেশের নানা জনপদের বিচিত্র পরিবেশে চিন্তাভাবনা ও ধ্যানমগ্নতার সুযোগ। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল এরূপ বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়নমান যে ব্যস্ত জীবন, সে জীবনে মহত্তর লক্ষ্য নিয়ে দীর্ঘকাল ব্যাপী ভাববার অবসর কোথায়? অথচ জীবনের সঠিক উপলব্ধি ও মূল্যায়নে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এরূপ তাফাক্কুহ বা চিন্তাভাবনা ইসলামে শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। নবীজীর হাদীস: “আফজালুল ইবাদাহ তাফাক্কুহ”। অর্থ: শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো চিন্তাভাবনা করা। চিন্তা ভাবনার অভাবে সুস্থ মানুষও ভারবাহী গাধায় পরিণত হয়। কুর’আনে বহু আয়াত নাজিল হয়েছে শুধু চিন্তাভাবনার গুরুত্ব বোঝাতে। “আফালা তাফাক্কারুন”, “আফালা তাদাব্বারুন”, “আফালা তাক্বীলুন” পবিত্র কুর’আনে এরূপ নানা প্রশ্ন। চিন্তা ভাবনার সামর্থ্য থাকা সত্বেও মানুষ কেন চিন্তাভাবনা করে না -পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতয়ালার সেটিই গুরুত্নবপূর্ণ প্রশ্ন। মোজাদ্দিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি এবং বাংলার হাজী শরিয়াতুল্লাহ দুদু মিয়া ও হাজী তিতুমীরের মত মহান ব্যক্তিবর্গ তাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবক ও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা পেয়েছেন হজ্জে গিয়ে। হজ্জে গিয়েই ইরানের বিপ্লবী লেখক ড. আলী শরিয়তি এবং বিখ্যাত মার্কিন নওমুসলিম ম্যালকম এক্স’য়ের ন্যায় শত শত ব্যক্তি পেয়েছিলেন তাদের নিজ নিজ জীবনে নতুন পাঠ। হজ্জ শেষে তারা দেশে ফিরেছিলেন আমুত্যু মোজাহিদ রূপে। হজ্জে গিয়ে তারা পেয়েছিলেন আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের এক অদম্য প্রেরণা এবং জীবনের মোড়-ফেরানো প্রশিক্ষণ। অথচ লক্ষ লক্ষ ভাবনাশূণ্য মানুষ হজ্জ থেকে ফিরে স্রেফ হাজির খেতাব নিয়ে। এটি কি কম ব্যর্থতা?
যাদের জীবনে আল্লাহর পথে গতিময়তা এবং ভাবনা নাই, তাদের জীবনে সিরাতুল মোস্তাকিমপ্রাপ্তিও নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা থেকে সকাল এক আমৃত্যু চক্রে তারা বন্দী। এ বন্দীদশাতেই অবশেষে তারা একদিন মৃত্যুর পথে হারিয়ে যায়। অসংখ্য উদ্ভিদ ও কীটপতঙ্গের ন্যয় এভাবেই অতীতের গর্ভে হারিয়ে গেছে শত শত কোটি মানুষ। মহান আল্লাহতায়ালা এ ব্যস্ত মানুষকে সব ব্যস্ততা ফেলে তার ঘরে জমায়েত হওয়ার ডাক দেন। মিনা, আরাফাত ও মোজদালিফায় অবস্থান তার জীবনে ধ্যান মগ্ন হওয়ার সুযোগ করে দেয়। আল্লাহর ডাকে এভাবে তাঁরই ঘরে গিয়ে লাব্বায়েক তথা ‘আমি হাজির’ বলার মাঝে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে যে একাত্মতা ঘটে তা কি আর কোন ইবাদতে সম্ভব? আর এ একাত্মতার মাঝে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাহর জীবনের মূল পাঠটি তার চেতনার সাথে মিশিয়ে দিতে চান। সেটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমে লাব্বায়েক অর্থাৎ আমি হাজির বলা। একজন একনিষ্ট গোলামের জীবনে এর চেয়ে উত্তম আচরণ আর কি হতে পারে? এর বিপরীত হল অবাধ্যতা বা বিদ্রোহ, ব্যক্তির জীবনে তা নিরেট পথভ্রষ্টতা এবং পরিণামে তা জাহান্নাম ডেকে আনে। কথা হলো, যে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বস্তরে আল্লাহর অবাধ্যতা, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব যেখানে ভূলুন্ঠিত, প্রতিষ্ঠিত যেখানে মানুষের সার্বভৌমত্ব এবং মুসলিমের রাজনীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ,অর্থনীতি ও সংস্কৃতি যেখানে আল্লাহর বিরুদ্ধে অবাধ্যতার প্রতীক -সেখানে লক্ষ লক্ষ হাজীর মুখে লাব্বায়ক উচ্চারনের মূল্য কতটুকু? মহান আল্লাহতায়ালা কি বান্দাহর এমন ফাঁকা বুলিতে খুশি হন?
অভ্যাস গড়ে আল্লাহর হুকুমে ‘লাব্বায়েক’ বলার
ঈমান হলো আল্লাহর প্রতি হুকুমে সর্বাবস্থায় ‘লাব্বায়েক’ (আমি হাজির) বলার সামর্থ্য। সে সামর্থ্যটি না থাকলে আল্লাহর দ্বীন ও তাঁর নাযিলকৃত কুর’আন বোঝা যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব হলো সে কুর’আনী হুকুমের প্রতিপালন ও পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়া। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ও সবচেয়ে বড় অসামর্থ্যতা হলো এটি। এই একটি মাত্র অসামর্থ্যতাই মানব জীবনের সকল অর্জনকে পুরাপুরি ব্যর্থ করে দেয়। আজকের মুসলিমরা যে কুর’আনকে বুঝতে ও তার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে -তার মূল কারণ হলো আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্যহীনতা। তাদের সামনে আল্লাহর কুর’আন আছে, কুর’আনের হুকুমও আছে এবং নবীজী (সা:)’র মহান সূন্নতও আছে, কিন্তু যা নাই তা হলো তাঁর হুকুমে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য। এমন অসামর্থ্যতাই মূলত আযাব ডেকে আনে। শুধু আখেরাতে নয়, দুনিয়াতেও। নামধারি মুসলিমরা তখন ইহুদীদের ন্যায় ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়। মহান আল্লাহর নাযিলকৃত তাওরাত নিয়ে ইহুদীরা খুবই গর্ব করতো –যেমন আজকের মুসলিমরা পবিত্র কুর’আন নিয়ে করে। কিন্তু তাদের আগ্রহ ছিল না তাওরাতে বর্নিত মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমগুলি পালনে। সে অপরাধে মহান আল্লাহতায়ালা ইহুদীদেরকে ভারবাহি গর্দভ রূপে আখ্যায়ীত করেছেন। পবিত্র কুর’আনে সে বর্ণনাটি এসেছে এভাবে, “যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেয়া হয়েছিল অথচ তারা সেটি বহন করেনি তাদের দৃষ্টান্তটি হলো ভারবাহি গর্দভের ন্যায়। কতই না নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতগুলিকে অস্বীকার করে। আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন।” –(সুরা জুমু’আ, আয়াত ৫)। ভারবাহী পশুদের পিঠে মূল্যবান কিতাবের বিশাল বোঝা থাকলেও সে কিতাবের শিক্ষা ও হুকুম-আহকাম নিয়ে তারা ভাবে না। এরূপ ভারবাহি গর্দভদের কাছে সেগুলির প্রতিষ্ঠাও গুরুত্ব পায় না। ইহুদীগণ তাই শুধু তাওরাতকে যুগ যুগ বহন করেই বেরিয়েছি, কিন্তু তার প্রতিষ্ঠায় মনযোগী হয়নি। মহান আল্লাহর কাছে ইহুদীগণ একারণেই ভয়ানক অপরাধী। এরূপ অপরাধীগণ কি কোন পুরস্কার পেতে পারে? সিরাবতুল মোস্তাকীম থেকে পথভ্রষ্টতাই যে এরূপ ভারবাহি গর্দভদের প্রকৃত প্রাপ্তি –পবিত্র কুর’আনে সে হুশিয়ারিটিও বার বার এসেছে। আর সে পথভ্রষ্টতার পথ বেয়েই তাদের জীবনে ধেয়ে আসে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিশ্রুত আযাব। প্রশ্ন হলো, ইহুদীদের ন্যায় মুসলিম নামধারি ভারবাহি গর্দভও কি মুসলিম সমাজে কম? লক্ষ লক্ষ হাফেজ, আলেম ও মুসল্লি ব্যস্ত শুধু কুর’আনের আয়াতগুলি তেলাওয়াত ও মুখস্ত করা নিয়ে, কিন্তু সেগুলির পালনে কোন আগ্রহই নেই। ফলে তাদের জীবনে জিহাদ বা কোরবানিও নেই। ফলে ইহুদীগণ যেমন তাওরাতের বিধান পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি ব্যর্থ হয়েছে ৫০টির বেশী মুসলিম রাষ্ট্রের দেড় শত কোটি মুসলিম। তাই এসব মুসলিম দেশের কোনটিতেও মহান আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত শরিয়তি বিধানের প্রয়োগ হচ্ছে না। কোন রাষ্ট্রে কতটা ধর্ম পালন হলো সেটির হিসাব কি মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা গুণে হয়? নামাযী, রোযাদার ও হাজীদের সংখ্যা দিয়েও কি সে বিচার চলে? পশু কোরবানির আয়োজন দেখেও কি সেটি বুঝা যায়? সে বিচার তো হয় মহান আল্লাহর শরিয়তি বিধান কতটা প্রতিষ্ঠা পেল তা থেকে। এজন্য তো চাই মানুষের জানমালের কোরবানি। নবীজী(সা:) ও তাঁর মহান সাহাবাগণ তো সে পথেই দ্বীনের বিজয় এনেছিলেন, স্রেফ মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়িয়ে নয়।
অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও দুর্বৃত্তিতে মুসলিমগণ যে বিশ্বে রেকর্ড গড়ছে তার মূল কারণ তো শরিয়তের প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের ব্যর্থতা। ফলে মুসলিম বিশ্বে তেলগ্যাস, ধন-সম্পদ ও জনসম্পদ বিপুল ভাবে বাড়লেও পরাজয় ও অসম্মান এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। নিছক কুর’আন পাঠ ও কুর’আনের মুখস্থ্য তেলাওয়াতে যেমন সে সামর্থ্য বাড়ে না, তেমনি বাড়ে না নিছক নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত পালনেও। কুর’আন-পাঠ ও নামায-রোযা পালন এমন কি মুনাফিক, ফাসেক বা জালেমের পক্ষেও সম্ভব। আল্লাহপাক চান, তাঁর প্রতিটি হুকুমের প্রতি ঈমানদারের আনুগত্য ও অঙ্গিকার প্রকাশ পাক তার প্রতিটি কথা, কর্ম ও আচরণে। ইসলাম সেটিকেই মু’মিনের আজীবনের অভ্যাসে পরিণত করতে চায়। তাছাড়া যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকুম পালনে “লাব্বায়েক” বলতে পারে না, সে ব্যক্তি কি তার নিজ বিবেকের ডাকে বা অন্য কোন ন্যায় কর্ম পালনে লাব্বায়েক বলতে পারে? আল্লাহর হুকুমে লাব্বায়েক বলার অভ্যাস গড়ে তোলার স্বার্থেই নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাতের ন্যায় ইবাদত পালনে রয়েছে ধর্মীয় বাধ্য-বাধকতা। যে শ্লোগানটিতে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি আনুগত্যের প্রবল প্রকাশ, সেটিই হলো ‘লাব্বায়েক’। তাই যেখানেই আল্লাহর নির্দেশ, সেখানেই ঈমানদার মাত্রই বলে “আমি হাজির”।
ঈমানদারের পুরস্কারটি বিশাল, তেমনি দায়বদ্ধতাও বিশাল। সে বিশাল পুরস্কারটি হলো অনন্ত অসীম কালের জন্য অফুরন্ত নিয়ামত-ভরা জান্নাত। আর দায়বদ্ধতা হলো, আমৃত্যু আল্লাহর সৈনিক রূপে কাজ করা। আল্লাহতায়ালা ঈমানদারের জানমাল কিনে নেন জান্নাতের বিনিময়ে। মহান আল্লাহর সে ঘোষণাটি এসেছে এভাবে,“নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনের জান ও মাল এ মূল্যে কিনে নিয়েছেন যে তাদের জন্য হবে জান্নাত।(এবং বিনিময়ে) তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে করে,সে যুদ্ধে তারা (শত্রুদের) হত্যা করে এবং (নিজেরাও শত্রুদের) হাতে নিহত হয়।” –(সুরা তাওবাহ, আয়াত ১১১)। মু’মিন মাত্রই তাই মহান আল্লাহর ক্রয়কৃত সৈনিক। তার উপর মালিকানা একমাত্র মহান আল্লাহর। তাঁর প্রতি হুকুমদাতা হলেন একমাত্র তিনিই। মহান আল্লাহর সে হুকুম আসে পবিত্র কোরআনের ফরমানের মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহর ক্রয়কৃত এ সৈনিক কখনোই কোন রাজা, স্বৈরাচারি শাসক বা সেক্যুলার নেতার ডাকে লাব্বয়েক বলে না। তাদের ডাকে যুদ্ধও করে না। যুদ্ধ করে না কোন বর্ণ, ভাষা বা ভূগোল-ভিত্তিক পরিচয়কে বড় করার জন্য। বরং যুদ্ধ করে একমাত্র মহান আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আনতে।
আল্লাহর ডাকে সর্বাবস্থায় লাব্বায়েক বলতে গিয়ে ইব্রাহিম (আ:) পিতা-মাতা, ঘরবাড়ী, এমনকি দেশছাড়াও হয়েছেন। বিচ্ছিন্ন হয়েছেন একমাত্র পুত্র ঈসমাইল ও বিবি হাজেরা থেকে। আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে খাদ্য-পানীয়হীন অবস্থায় ছেড়েছেন জনবসতিহীন মক্কার মরুর প্রান্তরে। যখন হুকুম পেয়েছেন একমাত্র পুত্রের কোরবানির, তখনও তিনি দ্বিধাদ্বন্দে পড়েননি। প্রবল ঈমানী বল নিয়ে সে হুকুম পালনে লাব্বায়েক বলেছেন। আল্লাহতায়ালার হুকুমে এভাবে লাব্বায়েক বলার ক্ষেত্রে ইব্রাহীম (আ:) হচ্ছেন সমগ্র মানব ইতিহাসে এক মহান আাদর্শ। “লাব্বায়েক” বলেছেন হযরত ইব্রাহিম (আ:)’র স্ত্রী বিবি হাজেরা এবং শিশু পুত্র ঈসমাইল(আ:)ও। তাঁকেও যখন বলা হয়েছিল, আল্লাহ তোমার জানের কোরবানি চান তখন তিনিও সাগ্রহে বলেছিলেন, “লাব্বায়েক”। অথচ বাঁচবার স্বপ্নসাধ কার না থাকে? কিন্তু আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ জীবনে আর কি থাকতে পারে? শিশু ঈসমাইলও সেটি বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন তাঁর মহান বিবি হাজেরাও। ফলে ঘরবাড়ী ও গাছপালা নেই,খাদ্য-পানীয় ও কোন প্রাণীর আলামত নেই -এমন এক মরুর বুকে শিশু পুত্রকে নিয়ে একাকী অবস্থানের হুকুম এলে তিনিও তখন লাব্বায়েক বলেছিলেন। অতি কষ্টে প্রতিপালিত একমাত্র সে শিশু ইসমাইলককে যখন কোরবানি করার হকুম হলো বিবি হাজেরা তখনও দ্বিধান্বিত হননি। আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার চেয়ে বাঁচবার অন্য কোন উচ্চতর প্রেরণার কথা তিনি ভাবতেই পারেননি। তাই তিনি মহান আল্লাহর প্রতি নির্দেশে লাব্বায়েক বলেছেন সমগ্র অস্তিত্ব ও অঙ্গিকার নিয়ে। এভাবে আল্লাহর ডাকে সর্বাবস্থায় লাব্বায়েক বলার যে শিক্ষা ইব্রাহীম (আ:) এবং তাঁর পরিবার রেখেছেন তা সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে আজও অনন্য হয়ে আছে। প্রতি যুগের প্রতিটি মুসলিম বাঁচবে সে ইব্রাহীমী মিশন নিয়ে –সেটিই তো কাঙ্খিত। তিনিই তো মুসলিমের আদি পিতা ও মডেল। আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং তাঁর পরিবারের মিশনে ও আত্মত্যাগে এতোই খুশি হয়েছিলেন যে সেটিকে তিনি পবিত্র কুর’আনে বার বার উল্লেখ করেছেন। তাঁর সে মহান সূন্নতকে আল্লাহতায়ালা হজ্জ রূপে ফরজ করেছেন। এভাবে সুস্পষ্ট করেছেন, আল্লাহপাক মোমেনের কোন ধরণের আমলে খুশি হন -সে বিষয়টিও।
লাব্বায়েক শয়তানের ডাকে!
শুধু নামায-রোযা পালন, কিছু অর্থদান, কিছু সময়দান বা হজ্জ করে যারা আল্লাহকে খুশি করার স্বপ্ন দেখেন ইব্রাহীম (আ:)’র শিক্ষা থেকে তাদের বোধোদয় হওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর হুকুমের প্রতি সর্বাবস্থায় ও সর্বসময়ে পূর্ণ-আনুগত্য। তাই শুধু হজ্জে গিয়ে লাব্বায়েক বলায় কল্যাণ নেই। আল্লাহর নির্দেশের প্রতি লাব্বায়েক বলতে হবে দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কতি, আইন-আদালত তথা সর্বক্ষেত্রে। তাই যে দেশে আল্লাহর শরিয়ত ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা নেই এবং সে লক্ষ্যে কোন চেষ্টাও নেই –বুঝতে হবে আল্লাহর হুকুমের ডাকে সেদেশে লাব্বায়েক বলার লোক নেই। জাতীয়তাবাদ যে দেশের রাজনীতি, সূদী ব্যবস্থা যে দেশের অর্থনীতি এবং পর্দাহীনতা, নাচ-গান ও অশ্লিল যাত্রা-সিনেমা যে দেশের সংস্কৃতি -সেদেশ তো বিজয়ের ঝান্ডা উড়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। যে মহিলা হজ্জ করে অথচ বেপর্দা ভাবে জনসম্মুখে চলাফেরা করে, বুঝতে হবে হজ্জ-পালন কালে তার মুখে লাব্বায়েক ধ্বনিত হলেও তাতে সাচ্চা ঈমানদারী ছিল না। সেটি ছিল নিছক আচার, আল্লাহর প্রতি ঈমানদারী নয়। এমন হাজীরা তো শয়তানের ডাকেও লাব্বায়েক বলে। পোষাকে বেপর্দাগী, রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজম, অর্থনীতিতে সূদ ও পুঁজিবাদ, বিচারে কুফরি আইন –এসবই তো শয়তানের ডাকে লাব্বায়েক বলার আলামত। ভন্ডামি এখানে ইসলামের সাথে। এমন ভন্ডদের কারণেই বাংলাদেশে মত মুসলিম দেশগুলিতে হাজীর সংখ্যা বাড়লেও আল্লাহর শরিয়তী বিধানের প্রতিষ্ঠার জিহাদে লাব্বায়েক বলা লোকের সংখ্যা বাড়ছে না। বরং বিপুল ভাবে বাড়ছে শয়তানের হুকুমের প্রতি লাব্বায়েক বলার লোক। ফলে বাড়ছে সূদী ব্যাংক, বাড়ছে পতিতাপল্লি, বাড়ছে দূর্নীতি, বাড়ছে মদ্যপান, বেপর্দাগী ও ব্যভিচার । এমন ভন্ড মুসলিমগণ হজ্জ পালন করে নিছক ধর্মীয় আচার রূপে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের মিশনকে নিজ জীবনে গ্রহণ করার আগ্রহ নিয়ে নয়। অথচ মুসলিমকে শুধু মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর নবী-রাসূলদের প্রতি গভীর ভালবাসা নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বাঁচতে হয় শয়তান ও তার অনুসারীদের প্রতি আপোষহীন ঘৃনা নিয়ে। সে ছবকটিও হজ্জে শেখানো হয়। তাই হজ্জে শয়তানের প্রতিকী স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপও ইবাদতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর বান্দাহর ইসলামে পুরাপুরি প্রবেশ। ঈমানদারীর অর্থ শুধু নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত পালন নয়, সেটি মিথ্যাচর্চা, সূদ-ঘুষ, ব্যাভিচারী, বেপর্দাগীর ন্যায় সকল প্রকার অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকাও। নইলে নেমে আসে কঠিন আযাব। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে কঠোর ঘোষণাটি এসেছে এভাবে, “তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির মধ্যে নিক্ষপ্ত হবে। তারা যা করে আল্লাহ সে সম্বন্ধে বেখবর নন।” –(সুরা বাকারা, আয়াত ৮৫)। ইসলামে পুরাপুরি প্রবেশের সে ছবকটি দেয় হজ্জ। সেটি লাব্বায়েক বলার সামর্থ্যটি চেতনার গভীরে প্রথীত করার মধ্য দিয়ে। তখন মু’মিন ব্যক্তিটি শুধু আযান বা হজ্জের ডাকে শুধু লাব্বায়েক বলে না, জিহাদের ডাকেও লাব্বায়েক বলে। তখন বিজয় এসেছে আল্লাহর দ্বীনের।
মুসলিমদের আজ যে বিশ্বব্যাপী পরাজয়, পশ্চাদপদতা ও হীনতা, সেটি কি উপরে উল্লেখিত আয়াতকেই শতভাগ সত্য প্রমাণিত করে না? এ হীনতা যে আল্লাহর প্রতিশ্রুত আযাব -তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে? মুসলিম বিশ্ব বস্তুত সে প্রতিশ্রুত আযাবের গ্রাসে। বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলিমের মানসম্মান ও ইজ্জতের এখনো কি কিছু অবশিষ্ঠ আছে? স্রেফ খাদ্য-উৎপাদন, শিল্প-উৎপাদন, সড়ক-উন্নয়ন বা শিক্ষার হার বাড়িয়ে কি এ হীনতা ও অপমান থেকে মুক্তি মেলে? মুসলিমদের মাঝে ইসলামের আংশিক অনুসরণ করে তথা নামায-রোযা-হজ্জ-যাকাত পালন করে, এমন লোকের সংখ্যা আজ বহু কোটি। কিন্ত মুসলিম সমাজে সূদখোর, ঘুষখোর, মদখোর ও ব্যাভিচারীর ন্যায় আল্লাহর অবাধ্য মানুষের সংখ্যাও কি কম? মুসলিম রাষ্ট্রগুলির রাজনীতি, অথনীতি ও আইন-আদালতের সবটুকু জুড়ে আল্লাহর অবাধ্যতা, প্রতিষ্ঠা পায়নি শরিয়ত। ইসলামের নামে মুসলিমদের মাঝে যা বেড়েছে তা তো আংশিক অনুসরণ মাত্র। এমন আংশিক অনুসরণ মহান আল্লাহর আযাব ডেকে আনার জন্য যথেষ্ঠ। সে আযাবের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি শুনানো হয়েছে উপরুক্ত আয়াতে। চেতনার ভূমি কখনোই খালি থাকে না। আল্লাহর স্মরণ বা যিকর সেখানে স্থান না পেলে সে স্থান অধিকৃত হয় শয়তানের হাতে। তেমনটি ঘটে মত ও পথের অনুসরণের ক্ষেত্রেও। ইসলামের পূর্ণ অনুসরণ জীবনে স্থান না পেলে স্থান পায় শয়তানের অনুসরণ। এমন ব্যক্তিরাই রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি ও কর্মক্ষেত্রে শয়তানের ডাকে ‘লাব্বায়েক’ বলে।
মহান আল্লাহতায়ালার ইনষ্টিটিউশন
হজ্জ মূলত মুসলিমদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও তাঁর পরিবারের আদর্শের সাথে পরবর্তীকালের মুসলিমদের একাত্মতার মহড়া। আল্লাহপাক তাঁর এই মহান বান্দাহ ও তাঁর পরিবারকে এভাবেই সন্মানিত করেছেন। আল্লাহ চান তার অনুগত বান্দাহগণ হযরত ইব্রাহীমের (আ:) আদর্শে গড়ে উঠুক। গড়ে তুলুক এমন এক বাহিনী যার প্রতিটি সৈনিক হযরত ইব্রাহীম (আ:)’র মতই আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশে দ্বিধাহীন চিত্তে লাব্বায়েক বলবে। আল্লাহতায়ালার অনুগত বান্দাদের জন্য তিনিই শ্রেষ্ঠতম মডেল। ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) যে ভাবে এ মডেলকে অনুসরণ করেছিলেন সেটি ফরজ সকল মুসলিমের জন্যও। বস্তুত হজ্জ হলো সূন্নতে ইব্রাহীম (আ:)’র আলোকে সত্যনিষ্ঠ মু’মিন গড়ার ইনষ্টিটিউশন। আল্লাহতে আত্মসমর্পণের ছবকই এর মূল পাঠ। আল্লাহর অনুগত বান্দারূপে ঈমানদারের কি দায়িত্ব সে বিষয়ে ঘর থেকে বহুদূরে একান্ত নিবিড়ে নিয়ে মিনায়, আরাফায় বা মোজদালেফায় বসিয়ে ভাববার সুযোগ করে দেয়।
হযরত ইব্রাহীম (আ:) এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্রের সূন্নতকে হাজীদের পালন করতে হয়। অন্যথায় হজ্জ হয় না। বিবি হাজেরা তার শিশুপুত্রের তৃষ্ণা মেটাতে যেভাবে পানির খোঁজে সাফওয়া ও মারওয়ার মাঝে দৌড়িয়েছিলেন আজও প্রতিটি হাজীকে -তা বৃদ্ধ হোক বা জোয়ান হোক, নারী হোক বা পুরুষ হোক, রাজা হোক বা প্রজা হোক, সকলকেই সেভাবে দৌড়াতে হয়। ‘সায়’ অর্থ প্রচেষ্ঠা। পানিহীন মরুভূমির মাঝেও হতাশ না হয়ে বিবি হাজেরা যেরূপ পানির খোঁজে স্বচেষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি স্বচেষ্ট হতে হবে প্রতিটি মুসলিমকে তার জীবন-সমস্যার সমাধানে। তথা কল্যাণকর কাজে। এখানে কোন অলসতা চলে না। তাঁর সে নিরলস প্রচেষ্ঠাটি মানব জাতির জন্য এতটাই শিক্ষণীয় যে বিবি হাজেরার সে সূন্নত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে হজ্জের ফরজ বিধান রূপে। সভ্যতা সভ্যতর হয় এবং মানব-জীবন উন্নততর হয় তো কল্যাণ কর্মে এমন প্রাণান্তকর প্রচেষ্ঠার কারণেই। এ চেতনাতেই মুসলিম তাই ভিক্ষুক হয়না, হতাশ ও হতোদ্যম হয় না এবং কর্ম থেকে অবসরও নেয় না। বরং সর্বাবস্থাতে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে মেধা, শ্রম, সময় ও রক্ত বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ মু’মিনের “সায়” শুধু সাফা ও মারওয়ার মাঝে শেষ হয় না, বরং সেটি আমৃত্যু চলে। মু’মিনের জীবনে এজন্যই কোন অবসর নাই। এটি সেক্যুলার ধারণা।
বিবি হাজেরা ছিলেন একজন দাসী। তাই ইব্রাহীম (আ:)’র নিঃসন্তান প্রথম স্ত্রী বিবি সারার আপত্তি ছিল না তাঁকে স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করায়। আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ আনুগত্যের কারণেই বিবি হাজেরা পুরস্কৃত হয়েছেন। আল্লাহপাক এভাবে সম্মানিত করেছেন এক নারীকে। এমন মহাসম্মান কোন রাজাবাদশাহ বা সম্ভ্রান্ত বংশের কোন অভিজাত নর বা নারীর ভাগ্যেও জুটেনি। কোন পয়গম্বরের ভাগ্যেও জুটেনি। বরং পেয়েছে এমন এক মা যিনি তাঁর একমাত্র সন্তানের কোরবানির নির্দেশে নিঃসংকোচে লাব্বায়েক বলেছিলেন।। পিতা-মাতার সাথে একাত্ম হয়ে ইসমাইল (আ:) যে ভাবে নিজেকে কোরবানি করতে লাব্বায়েক বলেছিলেন সেটিও সমগ্র মানব-ইতিহাসে অনন্য। মানুষের আমল তো পুরস্কৃত হয় তার নিয়তের ভিত্তিতে। সে নিয়তে কি হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও ইসমাইল (আ:)’য়ের মাঝে কোন কমতি ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ:) যখন নিজের চোখ বেঁধে পুত্র ইসলামের গলায় ছুড়ি চালাচিছলেন তখন তো হযরত ইব্রাহীম (আ:) ও ইসমাইল (আ:)-এ দুজনের কেউ জানতেন না যে আল্লাহতায়ালা হযরত ইসলমাঈল (আ:)’র বদলে ভেড়াকে সেখানে কোরবানির জন্য পেশ করবেন। তাই তাদের কোরবানি মহান আল্লাহর দরবারে সেদিন গৃহীত হয়েছিলে। পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে তাদের সে আদর্শের সূন্নত পালন করতে হয় বিশ্বের মুসলিমদের। এটি না করলে হাজীদের হজ্জ পালনই হয় না।
হজ্জ নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, মানুষকে একটি মহত্বর লক্ষে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া মাত্র। আল্লাহর চুড়ান্ত লক্ষ্যটি হলো তার দ্বীনকে বিজয়ী করা। পবিত্র কুর’আনে যেমন বলা হয়েছে, “হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ তিনি তাঁহার রাসূলকে প্রেরণ করেছেন এ জন্য যে দুনিয়ার সকল দ্বীনের উপর এটি বিজয়ী হবে।” -(সুরা ছফ, আয়াত ৯)। তবে এ বিজয় এমনিতে আসে না। এ কাজ ফেরেশতাদেরও নয়। বরং একাজ নিতান্তই মানুষদের। এ কাজ সমাধার জন্য ফেরেশতা হওয়ার যেমন প্রয়োজন নেই, তেমনি সুফি বা দরবেশ হওয়াও কাঙ্খিত নয়। বরং চাই জিহাদ। চাই সে জিহাদে অর্থদান, শ্রমদান, রক্তদান, এমনকি প্রাণদান। ইসলাম-বিরোধীদের নির্মূলে জরুরি হলো এমন এক বাহিনীর যারা আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশের প্রতি নিষ্ঠার সাথে লাব্বায়েক বলবে। যেমনটি হযরত ইব্রাহীম (আ:) বলেছিলেন। নইলে বিজয় অসম্ভব। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ফেরেশতাকুল নেমে আসে একমাত্র তখনই যখন পৃথিবী পৃষ্ঠে এমন একটি বাহিনী আল্লাহর পথে জান ও মালের কোরবানিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। আল্লাহর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এমন একটি বাহিনী গড়তে পেরেছিলেন বলেই তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলিমরাই হচ্ছে এ কাজে তাঁর একমাত্র বাহিনী। পবিত্র কুর’আনে আল্লাহতায়ালা সে বাহিনীকে আখ্যায়ীত করেছেন ‘হিযবুল্লাহ’ বা আল্লাহর দলরূপে। তবে নিছক দলই যথেষ্ট নয়। সে দলের জন্য লাগাতর ট্রেনিংও অপরিহার্য। সে ট্রেনিং শুধু দৈহিক নয়; আর্থিক ও আত্মিক হওয়াটাও জরুরি। নইলে অর্থ, রক্ত ও অর্থদানের জজবা সৃষ্টি হয়না। হজ্জের মধ্যে সমন্বয় ঘটেছে সবগুলীরই। লাব্বায়েক হলো বস্তুত এ বাহিনীর শপথ বাক্য। এখানে শপথ আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের। এটি হলো তাঁর লা-শরিক ওয়াহদানিয়াতের তথা শিরকমুক্ত একত্বের স্বীকৃতি এবং সে সাথে আল্লাহর ডাকে সদাসর্বদা লাব্বায়েক বলার। হাজীদের তাই বলতে হয়, “লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েক লা-শারিকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়ামাতা লাকাওয়াল মুলক, লা-শারিকা লাকা লাব্বায়েক।”
ইতিহাসের উম্মূক্ত যাদুঘর
ইসলামের বিজয় আনার দায়ভারটি একার নয়, এ কাজ সমষ্টির। তাই প্রয়োজন, এ বাহিনীর অন্য সবার সাথে এক সাথে বসার। প্রয়োজন হলো, নানা বর্ণ, নানা ভাষা ও নানা দেশের এ বিশ্ববাহিনীর সৈনিকদের পারস্পারিক পরিচয়ের। প্রয়োজন হলো, মুসলিম সমস্যার পরস্পরে অনুধাবনের এবং একসাথে চিন্তাভাবনা ও স্ট্রাটিজী প্রণয়নের। এজন্য জরুরি হলো বিশ্বভাতৃত্ব। তাই মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো প্যান-ইসলামিক চেতনায় দীক্ষা নেওয়া। বিশ্বভাতৃত্ব তাই মুসলিমের রাজনৈতিক শ্লোগান নয় -এটি তাঁর গভীর ঈমানের আত্ম-চিৎকার। ফলে ঈমানদার ব্যক্তি পুতুল-পূজাকে যতটা ঘৃনা করে, ততটাই ঘৃনা করে বর্ণবাদ, গোত্রবাদ ও জাতীয়তাবাদকে। কারণ, এগুলো হলো মুসলিমদের বিশ্বজনীন ভাতৃত্বের বুকে অনৈক্য সৃষ্টির ঘাতক ভাইরাস। আজ মুসলিমেরা যেভাবে বিভক্ত, শক্তিহীন ও বিপর্যস্ত তা তাদের মাঝে কোন পুতুল পূজার কারণে নয়। বরং সেটি ভিন্ন ভিন্ন ভূগোল, ভাষা, বর্ণ ও গোত্র-ভিত্তিক জাহেলী চেতনার কারণে। হজ্জ সে পাপাচার থেকে দূরে সরিয়ে এনে মুসলিমদেরকে এক মহা-সম্মেলনে হাজির করে। এখানে ধনি-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো সবার পোষাক যেমন এক, তেমনি এক হলো আত্মার আকুতি ও উচ্চরণও। লক্ষ্য একটিই এবং সেটি হলো আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া এবং তাঁকে খুশি করা। এমন এক মহা-সম্মেলনের লক্ষ্যেই আল্লাহপাক তার নিজের ঘর বায়তুল্লাহ গড়েছিলেন। সেটিও নির্মিত হয়েছিল ইব্রাহীম (আ:) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ:)’র হাত দিয়ে। এটি তাই ইতিহাসের কাদিম যাদুঘর, এবং সে সাথে ইন্সটিটিউশনও। এখানে পা রেখেছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ:), হযরত ঈসমাইল (আ:), বিবি হাজেরা, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) ও তাঁর বিখ্যাত সাহাবাগণ। এ নগরের প্রতিটি প্রান্তর, প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি পাথর এবং প্রতিটি ধুলিকণায় জড়িত রয়েছে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের স্মৃতি। এখানে রয়েছে হাজরে আসওয়াদ, মাকামে ইব্রাহীম, আরাফা, মিনা ও মোজদালেফা। মারেফাতের তথা আল্লাহকে জানা ও তাঁর সান্নিধ্যলাভের প্রানকেন্দ্র হলো এগুলি। আল্লাহর সৈনিকদের শপথ বাক্য উচ্চারণের এর চেয়ে পবিত্রতম আয়োজন আর কি হতে পারে? আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা মানব সভ্যতার এ শ্রেষ্ঠ ভূমিতে দাঁড়িয়েই আল্লাহর প্রতিটি নির্দেশে লাব্বায়েক বলেছিলেন। ফলে গড়ে উঠেছিল ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর মানব। এ পবিত্র প্রাঙ্গণের প্রতিটি ধুলিকণা আজও মানুষকে সেই একই পথে চলতে নির্দেশ দেয়। ইতিহাসের সেই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে একই সূরে একই শপথ “আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক”উচ্চারন করে বিশ্বের নানা কোন থেকে আগত আজকের ঈমানদারগণ। আত্মিক উন্নয়নের এর চেয়ে পবিত্রতম স্থান এবং এর চেয়ে পবিত্রতম আয়োজন আর কি হতে পারে? এর চেয়ে উত্তম মারেফতি ধ্যান আর কি কোথাও হতে পারে?
যে কারণে শ্রেষ্ঠ ইবাদত
আন্তর্জাতিক এ মহাসম্মেলনের আয়োজক মহান আল্লাহতায়ালা খোদ নিজে। নইলে ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এ সম্মেলনটি চৌদ্দ শত বছর ধরে সম্ভব হত না। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহ ও দুর্যগের মাঝেও এ বিশাল সম্মেলনটি সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। অন্যরা এখানে মেহমান, খোদ আল্লাহতায়ালা এখানে মেজবান। আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়ায় এ সম্মেলনে যোগ হয় পবিত্রতা। লক্ষ্য যখন এক ও অভিন্ন, তখন দ্বন্দ থাকে না। দলাদলিও থাকে না। নানা বিভিন্নতা থেকে এসে এখানে এসে সবাই অভিন্ন হয়ে যায়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে ছুটে আসে নিজস্ব অর্থে। কারো অনুদানের প্রয়োজন হয়না। হেজাজের পুণ্যভূমি যখন বৈষয়িক সম্পদে দরিদ্র্য ছিল তখনও এ হজ্জ আয়োজিত হয়েছে মানুষের নিজস্ব উদ্যোগে। মক্কা হলো ইসলামের মূক্ত নগরী। এখানে আসার জন্য অনুমতিরও প্রয়োজন নেই। আসতে বাধা দেওয়াই চরম অধর্ম। বাধা দিলে সে বাধা অপসারণ করা সকল মুসলিমের ধর্মীয় দায়িত্ব হয়ে পড়ে। এভাবেই নিশ্চয়তা বিধান হয়েছে এ বিশ্ব সম্মেলনের।
আরাফার মহা জমায়েত, মোজদালিফায় রাত্রিযাপন, কাব্বার তোয়াফ এবং শয়তানের স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপের পর মুসলিম বিশ্বে আসে ঈদুল আযহা। আনে ঈদ তথা খুশি। প্রকৃত ঈদ বা খুশির প্রকৃত কারণটি নিজের বা অন্যের জন্ম নয়, বরং সেটি নিজের অর্জিত সাফল্য। মাতৃগর্ভ থেকে নিজের জন্মলাভে ব্যক্তির নিজের কোন কৃতিত্ব থাকে না, সে দানটি তো মহান আল্লাহর। ফলে প্রশংসা তো একমাত্র তারই প্রাপ্য। তাই নিজের বা অন্যের জন্মদিনে কেন সে খুশি করবে? তাই খৃষ্টান ধর্মে এবং অন্যান্যে ধর্মে ধর্মীয় নেতার জন্ম দিবস পালনের রীতি থাকলেও ইসলামে সেটি নাই। তাই সাহাবায়ে কেরাম নবীজী(সা:)’র জন্ম দিন পালনে করেছেন সে নজির নেই। মুসলিমের জীবনে প্রকৃত ঈদ মাত্র দুটি। একটি মাহে রমযানের, অপরটি ঈদুল আযহার। এ দুটি ঈদে উযপাপিত হয় ঈমানদারের জীবনের দুটি বিশাল বিজয়। একটি মাহে রমযানের মাসব্যাপী রোযা পালনের, অপরটি হজ্জ পালনের তথা আল্লাহর ডাকে লাব্বায়েক বলার সামর্থ্য অর্জনের। সে হজ্জ যেন রোজ-হাশর বা বিচারদিনের মহড়া। সর্বত্র এক পোষাক, এক বর্ণ, একই আওয়াজ। সবার মধ্যে একই পেরেশানী। নানা দেশের নানা ভাষার মানুষ এখানে এক মানবসমুদ্রে লীন। মাথায় টুপি নেই, পায়ে জুতা নেই, গায়ে জামা নেই, আভিজাত্য প্রকাশের কোন মাধ্যমও নেই। দুই টুকরো সিলাই হীন কাপড় নিয়ে সবাই এখানে একই সমতলে। কাফনের কাপড় পরে লাশেরা যেন কবর থেকে লাখে লাখে বেরিয়ে এসেছে। সাদা-কালো, আমির-ওমরাহ, নারী-পুরুষ সবাই এখানে একাকার। সবাই ছুটেছে একই লক্ষ্যে। বান্দার সুউচ্চ লাব্বায়েক ধ্বনি আল্লাহর উপস্থিতিকে যেন স্মরন করিয়ে দেয়। আল্লাহর স্মরণে কেঁপে উঠে বান্দার দেহ, মন তথা সমগ্র অস্তিত্ব। এখানে ভয়, বিনয় ও আনুগত্যের ভাব সর্বত্র। সবাই ঘুরছে আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে। রোজ হাশরের বিচার দিনে মানুষ যে কত অসহায় হবে হজ্জ সেটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। মৃত্যূবরণ না করেও যেন মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। ফলে প্রেরণা মেলে সময় থাকতে জীবনের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের। গুরুত্ব পায় আল্লাহর কাছে হিসাব দেওয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নেয়ার। পরকালীন সাফল্য লাভে এ মূল্যায়নটুকুই তো মূল। এমন উপলব্ধি ছাড়া আল্লাহতে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও শয়তানের দাসত্বমূক্তি কি সম্ভব? হজ্জ তো সে সুযোগই এনে দেয়। সম্ভবতঃ এ জন্যই এটি ইসলামের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত। কিন্তু সে শ্রেষ্ঠ ইবাদতের সে শিক্ষা আজকের মুসলিমের জীবনে কই? আজকের মুসলিমদের জীবনে এটাই কি বিশাল ব্যর্থতা নয়? লন্ডন; ২০/১০/২০১২, দ্বিতীয় সংস্করণ ১২/১০/২০১৩।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- দেশের সংবিধান ও নির্বাচন পদ্ধতিই যখন গণতন্ত্রের বড় দুশমন
- বাংলাদেশে কিরূপে সম্ভব সভ্য মানুষ ও সভ্য রাষ্ট্রের নির্মাণ?
- স্বাধীন ভাবে বাঁচার খরচ ও বাঙালি মুসলিমের ব্যর্থতা
- বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণে রুখতে হবে ভূমিদস্যুদের
- রাষ্ট্র কিরূপে জান্নাতের বাহন হয় ও জনগণ কিরূপে জান্নাতের যোগ্য হয়?
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- March 2025
- February 2025
- January 2025
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018