১৯৪৭’য়ের নেতৃবর্গ এবং ১৯৭১’য়ের নেতৃবর্গ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মানব গুণাবলীর অতি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হলো তার শিক্ষা তাই শিক্ষিত অশিক্ষিতরা কখনোই এক নয় চাকুরি-বাকুরিসহ জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তাই মানবের মূল্যায়নে তার শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয় এমন কি গৃহের চাকরবাকরের কাজেও গুরুত্ব দেয়া হয় শিক্ষাকে তাই ইসলামে নামাজরোজার আগে শিক্ষাকে প্রথম ফরজ করা হয়েছিল বাংলাদেশের বিপর্যের কারণ, রাজনীতির অঙ্গনের শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।  অধিকাংশ নেতারাই উপযুক্ত শিক্ষাশূণ্য প্রজ্ঞাশূণ্য। এরই ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা অতীতের তূলনায় যেমন ইসলাম থেকে দূরে সরেছে, তেমনি দূরে সরেছে শিক্ষা সভ্য রাজনীতি থেকে বরং তাদের হাতে জন্ম নিয়েছে সন্ত্রাসের রাজনীতি ১৯৪৭য়ের পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম সারির বাঙালি মুসলিম নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, সততা, শত্রুদের চিহ্নিত করণ এবং বাংলার মুসলিমদের নিয়ে তাদের কল্যাণচিন্তা শেখ মুজিব, তাজুদ্দীন, জিয়াউর রহমান সিরাজুল আলম খানদের ন্যায় একাত্তরের নেতাদের চেয়ে বহুগুণ অধিক ছিল দেখা যা, ১৯৪৭‌’য়ের নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খাজা নাজিমুদ্দীন লেখাপড়া করেছেন ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হোসেন শহী সোহরাওয়ার্দী লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলভী তমিজুদ্দীন খান লেখাপড়া করেছেন কলকাতার প্রসিডেন্সি কলেজে শেরে বাংলা ফজলুল হক নূরল আমীন লেখাপড়া করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরূপ শিক্ষাগত যোগ্যতা একাত্তরের কোন শীর্ষ নেতারই ছিল না তাদের সামর্থ্য ছিল না এসব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পা রাখার উচ্চ শিক্ষা ১৯৪৭য়ের নেতাদের দিয়েছিল ভূরাজনৈতিক জ্ঞান প্রজ্ঞা সেসাথে দিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর কিছু করার তাড়না

অপর দিক দিয়ে একাত্তরের নেতাদের তেমন কোন উচ্চতর ভাবনা ছিল না চেতনার দিক দিয়ে তারা ছিল ইসলামপূর্ব জাহিলী যুগের ট্রাইবাল; এবং ট্রাইবাল নেতাদের মতই প্রচণ্ড ফ্যাসিস্ট ট্রাইবাল নেতারা তাদের গোত্রের বাইরের কাউকে নিয়ে ভাবতে পারে না। ফলে বিহারীদের বাড়ী দখল ও বিহারী মেয়দের উপর ধর্ষণ তাদের কাছে গৌরবের বিষয় গণ্য হয়েছে।  তাদের ছিল ক্ষমতার প্রবল মোহ তারাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসের জন্ম দেয় রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূলে মুজিবের রক্ষিবাহিনী, সিরাজুল আলম খানদের গণবাহিনী, জেনারেল জিয়ার সামরিক আদালত এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠিত RAB –এসবই হলো নির্মূলমূখি সন্ত্রাসী চেতনার ফসল পাকিস্তানপন্থী নেতাদের কেউই মুজিবের ন্যায় গণতন্ত্রের শত্রু ছিলেন না তাদের কেউ মুজিবের ন্যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বেতনভোগী চাকর ছিলেন না এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদদের সাথে নিয়ে তারা কখনোই কোন ষড়যন্ত্র করেননিযেমনটি করেছে শেখ মুজিব পাকিস্তান ভাঙ্গা এবং দেশটিকে অধীনত করার এজেন্ডা নিয়ে ভারত ১৯৪৭য়ে দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই ছিল সক্রিয় কারণ, ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতাগণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যেমন চায়নি, তেমনি দেশটি বেঁচে থাকুকসেটিও চায়নি মুজিব স্বেচ্ছায় ভারতীয় সে প্রকল্পের কলাবোরেটরে পরিণত হয়। জিয়াও ভারতের কোলে গিয়ে উঠে।

পাকিস্তানের ১৯৬৬ ব্যাচের সিএসপি অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী ডক্টর কামাল সিদ্দিকী তার প্রকাশিতব্য এক বইয়ে ১৯৪৬ সনে শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে একটি ফাইলে ফরিদপুরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট কি মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন সেটা উল্লেখ করেছেন। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তার পরবর্তী ভিষ্ট্রিক্ট মেজিস্ট্রেটকে শেখ মুজিবকে দুস্কৃতিকারি গুন্ডা হিসাবে চিহ্নিত করে তার উপর ড়া নজরদারী রাখার পরামর্শ দেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সুদূর প্রসারি পরকল্পনা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই গুন্ডা মুজিব ২৬ বছর পর (১৯৭০১৯৪৬) জয়বাংলার বাঙালিদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হয়ে যায়

শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পটির শুরু যে ১৯৪৭ সাল থেকেইসে কথাটি মুজিব নিজে বলেছে পাকিস্তান থেকে ফেরার পর ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের জনসভায় ঐদিন মুজিবের সে কথাটি গ্রন্থের লেখক নিজ কানে শুনেছে অথচ মুজিব তার পাকিস্তানী উকিল .কে. ব্রোহির কাছে বলেছিল ভিন্ন কথা তাকে বলেছিল সে কখনোই পাকিস্তান ভাঙ্গতে চায়নি তখন পাকিস্তানে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা চলছিল সে মামলাকে মুজিব মিথ্যা মামলা বলেছিল মুজিব একই কথা বলেছিল আগরতলার মামলায় জবানবন্দীতে

মুজিব ১৯৭০ নির্বাচনে ভোট নিয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র নির্মাণের লক্ষ্যে মুজিব সে নির্বাচনটি লড়ে দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র নির্মাণের ওয়াদা দিয়ে এবং স্বাক্ষর করেছিল পাকিস্তান সরকারের দেয়া Legal Frame Work’য়েযাতে তাকে ঘোষণা দিতে হয়েছিল পাকিস্তানের ঐক্য সংহতির প্রতি অঙ্গিকারবদ্ধতাকে মুজিব যে পাকিস্তান ভাঙ্গাতে চায়সে কথাটি সে পাকিস্তান ভাঙ্গার আগে একবারও কোথাও কোন জনসভাতে বলেনি বরং নির্বাচনি জনসভাগুলিতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্দানের ৭ই মার্চের ভাষনেও মুজিব পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছে গ্রন্থের লেখক সেদিন সে স্লোগান জনসভায় উপস্থিত থেকে শুনেছিল এসবই ছিল বাঙালি মুসলিমদের সাথে মুজিবের মিথ্যাচারীতা প্রতারণা রাজনীতি তার মনের গোপন কথাটি জনগণ জানালে জনগণ কি তাকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী করতোকিন্তু মনের সে সত্য কথাটি বলার সাহস তার ছিলনা কারণ মুজিব জানতো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিম পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে নয় তাই সে তার প্রকল্পকে গোপন রাখতো।

মুজিব তার গোলপোস্ট পাল্টিয়েছে নির্বাচনি বিজয়ের পর তখন তার দফা এক দফা তথা স্বাধীনতার দাবীতে পরিণত হয় তখন ইচ্ছাকৃত ভাবেই মুজিব ভূলে যায় কি ওয়াদা দিয়ে সে জনগণের ভোট নিয়েছিল নির্বাচন শেষে জনগণও তার উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় নির্বাচনি বিজয়ের পর মুজিব আবির্ভৃত হয় এক অদম্য ফ্যাসিস্ট রূপে সকল সিদ্ধান্ত নিত সে নিজে; এমন কি নিজ দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে একবারও সে কোন মত বিনিময় সভা করেনিমিথ্যা কথা বলা, প্রতারণা করা দুর্নীতি করা ছিল তার চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য  দুর্নীতির দায়ে ঢাকার আদালতে মুজিবের জেলও হয়েছিল বাঙালি মুসলিমের একাত্তরের মূল ব্যর্থতা হলো, তারা মুজিবের ন্যায় এই ভণ্ড প্রতারক ফ্যাসিস্টকে চিনতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং তাকে মাথায় তুলেছে অপর দিকে ২০২৪য়ের জুলাইআগস্ট বিপ্লবের নায়কদের কৃতিত্ব প্রজ্ঞার মাত্রাটি বিশাল তারা এই দুর্বৃত্ত প্রতারককে সঠিক ভাবে চিনতে পেরেছে ফলে তারা মুজিবের শত শত মূর্তিকে গুড়িয়ে দিয়েছে বিশাল কাজটির জন্য তারা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে বহু শত বছরও বাঙালি মুসলিমের নতুন প্রজন্ম তাদের নিয়ে গর্ব করবে   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *