বাংলা সাহিত্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও নাশকতা
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on November 27, 2020
- Bangla Articles, ইতিহাস
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
হাতিয়ার সাংস্কৃতিক যুদ্ধের
সমগ্র ভারত মাঝে ইসলামের প্রসার সবচেয়ে দ্রুত ঘটেছিল বাংলায়। এরই ফল হলো, বিশ্বের আর কোন দেশে এতো ক্ষুদ্র ভৌগলিক সীমানার মধ্যে এতো মুসলিমের বসবাস নাই যা বাস করে বাংলায়। তবে ইসলামের প্রসার রোধে ইসলামের শত্রুরা কোন কালেই বসে থাকেনি। যেমন আজ নয়, তেমনি অতীতেও ছিল না। অতীতে মুসলিমদের বিজয় রোধে তাদের সামরিক সামর্থ্য ছিল না, তবে সামর্থ্য ছিল ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গণে। ভাষা ও সাহিত্য পরিণত হয় ইসলামে বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের হাতিয়ারে। ইসলামের যখন দ্রুত প্রসার ঘটছিল তখন সে প্রসার ঠেকাতে ময়দানে নামে শ্রী চৈতন্য দেব ও তাঁর সাথীরা বৈষ্ণব পদাবলী নিয়ে। গীর্জায় ভক্তিমূলক গানের মধ্যে বেঁচে আছে খৃষ্টান ধর্ম। তেমনি ভক্তিমূলক বৈষ্ণব গানের মধ্যে হিন্দু ধর্মও যেন নতুন প্রাণ পায়। বৈষ্ণব সন্যাসীরা তাদের ভাববাদী গান নিয়ে বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতো, আর তাদের ঘিরে জমা হত গ্রামের হিন্দু নর-নারীরা। গানের মাঝে তারা ধর্ম খুঁজে পায়। শ্রী চৈতন্য দেব ও তার শিষ্যরা এ ভাবে আবির্ভূত হয়েছিল এক সংগঠিত শক্তি রূপে, হিন্দু ধর্মের অনুসারিদের মনে যোগ করছিল এক নতুন আধ্যাত্মীকতা। কোথাও কোথাও তারা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও গড়ে তোলে। তাদের কারণেই স্তিমিত হয়ে যায় বাংলায় ইসলামের প্রসার, যা পরবর্তীতে দারুন ভাবে প্রভাবিত করে বাংলার পরবর্তী মানচিত্র ও রাজনীতি। বলা যায়, বৈষ্ণব সাহিত্যির ফলেই বাংলার পশ্চিম অংশের জনগণের অধিকাংশই হিন্দু থেকে গেছে। ফলে ধর্মীয় ভাবে বাংলা বিভক্ত থেকে গেছে সেদিন থেকেই। বাংলার ভূগোলের সবচেয়ে দুর্বলতা এই ধর্মীয় এবং ভৌগলিক বিভক্তি। ফলে আরব, ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান যেরূপ মুসলমানদের অখণ্ড মানচিত্র রূপে গড়ে উঠে, নির্মাণ করে শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র -সেটি বিভক্ত বাংলাদেশে সম্ভব হয়নি। এভাবেই রহিত হয়ে যায় বিশ্বের মানচিত্রে একটি মুসলিম শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে বাংলাদেশের উত্থান। কারণ শক্তিশালী রাষ্ট্রের নির্মাণে শুধু জনশক্তিই জরুরী নয়, অপরিহার্য হল বৃহৎ ভূগোলের বল।
তবে বাংলাদেশের মুসলিমদের বিপদ শুধু শ্রী চৈতন্য ও তাঁর আমলের বৈষ্ণব পদাবলী নয়। বাংলা সাহিত্যকে ঘিরে নানা প্রকল্প কাজ করছে মুসলিমদের চেতনা বিনাশে। বাংলার মুসলিমদের বড় ব্যর্থতা হলো বাংলা ভাষাকে যেমন তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের ভাষা রূপে যথার্থ ভাগে গড়ে তুলতে পারিনি, তেমনি বাড়াতে পারিনি আরবী, ফার্সী বা উর্দুর ন্যায় অন্যান্য সমৃদ্ধ ভাষা থেকে শিক্ষা লাভের সামর্থ্য। মানুষ তার দেহের পুষ্টি বাড়াতে নানা হাটের নানা দোকান থেকে নানা দেশের খাদ্য ক্রয় করে। তেমনি মনের বা ঈমানের পুষ্টিবাড়াতে নানা ভাষার নানা বই পড়তে হয়। মুসলিম শাসনামলে, এমন কি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলেও আলেম-উলামা বা শিক্ষিত বাঙালী মুসলিমদের কাছে শিক্ষা,সংস্কৃতি ও ধর্মের ভাষা ছিল আরবী, ফার্সি বা উর্দু। কিন্তু আরবী, ফারসী ও উর্দুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে অনেক আগেই। ফলে দিন দিন অপুষ্টি বেড়েছে বাঙালী মুসলিমের চেতনায়। অবস্থা দিন দিন আরো ভয়ানক হচ্ছে। শতবছর আগেও একজন বাঙালী মুসলিমের পক্ষে সেক্যুলার বা জাতীয়তাবাদী হওয়া অসম্ভব ছিল। মুর্তিপূজার ন্যায় সেটিকে কুফরী বা হারাম মনে করত। সে সময় আলেম বা শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম মাত্রই ছিল প্যান-ইসলামী। তখন তাদের কাছে পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, বিহারী, গুজরাতী ও অন্যান্য অবাঙালী মুসলিমগণ শত্রু মনে হয়নি, বরং তাদেরকে তারা ভাই রূপে গ্রহণ করেছে। তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেমেছে। ১৯৪৭ সালে হিন্দু ও ব্রিটিশদের প্রবল বাধার মুখে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল তো তেমনি এক প্রেক্ষাপটে। অথচ আজ সেটি কল্পনা করাও অসম্ভব। ভাষার নামে সবচেয়ে বড় নাশকতাটি ঘটেছে তাই চেতনার ভূমিতে। মাত্র ৫০ বছর আগেও একজন বাঙালী মুসলিমের পক্ষে গেরুয়া ধুতি পরে মঙ্গল প্রদীপ হাতে নিয়ে মিছিল করা অচিন্তনীয় ছিল। অসম্ভব ছিল থার্টি ফাস্ট নাইট বা ভ্যালেন্টাইন দিবস পালনে রাস্তায় নামা। অসম্ভব ছিল একজন পল্লির বধুর পক্ষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাছ পাহাড়া দেয়া বা সূদ খাওয়া। কিন্তু এমন গর্হিত তথা হারাম কর্ম এখন অহরহ হচ্ছে। বরং এসবই পরিণত করা হচ্ছে বাংলাদেশীদের সংস্কৃতিতে।
দৈন্যতাটি জ্ঞানের
শিক্ষাহীন, জ্ঞানহীন ও চিন্তাভাবনাহীন মানুষের পক্ষেও সুস্থ্য দেহ নিয়ে শত বছর বাঁচা সম্ভব, কিন্তু সেরূপ শূণ্যতা নিয়ে মুসলিম রূপে একদিন বাঁচাও সম্ভব নয়। এমন জ্ঞানহীন মানুষের পক্ষে মুসলিম হওয়াই অসম্ভব। সেটি যে কতটা অসম্ভব সেটিই সুস্পষ্ট করেছেন মহান আল্লাহতায়ালা নিজে। সেটি পবিত্র কোর’আনে তাঁর নিজের ঘোষণায়, “ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল ওলামা” অর্থঃ একমাত্র জ্ঞানবান ব্যক্তিগণই আমাকে ভয় করে। অর্থাৎ একমাত্র জ্ঞানবান মানুষগণই প্রকৃত মুসলিম হয়। ফলে মুসলিম হওয়ার জন্য জ্ঞানবান হওয়াটি অপরিহার্য। তাই নামায রোযার পূর্বে ফরয করা হয়েছে জ্ঞানার্জন, এবং সেটি প্রতিটি মুসলমান নর-নারী উপর। পবিত্র কোর’আনের প্রথম শব্দটি তাই নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত নয় বরং ‘ইকরা’ অর্থ ‘পড়’। তাই যেখানেই মুসলিম সমাজ বা রাষ্ট্রের পত্তন ঘটবে সেখানে শুধু কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যই গড়ে উঠবে না, গড়ে উঠবে জ্ঞান-বিজ্ঞানও। তাই মুসলিম সমাজে শুধু মসজিদই গড়ে উঠে না, গড়ে উঠে বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরী। গড়ে উঠে সৃষ্টিশীল সাহিত্য, সমৃদ্ধ হয় ভাষা। তখন বিদ্যাদানের সে ফরয কাজটি শুধু বিদ্যালয়ে চলে না, লাগাতর চলে বিদ্যালয়ের বাইরেও। মসজিদ-মাদ্রাসার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে পরিণত হয় প্রতিটি গৃহও। কিন্তু বাঙালী মুসলিমদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। এক্ষেত্রে বাংলাভাষার দৈন্যতাটি বিশাল। বালাভাষী মুসলিমদের সংখ্যা ইরানী ও তুর্কীদের চেয়ে বেশী। সংখ্যায় আরব, ইন্দোনেশিয়ান ও পাকিস্তানী মুসলিমদের পরই তাদের অবস্থান। কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার বাড়লেও বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞানের চর্চা তেমন বাড়েনি। অথচ সাহিত্য ও জ্ঞানের রাজ্যে বিপ্লব না এলে কি রাজনৈতিক শক্তি বাড়ে? নির্মিত হয় কি সভ্যতা?
বাঙালী মুসলিমদের সাহিত্য-সংকট আজকের নয়, শুরু থেকেই। মুসলিম শাসনের আগে বাংলার শাসক ছিল সেন রাজবংশ। তাদের আগমন ঘটেছিল ভারতের কর্ণাটক থেকে। বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। বরং বাংলা ভাষা ছিল তাদের ঘৃনার শিকার। হিন্দু ব্রাহ্মণগণ এ ভাষাকে এক সময় পক্ষিভাষা বলত। ফলে তাদের আমলে বাংলা সাহিত্যে কোন উন্নয়ন ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতানেরা প্রথম শুরু করে বাংলা ভাষার পরিচর্যা। তবে সেটি যতটা না ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশী ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে। তাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশসহ ভারতের পূর্ব ভাগে দিল্লির প্রভাব মূক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের নির্মাণ। শাসকগণ নিজেরা ছিলেন অবাঙালী, তাদের পরিবারে ভাষা ছিল ফার্সী। রাষ্ট্র পরিচালনা ভাষাও ছিল ফার্সী। সে সময় দিল্লির শাসকগণ ছিল মুসলিম, তাদের ভাষাও ছিল ফার্সী। ফলে দিল্লি থেকে পৃথক ভূগোলের নির্মাণের স্বার্থে প্রজাদের মাঝে একটি পৃথক ভাষাভিত্তিক দেয়াল খাড়া করাকে তারা জরুরী মনে করে। তাদের কাছে রাজনৈতিক প্রয়োজনটি বড় হওয়ার কারণে গুরুত্ব হারায় মুসলিমদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রয়োজনে আরবী, ফার্সী বা বাংলা ভাষার উন্নয়ন। অথচ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রয়োজনটি গুরুত্ব পেলে কয়েক শত বছরের মুসলিম শাসনে অন্ততঃ বাংলা ভাষায় কিছু ধর্মীয় পুস্তক রচনা বা অনুবাদের ব্যবস্থা নেয়া হত। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং সে লক্ষে যা কিছু হয়েছে তা বেসরকারি ভাবে। এবং অতি সীমিত ভাবে। ভা
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম বিদ্বেষ
লক্ষণীয় হল, মুসলিমগণ যখন বাংলা ভাষাকে নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ভাষা রূপে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছিল তখন হিন্দুরা অনুধাবন করে ভাষার গুরুত্ব। বিশেষ করে দ্রুত-প্রসারমান ইসলামের প্রতিরোধে। এ ভাষাকে তারা একদিকে যেমন গড়ে তোলে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ভাষা রূপে, তেমনি ব্যবহার করে প্রতিবেশী মুসলিমদের ইসলামী চেতনা বিনাশের লক্ষ্যে। হিন্দুদের রচিত সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলার হিন্দুদের মাঝে যে রেনেসাঁর সূত্রপাত হয় তা আদৌ সেক্যুলার ছিল না। বরং তাতে ছিল প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম বিদ্বেষী চরিত্র। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, দ্বীনবন্ধু মিত্র, রবীন্দনাথ ও শরৎচন্দ্রের মত যেসব ব্যক্তিবর্গ সে রেনাসাঁ আন্দোলনের নেতা ছিলেন -তারা ছিলেন মনে প্রাণে হিন্দু। তারা হিন্দুদের জাগরণ বা রেনেসাঁকে দেখতেন হিন্দু রূপে বেড়ে উঠার মধ্য দিয়ে। হিন্দুত্বের বাইরে কোন আন্দোলনকে তারা হিন্দুর জাগরণ রূপে দেখতেন না। তাছাড়া তারা সেটিকে দেখতেন অখণ্ড ভারতে বাঙালী হিন্দুদের একীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। সে আমলেই আসে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ। বাংলা সাহিত্যে আসে তখন নতুন জোয়ার। হিন্দুদের এ জাগরণে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের সহায়তাও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্র ভাষা ছিল ফারসী। কিন্তু সেটি উচ্ছেদ করে ইংরেজীর প্রচলন করা হয়। আর এতে সরকারি খাতায় রাতারাতি নিরক্ষরে পরিণত হয় আরবী-ফারসী ভাষায় শিক্ষিত মুসলিমগণ। অপর দিকে হিন্দুগণ ইংরেজী শিখে ইংরেজ শাসনের দক্ষ কলাবেরটরে পরিণত হয়। এবং লাভ করতে থাকে নানারূপ সরকারি সুযোগ সুবিধাও। বঙ্কিম চন্দ্র ছিলেন তাদেরই একজন। ইংরেজী সাহিত্যের ধাঁচে তারাই বাংলা সাহিত্যে পদ্য ও গদ্য রচনা শুরু করেন।
আর বাংলা সাহিত্যের হিন্দু-রেনাসাঁর বাণীটি প্রবল ভাবে ফুঠে উঠে বাঙালী হিন্দুদের রাজনীতিতেও। হিন্দু রেনেসাঁ আন্দোলনের নেতাদের হাতেই তখন ভারতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব। ভারতীয় কংগ্রেস নিজেকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের দাবী করলেও সেটি যে কতটা ধোকাবাজী ছিল, সেটিও সেদিন গোপন থাকেনি। তখন কংগ্রেসের নেতা ছিলেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। ১৮৯৫ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর তিনি পুনায় আমন্ত্রিত হন শিবাজী স্মৃতিসভায়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “মহোদয়গণ, এখানে এই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে (দেয়ালে টাঙ্গানো শিবাজী ছবি দেখিয়ে) আমরা কি তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি না? এই আন্দোলনের প্রতি আমার উষ্ণতম সমর্থন ও সহানুভুতি আছে। সমগ্র ভারতের সহানুভুতি আছে। আমি জানি শিবাজী বার বার বঙ্গদেশে হামলা করেছিলেন, তাঁর বাহিনী আমাদের সম্পদ লুট করেছে, আমাদের মন্দির ও গৃহদেবতা ধ্বংস করেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করছি যে, ইংরেজদের সভ্যতা সূচক শাসনে আমরা এখন অখণ্ড ভারতে পরিণত হয়েছি। একজন বাঙ্গালী হিসাবে শিবাজীর পবিত্র স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।” –(সুত্র: স্পিচেস বাই দি অনারেবল বাবু সুরেন্দ্রনাথ বঙ্গোপাধ্যায়, পঞ্চম খন্ড, এস কে লাহিড়ী এন্ড কোং, কোলকাতা, ১৮৯৬, ৮৬ পৃঃ)।
রবীন্দ্রনাথের চেতনাও এক্ষেত্রে ভিন্নতর ছিল না। শিবাজী উৎসব সম্পর্কে গিরিরাজা শঙ্কর রায় চৌধুরী লিখেছেন,“তিলক প্রবর্তিত শিবাজী উৎসবে কবিতা, গল্প-উপন্যাস, গান ও নাটকে সে চেতনারই নানা ভাবে প্রকাশ ঘটে। তরঙ্গ বাংলাদেশেও আসিয়া লাগিয়াছিল। সখারাম গণেশ দেউস্কর সম্ভবত ১৯০২ সালে মারাঠার এই বীরপুজা বাংলাদেশে প্রবর্তিত করেন। তদবধি মহাসমারোহে কয়েকবার কলিকাতা ও মফস্বলে শিবাজী উৎসবের সাম্বাৎসরিক অধিবেশন হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথ, বিপিনচন্দ্র প্রভৃতি সকলেই এই উৎসবে যোগদান করিয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শিবাজী উৎসব সম্বন্ধে কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে অমর হইয়াছে।(সূত্রঃ গিরিরাজা শঙ্কর রায় চৌধুরী, শ্রী অরবিন্দু ও বাংলার স্বদেশী যুগ, নবভারত পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃঃ ২৭৩)।
বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার সাহিত্যের যেটি প্রবলতম দিক সেটি তাঁর আধুনিক হিন্দু মানস। হিন্দু রেনেসাকেঁ তিনিই শীর্ষে পৌছে দেন। তাই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের চরিত্রটি বুঝতে হলে বুঝতে হবে রবীন্দ্র-মানসকে। কিন্তু কি সে রবীন্দ্র-মানস বা রবীন্দ্র চেতনা? সে রবীন্দ্র-চেতনার পরিচয় তুলে ধরেছেন আবুল মনসুর আহমদ, যিনি নিজেও ছিলেন একজন সেক্যুলার চেতনার মানুষ। লিখেছেন,“হাজার বছর মুসলমানরা হিন্দুর সাথে একদেশে একত্রে বাস করিয়াছে। হিন্দুদের রাজা হিসেবেও, প্রজা হিসেবেও। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ঐক্য হয় নাই। হয় নাই এই জন্য যে, হিন্দুরা চাহিত ‘আর্য-অনার্য, শক, হুন’ যেভাবে ‘মহাভারতের সাগর তীরে’ লীন হইয়াছিল মুসলমানেরাও তেমনি মহান হিন্দু সমাজে লীন হইয়া যাউক। তাদের শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকিলে চলিবে না, হিন্দু মুসলমান’ হইতে হইবে। এটা শুধু কংগ্রেসী বা হিন্দু সভার জনতার মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মত ছিল। -(সুত্রঃ আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা ১৫৮-১৫৯। রবীন্দ্রনাথের জমিদারী ছিল কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে। এলাকার অধিকাংশ রায়তই ছিল মুসলিম। তিনি সেখানে গরু কোরবানী নিষিদ্ধ করেছিলেন, অথচ দেবী কাত্যায়নীর পুজা উপলক্ষে পনর দিনব্যাপী লাঠি খেলা ও যাত্রাভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই পুজার ব্যয়ভার হিন্দু-মুসলমান সব প্রজাকে বহন করতে হতো। পনর দিনব্যাপী এই মহোৎসব অনুষ্ঠানে যে বাড়তি খরচ হতো, সে জন্য তিনি একতরফাভাবে খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলামের মত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী লিখেছেন, “শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ পৌষ মেলার প্রবর্তন করেন ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে। তারই অনুসরণে শিলাইদহে স্থানীয় দেবী কাত্যায়নীর পুজা উপলক্ষে ১৯০২ সালে ১৫ দিন ব্যাপী স্বদেশী মেলা প্রবর্তন করেন যেখানে লাঠি খেলা ও যাত্রাভিনয় প্রাধান্য পায়। এই মেলাতে রাখীবন্ধন ব্যবস্থাও চালু করা হয়। স্বদেশী এবং বাগ্মী কালিমোহন ঘোষকে কবি কাছে নিয়ে আসেন এই স্বদেশী মেলা উপলক্ষে। কবিগুরুর নির্দেশে তিনি সর্বক্ষণ গ্রামে গ্রামে ঘুরে শত শত যুবককে স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। -(সুত্রঃ মাযহারুল ইসলাম, কর্মযোগী রবীন্দ্রনাথঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২রা জৈষ্ঠ, ১৩৯৭।
হাতিয়ার ইসলামী চেতনা বিনাশের
ইসলামী চেতনা বিনাশের উপকরণ বাংলা সাহিত্যে প্রচুর। সাহিত্য কাউকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে না। বরং ধীরে ধীরে হত্যা করে তার চেতনাকে। আর বাংলায় নিহত হচ্ছে বাঙালী মুসলিমদের ইসলামী চেতনা। এবং সেটি চলছে বহু শত বছর ধরে। সে চেতনা বিনাশী প্রকল্পের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। মোহম্মদ কবিরউদ্দীন সরকার বহু বছর আগে বাংলার পাঠ্য পুস্তক নিয়ে তৎকালীন ‘বাসনা’ পত্রিকায় (২য় সংখ্যা, জৈষ্ঠ, ১৩১৬) লিখেছিলেন, “আজকাল বিদ্যালয়াদিতে যে সকল সাহিত্য ও ঐতিহাসিক পুস্তকাদি পঠিত হইতেছে, তাহা হিন্দু দেবদেবী, মুণি-ঋষি, সাধু-সন্নাসী, রাজা-মহারাজা, বীর-বীরাঙ্গাণা ইত্যাদির উপখ্যান ও জীবন চরিত আদিতেই পরিপূর্ণ হিন্দুর ধর্ম-কর্ম, ব্রত-অর্চনা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদির মাহাত্ম্য বর্ণনাতেই সেই পাঠ্যগ্রন্থ অলংকৃত। মুসলমানদের পীর-অলি-দরবেশ, নবাব-বাদশাহ, পন্ডিত-ব্যবস্থাপক. বীর- সব বীরাঙ্গনাদির উপখ্যান বা জীবন-বৃত্তান্ত অথবা ইসলামের নিত্য-কর্তব্য ধর্মাধর্ম্ম ব্রত উপাসনা, খয়রাত-যাকাত ইত্যাদির মাহাত্ম্যরাজীর নামগন্ধও ঐ সকল পুস্তকে নাই, বরঞ্চ মুসলমান ধর্মের ধার্মিকদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষের াবই বর্ণিভাবই বর্ণিত আছে।….প্রথম বর্ণ পরিচয় কাল হইতেই আমাদের বালকগণ রামের গল্প, শ্যামের কথা, হরির কাহিনী, কৃষ্ণের চরিত্র ইত্যাদি পড়িতে থাকে। যদু-মধু, শিব-ব্রহ্মা, রাম-হরি ইত্যাদি নামেই পাঠ আরম্ভ করিতে হয়। কাজে কাজেই আমাদের সরলমতি কোমল প্রকৃতি শিশুগণ বিদ্যালয় পঠিত হিন্দুগণের উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং আমাদের জাতীয় পবিত্র শাস্ত্র ও ইতিহাস উপাখ্যান ধর্ম-কর্মাদির বিষয় অপরিজ্ঞাত হইয়া থাকে।” –(সূত্রঃ মুস্তফা নুরউল ইসলামঃ সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত, বাংলা একাডেমী¸ ঢাকা। পৃঃ ৩০-৩১)।
ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন,“কি পরিতাপের বিষয় আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাশেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তাহা পড়িতে পায় না। এখন হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে রাম-লক্ষণের কথা, কৃষ্ণার্জ্জনের কথা, সীতা-সাবিত্রির কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে। সম্ভবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের বড় লোক নেই। এই সকল পুস্তুক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ববিহীন করা হয়। হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মোসলমানরা নিতান্তই ছোট জাত। তাহাদের মধ্যে ভাল লোক জন্মিতে পারে না।” অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল যে মাদ্রাসাতে হিন্দুদের লেখা বই পড়ানো হতো। ডঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছিলেন, “মক্তবে ও মুসলমান বালিকা বিদ্যালয়েও আমাদিগের শিশুগণকে হিন্দুর লিখিত পুস্তক পড়িতে হয়, তদপেক্ষা আর কি কলংকের কথা আছে? আমরা কি এতই মূর্খ যে তাহাদের জন্য পুস্তক রচনা করিতে পারি না? মূল পাঠ্য ইতিহাস সম্বদ্ধে ঐ কথা। তাহাতে বুদ্ধদেবের জীবনী চার পৃষ্ঠা আর হযরত মোহম্মদ (সাঃ)এর জীবনী অর্ধপৃষ্ঠ মাত্র। অথচ ক্লাসে একটি ছাত্রও হয়তো বৌদ্ধ নহে। আর অর্ধাংশ ছাত্র মুসলমান।.. মূল পাঠ্য ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের সম্বদ্ধে অগৌরবজনক কথা প্রায় ঢাকিয়া ফেলা হয়, আর মুসলমানদিগের বেলা ঢাকঢোল বাজাইয়া প্রকাশ করা হয়। গুণের কথা বড় একটা উল্লিখিত হয় না। ফল দাঁড়ায় এই, ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়িয়া ছাত্ররা বুঝিল, মুসলমান নিতান্তই অপদার্থ, অবিশ্বাসী, অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর জাতি। পৃথিবী হইতে তাহাদের লোপ হওয়াই মঙ্গল। (সূত্রঃ আমাদের (সাহিত্যিক) দারিদ্রতা, মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আল এসলাম¸ ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জৈষ্ঠ ১৩২৩, সংগ্রহে মুস্তফা নুরউল ইসলামঃ সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত, বাংলা একাডেমী¸ ঢাকা। পৃঃ ৩০-৩১)।
সাম্প্রদায়িক রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্যের নামে বিষপান
হিন্দুদের এ মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা শুধু সাহিত্যের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। সে চেতনাধারীদের হাতে অধিকৃত হয়েছিল বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। সাংবাদিক ও লেখক জনাব আবুল কালাম সামসুদ্দীন (মাসিক মোহম্মদী এবং দৈনিক পাকিস্তান) লিখেছেন, “বস্তুতঃ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় মুসলমানদের আপত্তিকর তথা হিন্দুত্বের পরিপোষক বিষয়সমুহ চালু করে বুঝাবার এই চেষ্টা চলেছিল যে, এ সবই হলো বাঙালী ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও জাতীয় বৈশিষ্ট্য। কাজেই হিন্দুদের মত মুসলমানদেরও এসবে আপত্তি করার কিছু নাই। কিছু সংখ্যক তরলমতি মুসলমান তরুণদের মনে এ প্রচরণার প্রভাব পড়ে নাই, একথা বলিতে পারি না। তাছাড়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতো মনিষীও এ প্রকার উক্তি করতে দ্বিধা করেন নাই যে, মুসলমানরা ধর্মে ইসলামানুসারী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা ‘হিন্দু-মুসলমান’। বাঙলার শিক্ষা ক্ষেত্রে এই ‘হিন্দু-মুসলমান’ সৃষ্টির চেষ্টাই অব্যাহতগতিতে শুরু হইয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য-পুস্তকের মাধ্যমে। মুসলমান তরুণদের একশ্রেণী এ প্রচারণায় এতটা প্রভাবান্বিত হয়েছিলো যে, এদেরই গুরুস্থানীয় জনৈক চিন্তাশীল মুসলমান অধ্যাপক (কাজী আব্দুল ওদুদ) এক প্রবন্ধে নির্দ্বিধায় লিখেই ফেলেছিলেন যে এদেশী মুসলমান হচ্ছে ‘হিন্দু-মুসলমান’।- (আবুল কালাম সামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতী, পৃঃ ১৫০)।
রবীন্দ্র-সাহিত্যের মধ্যে যে হিন্দু সাম্প্রদায়ীকতা ও হিন্দু মানস সেটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে স্বভাবতই গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেটিকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য পরিল্পিত ভাবে সুগারকোট লাগানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে এই বলে যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসাম্প্রদায়ীক। বলা হচ্ছে তিনি উভয় বাংলার কবি, তিনি বিশ্বকবি, ইত্যাদি বহুকিছু। প্রশ্ন হলো, রবীন্দ্রনাথ যে জন্মভূমির স্বপ্ন দেখতেন বা কথা বলতেন সেটি কি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের? যে চেতনা ও যে ধর্মবিশ্বাসের কথা বলতেন সেটিও কি সার্বজনীন বাঙালীর? রবীন্দ্রনাথ তার ‘জন্মভূমি’ প্রবন্ধে যে জন্মভূমির কথা আলোচনা করেছেন সেখানে আছে মায়ের পূজা, মায়ের প্রতিষ্ঠা, আছে অধিষ্ঠাত্রী দেবী ও ভারতীয় ভারতীয় বীণাধ্বনি। তিনি যে মনে প্রাণে মুর্তিপূজারী হিন্দু ছিলেন তার পরিচয় রেখেোছন তার পূজারিনী কবিতায়। লিখেছেন,
“বেদব্রাহ্মণ-রাজা ছাড়া আর কিছু
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার।”
রবীন্দ্র-দর্শন ও রবীন্দ্র সাহিত্যের উপর মূল্যায়ন করেছেন তাঁরই এক প্রগাঢ় ভক্ত শ্রী নীরদ চৌধুরি। তিনি লিখেছেন,“একটা বাজে কথা সর্বত্র শুনিতে পাই। তাহা এই, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তি হিসেবে ‘বিশ্বমানব’ ও লেখক হিসাবে ‘বিশ্ব মানবতার’ই প্রচারক। কথাটার অর্থ ইংরেজী ও বাংলা কোনো ভাষাতেই বুঝিতে পারিনা। তবে অস্পষ্টভাবে ধোঁয়া-ধোঁয়া যেটুকু বুঝি, তাহাকে অর্থহীন প্রলাপ বলিয়া মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা বিশিষ্ট বাঙালী খাঁটি বাঙ্গালী হিন্দু জন্মায় নাই।” -(সুত্রঃ ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ নীরদ চন্দ্র চৌধুরী, পৃঃ ১৪১)।
বাংলায় হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি বসবাস শত শত বছর ধরে। একই আলো-বাতাস, একই নদ-নদী,একই মাঠ-ঘাট নিয়ে তাদের বসবাস। সাধারণ হিন্দু-মুসলিমের মাঝে বিবাদ ততটা না থাকলেও হিন্দু সাহিত্যিকগণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু করেছেন সাহিত্যের ময়দানে। এমনকি রবীন্দ্রনাথও সুরুচী ও ভদ্রতার পরিচয়ও দিতে পারেননি। তাঁর “বৌ ঠাকুরানীর হাট” উপন্যাসে তিনি প্রতাব চরিত্রের মুখ দিয়ে ম্লেছদের দূর করে আর্য ধর্মকে রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত করার সংকল্প করেন। গোরা উপন্যাসে গোরার মুখ দিয়ে ইসলাম বিষয়ে জঘন্য উক্তি করিয়েছেন। “সমস্যাপূরণ” গল্পে অছিমদ্দিনকে হিন্দু জমিদারের জারজ সন্তান বানিয়েছেন। মুসলিমদের চরিত্র হননে সকল শালীনতার উর্দ্ধে উঠেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। অথচ তিনিই বাংলা সাহিত্যে হিন্দুদের আদর্শ পুরুষ। মুসলিম বিদ্বেষী এ ব্যক্তিটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথেরও অতি প্রিয়। বঙ্কিম তাঁর সাহিত্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে গালিগুলি বেছে বেছে ব্যবহার করেছেন তা হলো হীন, নীচ, কাপুরুষ, যবন, ম্লেছ, নেড়ে ইত্যাদি। আগে ‘নেড়ে’ গালিটি বৌদ্ধদের দেয়া হতো, পরে সে প্রয়োগ হতে থাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে। “কৃষ্ণকান্তের উইল”‘য়ে দানেশ খাঁকে দিয়ে মুসলিমদেরকে শুয়োর বলে গালি দিয়েছেন। “রাজসিংহ” উপন্যাসে কতিপয় স্ত্রীলোককে দিয়ে আওরাঙ্গজেবের মুখে লাথি মারার ব্যবস্থা করেছেন। “মৃণালিনী”তে বখতিয়ার খিলজীকে ‘অরণ্য নর’ বলেছেন। “কবিতা” পুস্তকে তিনি লিখেছেন,
“আসে আসুক না আরবী বানর
আসে আসুক না পারশী পামর”
“রাজসিংহ” উপন্যাসে আওরাঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নিসার মুখে ভাষা গুঁজে দিয়েছেন এভাবে,
“জেবউন্নিসা হাসিয়া বলিল,“ঐ পুরাতন কথা। বাদশাহজাদীরা কখন বিবাহ করে?
মবারক। এই মহাপাপ….
জেব উন্নিসা উচ্চ হাসিল। বলিল বাদশাহজাদীর পাপ! আল্লা এ সকল ছোট লোকের জন্য করিয়াছেন –কাফেরদের জন্য। আমি না হিন্দু বামুনের মেয়ে, না রাজপুতের মেয়ে যে এক স্বামী করিয়া চিরকাল দাসত্ব করিয়া শেষে আগুনে পুড়িয়া মরিব!”
এ হলো বাংলা সাহিত্যের বড় বড় মহারথিদের চেতনার মান। তাদের মন ও মানস মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে কতটা ঘৃনাপূর্ণ ও বিষপূর্ণ ছিল -এ হলো তার নমুনা। অথচ মুসলিম-বিদ্বেষপূর্ণ বাংলা সাহিত্যকে হিন্দু-মুসলিম –উভয়ের সাহিত্য বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা বাড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশে। এমন বিষপূর্ণ সাহিত্য কি মুসলিম চেতানায় পুষ্টি জোগাতে পারে?
বিষ পান সবদেশেই কম বেশী ঘটে। তবে তাতে কিছু ব্যক্তির মৃত্যু হলেও জাতির মৃত্যু আসে না। কারণ কোন বিষই ঘরে ঘরে ছড়ায় না। কিন্তু সাহিত্যের মাধ্যমে চেতনা রাজ্যে বিষ ছড়ায় ঘরে ঘরে। তাই সাহিত্যের মাধ্যমে বিষ পান শুরু হলে বিপন্ন হয় সমগ্র জাতি। চেতনায় তখন মহামারি দেখা দেয়। চেতনা মারা পড়লে তখন মারা পড়ে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য বাছবিচারের নৈতিক বল। আজকের বিশ্বে তেমনি একটি নৈতিক বলহীন জাতির নমুনা হল বাংলাদেশ। এবং সে বিপন্নতাই অতি প্রকট ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে দেশটির দূর্নীতি, সন্ত্রাস, গুম-খুন, ভোটডাকাতির রাজনীতি, অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা এবং ভারতের প্রতি আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। লন্ডন, ১ম সংস্করণ ২০/০২/১১; ২য় সংস্করণ ২৭/১১/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018