পাশ্চাত্য দেশে যে মহাসংকট মুসলিমদের
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on December 30, 2020
- Bangla Articles, মুসলিম জাহান
- No Comments.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
বিপদ স্রোতে ভেসে যাওয়ার
অনৈসলামিক দেশে বসবাস যে কতটা বিপদজনক -তা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ইতিমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে। বানের জলে ভাসার চেয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্লাবনে ভাসার বিপদ যে কম নয় -সে বিষয়টি এখন সুস্পষ্ট। বানের জলে ক্ষেতের ফসল ও গরুছাগল ভেসে যায়, কিন্তু এখানে ভেসে যাচ্ছে তাদের নিজের ও নিজ সন্তানদের ঈমান-আখলাক, রুচিবোধ ও সংস্কৃতি। ফলে ভেসে যাচ্ছে পরকাল। পরকাল হারানোর চেয়ে বড় বিপদ মানব জীবনে আর কি হতে পারে? অথচ সে মহাবিপদই মুসলিমদের ঘিরে ধরেছে। পরকাল বাঁচাতে মুসলিমগণ নিজেদের ঈমান-আখলাক, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বাঁচায় এবং সেগুলো বাঁচাতে আলাদা রাষ্ট্র গড়বে, ভিন্ন কম্যুনিটি ও প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিবে এবং এ কাজে অর্থদান ও শ্রমদানের পাশাপাশি লড়াই করবে -সেটিই ছিল কাঙ্খিত। যুগে যুগে মুসলিমগণ তাই করেছে। অথচ পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সেগুলোর কিছুই হচ্ছে না। বরং ঈমান-আখলাক ও সংস্কৃতি বাঁচাতে নয়, নিছক পানাহারে বাঁচার প্রয়োজনে মুসলিমগণ পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে ঈমান বিসর্জন দিচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে নিজেদের ধর্ম, রুচিবোধ ও সংস্কৃতি। এটি কি কম আতংকের?
শংকার আরো কারণ, অধিকাংশ মুসলিমের মনে এ ভাবে স্রোতে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কোন দুশ্চিন্তাও নেই। বিপদ বোঝার মত বোধশক্তিও নেই। তাদের দুশ্চিন্তা বরং পাউন্ত-ডলারের কামাই কি করে আরো বাড়ানো যায় -তা নিয়ে। উপার্জন বাড়াতে অনেকে মদবিক্রয়, রেস্তোঁরায় মদ সরবরাহের ন্যায় হারাম পথও ধরেছেন। অনেকে নানারূপ দুর্নীতিতেও নেমেছে। মুসলিমদের পচন যে কত গভীরে পৌঁছেছে -এসব হলো তারই প্রমাণ। উদ্ভিদও বেড়ে উঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ চায়। বীজ যত উত্তমই হোক তা পাথরের উপর বা মরুভূমিতে গজায় না। ঝোপঝাড়েও বেড়ে উঠে না। একই কারণে অনুকূল পরিবেশ অপরিহার্য মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার জন্যও। তেমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতেই নবীজী (সা:) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। এবং মদিনার বুকে সর্বপ্রথম যে কাজটি করেছিলেন -সেটি হলো ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা। এবং নিজে রাষ্ট্রপ্রধানের আসনে বসে সেটিকে এক শ্রেষ্ঠ সূন্নত রূপে প্রতিষ্টা দিয়েছিলেন। তাঁর সাহাবাদের জান ও মালের সবচেয়ে বেশী কোরবানী পেশ করতে হয়েছে সে রাষ্ট্রের শক্তি বাড়াতে ও প্রতিরক্ষা দিতে। মুসলিমগণ তাদের গৌরব কালে যে ভাবে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার জন্ম দিতে পেরেছিলেন -তার মূলে ছিল এ ইসলামী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র না গড়ে শুধু মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে কি সেটি সম্ভব হতো? অথচ ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও আদর্শের তীব্র স্রোতে বীজ ছিটিয়ে মুসলিমগণ ভাবছে তাদের নতুন প্রজন্ম সুন্দর ভবিষ্যৎ পাবে!
স্রোতে ভাসা কি মুসলিমের সাজে?
অন্যদের বাঁচা আর মুসলিমদের বাঁচা এক নয়। মুসলিম উদ্ভিদ নয়, অন্য জীবজন্তু বা পশুপাখিও নয় যে শুধু জন্মালো, কিছু খেলো, কিছুকাল বাঁচলো এবং মরে গেল। মুসলিম নিছক বাঁচার জন্য বাঁচে না। মরার জন্যও মরে না। মুসলিমের বাঁচা ও মরা –উভয়ের মধ্যেই সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকে। তাঁকে বাঁচতে হয়, প্রতি পদে ইবাদত নিয়ে। বাঁচতে হয় সিরাতুল মুস্তাকীম বেয়ে। মরতে হয় মহান আল্লাহ-প্রদত্ত মিশনকে নিয়ে। তাই কোন একটি দেশে বাঁচলেই চলে না, ইসলামের মিশনটি নিয়ে সেদেশে বাঁচাটি কতটা নিশ্চিত -ঈমানদারকে সে বিষয়কেও গভীর ভাবে খতিয়ে দেখতে হয়। নিছক বাঁচার স্বার্থে সাইবেরিয়ার পাখিরা শীত কালে হাজার হাজার মাইল উড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেয়। পাখির বাঁচাতে রাজনীতি, আদর্শ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি লাগে না। কিন্তু সেরূপ বাঁচাটি কি ঈমানদারের লক্ষ্য হতে পারে? মুসলিমদের পরিচয়টি সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির। সে বিশেষ মর্যাদাটি স্রেফ পানাহারে বাঁচার কারণে নয়, বরং মিশন নিয়ে বাঁচার কারণে। সেটি হলো, “আ’মিরু বিল মারুফ” তথা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং “নেহী আনিল মুনকার” তথা অন্যায়ের নির্মূল। লক্ষ্য, উচ্চতর সভ্যতার নির্মাণ। এরূপ একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচা ও মরার কারণেই মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের “খায়রুল উম্মাহ” তথা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ রূপে অভিহিত করেছেন। তবে এ কাজের জন্য তাঁরা মহান আল্লাহতায়ালার কারিগর মাত্র, আর্কিটেক্ট বা ডিজাইনারও নন। কিভাবে সে সভ্যতা নির্মিত হবে সেটির ডিজাইন ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। কোরআন পাক তো সে নির্দেশনারই কিতাব।
রাসূলে পাক (সা:) নিজ হাতে দেখিয়ে গেছেন, পবিত্র কোর’আনে বর্ণীত সে নির্দেশনাগুলো কি করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কার্যকর করতে হয়। মুসলিমের প্রতি মুহুর্তের ব্যস্ততা হলো, এ মিশনকে বিজয়ী করা। সে বাঁচে, এবং বাঁচার জন্য কিছু উপার্জন করে শুধু এ মিশন চালিয়ে যাওয়ার জন্য। সে জ্ঞানার্জন করে, ঘর গড়ে, কখনো ঘর ছেড়ে হিজরত করে -নিছক সভ্যতর সমাজ নির্মাণের স্বার্থে। এটিই ঈমানদারের জিহাদ। তাই মুমিনের জীবনে শুধু নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত থাকে না, লাগাতর জিহাদও থাকে। এ জিহাদ নিজের ও অন্যদের ঈমান ও আমল বাঁচানোর। এরূপ অবিরাম জিহাদ থাকার কারণেই মুসলিমগণ তাই অনৈসলামিক সমাজে হারিয়ে যায় না, বরং অন্যরা হারিয়ে যায় তাদের সৃষ্ট সমাজে।
পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, মুসলিমও তেমনি বাঁচে না ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি ছাড়া। তাই একজন হিন্দু, চৈনীক বা খৃষ্টান যত সহজে ভিন্ দেশে খাপ খাইয়ে নেয়, কোন মুসলিম তা পারে না। শক, হুন, বৈদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মের লোকেরা ভারতের হিন্দু সমাজে হারিয়ে গেলেও মুসলিমগণ যে হারিয়ে যায়নি -তার কারন তো এটিই। মুসলিমগণ যেখানেই গেছে সেখানেই তাঁরা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথ ধরে কোর’আনের জ্ঞান-নির্ভর ইসলামী ধারার জন্ম দিয়েছে। এরূপ একটি ভিন্ন ধারা জন্ম দেয়ার মধ্যেই নিশ্চিত হয় মুসলিমের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকাটি। নইলে হারিয়ে যেতে হয়। বহু অমুসলিম দেশে মুসলিমগণ বিপুল সংখ্যায় হারিয়ে যাচ্ছে বস্তুত একটি ইসলামী ধারা জন্ম দেয়ায় ব্যর্থ হওয়াতে।
যাত্রী জাহান্নামমুখি জাহাজের
ইসলামের শত্রুপক্ষ চায়, মুসলিমগণ নিজেদের ভিন্নধারাটি বিলুপ্ত করুক এবং হারিয়ে যাক সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলিমদের “মেল্টিং পট”য়ে। এরূপ হারিয়ে যাওয়াকে তারা বলে সামাজিক ইন্ট্রিগ্রেশন। মুসলিমদের উদ্দেশ্যে পাশ্চত্যের দেশগুলোর এটিই হলো সরকারি নীতি। এরূপ নীতির বাস্তবায়নের মাঝে তারা নিজ সমাজের প্রগতি ভাবে। এ নীতির বাস্তবায়নে সরকারি স্কুল-কলেজের পাশাপাশী কাজ করছে শত শত এনজিও। এ লক্ষ্যে বাঁধা রূপে মনে করা হয় মসজিদ-মাদ্রাসার ন্যায় ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ফলে বন্ধ করা হয় মসজিদ-মাদ্রাসার ন্যায় ইসলামী প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল মাক্রন সেদেশের ৭০টির বেশী মসজিদে তালা লাগিয়েছে। তবে এ নীতি শুধু পাশ্চাত্য দেশগুলোর নয়; একই নীতি আন্যান্য অনেক অমুসলিম দেশেরও। কম্যুনিস্ট শাসনামালে বহু হাজার মসজিদে তালা লাগিয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীন। ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার লক্ষ্যেই চীন সরকার লক্ষ লক্ষ মুসলিম সন্তানদের তাদের পিতামাতা থেকে ছিনিয়ে নির্বাসন কেন্দ্রে তুলেছে। মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস বা দুর্বল করা হচ্ছে ভারতে। লক্ষ্য একটাই, মুসলিমদের মুসলিম রূপে বেড়ে উঠাকে বাধাগ্রস্ত করা। অমুসলিম দেশে বসবাসের এটিই হলো সবেচেয়ে ভয়াবহ বিপদ। এটি এমন এক জাহাজে চড়ে বসার ন্যায় -যার লক্ষ্য জাহান্নামের দিকে।
উনুনের পাশে রাখলে পাথরের ন্যায় শক্ত বরফও গলে যায়। সেটি হয় উত্তপ্ত পরিবেশের কারণে। তেমনি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার পরিবেশও ব্যক্তিকে পাল্টে দেয়। হাদীসপাকে বলা হয়েছে, সকল শিশুর জন্ম হয় মুসলিম রূপে, কিন্তু পরিবেশের প্রভাবে তারা বেড়ে উঠে ইহুদী, নাসারা, মুর্তিপূজারী বা অন্যধর্মের অনুসারী রূপে। তাই অনৈসলামিক দেশের কুফরি পরিবেশে মুসলিম সন্তানেরা মুসলিম হিসাবে বেড়ে উঠবে -সেটি কি এতই সহজ? বিষয়টি স্রোতের উজানে লাগাতর সাঁতার কাটার মত। সাঁতারে ঢিল দিলে ভেসে যেতে হয়। সেরূপ ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচতেই নিজের অনুকূলে স্রোত সৃষ্টি করতে হয়। সেজন্য ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে হয়। পানাহারের অভাবে কেউ জাহান্নামে যাবে না, কিন্তু সেটি অনিবার্য হয় অনৈসলামের স্রোতে ভাসাতে। এবং সেটি আরো সহজ হয় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র না থাকাতে।
হিযরত কেন ফরজ?
মুসলিম অভিভাবককে তাই শুধু পানাহারে হালাল-হারাম নিয়ে ভাবলে চলে না। ভাবতে হয় নিজের ও নিজ সন্তানের জন্য শিক্ষা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়েও। এজন্যই মুসলিমগণ অতীতে সবদেশে বসতি গড়েনি। যেখানে বসত গড়েছে সেখানকার শিক্ষা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করেছে। ভারত ও স্পেনের মত দেশে সংখ্যা লঘিষ্ট হয়েও তারা রাজনীতিকে নিজ হাতে নিয়েছে। এমন কি পশু-পাখি, জীবজন্তুও উপযোগী পরিবেশ ছাড়া বাসা বাঁধে না।
অন্য জীবের কাছে গুরুত্ব পায় স্রেফ দৈহিক ভাবে বাঁচা। কিন্তু ঈমানদারকে শুধু দৈহিকভাবে বাঁচলে চলে না, তাঁকে বাঁচতে হয় ঈমান নিয়ে। এবং সেরূপ বাঁচায় ব্যক্তির নিজস্ব সামর্থ্যই যথেষ্ট নয়, সে জন্য জরুরি হলো দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আদর্শিক ও শিক্ষার পরিবেশ থেকে লাগাতর পুষ্টি। সে পুষ্টি যোগ হয় ঈমানের ভূমিতে। অনৈসলামিক রাষ্ট্রে সেটি অসম্ভব। তেমন একটি সহায়ক পরিবেশ পেতে ইসলামী রাষ্ট গড়া মুসলিম জীবনে এজন্যই এতো গুরুত্বপূর্ণ। জিহাদ এ জন্যই অনিবার্য হয়ে উঠে। এ জিহাদ মূলত ঈমান নিয়ে বাঁচা ও নিজেদের আখেরাত বাঁচানোর লড়াই। ইসলামি রাষ্ট্র গড়া অসম্ভব মনে হলে মুসলমান সেখানে বসতি না গড়ে বরং সে দেশ থেকে হিজরত করে। নামাজ রোজা, হজ্ব-যাকাতের ন্যায় হিজরতও তখন ফরজ ইবাদতে পরিণত হয়।
অনৈসলামিক দেশে আবাদী গড়ার যে ধারণা -সেটি সাম্প্রতিক। অমুসলিমের রাইফেল কাঁধে নিয়ে যুদ্ধে নামা বা তাদের কামানে গোলা ভরা বা কারখানায় শ্রমিক হওয়া বা জাহাজে কয়লা ঢালার যে ঐতিহ্য -সেটিও এযুগের। একাজে তারাই নেমেছে যাদের কাছে দৈহিক ভাবে বাঁচাটাই অধিক গুরুত্ব পেয়েছে, ঈমান নিয়ে বাঁচাটি নয়। এতে শক্তি বেড়েছে ইসলামের শত্রু পক্ষের, মুসলিমদের নয়। এখনও অমুসলিম শক্তিবর্গ সে লক্ষ্যেই মুসলিমদের ব্যবহার করতে চায়। অন্যদের স্বর্ণখনি বা তেলের খনির লুন্ঠনের ন্যায় এরা এখন মুসলিম দেশের মেধার খনিকেও কাজে লাগাতে চায়। দ্বীনের কাজে মুসলিমদের দেশত্যাগ অহরহ হলেও অতীতে সেটি কখনোই অমুসলিম দেশে রুজীরোজগারের জন্য হয়নি। অথচ রুটি রুজীর জন্য আজকের মুসলিমগণ এমন ভাবে নিজ ঘরাড়ী ছাড়ছে -যা শুধু আগুন লেগেছে এমন ঘর বা জাহাজ থেকে ঝাপিয়ে পড়া মানুষের সাথেই তুলনা চলে। মুসলিমদের আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) যোগাযোগহীন সে যুগে জন্মভূমি ইরাক ছেড়ে সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিশর ও হেজাজের পথে পথে ঘুরেছেন। হাজার হাজার মাইল তিনি এভাবে ভ্রমন করেছেন। সে দেশত্যাগে রুজী-রোজগার গুরুত্ব পেলে স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে নিয়ে তিনি কখনই মক্কার বিজন মরুভূমিতে হাজির হতেন না। অর্থের লোভে কুফুরি পরিবেশে নিজেকে সঁপে দেয়া নবীরাসুলের সুন্নত নয়। রেযেকের জন্য মুসলিমদের তাওয়াক্কুল সব সময়ই মহান আল্লাহতায়ালার উপর। মুসলিমের বাঁচবার লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রুপে দায়িত্বপালন। সে দায়িত্বপালন কি বৈরী পরিবেশে আত্মসমর্পণে বা বসবাসে হয়? বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই রোজগার করতে হয়। তবে রোজগারের জন্যই বাঁচতে হবে এবং সে লক্ষ্যে সকল সামর্থ্য নিয়োগ করতে হবে -সেটি কি ঈমানদারি? সেটি তো নিছক দুনিয়াদারি। এবং কোনটি ঈমানদারি আর কোনটি দুনিয়াদারি -অন্ততঃ এ দুটি বিষয়ে মুসলিমদের সম্যক উপলব্ধি প্রয়োজন। এ মৌলিক বিষয়ে অজ্ঞতা নিয়ে কে জান্নাতের পথে চলা যায়?
কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির নাশকতা
শিক্ষা-সংস্কৃতির সৃষ্টিশীলতা যেমন বিশাল, তেমনি অতি ভয়ংকর হলো কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির নাশকতা। নির্ভর করে কি উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষানীতি প্রণীত হলো -তার উপর। যারা আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করলো, হিটলারের গ্যাসচেম্বারে ইহুদীদের পুড়িয়ে মারলো, জাপানে পারমানবিক বোমা ফেললো এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে দুই লাখের বেশী মানুষকে হত্যা করলো -তারা বনে জঙ্গলে বেড়ে উঠেনি। নিরক্ষরও ছিল না। তারা বেড়ে উঠেছিল একটি বিশেষ শিক্ষানীতি ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষকে পশুর চেয়েও কত অধিক হিংস্র করতে পারে –এ হলো তারই উদাহরণ। পাশ্চাত্য দেশসমুহে মুসলিমদের বিপদের সবচেয়ে বড় কারণ হলো, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতি। এ শিক্ষাই জন্ম দিয়েছে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদের ন্যায় নৃশংস মতবাদ। তাই বিপদ শুধু ঈমান বিলুপ্তির নয়, জাতিগত বিলুপ্তিরও। শত শত মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়েও স্পেনে ৭ শত বছরের মুসলিম শাসন বাঁচেনি। বরং সম্পূর্ণ নির্মূল হতে হয়েছে। বাঁচতে হলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে বাঁচার স্ট্রাটেজী নিয়ে বাঁচতে হয়। থাকতে প্রবল প্রতিরক্ষার স্ট্রাটেজী। থাকতে হয় জিহাদের স্পিরিট। ইতিহাসের শিক্ষা তো সেটিই। কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের মাঝে সে সবের বালাই নাই। ডলার-পাউন্ড কামাই ছাড়া তাদের তেমন কোন উচ্চতর ভাবনা নাই। যেন হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেই তাদের তৃপ্তি।
চেতনা, চরিত্র ও সমাজ পরিবর্তনে শিক্ষা ও সংস্কৃতি হলো শক্তিশালী হাতিয়ার। পাশ্চাত্যে দেশে এ হাতিয়ার দুটি ইসলামের বিরুদ্ধে যেমন আগ্রাসী, তেমনি ঈমান- বিনাশীও। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপাদানগুলি এতোই শক্তিশালী যে সংখ্যালঘুরা তাতে নিজ পরিচয় হারিয়ে বিলীন হতে বাধ্য। পাশ্চাত্য দেশের কর্ণধারগণ এজন্যই মুসলিমদের ধর্মান্তর নিয়ে ভাবে না, তারা চায় কালচারাল কনভার্শন। একাজে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো শক্তিশালী হাতিয়ার। উপনিবেশিক শাসনামলে ভারতবর্ষে এমন শিক্ষাব্যবস্থা শুরু করতে গিয়ে ব্রিটিশ শিক্ষামন্ত্রী লর্ড মেকলে বলেছিলেন, “এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষিত হয়ে বেরুবে তারা শুধু রক্ত-মাংসেই ভারতীয় হবে, মন-মানসিকতায় হবে বৃটিশ।” লর্ড মেকলে আসলে এখানে অসত্য বলেছেন। লক্ষ্য আদৌ চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় ইংরেজ বানানো ছিল না। সেটি ছিল ব্রিটিশের গোলাম ও তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থের সেবাদাস বানানো। তারই ফল হলো, এমন কি কংগ্রেস নেতা করম চাঁন্দ গান্ধি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলা কালে ব্রিটিশ বাহনীকে বিজয়ী করতে ভারতীয় মাঝে সৈন্য সংগ্রহে নেমেছিলেন।
মানুষ তার সময়, শ্রম, মেধা তথা জীবনের শ্রেষ্ঠ সামর্থ্য কোথায় বিনিয়োগ করবে এবং সে বিনিয়োগের কাজে কোন দেশে বা কোন ফ্রন্টিয়ারে যাবে -সে নির্দেশটি পায় তার চেতনা ও মন-মানসিকতা থেকে। মন-মানসিকতায় বৃটিশের গোলাম হওয়ার অর্থ, বৃটিশের পক্ষে যুদ্ধ লড়া বা বৃটিশ সমাজে বিলুপ্ত হওয়াকেই তারা যথার্থ ভাববে। সে চেতনায় নিজ ধর্ম ও নিজ দেশের চেয়ে বৃটিশ স্বার্থের প্রতি অঙ্গিকার হয় অধিক। যে সব মুসলমান ১৯১৭ সালে বৃটিশ বাহিনীতে শামিল হয়ে উসমানিয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে ক্রসেড লড়েছিল -তারা ছিল এ শিক্ষানীতিরই ফসল। উল্লেখ্য যে, দুই লাখের অধিক ভারতীয় মুসলিম প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করেছিল। তাদের মাঝে বাংলার কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন। বায়তুল আকসা, ইরাক, সিরিয়া দখল করে বৃটিশের হাতে তুলে দেয়াকে এরা গর্বের কাজ মনে করেছিল। আজও মার্কিন নেতুত্বে যে ক্রুসেড শুরু হয়েছে সে ক্রসেডে বহু মুসলিম দেশ যে তাদের পক্ষ নিচ্ছে তার কারণ তো এ ইসলামশূণ্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি। মানুষকে বিবেক শূণ্য, ধর্মশূণ্য ও দেশপ্রেমশূণ্য করার কাজে শিক্ষানীতি যে কতটা সর্বনাশা ভূমিকা পালন করতে পারে -এ হলো তার নজির।
বিপদ “মেল্টিং পট”য়ের
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ রূপান্তরের যে শক্তিশালী প্রক্রিয়া পশ্চিমা সমাজে ক্রিয়াশীল -সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় “মেল্টিং পট ফেনোমেনা”। উনুনের উচ্চতাপে কড়াইয়ের আলু, পটল, মরিচ, বেগুন যেমন একাকার হয়ে যায়, পাশ্চাত্য সমাজের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় তেমনি একাকার হয়ে যাচেছ বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগণ। শিক্ষাই জীবনে পথ দেখায়। পাপ-পুণ্য ও শিষ্ঠ-অশিষ্ঠের সংজ্ঞা দেয় এবং সেসাথে ব্যক্তিকে দেয় বিশিষ্ঠ পরিচয়। হাওয়ায় যেমন প্রাসাদ গড়া যায় না, শিক্ষাছাড়া তেমনি ঈমানও গড়ে উঠে না। পবিত্র কোর’আনের সর্বপ্রথম ওহীটি হলো, “ইকরা” অর্থাৎ পড় তথা জ্ঞানবান হও। মহান আল্লাহতায়ালা নিজে শপথবাণী উচ্চারণ করেছেন কলম ও কলম দিয়ে যা লেখা হয় তার নামে -(সুরা কলম)। বিদ্যালাভ ও শিক্ষার গুরুত্ব যে কত অধিক মহান আল্লাহতায়ালার এ ঘোষনা থেকে সেটিই সুস্পষ্ট।
অপরদিকে সংস্কৃতি হলো ব্যক্তির কর্মে, চরিত্রে, চৈতন্যে ও রুচিবোধে সংস্কারের প্রক্রিয়া। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশসমুহে শিক্ষা ও সংস্কৃতি -এ দুটির কোনটিই ইসলামের পক্ষে নয়, বরং শিকড় কাটছে ঈমানের। ফলে মুসলিম সন্তানদের পক্ষ্যে ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠাই দিন দিন দুরুহ হচ্ছে। সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম অভ্যস্থ করছে অশ্লিলতা ও বিবাহ-বহির্ভুত যৌনতায়। বাড়ছে মাদকাসক্তি, বাড়ছে নানারূপ পাপাচার। ফলে এসব দেশে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে মুসলিমদের দর্শন ও জীবনবোধে। তাওহীদ, রেসালাত, আখেরাত, ইবাদত ও খেলাফতের যে মৌলিক কোর’আনী ধারণা -সেগুলি এ শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু অজানাই থাকছে না বরং চেতনা থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। নিছক কোরআনের তেলাওয়াত শিখিয়ে বা কিছু ওয়াজ শুনিয়ে কি চেতনার এ বিচ্যুতি দুর করা যায়? যাচ্ছেনা। ফলে সময়ের তালে বরফ যেমন হাওয়ায় হারিয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ মুসলিম যুবকও তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে অমুসলিম সমাজে। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন অমুসলিমের মুসলিম হওয়ার যে আনন্দ -তা কি লাখ লাখ মুসলিম সন্তানের হারিয়ে যাওয়ার বেদনাকে লাঘব করতে পারে?
চেতনায় আরেক গভীর বিচ্যুতি হলো শিক্ষার গুরুত্ব ও তার উদ্দেশ্য নিয়ে অজ্ঞতা। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিছক উপার্জনের কৌশল শেখানো নয়। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, শিষ্ঠ-অশিষ্ঠ চিনতে যে শিক্ষা সাহায্য করে না -তা কি আদৌ শিক্ষা? এমন শিক্ষায় কি ঈমান গড়ে উঠে? আসে কি নেক আমলে প্রেরণা? শিক্ষা হবে প্রতি পদে সত্য-মিথ্যা চেনা ও হেদায়াত লাভের হাতিয়ার, নিছক উপার্জনের নয়। উপার্জনের কৌশলাদী আবু লাহাব বা আবু জেহেলের কম জানা ছিল না। কিন্তু তাদেরকে শিক্ষিত বলা হয়নি। আবু জেহেলকে বরং মুর্খের পিতা বলা হয়েছে। কারণ তার বিদ্যা সত্যাপোব্ধির সামর্থ্য বাড়ায়নি। পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিতদের উপার্জন বাড়ছে বটে, তবে তাতে তাদের ঈমানও কি বাড়ছে? বাড়ছে না, বরং উল্টোটি হচ্ছে। পাশ্চাত্যে মুসলিম শিশুরা ধর্মান্তরিত হচ্ছে না বটে, তবে লাখে লাখে যে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে –সেটি তো এ কারণেই। এটিই হলো কালচারাল কনভার্শন। এরই ফলে মুসলিম সন্তানদের চরিত্র ও চাল চলনে ইসলামের নামগন্ধ থাকছে না।
এরূপ বিপর্যের মূল কারণ, শিক্ষাদানের ন্যায় ফরজ কাজটিই পাশ্চাত্যের মুসলিমদে মাঝে যথার্থ ভাবে হচ্ছে না। অথচ শিশুদের শিক্ষাকে সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রতিটি মুসলিমের। ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, যানবাহন বা কলকারখানাগুলো অমুসলিমদের দিয়ে তৈরী করিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সন্তানদের মুসলিম রূপে গড়ে তোলার কাজটি একান্তই তাদের নিজেদের। অমুসলিদের দিয়ে এটি করাতে গেলে বিপদটি ভয়াবহ। এতে বিদ্যা-হাসিলের ফরজ বিধানটি আদায় হয় না। তুরস্ক, পাকিস্তান ইত্যাদি মুসলিম দেশগুলি সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণের দায়ভার যেদিন থেকে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে গেল, তাদের ধ্বংসের গতিও তখন থেকে বেড়ে গেল। বিদ্ধস্ত হলো উসমানিয়া খেলাফত, খন্ডিত ও বিপর্যস্ত হলো বড় বড় মুসলিম দেশগুলি। কারণ চেতনায় দূষিত চেতনার প্রবেশ ঘটাতে শিক্ষাব্যবস্থা পাইপ লাইনের কাজ করে। অন্যকে প্রভাবিত করার এটিই শক্তিশালী মাধ্যম। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের পিতা-মাতা ও নেতা-নেত্রী। তারা সুশিক্ষা না পেলে তাদের সন্তানেরাও পাবে না। পিতা-মাতার দায়িত্ব শুধু সন্তানের দেহের খাদ্য জোগানো নয়, বরং মনের খাদ্যকেও সুনিশ্চিত করা। এটির উপরই নির্ভর করে তার ঈমান পুষ্টি পাবে কি পাবে না, সে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠবে কি উঠবে না – এসব গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলো। কিন্তু পশ্চিমা দেশে সে সুযোগ সামান্যই। ফ্রান্সে মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ পড়াকে যেভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাতে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠার বিষয়টি তাদের কাছে কতটা অপছন্দের -সেটি কি গোপন থাকে?
তবে মুসলিম রূপে টিকে থাকা বা বেড়ে উঠার স্বার্থে বিক্ষিপ্ত ভাবে চেষ্টা যে হচ্ছে না -তা নয়। কিন্তু এর সুফল কতটুকু? বিষাক্ত পানির প্লাবনে যে ব্যক্তি ডুবতে বসেছে তাকে দুয়েক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করিয়ে কি বাঁচানো যায়? ঔষধ সারা জীবন খাওয়ার বস্তু নয়, এতে স্বাস্থ্য বাঁচে না। বরং এর জন্য দূষিত পানি থেকে পরিত্রাণ চাই; এবং নিয়মিত বিশুদ্ধ খাদ্য-পানীয় চাই। তেমনি মুসলিমদের ঈমানী স্বাস্থ্যের জন্য সুশিক্ষার ও সু-সংস্কৃতির পবিত্র পরিবেশ চাই। এজন্যই ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ চাই। কিন্তু সেটি কি পাশ্চাত্যে সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই এখানে মুসলিমদের জীবন নিরাপদ নয়। এ কঠিন বাস্তবতা অবশ্যই বুঝতে হবে।
উদ্ধার কীরূপে?
পাশ্চাত্য দেশে মুসলিমদের উদ্ধারের পথ খুব একটা বেশী নেই। বরং শংকার কারণ হলো, মুসলিমগণ উদ্ধার পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পাশ্চাত্য দেশে আসেনি। ফলে উদ্ধার পাওয়া নিয়ে তাদের ভাবনাও তেমন একটা নাই। প্রচেষ্টাও তেমন নাই। উদ্ধারের পথ নয় বরং যে পথটি নিশ্চিত নিমজ্জনের -সেটিই বহু মুসলিম বেছে নিয়েছে। এ পথের পথিকেরা পাশ্চাত্য সমাজে ইন্টিগ্রেটেড তথা একাত্ব হওয়া নিয়ে ব্যস্ত। তারা তাই খরচের খাতায়। মুক্তির পথ মাত্র দুইটি। প্রথমটি, কবি আল্লামা ইকবাল(পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা), মুহাম্মদ আসাদ (জার্মান নওমুসলিম, প্রখ্যাত সাংবাদিক, তাফসির লেখক ও বুদ্ধিজীবি যিনি পাকিস্তানে হিজরত করেছিলেন এবং জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদুত ছিলেন) ও পারমানবিক বিজ্ঞানী ড. আব্দুল কাদের খানের (যিনি পাকিস্তানকে পারমানবিক শক্তিতে পরিণত করেছেন) পথ। তাদের পথ হলো, পশ্চিমা দেশ থেকে যা কিছু শেখার তা দ্রুত শিখে একটি মুসলিম দেশে তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে সে দেশের উন্নয়নে লেগে যাওয়া। দ্বিতীয় পথটি হলো, মিশনারীর পথ। অমুসলিম দেশে অবস্থান একমাত্র এ পথেই জায়েজ হয়। যুগে যুগে মুসলিমগণ এ পথেই বাংলা, ভারত, বার্মা, মালয়, ও আফ্রিকার নানা দেশে অনৈসলামিক সমাজে না হারিয়ে ঈমান-আমল নিয়ে বেঁচে থাকতে পেরেছিলেন। মিশনারি কাজ চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে তাদের প্রয়োজন হবে উপার্জনের। উপার্জনের প্রয়োজনে হালাল ব্যবসা বা চাকুরি মাধ্যম হতে পারে। তবে নিছক উপার্জনের স্বার্থে এদেশে থাকা শুধু অর্থহীনই নয়, অতি বিপদজনকও।
সাংস্কৃতিক বা আদর্শিক স্রোতে হয় উজাতে হয়, নইলে ভেসে যেতে হয়। সব সময় একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। মিশনারি স্পিরিটই মুসলিমদেরকে দিতে পারে পাশ্চাত্যের প্রচন্ড স্রোতে উজানে ছুটার শক্তি। কারণ এরূপ মিশনারীরাই চিন্তা-চেতনা ও কর্মে ভিশনারী হয়। তাদের দৃষ্টিতে সদা জাগ্রত থাকে মহান আল্লাহতায়ালার সান্যিধ্যে সফলকাম হয়ে পৌঁছার প্রচন্ড বাসনা। মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করাই তখন তাদের একমাত্র সাধনা হয়। এ বাসনা ও সাধনাতেই তাদের জীবন অবিশ্বাস্য শক্তি ও অদম্য গতি পায় – যেমনটি ছিল রাসুলে পাকের (সা) সাহাবীদের মাঝে। সে অদম্য গতিতে তারা নানা দেশে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ছুটেছেন। পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল, মরুভুমি কোন কিছুই তাদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পারেনি। সমাজের প্রতিকূল স্রোত বা অনৈসলামিক সংস্কৃতি তাদের ভাসিয়ে নিতে পারেনি। বরং তারাই অন্যদের ভাসিয়ে নিয়েছেন নিজেদের স্রোতে। পাশ্চাত্যের স্রোত থেকে বাঁচবার তাগিদে ইউরোপের অর্থডক্স ইহুদীরা মধ্যযুগে যেভাবে শহরের অভ্যন্তরে নিজেদের জন্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ঘেটো জীবনের জন্ম দিয়েছিল -আজকের আধুনিক যুগে সেটি অচল। এমনকি ইহুদীরাও তা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। কারণ টিভি, পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট ও রাষ্ট্র পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থার বদৌলতে সংস্কৃতির জোয়ার এখন বেডরুমেও ঢুকেছে। ফলে ঘেটো জীবন মুসলিমদের জন্যও মুক্তির পথ নয়।
নবী পাকের (সাঃ) যুগে মুসলিমদের যে সংখ্যা ছিল, একমাত্র লন্ডন শহরে নিয়মিত নামাযীদের সংখ্যাই তার চেয়ে কয়েকগুণ। দাওয়াতী কাজে এ বিশাল সংখ্যাকে শক্তিতে পরিণত করতে পারলে অলৌকিক কিছু আশা করাও অসম্ভব নয়। এদেশের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর দায়িত্ব এখন মুসলিমদের। সমগ্র ইউরোপের যে আয়তন তার চেয়ে বৃহত্তর ভুখন্ডে প্রাথমিক যুগের মুষ্টিমেয় মুসলিমগণ ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন। এ কাজো তাঁরা বহু দুর্গম পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ও বিজন মরুভূমি অতিক্রম করেছেন পায়ে হেঁটে। অথচ এখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার অভ্যন্তরে বসে সেরূপ কষ্টস্বীকারের প্রয়োজন নেই। তবে এ কাজে জরুরি হলো, অন্যদের শিক্ষিত করার আগে নিজেদেরকে শিক্ষিত করা। জরুরি, কোর’আনের জ্ঞানে নিজেদের আলোকিত করা এবং চেতনায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব আনা।
মহান আল্লাহতায়ালা তো সত্যিকার মুসলিমদের সাহায্য করতে সদাপ্রস্তুত। তাঁরা যদি মহান আল্লাহতায়ালার পথে এগোয়, তবে তিনিও তাঁদের দিকে ছুটে আসেন। কোর’আন পাকে সে প্রতিশ্রুতির কথা উচ্চারিতও হয়েছে বহুবার। তবে শর্ত হলো সে সাহায্য গ্রহণের সামর্থ্য থাকা দরকার। সাহায্য না আসার কারণ, সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য তারা নিজেদেরকে তৈরীই করেনি। পাশ্চত্য দেশসমুহে মুসলিমদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বস্তুত তাদের নিজেদের প্রস্তুতির উপর। নইলে এ মহাপ্লাবনের মধ্যখানে নিজেদের ঈমান-আমল নিয়ে বেঁচে থাকাই অসম্ভব। নিজেদের ছেলেমেয়ে ও আপনজনদের অনেকেই যে সে প্লাবনে ভেসে যাবে –তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে? কারণ, প্লাবনের কাজই তো গ্রাস করা। প্লাবনের পানিতে মানুষ সাগরে বা নদীতে ভেসে যায়। কিন্তু কুফরির এ প্লাবন যে জাহান্নামে নিয়ে পৌঁছাবে –সে হুশ ক’জনের? ১ম সংস্করণ ২৬/০৭/২০০৩; ২য় সংস্করণ ১০/১২/২০২০।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018