অর্জিত পরাধীনতা ও স্বাধীনতার যুদ্ধ

ফিরোজ মাহবুব কামাল

অর্জিত পরাধীনতা

মানুষ শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্যই লড়াই করে না। অনেক সময় আত্মঘাতী হয় এবং নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনে। তেমনটি ঘটে এমন কি জাতীয় জীবনেও। অনেক সময় নিজ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যুদ্ধ করে নিজেদের পরাজয় বাড়াতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে শত্রুর হাতে পরাধীনতা বাড়াতে তেমন আত্মঘাতী যুদ্ধ দেখা গেছে মধ্যপ্রাচের আরব দেশগুলোতে। বহু লাখ আরব সে যুদ্ধে ব্রিটিশ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে চিহ্নিত শত্রুদের বিজয় বাড়িয়েছে এবং ২২ টুকরোয় বিভক্ত ও পরাজিত এক আরব মানচিত্রের জন্ম দিয়েছে। তেমন উসমানিয়া খেলাফত জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়ে উসমানিয়া খেলাফতের পরাজয় ও বিলুপ্তি ডেকে এনেছে। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরব ও তুর্কী মুসলিমদের যুদ্ধ ছিল না। এ যুদ্ধ ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের নিজেদের যুদ্ধ। তেমনি ১৯৭১’য়ের যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতে যুদ্ধ। বাঙালীগণ সে যুদ্ধে ভারতের পক্ষ নিয়ে যেমন ভারতের বিজয় বাড়িয়েছে, তেমনি পরাধীনতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ আজও তার ঘানি টানছে। এবং বহু শত বছর সে ঘানি টানতে হবে। এ পরাধীনতা বাংলাদেশীদের নিজ হাতের অর্জিত পরাধীনতা।    

পরাধীনতা অধিকৃত দেশের মুসলিমদের উপর গুরুতর দায়ভার চাপায়। সেটি প্রতিরোধ জিহাদের। দেশবাসীর উপর শত্রুর পক্ষ থেকে আরোপিত পরাধীনতা থাকবে অথচ জিহাদ থাকবে না -সেটি ইসলামের রীতি নয়। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো নির্ভয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মু’মিনের জীবনে সেটিই তো মিশন। সে পরাধীনতার বিলুপ্তিতে ঈমানদারের জীবনে জিহাদ শুরু হবে -সেটিই স্বাভাবিক ও কাঙ্খিত। শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে এরূপ দাঁড়ানোর অর্থই হলো মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে দাঁড়ানো। সেটি শুধু বিদেশী কাফেরদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ইসলামের দেশী শত্রুদের বিরুদ্ধেও। ইসলামে এরূপ দাঁড়ানোটি প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ। নইলে গোলামি হয় শয়তানের। আর শয়তানের গোলামী নিয়ে বাঁচা তো হারাম। শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম দেন খলিফা বা আমিরুল মু’মিনুন। কিন্তু  আজকের বিশ্বে না আছে কোন খলিফা, না আছে আমির। দেশে দেশে আছে কেবল ইসলামের শত্রুশক্তির দখলদারি। কিন্তু তাই বলে কি পরাধীনতার বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু হবে না? সেটি না হলে পরাধীনতা বিলুপ্ত হবে কীরূপে? এবং কীরূপে বিজয়ী হবে মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীন? বিষযটি এতোই গুরত্বপূর্ণ যে, শয়তানী শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর হুকুমটি এসেছে পবিত্র কোর’আনে। সে হুকুমটি এসেছে এভাবে, “বলো (হে মুহাম্মদ)! “(হে ঈমানদারগণ) তোমাদের উদ্দেশ্যে আমার একমাত্র নসিহত: তোমরা আল্লাহর জন্য জোড়ায় জোড়ায় এবং (সাথী না জুটলে) এক এক জন করে খাড়া হয়ে যাও। অতঃপর ভেবে দেখো -কোনরূপ উম্মাদনা নাই তোমাদের সাথীর মাঝে। সে তো আসন্ন আযাব সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্ক কারী মাত্র।” –(সুরা সাবা, আয়াত ৪৬)। লক্ষ্যণীয় হলো, উপরুক্ত হুকুমটি যখন এসেছিল তখন নবীজী (সাঃ)’র হাতে বিশাল বাহিনী ছিল না, প্রস্তুতিও ছিল না। বিশাল দল ও প্রস্তুতি এ আয়াতে শর্তও করা হয়নি।

 

ইব্রাহীম (আঃ)’র সূন্নত

জালেম শাসকের সামনে নির্ভয়ে একাকী দাঁড়ানোর ইতিহাস গড়েছেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)। সে অপরাধে তাঁকে নির্মম শাস্তি দেয়া হবে সেটি তাঁর অজানা ছিল না। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালন, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালের মুক্তিই তাঁর কাছে অধীক গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি কোন আমিরের অনুমতির অপেক্ষায় থাকেননি। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে আগুণে ফেলে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটিকে তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। সত্যের পক্ষে নির্ভয়ে দাঁড়ানোর এটি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নমরুদের সামনে একাকী দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সেদিন যা কিছু বলেছিলেন সেটির রেকর্ড অন্য কেউ নন, ধারন করেছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র সে সাহসী ঘোষণাটি ছিল এরূপ: “তোমাদের থেকে এবং  আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে পুঁজা করো তাদের থেকে ছিন্ন করছি সম্পর্ক; তোমাদেরকে আমরা মানিনা; এবং তোমাদের সাথে শুরু হলো আমাদের চিরকালের শত্রুতা ও বিদ্বেষ -যদি না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান না আনো..।” –(সুরা মুমতাহেনা, আয়াত ৪)। মহান আল্লাহতায়ালা চান, সমগ্র মানবজাতি হযরত ইব্রাহীম (আঃ)’র ন্যায় প্রজ্ঞাবান সাহসী ব্যক্তি থেকে শিক্ষা নিক। গড়ে উঠুক মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে খাড়া হওয়ার তথা জিহাদের সংস্কৃতি। সভ্যতর সভ্যতা গড়ে উঠে তো এমন জিহাদী সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করেই। মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণে কখনোই কোন সভ্যতর সমাজ গড়ে উঠে না; বরং তাতে বাড়ে ইতর বর্বরতা। তাতে বিজয় আসে শয়তানের। শয়তানের সে আধিপত্যকে মেনে নেয়া কখনোই মহান আল্লাহতায়ালার খলিফার কাজ হতে পারে না। তাতে গাদ্দারী হয় মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। খলিফার দায়িত্ব তো সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। ইব্রাহীম (আ:)’র জীবন থেকে সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তাই পবিত্র কোর’আনে সর্বযুগের মু’মিনদের সামনে অনুকরণীয় মডেল রূপে খাড়া করা হয়েছে ইব্রাহীম (আ:)।

অথচ নমরুদ, ফিরাউনদের ন্যায় জালেমদের বিরুদ্ধে একাকী দাঁড়ানোটি কোন কালেই সুস্থ্য ব্যক্তির কর্ম রূপে গণ্য করা হয়নি। গণ্য হয়েছে উম্মাদনা রূপে। সেটি যেমন মহান নবীজী(সা:)’র যুগে দেখা গেছে, তেমনি দেখা যায় আধুনিক যুগেও। ইসলাম বিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আজও তাই বহু ইসলামী দলের নেতাকর্মী ও আলেম কান্ডজ্ঞানহীন উম্মাদনা মনে করে। অথচ যারা দাঁড়ায় তারাই যুগে যুগে ইতিহাস গড়ে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) তাই একাকী ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন নমরুদের মনে। তিনি একা হলে কি হবে, পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে মিল্লাত রূপে চিত্রিত করেছেন। একই ভাবে ফিরাউনের মনে ক্ষমতা হারানোর ভয় ধরেছিল হযরত মূসা (আ:) ও তার ভাই হারুন (আ:)কে দেখে। মুষ্টিমেয় মু’মিনের জিহাদে শয়তানী শক্তির মনে সব সময়ই ত্রাস সৃষ্টি হবে –সেটিই নিয়ম। সে গুরুত্বপূর্ণ নসিহতটি ঈমানদারদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে পবিত্র কোর’আনের উপরুক্ত আয়াতে।

মু’মিনের জীবনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাতে হয় না, সেটি হয় মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে দাঁড়নোর মধ্য দিয়ে। পরকালে জান্নাত প্রাপ্তি নির্ভর করে এ পরীক্ষায় পাশের উপর। এবং সে পরীক্ষায় পাশ করে একমাত্র সাচ্চা ঈমানদারগণই। জায়নামাজে ঘুষখোর, সূদখোর, মদখোর, লম্পট এবং মুনাফিকগণও খাড়া হয়। কিন্তু জিহাদের ময়দানে দাঁড়ানোর কথা তারা মুখে আনতেও ভয় পায়। এবং জিহাদে যোগদানকে তারা উম্মাদনা বলে। বলে চরমপন্থা। ফলে তাদের রীতি হয়, স্বৈরাচারী, জাতীয়তাবাদী, রাজতন্ত্রী, সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে দাঁড়ানোর। তাদের কারণেই মুসলিম দেশগুলোকে দখলে রাখার কাজে ইসলামের শত্রুপক্ষের লোক বলের কমতি পড়েনা। অথচ প্রকৃত ঈমানদার জিহাদের ময়দানে হাজির হন এবং শহীদও হন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় এভাবেই তারা কৃতকার্য হন। সমগ্র মানব ইতিহাসে সে পরীক্ষায় পাশের হারটি সর্বাধিক ছিল সাহাবায়ে কেরামের যুগে। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে দাঁড়ানোর দায়িত্ব পালনের কাজে শতকরা ৭০ ভাগের বেশী শহীদ হয়ে গেছেন। যাদের জীবনে শহীদ হওয়ার নসীব হয়নি তাদের মাঝেও শাহাদতের তামান্না কি কম ছিল? তাছাড়া যেখানেই মু’মিনের জান ও মালের বিশাল বিনিয়োগ, সেখানেই ঘটে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশাল সাহায্যপ্রাপ্তি।  ফলে সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে সাহাবায়ে কেরামের যুগে সবচেয়ে বেশী বিজয় এসেছে। তাদের হাতে পতন ঘটেছে রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যের –যারা ছিল সে সময়ের দুটি বিশ্বশক্তি।

 

যুদ্ধ পরাধীনতা বৃদ্ধির!

কিন্তু আজকের মুসলিমগণ বিজয়ের পথে পা দেয়নি। তারা ইতিহাস গড়েছে অন্য ভাবে। যুদ্ধ তারাও করে। তারাও প্রাণ দেয়। শ্রম ও শক্তির বিশাল বিনিয়োগও করে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেটি স্বাধীনতা বাড়াতে নয়, বরং শত্রু শক্তির হাতে পরাধীনতা বাড়াতে। ব্রিটিশ কাফিরদের অস্ত্র নিয়ে সে পরাধীনতার জন্য ১৯১৭ সালে উসমানিয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল আরব মুসলিমগণ। তেমন এক পরাধীনতার জন্য ১৯৭১সালে লড়েছিল বাঙালী মুসলিমগণ। সেটি ভারতীয় কাফেরদের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার লক্ষ্যে। অথচ তারাই ছিল দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। কাফেরগণ যে কখনোই মুসলিমের স্বাধীনতা বাড়াতে অস্ত্র দেয় না -সে অতি সত্যটিও তারা বুঝতে পারিনি। এমন অজ্ঞতা নিয়ে কেউ কি ইসলাম ও মুসলিমের বিজয় ও কল্যাণ আনতে পারে?  সে অজ্ঞতায় যা আসে তা তো পরাজয় ও অপমান। এমন জাহেলগণ ভাষা, বর্ণ, গোত্র, দেশের নামে প্রাণ দিলেও, তারা ব্যর্থ হয় মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে দাঁড়াতে। তারা ভূলে যায়, মানব জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন যেমন মহান আল্লাহতায়ালার পথে শহীদ হওয়া, তেমনি সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো ইসলাম ভিন্ন অন্য পথে প্রাণদান। সেরূপ প্রাণদানের পথটি যে জাহান্নামের পথ -তা নিয়ে কি সন্দেহ করা চলে? অমুসলিম কাফের শক্তি তো মুসলিমদের দলে নেয়, অস্ত্র দেয় ও রক্ত ঝরায় পরকালের ব্যর্থতা বাড়াতে। বাংলার বুকে শত্রু শক্তির বিপুল বিনিয়োগ যেমন ১৯৭১’য়ে ছিল, তেমন বিনিয়োগ আজও। মুসলিম বিশ্বের নানা কোনে একই রূপ বিনিয়োগ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর নেতৃত্বাধীন জোট। শত্রুশক্তির এমন বিনিয়োগ যে পরাধীনতা আনে–ইতিহাসের গ্রন্থ তো সে কাহিনীতে ভরপুর।

পরীক্ষায় পাশের জন্য প্রস্তুতি চাই। সৈনিকগণ দেশের জন্য খাড়া হবে ও প্রাণ দিবে -সে সামর্থ্য বাড়াতে সেনানীবাসগুলোতে বছরের পর প্রশিক্ষণ হয়। এমন ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণের সে বাধ্যবাধকতাটি ইসলামেও। মহান আল্লাহতায়ালা চান, ঈমানদারগণ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় কৃতকার্য হোক। এ পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার উপর নির্ভর করে মানব জীবনের প্রকৃত সফলতা। কৃতকার্য হওয়ার সে সামর্থ্য বাড়াতেই ইসলামে কোর’আনী জ্ঞানার্জনকে ফরজ করা হয়েছে, এবং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নামাজ-রোযা, হজ্ব-যাকাতের ন্যায় প্রশিক্ষণ। স্কুল-কলেজের ক্লাসে অংশ না নিলে যেমন পরীক্ষায় পাশ জুটে না, তেমনি নামাজ-রোযা, হজ-যাকাতের ন্যায় প্রশিক্ষণে নিয়মিত অংশ না নিলে সফলতা জুটে না জীবনের চুড়ান্ত পরীক্ষায়। তবে স্কুল-কলেজে হাজিরা দিয়েও যেমন অনেকে পরীক্ষায় ফেল করে, তেমনি যারা সারাজীবন নামায-রোযা পালন করেও ঈমানের মূল পরীক্ষায় অনেকেই ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের মত অধীকাংশ দেশে ব্যর্থতার সে হারটি বিশাল। সে বিশাল ব্যর্থতাটি ধরা পড়ে মহান রাব্বুল আ’লামীনের পক্ষে খাড়া না হওয়ার মধ্য দিয়ে। এরূপ ব্যর্থতা নিয়ে কেউ কি আখেরাতে সফলতা পেতে পারে? কোটি কোটি মুসলিম নামায-রোযা পালন করলেও ক’জনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষে দাঁড়ানোর সামর্থ্য? বরং বিপুল সংখ্যায় জমা হয়েছে ইসলামের শত্রুপক্ষের শিবিরে। ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিত পরাজিত হয়েছে মহান আল্লাহর শরয়তি বিধান। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বে শরিয়তের বিধান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ৫৭টি মসুলিম দেশের মাঝে একমাত্র আফগানিস্তানে। সেটিই দেশটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামের শত্রুশক্তির ৪০টির বেশী দেশের সম্মিলিত বাহিনী দেশটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন কাফের বাহিনী যখন দেশটিতে মুসলিম নিধনে লিপ্ত সে বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার তুর্কী সৈনিক। এক বছর যাবত সে কোয়ালিশন বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল একজন তুর্কী জেনারেল। মার্কিন বাহিনীর জন্য হামালার পথ করে দেয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোশাররাফ। ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে এ কোয়ালিশনের যুদ্ধ এখন বিশ্বজুড়ে। 

 

শত্রুর সন্ত্রাস ও ঈমানদারের জিহাদ

লড়াইয়ের ময়দানে যেমন আগ্রাসী সন্ত্রাসী থাকে, তেমনি সে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জিহাদও থাকে। যারা সন্ত্রাসী তাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার নিয়েতটাই ভিন্ন। মহান আল্লাহতায়ালাকে খুশি করা তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য, নিজেদের বিজয় ও আধিপত্যের বিস্তার। আভিধানিক অর্থে ত্রাস সৃষ্টির প্রতি প্রচেষ্টাই হলো সন্ত্রাস। তাই সন্ত্রাস হলো প্রতিটি অনায্য যুদ্ধ। রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের তূলনায় সন্ত্রাসের সে সামর্থ্য তো তাদেরই বেশী যাদের হাতে রয়েছে মারণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, বিমানবাহী জাহাজ, ড্রোন, পারমানবিক বোমা ও সাবমেরিনের বিশাল ভান্ডার। এসব মারাত্মক অস্ত্রধারীরা সন্ত্রাসকে ভয়ংকর আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাসের মনোপলি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত, ফ্রান্স, ইসরাইলের ন্যায় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হাতে। মহল্লার বা রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীগণ সন্ত্রাসে চাকু, পিস্তল, হাতবোমা বা বন্দুক ব্যবহার করে; ব্যরেল বোমা, ক্লাস্টার বোমা বা ড্রোন হামলার সামর্থ তাদের থাকে না। ফলে তাদের সন্ত্রাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয় না; দেশত্যাগেও বাধ্য হয় না। প্রকৃত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হলো নিরস্ত্র জনগণের উপর যারা সামরিক আগ্রাসন চালানোর নীতি। ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও কাশ্মীরের জনগণ হলো সে সন্ত্রাসের শিকার। সে সন্ত্রাসে একমাত্র আফগানিস্তান ও ইরাকে বিশ লাখের বেশী নরনারী ও শিশুর প্রাণনাশ হয়েছে। 

ইতিহাসের আরেক সত্য বিষয় হলো, সমাজের জঘন্য অপরাধীগণ শুধু অপরাধীই নয়, অতিশয় মিথ্যাবাদীও। তাই অতি নৃশংস গণহত্যার নায়ক হয়েও ফিরাউন বা হিটলারের ন্যায় বর্বরগণ নিজেদেরকে  নিরপরাধ মনে করতো। ফিরাউন তো সমাজে অশান্তির কারণ রূপে চিত্রিত করতো মহান নবী হযরত মুসা (আ:)কে। একই কারণে সেসব অপরাধীগণও নিজেদের নিরপরাধ মনে করে যারা অতীতে দুইবার পারমানবিক বোমা নিক্ষেপের ন্যায় অপরাধ কর্ম করেছে, দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে এবং জন্ম দিয়েছে উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, ফ্যাসীবাদ এবং এথনিক ক্লিন্জিংয়ের ন্যায় নানারূপ বর্বরতার। এবং এরাই আজ দেশে দেশে নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্যারেল বোমা, ক্লাস্টার বোমা ও ড্রোন হামলা করছে। অথচ এ পেশাদার অপরাধীগণই সন্ত্রাসী বলছে তাদের যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠা চায়। এবং চায় মুসলিমদের নবীজী (সাঃ)’র যুগের ইসলামের দিকে ফিরিয়ে নিতে।  জিহাদ চিত্রিত হচ্ছে সন্ত্রাস রূপে। ইসলামের শত্রুপক্ষ মুসলিমদের নামায-রোযা, হজ-যাকাত থেকে দূরে সরানো নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা জানে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কখনোই নামাযী, রোযাদার বা হাজীদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে বিপদে পড়বে না। তারা বিপদ দেখে জিহাদের ময়দানে মুজাহিদদের দেখে।

অথচ প্রকৃত মু’মিনের জীবনে শুধু নামাজ-রোযা ও হজ-যাকাতাই থাকে না, জিহাদও থাকে। সে প্রমাণ মেলে সাহাবায়ে কেরামদের জীবন থেকে। ঈমানের দাবীতে কে কতটা সাচ্চা -সেটি কখনোই নামাজ-রোযা ও হজ-যাকাত দিয়ে যাচাই হয় না। ঘুষখোর, সূদখোর, মিথ্যাবাদী, চোর-ডাকাত ও মুনাফিকও নামায-রোযা পড়তে পারে। তারা বার বার হজও করতে পারে। খোদ নবীজী (সা:)’র পিছনে নামায পড়েও বহু মানুষ মুনাফেকী করেছে। ব্যক্তির সাচ্চা ঈমানদারী ধরা পড়ে জিহাদের ময়দানে জানমালের কোরবানীতে; সে সামর্থ্য কখনোই মুনাফিকদের থাকে না। জিহাদ তাই প্রকৃত ঈমানদারদের বাছাইয়ে ফিল্টারের কাজ করে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রকৃত মুসলিম রূপে গৃহীত হওয়ার জন্য জিহাদে অংশ নেয়াটি এজন্যই এতো অপরিহার্য।

মানব জাতির বিভাজনটি নানা ভাষা, নানা বর্ণ, নানা গোত্রের হলেও মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সে বিভাজনটি মাত্র দুটি পক্ষে। একটি  মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ এবং অপরটি শয়তানের পক্ষ। তেমনি দুটি পক্ষ থাকে রণাঙ্গনেও। আল্লাহতায়ালার পক্ষের যুদ্ধের লক্ষ্য,  তাদের প্রভূর ইচ্ছাপূরণ ও তাঁর নির্দেশিত বিধি-বিধান ও স্বার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা। তাদের লক্ষ্য, ইসলামের বিজয় ও মুসলিমের শক্তি ও গৌরব বৃদ্ধি। ইসলামেই এটিই জিহাদ। অপর দিকে শয়তানের পক্ষটি খাড়া হয় এর প্রতিপক্ষ রূপে। তাদের লক্ষ্য, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকে প্রতিরোধ করা। ইসলামের বিরুদ্ধে ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও জাতীয়তার নামে তারা জনগণকে  রণাঙ্গণে নামায়। এমন যুদ্ধে মহান আল্লাহতায়ালার ইচ্ছাপূরণ গুরুত্ব না পাওয়ায় সে যুদ্ধে কোন পবিত্রতা ও মানবিকতা থাকে না। এরা তখন যুদ্ধে ব্যারেল বোমা, ক্লাস্টার বোমা, কেমিক্যাল বোমা এমনকি পারমানবিক বোমাও নিক্ষেপ করে। লক্ষ্য, শক্তির প্রদর্শনী ও ত্রাস সৃষ্টি। মূল লক্ষ্যটি এখানে ত্রাস সৃষ্টি। এরাই মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস সন্ত্রাসী। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এরূপ দেশী ও বিদেশী সন্ত্রাসীদের হাতে অধিকৃত। কোন কোন অধিকৃত দেশে সংঘাত শুরু হয় জিহাদী মুসলিমদের সাথে সন্ত্রাসীদের।

 

পরাধীনতা নির্মূলের জিহাদ

জিহাদ না থাকলে মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা থাকে না। তাতে মুসলিমদের স্বাধীনতা ও গৌরবও বাঁচেনা। খোদ মুসলিম দেশগুলিতে ইসলাম যেরূপ পরাজিত এবং মুসলিমগণ যেরূপ ইজ্জতহীন -সেটি নামাজী ও রোজাদারদের কমতির কারণে নয়। বরং নবীজী (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে যত নামাজী ও রোযাদার ছিল বর্তমান বিশ্বে সে সংখ্যা হাজারগুণ অধীক। কিন্তু সে বিপুল সংখ্যার কারণে পৃথিবীর কোথাও ইসলামের প্রতিষ্ঠা যেমন বাড়েনি, তেমনি মুসলিমদের বিজয় ও স্বাধীনতাও বাড়েনি। কোন দেশে সৈন্য সংখ্যা লাখ লাখ হলেও তাতে বিজয়  আসে না, বিজয়ে  আনতে হলে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়। জান ও মালের কোরবানীও পেশ করতে হয়। নইলে শত্রু শক্তির অধিকৃতি বাড়ে; তখন আদর্শ, ন্যায়নীতি ও শরিয়তি বিধান অপসারিত হয় রাষ্ট্র থেকে। ১৭৫৭ সালে হানাদার ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সৈন্য সংখ্যা প্রায় দশগুণ ছিল। কিন্তু তারা যুদ্ধে নামেনি। ফলে যুদ্ধ ছাড়াই ইংরেজগণ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার বিশাল ভূ-খন্ডের উপর নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সফল হয়। ধীরে ধীরে মুষ্টিমেয় ইংরেজগণ সমগ্র ভারত জুড়ে তাদের শাসন বিস্তৃত করতে সফল হয়। অথচ শত্রুর হামলার মুখে মুসলিম জনগণের এরূপ আচরণ  ছিল অভাবনীয়। সকল ইসলামবিরোধী শক্তির সমগ্র বিশ্বজুড়ে এখন প্রচন্ড প্রচারণা জিহাদের বিরুদ্ধে।

জিহাদ সন্ত্রাস নয়, জিহাদ হলো মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে পবিত্র লড়াই। জিহাদ হলো, মুসলিম ভূমিকে শত্রুশক্তির আগ্রাসন থেকে মহান আল্লাহতায়ালার স্বার্বভৌমত্ব বাঁচানোর যুদ্ধ। মহান আল্লাহতায়ালার স্বার্বভৌমত্বের অর্থ, দেশে শরিয়ত, খেলাফত, হুদুদ, জিহাদের প্রতিষ্ঠা। শরিয়ত হলো মহান আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত কোর’আনী আইন। খেলাফত হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় নবীজী (সাঃ)র প্রতিনিধিত্ব -তথা তাঁর অনুসৃত নীতিমালার প্রতিষ্ঠা। দুনিয়ার বুকে  মুসলিম রূপে বাঁচার এ হলো এক অনিবার্য দায়বদ্ধতা। যে দেশে মহান আল্লাহতায়ালা-প্রদত্ত কোর’আনী আইনের প্রতিষ্ঠা নাই এবং নাই খেলাফত তথা নবীজী (সাঃ)’র প্রতিনিধিত্ব -তাকে কি মুসলিম দেশ বলা যায়? সে ইসলামশূণ্যতার মাঝে যা প্রতিষ্ঠা পায় তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সামরিক আগ্রাসন। তখন কাফের দেশ থেকে কি সে দেশের কোন পার্থক্য থাকে?

নামায-রোযা ও হজ্ব-যাকাত যেমন মুসলিমকে কাফেরদের থেকে তাকে পৃথক করে, তেমনি তাকে ভিন্নতর পরিচয় দেয় শরিয়ত প্রতিষ্ঠার  দায়বদ্ধতার কারণে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনে এমন একটি দিনও কি গেছে যখন শরিয়তের পালন হয়নি? তাদের আমলে কোন মুসলিম মুসলিম ভূমি কি কোন অমুসলিম শক্তির হাতে অধিকৃত হয়েছে? হয়নি। কিন্তু তবুও তাদের জীবনে লাগাতর জিহাদ ছিল। শতকরা ৭০ ভাগের বেশী সাহাবী শহীদ হয়েছেন। সে জিহাদ এসেছিল কাফের শক্তির অধিকৃতি থেকে মহান আল্লাহতায়ালার বিশাল বিশাল ভূমিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। যাদের জীবনে সেদিন জিহাদ ছিল না, তারা চিত্রিত হয়েছে মুনাফিক রূপে। অথচ ইসলামের শত্রুপক্ষের কথা, ইসলামে কোন যুদ্ধ নাই। তারা বলে, ধর্মকর্মের অর্থ শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল। যেন ইরান, সিরিয়া, মিশর, আফ্রিকার বিশাল ভূ-ভাগ জুড়ে ইসলামের বিজয় এবং বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিমদের উদয় তা সম্ভব হয়েছে স্রেফ দোয়া দরুদের বরকতে। ইসলামের এরূপ একটি পরিচয় তুলে ধরার লক্ষ্য মুসলিমদের নবীজী (সা:)’র ইসলাম থেকে দূরে সরানো। সে সাথে তাদেরকে প্রতিরক্ষাহীন করা। কারণ, রণাঙ্গণ ছেড়ে মসজিদে আশ্রয় নিলে তো প্রতিরক্ষা থাকে না।

নবীজী (সা:)’র ইসলামে নামায-রোযা, হজ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল যেমন ছিল, তেমনি ছিল ইসলামী রাষ্ট্র, হুদুদ, শরিয়ত ও জিহাদ। কিন্তু মুসলিমগণ আজ নবীজী (সা:)’র ইসলাম থেকে এতটাই দূরে সরেছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র, হুদুদ ও শরিয়তী আইন এবং জিহাদ –এর কোনটাই মুসলিম দেশগুলোতে বেঁচে নাই। মুসলিমগণ বাঁচছে নবীজী (সা:)’র ইসলাম ছাড়াই। নবীজী (সা:)’র যুগে কি কখনো ভাবা যেত, মুসলিম ভূমি অধিকৃত হবে, শরিয়তী আইন আবর্জনার স্তুপে যাবে, কাফেরদের প্রণীত আইন প্রতিষ্ঠা পাবে এবং শত্রুর বিমান হামলা, ট্যাংক হামলা, ড্রোন হামলা হবে এবং মুসলিমগণ তখনও নীরব ও নিষ্ক্রীয় থাকবে? এমন নিষ্ক্রীয়তায় যা প্রতিষ্ঠা পায় তা হলো, মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও আগ্রাসন। এ নিষ্ক্রীয়তায় যা প্রকাশ পায় তা হলো মহান আল্লাহতায়ালার সাথে গাদ্দারী। তাতে প্রবলতর হয় পরাধীনতা। মুসলিম উম্মাহ তো আজ তারই শিকার। বেশী বেশী মসজিদ গড়ে বা নামায-রোযা বাড়িয়ে কি এ পরাধীনতা থেকে বাঁচা যাবে? এ লক্ষ্যে জিহাদই হলো মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত একমাত্র পথ। ১২/০২/২০২১।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *