শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও বিপর্যয়
- Posted by ফিরোজ মাহবুব কামাল
- Posted on September 3, 2021
- Bangla Articles, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
- 1 Comment.
ফিরোজ মাহবুব কামাল
কুশিক্ষার বিপদ
চেতনা, চরিত্র, কর্ম ও আচরণে মানুষ মূলত তাই যা সে শিক্ষা থেকে পেয়ে থাকে। তাই শিক্ষা পাল্টে দিলে মানুষের ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি এবং রাষ্ট্রও পাল্টে যায়। তাই মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে মুসলিম করার কাজটি নামায-রোযা ও হজ্জ-যাকাত দিয়ে শুরু করেননি। সে কাজে জ্ঞানার্জনকে প্রথম ফরজ করেছেন এবং সেটি ৫ ওয়াক্ত নামায ফরজ হওয়ার প্রায় ১১ বছর আগে। ইকরা তথা পড়ো ও জ্ঞাবান হও -তাই পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা পক্ষ থেকে মানব জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম নির্দেশ। অথচ মুসলিমগণ সে কুর’আনী ইসলাম থেকে এতোটাই দূরে সরেছে যে তারাই বিশ্ববাসীর মাঝে সবচেয়ে অধিক অশিক্ষিত। শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিমদের ব্যর্থতা ও বিপর্যয়ের এই হলো সবচেয়ে বড় দলিল। যেন অশিক্ষা নিয়েই তারা মুসলিম হতে চায়।
মানুষের সামনে শুধু শ্রেষ্ঠ একটি ভিশন বা মিশন পেশ করলেই চলে না। প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে সে ভিশন ও মিশন নিয়ে বাঁচার সামর্থ্যও সৃষ্টি করতে হয়। নইলে সে ভিশন ও মিশন শুধু কিতাবই থেকে যায়। মুসলিম মাত্রই হলো, মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত খলিফা। মানব সৃষ্টির মূল কারণ এটিই। রাজার খলিফাগণ হলো দেশের নানা অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকগণ। সে দায়িত্বপালনে তাদেরকে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত হতে হয়। তাদের অবহেলা ও অযোগ্যতায় রাজার রাজত্ব বাঁচে না। তেমনি মহান আল্লাহতায়ালার রাজত্বে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও আইনের শাসন বাঁচাতে প্রতিটি মুসলিমের দায়ভারটি বিশাল। এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো সে দায়িত্ব পালনে মুসলিমদের যোগ্যতর রূপে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। সে কাজে নির্ধারিত টেক্সটবুক হলো পবিত্র কুর’আন। কিন্তু বাংলাদেশে ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থায় সে পবিত্র কুর’আনে কোন স্থান নাই। শিক্ষার অঙ্গণে ব্যর্থতার মূল কারণ এখানেই। এবং শিক্ষার অঙ্গণে এ ব্যর্থতার কারণে সীমাহীন ব্যর্থতা ও বিপর্যয় নেমে এসেছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত ও সংস্কৃতির অঙ্গণে।
প্রস্তর যুগের আদিম মানুষটির সাথে আধুনিক মানুষের যে পার্থক্য সেটি দৈহিক নয়, বরং শিক্ষাগত। শিক্ষার কারণেই ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এবং জাতিতে জাতিতে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। তবে শিক্ষার পাশে প্রতি সমাজে প্রচণ্ড কুশিক্ষাও আছে। কুশিক্ষার কারণেই ধর্মের নামে অধর্ম, নীতির নামে দুর্নীতি এবং আচারের নামে অনাচার বেঁচে আছে। এবং সংস্কৃতির নামে বেঁচে আছে আদিম অপসংস্কৃতি। সুশিক্ষার কারণে মানুষ যেমন সঠিক পথ পায়, তেমনি কুশিক্ষার কারণে পথভ্রষ্ট বা জাহান্নামমুখি হয়। আজকের মুসলিমদের ভয়ানক ব্যর্থতাটি কৃষি, শিল্পে বা বাণিজ্যে নয়, বরং সেটি শিক্ষায়। শিক্ষাক্ষেত্রে এ থেকেই জন্ম নিয়েছে অন্যান্য নানাবিধ ব্যর্থতা। ভূলিয়ে দিয়েছে মানব-সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যটি। বহুলাংশে বিলুপ্ত করেছে আখেরাতে ভয়। ফলে মুসলিম ব্যর্থ হচ্ছে তার উপর অর্পিত খেলাফতের দায়িত্ব পালনে। অনেকেই ফিরে গিছে প্রাক-ইসলামিক যুগের জাহিলিয়াতে। ফলে আল্লাহর সৈনিকের বদলে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেড়ে উঠছে শয়তানের সৈনিক রূপে। মুসলিম ভূমিতে মহান আল্লাহর শরিয়তী বিধানের আজ যেরূপ বিলুপ্তি এবং জেঁকে বসেছে যেরূপ কুফরি আইন –তার মূল কারণ তো এই শয়তানের সৈনিকেরা। তাদের কারণেই বিলুপ্ত হয়েছে প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গোত্র, বর্ণ, ভাষা ও ভূগোলভিত্তিক বিভক্তির দেয়াল। এবং বেড়েছে মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে শত্রুশক্তিকে মুসলিম ভূমিতে আজ কোন যুদ্ধই নিজেদের লড়তে হচ্ছে না। তাদের পক্ষে সে রক্তাত্ব যুদ্ধটি মুসলিম রূপে পরিচয় দানকারীরাই লড়ে দিচ্ছে। ফলে বেঁচে আছে শরিয়তী আইনের বদলে সাবেক কাফের শাসকদের প্রণীত কুফরী আইন। বেঁচে আছে সূদী অর্থনীতি, সেক্যুলার শিক্ষা, পতিতবৃত্তি, জুয়া এবং সংস্কৃতির নামে অশ্লিলতা। এবং ইসলাম বেঁচে আছে প্রাণহীন ও অঙ্গিকারহীন আনুষ্ঠিকতা রূপে। সংজ্ঞাহীন মুমুর্ষ রোগীর দেহে যেমন মাতম থাকে না, তেমনি মাতম নাই পরাজিত ও বিপর্যস্ত এ মুসলিমদেরও। কোন জাতির জীবনে এরচেয়ে ভয়ানক ব্যর্থতা আর কি হতে পারে?
ঈমান বাঁচাতে সত্যকে জানা ও লাগাতর মেনে চলাটি যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হলো মিথ্যাকে মিথ্যা রূপে জানা এবং সেটি পরিহার করা। নইলে ঈমান বাঁচে না। পানাহার যেমন প্রতিদিনের কাজ, তেমনি প্রতিদিনের কাজ হলো জ্ঞানার্জন। একমাত্র তখনই লাগাতর সমৃদ্ধি আসে জ্ঞানের ভূবনে। মহান নবীজী (সা:) বলেছেন, “সে ব্যক্তির জন্য বড়ই বিপদ, যার জীবনে দুটি দিন অতিবাহিত হলো অথচ তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডারে কোন বৃদ্ধিই ঘটলো না।” তবে সে বিশেষ জ্ঞানটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। এ জ্ঞান থেকেই ঈমান পুষ্টি পায় এবং মু’মিনের মনে প্রবলতর হয় মহান আল্লাহতায়ালার ভয় ও আখেরাতের ভয়। কুর’আন পাঠের সাথে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে মু’মিনের সম্পর্ক এভাবেই নতুন প্রাণ পায়। আত্মায় পুষ্টি জোগানোর সে কাজটি নিয়মিত না হলে দৈহিক ভাবে বেঁচে থাকলেও ব্যক্তির াবেআধ্যাত্মিক মৃত্যু ঘটে। নিয়মিত কুর’আন পাঠের সাথে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায, মাসব্যাপী রোযা, হজ্জ, যাকাত, তাসবিহ পাঠ ও দানখয়রাত –এগুলো হলো মানুষকে আধ্যাত্মিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার অপরিহার্য বিধান।
তবে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং মিথ্যা, অধর্ম ও নানারূপ পাপাচারকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে শয়তানেরও নিজস্ব বিধান ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মদ্যপান, পতিতাবৃত্তি, সূদ, জুয়া, অশ্লিলতা, ব্যাভিচার, পর্ণগ্রাফি, নাচ-গান এগুলো হলো শয়তানের সনাতন বিধান। তবে শয়তানের হাতে সবচেয়ে বৃহৎ ও আধুনিক হাতিয়ার হলো সেক্যুলার রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের পরিচালিত সেক্যুলার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি। এজন্য মুসলিম দেশে যতই বাড়ছে সেক্যুলার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ততই বাড়ছে ইসলাম থেকে মুসলিমদের দূরে সরা। বাড়ছে ডি-ইসলামাইজেশন। বাড়ছে ইসলামী বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদৌলতেই মুসলিম দেশে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, সামন্তবাদ, সেক্যুলারিজম ও পুঁজিবাদের ন্যায় জাহিলিয়াত দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে সরে এসব মানুষ দ্রুত জাহান্নামমুখি হচ্ছে। বাড়ছে সূদ, ঘুষ, অশ্লিলতা, উলঙ্গতা, ব্যাভিচার, হত্যা, গুম ও নানারূপ পাপাচারের সংস্কৃতি।
সবচেয়ে বড় বেঈমানি
মুসলিমদের আজকের বিভ্রান্তি এতোটাই প্রকট যে, পৃথিবীতে তারা যে মহান আল্লাহর খলিফা সে ধারণাটিও অধিকাংশের চেতনা থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। পলায়নপর সৈন্য শুধু রণাঙ্গনই ছাড়ে না, সৈনিকের পোষাক এবং নিজ দলের ঝান্ডাও ছেড়ে দেয়। তেমনি আজকের মুসলিমগণ শুধু হাত থেকে ইসলামের ঝান্ডাই ফেলে দেয়নি, বরং তুলে নিয়েছে জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, রাজতন্ত্র, স্বৈরাচার, পুঁজিবাদ ও সেক্যুলারিজমের ঝান্ডা তুলে নিয়েছে। এভাবে পরিণত হয়েছে শয়তানের সৈনিকে। মুসলিম ভূমিতে আল্লাহর শরিয়তী বিধান প্রতিষ্ঠা রুখতে তাই কোন কাফের সৈনিকদের মুসলিম দেশে নামতে হচ্ছে না, সে কাজটি তারা নিজেরাই করে দিচ্ছে। ফলে আল্লাহর কুর’আনী বিধান আজ প্রায় প্রতি মুসলিম দেশে পরাজিত। মহান আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় বেঈমানি, কুর’আনের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় অবমাননা আর কি হতে পারে?
অথচ “মুসলিম” শব্দটি কোন বংশীয় খেতাব নয়। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো ইসলামের বিপ্লবী বিশ্বাস নিয়ে বাঁচা। এবং সে বিশ্বাসে উৎস্য হলো পবিত্র কুর’আন। কিন্তু সমস্যা হলো সেক্যুলারিস্ট-অধিকৃত দেশগুলোতে ইসলামের সে বিপ্লবী চেতনা নিয়ে বাঁচাটাই অসম্ভব করা হয়েছে। কোন কাফেরের সন্তান যেমন মুসলিম হতে পারে, তেমনি মুসলিমের সন্তানও কট্টোর কাফির হতে পারে। সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি এনেছিল ইসলাম। যুগে যুগে বড় বড় নীতি কথা অনেকে মনিষীই বলেছেন, কিন্তু তারা সেগুলি প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। কারণ তাদের হাতে রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু মুসলিমগণই মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিগুলি প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কারণ ইসলামের নবী হযরতর মুহাম্মদ (সা:) শুধু কুর’আনী নীতি কথা শিক্ষা দেননি, সেগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা দেন এবং দশ বছর তিনি সে রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন। সে রাষ্ট্রই পরবর্তীতে বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়। তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তা থেকে গড়ে তুলেছন ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ঈমানদার জনশক্তি। ফলে দাসগণ তখন মুক্তি পেয়েছে, সাধারণ মানুষের সাথে নারীগণও অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শরিয়তী আইনের পূণ্য শাসন। সাধারণ জনগণ পেয়েছে জানমাল নিয়ে বাঁচার নিরাপত্তা।
ইসলামের যে চেতনাটি বিপ্লব এনেছিল তার ভিত্তিটি হলো মহান আল্লাহ, তাঁর রাসূল, কুর’আন ও আখেরাতের উপর অটল বিশ্বাস। তবে মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু বিশ্বাসী হওয়া নয়, বরং সে বিশ্বাসকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিষ্ঠাবান সৈনিক হওয়াও। তাই মুসলিম তাঁর বিশ্বাসকে কখনোই চেতনায় বন্দী রাখে না; বরং কর্ম, আচরণ, রাজনীতি¸ অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও যুদ্ধবিগ্রহসহ সকল ক্ষেত্রে সে বিশ্বাসের প্রকাশও ঘটায়। তাঁর বিশ্বাস ও কর্মে থাকে এক সামগ্রীক রাষ্ট্র বিপ্লবের সুর। ১৪ শত বছর পূর্বে নবীজী (সা:) এবং তাঁর অনুসারি প্রতিটি মুসলিম সে বিশ্বাস নিয়ে নিজ নিজ ভূমিকা রেখেছিলেন। নিজেদের বিশ্বাস ও ধর্মকর্মকে তাঁরা নিজ ঘর ও মসজিদে সীমিত রাখেননি, বরং বিপ্লব এনেছিলেন সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। কোন গাছই পাথর খন্ড ও আগাছার জঞ্জালে গজায় না। গজালেও বেড়ে উঠে না। সে জন্য উর্বর ও জঞ্জালমুক্ত জমি চাই। গাছের বেড়ে উঠার জন্য নিয়মিত পরিচর্যাও চাই। রাষ্ট্র তো সে কাজটি করে মানব সন্তানের ঈমান ও নেক আমল নিয়ে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে। মানব শিশুর পরিচর্যার সে কাজটি করে শিক্ষা। নবীজী (সা:) তেমন একটি রাষ্ট্র গড়া এবং সে রাষ্ট্রের বুকে জনগণকে শিক্ষা দেয়ার কাজকে পবিত্র জিহাদে পরিণত করেন। সর্বকালের মুসলিমদের জন্য আজও সেটিই অনুকরণীয় আদর্শ। এবং সে আদর্শের অনুসরণের মধ্যেই দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ। অন্যথায় যেটি ঘটে সেটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে অবাধ্যতা। তাতে অনিবার্য হয় জাহান্নামের আযাব।
শিক্ষাদান, শিক্ষালয় ও শিক্ষার মাধ্যম হলো মানব-সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম আবিস্কার। মানব-সংস্কৃতির এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার। সে সমাজে শিক্ষা নেই সে সমাজে সংস্কৃতিও নাই। শিক্ষার বলেই মানুষ পশু থেকে ভিন্নতর হয়। চেতনা, চরিত্র ও কর্মে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যে বিপুল তারতম্য দেখা যায় সেটিও শিক্ষা ভেদে। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব। জানতে পারে এ জীবনে বাঁচার মূল লক্ষ্য এবং সে লক্ষ্যে পৌঁছার সঠিক পথ। জ্ঞানার্জন ছাড়া তাই ইসলাম নিয়ে বাঁচা যায় না। শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভের কাজ তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ ইবাদতের ব্যর্থতায় ব্যক্তির অন্যান্য ইবাদতেও ভয়ানক অপূর্ণতা ও সমস্যা দেখা দেয়। তখন ব্যর্থতায় পূর্ণ হয় সমগ্র জীবন –সেটি যেমন ইহকালে তেমনি আখেরাতে। শিক্ষাদানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাই মানব সমাজে দ্বিতীয়টি নেই। নবীরাসূলদের এটিই শ্রেষ্ঠতম সূন্নত।
মানুষ কতটা মানবিক গুণের মানুষ হবে এবং কতটা বেড়ে উঠবে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে -তা নির্ভর করে জ্ঞানার্জন কতটা সঠিক ভাবে পালিত হলো তার উপর। ইসলামের পরাজিত দশা, মুসলিমদের পথভ্রষ্টতা এবং সমাজে পাপাচারের জয়জয়াকার দেখে এ কথা নিশ্চিত বলা যায় যে, মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানার্জনের কাজটি সঠিক ভাবে হয়নি। এটিই হলো মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। অন্যান্য ব্যর্থতা হলো তার শাখা-প্রশাখা মাত্র। মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়লেও ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে সেগুলো সফলতা দেখাতে পারিনি। ফল দাঁড়িয়েছে, যে ইসলাম নিয়ে আজকের মুসলিমদের ধর্মকর্ম ও বসবাস -তা নবীজী (সা:)’র আমলের ইসলাম থেকে ভিন্নতর। নবীজী (সা:)’র ইসলামে ইসলামী রাষ্ট্র ছিল, সে রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্টা ছিল, দ্বীনের প্রচার ছিল, নানা ভাষাভাষী মুসলিমের মাঝে অটুট ভাতৃত্ব ছিল এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লাগাতর জিহাদও ছিল। কিন্তু আজ সেগুলো শুধু কিতাবেই রয়ে গেছে। ফলে বিজয় এবং গৌরবের পথ থেকে তারা বহু দূরে সরেছে। বরং দ্রুত ধেয়ে চলেছে অধঃপতনের দিকে। পরাজয়, আযাব এবং অপমান ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। সেনানিবাসে দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে যে ব্যক্তি সৈনিকের বদলে শত্রুর বন্ধু ও গাদ্দার হয়, তবে বুঝতে প্রশিক্ষণে প্রচণ্ড ব্যর্থতা আছে। তেমনি বছরের পর বছর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় কাটিয়ে কেউ যদি ঈমানদার হওয়ার বদলে মিথ্যাবাদী, ব্যভিচারী, ঘুষখোর, মদখোর, চোরডাকাত, ভোটডাকাত, সন্ত্রাসী, জাতীয়তাবাদী, সেক্যুলারিস্ট ও ইসলামের শত্রু হয় -তবে বুঝতে হবে প্রচণ্ড ব্যর্থতা রয়েছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়।
সেক্যুলারিজমের বিপদ
সেক্যুলারিজম সর্বার্থেই প্রচণ্ড ইসলাম বিরোধী একটি মতবাদ। সেটি যেমন তত্ত্বে ও বিশ্বাসে, তেমনি রাজনৈতিক এজেন্ডায়। মুসলিম শুধু দুনিয়ার কল্যাণ নিয়ে ভাবে না, বরং বেশী ভাবে আখেরাতের কল্যাণ নিয়ে। কারণ দুনিয়ার জীবনটি অতি ক্ষুদ্র; কিন্তু আখেরাত মৃত্যুহীন তথা অন্তহীন। অথচ সেক্যুলারিস্টদের চেতনায় আখেরাতের গুরুত্ব নাই। ফলে তা নিয়ে ভাবনাও নাই। তাদের প্রায়োরিটি পার্থিব জীবনে সফল হওয়া নিয়ে। আখেরাতের ভাবনা নিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার-আচার, সংস্কৃতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহকে তারা পশ্চাদপদতা, কূপমণ্ডূকতা ও সাম্প্রদায়িকতা ভাবে। সেক্যুলারিস্টদের সাথে ঈমানদারদের মূল দ্বন্দটি এখানেই। জান্নাত লাভের চিন্তায় মুসলিমকে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুম পালনে একান্ত অনুগত ও নিষ্ঠাবান হতে হয়। কারণ, তাঁর চেতনায় সর্বক্ষণ কাজ করে কোনরূপ অবাধ্যতায় জাহান্নামে পৌঁছার ভয়। এজন্যই ঈমানদারের জীবনে ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লব ও রাষ্ট্রে শরিয়তের প্রতিষ্ঠার কাজে লেগে থাকাটি কোন নেশা বা পেশা নয়; বরং সেটি জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন মাত্র। এটি তাঁর নিজের, নিজ সন্তানের ও আপনজনদের জন্য ঈমান ও নেক আমল নিয়ে বাঁচার নিরাপদ পরিবেশ নির্মাণের লড়াই। এ কাজে কোনরূপ আপোষ বা অবহেলার সামান্যতম সুযোগও নাই। কারণ সে কাজের হুকুম এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। কোন ঈমানদার কি সে হুকুম অমান্য করতে পারে? অমান্য করলে কি ঈমান থাকে? কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের জীবনে সে ভয় নাই, সে ভাবনাও নেই। তাই আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনে তাদের মাঝে কোন আগ্রহও নেই। ফলে নামে মুসলিম হলেও সেক্যুলারিস্টদের মনে ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের মিশন নেই। বরং তাদের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির লক্ষ্য হলো, সে জান্নাতমুখি মিশনে মুসলিমদেরকে অমনযোগী করা এবং সে সাথে সে পথ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরানো। একাজে তাদের মূল হাতিয়ারটি হলো সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার মাধ্যমেই তারা মানুষের চেতনার রাজ্যে হামলা করে, ভূলিয়ে দেয় আখেরাতের ভয় এবং ইসলামের মূল মিশন ও ভিশনটি। ইহকালীন সুখ-সমৃদ্ধি বাড়াতে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ একমাত্র তাতেই তারা আগ্রহ বাড়ায়। মনের ভূবনে এভাবেই তারা দুনিয়ামুখি পরিবর্তন আনে। আর সে দুনিয়ামুখিতাই হলো সেক্যুলারিজম। সেক্যুলারিজমের মূল বিপদটি এখানেই। নাস্তিকতা, মুর্তিপূজা ও শাপ-শকুন পূজার চেয়ে এর নাশকতা তাই কোন অংশেই কম নয়। জনগণের ক্ষতি শুধু চোর-ডাকাত, খুনি, ধর্ষক ও দুর্বৃত্তদের হাতে হয় না, বরং সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতিটি হয় সেক্যুলারিস্টদের হাতে।
তবে এরূপ দুনিয়ামুখীতা মানব ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। সেক্যুলারিজম কোন আধুনিক মতবাদ নয়। বরং মুর্তিপূজার মত সনাতম জাহিলিয়াতের ন্যায় এটিও অতি সনাতন ব্যাধি। একই রোগ বাসা বেঁধেছিল প্রাক-ইসলামিক আরব পৌত্তলিকদের মনেও। তারা যে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতো, তা নয়। তারা বরং নিজ সন্তানের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুর রাহমানও রাখতো। ক্বাবা যে আল্লাহর ঘর সেটিও তারা বিশ্বাস করতো। বরং এ কথাও বিশ্বাস করতো, ক্বাবা ঘরটি নির্মাণ করেছিলেন হযরত ইব্রাহীম (আ:), এবং তাঁকে সহায়তা দিয়েছিলেন পুত্র ইসমাঈল (আ:)। কিন্তু তারা বিশ্বাস করতো না পরকালে। জান্নাত ও জাহান্নামের কোন ধারণা তাদের মনে ছিল না। মৃত্যুর পর আবার জীবিত হবে -সে ধারণা তাদের ছিল না। ফলে পরকালের জবাবদেহীতার ভাবনাও ছিল না। আখেরাতের ভয় ব্যক্তির জীবনে পাপরোধে লাগামের কাজ করে, কিন্তু সে ভয় না থাকায় তারা পাপাচারে লিপ্ত হতো কোনরূপ ভয়ভীতি ছাড়াই। ফলে তৎকালীন আরবভূমি নিমজ্জিত হয়েছিল পাপাচারে। সেক্যুলারিস্টগণ আজও একই রূপ পাপের প্লাবন আনছে দেশে দেশে। তাদের কুকীর্তির বড় স্বাক্ষর হলো আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যেভাবে এ শতাব্দীর শুরুতে দুনীর্তিতে বিশ্ব ৫ বার পর পর প্রথম হওয়ার রেকর্ড করলো তা কোন মোল্লা-মৌলবীর কাজ ছিল না। গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, তাঁতীর কাজও ছিল না। বরং সেটি অর্জিত হয়েছিল আখেরাতের ভয়শূন্য সেক্যুলারিস্ট দুর্বৃত্তদের হাতে –যাদের হাতে অধিকৃত দেশের শিক্ষা, আইন-আদালত, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও রাজনীতি।
বিপ্লব চেতনার মডেলে
আরবদের আর্থসামাজিক পশ্চাদপদতা নিয়ে ইসলামের শেষনবী (সা:) কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা বানাননি। তাদেরকে তিনি অর্থনৈতিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিও দেননি। নবী (সা:)’র এজেন্ডা ছিল তাদেরকে জান্নাতের উপযোগী রূপে গড়ে তোলা। লক্ষ্য ছিল, উচ্চতর মানবিক গুণে সমৃদ্ধ মানব বানানোর। সে লক্ষ্যে তিনি বিপ্লব এনেছিলেন তাদের চেতনা রাজ্যে। কারণ, চেতনা ও বিশ্বাসই হলো চরিত্র ও কর্মের নিয়ন্ত্রক। নবীজী (সা:)’র সে বিপ্লবটি ছিল ১৮০ ডিগ্রির। চেতনায় আখেরাতে বিশ্বাস ও মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে জবাবদেহীতার ধারণাটি তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ভাল কাজের প্রতিদান আছে এবং খারাপ কাজের শাস্তি আছে, মৃত্যুর পর জান্নাত ও জাহান্নাম আছে এবং সেখানে মৃত্যুহীন অনন্ত জীবন আছে -সে বিষয়গুলো তিনি তাদের মনে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এতেই শুরু হয় ধর্মকর্মের সাথে তাদের চিন্তা-চরিত্র, কর্ম, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতায় আমূল বিপ্লব। মনজগতের এরূপ বিপ্লবকেই বলা হয় প্যারাডাইম শিফ্ট। যে কোন সমাজ বিপ্লবের এ হলো পূর্বশর্ত। নবদীক্ষিত এ মানুষগুলো পরিণত হন নবীজী (সা:)’র একান্ত অনুগত সাহাবায়। তাদের হাতেই শুরু হয় সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে মহাবিপ্লব। দুনিয়ার এ জীবনকে তাঁরা গ্রহণ করেন পরীক্ষা ক্ষেত্র রূপে এবং সে সাথে আখেরাতে পুরস্কার বৃদ্ধির ক্ষেত্র রূপে। তাদের জীবনে বাঁচা-মরা ও লড়াই-সংগ্রামের একমাত্র লক্ষ্য হয় আল্লাহকে খুশি করা। ফলে মিশন হয়, সর্বপ্রকার পাপ থেকে বাঁচা এবং প্রতিটি মুহুর্তকে নেক আমলে ব্যয় করা। শুরু হয় আল্লাহর মাগফেরাত লাগে প্রচণ্ড তাড়াহুড়া –যেমনটি বলা হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। সুরা আল-ইমরানের ১৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তোমরা তাহাহুড়া তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে মাগফেরাত লাভের জন্য এবং সে জান্নাতের জন্য যার বিস্তার আসমান ও জমিনের ন্যায় যা প্রস্তুত করা হয়েছে মুত্তাকীনদের জন্য।” সুরা হাদীদের ২১ নম্বর আয়াতে মাগফেরাত লাভ এবং জান্নাত লাভের জন্য মু’মিনদের প্রতিযোগিতার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে প্রতিযোগিতা ও তাড়াহুড়ায় সে যুগের মুসলিমগণ নিজেদের সময়, সম্পদ, শক্তি এমনকি প্রাণের কোরবানী পেশেও কৃপণতা করেনি। ফলে আখেরাতমুখি সে তাড়াহুড়ায় দ্রুত নির্মিত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতা। সমগ্র মানব ইতিহাসে মানবতা নিয়ে অতি দ্রুত উপরে উঠার সেটিই হলো সর্বোচ্চ রেকর্ড।
মুসলিমের মূল পরিচয়টি হলো, সে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা প্রতিনিধি। ঈমানের প্রকাশ ঘটে মূলত সে পরিচিতি নিয়ে বাঁচাতে। শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভের মূল উদ্দেশ্য হলো খলিফার সে দায়িত্বপালনে নিজেকে যোগ্যবান করে গড়ে তোলা। এজন্যই মুসলিম ও অমুসলিমের শিক্ষাগত প্রয়োজনটা কখনোই এক নয়। মুসলিম ও অমুসলিম একই আলো-বাতাসে শারীরিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারে, কিন্তু একই শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠতে পারে না। কারণ, যে শিক্ষায় বেঈমান তার চেতনায় পুষ্টি পায়, মুসলিম তা পায় না। বরং বেঈমানের শিক্ষার যা সামগ্রী তাতে মৃত্যু ঘটে ঈমানী চেতনার। তাই নিজেদের গৌরব কালে মুসলিমগণ নিজ সন্তানদের শিক্ষাদানের দায়ভার কখনই কাফেরদের হাতে দেয়নি। কাফেরদের থেকে চাল-ডাল ও আলু-পটল কেনা যায়, কিন্তু শিক্ষা নয়। শিক্ষা ধর্মান্তরের বা সাংস্কৃতিক কনভার্শনের অতি শক্তিশালী হাতিয়ার। এখানে কাজ করে শয়তানের ফাঁদ। এজন্যই ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠার জন্য মুসলিমদের জন্য আলাদা হয়ে ইসলামী রাষ্ট্র গড়া, সমাজ গড়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এতোটা অপরিহার্য। তেমন একটি প্রয়োজনেই ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমগণ পাকিস্তান নামে একটি পৃথক রাষ্ট্রর জন্ম দেয়।
কাফেরগণ মুসলিম দেশে মিশনারি স্কুল-কলেজ চালায় জনসেবার খাতিরে নয়। বরং সেটি মুসলিম শিশুদের ধর্মান্তর করতে। এবং ধর্মান্তর সম্ভব না হলে মনযোগ দেয় মুসলিম সন্তানদের মাঝে সাংস্কৃতিক কনভার্শন তথা ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজটি বাড়াতে। কুশিক্ষার পথ ধরেই ছাত্রদের মগজে কুফরি ঢুকে। শিক্ষাদানের নামে কুশিক্ষাটি তাই শয়তানের প্রধান হাতিয়ার। তাই মুসলিমদের শুধু হারাম পানাহারে সতর্ক হলে চলে না, হারাম শিক্ষা থেকেও অতি সতর্ক হতে হয়। কিন্তু সেক্যুলারিজম সে হারাম শিক্ষাকেই মুসলিম দেশগুলোতে সহজ লভ্য করেছে; এবং অতি কঠিন করেছে পবিত্র কুর’আন থেকে শিক্ষা লাভ। ইংরাজী ভাষা শেখানো গুরুত্ব পেলেও গুরুত্ব পায়নি পবিত্র কুর’আনের ভাষা। বুঝতে হবে বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে নাস্তিক, সূদখোর, মদখোর, ঘুষখোর, ব্যাভিচারী, ধর্ষক, চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, স্বৈরাচারী, সন্ত্রাসী ইত্যাদী দুর্বৃত্তগণ বনজঙ্গলে গড়ে উঠেনি, গড়ে উঠেছে দেশের সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে।
শিক্ষা যেভাবে বিপর্যয় আনে
ইসলামের জয়-পরাজয়ের যুদ্ধটি শুধু রণাঙ্গণে হয় না, সেটি হয় শিক্ষাঙ্গণেও। এটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের জায়গা। মুসলিমদের পরাজয়ের শুরু মূলত তখন থেকেই যখন তারা বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদে ইস্তাফা দিয়েছে। এবং শিক্ষার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিজ দায়িত্বে না রেখে কাফের, ফাসেক ও সেক্যুলারিস্টদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। যখন আলেমদের কাছে গুরুত্ব হারায় শিক্ষাদানের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই ভেঙ্গে গেছে মুসলিমদের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র উসমানিয়া খেলাফত। অথচ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান শুধু মসজিদ বা মাদ্রাসা নয়, সেটি হলো খেলাফার রাজনৈতিক কাঠামো। এটিই হলো ইসলাম ও মুসলিমদের সুরক্ষা দেয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এটি বিলুপ্ত হলে বিপন্ন হয় মুসলিমদের ইজ্জত, আবরু, ঈমান-আমল, জানমাল ও স্বাধীনতা।
মসজিদ বা মাদ্রাসা গড়তে অর্থ ও শ্রম ব্যয় হলেও তাতে রক্ত ব্যয় হয় না। অথচ রাষ্ট্রের ভূগোল এক মাইল বাড়াতে হলে প্রকাণ্ড যুদ্ধ লড়তে হয়। বহু লক্ষ মুসলিম সৈনিকের রক্ত ব্যয়ে নির্মিত উসমানিয়া খেলাফতের বিশাল রাষ্ট্রটি শত শত বছর ধরে মুসলিমদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু ও ধর্মীয় বিশ্বাসের হেফাজত করেছে। বিশাল সে উসমানিয়া খেলাফতে তুর্কী, আরব, কুর্দি, মুর, আলবানিয়ান, কসোভান, বসনিয়ানগণ শত শত বছর একত্রে শান্তিতে বসবাস করেছে। ভাষাগত, বর্ণগত ও আঞ্চলিকতার বিভেদ ইউরোপকে শত বছরের যুদ্ধ ও যুদ্ধ শেষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্তি উপহার দিলেও উসমানিয়া খেলাফতে তেমন দুর্যোগ দেখা দেয়নি। ভাষাগত, বর্ণগত ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ হলো মূলত ইউরোপীয় জাহিলিয়াত। সে জাহিলিয়াতের ভাইরাস থেকে মুসলিম ভূমি শত শত বছর মূক্ত ছিল। আলেমদের মাঝে নানা বিষয়ে মতভেদ তাকলেও জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও আঞ্চলিকতা যে হারাম -তা নিয়ে কোন কালেই কোন বিরোধ ছিল না। ইসলামে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার আছে, কিন্তু ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে যুদ্ধ, বিভক্তি ও দেশভাঙ্গার অনুমতি নেই। রাষ্ট্রের সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র মহান আল্লাহর, সে রাষ্ট্রের শাসক মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা প্রতিনিধি মাত্র। তাই মুসলিম রাষ্ট্রের খণ্ডিত করার যে কোন উদ্যোগই মূলত আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধের শাস্তিও তাই অতি কঠোর। তাই উমাইয়া, আব্বাসী ও উসমানিয়া খেলাফতে শতবার খলিফার বদল হলেও তার ভৌগলিক অখণ্ডতা বেঁচেছিল হাজার বছরের অধিক কাল। সৈন্যরা লড়েছে সীমান্তের ওপারে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে, কিন্তু দেশের ভিতরে ভূগোলের অখণ্ডতা বাঁচাতে যুদ্ধ করতে হয়েছে সামান্যই। কিন্তু বিদ্যাশিক্ষার নামে তুর্কি, আরব, কুর্দিগণ যখন ইউরোপে পা রাখে তখন থেকেই তারা বিভক্তির ভাইরাস নিয়ে দেশে ফিরাও শুরু করে। তখন অসম্ভব হয়ে উঠে তুর্কি, আরব, কুর্দি এরূপ নানা ভাষাভাষী মুসলিমদের পক্ষে এক রাষ্ট্রে বসবাস করা। শুরু হয় ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ফলে মুসলিমদের পরাজিত করতে শত্রুদের যুদ্ধ করতে হয়নি, সে যুদ্ধগুলো এসব জাতীয়তাবাদীরাই লড়ে দিয়েছে। এবং এখনও লড়ছে। এদের কারণেই খেলাফত ভেঙ্গে জন্ম নিয়েছে বিশের বেশী রাষ্ট্র। এবং বিভক্তির পরপরই জন্ম নেয়া নতুন রাষ্ট্রগুলি অধিকৃত হয়েছে ব্রিটিশ, ফরাসী, মার্কিনী ও ইসরাইলীদের হাতে। অথচ খেলাফতভূক্ত থাকার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমগণ ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রেহাই পেয়েছিল। অথচ খিলাফত বা বিশাল কোন মুসলিম রাষ্ট্রের বাইরে থাকার কারণে সে সৌভাগ্য বাংলাদেশীদের জুটেনি। ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ইংরেজদের হাতে গোলাম হয় ১৯১৭ সালে। অথচ তার ১৬০ বছর আগেই বাংলা ব্রিটিশের গোলাম হয়েছে। ভূগোলে ক্ষুদ্রতর হওয়ার এটি হলো বিপদ। আরব মুসলিমদের বিপদের শুরু তো উসমানিয়া খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর। পরিতাপের বিষয় হলো, খেলাফতের নেয়ামত তারা খেলাফত বেঁচে থাকতে বুঝেনি এবং রক্ষার চেষ্টাও করেনি।
সেক্যুলারিস্টদের অপরাধ
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় পরাজয়টি রণাঙ্গণে হয়নি। সেটি হয়েছে শিক্ষার ময়দানে। ইসলাম সর্বপ্রথম তার দখলদারি হারিয়েছে মুসলিমদের চেতনার ভূমিতে, ভূগোলের উপর দখলদারিটি হারিয়েছে অনেক পরে। এবং সেটি ঘটেছে শিক্ষাব্যবস্থার সেক্যুলারাইজেশনের কারণে। সেক্যুলারিজমের মূল লক্ষ্য হলো, শিক্ষা, সমাজ, আইন-আদালত ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রগুলিতে ইসলামের ভূমিকাকে প্রতিহত করা। সেক্যুলারিস্টদের হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে বন্দীদশা নেমে আসে ঈমানদারদের উপর। অসম্ভব করা হয় পূর্ণ ইসলাম পালন। তখন রাষ্ট্রের সন্ত্রাস ও যুদ্ধটি শুরু হয় ধর্মের বিরুদ্ধে। শরিয়তের প্রতিষ্ঠার ন্যায় ইসলামের অতি মৌলিক ও ফরজ কাজটিও তখন শাস্তি যোগ্য অপরাধ গণ্য হয়। বাংলাদেশের ন্যায় সেরূপ পবিত্র উদ্যোগকে সন্ত্রাস বলা হচ্ছে। ফলে সেক্যুলারিজমকে ধর্মনিরেপক্ষতা বলে জাহির করাটি নিছক প্রতারণা মাত্র। অথচ মুসলিম দেশগুলিতে সে প্রতারণাটিই চলছে লাগামহীন ভাবে। এবং সে প্রতারকদের রুখবার কেউ নাই।
মানব কল্যাণে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হয় শিক্ষার অঙ্গণে। শিক্ষার মাধ্যমেই ইসলাম মহান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর পবিত্র মিশনের সাথে মানব সন্তানদের পরিচিতি ঘটায়। এবং সংশ্লিষ্ট করে সে মিশনের সাথে। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে ঈমানদার তৈরীর কারখানাই বন্ধ হয়ে যায়। তখন পূর্ণ ইসলাম পালন ও রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে ইসলামকে বিজয়ী করার সৈনিক থাকে না। তখন মহান আল্লাহতায়ালার মানব কল্যাণের মূল প্রজেক্টই ব্যর্থ হয়ে যায়। তখন ব্যর্থ হয়ে যায় নবী প্রেরণ ও পবিত্র কুর’আন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য। তাই শয়তান ও তার অনুসারীদের মূল হামলাটি মুসলিমদের ক্ষেত-খামারে হয় না, সেটি হয় শিক্ষার অঙ্গণে। সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে অপরাধটি এখানেই। তাদের অপরাধটি মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে।
জনগণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনায় ইসলামের প্রবেশ রুখতে তাদের মনকে ইম্যুনাইজড করছে ঈমান বিনাশী দুষ্ট ধ্যানধারণার ভ্যাকসিন দিয়ে। সে কাজে তারা ব্যবহার করে মিডিয়ার সাথে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে। সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রদের মনে ইসলামী ধ্যানধারণার প্রবেশ এজন্যই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের মত দেশে যতই বাড়ছে সেক্যুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মানুষ ততই ইসলাম থেকে দূরে সরছে। ফলে মুসলিমদের রাজস্বের অর্থে বিপুল সংখ্যায় ইসলামের শত্রু উৎপাদিত হচ্ছে। এবং এভাবে বাড়িয়ে চলেছে ইসলামের পরাজয়। জনগণ এভাবে নিজেদের পাপের পাল্লা ভারী করছে। দেশের শিক্ষানীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তাই দেশবাসীর বিপর্যয় বাড়াচ্ছে শুধু পার্থিব জীবনে নয়, আখেরাতেও। লন্ডন, ১ম সংস্করণ ০৫/০৬/২০১২; দ্বিতীয় সংস্করণ ০৩/০৯/২০২১।
ANNOUNCEMENT
ওয়েব সাইটটি এখন আপডেট করা হচ্ছে। আগের লেখাগুলো নতুন ওয়েব সাইটে পুরাপুরি আনতে কয়েকদিন সময় নিবে। ধন্যবাদ।
LATEST ARTICLES
- বাঙালি মুসলিমের সংকটের শুরু কিরূপে?
- রাজনীতিতে কবিরা গুনাহ ও দুর্বৃত্তকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর আযাব
- আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার
- নবীজী (সা:)’র সফল রাজনীতি এবং আজকের মুসলিমদের ব্যর্থ রাজনীতি
- মুসলিম দেশে বিজয় শয়তানের এবং পরাজয় নবীজী (সা:)’র ইসলামের
বাংলা বিভাগ
ENGLISH ARTICLES
RECENT COMMENTS
- Fazlul Aziz on The Israeli Crimes, the Western Complicity and the Muslims’ Silence
- Fazlul Aziz on India: A Huge Israel in South Asia
- Fazlul Aziz on ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণ এবং অনৈসালিমক রাষ্ট্রের অকল্যাণ
- Fazlul Aziz on বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ
- Fazlul Aziz on Gaza: A Showcase of West-led War Crimes and the Ethnic Cleansing
ARCHIVES
- December 2024
- October 2024
- September 2024
- August 2024
- July 2024
- June 2024
- May 2024
- April 2024
- March 2024
- February 2024
- January 2024
- December 2023
- November 2023
- October 2023
- September 2023
- August 2023
- July 2023
- June 2023
- May 2023
- April 2023
- March 2023
- January 2023
- December 2022
- November 2022
- October 2022
- September 2022
- August 2022
- July 2022
- June 2022
- May 2022
- April 2022
- March 2022
- February 2022
- January 2022
- November 2021
- October 2021
- September 2021
- August 2021
- July 2021
- June 2021
- May 2021
- April 2021
- March 2021
- February 2021
- January 2021
- December 2020
- November 2020
- October 2020
- April 2020
- March 2020
- February 2020
- January 2020
- December 2019
- November 2019
- October 2019
- September 2019
- August 2019
- July 2019
- June 2019
- May 2019
- April 2019
- March 2019
- February 2019
- January 2019
- December 2018
- November 2018
Assalam….
Thank you very much for the article. May Allah reward you.
Anwar H. Joarder