রমজানে মুসলিমের ব্যর্থতা ও সফলতার অডিট

ফিরোজ মাহবুব কামাল

কোথায় নিজ জীবনের অডিট?

রমজান শেষ হতে চললো। আজ লন্ডনে ২৯তম রোজ। আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ। কোটি কোটি মানুষ রোজা রাখছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কি অর্জিত হলো এ রোজায়? রমজানের মূল লক্ষ্যটি হলো ঈমানদারের তাকওয়া বৃদ্ধি। পবিত্র কুরআনে রোজার মূল লক্ষ্য রূপে মহান আল্লাহ সেটিই বলেছেন। তাকওয়া’র অর্থ আল্লাহর ভয়। এ ভয় মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে রোজ হাশরের বিচার দিনে জবাবদেহীতার লাগাতর ভয়। তাকওয়া হলো আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে ছিটকে পড়ার ভয়। এ ভয় অনন্ত কালের জন্য জাহান্নামের যাত্রী হওয়ার। কারো মনে যখন সে ভয় সৃষ্টি হয় তখন তার জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আল্লাহর দ্বীনের আনুগত্য বাড়ে। তার জীবনে তখন বিপ্লব আসে। তখন সে ব্যক্তি প্রতিটি হারাম ও অবাধ্যতা থেকে বাঁচে। তাকওয়া থেকেই জন্ম নেয় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য নিয়ে বাঁচার সার্বক্ষণিক আগ্রহ।

ব্যবসায় নামলে সফল ব্যবসায়ী প্রতিদিন তার ব্যবসার হিসাব কষে। লাভ-লোকসান খতিয়ে দেখে। দক্ষ ম্যানেজার কোন অফিস খুললে সে ব্যক্তিও অফিসের কাজকর্মের নিয়মিত হিসাব নেয়। সে হিসাবের কাজকে বলা হয় অডিট। দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচতে হলে এরূপ অডিট নিয়মিত করতে হয়। নইলে ব্যর্থতা ধরা পড়ে না। মু’মিনের জীবনেও সেরূপ অডিটি নিয়মিত থাকতে হয়। বার বার হিসাব নিতে হয়, তার ইবাদত থেকে কাক্ষিত লক্ষ্যটি অর্জিত হচ্ছে কিনা? হযরত উমর রা: তাই যথার্থই বলেছেন, আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দেয়ার আগে নিজেই হিসাব নিজেই নাও। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মুসলিম জীবনে কোথায় সে হিসাব-নিকাশ বা অডিট?

ইসলামের মূল লক্ষ্য ও মুসলিমের ব্যর্থতা

ইসলাম স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত প্রতিষ্ঠার জন্য নাযিল হয়নি। কি জন্য নাযিল হয়েছে সে বর্ণনাটি দিয়েছেন খোদ মহান আল্লহাতায়ালা নিজে। তাই পবিত্র কুর’আনে তিনবার ঘোষিত হয়েছে তাঁর নিজের সেই বয়ান। সেটি হলো: “লি’ইয়ুযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি।” এর অর্থ সকল ধর্ম ও সকল মতাদর্শের উপর ইসলামের বিজয়।

এ কাজটি দোয়া-দরুদের নয়, স্রেফ নামাজ-রোজাতেও হওয়ার নয়। এজন্য লড়াই চাই। এবং সে লড়াইয়ে সৈনিক চাই। কারণ, শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ের কাজে জিহাদ অনিবার্য। কারণ দখলদার দুর্বৃত্তগণ বিনা যুদ্ধে তাদের দখলদারী ছাড়েনা। কুর’আনী জ্ঞান, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতের মূল উদ্দেশ্য মুসলিমদের অনুগত সৈনিক রূপে গড়ে তোলা –যেমনটি হয়েছিল নবীজী সা:’এর আমলে। নামাজ-রোজার ন্যায় প্রতিটি ইবাদতের মূল লক্ষ্য হলো, তাকওয়া সৃষ্টি। তাকওয়া বাড়লেই মুসলিম জীবনে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সৃষ্টি হয়। মুসলিম তখন তাঁর সৈনিকে পরিণত হয়। সেটি না হলে বুঝতে হবে ইবাদত ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে কোথায় সে সৈনিক? মুসলিম জীবনে কোথায় সে সৈনিক-স্বরূপ আনুগত্য? কোথায় আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ? অথচ এ জিহাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, জিহাদ না থাকাটি মুনাফিকী রূপে চিত্রিত হয়েছে। সে নবীজী সা:’র সে কথাটি বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফের হাদীসে।

বাংলাদেশের মত দেশের আদালত, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা সর্বত্র জুড়েই মহান আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বিশ্বে ১৫০ কোটি মুসলিম। কিন্তু সর্বত্র ইসলামের পরাজয়। বেড়েছে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসা ও নামাজী-রোজাদারদের সংখ্যা। আদালত চলে মহান আল্লাহর শরীয়তী আইনের বদলে কুফরি আইন। সে আইনে সূদ এবং বেশ্যাবৃদ্ধি সিদ্ধ পেশা। রাজনীতিতে নাই আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার। শিক্ষা ব্যবস্থায় নাই কুরআন, হাদীস ও নবী-চরিত বোঝার আয়োজন। পোশাক-পরিচ্ছদে চলছে বেপর্দাগী। অর্থনীতিতে চলছে সূদ। ‌জনগণ রাজস্ব দিয়ে এবং সে রাজস্বের অর্থে পুলিশ লাগিয়ে পাহারা দেয়আ হয় বেশ্যাবৃত্তির ন্যায় ব্যাভিচারকে। এই কি তাকওয়ার নমুনা? হৃদয়ে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান ও তাকওয়া থাকলে মহান আল্লাহর দ্বীনের এই পরাজয় কি কেউ মেনে নিত? মেনে নিত কি কাফেরদের প্রণীত আইনের বিজয়?

যেখানে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বুঝতে হবে সেখানে তাকওয়া‌র ভান্ডারটি শূন্য। যেখানেই কুর’আনের অবাধ্যতা, বুঝতে হবে সেখানেই কুফরি বা মুনাফেকি। ‌অথচ অবাধ্যতা নিয়েই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর রাজনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত ও শিক্ষা-সংস্কৃতি। অতএব এক মাস রোজা রেখে কোথায় অর্জিত হলো সেই তাকওয়া।

ব্যর্থতা রমজানে

 বছর ঘুরে মুসলিম জীবনে বারবার মাহে রমজান আসছে। কিন্তু রমজানের কারণে মুসলিমগণ কি আদৌ আল্লাহর ভয় অর্জন করছে? যে রাষ্ট্রে জনগণের জীবনে তাকওয়া সৃষ্টি হয় সে রাষ্ট্রে বিজয় আসে আল্লাহর আইন শরিয়তের। তখন নির্মূল হয় গুম খুন ধর্ষণ, ভোট ডাকাতি, চুরি ডাকাতি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি। তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে না বলেই বাংলাদেশের বুক থেকে পাপাচারের প্লাবন কমছে না। এর অর্থ, ব্যর্থ হচ্ছে রোজা। প্রশ্ন হলো, এ নিদারুণ ব্যর্থতা নিয়ে মুসলিমদের মাঝে সেই আত্মসমালোচনাযাই বা কি?

তাকওয়ার ভান্ডার শূন্য হলে সেখানে বিজয় বাড়ে শয়তানের। এমন দেশে ইসলামের প্রতিষ্ঠার জিহাদ চিত্রিত হয় সন্ত্রাস রূপে। বাংলাদেশের ন্যায় তো সেটিই হয়েছে। কোটি কোটি মুসলিমের রোজা কি তাই ব্যর্থ হচ্ছে না? এই ব্যর্থতা নিয়েই আবার মহা ধুমধামে ঈদের মহা খুশি উদযাপিত হতে যাচ্ছে। ঈদের খুশির বিধান তো রমজানের বিশাল বিজয় বা অর্জন নিয়ে। কিন্তু ব্যর্থতা নিয়ে কি খুশি করা সাজে? মুসলিমগণ ধর্মের নামে এরূপ আত্মপ্রবঞ্চনা বা ধোকাবাজী আর কত কাল করবে? এভাবে নিজেকে ধোকা দেয়া যায়, কিন্তু সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালাকেও কি ধোঁকা দেয়া যায়? ৩০.০৪.২০২২

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *