সেক্যুলারিস্টদের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ এবং যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে

ফিরোজ মাহবুব কামাল

ধর্মনিরপেক্ষতার হারাম ধারণা

প্রতিটি জনপদে থাকে নানা গন্তব্যে পৌঁছার নানা পথ। সঠিক গন্তব্যে পৌঁছার লক্ষ্যে অবশ্যই সঠিক পথটিকে বেছে নিতে হয়। এখানে আপোষ চলে না। এক সাথে দুই পথে চলা যায় না। তেমনি প্রতি দেশে থাকে নানা ধর্ম। বেছে নিতে হয় সঠিক ধর্মকে। এখানেও আপোষ চলে না। এক সাথে দুই ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া যায় না। মিথ্যা ধর্ম ও মিথ্যা মতাদর্শের নানা রূপ থাকে। থাকে নানা বয়ান। সময়ের তালে ও দেশ ভেদে মিথ্যা তার রূপ পাল্টায়। তাই বাংলার মন্দিরে হিন্দুদের যেসব দেব-দেবীর মূর্তি দেখা যায়, সেসব দেব-দেবীর মূর্তি রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের মন্দিরে নাই। সেখানে দেব-দেবী যেমন ভিন্ন, পূজার আচারও ভিন্ন। কিন্তু সত্যের রূপ মাত্র একটিই। সে শাশ্বত সত্যের বাণী নিয়ে একমাত্র সত্য ধর্মটি হলো ইসলাম। এই ধর্মেরই প্রথম নবী ছিলেন হযরত আদম (আ:) এবং সর্বশেষ নবী হলেন হযরত মহম্মদ (সা:)। তাদের মাঝে এক ও অভিন্ন সত্যের পয়গাম নিয়ে এসেছেন লক্ষাধিক নবী-রাসূল। প্রতি যুগে একমাত্র এই ইসলামই দেখিয়েছে জান্নাতের সঠিক পথ; সে পথটিই হলো পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত সিরাতাল মুস্তাকীম।

আলো ও আঁধারের মাঝামাঝি কিছু নাই। হয় আলো থাকবে, না হয় আঁধার থাকবে। তেমনি সত্য ও মিথ্যার মাঝামাঝি নিরপেক্ষ বলেও কিছু নাই। সত্যের পক্ষ নেয়ার মধ্যেই সততা। এবং মিথ্যার পক্ষ নেয়ার মধ্যেই পাপ ও দুর্বৃত্তি। তেমনি একটি ধর্মকে সত্য ধর্ম রূপে বিশ্বাস করলে অন্য ধর্মকে অবশ্যই মিথ্যা বলে মেনে নিতে হয়। এবং সেটি মেনে নেয়ার মধ্যেই ঈমানদারী। চরম বেঈমানী হলো মিথ্যাকে সত্যের সমকক্ষতা দেয়া। এ জন্যই ঈমানদারের জন্য অসম্ভব হয় সত্য ধর্ম ও মিথ্যা ধর্মের মাঝে নিরপেক্ষ থাকা। মিথ্যা ধর্মের পক্ষ নেয়া যেমন গুরুতর অধর্ম বা পাপ, তেমনি পরম অধর্ম বা পাপ হলো সত্য ও মিথ্যা ধর্মের মাঝে ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নেয়া। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পড়িয়ে হাজির করা হয় সেক্যুলারিস্টদের। এবং সেক্যুলারিজমকে পেশ করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা বলে। এটি সত্যের সাথে নিরেট গাদ্দারী।

প্রতিটি দুর্বৃ্ত্তিই পাপ। এবং সে পাপের নির্মূলে কোন কিছু না করাই মহাপাপ। তাতে সমাজ পাপে ভরে উঠে এবং বসবাসের অযোগ্য হয়। পাপী ও তার পাপের সামনে তাই নিরপেক্ষ সাজা যায় না। তেমনি অধর্মের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করাই পরম অধর্ম। তখন দেশ অধর্ম কর্মে ভরে উঠে এবং বাসের অযোগ্য হয়। ঈমানদারকে এজন্যই সকল পাপ ও সকল অর্ধের নির্মূলে আমৃত্যু জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ জনকল্যাণমূলক কর্ম। এবং ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। তাই প্রশ্ন হলো, প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার নামে অধর্মকে সহ্য করে কী করে? তাতে কি ঈমান বাঁচে? অধর্ম বা মিথ্যা ধর্মের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহতায়ালার বয়ান অতি সুস্পষ্ট। টি

ঈমানদার হওয়ার শর্তই হলো, ইসলামই যে সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একমাত্র নির্ধারিত ধর্ম -সে সত্যকে মনেপ্রাণে মেনে নেয়া এবং তার উপর অটল থাকা। কোন রূপ সন্দেহ পোষণ করার অর্থই হলো বেঈমানী। এবং অটল বিশ্বাস থাকতে হয় এ নিয়েও যে, পবিত্র কুর’আনই হলো জান্নাতে পৌঁছার একমাত্র রোডম্যাপ। প্রতিটি দেশের প্রতিটি জনপদের মানুষের সামনে এই কুর’আনী রোডম্যাপের প্রতিষ্ঠাই হলো মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় কল্যাণ কর্ম। অর্থদান, গৃহদান বা চিকিৎসাদান নয়, বরং সর্বশ্রেষ্ঠ এ কল্যাণ কর্মটিই মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচায়। তবে কাজ স্রেফ ওয়াজ-নসিহত ও দোয়াদরুদে হয়। বরঙ এটিই হলো পৃথিবীপৃষ্ঠে সবচেয়ে অধিক ব্যয়বহুল। এ রোডের প্রতিষ্ঠা দিতে নির্মূল করতে সকল দুর্বৃত্ত শক্তির ।  শুধু ওয়াজ-নসিহত নয়, একাজটি অর্থ, শ্রম, মেধা ও জানের বিপুল কুর’বানী চায়। একমাত্র এ কাজের মধ্যেই মানুষ শহীদ হয় এবং সরাসরি জান্নাতে যায়। নবীজী (সা:)’র অর্ধেকের বেশি সাহাবা এ কাজে শহীদ হয়ে গেছেন। অথচ ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের কাছে ধর্মের পক্ষে সক্রিয় হওয়াটাই সাম্প্রদায়িকতা। অনেকের কাছে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস রূপে গণ্য হয়। প্রশ্ন হলো, যুদ্ধ নিয়ে বাঁচলেই কেউ যদি জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হয়, তবে তো সবচেয়ে বেশি শুধু মার্কিনীদের জীবনে। তাদের যুদ্ধের কোন শেষ নাই। কখনো কোরিয়া, কখনো ভিয়েতনাম, কখনো আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া। এবং এগুলি নিজ দেশের সীমান্ত থেকে বহু হাজার মাইল দূরের অন্য মহাদেশে। ফলে এ মার্কিনীদের কি বলা যাবে? তাছাড়া  যুদ্ধ তো নবীজী (সা:) ও সাহাবাদের জীবনেও যুদ্ধ ছিল। তাদেরকে তবে কী বলা যাবে?  বস্তুত সেক্যুলারিস্টদের অবস্থান ও যুদ্বটি মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে। এজন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামে চরম অধর্ম। এটি হারাম। ইসলামের মূল এজেন্ডার বিরূদ্ধে এটি এক ঘৃণ্য শয়তানী ষড়যন্ত্র। তবে ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের অস্ত্রখানি রণাঙ্গণের কাফেরের অস্ত্রের ন্যায় কোষমুক্ত নয়, এর নাশকতা ছদ্দাবরণে।

ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আঙ্গণে যতটা প্রতারণা হয়েছে, ততটা বিশ্লেষণ হয়নি এর মূল এজেন্ডা নিয়ে। ফলে প্রকাশ পায়টি এর ইসলামবিনাশী এজেন্ডা ও ষড়যন্ত্র। এ কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতার নাম নিয়ে বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টগণ বিপুল সংখ্যক মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। প্রপাগান্ডার জোরে যে বহু অখাদ্য, কুখাদ্য ও বাজে বিষয়ও বাজার পেতে পারে –বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার বাণিজ্য হলো তারই উদাহরণ। একজন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা নাস্তিক রাজনীতিতে নীতিহীন, পক্ষহীন ও নিষ্ক্রিয় হতে পারে। কারণ এতে তারা ধর্মচ্যুৎ হয় না। কারণ, তাদের ধর্মে রাষ্ট্র নির্মাণ ও শরিয়তী আইন-আদালতের বিধান নাই। এসব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাগণ বা নেতাগণ রাষ্ট্র  নির্মাণ করেছেন, রাষ্ট্র নির্মাণে যুদ্ধ করেছেন এবং তারা নিজেরা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন -তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই। ফলে তাদের অনুসারীগণ কেন রাষ্ট্র নির্মাণে যুদ্ধ করবে? কেনই বা অর্থ ও রক্ত ব্যয় করবে? এক্ষেত্রে তারা স্বাধীন। ইসলামে যেমন শরিয়তী আইন রয়েছে, এসব ধর্মে সেরূপ কোন আইনও নাই। রাষ্ট্রের উপর তাদের উপাস্য ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কথা তারা বলে না। ফলে তারা নিজেরা যেমন ইচ্ছামত আইন বানাতে পারে। তেমনি রাষ্ট্রের উপর নিজেদের সার্বভৌমত্বও প্রতিষ্ঠা দিতে পারে।

এসব ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান ও ইতিহাস অন্যান্য ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। হযরত মহম্মদ (সা:) নিজে রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন এবং ১০টি বছর সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন। ইসলাম নিয়ে বাঁচতে হলে নবী-জীবনের সে ইতিহাস চেতনায় ধারণ করে বাঁচতে হবে। মুসলিম হওয়ার শর্ত হলো, তাকে শুধু মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম মানলে চলে না, অবশ্যই মানতে হয় তাঁর রাসূলের গুরুত্বপূর্ণ সূন্নতগুলিকেও। নবীজী (সা:) কোন কিছুই নিজের খেয়াল-খুশি মত করতেনা না। তিনি তাই করতেন, যে বিষয়ে তিনি মহান আল্লাহতায়ালা থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হতেন। অতএব নবীজী (সা:)’র সূন্নত অনুসরণের মধ্যেই মহান আল্লাহতায়ালার অনুসরণ। সে ঘোষণাটি এসেছে সুরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, “মাই ইউ’তিয়ীর’রাসূলা ফাক্বাদ আতায়াল্লাহা।” অর্থ: যে অনুসরণ করলো রাসূলকে, সেই অনুসরণ করলো আল্লাহকে। তাই নবীজী (সা:)’র অবাধ্যতার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার অবাধ্যতা। সে অবাধ্যতা ব্যক্তিকে কাফের বানায়। এবং নবীজী (সা:)’র অনুসরণের অর্থ ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ ও তাঁর রাজনীতির সূন্নতকেও পুরোপুরি অনুসরণ করা।

 

সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত এবং সবচেয়ে ভয়ংকর পাপ

মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি কৃষিকাজ, পশুপালন, গৃহ নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, কলকারখানা নির্মাণ, শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্য নয়। এগুলো অসভ্য ও নৃশংস দুর্বৃত্তরাও করতে পারে। বরং সেটি হলো সভ্য মানব, সভ্য সমাজ ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণ; এবং সে রাষ্ট্রে সকল প্রকার দুর্বৃত্তির নির্মূল ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা। সে লক্ষ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ হলো উন্নত আইন ও ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা। এখানেই ধরা পড়ে একটি জাতি কতটা সভ্য বা অসভ্য -সেটি। এমন রাষ্ট্রের নির্মাণ কখনো দৈবাৎ ঘটে না। এর জন্য জন্য প্রয়োজন শুধু দেশবাসীর অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ নয়, বরং ব্যক্তির প্রতিটি সামর্থ্যের। ইসলামে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। ইসলামে এটি জিহাদ। কারণ এখানে অর্থ, মেধা, শ্রম রক্তসহ সকল সামর্থ্যের লাগাতর বিনিয়োগ ঘটে। এই কাজটি সবচেয়ে সুন্দর ভাবে সমাধা দিতে পেরেছিলেন নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাগণ। ফলে মুসলিমগণ সেদিন হতে পেরেছিল সে আমলের সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তি। এবং তাদের হাতে নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। এটিই হলো, মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম।  অন্য কোন নবী বা রাসূলের দ্বারা সেটি কখনোই ঘটেনি। তাই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। কোটি কোটি মানুষ নামাজ-রোজা পালন করতে পারে। কিন্তু তারা পুরাপুরি ব্যর্থ হতে পারে সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণে। ফলে বরং চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, ধর্ষণ, অর্থপাচার ও সন্ত্রাসের ন্যায় নানারূপ দুর্বৃত্তির কাজে রাষ্ট্র ভয়ানক অপরাধীদের হাতে হাতিয়ারে রূপে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমনটি হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। তাই মানব সভ্যতার সবচেয়ে জঘন্য পাপটি চুরি-ডাকাতি ও গুম-খুন নয়, সেটি হলো সভ্যতর রাষ্ট্র নির্মাণের পথকে বাধাগ্রস্ত করা। সেক্যুলারিস্টগণ সে পাপের দিকে মানুষকে টানে। এটিই হলো শয়তানের শিবিরের মূল মিশন এবং সর্বনিকৃষ্ট পাপকর্ম। অপরাধ এখানে মানবকে নিয়ে মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে ব্যর্থ করে দেয়ার। এবং সে সাথে রাষ্ট্রকে জাহান্নামের বাহনে পরিণত করার।

এজন্যই নবীজী (সা:)’র সর্বশ্রেষ্ঠ সূন্নতটি নফল নামাজ, নফল রোজা, দাড়ি রাখা, মানুষকে সালাম দেয়া বা পথের কাঁটা সরানো নয়। বরং সেটি হলো, শয়তান ও তার অনুসারীদের এজেন্ডাকে ব্যর্থ করা এবং মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করা। সেটি ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ, রাষ্ট্রের আদালতে শরিয়ত প্রতিষ্ঠা এবং সে রাষ্ট্রের সুরক্ষায় লাগাতর জিহাদে লিপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। মুসলিমদের দ্বারা সে কাজটি না হলে খোদ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও বিজয়ী হয় ইসলামের শত্রুপক্ষ তথা শয়তানের অনুসারীরা। বাংলাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশে তো সেটিই হয়েছে। অথচ নবীজী (সা:) এ পবিত্র কাজে রণাঙ্গণে আহত হয়েছেন এবং অর্ধেকের বেশি সাহাবা শহীদ হয়েছেন। নবীজী (সা:)’র ইন্তেকালের পর সাহাবাগণ তাঁর সে সূন্নতকে পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন। নবীজী (সা:)’র অন্য সকল সূন্নতের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক সূন্নতকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদার মধ্য দিয়ে। নবীজী (সা:)’র সে সূন্নতকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার দায়িত্ব তো প্রতি যুগের প্রতিটি মুসলিমের।

পবিত্র কুর‌’আনের ঘোষণা, “যারা নবীজী (সা:)কে অনুসরণ করে তারাই অনুসরণ করে আল্লাহকে।” -(সুরা নিসা, আয়াত ৮০)। এবং যারা বাঁচে সে অনুসরণ, নিয়ে তারাই চলে সিরাতাল মুস্তাকীমে। তাই নবীজী (সা:)‌’র সূন্নত থেকে বিচ্যুৎ হওয়ার অর্থ সিরাতাল মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত হওয়া। বিদ্রোহ এখানে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে। বিদ্রোহের পথ তো শয়তানের পথ। সে পথ জাহান্নামের। মুসলিম বিশ্ব আজ বিদ্রোহে ভরপর। বিদ্রোহ এখান আল্লাহতায়ালার হুকুম ও নবীজী (সা:)‌’র সূন্নতের বিরুদ্ধে। সে বিদ্রোহেরই নমুনা হলো, বেঁচে নাই ইসলামী রাষ্ট্র, আদালতে নাই শরিয়তী আইন, স্কুল-কলেজে নাই কুর’আনী জ্ঞানের চর্চা, নাই প্যান-ইসলামিক মুসলিম ভাতৃত্ব এবং নাই দুর্বৃত্ত নির্মূল ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। এরপরও কি বিশ্বাস করা যায়, মুসলিমগণ চলছে সিরাতাল মুস্তাকীম বেয়ে? ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এরূপ নিষ্ক্রিয় থেকে শয়তানের সেক্যুলারিস্ট ও পৌত্তলিক সৈনিকদের খুশি করা যায়। কিন্তু তা দিয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালা খুশি করা যায়?

পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মানুষের পরিচয় হলো, সে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা তথা প্রতিনিধি। খলিফা বা প্রতিনিধির সার্বভৌম হওয়ার অধিকার থাকে না। সেটি তার জন্য হারাম। এখানেই ইসলামের “রেড লাইন”। এ “রেড লাইন” অতিক্রম করার অর্থ ইসলামের রশিকে গলা থেকে ছুঁড়ে ফেলা। অথচ বাঙালি মুসলিমগণ সে রেড লাইন বহু আগেই অতিক্রম করেছে। তারা দেশের শাসনতন্ত্রে নিজেদের সার্বভৌম রূপে ঘোষণা দিয়েছেন। এটি হলো সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বাঙালি মুসলিমদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। সার্বভৌম হওয়ার অধিকার একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। মানুষ নিজে আইন বানাবে না, বরং মেনে চলবে একমাত্র মহান আল্লাহতয়ালার আইন। আদালতের বিচার-আচার করবে শরিয়তী আইন অনুযায়ী। খোলাফায়ে রাশেদার আমলে সাহাবাগণ তো সে ভাবেই বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন। যে বিষয়ে শরিয়তের আইন রয়েছে, সে বিষয়ে আইন রচনা করা হারাম। বাংলাদেশের এই শাসনতন্ত্র ইসলামপন্থীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। কারণ, কোন দলকে আইনগত বৈধতা পেতে হলে শাসনতন্ত্রের এই হারাম বিধির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান আছে এমন কেউ কি সেটি করতে পারে?

এ পৃথিবীপৃষ্টে ঈমানদারের ভূমিকাটি বিশাল। সে কখনোই কোন রাষ্ট্রের নীরব ও নিষ্ক্রিয় প্রজা নয়। বরং সে হলো বিশ্বজাহানের মালিক মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দায়প্রাপ্ত খলিফা। তাঁর খলিফা রূপে ইসলামী রাষ্ট্রের সক্রিয় নির্মাতা ও রক্ষক হওয়াই তার মূল দায়িত্ব। সে শুধু রাষ্ট্রের বুকে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতিষ্ঠা দেয়ার জিহাদে অংশ নেয় না, বরং সে রাষ্ট্রের সুরক্ষাও নিজের মেধা, শ্রম, অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগ করে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যয় হয়েছে ইসলামের এ শিক্ষাটি হাতে-কলমে শেখাতে।

পবিত্র কুর’আনে হক্ক তথা সত্যের প্রতিষ্ঠা এবং বাতিল তথা মিথ্যার নির্মূলের হুকুম বার বার এসেছে। কিন্তু একটি বারও ধর্ম প্রসঙ্গে নিরপেক্ষ থাকার হুকুম আসেনি। বরং মুসলিম জীবনের যাত্রা শুরু হয় ইসলামের পক্ষ নেয়ার মধ্য দিয়েই। সেটি হক্কের পক্ষে এবং মিথ্যার বিপক্ষে। তাই ইসলাম ও অনৈসলাম এবং ধর্ম ও অধর্মের মাঝে নিরপেক্ষ থাকা একজন মুসলিমের পক্ষে অসম্ভব। মৃতদের কোন পক্ষ থাকে না, তেমনি থাকে না ঈমানহীন বেঈমানদেরও।  মৃত্যুটি এখানে ঈমানের।

 

ষড়যন্ত্রটি ইসলামকে শক্তিহীন করায়

ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের যুক্তি, রাষ্ট্রে ইসলামের প্রতিষ্ঠা দিলে অন্য ধর্মের স্বার্থহানী হয় ও সে ধর্মের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব হয়। কিন্তু সে যুক্তি একজন মুসলিম মেনে নেয় কি করে? ইসলাম এসেছে মিথ্যা ধর্মের জাহিলিয়াত সরিয়ে কুর’আনী সত্যের প্রতিষ্ঠা দিতে। আবর্জনার সাথে নিরপেক্ষতা চলে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশের নির্মাণে আবর্জনার নির্মূলে আপোষহীন হতে হয়। একই রূপ নীতি মিথ্যা ধর্ম ও মিথ্যা মতাদর্শের ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নাই। মিথ্যার নির্মূলে আপোষহীন হওয়া এজন্যই ঈমানদার হওয়ার শর্ত। নইলে বেঈমানী হয় সত্যের সাথে। সেরূপ আপোষহীনতা না থাকলে নবীজী (সা:) কি ক্বাবার ভিতর থেকে মূর্তিগুলিকে সরাতে পারতেন? পৌত্তলিকতার নির্মূলে আপোষহীন না হলে ৩৬০টি মূর্তি এবং মূর্তিপূজা বেঁচে থাকতো ক্বাবার মধ্যে। বিষয়টি অবিকল অভিন্ন শরিয়তকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার ক্ষেত্রেও। প্রতিটি ঈমানদারের দায়বদ্ধতাটি এখানে খোদ মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি। অন্য ধর্মের অনুসারীদের খুশি করতে গিয়ে কোন ঈমানদারই তাঁর মা’বুদের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়ভার পালনে সামান্যতম অবহেলা দেখাতে পারে না। দায়িত্ব পালনে অবহেলা ব্যক্তিকে মুনাফিক বানায়। মুসলিম মাত্রই খলিফা মহান আল্লাহতায়ালার; তাই তাকে প্রতি মুহুর্ত বাঁচতে হয় খেলাফতের দায়িত্বপালন নিয়ে। সে দায়িত্বপালনে অবহেলার শাস্তি জাহান্নামের আগুন। তখন কোন অমুসলিমই তার কোন কাজে আসবে না।

অন্ধকার বিলুপ্ত হবে –এ যুক্তি দেখিয়ে কি কখনো অন্ধকার বাঁচিয়ে রাখা এবং আলো জ্বালানোর কাজে বাধা সৃষ্টি করা যায়? এটি তো অন্ধকারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। তাই অন্য ধর্মের স্বার্থহানী হবে -এই যুক্তিতে কি ইসলামের প্রতিষ্ঠার কাজে সামান্যতম অবহেলা দেখানো যায়?  এটি কি নিরপেক্ষতা? এটি সত্যের পক্ষ ছেড়ে অসত্যের পক্ষ নেয়া। ধর্মনিরপেক্ষবাদীগণ সেটিই করছে। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্মগুলি কোন ধর্মই নয়। এগুলি নিরেট মিথ্যাচার। পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতয়ালার ঘোষণা: “ইন্না দ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম।” অর্থ: আল্লাহর কাছে একমাত্র ধর্ম হলো ইসলাম। ধর্মীয় বিধানে নানা রূপ মিথ্যা যোগ করার কারণে খৃষ্টান ধর্ম ও ইহুদী ধর্মের অনুসারীগণ আহলে কিতাব হওয়া সত্ত্বেও সত্যের উপর বেঁচে নাই। তারা পথভ্রষ্টদের দলে।

রাষ্ট্রের অঙ্গণ থেকে ইসলামকে দূরে রাখার স্বার্থে তারা এ কথাও বলে, সাড়ে চৌদ্দ শত বছর পূর্বে ইসলামের যেরূপ প্রতিষ্ঠা দেয়া সম্ভব হয়েছিল, এখন সেটি সম্ভব নয়। তাদের যুক্তি, সময় অনেক সামনে এগিয়েছে, রাষ্ট্রকে নতুন ভাবে গড়তে হবে। এ যুক্তি সেক্যুলারিস্টদের। মুসলিমদের কাছে এ যুক্তির কোন মূল্য নাই। মুসলিম নির্দেশনা নেয় একমাত্র কুর’আন ও হাদীস থেকে। কুর’আন-হাদীসের কোথাও কি বলা আছে যে, সাড়ে চৌদ্দ শত বছর পর ইসলামের বিধানগুলি অচল? অনুমতি দেয় কি শরিয়ত বাদ দিয়ে অন্য আইন অনুসরণের। তাছাড়া সময়ের তালে সত্য কখনোই মিথ্যা হয় না এবং মিথ্যা কখনোই সত্যে পরিণত হয় না। নবীজী (সা:)‌র পর সাড়ে চৌদ্দশত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এতো দীর্ঘকাল পরও চুরি-ডাকাতি, সূদ, ঘুষ, জ্বিনা, ধর্ষন, হত্যার ন্যায় অপরাধগুলিও নেক কর্মে পরিনত হয়নি। সেগুলি আজও অপরাধ রূপেই গণ্য হচ্ছে। ফলে সে অপরাধগুলির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানগুলিই বা অচল হবে কেন? মহান আল্লাহতায়ালার বিধান মেনে যদি আজও চন্দ্র-সূর্য, দিবা-রাত্র ও জোয়ার-ভাটা চলতে পারে, তবে মানবের জীবন ও রাষ্ট্র কেন তাঁর বিধান অনুযায়ী চলতে পারে না?

ধর্মনিরপেক্ষবাদীগণ নিজেদের পক্ষে পবিত্র কুর’আনের আয়াত “লাকুম দ্বীনাকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” পেশ করে। অর্থ: তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম। লক্ষণীয় হলো, এ আয়াতে নিরপেক্ষতার কথা নাই, বরং আছে নিজ ধর্মে অটল থাকার কথা। বলা হয়েছে, “আমাদের জন্য আমাদের দ্বীন।” অর্থাৎ দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে আপোষের বা নিরপেক্ষতার স্থান নাই। দ্বীন বা ধর্ম বলতে ইসলাম যা পেশ করে সেটি শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত নয়। বরং সে দ্বীনপালনের মধ্যে রয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ, কুর’আন-হাদীস শিক্ষা, শরিয়তী আইনের বিচার, দুবৃত্তির নির্মূলে জিহাদ, শুরা ভিত্তিক শাসন এবং প্যান-ইসলামিক মুসলিম ঐক্য।

“লা ইকরাহা ফিদ্দীন” অর্থাৎ ধর্মে জবরদস্তি নাই। ধর্মনিরপেক্ষবাদীগণ নিজেদের পক্ষে পবিত্র কুর’আনের এ আয়াতটিও পেশ করে। এই আয়াতে ইসলামের প্রচারে শক্তির প্রয়োগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু নিজ জীবনে দ্বীনের হুকুম পালনে শিথিল বা আপোষমুখী হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। বরং পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে “উদখুলু ফিস সিলমি কা’ফফা” অর্থ: ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি দাখিল হয়ে যাও। এখানে হুকুম হলো, পূর্ণ মুসলিম হওয়ার। পূর্ণ মুসলিম কি ভাবে হতে হয় সেটি নবীজী (সা:) দেখিয়ে গেছেন। পূর্ণ মুসলিম হতে হলে শুধু কালেমা পাঠ, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করলে চলে না। স্রেফ মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করলেও চলেনা। পূর্ণ ইসলাম পালনের যে চিত্রটি নবীজী (সা:) স্থাপন করে গেছেন সেভাবে ইসলাম পালন করতে হয়। তখন ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়তী আদালত, দুর্বৃত্তির নির্মূল, সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, শুরা ভিত্তিক শাসন, মুসলিম ঐক্য এবং  জিহাদও এসে যায়। প্রশ্ন হলো, এর কোন একটিকে বাদ দিয়ে কি পূর্ণ ইসলাম পালন হয়? পূর্ণ ইসলাম পালন ছাড়া কি কখনো পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হওয়া যায়? আজকের মুসলিমদের মূল সমস্যা তো এখানেই। তারা ব্যর্থ হচ্ছে পূর্ণ ইসলাম পালনে। সেক্যুলারিস্টগণও সেটিই চায়।

 

যুদ্ধটি ইসলামের মূল এজেন্ডার বিরুদ্ধে

ইসলামের মিশনটি যেমন বিশাল, তেমনি বিপ্লবীও। মিশনটি সমগ্র বিশ্ববাসীকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসার। মিশন যেমন জান্নাতের উপযোগী মানুষ গড়ার, তেমনি সে কাজে সহায়ক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার। মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো: ইসলামের সে মিশনকে নিয়ে বাঁচার। জান্নাতের উপযোগী সে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রগড়ার কাজটি কখনোই কোন জঙ্গলে বা জনশূণ্য স্থানে হয় না। ইসলাম সেকাজে একটি পদ্ধতিরও প্রতিষ্ঠা দেয়। সেটিই হলো পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত সিরাতাল মুস্তাকীম। তাই প্রতিটি মুসলিমকে অবশ্যই বাঁচতে হয় সে পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জিহাদের ন্যায় ইবাদত বস্তুত সেটিরই অংশ। কীভাবে সে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের সে জিহাদ নিয়ে বাঁচতে হয় – নবীজী (সা:) সেটিই হাতে-কলমে শিখিয়ে গেছেন। সে জিহাদের মধ্য দিয়েই ইসলামের বিজয় এসেছে এবং মুসলিমগণ বেড়ে উঠেছে বিশ্বশক্তি রূপে।

সফলতা যেহেতু একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার হাতে, ঈমানদার তাই সফলতার পুরস্কার নিয়ে ভাবে না। বরং ভাবে নিজের বাঁচাটি কতটা তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার নিয়েত ও জিহাদ নিয়ে হলো –তা নিয়ে। আখেরাতে পুরস্কার পাবে সে নিয়েত ও জিহাদ নিয়ে বাঁচার কারণে। তাই যারা শুধু নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত এবং তাসবিহ-তাহলিল নিয়ে বাঁচে এবং দূরে থাকে ইসলামকে বিজয়ী করার জিহাদ থেকে, বুঝতে হবে তারা ইসলামের মূল মিশনই বুঝতে পারিনি। মহান নবীজী (সা:) ও সাহাবায়ে কেরামদের জীবন থেকেও তারা তেমন কিছু শিখতে পারিনি। ইসলামের গৌরব যুগে মুসলিমগণ শুধু ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ নারী-পুরুষ, পরিবার ও সমাজই গড়েননি। নির্মাণ করছেন শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী সভ্যতা। এমন কাজে বিরামহীন যুদ্ধ নিয়ে বাঁচাই মুসলিম জীবনের মিশন। এ জন্য চাই সংঘবদ্ধ প্রচেষ্ঠা। গড়ে তুলতে হয় ইসলামের পক্ষে প্রবল একটি লড়াকু পক্ষ। নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় লোকদের দিয়ে কি সেটি সম্ভব? এমন প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতার ছবক দেয়ার অর্থ, ইসলামের পক্ষ থেকে মুসলিমদের দূরে সরানো। ষড়যন্ত্রটি এখানে ইসলামের মূল এজেন্ডাকে ব্যর্থ করে দেয়ার।

মুসলিমদের পতনটি হঠাৎ শুরু হয়নি। পতনের শুরু তখন থেকেই যখন মুসলিমগণ ইসলামের পক্ষ ছেড়ে শত্রু পক্ষে অবস্থান নেয়া শুরু করে। ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার সে কাজটি হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে। ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে সেক্যুলারিস্টগণ নিজেরাই একটি পক্ষ খাড়া করে। সেটিই হলো ইসলামের প্রতিপক্ষ। এদের দেখা গেছে কাফিরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে। নিরপেক্ষ থাকাটি ইসলামে হারাম। ঈমান আনার সাথে সাথে প্রতিটি মুসলিমকে ইসলামের পক্ষ নিতে হয়। ফলে ঈমান আনার সাথে সাথে ব্যক্তির শুধু ধর্মেরই পরিবর্তন হয় না, তারা দলের বা পক্ষেরও পরিবর্তন হয়। মহান আল্লাহতায়ালা চান, প্রতিটি মানুষ অবশ্যই সত্যের পক্ষ নিবে। এবং বীরবিক্রমে খাড়া হবে মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলে। মহান সাহাবাদের জীবনে সেটিই দেখা গেছে।

মানুষের ঈমানের ও বিবেকের পরীক্ষা শুরু হয়, সে কোন পক্ষে দাঁড়ালো বা কার পক্ষে লড়াই করলো -তা থেকে। ব্যক্তির ঈমান তখনই দৃশ্যময় হয়। যেখানেই কোন জনগোষ্ঠি একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দেয়, সেখানেই কিছু লোক বাঁচে মিথ্যা ও দুর্বৃত্তি নিয়ে। ঈমানদার বাঁচবে  সে মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলে জিহাদ নিয়ে। মানব জাতির মাঝে প্রতিদ্বন্দি পক্ষ মাত্র দুটি: একটি সত্যের, অপরটি মিথ্যার। সত্যের পক্ষ মহান আল্লাহতায়ালার, মিথ্যার পক্ষটি শয়তানের। মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিচার হয় সত্যের পক্ষটি বেছে নেয়ার সামর্থ্য দেখে। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে মানব-হত্যা, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ এরূপ অপরাধে লিপ্ত হওয়ার কারণে নয়। বরং সত্যকে চেনা এবং সত্যের পক্ষ নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। যারাই ইসলামের বিপক্ষে, বুঝতে হবে তারাই নিশ্চিত শয়তানের পক্ষ। তাই মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা যেখানে ইসলামের মিশন, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে নিষ্ক্রিয় ও নিরপেক্ষ থাকাটি কখনোই ঈমানদারের নীতি হতে পারে না।

 

সেক্যলারিজমের সৃষ্ট মহাবিপদ          

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ধর্ম প্রসঙ্গে নিরপেক্ষ থাকার কথা বললেও তারা আদৌ নিরপেক্ষ নয়। বরং বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষপাতদুষ্টতা অতি প্রকট। তারা যুদ্ধবাজ। তাদের যুদ্ধটি সর্বত্রই ইসলামের বিরুদ্ধে। তুরস্ক, মিশর, তিউনিসিয়া, বাংলাদেশসহ যেখানেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ক্ষমতায় গেছে. সেখানেই তারা যুদ্ধ শুরু করেছে ইসলামপন্থীদের নির্মূলে। তুরস্ক, মিশর, তিউনিসিয়ার ন্যায় দেশে তারা মদকে পানির ন্যায় অবাধ করেছে। হিজাবকে নিষিদ্ধ করেছে। এ দেশগুলি প্রণয়ন করেছে শরিয়ত বিরোধী আইন। তিউনিসিয়ার হাবিব বারগুইবা’র সরকার উত্তরাধিকার সম্পত্তির বন্টনে পুত্র ও কন্যার মাঝে সমান অংশের নীতি চালু করে। পুরুষের একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ করে। অশ্লিলতাকে সংস্কৃতি রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছে মূর্তি নির্মাণের পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে। তুরস্কের রাস্তা ঘাটে তাই কামাল পাশার মূর্তির ছড়াছড়ি। নিষিদ্ধ করেছে আরবীতে আযান। শত শত মাদ্রাসাকে বন্ধ করে দিয়েছে। এই সেক্যুলারিস্টগণই বাংলাদেশে শেখ মুজিবের অসংখ্য মূর্তি গড়েছে। শত শত আলেমকে তারা নির্যাতন-কেন্দ্রে বন্দী করেছে। নিয়ন্ত্রিত করছে পবিত্র কুর’আনের তাফসির। এভাবে ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের প্রবল অবস্থান যেখানে পৌত্তলিকতার পক্ষে এবং ইসলামের মৌল শিক্ষার বিরুদ্ধে, সেখানে তাদের নিরপেক্ষতা কোথায়?

বাংলাদেশী ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের পক্ষপাতদুষ্টতা ধরা পড়ে তাদের বিদেশ নীতিতেও। কোন মুসলিম দেশের সাথেই তাদের এতো বন্ধুত্ব নাই -যেমনটি দেখা যায় হিন্দুত্ববাদী ভারতের সাথে। লক্ষণীয় হলো, বাংলাদেশে যারা সেক্যুলারিস্ট তাদের অধিকাংশই ভারতপন্থী। তথাকথিত এ ধর্মনিরপেক্ষবাদীগণ পৃথিবীর যে কোন দেশের বিরুদ্ধে সমালোচনা সহ্য করতে রাজী, কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নয়। ভারতের নিন্দা করলে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের এই সেবাদাসদের হাতে নির্মম ভাবে লাশ হতে হয় -যেমনটি হয়েছে বুয়েটের নিরীহ ছাত্র আবরার ফাহাদ। ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও গণলুট হলেও বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা তার নিন্দা করে না। ভারতের মজলুম মুসলিমদের পক্ষে কথা বলাও তাদের কাছে সাম্প্রদায়িকতা। ভারতের সাথে সম্পর্ককে তারা গুরুত্ব দেয় এবং উপেক্ষা করে মজলুম মুসলিমের আর্তনাদ। বাবরী মসজিদের ন্যায় ঐতিহাসিক মসজিদ যখন ধুলিস্যাৎ করা হলো, তখনও বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা সেটির নিন্দা করেনি। এটি আদৌ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং বিবেকশূন্যতা।

পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান  থেকেই ব্যক্তি তার বিবেকে পুষ্টি পায়। পরিশুদ্ধি পায় চেতনায়। এই কুর’আনী জ্ঞানের সরবরাহ বন্ধ হলে মৃত্যু ঘটে বিবেকের। তখন মৃত বিবেকের মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম এবং সত্য-মিথ্যার মাঝে তারতম্য করার সামর্থ্য হারায়। তখন মূর্তিপূজা, গরুপূজা, লিঙ্গপূজা, যীশুপূজা এবং বৌদ্ধপূজাও ধর্মকর্ম মনে হয়। এজন্যই পবিত্র কুর’আন থেকে মানুষ যতই দূরে সরে ততই সে বিবেকশূন্য ও ধর্মশূন্য হয়। তাই গুরুতর অপরাধটি স্রেফ অর্থাভাব বা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি নয়, বরং সেটি হলো কুর’আনী জ্ঞানের শূন্যতা সৃষ্টি। অথচ সেক্যুলারিস্টগণ সে ভয়ানক অপরাধ কর্মটি করে ইসলাম থেকে দূরে সরানোর মধ্য দিয়ে। দুবৃত্তায়নের এটিই হলো সবচেয়ে সফল প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে। এবং সেটি হচ্ছে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। তাই ভারতের সেক্যুলারিস্টগণ যেমন সেদেশে হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম-নির্মূল প্রকল্প রোধে আগ্রহ দেখায় না, তেমনি অবস্থা বাংলাদেশী সেক্যুলারিস্টদের। এটিই হলো নিহত বিবেকের লক্ষণ। লক্ষণীয় হলো বাংলাদেশে যতই প্রবলতর হচ্ছে সেক্যুলারিজমের জোয়ার, ততই বাড়ছে গুম, খুন, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও স্বৈরাচারের তান্ডব।

অথচ বাংলাদেশের মত যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম সে দেশের মানুষ মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত সিরাতাল মুস্তাকীম অনুসরণ করে গৌরবযুগের মুসলিমদের ন্যায় শান্তি, সমৃদ্ধি, ন্যায়নীতি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস গড়বে -সেটিই তো কাঙ্খিত ছিল।  কিন্তু সেটি হয়নি। কারণ, অতীতে মুসলিমগণ বিজয় ও গৌরব পেয়েছে কুর’আনী রোডম্যাপ তথা সিরাতাল মুস্তাকীম অনুসরণ করে। অথচ আজ সে পথ অনুসরণের বদলে তা থেকে দূরে সরার কাজটিই বেশি হয়েছে। সেটি হয়েছে সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে। তাই মানব ইতিহাসে সেক্যুলারিজম হাজির হয়েছে ভয়ানক রোগ রূপে। এ রোগের নাশকতা কোভিড বা অন্য যে কোন ভয়ানক রোগের মহামারী থেকেও অধিক ভয়ানক। দৈহিক রোগ মানুষকে বিবেকহীন, ঈমানহীন ও ইসলামের শত্রুতে পরিণত করে না। ফলে জাহান্নামেও নেয় না। কিন্তু সে ভয়ানক বিপদ ঘটায় সেক্যুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা। সেক্যুলারিজমের মূল বিপদটি এখানেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *