জিততে হলে প্রথমে বিজয়ী হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে

ফিরোজ মাহবুব কামাল

শুরু বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ থেকে  

রাজনৈতিক অঙ্গণে বিজয়ী হতে হলে প্রথমে বিজয়ী হতে হয় জনগণের চেতনার ভূমিতে।  ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদের শুরুও সব সময় বুদ্ধিবৃত্তির ময়দান থেকে। সেটিই হলো ঈমানদারদের বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। মক্কার কাফিরদের বিরুদ্ধে নবীজী (সা:)’র সশস্ত্র যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল নবুয়ত প্রাপ্তির ১৫ বছর পর, সেটি বদরের প্রাঙ্গণে ৬২৪ খৃষ্টাব্দে। কিন্তু তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের শুরুটি নবুয়তপ্রাপ্তির প্রথম বছর থেকেই।  লড়াইটি এখানে জনগণের চেতনার ভূমিকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে মুক্ত করার। জনগণের চেতনার ভূমি শয়তানী শক্তির হাতে অধিকৃত থাকলে রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ কোন ময়দানেই বিজয়ের সম্ভাবনা থাকে না। বুদ্ধিবৃত্তির এ লড়াইয়ে কুর’আনী জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। যেদেশে জনগণের মাঝে কুর’আনী জ্ঞানার্জনে আগ্রহ নাই এবং কুর’আনী জ্ঞানদানের তেমন কোন আয়োজনও নাই, বুঝতে হবে সে দেশে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। তেমনি যেসব ইসলামী দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে আগ্রহ নাই কুর’আনী জ্ঞানার্জনে এবং আগ্রহ নাই কুর’আনী জ্ঞানের বিস্তারে -বুঝতে হবে তারা ব্যর্থ হতে বাধ্য।  বুঝতে হবে তারা নাই নবীজী (সা:)’র সূন্নতের উপর। এসব তথাকথিত ইসলামী দলগুলি কিছু নেতাকর্মী নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু তাদের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ সফল হওয়ার নয়।

কুর’আনের সুপ্ত শক্তি শয়তানের অজানা নয়। এ জন্যই শয়তানের অনুসারীদের এজেন্ডা হলো, ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মাণ রোধে সর্বস্তরে কুর’আন শিক্ষা বন্ধ করা। এবং সে সাথে জনগণের চেতনার ভূমিতে আদিম জাহিলিয়াতের প্লাবন আনা। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই স্কুল-কলেজের সিলেবাস থেকে বিলুপ্ত করা হয় পবিত্র কুর’আনের তা’লিম। বাংলাদেশে সে অভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পূর্বে সে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছিল তাঁর পিতা শেখ মুজিব। বাংলাদেশে কুর’আনের তাফসির আজ নিয়ন্ত্রিত। এবং কারাবন্দী করা হয় দেশের বিখ্যাত তাফসিরকারকদের। সে সাথে দিন দিন তীব্রতর করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের সনাতন জাহিলিয়াত। রাস্তাঘাটে ও শিক্ষাঙ্গণে গড়া হচ্ছে মুর্তি। বর্ষবরনের নামে করা হচ্ছে মুর্তিমিছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক রণাঙ্গণে ইসলামের বিজয়কে প্রতিহত করার লক্ষ্যে এসবই হলো ইসলামের শত্রুপক্ষের স্ট্র্যাটেজী। এ স্ট্র্যাটেজী সফল হলে, অসম্ভব হয় রাজনৈতিক ও সামরিক অঙ্গণে ইসলামের বিজয়। 

 

গাদ্দারী আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে

মুসলিমদের আজকের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে গাদ্দারী। এরূপ গাদ্দারীর পর যা অনিবার্য প্রাপ্তি তা হলো প্রতিশ্রুত আযাব। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, গাদ্দারী ন্যায় মুসলিম জীবনের এ ভয়াবহ অপরাধ নিয়ে মুসলিমদের মাঝে কোন আলোচনা নাই। সেটি যেমন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বিষয় নয়, তেমনি উলামা, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার বিষয়ও নয়। বরং এরূপ গাদ্দারী নিয়ে বাঁচাই  তাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এটিই হলো মুসলিমদের মাঝে নব্য জাহিলিয়াত। অথচ ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের শুরুটি হতে হয় এ জাহিলিয়াত নির্মূলের মধ্য দিয়ে। কারণ, সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি কখনোই জাহিলিয়াতের মধ্যে অবগাহন করে হয়না।

জাহিলিয়াতের নির্মূলে মূল অস্ত্রটি হলো আল-কুর’আন। এজন্যই ঈমানদারের সবচেয়ে বড় সামর্থ্যটি তার দৈহিক বা অর্থনৈতিক বল নয়, বরং সেটি হলো কুর’আন বুঝার সামর্থ্য।  একমাত্র সে সামর্থ্যই ব্যক্তিকে জাহিলিয়াত থেকে বাঁচায় এবং সিরাতাল মুস্তাকীম দেখায়। নবীজী (সা:) তাঁর মিশনের শুরুটি তাই কুর’আন দিয়ে শুরু করেছিলেন, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত দিয়ে নয়। নবীজী (সা:)’র এই বৈপ্লবিক স্ট্র্যাটেজির মধ্যে প্রকাশ ঘটেছিল সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার হিকমত। যার মধ্যে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য নাই, সে নামাজী, রোজাদার ও হাজী হতে পারে, কিন্তু  ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে সে কখনোই মুজাহিদ হতে পারেনা। সর্বোপরি সে একাত্ম হতে পারে না পবিত্র কুর‌’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডার সাথে। এজন্যই বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ দেশে কোটি কোটি নামাজী ও রোজাদার থাকা সত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে লোকবল নাই। ব্যর্থতাটি এখানে শিক্ষাব্যবস্থার। এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গণে প্লাবনটি জাহিলিয়াতের।

 

আদায় হচ্ছে না জ্ঞানার্জনের ফরজ

মুসলিম দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল দায়িত্ব হলো ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য সৃষ্টি করা। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সে কাজটি করছে না। অথচ কুর’আনের জ্ঞানার্জন নামাজ-রোজার ন্যায় ফরজ। এবং অজ্ঞ থাকা মহাপাপ। অথচ বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশে হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হলেও তা দিয়ে জ্ঞানার্জনের ফরজ আদায় হচ্ছে না। বরং শিক্ষাদানের নামে হচ্ছে পবিত্র কুর‌’আন ও মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা থেকে দূরে সরানোর কাজ। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে ইসলামের শত্রু উৎপাদনের বিশাল কারখানায়। পূর্ণ অধিকৃতি এখানে শয়তানের। দেশটির অঙ্গণে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়ছে -তারা গড়ে উঠেছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেরূপ বিপুল সংখ্যায় কাফির, মুনাফিক, জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট ও নাস্তিক কম্যুনিস্ট গড়ে উঠেছে -তা দেশটির শত শত পতিতাপল্লী বা হাজার হিন্দু মহল্লাতেও গড়ে উঠেনি। যারা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে তারা যোগ দিচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধে। এরা এতোই হিংস্র ও নৃশংস যে, লগি বৈঠা হাতে এদের দেখা যায় ইসলামপন্থীদের হত্যা করে তাদের লাশের উপর নাচতে। এরাই ঢাকার শাপলা চত্বরে শত শত মুসল্লীকে হত্যা করেছে এবং হ্ত্যা শেষে তাদের লাশকে গায়েব করে দিয়েছে। এরা পরিণত হয়েছে চোর-ডাকাত, ভোটডাকাত, গুম-খুনের নায়ক ও সন্ত্রাসী রাজনীতির ক্যাডারে।

মুসলিম দেশগুলো আজ যেভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে, মুসলিম দেশগুলো শত্রুশক্তির হাতে যেরূপ অধিকৃত হচ্ছে এবং সে দেশগুলিতে যেরূপ কুফরি আইন ও সেক্যুলার  সংস্কৃতির প্লাবন বইতে শুরু করেছে –তা তো এসব বড় বড় ডিগ্রিধারী জাহিলদের জন্যই; গ্রামের নিরক্ষর মানুষদের জন্য নয়। অথচ মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে গর্বের কাজ করেছেন মরুবাসী আরব। সে কালে কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, ফলে তাদের মাঝে কোন ডিগ্রিধারি ছিল না। আরবী ভাষাকে তারা অতি স্বল্প সময়ের মাঝে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত করেছিলেন। আথচ পবিত্র কুর’আনের পূর্বে আরবী ভাষায় কোন গ্রন্থ ছিল না। তাদের এ সাফল্যের কারণ, তারা শুধু নামাজ-রোজার ফরজই পালন করেননি, কুর’আন বুঝা ও তা থেকে জ্ঞানার্জনের ফরজও পালন করেছিলেন -যা আজকের মুসলিমগণ করছে না। ইসলামকে বিজয়ী করতে তারা সেদিন শুধু শ্রম, অর্থ ও সময়ই দেননি, প্রাণও দিয়েছেন। অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। অথচ সেরূপ ত্যাগের সামর্থ্য আজ ক’জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীর? আফগানিস্তানে এরূপ ডিগ্রিধারী জাহিলদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে মুসলিমগণ সেখানে বিজয়ী হয়েছে। এবং সে দেশে পরাজিত হয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ৫০টির বেশী দেশের সম্মিলিত সেনা বাহিনী। ইসলামের সে চিহ্নিত শত্রুগণ সেখানে ব্যর্থ হয়েছে শরিয়ত-বিরোধী আইনের প্রয়োগ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা দিতে। গ

 

গ্রহণ করা হয়নি ইসলামের সবটুকু

পবিত্র কুর’আনে বর্ণিত মহান আল্লাহতায়ালার সত্য বাণীকে অনুধাবনের জন্য যা অপরিহার্য তা হলো বিবেকের বল ও সুস্থতা। বিবেকের সে বল ও সুস্থতা বিনষ্ট হতে পারে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার বিকৃত শিক্ষায়। নবী (সা:)’র যুগে ইসলামী রাষ্ট্রবিপ্লবের কাজে যারা এগিয়ে এসেছিলেন তারা ছিলেন হযরত আলী (রা:), বেলাল (রা:), খাব্বাব (রা:), আম্মার (রা:)র মত অতি সাধারণ মানুষ। তাদের বিবেক কোন সেক্যুলার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা রোগাগ্রস্ত হয়নি। তাদের স্বচ্ছ বিবেক কুর‌’আনী জ্ঞানের আলোতে সহজেই আলোকিত হয়েছিল এবং বিপ্লব এনেছিল তাদের চেতনালোকে। তারা শুধু  নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতের বিধানকেই কবুল করেননি, কবুল করেছিলেন ইসলামের সবটুকু। ইসলামের বিধান ও দর্শন নিয়ে তারা শুধু জায়নামাজে ধ্যানে বসেননি, বরং ময়দানে নেমেছেন এবং ইসলামের বিজয় এনেছেন রাষ্ট্র জুড়ে এবং সে বিজয়কে সুরক্ষা দিতে নিজেদের জানমাল নিয়ে সব সময় ময়দানে থেকেছেন। বার বার তারা জিহাদে নেমেছেন। দুর্বৃত্তদের জন্য রাজনীতির ময়দান একদিনের জন্যও খালি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা কখনোই মসজিদের বা গৃহের চার দেয়ালের  মাঝে আশ্রয় নেননি। বেতনভোগী সৈনিক না হয়েও তারা ইসলামের সার্বক্ষনিক সৈনিক হয়েছিলেন। এসব আত্মত্যাগী সার্বক্ষণিক সৈনিকেরাই আল্লাহর দ্বীনের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধে নিজ তরবারী কোষমূক্ত করেছেন এমনকি হযরত আবু বকর (রা:)’য়ের ন্যায় নিবেদিত প্রাণ খলিফার সামনেও। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁকে বলেছেন, “হে আমিরুল মু’মিনিন! আপনি যদি আল্লাহর কুর’আন ও রাসুলুল্লাহ (সা:)’র সুন্নাহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা না করেন তবে এ তরবারি দিয়ে আপনাকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলবো।” তারা হযরত ওমর (রা:)’য়ের ন্যায় মহান খলিফর গায়ে বৃহৎ আকারের পিরহান দেখে তাঁর জুম্মার খোতবা থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, “এতো বড় জামা তৈরীর কাপড় কোত্থেকে পেলেন?”  ঈমান ও কুর’আনী জ্ঞান-প্রসূত তাকওয়া সাধারণ মানুষের জীবনেও এরূপ ক্ষমতায়ন ঘটায়।

কুর’আনী জ্ঞানের গুরুত্ব বুঝাতে মহান আল্লাহতায়ালা সুরা ফাতিরের ২৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “ইন্নামা ইয়াখশাল্লাহা মিন ইবাদিহিল উলামা।”  অর্থ: “একমাত্র জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করে।” এখানে জ্ঞানীদের অর্থ চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানী, ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের জ্ঞানী, ভূগোলের জ্ঞানে জ্ঞানী বা বিজ্ঞানের জ্ঞানে জ্ঞানীদের কথা বুঝানো হয়নি। সেটি হলে তো সকল চিকিৎস্যক, সকল ইঞ্জিনীয়ার এবং সকল বিজ্ঞানী মুসলিম ও মুত্তাকী  হতো। এখানে জ্ঞানী বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যাদের রয়েছে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। এর অর্থ দাঁড়ায়, যার মধ্যে পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান নেই তার মধ্যে আল্লাহর ভয়ও নেই। এবং যার মধ্যে আল্লাহতায়ালার ভয় নাই, সে কখনোই তাঁর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হতে পারে না। এমন ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয় সিরাতাল মুস্তাকীম চলতে। এমন অজ্ঞ মানুষেরা নামাজ-রোজা পালন করেও ঘুষ খায়, সূদ খায়, মিথ্যা বলে, শয়তানের পথ ধরে এবং জাহান্নামে যায়।

 

সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা প্রসঙ্গ

তাই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো পবিত্র কুর’আন বুঝতে শেখা এবং তা থেকে জ্ঞানার্জন করা। বস্তুত কে কতটা ঈমানদার ও তাকওয়ার অধিকারী -সেটি নির্ভর করে অর্জিত কুর’আনী জ্ঞানের উপর। কে সিরাতাল মুস্তাকীম চিনতে সফল হবে, কে সে পথে চলবে -সেটিও নির্ভর করে কুর’আনী জ্ঞানের উপর। তাই এ জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানে অজ্ঞ থাকা। সে অজ্ঞতা নিয়ে অসম্ভব হয় সত্যিকারের ঈমানদার হওয়া, যেমন ডাক্তারী বই না পড়ে অসম্ভব হয় ডাক্তার হওয়া। জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা থেকে মুক্তি দেয় একমাত্র কুর’আনী জ্ঞান। এজন্যই একটি মুসলিম রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কল-কারখানা নির্মাণ নয়, সেটি হলো কুর’আনের জ্ঞানদান। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কল-কারখানা কাউকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাবে না এবং জান্নাতেও নিবে না, জান্নাতে নেয় কুর’আনী জ্ঞান-প্রসূত তাকওয়া। মহান আল্লাহতায়ালা তাই সর্বপ্রথম কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন।

নবীজী (সা:) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠতম যে নিজে কুর’আন শিখলো এবং অন্যকে কুর’আন শিক্ষা দিল‍।” নবীজী (সা:)’র এ হাদীস অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও দেয়। সেটি হলো, তারাই সবচেয়ে অযোগ্য যারা কুর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানশূণ্য। অথচ আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলির নেতৃত্বের আসনে বসে আছে  যারা কুর’আনের জ্ঞানে জ্ঞানশূণ্য। বুঝতে হবে কুর’আন শেখার অর্থ পবিত্র কুর’আনের তেলাওয়াত শেখা নয়, বরং কুর’আন বুঝতে শেখা । মুসলিমদের আজকের সকল ব্যর্থতার মূল কারণ, সম্পদ ও জনসংখ্যায় কমতি নয়, সেটি কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা।  কুর’আনী জ্ঞান না থাকায় তারা বাঁচছে প্রচণ্ড জাহিলিয়াত নিয়ে। একারণেই নবীজী (সা:) যে ইসলাম প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন সে ইসলাম আজ মুসলিম বিশ্বের কোথাও বেঁচে নাই। তাদের থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র, শরিয়তী আইনের বিচার, প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্ব, অন্যায়ের নির্মূল এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার জিহাদ। মুসলিম বাঁচছে গোত্রবাদ, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সেক্যুলারিজমের জাহিলিয়াত নিয়ে। এমন কি নেমেছে মুর্তি নির্মাণ ও মুর্তি স্থাপনে -যেমনটি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে ভোটডাকাত হাসিনার শাসনামলে। 

নবীজী (সা:) বলেছেন, সামান্য সময়ের জ্ঞানচর্চা সারা রাতের নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম। জ্ঞান বিপ্লব আনে চেতনার ভূবনে, তখন পাল্টে যায় জীবনদর্শন, মূল্যবোধ, বিচারবোধ ও সংস্কৃতি। সে জ্ঞানটি কুর’আন-হাদীসের জ্ঞানের ভিত্তিতে হলে তখন ওহীর জ্ঞানে আলোকিত হয় মন। তাতে সৃষ্টি হয় তাকওয়া‌; পাল্টে যায় মনের এবং সে সাথে বিশাল ভূগোল জুড়ে আদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্র। কার্ল মার্কসকে তাই মার্কসবাদের প্রচারে ও প্রতিষ্ঠায় দেশে বিদেশে ঘুরতে হয়নি। সে কাজটি করে দিয়েছে তার লিখিত বই। ইসলামের প্রচারে এ কাজটি মুসলিমরাও করতে পারতো। কিন্তু তারা সে কাজটি করেনি; এখনো করছে না। ক’জন মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদকে গুরুত্ব দিচ্ছে? ক’জন বই লিখছে?

বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় সিকি ভাগ মুসলিম। কিন্তু তারা বিশ্বের সকল প্রকাশিত বইয়ের শতকরা ৫ ভাগ বইও লেখে না। সাড়ে ৬ কোটি মানুষের দেশ ব্রিটেন। কিন্তু এ দেশটিতে যত বই প্রকাশিত হয় তার অর্ধেক বই ৫০টির বেশী মুসলিম দেশে প্রকাশিত হয়না। এক কোটি মানুষের দেশ হলো গ্রীস। কিন্তু সে দেশটিতে যত বই ছাপা হয় তা ৩০ কোটি মানুষের ২২টি আরব দেশেও ছাপা হয়না। কারণ সৌদি আরব, মিশর, আরব আমিরাত, সিরিয়া, জর্দান, মরক্বো, কাতার, বাহরাইনের মত অধিকাংশ আরব দেশে বই লেখা ও বই প্রকাশের কোন স্বাধীনতা নাই। বই লেখা ও বইয়ের প্রকাশ কঠোর ভাবে সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অথচ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলিতে ইচ্ছামত কথা বলার যেমন স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ইচ্ছামত বই লেখা ও বই প্রকাশের স্বাধীনতা। পথে ঘাটে মনের ভাব প্রকাশে যেমন সরকারের অনুমতি লাগে না, তেমনি অনুমতি লাগে না বই লিখতে ও প্রকাশ করতে। অথচ অধিকাংশ মুসলিম দেশে সে স্বাধীনতা নাই। সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন বই প্রকাশ করা যায় না। প্রশ্ন হলো, বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে এতো নিয়ন্ত্রন থাকলে মুসলিমগণ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের সামর্থ্য পাবে কি করে? অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে পরাজিত হলে কঠিন হয় সশস্ত্র যুদ্ধের ময়দানে সৈনিক পাওয়া। তখন শুরু হয় রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন। কারণ, যুদ্ধের জন্য তো জরুরি  মনের বল। আর মনের বল তো আসে ঈমানের বল থেকে। এবং ঈমান শক্তি পায় কুর’আন থেকে। সৈনিকের হাত-পা তো তখনই যুদ্ধ করে -যখন তার জ্ঞানসমৃদ্ধ চেতনা সে যুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগায়। মুসলিম দেশের সরকারগুলি তাই পরিকল্পিত ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণের দখলদারিটি শয়তানী শক্তির হাতে তুলে দিয়েছে। এভাবেই প্রতিহত করেছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ।

মুসলিমের ঈমান বেড়ে উঠে কুর’আনী জ্ঞানের অনুপাতে। এবং জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে বাড়ে আমলের ওজন। আজ মুসলিম বিশ্বজুড়ে ইসলামের যে পরাজয় -তার মূল কারণ তো কুর‌’আনী জ্ঞানের কমতি; জনসংখ্যা ও সম্পদের কমতি নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে ছেয়ে আছে অজ্ঞতার কালো মেঘ। তারা অন্যদের ইসলাম কি বুঝাবে, তাদের নিজেদের কাছেই কুর’আন অজানা। তারা বরং নিজেদের চারিত্রিক কদর্যতা দিয়ে আড়াল করে রেখেছে ইসলামের আসল পরিচয়। এবং নিজেরা ভেসে চলছে অন্যদের সৃষ্ট আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক স্রোতে। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের ন্যায় মুসলিম দেশগুলিতে গণ-ধর্মান্তরের ন্যায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা লাখে লাখে দীক্ষা নিয়েছে মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের ন্যায় হারাম মতবাদে। এভাবে দূরে সরেছে ইসলাম থেকে। এবং এখন ভাসছে জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, সেক্যুলারিজমের স্রোতে। বস্তুত কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতায় জন্ম দিয়েছে প্রচন্ড শিকড়শূণ্যতা। ফলে যেদিক থেকেই আসে জাহিলিয়াতের স্রোত -সে স্রোতে সেদিকেই তারা ভাসতে থাকে। এখন ভাসছে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক স্রোতে।

একারণে মুসলিম দেশগুলিতে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরের ঘটনা না ঘটলেও, প্রচন্ডভাবে ঘটছে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক কনভার্শন। যেখান থেকে তারা রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আচার-আচরণের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা পায় সেটি ইসলাম নয়; সেটি অন্য ধর্ম ও অন্য মতবাদ। অথচ মুসলিমদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস তো অন্যদের সৃষ্ট স্রোতে ভেসে যাওয়া নয়, বরং বিরাজমান স্রোতের বিপরীতে ইসলামের পক্ষে স্রোত সৃষ্টি করা। এবং সে স্রোতে অন্যদেরও ভাসিয়ে নেয়া। এটিই তো মহান নবীজী(সা:)’র সূন্নত। নবীজী (সা:) যে সত্য দ্বীনের জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন -তা কয়েক দশকের মধ্যেই প্লাবিত করেছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিশাল ভূ-ভাগ। সে স্রোতে ভেসেছিল বহু দেশের বহু লক্ষ মানুষ। অথচ মুসলিমরা আজ সে সূন্নতকে ভূলে গেছে; তারা ব্যর্থ হয়েছে ইসলামের পক্ষে স্রোত সৃষ্টিতে। তারা বরং গড়েছে স্রোতে ভাসার সংস্কৃতি। জোয়ারের বদলে প্রবল ভাটা শুরু হয়েছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। মুসলিমগণ তাই কাফিরদের সৃষ্ট স্রোতে ভেসে ইতিহাস গড়েছে। এজন্যই মুসলিম দেশে সেক্যুলারিজম, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের ন্যায় জাহিলী মতবাদের অনুসারীদের সংখ্যা এতো বিশাল। তারই উদাহরন হলো বাংলাদেশ।

 

সবচেয়ে বড় খেয়ানত এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ প্রসঙ্গ

অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ারটি রয়েছে একমাত্র মুসলিমদের হাতে। সে হাতিয়ারটি হলো মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া পবিত্র কুর’আন। মানব জাতির জন্য এর চেয়ে বড় নিয়ামত আর কোন কালেই মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আসেনি। নবীজী (সা:) এই কুর’আন দিয়েও তাঁর আমলের কাফিরদের উপর ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক বিজয় এনেছিলেন। এই কুর’আন বুঝার প্রবল তাড়নায় বহু দেশের জনগণ তাদের মাতৃভাষা কবরে পাঠিয়ে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছে। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে আজও যারা ইসলাম কবুল করছে -তাদের ইসলাম কবুলের কারণ, কুর’আনের নিজের মোজেজা। কুর’আনের বাণীতে সত্যতা দেখে তারা মুসলিম হয়েছে। অথচ বিস্ময়ের বিষয় হলো, এ যুগে সবচেয়ে বড় খেয়ানত হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার এই সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতটির সাথে। এরূপ খেয়ানত নিজেই এক বিশাল অপরাধ যা আযাব ডেকে আনছে।

রোগের চিকিৎসায় গৃহে অব্যর্থ ঔষধ থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি মানুষ যদি সে ঔষধ সেবন না করার কারণে মারা যায়, তবে সেটি কি কম জঘন্য অপরাধ? সেটি কি কম আত্মঘাতী? অথচ সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে সে জঘন্য আত্মঘাতী অপরাধটাই হচ্ছে বিগত বহু শত বছর ধরে। এখন সে অপরাধটি ছেয়ে গেছে সর্বত্র জুড়ে। গণহারে সে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কারণে কোটি কোটি মানব সন্তান দল বেঁধে এবং উৎসব-ভরে জাহান্নামের যাত্রী হচ্ছে। মহান আল্লাহতায়ালার প্রেসক্রিপশনকে তেলাওয়াত করে ও সেটিকে চুমু দিয়ে মানুষ দায়িত্ব সারছে। সে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চিকিৎসা নিচ্ছে না। এটি তো গুরুতর অপরাধ। প্রশ্ন হলো, এ অপরাধের জন্য দায়ী করা? দায়ী তো খোদ মুসলিম জনগণ ও তাদের সরকার। তারা কুর’আন থেকে কোন ফায়দাই নেয়নি। কুর’আন বুঝার চেষ্টাও করেনি। তারা ইতিহাস গড়েছে কুর’আনের প্রতি প্রবল অবহেলায়। কুর‌’আনের বিধান ছেড়ে তারা নিজেদের মনগড়া বিধানকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। এটি কি কম গাদ্দারী? অথচ মহান আল্লাহতায়ালার চান, তাঁর সৃষ্ট এ পৃথিবীর উপর একমাত্র তাঁর বিধানের বিজয় আসবে।  এবং সে বিজয় আনার কাজে তাঁর ঈমানদার বান্দাগণ সাহায্যকারী তথা আনসার রূপে কাজ করবে। সে হুকুমটি এসেছে সুরা সাফ’য়ের ১৪ নম্বর আয়াতে।  তাঁর খলিফা রূপে এটিই তো ঈমানদারদের মূল দায়িত্ব। কিন্তু খলিফার দায়িত্ব পালনের কাজটি তাদের দ্বারা হয়নি। তারা বরং রাস্তায় নেমেছে এবং যুদ্ধ লড়ছে মহান আল্লাহতায়ালার শত্রুপক্ষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। বাঙালি মুসলিমগণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদেুর সাথে -যেমনটি দেখা গেছে ১৯৭১’য়ে। এবং তাদেরকেই তারা বিজয়ী করেছে। বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ভারতের গণিমতের মালে। এজন্যই দেশের অর্থনৈতিক বাজার, করিডোর, ট্রানজিট, সামদ্রিক বন্দরের সুবিধা ইত্যাদি -যা ইচ্ছে তাই নিচ্ছে। এভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বিধানের পরাজয় এসেছে তাদের নিজ হাতের অর্জিত কামাই রূপে। মুসলিম ভূমি আজ ৫০ টিরও বেশী টুকরায় বিভক্ত তো তাদের অর্থ, শ্রম ও রক্ত বিনিয়োগের ফলেই। মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের সাথে এর চেয়ে বড় গাদ্দারী আর কি হতে পারে? এ গাদ্দারীই কি তাঁর আযাব নামিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট নয়?

বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের কাজে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তায়াক্কুল, তাফাক্কুর ও তাদাব্বুর। শুধু কুর’আনের তেলাওয়াত বা পাঠ বাড়িয়ে সে লড়াই হয় না। যাদের মধ্যে বুদ্ধির প্রয়োগ (তায়াক্কুল) নেই, চিন্তার সামর্থ্য (তাফাক্কুর) নেই এবং গভীর বিচার-বিশ্লেষনের (তাদাব্বুর) যোগ্যতা নেই, তাদের দ্বারা কি কোন সভ্যতার নির্মাণ হয়? এ ব্যর্থতা তো ছেয়ে গেছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। ফলে তাদের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র দূরে থাক, মানবিকতায় সমৃদ্ধ একটি সভ্য রাষ্ট্রও গড়ে উঠছে না। সংখ্যায় প্রায় দেড় শত কোটি হলেও তাদের হাতে বাড়ছে না ইসলামের গৌরব। এবং প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইন। তাদের হাতে  ৫০টির বেশী মুসলিম রাষ্ট্র প্রচেষ্টা পেলেও, সেগুলির মাঝে কোন একটিকে নিয়েও কি গর্ব করা যায়? একটিও কি ইসলামী? অথচ নবীজী (সা:) যে রাষ্ট্র গড়েছিলেন সেটি কোন রাজতান্ত্রিক, সেক্যুলার, জাতীয়তাবাদী বা গোত্রবাদী রাষ্ট্র ছিল না। সেটি ছিল পূর্ণ ইসলামী। অথচ আজকের মুসলীমগণ নবীজী (সা:)’র সে ইসলাম নিয়ে বেঁচে নাই। তারা বাঁচছে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের প্রতি গাদ্দারী নিয়ে। এমন গাদ্দারী নিয়ে কেউ কি মুসলিম হতে পারে? আজকের মুসলিমদের জন্য এটিই হলো সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এবং এ ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নিয়েছে তাদের সকল ব্যর্থতা।  

 

শিক্ষাই হাতিয়ার

উন্নত জাতি বা রাষ্ট্র গড়ার শুরুটি সব সময়ই উন্নত মানুষ গড়ার মধ্য দিয়ে। মানুষ গড়ার সে হাতিয়ারটি হলো শিক্ষা। জাতি ধ্বংসের কাজের শুরুটিও হয় শিক্ষাধ্বংসের মধ্য দিয়ে। শিক্ষা বা জ্ঞানার্জনের কাজটি ছাত্র জীবনে শেষ হবার  নয়। এটি এক লাগাতর পদ্ধতি -যা অবশ্যই আমৃত্যু চালাতে হয়। এ ব্যাপারে মহান নবীজী (সা:)‌’র হাদীস হলো, “ধ্বংস সে ব্যক্তির জন্য যার জীবনে দুটি দিন আসলো অথচ তার জ্ঞানের ভান্ডারে কোন বৃদ্ধি ঘটলো না।” তাই সময়ের তালে প্রকৃত মু’মিনের জীবন থেকে তার মূল্যবান বছর বা দিনগুলি নিছক হারিয়ে যায় না, বরং হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘন্টা ও প্রতিটি মুহুর্তে তার জীবনে যোগ করে অমূল্য সম্পদ। তা হলো নতুন জ্ঞান, নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন উপলদ্ধি। সে  নতুন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধি ব্যক্তিকে পাল্টে দেয়। তখন তাঁর ভাবনায়, আমলে ও চরিত্রে পরিশুদ্ধি ও সমৃদ্ধি আনে। যার জীবনে সে সমৃদ্ধি ও পরিশুদ্ধি এলো না, বুঝতে হবে সে শুধু সময়ে স্রোতে হারিয়েই গেল এবং শূণ্য রয়ে গেল তাঁর জ্ঞানের ভান্ডারটি। মহাক্ষতি বা ধ্বংস বস্তুত এমন ব্যক্তিদের জন্যই। সময়ের কসম খেয়ে সে হুশিয়ারিটি সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা শুনিয়েছেন সুরা আসরে। জ্ঞানার্জনে ও নেক আমলে তাই সদা সচেষ্ট থাকতে হয় প্রতিটি ঈমানদারকে।

পানি যেমন বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখে ও ফলবান করে, পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান তেমনি ঈমানকে বাঁচিয়ে রাখে ও আমলকে সমৃদ্ধ করে। তবে জ্ঞানার্জনে শুধু পড়ার সামর্থ্যকে কাজে লাগালে চলে না, কাজে লাগাতে হয় দর্শন, শ্রবন এবং ভাবনার সামর্থ্যকেও। ইসলামে এগুলিও ইবাদত। হাদীসে বলা হয়েছে, “আফজালুল ইবাদত তাফাক্কুহ”। অর্থ: শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো চিন্তা-ভাবনা করা। চিন্তা-ভাবনা-শূণ্য মানুষেরাই নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত, কুর’আন পাঠ ও দোয়াদরুদ পালন করেও সূদ খায়, ঘুষ খায়, মিথ্যা বলে এবং জাতীয়তাবাদী ও আঞ্চলিকতাবাদী সেক্যুলারিস্টদের বিজয়ী করার রাজনীতি করে এবং নির্বাচনে ইসলামের চিহ্নিত শত্রুদেরকে ভোট দেয়। বাংলাদেশে এমন মানুষদের সংখ্যা তো কোটি কোটি। এসব চিন্তাশূণ্য মানুষদের কারণে বাংলাদেশের ন্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ ইতিহাস গড়ছে গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, প্রতারণা, চুরিডাকাতি, ভোটডাকাতি ও সন্ত্রাসের ন্যায় নানারূপ অপরাধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *