এ বিপ্লবের সুরক্ষা কিরূপে?

ফিরোজ মাহবুব কামাল

পরীক্ষা দিয়ে বাঁচতে হবে প্রতিক্ষণ

চলমান ছাত্র-জনতার এ সফল বিপ্লব বাঙালি মুসলিমদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এক পরীক্ষা নিয়ে হাজির হয়েছে। বুঝতে হবে, মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা নেন। এ পৃথিবীটাই হলো এক পরীক্ষাস্থল। এ পরীক্ষা এ জীবনে অনিবার্য। কারণ, সমগ্র মানবকূলের মধ্য থেকে এক দল মানুষকে তিনি জান্নাতে নিবেন। এবং অন্য দলটিকে জাহান্নামে নিবেন। কাদেরকে জান্নাতে নিবেন এবং কাকে জাহান্নামে নিবেন -সে বিষয়টি তিনি নির্ধারণ করবেন পরীক্ষার ভিত্তিতে। সে পরীক্ষাটি হবে তার ঈমানের ও আমলের। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের সে পরিকল্পনাটির ঘোষণা করেছেন সুরা মুলকের ২ নম্বব আয়াতে। বলেছেন:

ٱلَّذِى خَلَقَ ٱلْمَوْتَ وَٱلْحَيَوٰةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًۭا ۚ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْغَفُورُ

অর্থ: “তিনিই সেই (আল্লাহ) যিনি মউত ও হায়াতকে সৃষ্টি করেছেন এ জন্য যে, তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল।”   

কখনো সে পরীক্ষাটি তিনি নেন নানারূপ বিপদ-আপদ, ক্ষয়-ক্ষতি, জেল-জুলুম ও পরাধীনতা দিয়ে, আবার কখনো বা পরীক্ষা নেন বিপদমুক্ত এক স্বচ্ছল, নিরাপদ ও স্বাধীন জীবন দিয়ে। কখনো বা সে পরীক্ষাটি তিনি নেন নৃশংস জালিম শাসককে মাথার উপর চাপিয়ে দিয়ে।‌‌ যেমন বনি ইসরাইলীদের উপর চাপানো হয়েছিল ফেরাউনকে। ঘাড়ের উপর এরূপ রকম জালেম শাসক চাপানো হলে জিহাদ ফরজ হয়ে যায়। তখন প্রতিদিন বাঁচতে হয় জিহাদে জান, মাল ও মেধা বিনিয়োগ নিয়ে। যারা এ পথে নামে তারাই পরীক্ষায় পাশ করে। তাদের বিজয় দেন এবং ইজ্জত দেন। এবং পরকালে জান্নাত দেন। অপর দিকে যারা জালেম শাসকের কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে বাঁচে এবং নীরব ও  নিষ্ক্রিয় থাকে -তারা নিশ্চিত ফেল করে। তখন এ জীবনে পরাধীনতা ও বেইজ্জতি এবং পরকালে জাহান্নাম জুটে। ফিরাউনের আমলে মিশরে বহু হাজার বনি ইসরাইলীদের বসবাস ছিল। নবীজী (সা:)’র যতজন সাহাবী ছিলেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশী ছিল মিশরে বসবাসকারী বনি ইসরাইলীদের সংখ্যা। নবীজী (সা:)’র অনুসারীগণ রোমান ও পারসিক -এ দুটি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছেন। কিন্তু ইসরাইলীগণ ফিরাউনের বিরুদ্ধে কখনোই কোন লড়ায়ে খাড়া হয়নি, তারা বেঁচেছে আত্মসমর্পণ নিয়ে। ফলে সে পরীক্ষায় তারা ফেল করেছে। ফলে জুটেছে আযাব। তাদের পুত্র সন্তানদের হ্ত্যা করা হতো এবং মেয়েদের জীবিত রাখা হতো।

এরপর বনী ইসরাইলীদের পরীক্ষা নেয়া হয়েছে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দিয়ে। কিন্তু সে পরীক্ষাতেও তারা চরম ভাবে ফেল করেছে। ফেরাউন তাদের নির্মূলে নেমেছিল। তাদের বাঁচাতে মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা সমুদ্রকে ভাগ করে মাঝখান দিয়ে রাস্তা করে দিয়েছেন। তারা পায়ে হেঁটে সমুদ্র অতিক্রম করেছে। অপরদিকে ফিরাউন ও তার বাহিনীকে সে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করেছেন। জনমানবশূণ্য সিনা মরুভূমিতে কোন খাদ্য-পানীয় ছিল না। সে মরুভূমিতে বনী ইসরাইলীদের বাঁচিয়ে রাখতে তিনি আসমান থেকে মান্না ও সালওয়া পাঠিয়েছেন। পাথরের বুক চিরে ঠান্ডা পানির ঝরণা প্রবাহিত করেছেন। কিন্তু তাদের বেঈমানীর নমুনা হলো, হযরত মুসা (আ:) অনুপস্থিতিতে গরুর মুর্তি বানিয়ে সেটির পূজা শুরু করেছিল।

হযরত মুসা (আ:)’র মাধ্যম বনী ইসরাইলীদের জন্য ধর্মগ্রন্থ তাওরাত দেয়া হয়েছিল।‌ তাওরাতে ছিল আল্লাহতায়ালার শরীয়তী আইন। শরিয়তী আইন কখনোই শুধু তেলাওয়াতের জন্য দেয়া হয়না, বরং ফরজ হলো, সে আইন অনুযায়ী আদালতে বিচার পরিচালনা করা। সে জন্য চাই ইসলামী রাষ্ট্র। বনী ইসরাইলীদেরকে হুকুম দেয়া হয়েছিল কানানে তথা আজকের ফিলিস্তিনে গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার এবং শরীয়তের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্র পরিচালনার। কিন্তু সে হুকুম তারা মানেনি। তারা বিদ্রোহ করেছিল। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে হলে যুদ্ধ করতে হয় এবং জান-মালের কুরবানী পেশ করতে হয়।‌ কিন্তু তারা সে যুদ্ধে রাজী হয়নি। তাদের আচরণ এতোই উদ্ধত ছিল যে তারা হযরত মুসা (আ:)কে বলেছিল, “তুমি এবং তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা অপেক্ষায় রইলাম।” তাদের সে গাদ্দারীর কারণ হযরত মুসা (আ:) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। বনী ইসরাইলীগণ সে পরীক্ষায় অতি শোচনীয় ভাবে ফেল করেছিল। সে ফেলের জন্য কঠোর শাস্তিও তারা পেয়েছিল। তাদের জন্য ৪০ বছরের জন্য ফিলিস্তিনে প্রবেশ হারাম করা হয়েছিল। তাদেরকে আবার ইজ্জতহীন, নিরাপত্তাহীন ও স্বাধীনতাহীন জীবনে ফিরেয়ে নেয়া হয় এবং উদ্বাস্তুর বেশে নানা দেশের পথে পথে ঘুরতে হয়।

বনী ইসরাইলীরা হলো ইসলামে’র অতি ব্যর্থ ছাত্র। মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে তারা বরং বার বার বিদ্রোহ করেছে। সে বিদ্রোহের জন্য তাদেরকে কঠোর আযাব পেতে হয়েছে। পবিত্র কুর’আনে তাদের কাহিনী বিষদ ভাবে বার বার তুলে ধরার কারণ, মুসলিমগণ যেন তাদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়। তাদের ন্যায় বিদ্রোহ করলে, আযাব তাদেরকেও ঘির ধরবে। পরিতাপের বিষয় হলো, আজকের মুসলিমদের বিপর্যেল মলু কারণ, তারা অনুসরণ করছে বনি ইসরাইলীদের পথ। ফলে তারা বাঁচছে না ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা দিয়ে।      

বাঙালি মুসলিম জীবনে পরীক্ষা

অন্য জাতির ন্যায় বাঙালি মুসলিম জীবনেও বার বার পরীক্ষা এসেছে। তাদের ঘাড়ের উপর চাপানো হয়েছিল শেখ হাসিনার মত নৃশংস বর্বর শাসক। অতি আনন্দের বিষয় যে, ছাত্রদের জিহাদ সফল হয়েছে। হাসিনার ন্যায় একজন নৃশংস জালিম শাসককে তারা উৎখাত করতে পেরেছে। তবে মনে রাখতে হবে, এ বিজয় দিয়েছেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। জালিম শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদে নামলে মহান আল্লাহতায়ালার এভাবেই মুজাহিদদের বিজয় দিয়ে পুরস্কৃত করেন। এরূপ বিজয় কখনোই নীরব ও নিষ্ক্রিয়তায় আসে না। বুঝতে হবে, সকল বিজয় একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা থেকেই আসে। সেটি বলা হয়েছে সুরা আনফালের ১০ নম্বর আয়াতে। বলা হয়ছে:

وَمَا ٱلنَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِندِ ٱللَّهِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

অর্থ: “এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত বিজয় ছাড়া আর কোন বিজয় নাই; নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” ঈমানদারের কাজ হলো, মহান আল্লাহতায়ালার এ বিশাল দানের জন্য সব সময় কৃতজ্ঞ থাকা এবং শুকরিয়া আদায় করা। এবং যারা তাঁর দানের শুকরিয়া আদায় করে তাদেরকে তিনি আরো বেশি বেশি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। সুরা ইব্রাহীমের ৭ নম্বর তাই বলা হয়েছে:

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِى لَشَدِيدٌۭ  

অর্থ: “এবং এটিই তোমাদের রবের ঘোষণা, যদি তোমরা তোমাদের রবের (দেয়া বিজয় বা রহমতের) শুকরিয়া আদায় করো, তবে তিনি অবশ্যই তা বাড়িয়ে দিবেন। এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে আমার আযাব বড়ই কঠিন।”    

বাংলাদেশ এখন এক স্বাধীন দেশ। ৫০টির বেশী মুসলিম দেশের মাঝে খুব কম দেশেই রয়েছে এমন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত এদেশে কথা বলা, লেখালেখি ও মিটিং-মিছিলের স্বাধীনতা ছিল না। এখন স্বাধীনতা পাওয়ায় দায়িত্বও বেড়ে গেছে। সুযোগ এসেছে, তার কুর’আনী এজেন্ডার বাস্তবায়নে আমাদের সর্ববিধ সামর্থ্যের বিনিয়োগের। আমরা যদি পরীক্ষার এ দ্বিতীয় পর্বে ফেল করি তাহলে আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাদের উপরে হয়তো আবার আরেক জালিম শাসক চাপিয়ে দিবেন। কারণ ব্যর্থতা মাত্রই আযাব আনে।

অতীতে বার বার হাতছাড়া হয়েছে সুযোগ

এক সময় বাঙালি মুসলিমদের উপর ছিল নৃশংস জুলুম-নির্যাতন ও শোষণের দুটি নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। একটি ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির, অপরটি ছিল হিন্দু জমিদারদের। আল্লাহ সুবাহানা ওয়া তায়ালা সে জুলুম থেকে বাঙালি মুসলিমদের মুক্তি দিয়েছিলেন। সেটি ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এটি ছিল তাঁর অতি বিশাল নিয়ামত। তিনি সুযোগ দিয়েছিলেন এই পাকিস্তানকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র (চীন এবং ভারতের পর) শক্তিশালী রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার। সুযোগ দিয়েছিলেন এ রাষ্ট্রে তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইন প্রতিষ্ঠার। তাদেরকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকান ও উইঘুর মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর।  পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ নাগরিক রূপে বাঙালি মুসলিমদের দায়ভারটিই ছিল সবচেয়ে বেশী।

কিন্তু আমরা বাঙালি মুসলিমগণ সে দায়িত্ব পালন করিনি। ইসলামী বিধানকে বিজয়ী না করে আমরা বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, কম্যুনিজম ও সেকুলারিজমের স্রোতে ভেসে গেছি। এরূপ ভেসে যাওয়াটি ছিল আল্লাহ সুবাহানা ওয়া তায়ালার সাথে চরম গাদ্দারী। আমরা ভারতের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে গিয়ে পাকিস্তানকে ভেঙ্গেছি। এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের সাথে গাদ্দারী। ফলে শাস্তিও পেয়েছি। সে শাস্তির আলামত হলো, আমাদের ঘাড়ের উপর চাপানো হয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের দখলদারী।  চাপানো হয়েছে শেখ মুজিবের ন্যায় এক ভারতীয় দালালের  নৃশংস বাকশালী ফ্যাসীবাদী শাসন। হাজার হাজার মানুষ মুজিবের বর্বর শাসনে নিহত হয়েছে। বহু হাজার মানুষ জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। সে নিষ্ঠুর শাসন থেকেও মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। সেটি ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টে। তিনি আমাদের জন্য আরেকটি সুযোগ দিয়েছিলেন ইসলামের বিজয় আনার ও সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের। কিন্তু আমরা সে সুযোগ থেকেও কোন ফায়দা নেয়নি। ফলে আবার শাস্তি এসেছে। আমাদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিল হাসিনার দানবীয় ফ্যাসিবাদের নৃশংসতা।

এবার আরেকটি সুযোগ দিলেন। হাসিনার অপসারণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ সুবাহানা ওয়া তায়ালা আমাদেরকে আবারো রাস্তা খুলে দিলেন বাংলাদেশের বুকে তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার। সেটি যেমন তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শরিয়তী আইন প্রয়োগের, তেমনি দুর্বৃত্তির নির্মূল এবং ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার। যদি তাঁর দেয়া এ সুযোগকে আমরা কাজে না লাগাই তবে আমাদের মাথার উপরে আবারো কঠিন আযাব নামিয়ে আনবেন। তাই এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমের জীবনে শুরু হয়েছে আরেকটি পরীক্ষা পর্ব। পরীক্ষার হলে বসে আনন্দ ফুর্তি করা যায়না, বরং পূর্ণ মনযোগী হতে হয় কৃতকার্য হওয়ায়। তাই আমাদের মনযোগী হতে হবে যেমন এ বিপ্লবের সুরক্ষায়, তেমনি এ বিপ্লব থেকে ফায়দা নেয়ায়। শুধু মহান আল্লহাতায়ালা নন, সমগ্র বিশ্ববাসী আমাদের কর্মকান্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন।  

বিপ্লবের সুরক্ষায় ৮ দফা প্রস্তাবনা

এক: গড়ে তুলুন বিপ্লব প্রতিরক্ষা পরিষদ 

যারা এ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী, সহসমন্বয়কারী এবং যারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এ আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের নিয়ে গড়ে তুলুন একটি বিপ্লব প্রতিরক্ষা পরিষদ। এরূপ পরিষদ যেমন জাতীয় পর্যায়ে গড়তে হবে, তেমনি গড়তে হবে থানা, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও। প্রতিটি বিপ্লব মাত্রই হলো একটি বিপ্লবী প্রক্রিয়া। বিপ্লব বাঁচাতে হলে তাই সে বিপ্লবী প্রক্রিয়াকেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তাই জালেমের পতনে বিপ্লব শেষ হয় না, শুরু হয় মাত্র। বিপ্লবী মাত্রই তাই আমৃত্যু বিপ্লবী।

মনে রাখতে হবে মাঠ কখনোই ছাড়া যাবেনা, মাঠের দখল অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। মাঠ ছাড়লে এ বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাবে। কারণ শয়তানী শক্তি বসে নাই, তারা প্রতিবিপ্লবের পরিকল্পনা করছে। এখন ঘুমিয়ে থাকার সময় নেই। ঘুমিয়ে থাকলে এ বিপ্লব চুরি হয়ে যাবে। যখনই প্রয়োজন দেখা দিবে তখনই ময়দানের ময়দানে মিটিং মিছিল করে সরকারের উপরে চাপ বজায় রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে, এ বিপ্লবকে কখনোই কোন রাজনৈতিক দলের হাতে হাইজ্যাক হতে দেয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, এ বিপ্লবের শক্তি হলো, এর দলীয় প্রভাবমুক্ত পরিচিতি। এ বিপ্লব কোন রাজনৈতিক দলের সাহায্য নিয়ে হয়নি। কোন রাজনৈতিক দলীয় লেজুড়বৃত্তি শুরু হলে এ বিপ্লব আর বিপ্লব থাকবেনা; তখন বিপ্লবের মৃত্যু ঘটবে।    

 দুই: গড়ে তুলুন দুর্বৃত্ত নির্মূল কমিটি 

পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা’র এজেন্ডা হলো “নেহী আনিল মুনকার” তথা দুবৃত্তির নির্মূল এবং “আমিরু বিল মারুফ” তথা ন্যায় ও সুবিচারে প্রতিষ্ঠা। ঈমানদার হওয়ার অর্থ মহান আল্লাহতায়ালার এ এজেন্ডার সাথে একাত্মতা। এ এজেন্ডা পালন  নিয়েই সত্যিকার মুসলিমের জীবনে আসে প্রতিদিনের জিহাদ। মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা সূরা আল ইমরানের ১১০ নাম্বার আয়াতে মুসলিমদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির মর্যাদা দিয়েছেন। তবে কি কারণে তাদের সে মর্যাদা সে কথাও তিনি উক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন।  সে মর্যাদা এজন্য নয় যে, তারা বেশী বেশী নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করে। বরং এজন্য যে, তারা দুবৃত্তির নির্মূল করে, ন্যায় ও সুবিচারে প্রতিষ্ঠা দেয় এবং আল্লাহতায়ালাকে বিশ্বাস করে।

হাসিনা নিজে দেশ ছাড়লেও তার ডাকাত বাহিনী দেশ ছাড়েনি। তার হাতে প্রতিপালিত বহু লক্ষ দুর্বৃত্ত এখনো বাংলাদেশে রয়ে গেছে। এরাই এ বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, এদুর্বৃত্তদের নির্মূলে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হাতে নিতে হবে। প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি থানায় ও প্রতিটি ইউনিয়নে হাসিনার ডাকাত দলের সদ্যস্যদের তালিকা তৈরী করতে হবে এবং তাদের নির্মূলে দূর্বৃত্ত নির্মূল কমিটি গড়ে তুলতে হবে। যারা পূর্ববর্তী বছরগুলি ধরে নানা ভাবে লুটপাট, চাঁদাবাজি ও চুরি ডাকাতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করুন। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী প্রমাণ সংগ্রহ করুন। সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতে মামলা দায়ের করুন। এ নিয়ে পুলিশ বা সরকার কি করছে সেটি দেখার সাথে সাথে আপনি নিজে কি করছেন সেটিরই হিসাব নিন। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে এ বিপ্লবের দায়িত্ববান প্রহরী হতে হবে।  

তিন. গড়ে তুলুন প্রসিকিউশন টিম 

শুধু রাজধানীতে নয়, প্রতিটি থানায় ও প্রতিটি জেলায় অভিজ্ঞ আইনবিদদের নিয়ে গড়ে তুলুন প্রসিকিউশন তথা বৈচারিক টিম। তাদের কাজ হবে এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা পরিচালনা করা। এগুলো করতে হবে সরকারি উদ্যোগে। শুধু সরকারি উকিল ও পুলিশ বাহিনী দিয়ে এ কাজ হবেনা। অপরাধের নায়ক, অপরাধের বিবরণ ও অপরাধের দলিল ও সাক্ষি-সাবুদ সংগ্রহ করতে হবে। এ কাজ বহু বছরের। তাই  ছাত্র-জনতার স্তরেও বৈচারিক টিম গড়ে তুলুন। এ কমিটিতে সে সব দলের লোকদের শামিল করতে হবে যারা আওয়ামী শাসনামলে নির্যাতিত হয়েছে। 

কোন অপরাধীকেই বিচারের উর্দ্ধে রাখা যাবে না। ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার জন্য সর্বপ্রকার উদ্যোগ নিতে হবে। বুঝতে হবে হাসিনাই হলো সবচেয়ে বড় অপরাধী। তার অপরাধের বিচার না করে শুধু অন্যদের বিচার করলে দায়িত্ব পালনে ত্রুটি থেকে যাবে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের অপরাধী বিনিময়ের চুক্তি রয়েছে। সে চুক্তিকে এখন কাজে লাগাতে হবে।      

 চার. গড়ে তুলুন শহীদ পরিবার প্রতিপালন ফান্ড 

এ বিপ্লবে যারা শহীদ বা আহত হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরী করুন। তাদের পরিবারের সাহায্যের জন্য গড়ে তুলুন শহীদ পরিবার সহায়তা ফান্ড। এ ফান্ডে সরকারি বরাদ্দের ব্যবস্থা করুন। সামর্থ্যবান ব্যক্তদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করুন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য মাসিক ভাতা নির্ধারণ করুন। মনে রাখতে হবে, এ বিপ্লব তাদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। তাই তাদের ত্যাগ ও কুরবানীর মূল্য দিতে হবে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরাই হলো এ বিপ্লবের মূল সৈনিক। এ বিপ্লব বাঁচাতে হলে এ সৈনিকদের যেমন ইজ্জত দিতে হবে, তেমনি আর্থিক সহায়তাও দিতে হবে। নইলে এ বিপ্লব বাঁচবে না।   

পাঁচ. ইতিহাস সংরক্ষণ সমিতি 

এই ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসে বিস্ময়কর একটি রেকর্ড নির্মিত হলো। সেটিকে হারিয়ে দেয়া যায় না, সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এ ইতিহাস থেকে শত শত বছর পরও নতুন প্রজন্ম শিক্ষা নিবে। কিভাবে বিপ্লব সংগঠিত হলো, কারা কোথায় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল, কার বাধা দিল,কারা আহত হলো এবং কারা শহীদ হলো -সকল বৃত্তান্ত বইয়ের আকারে লিখে রাখতে হবে এবং প্রকাশ করতে হবে। যারা জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা ছিল সে অপরাধীদেরকেও ভুলা যাবে না। কারণ তারা এ বিপ্লবের দুশমন। তাদের অপরাধের কাহিনীকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বই আকারে তাদের নাম ও ভূমিকা প্রকাশিত করতে হবে। এগুলি হবে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের দলিল।

বিপ্লব বাঁচাতে হলে বিপ্লবের এ ইতিহাসকে অবশ্যই বাঁচাতে হবে। যারা এ বিপ্লবে অংশ নিয়েছে শহীদ হয়েছে তারা আমাদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিভাবে এবং কোথায় তারা শহীদ হলো সে বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। তাদের স্মৃতি বাঁচানোর প্রয়োজনে তাদের নামে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে হবে।

 ছয়. গড়ে তুলুন পর্যবেক্ষণ টিম 

মনে রাখতে হবে সকল উপদেষ্টা ও সকল সরকারি কর্মকর্তা হলো প্রজাতন্ত্রে কর্মচারি।  তাদের কার্যক্রমের উপর সর্বক্ষণ নিবিড় তদারকি রাখা তাই জনগণের দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে এখন দেশে বিরোধী দল নেই। বিরোধীদলের দায়িত্ব পালন করতে হবে এই পর্যবেক্ষণ কমিটিকে। শুধু রাজধানীতে নয়, প্রতিটি থানায় ও প্রতিটি জেলায় পর্যবেক্ষণ কমিটি গড়ে তুলুন। যারা সমাজের বিজ্ঞ ও শিক্ষিত তাদেরকে এ কমিটিতে রাখুন। প্রতিটি নাগরিক এখান সংবাদ দাতা।  সরকারি কার্যকলাপে যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে -সেগুলির উপর সত্বর রিপোর্ট করুন। গড়ে তুলুন ওয়েব সাইট। সেখানে মানুষ সরকারি কার্যকলাপের দুর্নীতি ও শত্রুদের বিপ্লব বিরোধী কার্যকলাপ নিয়ে ইনফরমেশন শেয়ার করতে হবে।

সাত. গড়ে তুলুন পরিশুদ্ধি কমিটি 

দুর্বৃত্ত শাসকদের অপরাধ হলো, তার সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে অপরাধের হাতিয়ারে পরিণত করে।  সভ্য রাষ্ট্র গড়তে হলে সমাজ ও প্রশাসনকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে আপোষ করার অর্থ বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেয়া। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার সরকার বিগত ১৫ বছরে বিপুল সংখ্যক দলীয় দুর্বৃত্তদের প্রশাসনে ঢুকিয়েছে। তাদের তালিকা বের করতে হবে এবং খুঁজে খুঁজে প্রশাসন থেকে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। তাদের স্থলে সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে উন্নত চরিত্রে নতুন লোক নিয়োগ করতে হবে।

প্রতিটি জেলা শহরে, প্রতিটি থানায়, প্রতিটি মহল্লায়,প্রতিটি ইউনিয়নে সেসব লোকদের তালিকা তৈরি করতে হবে যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। যাদের চাকুরি নাই, ব্যবসা নাই এবং পিতার অঢেল সম্পদ নাই অথচ বিগত ১৫ বছরে কোটি কোটি টাকা, বড় বাড়ি, গাড়ি ও জমিজমার মালিক হয়েছে তাদের হাতে কারণ দর্শাও নোটিশ ধরিয়ে দিতে হবে। কিরূপে তারা সম্পদের মালিক হলো, কি তাদের আয়ের উৎস -সাত দিনের মধ্যে আয় ও ব্যয়ের হিসাব দাখিলের মেয়াদ বেঁধে দিতে হবে। এরপর ২৫ প্রসিকিউশন টিমের দায়িত্ব হবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা এবং মামলা পরিচালনা করা। মামলার অগ্রগতি নিয়মিত জনগণের সামনে পেশ করতে হবে।

আট. বিলুপ্ত করতে হবে ফ্যাসিবাদের নায়কের সম্মান প্রদর্শনের সকল আলামত

মনে রাখতে হবে, অপরাধ করাই শুধু অপরাধ নয়, অপরাধীকে সম্মান করাও গুরুতর অপরাধ। ইসলামে সেটি কবিরা গুনাহ। অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে খুন, ধর্ষণ ও চুরি-ডাকাতির ন্যায় অপরাধের সাথে জড়িত থাকার জন্য নয়, বরং অপরাধীদের সমর্থন করা ও তাদের সম্মান করার অপরাধে। তাই শুধু ফিরাউন-নমরুদই শুধু জাহান্নামে যাবে না, তাদের সমর্থকগণও জাহান্নামে যাবে। তাই বাংলাদেশে এমন কিছু করা যাবে না -যা দিয়ে কোন অপরাধীকে সম্মান করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধী হলো শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা। শেখ মুজিবের অপরাধ সে বড় মাপের প্রতারক। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনে সে গণতন্ত্রের কথা বলে সে ভোট নিয়েছিল, অথচ গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালী ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছি। তবে সে শুধু গণতন্ত্রের খুনি নয়, বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডেরও সে নায়ক। রক্ষি বাহিনীকে দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সে হত্যা করেছে। শেখ মুজিব ছিল তার দলীয় চোর-ডাকাত ও নানা রূপ দুর্বৃত্তদের প্রতিপালন কর্তা। তাছাড়া শেখ মুজিবের যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে মুসলিম ও ইসলাম ছিল সেগুলি বিলুপ্ত করেছে। কুর’আন আয়াত সরিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম থেকে। মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্বকে স্থান দেয়নি সংবিধানে। মুজিব ছিল ভারতের বেতনভোগী এজেন্ট এবং ভারতীয় স্বার্থের সেবক। আগরতলা ষড়যন্ত্র করেছিল ভারতের এজেন্ডা পূরণে।

অপর দিকে শেখ মুজিবের ন্যায় বাংলার ইতিহাসের আরেক কুখ্যাত অপরাধী হলো শেখ হাসিনা। তার হুকুমে খুন হয়েছে হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষ। কবরবাসী হয়েছে গণতন্ত্র। জামায়াত নেতাদের ফাঁসি, শাপলা চত্বরের গণহত্যা এবং হাজার আলেম ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর জেল-জুলুম হয়েছে হয়েছে তারই হু্কুমে। মুজিবের ন্যায় হাসিনারও যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে। এবং তার রাজনীতির এজেন্ডা ছিল ভারতের এজেন্ডা পূরণ। তাই মুজিব, হাসিনা ও তাদের পরিবারে সদস্যদের নামে বাংলাদেশের যত প্রতিষ্ঠানের নাম আছে সেগুলি থেকে তাদের নাম সত্বর বিলুপ্ত করতে হবে। নইলে কবিরা গুনাহ হবে। শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা বলা নিষিদ্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এ ঘৃণ্য অপরাধীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এ মহান বিপ্লবকে কখনোই বাঁচানো যাবে না। এবং কোন সভ্য রাষ্ট্রও নির্মাণ করা যাবে না। বরং এ ঘৃণ্য অপরাধীদের সম্মান দেখানোর অর্থ এ বিপ্লবের শহীদদের আদর্শের সাথে গাদ্দারী। চলমান এ বিপ্লবের প্রতি যাদের সামান্যতম ভালবাসা আছে তারা কি এ অপরাধীদের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে? ১৪/০৮/২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *