সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানব

ফিরোজ মাহবুব কামাল

সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত

রাষ্ট্রকে পরিশুদ্ধ করার কাজে অবশ্যই নির্মূল করতে হয় দখলদার দুর্বৃত্ত শাসক ও তার সহযোগীদের। সে নির্মূলের যুদ্ধই হলো পবিত্র জিহাদ। ব্যক্তির পরিশুদ্ধির জন্য মহান আল্লাহতায়ালা যেমন কুর’আনী জ্ঞানার্জন, নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ন্যায় ইবাদতকে ফরজ করেছেন, রাষ্ট্রকে পরিশুদ্ধ করার লক্ষ্যে ফরজ করছেন জিহাদকে। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন না করলে কেউ মুসলিম থাকে না। তেমনি মুসলিম থাকে না জিহাদে লিপ্ত না হলে। সে কথাটি মহান আল্লাহতায়ালা অতি স্পষ্ট ভাবে বলেছেন সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াতে। এজন্যই নবীজী (সা:)’র এমন কোন সাহাবী পাওয়া যায় না -যিনি জিহাদে ছিলেন না। যাদের জীবনে সেদিন জিহাদ ছিল না -তাদেরকে মুনাফিক বলা হয়েছে।  

মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূল, সত্য ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা এবং নিরাপদ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় জিহাদের বিকল্প নাই। প্রশ্ন হলো, সেরূপ জিহাদে অর্থ, রক্ত, মেধা, শ্রম ও সময়ের যে বিশাল বিনিয়োগ -সেরূপ বিনিয়োগ কি কখনো নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দোয়া-দরুদ পাঠে হয়? জিহাদের সর্বাধিক মর্যাদা ও পুরস্কার তো তাতে সর্বাধিক বিনিয়োগের কারণে। এখানে বিনিয়োগ হয় অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্তের। এজন্যই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে জিহাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের মর্যাদা। এ ইবাদতে কেউ নিহত হলে তাকে তিনি সরাসরি জান্নাতে নেন। সেরূপ পুরস্কার অন্য কোন ইবাদতে জুটে না। এজন্যই যারা সত্যিকার ঈমানদার এবং যারা চায় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয়তর হতে -তাদের প্রতিক্ষণের মনযোগ জিহাদে। সেটি দেখা গেছে নবীজী (সা:)’র সাহাবাদের জীবনে। তারা শুধু নামাজ-রোজায় ইতিহাস গড়েননি, ইতিহাস গড়েছেন ঈমানদারীতে ও মহান আল্লাহতায়ালার পথে প্রাণদানে। এজন্যই সাহাবাদের মর্যদা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের।

 

মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম

সমগ্র মানব ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মটি ঘটেছে মহান নবীজী (সা:)’র আমলে এবং তাঁর নিজ হাতে। হযরত দাউদ (আ:) ও হযরত সুলাইমান (আ:)‌’য়ের হাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেলেও সে রাষ্ট্র বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে ও ইসলামী সভ্যতার নির্মাণে সেরূপ প্রভাব ফেলতে পারিনি। সেটি আদিম ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু সেটি ঘটেছে নবীজী (সা:)’র হাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে। নবীজী (সা:)’র প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সিভিলাইজেশনাল স্টেটে। সে রাষ্ট্রের কারণে মুসলিমগণ পরিণত হয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তিতে। সে রাষ্ট্রের কারণে নির্মিত হয়েছে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার শরিয়তী আইন। একমাত্র তারাই নির্মূল করতে পেরেছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিশাল ভূভাগ থেকে কুফুরি আইনের স্বৈরশাসন। মুসলিমগণ বহুদেশ জয় করেছে; কিন্তু কোথাও ইউরোপীয়দের ন্যায় উপনিবেশ গড়েনি। লুণ্ঠন করে সম্পদ নিজ জন্মভূমিতে নিয়ে যায়নি। কোথাও নির্মাণ করেনি ঔপনিবেশিক শোষনের অবকাঠামো। ফলে প্রায় ৭ শত বছর শাসন করেও মুসলিমগণ ভারতে যেমন সংখ্যালঘু থেকে গেছে, তেমনি সংখ্যালঘু থেকে গেছে স্পেনে। স্থানীয় জনগণের সাথে তারা একাত্ম হয়ে গেছে। অধিকৃত দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার তাড়নায় ইউরোপীয়দের ন্যায় কোথাও তারা বর্ণগত, জাতিগত বা ধর্মগত নির্মূলের লক্ষ্যে নৃশংস গণহত্যা ঘটায়নি।

           

গাদ্দারী যখন আল্লাহতায়ালার সাথে               

মুসলিম জীবনে বিপর্যের শুরু তখন থেকেই যখন তারা মহান আল্লাহতায়ালার পথে যুদ্ধ ছেড়ে বাঁচতে শুরু করেছে নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অথবা যুদ্ধ করেছে স্বৈরাচারি রাজার বিজয় বাড়াতে। তখন থেকেই তাদের ঘাড়ে নৃশংস স্বৈরাচারী শাসকেরা সকল প্রকার দুর্বৃত্তি নিয়ে চেপে বসেছে। মহান আল্লাহতায়ালার পথে নিষ্ক্রিয়তাই মুসলিম চরিত্রের সবচেয়ে বড় রোগ। বেঈমানের পরিচয় হলো, তার সমগ্র আগ্রহ, সকল বিনিয়োগ এবং সর্বসময়ের ব্যস্ততা স্রেফ নিজ স্বার্থ-হাছিল এবং সে সাথে নিজ ভাষা, নিজ জাতি, নিজ দল ও নিজ নেতার গৌরব বৃদ্ধির তাগিদে। সে কাজে অর্থ, শ্রম, মেধা ও রক্ত দিতেও তারা রাজী। কিন্তু বিনিয়োগে রাজী নয় মহান আল্লাহতায়ালার দ্বীনের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা বাড়াতে।

বিগত একশত বছরে মুসলিমগণ বহু যুদ্ধ লড়েছে এবং বহু লক্ষ মানুষের প্রাণনাশও হয়েছে। বহু লক্ষ মুসলিম আহতও হয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশের বুকেই বহু হাজার মানুষের প্রাণনাশ হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে ১০ লাখের বেশি আরব মুসলিম এবং আড়াই লাখের বেশি ভারতীয় মুসলিম ব্রিটিশ সেনাদলে যোগ দিয়ে যুদ্ধ লড়েছে। বহু লক্ষ মুসলিম যুদ্ধ করেছে ফরাসী ও ইতালীর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে। সেসব যুদ্ধে বহু হাজার মুসলিম নিহত ও আহতও দিয়েছে। আজও বহু মুসলিম দেশে বহু যুদ্ধ চলছে। অতীতে যুদ্ধ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে ভাষা, গোত্র, ভূ-গোল ও রাজা-বাদশাহ’র নামে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আফগানিস্তানের তালেবানদের জিহাদ ছাড়া আর কোথাও কি ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জিহাদ হয়েছে? সেট হয়নি। এ থোকে বুঝা যায় মুসলিমগণ যুদ্ধ করতে সব সময়ই রাজী। যুদ্ধে প্রাণদানে ও আহত হতেও রাজী। কিন্তু ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে তারা রাজী নয়। বাঙালি বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টগণ সেটিকে সাম্প্রদায়িকতা বলে। মহান আল্লাহতায়ালার সাথে এর চেয়ে বড় গাদ্দারী আর কি হতে পারে?

 

আল্লাহতায়ালার সাথে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি ও জিহাদ

প্রতিটি ঈমানদার হলো মহান আল্লাহতায়ালা সৈনিক। তিনি তাঁর সৈনিকদের উপর তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যুদ্ধকে ফরজ করেছেন। সে নির্দেশটি এসেছে নিম্নের আয়াতে:

۞ فَلْيُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يَشْرُونَ ٱلْحَيَوٰةَ ٱلدُّنْيَا بِٱلْـَٔاخِرَةِ ۚ وَمَن يُقَـٰتِلْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًۭا

অর্থ: “অতঃপর যারা বিক্রয় করেছে আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে তারা তো অবশ্যই যুদ্ধ করবে আল্লাহর পথে। এবং যে যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, সে নিহত হোক বা বিজয়ী হোক -উভয় অবস্থাতেই আমি তাকে মহাপুরস্কার দিব।” –(সুরা নিসা, আয়াত ৭৪)।

উপরিউক্ত আয়াতটি  পবিত্র কুর’আনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। এটি একটি আয়াতে মোহকামাত -যা বুঝার জন্য কুর’আন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। এ আয়াতে রয়েছে প্রতিটি ঈমানদারের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। নির্দেশটি আল্লাহর পথে যুদ্ধের।  প্রশ্ন হলো, এরা কারা যারা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে নিজেদের জীবনকে বিক্রয় করে এবং যে বিক্রয়ের সূত্র ধরে তাদের উপর ফরজ হয়ে যায় আল্লাহর পথে যুদ্ধ? এ প্রশ্নের জবাব মহান আল্লাহতায়ালা নিজেই দিয়েছেন। সেটি সুরা তাওবার ১১১ নম্বর আয়াতে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে,

۞ إِنَّ ٱللَّهَ ٱشْتَرَىٰ مِنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلْجَنَّةَ ۚ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ

অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের জান ও মাল এ শর্তে কিনে নিয়েছেন যে, জান্নাত হবে তাদের জন্য। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, অতঃপর হত্যা করে ( শত্রুদের) এবং (শত্রুদের হাতে) নিজেরাও নিহত হয়।   

অতএব এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যারা ঈমানদার -তাঁরা বাঁচে মহান আল্লাহতায়ালার সাথে সম্পাদিত ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি নিয়ে। সে চুক্তি অনুযায়ী ঈমানদার মাত্রই জান্নাতের বিনিময়ে বিক্রয় করে তার নিজের জান ও মাল। সে চুক্তির পর তাঁর উপর দায়বদ্ধতা আসে আল্লাহর পথে জিহাদের।  সে দায়বদ্ধতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে সুরা নিসার ৭৪ নম্বর আয়াতে। কিন্তু ক’জন মুসলিম বাঁচে সে দায়বদ্ধতা নিয়ে? বরং তারা বাঁচে দায়িত্বহীনতা নিয়ে। তাই ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইসরাইলীদের, কাশ্মীরীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের, উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনাদের এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের প্রবল যুদ্ধ থাকলেও সেরূপ প্রবল যুদ্ধ মুসলিমদের জীবনে নাই। তারা বরং দেশে দেশে দ্রুত উদ্বাস্তু হচ্ছে।  জিহাদের ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকে বাংলাদেশের ন্যায় অধিকাংশ মুসলিম দেশে সন্ত্রাস বলা হয়। এমন কি আলেমগণও তাদের খোতবায় জিহাদের কথা মুখে আনতে ভয় পায়। তাদের অনেকেই সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালাকে আর কি ভয় করে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় করে শাসকদের। সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা জিহাদে অনাগ্রহী এই মুসলিমদের ভয়ের বর্ণনা তুলে ধরেছেন সুরা নিসার ৭৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:

َ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ ٱلْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌۭ مِّنْهُمْ يَخْشَوْنَ ٱلنَّاسَ كَخَشْيَةِ ٱللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةًۭ ۚ وَقَالُوا۟ رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَيْنَا ٱلْقِتَالَ لَوْلَآ أَخَّرْتَنَآ إِلَىٰٓ أَجَلٍۢ قَرِيبٍۢ

অর্থ: “অতঃপর যখন তাদের উপর যখন যুদ্ধ ফরজ করা হলো, তখন তাদের মধ্য থেকে একটি দল (বিপক্ষের) মানুষকে ভয় করতে লাগলো -যেন আল্লাহকে ভয় করার অনুরূপ; অথবা তার চেয়েও অধিক ভয়। এবং বললো, “হে আমাদের রব, আমাদের উপর যুদ্ধ কেন ফরজ করলেন? আমাদের কেন আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলেন না?”  

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *