আল্লাহর আনসার এবং শয়তানের আনসার

ফিরোজ মাহবুব কামাল

মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সত্যিকার মুসলিম হওয়া। মুসলিম হওয়াতে ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হয় এ জীবনে বাঁচার সকল প্রচেষ্টা। সে ব্যর্থতা নিশ্চিত জাহান্নামে হাজির করে। পেশাদারী সাফল্যসহ জীবনের অন্যান্য অর্জনগুলি যত বড়ই হোক -তাতে বিন্দুমাত্র লাভ হয়না।  মহান আল্লাহতায়ালা তার সর্বশ্রেষ্ঠ মানব সৃষ্টির কল্যাণ চান। তিনি চান মানবগণ বেড়ে উঠুক জান্নাতের যোগ্য রূপে। অর্জন করুক মাগফিরাত লাভের সামর্থ্য। আর জান্নাতের যোগ্য হতে হলে শর্ত হলো তাকে মুসলিম হতে হয়। অমুসলিমের জন্য জান্নাতে কোন স্থান নাই। সেজন্যই মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আল-ইমরানের ১০২ নম্বর আয়াতে হুশিয়ার করে দিয়েছেন কেউ যেন মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ না করে। বলা হয়েছে:

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ

 অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় করো যেরূপ ভয় করা উচিত (যথার্থ তাকওয়া অর্জন করো) এবং তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করো না।”  

প্রশ্ন হলো, মুসলিম হওয়ার অর্থ কি? এবং কিরূপে মুসলিম হওয়া যায়? মুসলিম হওয়ার অর্থ, কোন মুসলিম পিতামাতার গৃহে জন্ম গ্রহন নয়। নবীজী (সা:) নিজে এবং তাঁর সাহাবীদের জন্ম হয়েছিল কাফিরদের ঘরে, কিন্তু তাতে শ্রেষ্ঠ মুসলিম হওয়াতে কোন বাধা দেখা যায়নি। মুসলিম হওয়ার অর্থ, মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম বা ইচ্ছার  কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এবং তাঁর এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্মতা। তখন সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করার কাজে আল্লাহতায়ালার সৈনিক তথা আনসার হতে হয়। সে আনসার হওয়ার হুকুম এসেছে সুরা সাফ’য়ের ১৪ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:  

      يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ كُونُوٓا۟ أَنصَارَ ٱللَّهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّـۧنَ مَنْ أَنصَارِىٓ إِلَى ٱللَّهِ ۖ

অর্থ: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহতায়ালার আনসার তথা সাহায্যকারী হয়ে যাও -যেমন মরিয়ম পুত্র ঈসা তার সঙ্গীদের বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে আল্লাহর সাহায্যকারী?” 

পবিত্র কুর’আনে যখন ঈমানদারদের প্রতি হুকুম আসে তখন সে হুকুমটি পালন করা ফরজ হয়ে যায়। এখানে হুকুম এসেছে তাঁর আনসার তথা সাহায্যকারী হওয়ার। তাই মুসলিম মাত্র আনসার হবে একমাত্র মহান আল্লাহর; সে কখনোই কোন জালেম শাসক, ফ্যাসিস্ট নেতা বা কাফির শক্তির সাহায্যকারী হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, আল্লাহতায়ালার কেন আনসারের প্রয়োজন দেখা দিল? এর কারণ, মহান আল্লাহতায়ালার রয়েছে নিজস্ব এজেন্ডা। সে এজেন্ডার কথাটি বলা হয়েছে সুরা সাফ’য়ের ৯ নম্বর আয়াতে। ঘোষিত হয়েছে:

    هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ

অর্থ: ‍তিনিই সেই মহান আল্লাহ যিনি হিদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ রাসূল প্রেরণ করেছেন এজন্য যে তার দ্বীন যেন সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী হতে পারে -যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে।”   

সুরা আনফালের ৭ নম্বর আয়াতে সে এজেন্ডার কথা ঘোষিত হয়েছে এভাবে:

يُرِيدُ ٱللَّهُ أَن يُحِقَّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦ وَيَقْطَعَ دَابِرَ ٱلْكَـٰفِرِينَ

অর্থ: “আল্লাহ চান, তিনি তার কালিমা (কুর’আন)’র সাহায্যে হক্ককে হক্ক রূপে প্রতিষ্ঠা দিবেন এবং কাফিরদের শিকড় কেটে দিবেন।”

উপরিউক্ত আয়াতে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার নিজের এজেন্ডা। সেটি লো তাঁর দ্বীনের বিজয় করার এবং কাফির তথা শয়তানী শক্তির নির্মূল। একাজটি তিনি ফেরেশতাদের দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে করতে পারতেন। কিন্তু ফেরেশতাগণ এ পৃথিবী পৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা নয়; এখানে তাঁর খলিফা হলো মানব। এ পৃথিবী পৃষ্ঠ গড়া হয়েছে মানবের জন্য পরীক্ষাস্থল রূপে। তিনি চান পরীক্ষায় উত্তীর্ণদেরকে জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করতে। এজন্যই ঈমানদারদের জন্য হোম ওয়ার্ক হলো তারা দায়িত্ব পালন করবে মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা ও আনসার রূপে।      

তাই মুসলিম হওয়ার অর্থ আমৃত্যু এক পরম দায়বদ্ধতা নিয়ে বাঁচা। সে দায়বদ্ধতাটি প্রতি পদে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচতে হলে এ ছাড়া ভিন্ন পথ নাই। আনসার হওয়ার অর্থ তো সৈনিক হওয়া। নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা কখনোই কোন সৈনিকের গুণ হতে পারে না। যারা আল্লাহতায়ালার আনসার হতে ব্যর্থ হয়, তারা হয় শয়তানের আনসার। সে পথটি বেঈমানীর ও জাহান্নামের। তাই ঈমানের চুড়ান্ত পরীক্ষাটি কখনোই কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাতে হয় না। সেটি হয় কে কোন পক্ষে দাঁড়ালো, যুদ্ধ করলো এবং প্রাণ দিল -তা থেকে। কুর’আন পাঠ, নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও দান-খয়রাত তো ঘুষখোর, সূদখোর, প্রতারক মুনাফিকদের জীবনেও থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে গুণটি থাকে না তা হলো, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সামর্থ্য।

বাংলাদেশে যারা নিজেদেরকে মুসলিম রূপে দাবী করে তাদের মধ্যে আল্লাহতায়ালার আনসার হওয়ার সামর্থ্যের অভাবটি অতি প্রকট। তারা বরং পরিণত হয়েছে শয়তানের আনসারে। তারা খেটেছে মুজিব, এরশাদ ও হাসিনাসহ সকল দুর্বৃত্ত শাসকের আনসার রূপে। তাদের কারণে তথাকথিত ১৬ কোটি মুসলিমের দেশে ইসলাম আজ পরাজিত। এবং দেশ অধিকৃত হয়েছে ইসলামবিরোধীদের হাতে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম যদি আল্লাহতায়ালার আনসার হতো তবে এ দেশে ইসলাম বিজয়ী হতো। তখন এ দেশের শাসনতন্ত্রে আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি পেত; আদালতে প্রতিষ্ঠা পতে তার শরিয়তী আইন এবং দুর্বার জিহাদ দেখা যেত মিথ্যা ও দুর্বৃত্তির নির্মূলে। সেটি না হওয়াতে সুস্পষ্ট বুঝা যায়, তারা ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহতায়ালার আনসার হতে।

আল্লাহতায়ালার আনসার হতে এ ব্যর্থতার কারণ, তারা ব্যর্থ হয়েছে মুসলিম হতে। আর মুসলিম হতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ, তারা ব্যর্থ হয়েছে পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনে। স্রেফ মুসলিম ঘরে জন্ম, ইসলামী পোষাক বা হালাল ভাত-মাছে বেড়ে হওয়াতে কেউ মুসলিম হয়না। চিকিৎসক হতে হলে অবশ্যই চিকিৎসা শাস্ত্রের বই পড়তে হয়, নইলে সেটি স্বপ্নই থেকে যায়। তেমনি মুসলিম হতে হলে অবশ্যই কুর’আনের জ্ঞান অর্জন করতে হয়। নইলে মুসলিম হওয়াটি নাগালের বাইরে থেকে যায়। কুর’আনের জ্ঞানশূণ্য ব্যক্তিটি শয়তানের আনসার হবে -সেটিই স্বাভাবিক। এজন্যই মহান আল্লাহতায়াল কুর’আনের জ্ঞানার্জন প্রতিটি মুসলিমের উপর ফরজ করেছেন -সেটি নামাজা-রোজা ফরজ করার  এক দশক আগে। আর শয়তান শক্তির কাজ স্কুল-কলেজে কুর’আন থেকে শিক্ষাদান বন্ধ করা। ইংরেজরা সে কাজটি করেছে বাংলার শাসনক্ষমতা হাতে পাওযার সাথে সাথে। ইংরেজদের খলিফাদের কারণে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে এখনো বেঁচে আছে সে অভিন্ন কুর’আনশূণ্য শিক্ষানীতি।  এজন্যই বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে শয়তানের আনসার তৈরীর কারখানায়। এজন্যই দেশের রাজনীতি, মিডিয়া, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, এনজিও ও সেনাবাহিনীতে শয়তানের আনসারদের সংখ্যা এতো অধিক।

দেশে শয়তানদের আনসারদের সংখ্যাটি বিপুল হওয়াতে মুজিব-এরশাদ-হাসিনার ন্যায় দুর্বৃত্তরা নিজেদের দলে বিপুল সংখ্যক সৈনিক পেয়েছে। অনুগত সেবক পাচ্ছে বিদেশী শত্রু শক্তিও। এবং একই কারণে মুজিবের ন্যায় একজন ইসলামের দুশমন, গণতন্ত্র হত্যাকারি প্রতারক এবং ভারতসেবী ফ্যাসিষ্টও জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধুর খেতাব পেয়েছে। অথচ দুর্বৃত্তপ্রেম ও আল্লাহপ্রেম কখনোই একত্রে চলে না।  দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ঘৃনার সামর্থ্য না থাকলে ঈমানদার হওয়াটাই অসম্ভব। তখন অসম্ভব হয় সত্যিকার মানব হওয়াও। কিন্তু সে সামর্থ্য একমাত্র তাদের মাঝেই গড়ে উঠে যাদের রয়েছে আল্লাহর ভয় ও পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান। কুর’আনের  জ্ঞানশূণ্য বেঈমানদের মাঝে সে সামর্থ্য কখনোই গড়ে উঠে না। পবিত্র কুর’আনে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালা শয়তানের আনসার এই বেঈমানদের গবাদীপশুর চেয়েও অধম বলেছেন। গবাদী পশু ঘাস খায় বটে, তবে দুর্বৃত্তদের পক্ষে কখনোই ভোট দেয় না, মিছিল করে না ও তাদের পক্ষে লাঠিও ধরে না। কিন্তু সেগুলি করে এই বেঈমানগণ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *