মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি এবং অর্জিত বিপর্যয়

ফিরোজ মাহবুব কামাল

অনৈক্যের নাশকতা

মুসলিম উম্মাহ আজ যে কারণে শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন -সেটি মুসলিম দেশগুলির ভূমি, জলবায়ু ও অর্থনীতির কারণে নয়। মূল কারণটি হলো অনৈক্য। সে অনৈক্যের কারণ হলো, মুসলিমদের মাঝে কুর’আনী জ্ঞানের অজ্ঞতা ও দেশগুলির উপর দুর্বৃত্ত শাসকদের দখলদারি। দেশ ও দেশবাসী চলে নেতাদের নির্দেশে। ফলে শাসকগণ ভ্রষ্ট, অযোগ্য, দুর্বৃত্ত ও বেঈমান হলে দেশবাসীও পথভ্রষ্ট হয়। তখন দেশে প্লাবন আসে দুর্নীতির। দুর্বৃত্ত শাসক ও নেতাদের সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্তিটি হয় ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতা ও দলের নামে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে। দেশবাসীকে বিভক্ত করার অর্থ উম্মাহকে দুর্বল করা। এজন্যই ইসলামের শত্রুশক্তির কাছে জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী ও বর্ণবাদীরা এতো প্রিয়। সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ থেকে তাই আরব বিশ্বকে ২২ টুকরোয় খণ্ডিত করে সেগুলির শাসন ক্ষমতায় গোত্রবাদীদের বসানো হয়েছে। এভাবেই বিভক্তির অবকাঠামোকে স্থায়ী রূপ দেয়া হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসকচক্রের কাছে এজন্যই এতো প্রিয় ছিল শেখ মুজিব এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা। কারণ তারা বাঙালি মুসলিমদেরকে বিভক্তির পথে নিতে পেরেছে। একই রূপ গাদ্দারির কারণে ব্রিটিশ সরকার থেকে মক্বার গাদ্দার গভর্নর শরিফ হোসেন শুধু রাজনৈতিক উস্কানিই পায়নি -অর্থ, অস্ত্র এবং সামরিক সহায়তাও পেয়েছিল। কারণ উসমানিয়া খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে ব্রিটিশ বাহিনীর কলাবোরেটর হয়েছিল।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন যত বিশালই হোক তাতে ক্ষুদ্র দেশের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি বাড়ে না। মাথা পিছু আয়ের দিক দিয়ে কাতার সমগ্র পৃথিবীতে প্রথম। কিন্তু সে আয়ের কারণে দেশটির শক্তি বাড়েনি। মাথা পিছু আয় আরো শতগুণ বাড়লেও কাতার কোন শক্তিশালী দেশে পরিণত হবে না। কারণ দেশটি ক্ষুদ্র। রাশিয়ার অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির চেয়েও দুর্বল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটি একটি বিশ্বশক্তি। দক্ষিণ কোরিয়া কখনোই সে মর্যাদা পাবে না। কারণ, রাশিয়ার রয়েছে বৃহৎ ভূগোল। সে বৃহৎ ভূগোলই দেশটিকে বিশ্বশক্তি বানিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের দাপট বিলুপ্ত হয়েছে; কারণ বিলুপ্ত হয়েছে তার বিশাল ভূগোল। একই কারণে বিশ্বরাজনীতিতে তুর্কীদের প্রভাবও বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া এখনো বিশ্বশক্তি রূপে টিকে আছে। কারণ টিকে আছে তার বিশাল ভূগোল।

তাই বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তি, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে হলে ভূগোল বাড়াতে ও বাঁচাতে হয়। ভূগোল ক্ষুদ্রতর করার অর্থ রাষ্ট্রকে শক্তিহীন, স্বাধীনতাহীন ও নিরাপত্তাহীন করা। তাই ইসলামে এটি হারাম। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল ও পরাধীন দেখতে চান না। উম্মাহ দুর্বল হলে খুশি হয় শয়তান এবং শয়তানের অনুসারী কাফেরগণ। মুসলিমদের তখন গোলামী নিয়ে বাঁচতে। মহান আল্লাহতায়ালার এজেন্ডা তখন শুধু কিতাবে থেকে যায়। একাত্তরের বাঙালি মুসলিম রাজাকরগণ ইতিহাসের সে মৌলিক পাঠটি বুঝতো। তাই তারা পাকিস্তানের অখণ্ড ভূগোল বাঁচাতে জিহাদে নেমেছিল। কিন্তু সে বোধ মুসলিম নামধারী বাঙালি জাতীয়তাবাদী ফ্যসিস্ট ও বামপন্থীদের ছিলনা। মক্কার শরিফ হোসেন ও বাংলার মুজিবের ন্যায় যারাই মুসলিম দেশের ভূগোল ছোট করেছে -তারা কখনোই মুসলিম উম্মাহর বন্ধু ছিল না। তারা ছিল শয়তানী শক্তির দাস; এদের বিজয়ী করতে শয়তানের অনুসারী পৌত্তলিকগণ তাই বাংলাদেশে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করেছে -এমনকি একাত্তরের তাদেরকে ক্ষমতায় বসাতে যুদ্ধও করেছে। একাত্তরের সে বিজয় নিয়ে তারা আজ একত্রে উৎসব করে।

কোন মুসলিম দেশ যদি ভেঙ্গে যায় এবং ভেঙ্গে যাওয়ার বেদনাটি কেউ যদি হৃদয়ে অনুভব না করে -তবে তার বেঈমান হওয়া নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। বিবেকের ভাণ্ডারে সামান্যতম ঈমান থাকলে মুসলিম দেশ ভাঙ্গার বেদনায় তার হৃদয়ে ক্রন্দন উঠতো। কারণ ঈমানদারের কাছে প্রিয় কেবল তার নিজের জীবন নয়, প্রিয় হলো মুসলিম দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতা। সে অখণ্ডতা বাঁচাতে সে যুদ্ধও করে। সে যুদ্ধ তার কাছে পবিত্র জিহাদ গণ্য হয়। সে ভূগোলের সামান্য সময়ের পাহারাদারি সারা রাত নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এবং সে বয়ান এসেছে হাদীসের কিতাবে। এজন্যই একাত্তরে কোন আলেম, কোন ইসলামী দলের নেতা, ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ কোন বুদ্ধিজীবী, কোন শিক্ষক এবং কোন পীর পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষ নেয়নি। পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রকল্পটি ছিল বাঙালি ফ্যাসিস্ট, বাঙালি বাম, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট ও পৌত্তলিক হিন্দুদের। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এদের শত্রুতা কোন গোপন বিষয় নয়। একাত্তরে ভারত বিজয়ী হওয়াতে ইসলামের এই পরিচিত শত্রুদের হাতেই বাংলাদেশ অধিকৃত হয়। নামায়-রোজা, হজ্জ-উমরাহ ঘুষখোর-সূদখোর মুনাফিকও পালন করতে পারে। নবীজী’র যুগে মুনাফিকগণ তাঁর পিছনে নামাজও পড়েছে। কিন্তু তারা কখনোই হৃদয়ে ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠতে পারিনি। সে অভিন্ন অবস্থাটি মুসলিম নামধারী বাঙালি সেক্যুলারিস্টদেরও। তারা পরিণত হয় মুসলিম উম্মাহর ঘরের শত্রুতে। এবং বন্ধু রূপে গৃহিত হয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী শিবিরে।

মুসলিম দেশের বৃহৎ ভূগোলের কল্যাণ হলো, তাতে সে রাষ্ট্রের মুসলিম নাগরিকগণ বিশ্বের বুকে বৃহৎ ভূমিকা পালনের সুযোগ পায়। বিশাল হাতির সামনে বাঘ-ভালুকও অসহায়। এজন্যই নবীজী ও তাঁর সাহাবীগণ রাষ্ট্রের ভূগোল বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং সে লক্ষ্যে বহু জিহাদ লড়েছেন। ১৯৪৭’য়ে সে অভিন্ন চেতনাটি কাজ করেছে বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের মাঝে। তাই তারা বিচ্ছিন্ন স্বাধীন বাংলার বদলে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দীন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুহাম্মদ আলী বোগরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে বিশ্বে যে সম্মান ও গুরুত্ব পেয়েছেন সেটি কি মুজিব, জিয়া, এরশাদ বা হাসিনা পেয়েছে? পায়নি। কারণ, পাকিস্তান ছিল সে সময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র।

শক্তি, মর্যাদা, ইজ্জত ও স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে হলে রাষ্ট্রের বৃহৎ ভূগোলের বিকল্প নাই। ভারতী হিন্দুত্ববাদীরা সেটি বুঝে। রাশিয়ান ও চীনারাও সেটি বুঝে। তাই তারা বাচিয়েছে নিজ দেশের বিশাল ভূগোলকে। কিন্তু সেটি বুঝেনি একাত্তরের বাঙালি কাপালিকগণ। তাই তারা নিজ দেশ পাকিস্তানের ভূগোলে হাত দিয়েছে। বৃহৎ ভূগোলের গুরুত্ব নবীজী ও তাঁর সাহাবাগণ বুঝতেন। বুঝতেন গৌরব যুগের মুসলিমগণ। তাই তারা মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ক্ষু্দ্র ইসলামী রাষ্ট্রকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ ব্যাপী বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ইসলামের সে আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি, বিহারী, অসমীয়, সিন্ধি, গুজরাতী, পাঠান, বেলুচ ও অন্যান্য মুসলিমগণ বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দেয়। পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি হওয়ার কারণে বাঙালি মুসলিমগণ সুযোগ পেয়েছিল বিশ্ব রাজনীতিতে -বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের। কিন্তু একাত্তরে যুদ্ধে পাকিস্তান খণ্ডিত হওয়ায় বাঙালি মুসলিমের রাষ্ট্র বাংলাদেশ এক নতুন পরিচয় পায়। সেটি হলো ভারতের পদতলে আত্মসমর্পিত এক আশ্রিত রাষ্ট্রের। তখন বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাব রাখা দূরে থাক, বাংলাদেশের কাজ হয় ভারতের হাতে পদ্মা-তিস্তাসহ ৫৪টি যৌথ নদীর পানি তুলে দেয়া, বুক চিরে করিডোর দেয়া, সড়ক পথ ও রেল পথ দেয়া এবং সমুদ্র বন্দরের সুবিধা দেয়া। সে সাথে ভারতীয় পণ্যের জন্য নিজ দেশের বাজার উম্মুক্ত করে দেয়া। অথচ ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি এই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতকে কিছুই দিতে হয়নি।

 

অর্জিত পরাজয়

বিভক্তি পরাজয় ও অপমান আনে এবং একতা বিজয় ও গৌরব আনে। মুসলিমগণ বিভক্ত, পরাজিত ও অপমানিত হয়ে সে সত্যকেই বার বার প্রমাণ করে চলেছে। ঈমান নিয়ে বাঁচা ও বেড়ে হওয়ার জন্য অপরিহার্য শুধু মহাপ্রভু  মহান আল্লাহতায়ালার পরিচয়কে জানা নয়, তাকে জানতে হয় শয়তান ও তার এজেন্ডাকেও। এ জীবনে সফল হওয়ার জন্য এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্যই পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা শুধু তাঁর নিজের পরিচয়টি পেশ করেননি, বার বার পেশ করেছেন শয়তানের পরিচয় এবং তার এজেন্ডার কথা। যাতে মানব সন্তানেরা শয়তানের জালে আটকা পড়া থেকে বাঁচে। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য অতি জরুরি হলো সেটি। মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের একতা চান; এবং শয়তান চায় বিভক্তি। মুসলিমদের আজকের বিভক্তি এটাই প্রমাণিত করে, তারা মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ তাদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পায়নি। তারা পূরণ করছে শয়তানের ইচ্ছাকে। ইতিহাসের কোন পর্বেই মুসলিমগণ শত্রুমুক্ত ছিল না। মানব সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই অভিশপ্ত শয়তান পিছনে লেগেছে। সেটি হযরত আদম(আ:)কে সিজদা করতে অস্বীকার মধ্য দিয়ে। মানবের আদি পিতাকে জান্নাত থেকে বের করেই শয়তান ক্ষান্ত দেয়নি। এখন তার এজেন্ডা, মানব সন্তানদের শুধু জাহান্নামে নেয়া নয়, বরং দুনিয়াকেও জাহান্নামে পরিণত করা। এজন্যই শয়তান ভাষা, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি পরিচয়ে মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি গড়ে এবং পরস্পরে ঘৃণা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাতের জন্ম দেয়। এভাবে শয়তান ইহকালীন এ জীবনকেও অশান্তিময় করে।

তবে ইতিমধ্যেই যারা জাহান্নামের পথযাত্রী –শয়তান তাদের নিয়ে ভাবে না। শয়তানের লক্ষ্যবস্তু তো তারা, যারা নিজেদেরকে মুসলিম বা ঈমানদার রূপে দাবী করে। শয়তান তাদেরকেও জাহান্নামে নিতে চায়। ঈমান নিয়ে বাঁচার বিপদ এখানেই। এজন্যই ঈমান আনার সাথে সাথেই ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই শয়তানের টার্গেটে পরিণত হয়। মু’মিনের সামনে তাই দুটি পথ: এক). শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণের; দুই). শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের। আত্মসমর্পণের পথটি নিশ্চিত জাহান্নামের। জান্নাতকামী ঈমানদারকে এজন্যই শয়তান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই নিয়ে বাঁচতে হয়। সে অবিরাম লড়াই ছাড়া শয়তানের পথ থেকে বাঁচার ভিন্ন পথ নাই। মুসলিম জীবনে সে লড়াইটিই হলো জিহাদ। একারণেই মুসলিম জীবনে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাতের ন্যায় জিহাদকেও ফরয় করা হয়েছে। জিহাদ ছাড়া সিরাতাল মুস্তাকিমে এগুনো অসম্ভব।

যেখানে ঐক্যবদ্ধ জিহাদ নাই, শয়তানের অনুসারীগণ সেখানে বিনাযুদ্ধে বিজয়ী হয়। স্রেফ নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিল দিয়ে শয়তানী শক্তির সে বিজয় রুখা যায় না। সে জিহাদ না থাকায় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে পরাজয়টি মুসলিমদের। এবং বিজয় এসেছে ইসলামের শত্রুদের। মুসলিম দেশগুলোতে শয়তানী শক্তির বিজয় এবং মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তী আইনের বিলুপ্তির কারণ বহুবিধ। তবে মূল কারণ দুটি: এক). অনৈক্য, দুই). জিহাদশূণ্যতা। মুসলিমগণ বাঁচছে শুধু শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণ নিয়ে নয়, বরং নিজেদের অর্থ, মেধা, রক্ত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যের বিনিয়োগ করছে শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করতে। ফলে মুসলিম ভূমিতে পরাজিত হয়েছে ইসলাম এবং বিলুপ্ত হয়েছে শরিয়ত। নিজেদের মুসলিম রূপে দাবী করলেও ইসলামকে বিজয়ী করার ভাবনা তাদের মাঝে নাই। অথচ মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মুসলিমদের মূল পরিচয়টি হলো তাঁর পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত খলিফার তথা প্রতিনিধির। মুসলিম জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি হলো তাঁর খলিফা রূপে বাঁচায়। বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলিম যদি তাঁর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালন করতো -তবে কি শয়তানের খলিফাগণ মুসলিম দেশগুলোতে বিজয়ী হতো? বিলুপ্ত হতো কি শরিয়ত? তাদের উপর ফরজ করা হয়েছিল জিহাদ এবং সে সাথে ফরজ করা হয়েছিল জিহাদে সিসাঢালা দেয়াল-সম একতাবদ্ধ হওয়া। অথচ তারা বেছে নিয়েছে আত্মঘাতী বিভক্তির পথ।

শত্রুশক্তির অবিরাম ক্রুসেড চলছে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে। সে ক্রসেড কোন একক মুসলিম দেশে সীমিত নয়; সেটিই এখন বিশ্বময়। কোথাও হচ্ছে সেটি সামরিক আগ্রাসন রূপে -যেমন ফিলিস্তিন, কাশ্মির, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও আরাকানে, উইঘুর, লেবানন ও চেননিয়ায়। কোথাও হচ্ছে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বেশে –যেমন বাংলাদেশে। সামরিক ক্রসেডে বহু লক্ষ নিরপরাধ মানুষ মারা পড়ছে অধিকৃত মুসলিম দেশগুলোতে। অপর দিকে অসামরিক ক্রসেডে হিজাব নিয়ে রাস্তাঘাটে বিপদে পড়ছে ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসকারি মুসলিম মহিলারা। এবং জানমাল, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইজ্জত-আবরু নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হচ্ছে ভারত, মায়ানমার, থাইলান্ড, চীন, ফিলিপাইনসহ বহু অমুসলিম দেশে বসবাসকারি বহু কোটি মুসলিমের। ভারতে শুধু দাড়ি রাখা ও টুপি রাখার দায়ে রাস্তায় চড়-থাপ্পড় খেতে হয় ভারতীয় মুসলিমদের। ঈমান-আক্বীদা, ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠাকে বন্ধ করতে চীনে প্রায় ১০ লাখ মুসলিমকে তোলা হয়েছে প্রশিক্ষণ শিবিরের নামে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেগুলো আসলে ডি-ইসলামাইজেশন সেন্টার। মায়ানমার সরকার ঘরবাড়ীতে আগুন দিয়ে প্রায় ১০ লাখ মুসলিমকে আপন ভিটামাটি থকে বিতাড়িত করেছে। দেশটিতে ভয়ানক যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে, কিন্তু সে অপরাধে কাউকে আদালতে তোলা হচ্ছে না। মুসলিম উম্মহ হলো একটি দেহের মত; দেহের এক অঙ্গে আঘাত লাগলে সমগ্র দেহে ব্যাথায় কেঁপে উঠে। তাই বিশ্বের কোন প্রান্তে মুসলিমকে নিহত ও নির্যাতিত হতে দেখেও যদি হৃদয়ে ব্যাথা না উঠে -তবে নিশ্চিত করেই বলা যায় সে ব্যক্তি মুসলিম নয়। সে চ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুসলিম উম্মাহ থেকে।

মহান আল্লাহতায়ার খাতায় যারা নিজেদেরকে মুসলিম রূপে তালিকাভূক্ত করতে চায় -তাদের উপর অর্পিত হয় কিছু অলংঘনীয় দায়ভার। সে দায়ভার পালনের মধ্য দিয়ে তাঁকে জান্নাতের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। মু’মিনের উপর সে দায়ভারটি হলো, দেশের আদালতে মহান আল্লাহর আইন তথা শরিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়া। একমাত্র তখনই আল্লাহতায়ালার জমিনে প্রতিষ্ঠা পায় তাঁর নিজের সার্বভৌমত্ব। খলিফার অধিকার নাই সার্বভৌম হওয়ার; এ অধিকার একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। খলিফার থাকে না আইন প্রণোয়নের অধিকারও; সে অধিকারটিও একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালার। “মা হুকমু ইল্লা লিল্লাহ” অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কারোই নাই হুকুম (আইন) দেয়ার হক। শরিয়ত ভিন্ন অন্য আইনে আদালতে বিচার করা হারাম; তাতে অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রকাশ হয় মহান আল্লাহতায়ালার বিধানের বিরুদ্ধে। উমাইয়া, আব্বাসীয়া ও উসমানিয়া খলিফাগণ এবং ভারতের মোঘল ও সুলতানী শাসকগণ তাদের আদালেত শরিয়তের শাসন চালু রেখেছিলেন নিষ্ঠার সাথেই। নবাব সিরাজুদ্দৌলার শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় শরিয়তী আইনের শাসন ছিল। আদালত থেকে আল্লাহতায়ালার আইন সরানোর ন্যায় কুফরী কাজটি সে আমলের কোন মুসলিম শাসকই করেননি। সেটি হয়েছে ঔপনিবেশিক কাফেরদের হাতে মুসলিম ভূমি অধিকৃত হওয়ার পর। বাংলাদেশ সরকারের অপরাধ: তারা বহাল রেখেছে কাফেরদের প্রণীত ইসলাম বিরোধী আইনকে। ইসলামের বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় গাদ্দারী আর কি হতে পারে? এ অপরাধ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। আর জনগণের অপরাধ: রাজস্ব জুগিয়ে প্রতিপালন দিচ্ছে ইসলামবিরোধী শাসকচক্রকে। ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে কোটি কোটি নামাজী-রোজাদার থাকা সত্ত্বেও বিজয়ী হয়েছে শয়তানী এজেন্ডা। তবে ক্ষমতাসীন সেক্যুলারিস্টদের অপরাধ শুধু শরিয়তী আইনের বিলুপ্তি নয়; বরং ভাষা, দল ও অঞ্চলের নামে বিভক্তি গড়ার অপরাধটিও তাদের।

বিভক্তি উম্মাহ এবং শত্রুর নাশকতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, রাশিয়া ও ভারতের ন্যায় শত্রুর রাষ্ট্রগুলির সামনে কোন রেড লাইন নাই। যা ইচ্ছা তাই তারা করতে পারে। একমাত্র সামরিক শক্তিকেই তারা ভয় করে। কিন্তু বিভক্তি উম্মাহর সে শক্তি নাই। ফলে তারা মুসলিম ভূমিতে অপ্রতিরোধ্য। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আধুনিক ক্রুসেডে ১০ লাখের বেশী মানুষকে নির্মম হত্যা করা হয়েছে একমাত্র ইরাকে। বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আফগানিস্তানে। হত্যাকান্ড হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে সিরিয়ায়। মার্কিন বাহিনীর বিমান, মিজাইল ও ড্রোন আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া এবং ইয়েমেনের বহু হাজার ঘর ও বহু শত গ্রামকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। মার্কিনীগণ তাদের হাতে নিহত মুসলিমদের মৃতদেহ গণনা করে না। কারণ, মুসলিম জনগণ তাদের কাছে যেন মশামাছি। মৃত মশামাছির সংখ্যা কেউ গণনা করে না। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তার বক্তৃতায় ক্রুসেড রূপে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে চলমান এ ক্রসেডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একা নয়। সহচর শুধু ইসরাইল এবং ইংল্যান্ডও নয়। যোগ দিয়েছে ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, ডেনমার্ক, হলান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজল্যান্ড, পোলান্ড, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিকসহ বহু দেশ। মুসলিম বিরোধী এ ক্রসেডটি এখন বহুজাতিক প্রজেক্ট। সিরিয়া ও লিবিয়াতে হাজির হয়েছে রাশিয়াও।

শত্রুগণ যেখানে একতাবন্ধ, মুসলিমগণ সেখানে বিভক্ত। একটি বিভক্ত জাতিকে ধ্বংসের জন্য বড় রকমের শক্তি লাগে না; ক্ষুদ্র শক্তিও তাদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে পারে। মুসলিমগণ যখনই বিভক্ত হয়েছে, মহাবিপদ তখনই তাদের ঘাড়ের উপর এসে হাজির হয়েছে। এমনই এক প্রেক্ষাপটে হালাকু খাঁ তার সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুসলিম রক্তে দজলা-ফুরাতের পানিকে লাল করেছে। অথচ মঙ্গলদের সমুদয় জনসংখ্যা বাগদাদ বা দামেস্কের ন্যায় একটি শহরের সমান ছিল না। কিন্তু তাদের ছিল ঐক্য; এবং মুসলিমগণ ছিল বিভক্ত। একটি বৃহৎ জাতিকে শক্তিহীন করার জন্য অনৈক্যই যথেষ্ঠ। দেয়ালের মাঝ থেকে সিমেন্ট সরে গেলে ইটগুলো শিশুও খুলতে পারে। দেওয়াল তখন সামান্য ধাক্কাতেই বিধ্বস্ত হয়। মার্কিন কোয়ালিশন এখন সে সামান্য ধাক্কা দেওয়ার কাজটিই করছে।  ফলে মুসলিম নিধনে বা মুসলিম-ভূমি দখলে নিতে তাদের তেমন শক্তিহানি ও রক্তক্ষয় হয় না। অনৈক্যের কারণেই সামান্য সংখ্যক ইংরেজের হাতে ভারতের মুসলিমগণ স্বাধীনতা হারিয়েছিল। একই কারণে পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মিরের মুসলিমগণ অতীতে পরাজিত, ধর্ষিতা ও নিহত হয়েছিল মুষ্টিমেয় শিখদের কাছে।

অনৈক্য মুসলিমদের জন্য যে কতটা ভয়ানক – মহাজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার চেয়ে সেটি আর কে বেশী জানে? তিনিই তো মুসলিমদের প্রকৃত বন্ধু। তাদের জন্য পরকালে যেমন জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন, তেমনি দুনিয়াতেও তাদেরকে তিনি বিজয়ী ও সন্মানিত দেখতে চান। সে বিজয় কীরূপে অর্জন করতে হয় -সে পথও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। সেটি ঐক্য এবং জিহাদের পথে। পবিত্র কুর’আনে তাই নির্দেশ দিয়েছেন,

وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟ ۚ وَٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَآءًۭ فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِۦٓ إِخْوَٰنًۭا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍۢ مِّنَ ٱلنَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ لَكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ١٠٣

অর্থ: “এবং তোমরা আল্লাহর রশি (কুর’আন)’কে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। এবং স্মরণ করো তোমাদের উপর বর্ষিত আল্লাহর সে নিয়ামতকে -যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে, অতঃপর বন্ধন গড়া হলো তোমাদের হৃদয়ের মাঝে এবং তাঁর নিয়ামতের বরকতে তোমরা পরস্পরে ভাই হয়ে গেলে। এবং তোমরা তো ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর সেখান থেকে তোমাদের উদ্ধার করা হলো, এভাবেই আল্লাহ তাঁর আয়াতকে তোমাদের জন্য সবিস্তারে বর্ণনা করেন -যাতে তোমরা হিদায়েত পাও।  ”  -(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩)। উপরুক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বিভিক্তির পথে যেতে নিষেধ করেছেন। আর আল্লাহতায়ালা যা নিষেধ করেন, তা সাথে সাথে হারাম হয়ে যায়। তাই মদ পান, সূদ, জুয়া, জ্বিনা বা মানব হত্যা যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি করা। তাই অনৈক্যের প্রতিটি পথই হলো মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ। সে সাথে সেটি নিশ্চিত পরাজয়ের পথও। কারণ হারাম পথে তথা বিভক্তির পথে চলার অর্থ বিদ্রোহের পথে চলা। আর বিদ্রোহীদের তিনি কখনোই পরকালে জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করেন না।  

                                              

বিভক্তি আনে প্রতিশ্রুত আযাব

বিভক্তিতে অনিবার্য হয় আযাব। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে ঘোষণাটি হলো:

وَلَا تَكُونُوا۟ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُوا۟ وَٱخْتَلَفُوا۟ مِنۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلْبَيِّنَـٰتُ ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌۭ

অর্থ: “তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা নিজেদের কাছে সুস্পষ্ট ঘোষনা আসার পরও বিভক্তি হলো এবং পরস্পরে মতবিরোধ গড়লো। এরাই হলো তারা যাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে কঠিন আযাব।” –(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)। বিষ পানে মৃত্যু অনিবার্য। বিষপানকারীকে বাঁচানো তাই মহান আল্লাহপাকের সূন্নত নয়। এমন ব্যক্তির মৃত্যু না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। অনৈক্যও তেমনি জাতির, পরাজয়, পতন ও আযাব ডেকে আনে। পবিত্র কুর’আনে সেটি সুস্পষ্ট জানিয়ে দেওয়ার পরও যারা বিভক্তির পথকে বেছে নেয় -তাদের উদ্ধার করাও মহান আল্লাহতায়ালার নীতি নয়। বরং পবিত্র কুর’আনে ঘোষিত তাঁর নীতিটি হলো, তাদের উপর আযাবকে অনিবার্য করা। ফলে সে প্রতিশ্রুত শাস্তিটি না আসাটিই বরং অস্বাভাবিক। তাই মুসলিম দেশে শত্রুশক্তির হামলা, এবং সে হামলায় পরাজয়, গণনিধন, ধর্ষণ, শোষন ও নানাবিধ অত্যাচার – এগুলো মূলত প্রতিশ্রুত আযাব। সেগুলো এসেছে তাদের নিজ হাতের কামাই রূপে।

মুসলিমগণ এমন এক জাতি যারা একতা ছেড়ে বিভক্তির পথ ধরেছে বহু আগেই। তারা বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ, ভূগোল, অঞ্চল, মজহাব, ফেরকা, দল, এমনকি জেলাওয়ারী পরিচয় নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তি গড়াকে নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে। ভিন্নভাষী মুসলিমদের অর্থলুটই শুধু নয়, তাদেরকে হত্যা করা, তাদের ঘরবাড়ী দখল করা এবং তাদের নারীদের ধর্ষণকেও তারা আচারে পরিণত করেছে।

এমন এক ট্রাইবাল চেতনার নাশকতা থেকে মুক্ত নয় এমনকি পবিত্র মক্কা মদিনার পূর্ণভূমিও। ইসলামপূর্ব যুগের বর্বর জাহেলরাও নিজেদের গোত্রের নামে হেজাজের পবিত্র ভূমির নাম রাখেনি। এমন কাজ তাদের কাছেও রুচিহীন লেগেছে। কিন্তু আজকের সৌদি স্বৈর-শাসকেরা সেটিকেও হার মানিয়েছে। ইসলামের পবিত্র ভূমির নাম সৌদি আরব রেখে তারা প্রমান করেছে, তাদের অঙ্গীকার নিজ পরিবার ও গোত্রের প্রতি কত গভীর। নিজেদের গোত্রীয় শাসনকে বাঁচাতে হেজাজের পবিত্র ভূমিতে মার্কিনী কাফির বাহিনীকে ডেকে আনাটিও অপরাধযোগ্য মনে হয়নি। মুসলিম দেশে রাজতন্ত্র এই প্রথম নয়। উমাইয়ারা এসেছে, আব্বাসীয়ারা এসেছে, উসমানিয়ারাও এসেছে। তবে ইসলামের পবিত্র ভূমিতে কাফের সৈন্যদের ঘাঁটি নির্মাণের কাজ এই প্রথম। অথচ মুসলিম বিশ্বের কোথাও মুসলিমদের মাঝে সৌদি স্বৈর-শাসকদের সে হারাম কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেনি। নিন্দাবাদও হয়নি। বরং সে পবিত্র ভূমির স্বৈর-শাসকদের কাছে বিশ্বাসভাজন হওয়ার নেশাই তাদের মাঝে প্রচণ্ড। এমনকি সে বিষাক্ত চেতনাটি সংক্রামিত হয়েছে মুসলিশ বিশ্বের আলেম, নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের চেয়ে তারা বরং স্বৈরাচারী রাজাদের উপঢৌকন লাভকেই জীবনের বড় উপার্জন ও সম্মান মনে করেছে। শুধু আরবদের জন্যই নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্যও কি এটি কম অপমানকর যে মক্কা-মদীনার ন্যায় ইসলামের পূণ্য ভূমি আজ মার্কিন যুক্তরাষ্টের কাছে আত্মসমর্পিত একটি রাজশক্তির কাছে জিম্মি। মুসলিমদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দিস হাতছাড়া হয়েছে একই কারণে। নিজেদের প্রতিরক্ষায় যারা অসমর্থ এবং যাদের আত্মসমর্পণ অমুসলিম শাসকদের কাছে, পবিত্র ভূমির প্রতিরক্ষার দায়িত্ব-পালন কি তাদের দ্বারা সম্ভব?

ভাষা, ভূগোল ও গোত্র-ভিত্তিক জাতীয় ও উপজাতীয় অপচেতনার আধিপত্য শুধু হেজাজেই নয়, এটি জেঁকে বসেছে সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে। এরূপ দূষিত ও সংক্রামক চেতনার প্রভাবেই মুসলিম উম্মাহ আজ ৫০টির বেশী টুকরোয় বিভক্ত। হিন্দুদের জন্য ঐক্য কোন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়। কিন্তু তারপরও তারা ঐক্যবদ্ধ। ভারতে ১০০ কোটির বেশী হিন্দু নানা ভাষা, নানা অঞ্চল ও নানা বর্ণে বিভক্ত হওয়া সত্বেও একতাবদ্ধ। তারা একশত তিরিশ কোটি মানুষের একটি বিশাল দেশ গড়ছে। ফলে ভারত আজ বিশাল সামরিক শক্তি। বিশ্বের সকল রাষ্ট্র তাদের সমীহ করে চলে। কারণ, শক্তির কাছে কে না নরম? ভারতের এ শক্তি ও মর্যাদার কারণ সম্পদ নয়। বরং ভারতেই বাস করে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠি। তাদের এ শক্তির কারণ তাদের একতা। হাজার খানেক বাঁশের কঞ্চি একত্রিত হলে হাতিও তা ভাঙ্গতে পারে না। ভারতের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে। অথচ সংখ্যায় ১৫০ কোটি হয়েও মুসলিমগণ ভারতের সিকি ভাগ জনসংখ্যার একটি দেশও গড়তে পারেনি। শক্তি ও মান-মর্যাদায় নীচে নামার ক্ষেত্রে মুসলিমগণ পৌত্তলিক হিন্দুদেরও ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমদের ব্যর্থতা যাচায়ের এর চেয়ে বড় মানদন্ড কি হতে পারে? একসাথে মিলে মিশে ভদ্রভাবে বসবাসের সামর্থ্য যারা রাখে না, তারা কি কোথাও বিজয় ও ইজ্জত পায়?

 

দখলদারীটি মনের ভূগোলে

জনগণের মনের ভূগোলই রাজনৈতিক ভূগোল নির্মাণ করে। শক্তি, নিরাপত্তা ও ইজ্জত নিয়ে বাঁচার জন্য বৃহৎ ভূগোলের বিকল্প নাই। এবং যারা সেটি চায় তারা সে জন্য জনগণের মনের ভূগোল গড়ায় হাত দেয়। একতায় আগ্রহ বাড়ায়। যে জাতির মনের ভূগোল জুড়ে জাতীয়, উপজাতীয়, গোত্রীয়, ভাষাগত, দলীয় চেতনার তান্ডব, তারা কি কখনো বৃহৎ ভূগোল নির্মাণের গৌরব পায়? পায় কি বৃহৎ শক্তির মর্যাদা? পায় যে না -সেটিরই বড় প্রমাণ আজকের মুসলিমগণ। মুসলিম হওয়ার অর্থ শুধু এ নয় যে, সে মসজিদে যাবে বা হজ্জ করবে। বরং অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমের সাথে একত্রে বসবাস, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক গুণটিও অবশ্যই অর্জন করবে। শক্তি, সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে বাঁচার জন্য সে সামর্থ্যটি অপরিহার্য। নামাজ-রোজা নামাজ-রোজার কাজ করে। কিন্তু মান-সম্মান ও বিজয় নিয়ে বাঁচার জন্য তো তাই একতা ও জিহাদ। নানাভাষা ও নানা বর্ণে বিভক্ত ভারতীয় হিন্দুদের যেমন একতা আছে, তেমনি যুদ্ধও আছে। সে দুটি গুণ মার্কিনীদেরও আছে। মুসলিমদের মাঝে সে সামর্থ্যটি নাই বলেই তারা পরাজিত, অধিকৃত ও অপমানিত। এ ব্যর্থতা বিপুল হারে নামাজ-রোজা পালন ও মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে দূর হবার নয়। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি বা জনসংখ্যা বাড়িয়েও দূর হবার নয়। সারা রাতের নফল নামাজ কল্যাণ দেয় না, যদি না প্রতিদিনের ফরজ কাজগুলো সঠিক ভাবে পালিত না হয়। অতি গুরুত্বপূর্ণ সে ফরজটি হলো মুসলিমদের মাঝে একতা গড়া। একতার বিকল্প একমাত্র একতাই। কিন্তু সে ফরজ পালিত হয়নি। হয়নি বলেই মুসলিমদের আজ এ বিপন্ন দশা।

সারা জীবন রোজা রাখলেও তা দিয়ে নামাজের ফরজ আদায় হয়না। তেমনি একতা প্রতিষ্ঠার যে ফরজ -সেটি সারা জীবন নামাজ-রোজায় আদায় হয় না। একই কারণে বিভক্তি গড়ায় যে পাপ সেটি সারা জীবন নামাজ-রোজায় দূর হয়না। এ পাপ নিয়ে বিজয় ও ইজ্জত জুটেনা। তাতে ইহকালে জুটে পরাজয় ও অপমান। এবং পরকালে জুটে কঠিন আযাব। মুসলিম দেশগুলোতে নামাজীর সংখ্যা কি কম? তাসবিহ-তাহলিল করে এমন লোকের সংখ্যাই কি কম? কিন্তু তাতে মুসলিম বিশ্বের কোথাও কি গৌরব বেড়েছে? এসেছে কি বিজয়? অন্য ধর্মের মানুষেরা ইতিহাস গড়েছে ভাষা, বর্ণ, গোত্র, দল ও আঞ্চলিক ভিন্নতা সত্ত্বেও একত্রে একই ভূগোলে বসবাস, রাজনীতি ও যুদ্ধবিগ্রহে। কিন্তু মুসলিমগণ ইতিহাস গড়ছে কলহ-বিবাদ ও আত্মঘাতী সংঘাতে। দেশের ভূগোল ভাঙ্গার কাজকে তারা উৎসবে পরিণত করছে। ভাঙ্গা নিয়েই মুসলিমদের অহংকার ও উৎসব। মুসলিম দেশকে ভেঙ্গে জাতি ও অঞ্চল পূজার প্রবৃত্তিকে খুশি করা যায়। আগ্রাসী শত্রুশক্তিকেও খুশি করা যায়, কিন্তু একটি মুসলিম দেশ ভেঙ্গে কি মহান আল্লাহতায়ালাকেও খুশি করা যায়?

মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুর’আনে ৫ শত বারেরও অধিক চিন্তাভাবনার নির্দেশ দিয়েছেন। নবীজী (সা:) চিন্তাভাবনাকে উত্তম ইবাদত বলেছেন। যারা চিন্তা ভাবনা করে তারাই অতীতের ভ্রান্তিগুলো থেকে শিক্ষা নেয় এবং সিরাতাল মুস্তাকীমে ফিরে আসে। ইতিহাস জ্ঞান তাদের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান মনে হয়। যাদের মধ্যে প্রজ্ঞা ও চিন্তাভাবনা নেই তারাই অতীতের অপরাধগুলি নিয়ে উৎসব করে। একবার পথহারা হলে চিন্তাশূণ্যরা আর কখনোই সঠিক পথে ফিরে আসে না। ভ্রান্ত পথে চলাটাই তখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, বাঙালি মুসলিমগণ ইতিহাস গড়েছে চিন্তাশূণ্যতায়। এরই ফলে শেখ মুজিবের ন্যায় ভারতীয় এজেন্ট, গণতন্ত্র হত্যাকারী বাকশালী এবং নৃশংস ফ্যাসিস্টও তাদের কাছে শ্রদ্ধেয়। গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার নিয়ে যারা বাঁচতে চায় তারা কি কখনো এমন অপরাধীকে সন্মানের আসনে বসায়?

                                    

দায়িত্বটি প্রতিটি ঈমানদারের

ঈমান নিয়ে বাঁচার অর্থ শুধু নিজের পরকালীন কল্যাণ নিয়ে বাঁচা নয়; বরং মানব জাতির কল্যাণ ও ইসলামের বিজয় আনার দায়িত্ব নিয়ে বাঁচা। নইলে ঈমানের অর্থ থাকে না। যার মধ্যে সে দায়িত্ববোধ নাই, বুঝতে হবে তার মধ্যে ঈমানও নাই। দায়িত্ব নিয়ে বাঁচলে জিহাদ আসে, একতা আসে, ইসলামী রাষ্ট্র আসে, বিজয় আসে এবং সে সাথে নিরাপত্তা ও ইজ্জতও আসে। তখন প্রেরণা আসে -যাতে পরাজয় ঘটে তা থেকে সতর্কতার সাথে বাঁচার। ফলে সে বাঁচে অনৈক্য ও বিবাদ থেকে। সাহাবাগণ মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হতে পেরেছিলেন তো সে দায়িত্ব নিয়ে বাঁচার কারণেই। সে দায়িত্ব পালনে শতকরা ৬০ ভাগের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। আজকের মুসলিমদের পরাজয়ের মূল কারণ, তাদের দায়িত্বহীন জীবন। দায়িত্বহীন জীবনে জিহাদ ও কুরবানী  থাকে না। বরং পরাজয়, গোলামী ও অপমান নিয়ে বাঁচা তখন সহনীয় ও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবতা হলো, মুসলিম জীবনে সে দায়িত্বহীনতাই আজ প্রকট। এরূপ পরাজয় ও অপমান থেকে বাঁচার একটিই মাত্র পথ: সেটি হলো প্রতিটি মুসলিমকে ঈমানী দায়িত্ব নিয়ে বেড়ে উঠা। সে দায়িত্বশীলতার মূল কথা, মহান আল্লাহতায়ালার খলিফা রূপে বাঁচা। তখন নিজ খলিফাদের সাহায্য করা মহান আল্লাহতায়ালার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

দেশে দেশে মুসলিমগণ আজ যেরূপ বিপন্নদশার মুখোমুখী -তা থেকে বাঁচাতে অন্য কেউই এগিয়ে আসবে না। সাম্প্রতিক ইতিহাসই তার বড় প্রমাণ। বসনিয়ার মুসলিমগণ যখন লাখে লাখে নিহত হলো এবং বহু হাজার ধর্ষিতা হলো -তখন কেউ এগিয়ে যায়নি। বরং জাতিসংঘের ডাচ সৈনিকগণ এগিয়ে গিয়ে সার্ব ঘাতকদের হাতে প্রায় ৭ হাজার নিরস্ত্র মুসলিমকে তুলে দিয়েছিল। এবং নৃশংস ভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারনে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব পাশ করেও জাতিসংঘ কিছুই করেনি। বরং আজও ভারতের গণহত্যাকে নিরবে সমর্থণ দিচ্ছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের চোখের সামনেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, কাশ্মির, ভারত ও মায়ানমারে।

আযাব কোন দেশেই নোটিশ দিয়ে হাজির হয় না। বসনিয়াতেও নোটিশ দিয়ে আসেনি। আরো লক্ষণীয় হলো, দেশে দেশে কোটি কোটি মুসলিমের দীর্ঘ দীর্ঘ দোয়া সত্ত্বেও মুসলিমদের উপর দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য নেমে আসেনি। কারণটি সুস্পষ্ট। বিভক্ত, পথভ্রষ্ট, দায়িত্ত্বহীন ও ইসলামে অঙ্গীকারহীন জনগোষ্ঠির বিজয়ে সাহায্য পাঠানো মহান আল্লাহতায়ালার সূন্নত নয়। বরং তাঁর সনাতন সূন্নতটি হলো আযাব পাঠানো। সেটিই বার বার ঘোষিত হয়েছে পবিত্র কুর’আনে। তবে এ আযাবের এখানেই শেষ নয়। শেষটি এর চেয়েও ভয়ানক হতে পারে। তখন কাফেরদের মতা বেশ ভূষা, তাদের আদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ এবং তাদের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েও রক্ষা মিলবে না। বাংলাদেশের মুসলিমগণ ভারতের সাথে বন্ধুত্ব করেছে। ভারতের সাথে ১৯৭১’য়ে তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এক সাথে যুদ্ধ করেছে, সে যুদ্ধে ভারতকে বিজয়ীও করেছে –কিন্তু তারপরও সে দেশটির হাতে নৃশংস লুন্ঠন ও আধিপত্য থেকে মুক্তি পায়নি। রক্ষা পাচ্ছে না বাংলাদেশের ৫০টির অধিক নদীর পানি। ভারতীয় লুন্ঠনের কারণেই বাংলাদেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এসেছিল এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পেয়েছিল তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির খেতাব। বাংলাদেশে যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না এবং ছিল না কোন কল-কারখানা -তখনও আন্তর্জাতিক মহলে এরূপ কলঙ্কযুক্ত খেতাব জুটেনি।

 

একমাত্র ভরসা

মুসলিমদের একমাত্র ভরসা মহান আল্লাহতায়ালা। একমাত্র তিনি এ বিপন্নদশা থেকে বাঁচাতে পারেন। অতএব উপায়, মহান আল্লাহতায়ালার সে সাহায্যলাভে সর্বশক্তি দিয়ে মনযোগী হওয়া। সে সাহায্যলাভের পথ কোনটি সেটিও পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহতায়ালা অতি সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের সাহায্যে অতিশয় উদগ্রীব। তাঁর বিশাল ফেরেশতা বাহিনী এজন্য সদাপ্রস্তুত। হযরত মুসা (আ:)’র নিরস্ত্র জনগণকে তিনিই ফিরাউনের বিশাল বাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাদের জন্য সমুদ্রের বুক চিরে রাস্তা গড়েছেন এবং ডুবিয়ে মেরেছেন ফিরাউন ও তার বাহিনীকে। হযরত ইউনুসকে (আ:) তিনিই তিমি মাছের পেট থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তিনিই বাদশাহ আবরাহার বিশাল বাহিনীকে ধ্বংস করে অরক্ষিত ক্বাবাকে বাঁচিয়েছিলেন। গাছের একটি শুকনো পাতাকে মাটিতে ফেলা যতটা তুচ্ছ, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে ততটাই তুচ্ছ হলো ফেরাউনের ন্যায় কোন রাজার বিশাল বাহিনীকে ধ্বংস করা। এ যুগের নব্য ফেরাউনরাও এর ব্যতিক্রম নয়। মহান আল্লাহপাক আজও সে সাহায্যদানে প্রস্তত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সে সাহায্যলাভে আগ্রহী বান্দা কই? প্রস্তুতিই বা কই? নিশ্চয়ই তিনি এমন কোন বাহিনীকে সাহায্য করেন না যারা শয়তানের বাহিনীকে মুসলিম ভূমিতে ডেকে আনে এবং সেখানে ঘাঁটি নির্মাণের অধিকার দেয়। তিনি তাদেরও সাহায্য করেন না যারা তাঁর শরিয়তী আইনকে তাঁরই ভূমিতে নিষিদ্ধ করে কাফেরদের প্রণীত আইনকে বিজয়ী করে। অথচ সকল মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক ও জনগণই এ পাপে পাপী। ফলে এ বিদ্রোহ নিয়ে তারা কি মহান আল্লাহতায়ালার সাহায্য আশা করতে পারে? কোন রাজা কি তার বিদ্রোহী প্রজার কথা শুনেন? দয়াময় মহান আল্লাহতায়ালা কখনোই তাদেরকে সাহায্য করেন না যারা আল্লাহর অন্য বান্দাকে ঘৃনা করে, হত্যা করে ও ঘর-বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে শুধু এ জন্যই যে তাদের ভাষা, গায়ের রং এবং জন্মস্থান ভিন্ন। যে কুকর্মগুলো ১৯৭১’য়ে বাংলাদেশে বিহারীদের সাথে হয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার বিচারে এগুলো তো শাস্তিযোগ্য জঘন্য অপরাধ। অতএব এরূপ অপরাধীগণ কি তাঁর সাহায্য পেতে পারে? বরং তারা তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি হবে, দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হবে, ভোটডাকাতিতে ইতিহাস গড়বে, গুম-খুন-ধর্ষণে প্লাবন আনবে, দুর্বৃত্ত ভোটডাকাতকে মাননীয় বলতে জনগণকে বাধ্য করা হবে এবং পৃথিবীপৃষ্টে জাহান্নাম নির্মাণ করবে -সেটিই তো স্বাভাবিক।

মহান আল্লাহতায়ালা কাদের ভালবাসেন এবং সাহায্য করেন -সেটি কোন গোপন বিষয় নয়। পবিত্র কুর’আনে তাঁর ঘোষণা,

إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلَّذِينَ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِهِۦ صَفًّۭا كَأَنَّهُم بُنْيَـٰنٌۭ مَّرْصُوصٌۭ

অর্থ: “আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর রাস্তায় এমন ভাবে যুদ্ধ করে যেন তারা সিসাঢালা প্রাচীর।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৪)। নিছক নামাজ-রোজা, হজ্জ-যাকাত ও তাসবিহ-তাহলিলের মধ্য দিয়ে যারা মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন -এ আয়াতে তাদের জন্য রয়েছে বড়ই দুঃসংবাদ। মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হতে হলে অপরিহার্য হলো, আল্লাহতায়ালার পথে জিহাদ এবং সে জিহাদে সিসাঢালা প্রাচীরসম ঐক্য। ব্যক্তির জীবনে ইবাদত কতটুকু সফল -সেটির পরিমাপ দেয় তো এই জিহাদ এবং ঐক্য। তাই যে সমাজে জিহাদ এবং ঐক্য নাই -সে সমাজে ইবাদতের প্রক্রিয়া যে সঠিক ভাবে কাজ করছে না -সেটি কি প্রমাণের অপেক্ষা রাখে? সাহাবায়ে কেরাম তো জিহাদ ও ঐক্যের পথেই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হতে পেরেছিলেন।

সাহাবায়ে কেরাম মাত্র ৩০ বছরে যতগুলো জিহাদ করেছেন বাংলাদেশের ৮ শত বছরের মুসলিম ইতিহাসেও হয়নি। আর সিসাঢালা প্রাচীরসম ঐকের কথা? মুসলিমগণ ঐক্য না গড়ে গড়েছে বিভক্তির প্রাচীর। এ প্রাচীর পর্বতের চেয়েও দুর্গম। পর্বত অতিক্রম করা যায়, কিন্তু বিভক্তির এ প্রাচীর অতিক্রম করতে গেলে প্রতিবেশী মুসলিম দেশের সীমান্ত-প্রহরীর হাতে গুলীর খাদ্য হতে হয়। এ সীমাহীন বিভক্তি গড়ে উঠেছে ভাষা, গোত্র, বর্ণ ও পৃথক পৃথক ভূগোলের নামে। মুসলিম বিশ্বের এ ভৌগলিক বিভক্তি গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দাসদের হাতে। আরব বিশ্বে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের প্রবেশের আগে আরবগণ কি ২২ টুকরায় বিভক্ত ছিল? চিহ্নিত এ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ মুসলিম বিশ্বের এ বিভক্ত মানচিত্রের সবচেয়ে বড় পাহাড়াদারই শুধু নয় বরং ভয়ানক ভাবে ব্যস্ত কিভাবে আরো বিভক্ত করা যায় –তা নিয়ে। মুসলিম নাগরিকদের অপরাধ হলো, ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিভক্তিকে জীবিত রাখতে তারা শুধু রাজস্বই দেয় না, যুদ্ধ করে এবং প্রাণও দেয়। অথচ ইসলামের মৌল বিধান হলো, বিভক্তি গড়া যেমন হারাম, তেমনি হারাম হলো এ বিভক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে সে হারাম কাজই বেশী বেশী হচ্ছে। এ বিভক্তিকে স্থায়ী করতে প্রতি মুসলিম দেশে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল সেনা বাহিনী। কিন্তু এসব সেনা বাহিনীর হাতে মুসলিম উম্মাহর কোথায়ও কি কোন গৌরব বেড়েছে? প্রতিরক্ষা পাচ্ছে কি মুসলিমদের জানমাল ও ইজ্জত-আবরু? বাঁচছে কি স্বাধীনতা? বরং মুসলিম দেশ অধিকৃত হচ্ছে, জনগণ গোলামে পরিণত হচ্ছে এবং গুলীর খাদ্য হচ্ছে নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর হাতে। ঢাকার শাপলা চত্বরে শত শত মুসল্লী যাদের হাতে নিহত হলো তারা কি বিদেশী হানাদার?

প্রায় তিরিশ কোটি মানুষের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের কোন নিভৃত জংগলে মার্কিন নাগরিকের গায়ে পাথর ছুঁড়লেও তার বিচার নিশ্চিত করা হয়। কারণ, তারা ঐক্যবদ্ধ। অপরাধীদের আদালতে তোলার শক্তিও রয়েছে। কিন্ত একই বিশ্বে লাখে লাখে মুসলিম নিধন হলেও তার বিচার নেই। এর কারণ, মুসলিমদের শক্তিহীনতা, অনৈক্য এবং জিহাদে অনাগ্রহ। মার্কিনীরা বিশ্বের সর্বপ্রান্তে যুদ্ধে লিপ্ত; কিন্তু মুসলিমগণ অনাগ্রহী এমন কি নিজ দেশের প্রতিরক্ষাতেও। গরু-ছাগলের জন্মায় জবাই হওয়ার জন্য। তাদের মৃত্যুতে তাই বিচার নেই, মাতমও নেই। বিচার তো তারাই পায় -যারা সেটি আদায় করতে পারে। দেশে দেশে মুসলিম গণহত্যার বিচার না হওয়ার কারণ তো এই শক্তিহীনতা। ইসলামে তাই শক্তিহীন থাকাটি হারাম। নির্দেশ দেয়া হয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার এবং তা দিয়ে শত্রুকে সন্ত্রস্ত করার। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে নির্দেশ এসেছে সুরা আনফালের ৬০ নম্বর আয়াতে।

ভারতের গুজরাতে বহু হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হলো। অনেককে জীবন্ত আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মারা হলো। শত শত মুসলিম নারী ধর্ষিতা হলো। অথচ এ অপরাধে আজও কারো শাস্তি হলো না। ১৯৮৩ সালে আসামের নেলীতে ১৪ গ্রামের প্রায় ৫ থেকে ১০ হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হলো। কিন্তু কি বিস্ময়! এত বড় গণহত্যা হলো, কিন্তু সে অপরাধে একজনেরও কোন শাস্তি হলো না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির সরকার মুসলিম গণহত্যার নায়কদের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছেন যে, সে হত্যাকান্ডের কোন বিচার হবে না। একই রূপ অপরাধ হচ্ছে ইরাক, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, সিরিয়া, মায়ানমার ও আফগানিস্তানে। কিন্তু কোথাও কি এ অপরাধে কেউ কাঠগড়ায় উঠেছে? বরং গুজরাতের খুনি নরেন্দ্র মোদি এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তার পদসেবা দেয়াই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি। কাশ্মিরের গণহত্যার বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ সরকারের কোন প্রতিবাদ নাই। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আজ এক নিদারুন বিপন্নদশা।

অনৈক্য মহাপাপ; এ পাপ আর বহু পাপের দরজা খুলে দেয়। আর এ পাপই আজ মুসলিম জীবনে শক্তিহীনতা ও আযাব ডেকে এনেছে। আযাব থেকে মুক্তির জন্য সর্বপ্রথম পাপমোচন ঘটাতে হয়। এবং সে পাপমোচনের পথ হলো, অনৈক্য থেকে বাঁচা এবং আল্লাহর রশিকে (ইসলামকে) একতাবদ্ধ ভাবে আঁকড়ে ধরা। পবিত্র কুর’আনে আরো বলা হয়েছে,

فَٱسْتَمْسِكْ بِٱلَّذِىٓ أُوحِىَ إِلَيْكَ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ

অর্থ: “যারাই আঁকড়ে ধরলো আল্লাহকে তথা তাঁর কুর’আনকে -তারাই পেল সিরাতাল মুস্তাকিম।” –(সুরা জুখরাফ, আয়াত ৪৩)। এবং যারা পায় সিরাতাল মুস্তাকিম, তারাই তো পায় জান্নাত। দুনিয়ার বুকেও তাঁরা পায় বিজয় ও ইজ্জত। প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহতায়ালার সার্বভৌমত্ব, তাঁর ইজ্জত ও তাঁর আইনের বিজয় ও গৌরব বাড়াতে যারা কোন প্রচেষ্ঠাই করলো না –তাদেরকে কি তিনি পরকালে জান্নাত দিয়ে পুরস্কৃত করবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *